Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines




পরবাসে স্বপ্না মিত্রর
লেখা


ISSN 1563-8685




কাছের মানুষ

ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হওয়ার আধঘণ্টা আগে সূর্য পৌঁছে গেছে। রিসেপশনে জিজ্ঞাসা করতে ওরাই ওয়েটিং এরিয়া দেখিয়ে দিল। সূর্য এখন সেখানে বসে। নীল কুশনে মোড়া চেয়ার পর পর সারি দিয়ে রাখা। কোলকাতার এক নামীদামী হাসপাতালের অপেক্ষাঘর।

সাত দিন যাবৎ সূর্যর বাবা, অখিল বসু এই হাসপাতালে আছেন। গতসপ্তাহে তিয়াত্তর বছর বয়সে হঠাৎ অখিলবাবুর মেজর সেরিব্রাল, যায় যায় অবস্থা। মাঝরাতের প্যানিক টেলিফোন সূর্যর তরুণী স্ত্রী, শ্রী ধরেছিল। সারাদিন পরিশ্রমের পর সূর্য তখন ঘুমে কাদা। কিন্তু এমন একটা খবর! শ্রী কোন দ্বিধা করেনি। এক ধাক্কায় সূর্যকে কাঁচা ঘুমের মধ্যেই তুলে দেয়। ঘুম চোখে সূর্য কোনরকমে ফোন কানে ধরতেই ও প্রান্তে নন্দিনী, সূর্যর ছোট ভাই ঋষির স্ত্রীর থমথমে গলা,
দাদা, বাবা মনে হয় চলেই গেলেন।

শ্রী এতক্ষণে ঘরের সব আলো জ্বেলে দিয়েছে। রাত দুপুরে ক্যাটক্যাটে আলো, সাথে নন্দিনীর থমথমে মৃত্যুবাণ সূর্যর চোখ থেকে ঘুম নিয়ে নিমেষে উধাও। সে সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞাসা করে,
—মানে? কখন? কেমন করে?

—কাল বিকেল থেকেই বলছিলেন, শরীরটা জুতের লাগছে না। তবে তেমন কিছুই নয়। রাতে খাওয়ার পর আমার কাছে চেয়ে নিজেই দুটো অ্যানটাসিড খান। সকালেও নিয়মমতো বাথরুম গেছেন। দুপুরে খাওয়ার পর, এই হঠাৎ। কি ভাগ্যিস বাড়িতে ঝুমুর ছিল, নাহলে কি যে হতো! ঝুমুর শুনতে পায়, দাদুর ঘর থেকে কেমন ধারা আওয়াজ, গিয়ে দেখে গাঁজলা বেরোচ্ছে, মুখ এক পাশে বেঁকে বীভৎস ব্যাপার।

সূর্য আর শুনতে পারে না। সে নন্দিনী কে চুপ করাতে তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করে,
—এখন? এখন কেমন? কোথায় নিয়ে যাওয়া হোলো? ঋষি কোথায়?

—ঋষি তো বাবার পাশে। ঝুমুর ফোন করার সাথেসাথেই ঋষি দৌড়ে চলে এসেছে। তাড়াতাড়ি এ্যাম্বুলেন্স ডেকেছে। পাড়ার ছেলেদের সাহায্যে বাবাকে গাড়িতে তুলে ওরা হাসপাতালের জন্য রওনা হয়েছে।

সূর্য আর নন্দিনীর সাথে কথা বাড়ায়নি। সে সোজা ফোন করে ঋষির মোবাইলে। ঋষির গলা দিশেহারা,
—খবর পেয়েছিস? নন্দিনী ফোন করেছিল?

—হ্যাঁ, খবর পেয়েছি। তাইতো ফোন করছি। কি অবস্থা?

—অবস্থা খুবই সিরিয়াস। পালস আছে এখনও। তবে তাড়াতাড়ি হাসপাতাল পৌঁছনো দরকার।

—কত দূর তোরা?

—বীভৎস জ্যাম রে দাদা। গাড়ি এগোচ্ছেই না। এক সাথে দু-দুটো মিছিল।

—কোন রুট নিয়েছিস? শোন, মেইন রোড ধরিস না। ব্রিজে না উঠে, ব্রিজের পাশ দিয়ে নিচে নেমে বাঁ দিকে ঘুরে, হ্যালো হ্যালো, ঋষি শুনতে পাচ্ছিস?

সূর্যর কথার মাঝেই ও প্রান্তে পিঁপিঁ, অর্থাৎ দূরভাষ সংযোগ কেটে গেছে। সূর্য আবার রিং করে। লাইন ব্যস্ত, অটোমেটেড মেসেজ একটু অপেক্ষা করে ফোন করার পরামর্শ দিচ্ছে।


এতক্ষণে শ্রী দু-কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম কফি নিয়ে এসেছে। এইজন্য, এইজন্যই শ্রী মায়ের অতি প্রিয় ছিল। শ্রী যেন সূর্যর মনের কথা শুনতে পায়, প্রয়োজন পড়তে পারে। এই মুহূর্তে সত্যিই তার এক কাপ ব্ল্যাক কফির বড় দরকার ছিল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে সূর্য অসহায় চোখে শ্রীর দিকে তাকায়। সূর্য কিছু বলার আগেই শ্রী প্রশ্ন করে,
—কি করবে? তুমি কি যাবে?

—বলো তো শ্রী, কি করি এখন? এত দূর থেকে এতটা পথ! যাবো বললেই কি যাওয়া যায়! এদিকে নন্দিনী বাবা চলে গেলেন, এই হয়তো শেষ দেখা কত সব অশ্লীল শব্দ কানের পাশে একনাগাড়ে বলে গেল।

—অশ্লীল? অশ্লীল কেন?

—নন্দিনীর কথাগুলো যে কানে হুল ফোটায়। আজ এত বছরেও নন্দিনী বোঝে না এই দূরত্ব আমাদের জন্য কি বিরাট বোঝা, কি ভীষণ দায়। সময়ে অসময়ে, কারণে অকারণে নন্দিনী শুনিয়ে দেয়, ঋষি প্রতিদিন বাবার সাথে, সুখে দুখে ঋষি বাবার পাশে। গত কুড়ি বছর ধরে আমি ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি, যদি হঠাৎ কিছু হয়, যদি শেষ সময়ে মা-বাবার পাশে না থাকতে পারি। আজ হয়তো সত্যি তাই হতে চলেছে।

—সূর্য, এ তোমার অহেতুক আত্মগ্লানি, শুধু শুধু নিজেকে দোষারোপ। বিদেশে আসার পরিকল্পনা তোমার একার ছিল না। এ ছিল যুগ্ম সিদ্ধান্ত, তোমার এবং পরিবারের।

—তবু, তবু ওদেশ ছেড়ে চলে আসার পর প্রথম প্রথম ভেতরে কুঁকড়ে থাকতাম। বাবা-মার পাশে না থাকার অপরাধবোধ, ঋষির প্রতি অযথা কৃতজ্ঞতা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেত।

—সূর্য, তুমি বাবা-মার দুঃখের সাথী, প্রয়োজনের কল্পতরু। ছোড়দা এ্যাম্বুলেন্স ডেকে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। এইবার হাসপাতাল বিলের পেমেন্ট করবে কে? পেমেন্ট হবে তো তোমার অ্যাকাউন্ট থেকে। সে তো কালো টাকা নয়, শ্রমের উপার্জন। তাহলে? কোন দিকে বেশি ঝুঁকবে দাঁড়িপাল্লা?

সূর্য জানে শ্রীর কথার একশো ভাগ সত্যি। তবু সে ঋষিকে ব্যস্ত হয়ে ফোন করে, ডাক্তারের ফোন নম্বর নেয় বাবার বর্তমান অবস্থা বিশদভাবে আলোচনা করার জন্য। ডঃ সান্যাল ফোনে সূর্যকে বলেন, মিঃ বসু, টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্স ইজ দ্য ম্যাজিক বাউন্ডারি। এর মধ্যে যদি জ্ঞান ফিরে আসে, আপনার বাবা এযাত্রা বেঁচে গেলেন। অন্যথায় চিন্তার বিষয়। এই চিন্তার বিষয় শব্দবন্ধই সূর্যকে চিন্তায় ফেলে দেয়। সে টিকিট কাটে, কোলকাতার।


কোলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে সূর্য সোজা চলে এসেছে হাসপাতালে। ঋষিরও পৌঁছনোর কথা। ভিজিটিং আওয়ার্সে রোজই দু-চারজন অর্থাৎ পিসি, কাকা, তুতো ভাইবোন, বাবার বন্ধুদের কেউ না কেউ আসছেন। তবে রুগীর সাথে দেখা করা বারণ। দরজার বাইরে থেকে দেখে নেওয়া কাঁচের দরজার ওপাশে অখিলবাবু বেঁচেবর্তে আছেন। প্রথম তিনদিন অখিলবাবুকে আইসিইউতে রেখেছিল। আজ চারদিন হোলো বেডে দিয়েছে। গতকাল থেকে রুগীর সাথে ভিজিটরদের দেখা করার অনুমতি মিলেছে।

চব্বিশ ঘণ্টা পূর্ণ হওয়ার সামান্য আগে অখিলবাবুর জ্ঞান ফেরে। শুরু হয় চিকিৎসা। ডঃ সান্যালের কথা মতো ধীরে ধীরে উনি ভালোও হয়ে ওঠেন। তবে শরীরে সুস্থ হয়ে উঠলেও অখিলবাবুর স্মৃতির ভাণ্ডারে টানাটানি পড়েছে। শর্টটার্ম মেমরি লস। কিছুই মনে রাখতে পারছেন না। কি বললেন, কি করলেন, কি খেলেন সব ভুলে যাচ্ছেন। এমন কি চেনা মানুষদের চিনতে অবধি পারছেন না।

সূর্যর চোখ পড়ে এনট্রান্সের দিকে। ছোটপিসি না?

কি মোটাই হয়েছে পিসি! আজ আট–ন বছর হলো পিসির সাথে দেখা হয়নি। যতদিন মা বেঁচেছিলেন, সূর্য দেশে এলে, নিয়ম করে সবাইকে একদিন মা খেতে ডাকতেন। সারাদিন ধরে চলতো হাহাহিহি, আড্ডা, খাওয়া দাওয়া। সূর্যর বড় সুবিধে হতো। জনে জনে দেখা করার ঝক্কি ছাড়াই একছাদের নীচে দেখা সাক্ষাতের কাজ হয়ে যেত। আত্মীয়স্বজনের সান্নিধ্যে সে অনায়াসে ঘ্রাণ নিত ছেলেবেলার, পুরোনো সম্পর্কদের ফিরে পেত হাতের মুঠোয়। আজকাল আর কারও সাথেই দেখা হয় না। কোলকাতায় এলে নিজের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি করেই ছুটি শেষ, ফেরার ঘণ্টা বাজতে থাকে।

কিন্তু পিসি এদিকে আসছে না কেন?

পিসি কি সূর্যকে দেখতে পায়নি না চিনতে পারছে না?

অবশ্য আগের থেকে সূর্য অনেক মোটা হয়েছে। তবু, পিসি সূর্যকে চিনতে পারবে না এ কেমন কথা!

লম্বা লম্বা পা ফেলে সূর্য নিজেই পিসির দিকে এগিয়ে যায়। সে নিচু হয়ে প্রণাম করতে উদ্যত হতেই পিসির চশমা পরা চোখে পরিচিতির আলো, ওমা, সূর্য না? তাই বলি, যেন চেনা মুখ! কবে এলি? আজকাল পিসিকে তো মনেই পড়ে না, খোঁজও রাখিস না। তার ওপর সাহেবদের দেশে থেকে চেহারাটাও খাসা সাহেবী বানিয়েছিস।

কথা বলতে বলতে পিসি সামনের চেয়ারে বসে পড়েছে। পাশের চেয়ার ইঙ্গিতে দেখিয়ে সূর্যকেও বসতে বলে। সূর্য বসে, তার মুখে ফুটে ওঠে স্মিত হাসি।

পিসি বলে, দাদার কাছে শুনেছি নিউজার্সিতে বিরাট বাড়ি বানিয়েছিস। তা বৌ এসেছে না কি? আমাদের নাতি?

পিসির প্রশ্নে সূর্যর হাসি গুটিয়ে যায়। সে বলে, না পিসি, আমি একা এসেছি, আজ এইমাত্র, একদম হঠাৎ কিনা, সবাইকে নিয়ে আসতে পারিনি।

ভাবলেশহীন মুখে পিসি বলে, তা আমি বুঝি বাপু। অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয় বৈকি। তার পর সামান্য ভুরু কুঁচকে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করে, কত খরচ পড়ছে?

সূর্য উত্তর দেবার আগেই পিসি যোগ করে, এই আমাকে দ্যাখ না। হাঁটুর পুরো যায় যায় অবস্থা। কি যে যন্ত্রণা! ছ-মাস হোলো ডাক্তার অপারেশন করতে বলেছে। অপারেশনের পয়সা বুল্টি আর জোগাড় করে উঠতে পারছে না, হাঁটুও সারছে না, উঠতে বসতে ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছি। সেদিক থেকে দাদা সত্যিই ভাগ্যবান। এত বড় হাসপাতালে, এত পয়সা খরচা করে ছেলেরা চিকিৎসা করাচ্ছে।

ছেলেরা? হোঁচট খায় সূর্য।

এ্যাম্বুলেন্স ডাকা থেকে শুরু করে, ডাক্তার, অপারেশন, কেবিন, এমনকি আয়ার টিপসটুকুও যোগ করে নন্দিনী বিল ধরাবে সূর্যকে। কোলকাতার বাড়িতে একটা অলিখিত নিয়ম তৈরি হয়েছে। যেহেতু বাবা ঋষিদের সাথে বারোমাস থাকে, বাবার প্রতিদিনের ঝক্কি ঋষির পরিবার পোহায়, বাবার যাবতীয় খরচের দায়িত্ব সূর্যর। বাবার প্রয়োজনের নাম করে এ সংসারের বাড়তি চাহিদাও নন্দিনী আজকাল সূর্যর ঘাড় দিয়ে মেটায়।

পিসির কথায় সূর্য কোন প্রতিবাদ করে না। মনে পড়ে শ্রীর কমেন্ট।

শ্রী অনেকবার বলেছে, তুমি যেন কোলকাতার বাড়ির কল্পতরু। কোনরকম প্রয়োজন পড়লেই তোমাকে ওদের মনে পড়ে। এমনিতে তো দিব্যি নিজেদের নিয়ে থাকে!

সূর্য হেসেছে। বলেছে, কি করবে বলো? ঋষির আর ক-টাকা রোজগার?

শ্রী বলে, প্রশ্নটা শুধু টাকা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে গ্রেটফুলনেস, অ্যাপ্রিসিয়েশন, সেন্স অফ রেসপেক্ট। তুমি যতই টাকা পাঠাও, বাবা সারাক্ষণ নন্দিনী নন্দিনী করে অস্থির।

সূর্যর এইবার হাসি পায়। বোঝে, প্রতিযোগিতাটা নন্দিনীর সঙ্গে। বাবাকে কে বেশি ভালোবাসে, কে বেশি কর্তব্য করে, কে বেশি কাছের, ঋষি না সূর্য? বাবার সারাক্ষণ নন্দিনী-আখ্যানে শ্রীর অহমবোধে ছেদ পড়ে, আঘাত লাগে। সূর্যর মায়া হয় শ্রীর জন্য। একই সাথে আত্মতৃপ্তি চারিয়ে যায় বুকের ভেতর।

সূর্য নিশ্চিত, সে চিরকালই বাবার কাছে একনম্বরে ছিল এবং থাকবে।


রেডি, স্টেডি, অন ইওর মার্ক, দৌড় দৌড় দৌড়। সূর্য দৌড়চ্ছে, তীরগতিতে। কচি হাতের পাঁচ আঙুল ছুঁয়ে ফেললো, সবার প্রথমে, লাল ফিতে, দ্য ফিনিশিং লাইন। ফিনিশিং লাইনের পাশে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে তরুণ অখিলবাবু, দুহাত বাড়িয়ে সূর্যকে কোলে তুলে নিচ্ছে। কিছুই নয়, ছেলেমানুষদের কমলালেবু রেস। তবু। বাবার কোলে চড়ে, বাবার বুকের ওঠা পড়ায় সূর্য টের পায় উদগ্রীবতা, ফলাফলের।

অঙ্কন প্রতিযোগিতা। সূর্যর ড্রয়িং পাতায় রঙয়ের খেলা, নিটোল সূর্যাস্তের ছবি, যেমনটি সে রোজ দেখে দক্ষিণের ঝুলবারান্দা থেকে, শহরের আটচালা, একতলা, দোতলা, তিনতলা বাড়িগুলোর উঁচু নিচু ছাদের সীমানায়। লাউড স্পীকারে গমগমিয়ে বেজে ওঠে, ‘ক’ বিভাগে সূর্য বসু, অ্যানাউন্স শেষ হয় না, সূর্যর পিঠে আলতো চাপ, উদগ্রীবতার, বাবার হাতের।

খেলার মাঠ থেকে ড্রয়িং কম্পিটিশন, ড্রয়িং কম্পিটিশন থেকে স্কুল কলেজের পরীক্ষা, পরীক্ষা শেষে জীবিকা, বিবাহ, বিদেশযাত্রা। সর্বত্রই পাঁচজনের থেকে সূর্য এগিয়ে, অখিলবাবুর ইচ্ছের মাঠ পেরিয়ে দূরে, আরও অনেক দূরে। সূর্য ছিল অখিলবাবুর যৌবনের আনন্দ, প্রৌঢ় বয়সের গৌরব।

বছর পাঁচেক আগের কথা। শ্রীর দাদার ছেলের রেজাল্ট বেরিয়েছে, আইসিএসই বোর্ড, আটটি বিষয়ে লেটার।

খবর শুনে অখিলবাবুর মন্তব্য, আইসিএসই বোর্ডে আটটায় লেটার? দশটা হলে বুঝতাম। রেজাল্ট করেছিল আমাদের সূর্য, ওয়েস্টবেঙ্গল বোর্ডের মাধ্যমিক পরীক্ষায় ছ-টা লেটার!

দুবছর আগে ছোটকাকার মেয়ের বিয়ে হোলো। এই বয়সেই জামাই নামকরা কোম্পানিতে একটি বিভাগের প্রধান। বিয়েবাড়িতে অখিলবাবু পান চিবুতে চিবুতে বললেন, ছেলে ম্যানেজারের অ্যাসিসট্যান্ট? এ বয়সে সূর্য তো ম্যানেজার হয়ে পরের প্রোমোশনের জন্য ছুটছে!


ঐ যে নীলুজেঠু। নীলুজেঠু দূর থেকে সূর্যকে দেখতে পেয়েছে। জেঠুর অবশ্য সূর্যকে চিনতে না পারার কোন কারণ নেই। কোলকাতায় এলে জেঠুর সাথে সূর্যর যে অবশ্যই দেখা হয়। নীলুজেঠু হলো সূর্যদের পাশের জমির প্রতিবেশী, আনন্দবাজারের খবর নিয়ে বাবার প্রতিদিন তর্ক করার প্রতিপক্ষ। সূর্যকে দেখতে পেয়েও জেঠু এদিকে এলো না, ডানদিকে ঘুরে গেল। মনে প্রশ্ন নিয়ে নীলুজেঠুকে খোঁজার জন্য এদিক ওদিক দেখার মাঝে তিমিরদা, বড়পিসির বড় ছেলে।

তিমিরদা এসে জিজ্ঞাসা করলো, কিরে সূর্য, কি খবর? তার পর উত্তরের অপেক্ষা না করেই আলাপ জুড়লো ছোটপিসির সাথে, বিষয় হাঁটু। হাঁটুর আলোচনার মাঝে হঠাৎ কি যেন মনে পড়ে যাওয়ায় তিমিরদা আবার সূর্যকে প্রশ্ন করে, হ্যাঁ রে, শ্রীর কি খবর? তোর বৌদি শ্রীকে ফেসবুক ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। তা শ্রী বুঝি অ্যাকসেপ্ট করেনি। তাই ভাবলাম শ্রীর শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক আছে তো?

এই ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্টের কথা সূর্য জানে, শ্রী জানিয়েছিল। ইনফ্যাক্ট, সূর্যের পরামর্শেই দেশের আম আত্মীয়স্বজনের ফেসবুক ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট শ্রী অ্যাকসেপ্ট করে না।

সূর্য এবার টানটান, মুখে মেটালিক হাসি। বলে, সত্যি এই ফেসবুক এক হয়েছে বটে। পুরো ননসেন্স।

সূর্যর কথার উত্তরে তিমিরদা কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ছোটপিসি বলে ওঠে, এই তো, ঋষি এসে গেছে।

ঋষি হেঁটে এদিকে পৌঁছনোর আগেই তিমিরদা ঋষির দিকে এগিয়ে গেল। ডানদিক থেকে ধূমকেতুর মত উদয় হলো নীলুজেঠু। এখন সেও ঋষির পাশে। পিসির পায়ে ব্যথা, সে চেয়ার ছেড়ে হড়বড়িয়ে এগোতে পারছে না। সূর্যও উঠলো না। সে যাবে না, ঋষি আসবে সূর্যর কাছে। সূর্য তো এসেছে, সাতসমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে, প্রিয়জনের কাছে। বাকি পথটুকু ঋষি হাঁটুক।

ঋষির সাথে সূর্যর কোনদিনই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। বরং চিত্রটা ছিল উল্টো। সূর্যকে উদাহরণ রেখে সকাল বিকেল ঋষি বকুনি খেত, বিশেষত বাবার কাছে। বকুনি খেতে খেতে নিজেকে সূর্যতে উত্তরণের পরিবর্তে ঋষি বুঝি মেনে নিয়েছিল সূর্যর মাহাত্ম্য। ঋষি জানতো, দাদা মানেই প্রথম, বাবার শেষ উদাহরণ, ঋষির পক্ষে যে মাইলস্টোন স্পর্শ করা অসম্ভব।

সূর্যর জেদ মতো ঋষি এগিয়েই এলো। সাথে সাথে নীলুজেঠু, তিমিরদা।

ঋষি বললো, দাদা, ডাক্তারের সাথে দেখা করবি তো?

সূর্য বলে, নিশ্চয়ই। তার আগে বাবার সাথে একবার দেখা করে আসি।

--বাবা তো উল্টোপাল্টা কথা বলছে, কারোকে চিনতে পারছে না।

ঋষির কথায় সূর্যকে চিন্তিত দেখায়। সে বলে, তবু একবার দেখেই আসি।

এতক্ষনে নীলুজেঠু মুখ খোলে। জেঠু বলে, সত্যি কি কাণ্ড বলো তো! অখিল আমাদেরকে চিনতে পারছে না। নিজের অবস্থাও বুঝছে না। অখিল ভাবছে, এখানকার লোকজন ওকে জোর করে ধরে রেখেছে।

ছোটপিসি বলে, ঠিক তাই। গতকাল দাদার পাশে যেতে, দাদা গোল গোল চোখ করে ধমকে উঠলো, কে? যাও এখান থেকে। সব ষড় করে আমাকে বেঁধে রেখেছে।

সূর্য অবাক হয়। বেঁধে, বেঁধে কেন?

ঋষি বলে, ঐ যে ইসিজির একশো খানা তার, চব্বিশঘণ্টা শরীরে লাগানো, সেগুলোকেই দড়িদড়া ভাবছে বোধহয়।

ডাক্তারের সাথে কথা বলে, বাবাকে চোখের দেখা দেখে, ওরা এখন বাড়ি ফিরছে। সাথে নীলুজেঠু। নীলুজেঠুর একমাত্র মেয়ে জাপানে থাকে। জাপানের বাড়ি আয়তনে ছোট হয় সে খবর সারা পৃথিবী জানে। তবু অখিলবাবু ছাড়ে না। জেঠু বড় মুখ করে মেয়ের ছবির মত ঘরদোর বাগানের গল্প করলেই বাবা নিউজার্সিতে সূর্যর প্রাসাদোপম অট্টালিকার ছবি বার করে দেখায়। জেঠুর গল্প মাঝপথে থেমে যায়। এইসব তুলনামূলক আলোচনার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই সূর্যর প্রতি জেঠুর স্নেহে ঘাটতি পড়ে, ব্যবহারে প্রকাশ পায়।

তাই এই মুহূর্তে গাড়িতে সূর্য একদম একা। সে চুপচাপ পিছনের সিটে বসে। সূর্যর পাশ থেকে নীলুজেঠুর যত কথা সামনের সিটের ঋষির সাথে। সেরিব্রালের সময় ঠিক কি হয়েছিল, হাসপাতাল পৌঁছতে কেন দেরি হলো, আইসিইউ তে তিনদিন রাখা যুক্তিসঙ্গত কিনা, সেরিব্রালের পর মেমরি লসের গুরুত্ব, এইসব টুকরো-টাকরা বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনা।

নীলুজেঠু, ঋষির সাথে স্থানীয় ড্রাইভার ছেলেটি অমরও মাঝে মাঝে যোগ দিচ্ছে, গত সপ্তাহেই তো দাদুকে দেখলাম। দিব্যি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, হাতে বাজারের থলে।

শুধু সূর্যর কিছু বলার নেই। সে তো এখানে ছিল না। সেরিব্রালের মাহেন্দ্রক্ষণে সে ছিল দূর দেশে, অ্যামেরিকায়। বিলাসে ও বৈভবে, রাজার মত আরামে। সেটা তার দোষ, চরম অপরাধ। তবু ডাক পড়েছে, দেশ থেকে বিদেশে। সে এসেছে অতিথি হয়ে, টাকার অ্যাটাচিসহ। ঐ অ্যাটাচিটাই এদের প্রয়োজন, ঐখানেই আজ তার ভূমিকা সীমাবদ্ধ।

সূর্য নড়ে বসে। কিসব পাতি মধ্যবিত্ত ভাবনা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে? বাবা আছে তো! সে তো এসেছে বাবার জন্য, শুধু বাবার জন্যই।

সূর্য তার স্বাভাবিক আত্মবিশ্বাস ভরা গলায় জিজ্ঞাসা করে, অমর, আর কতক্ষণ?

অমর নামে ছেলেটি ঘুরে তাকায়। বলে, পনেরো মিনিট দাদা।

বাড়িতে ঢুকতেই ডোডো ছুটে এসেছে, সাথে ঝুমুরও। সূর্য একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তাড়াহুড়োয় এইবার কোন উপহার আনা হয়নি। প্রতিবার আনে, সুটকেস বোঝাই করে। ডোডো, ঝুমুর এমনকি নন্দিনীর জন্যেও। সূর্য হাসিহাসি মুখে ডোডোর পিঠে চাপড় দিয়ে বলে, কাল নিয়ে আসবো, বড় চকোলেটের বাক্স, তোর আর দিদির জন্য। রান্নাঘর থেকে নন্দিনীও এসে দাঁড়ায়। পড়া ছেড়ে ওঠার জন্য ডোডোকে মৃদু বকুনি দেয়। ঝুমুর চলে যায়, অনিচ্ছা মাখা পায়ে ডোডোও ধীরে ধীরে দিদিকে অনুসরণ করে। সুটকেস খুলে টাওয়েল বার করে সূর্য, টয়লেটে ঢোকে, শাওয়ার নিতে।

এই বাড়িটা অখিলবাবুর নিজের তৈরি, পৈতৃক নয়। রিটায়ারমেন্টের পর গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট-ফাণ্ডের সবটুকু পয়সা ঢেলে পাঁচ কাঠা জমির ওপর এই ছিমছাম বাড়িটা অখিলবাবু বানান, স্ত্রী মৃন্ময়ীর জন্য। নতুন বাড়িতে এসে মৃন্ময়ী খুব খুশি। এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সূর্য তখন সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে। চাকরির পাশাপাশি নিয়মিত রাত জেগে চলছে জিম্যাটের প্রিপারেশন।

মৃন্ময়ীর খুশিতে বাদ সাধলেন মৃন্ময়ীদের নতুন প্রতিবেশী, তার মেয়ে নন্দিনী। সূর্যদের বাড়ির সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা সোজা বাসরাস্তায় মিশে গেছে, সেই রাস্তার ওপর শেষ বাড়িটা ছিল নন্দিনীদের। নন্দিনীর গায়ের রং শ্যামলা, উচ্চতায় খাটো, তবে মুখখানা যেন মা দুর্গা। ঐ মা দুর্গা মার্কা মুখখানাই হয়তো ঋষিকে টেনে ছিল। গায়ের রং, উচ্চতা কোন কিছুই মৃন্ময়ীর অখুশির কারণ ছিল না। মায়ের আপত্তির আসল কারণ ছিল বয়স। পাড়ার কোন এক পুরোনো বাসিন্দার সুত্রে মৃন্ময়ী ততদিনে জেনে গেছেন, নন্দিনী হোলো গুণে গুণে ঋষির থেকে পনেরো দিনের বড়। বরের থেকে কনে বড়, ছিঃ!

নন্দিনীর খবর শুনে মৃন্ময়ীতো একরকম, অখিলবাবু ধরলেন চণ্ডালমূর্তি।

প্রেম? তাও সমবয়সী পাড়ার মেয়ে? একুশ বছর বয়স, এই তো জীবন গড়ার সময়। দ্যাখো তো সূর্যকে, একই মা-বাবার সন্তান, একজন শিব তো অন্যজন বাঁদর!

সূর্যর কিন্তু রাগ হয় না। বরং মজা লাগে। এই প্রথম, এই এক জায়গায়, প্রেমে ঋষি এগিয়ে গেল, সূর্যর থেকে। মৃন্ময়ীর অখুশি, অখিলবাবুর চণ্ডাল রাগ নস্যাৎ করে গড়গড়িয়ে চলতে লাগলো ঋষি নন্দিনীর প্রেম। সমবয়সী প্রেম, মেয়ের বয়স বেড়ে যাচ্ছে, স্বভাবতই নন্দিনীর বাবা বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বিয়ে হোলো, রেজিস্ট্রি করে। জাঁকজমকের মধ্য দিয়ে নয়। ঋষি নন্দিনীর বিয়েতে ভরসা ছিল ঋষির বাঁধাধরা চারটে টিউশনি আর নন্দিনীর সদ্য পাওয়া মন্টেসরী স্কুলের চাকরি।

ঋষির বিয়ের শোক অখিলবাবু সুদে আসলে মিটিয়েছিলেন সূর্যর বিয়েতে। ছেলে এঞ্জিনিয়র, বিদেশে থাকে, মোটা মাইনের চাকরি। ইংরিজী বাংলা নির্বিশেষে সমস্ত পত্রিকায় অখিলবাবু বিজ্ঞাপন দেন। শয়ে শয়ে চিঠি আসে। নির্মম হাতে একাধারে তিনি ফটো বাতিল করেন। বহু ঝাড়াইবাছাইয়ের পর অবশেষে নির্বাচিত হয় শ্রী। বড়লোকের মেয়ে, সুন্দরী, পড়াশোনায় ফ্যালনা নয়। তবে এক জায়গাতেই সূর্য আপত্তি করে, বয়স। সূর্যর থেকে শ্রী প্রায় দশ বছরের ছোট। মৃন্ময়ী এবং শ্বশুরের ইচ্ছের সামনে সূর্য শেষ অবধি হার মানে।

ফাল্গুন মাসে অর্থাৎ বসন্ত যখন বিকশিত মল্লিকা কুঞ্জে পলাশের বনে, কোকিলের অবিরত কুহু ডাকে কর্ণকুহর ঝালাপালা, দখিনাপবন শুধু শুধুই ঘুরিয়া বেড়ায় এ দ্বার থেকে ও দ্বার, এমনই এক মধু মাসের শুভ দিনে সূর্যর বিয়ে হয় শ্রীর সাথে, দেওয়া থোওয়া ও ধূমধামের মধ্য দিয়ে। মৃন্ময়ীর জন্য আসে দামী গরদ, নন্দিনীর বেনারসী ও একজোড়া দুল, অখিলবাবুর ধাক্কাপাড় ধুতি এবং গরদের পাঞ্জাবী আর ঋষির জীবনের প্রথম ও শেষ স্যুট। রাতারাতি পুত্রবধূর মান ও গুণের বিচারে শ্রী উঠে যায় এক নম্বরে, নন্দিনী হয়ে পড়ে দ্বিতীয়। ছোটবেলা থেকে এই দ্বিতীয় স্থানের সাথে ঋষি এতটাই অভ্যস্ত যে এক্ষেত্রেও তার কোনরকম হেলদোল হয় না। তবে নন্দিনী অন্য বাড়ির মেয়ে। তার হয়তো গায়ে লাগে, অভিমান হয়। সূর্য অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাবা মার প্রশ্রয়ে, সুন্দরী তরুণী স্ত্রীর সাহচর্যে বসন্ত তার জীবনে বারো মাস বাসা বাঁধে। প্রকৃত অর্থেই সে একজন সুখী পুরুষ।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভিজে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে সূর্য সাতপাঁচ ভাবছিল।

ফিরে যেতে হবে। খুব বেশি হলে সাত দিন। সেদিন ফোনে ডঃ সান্যাল এমন চিন্তা ঢুকিয়ে দিলেন! যাক এযাত্রা ফাঁড়া কেটে গেছে। বাবা ভালো হয়ে উঠছেন। একটা মোটা অংকের টেন্ডারের কাজ পড়ে আছে। ওখানে শ্রী আর জয়ও তো একদম একা। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।

চুল আঁচড়ানো শেষ করে সূর্য ল্যাপটপ অন করে। স্ক্রিনে অফিসিয়াল মেল দেখার মাঝে নন্দিনীর ডাক, দাদা, খেতে এসো।

পরদিন বিকেলবেলা ভিজিটিং আওয়ার্সে আবার হাসপাতাল। আজ সূর্যর গাড়িতে ঋষি আর নীলুজেঠুও এসেছে। বাকিদের মধ্যে আছে বড়পিসি, ছোটকাকা, ছোটোমেসো, ছোটপিসির মেয়ে পম্পি আর পম্পির সাত বছরের ছেলে গোলু। গতকাল বাবার সাথে দেখা হয়নি। ডাক্তারের সাথে দেখা করে ওরা যখন কেবিনে পৌঁছয়, অখিলবাবু তখন ঘুমোচ্ছেন। আয়া মেয়েটি নার্সকে জিজ্ঞাসা করে, নার্স মহিলা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে মানা করে। অগত্যা ওরা ভিজিটিং আওয়ার্সে ঘুমন্ত অখিলবাবুকে দেখে ফিরে আসে। আজ তাই ঠিক হয়েছে, প্রথমে রুগীর সাথে সাক্ষাৎ তার পর ডাক্তারের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলাপ আলোচনা।

সবাই মিলে ওরা চলে এলো অখিলবাবুর ঘরে। আজ অখিলবাবু জেগে আছেন। অবশ্য অখিলবাবুর সাথে দেখা করতে আসা অর্থহীন। তিনি আপন খেয়ালে কথা বলে চলেছেন, বেশিরভাগই বহু পুরোনো দিনের। চোখে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি, সবাইকে দেখছেন আবার কিছুই যেন দেখছেন না। এক মুখ থেকে আর এক মুখে দৃষ্টি সরে সরে যাচ্ছে। অখিলবাবুর বেডের চারিধারে ওরা সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। শুধু ঘরের কোণের সোফায় গোলু পা তুলে বসে পড়েছে। অখিলবাবুর সারা শরীরে অজস্র ইসিজির তার। চব্বিশঘণ্টা ওনার হৃদয়ের কম্পন রেকর্ড হয়ে চলেছে। বেডের পাশে টেবিল। টেবিলে জলের জাগ, গ্লাস।

নীরবতা কাটাতেই আয়া মেয়েটি হয়তো কথা বলে ওঠে, গতকাল সকাল পর্যন্ত দাদুর ডিপ চলেছে। এই যে বাঁ হাতে নীল দাগ দেখছো, এ হোলো ডিপের ছুঁচের দাগ। আজ আমি সকাল সকাল দাদুকে চান করিয়েছি। তাই তো দুপুরে আরামে ঘুমোলো। ঘুম থেকে উঠে আজ এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুটও খেয়েছে।

আয়া মেয়েটির একতরফা বকবকানির মাঝে হঠাৎ ডঃ সান্যাল হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে এলেন, সাথে দুজন সহকারী, তারমধ্যে একজন বোধহয় মেডিক্যাল ইন্টার্ন। ঘরে ঢুকে সূর্যদের দিকে একঝলক দৃষ্টিপাত করে ডঃ সান্যাল মন দেন রুগীর প্রতি। সহকারী ডাক্তার অখিলবাবুর বুকে স্টেথো লাগিয়ে মাপজোক করেন। ডঃ সান্যাল এগিয়ে যান ইসিজি মনিটরের দিকে, সাথে ইন্টার্নও। ডাক্তারি পরিভাষায় ডঃ সান্যাল ইন্টার্নটিকে অনেক কিছু বোঝান, সেও মন দিয়ে হাতের খাতায় লম্বা নোট নেয়। সহকারী দুজনকে সাথে নিয়ে ডঃ সান্যাল বেরিয়েই যাচ্ছিলেন, কি মনে হতে দরজা থেকে একা ফিরে এলেন।

অখিলবাবুর উদ্দেশ্যে ডঃ সান্যালের গমগমে স্বর বেজে ওঠে, মিঃ বসু, আগের থেকে আপনি অনেক ভালো আছেন, প্রায় সেরে উঠেছেন বলা যায়। দেখুন তো, এনাদের চিনতে পারেন কিনা? ডাক্তারের আঙুল তীর চিহ্ন হয়ে সরে যায় বড়পিসির থেকে ছোটকাকা, ছোটকাকার থেকে সূর্য, সূর্যর থেকে ছোটমেসো, তারপর নীলুজেঠু, পম্পি।

অখিলবাবুর চোখে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি, ডঃ সান্যালের গলায় বুঝি হতাশা।

গোলুকে সাথে নিয়ে ঋষি বাইরে গিয়েছিল, বোধহয় বাথরুমে। ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা ঠেলে ঋষি ভেতরে ঢোকে। ডঃ সান্যালের অসমাপ্ত বাক্যের মাঝে ঋষি এগিয়ে যায়, অখিলবাবুর বেডের পাশে। অখিলবাবুর স্মৃতির ছানিতে বুঝি চিড় ধরে, ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে ঈষৎ আলো, তিনি হাত তুলে ঋষিকে দেখান, ঋজু গলায় ডাক্তারকে বলেন, আমার ছেলে।

ডঃ সান্যালের মুখে আনন্দ ঠিকরে ওঠে। তিনি বলেন, এইতো, এইতো নার্ভের ওষুধ কাজ শুরু করেছে। এমনটাই আশা করেছিলাম। কথার মাঝে ডঃ সান্যাল আবার তর্জনী ওঠান, তীর চিহ্ন করে ঘোরান এক মুখ থেকে অন্য মুখে। উত্তেজিত গলায় বলেন, দেখুন তো মিঃ বোস, ভালো করে দেখুন, চিনতে পারছেন?

অখিলবাবুর চোখে আবার ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি। তিনি ডান হাত কনুই থেকে ভাঁজ করে দু-চোখ ঢেকে নেন। আয়া মেয়েটি গায়ের চাদর হাঁটুর কাছ থেকে টেনে বুক অবধি ঢেকে দেয়। মুহূর্তের জন্য ডঃ সান্যাল অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। বলেন, উনি বোধহয় ক্লান্ত বোধ করছেন। আজ এই পর্যন্তই থাক। ওষুধ কাজ শুরু করেছে। আশা করছি মাসখানেকের মধ্যে উনি পূর্ণ স্মৃতি ফিরে পাবেন।

ডঃ সান্যাল চলে গেছেন। ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়নি। হাসপাতালে যে যার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখনও সবাই আছে।

সূর্য বসেছিল, একা। অনেকক্ষণ। তার বুকটা ফাঁকা, একদম ফাঁকা। বাবার এই চিনতে পারার মাপকাঠিতে সে যেন আজ নির্বাসিত, এক দূর নির্জন দ্বীপে। ঋষিকে দেখিয়ে বাবা যখন বললো “আমার ছেলে", সূর্য দেখেছিল, ঋষির মুখ। এক অপার্থিব আলোয় ভরে উঠেছিল কলম পেষা কেরানী, ঋষি বসুর মুখমণ্ডল। ঠিক সেই মুহূর্তে সূর্যর চোখে কি ছিল? একাকীত্ব?

সূর্য পিঠে হাতের স্পর্শ পায়। ফিরে দেখে নীলুজেঠু। জেঠু ধীরে ধীরে বলেন, সূর্য মন খারাপ করো না। অখিলকে ভুল বুঝো না। আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড বলে একটা কথা আছে। সেটা তো অস্বীকার করা যায় না।



(পরবাস-৬১, ডিসেম্বর ২০১৫)