যুদ্ধের সময় কলকাতায় আগত ইংরেজ সৈনিকদের অন্যতম বৈমানিক বিল বাটলার 'ভারতীয় গণনাটকের প্রথম স্রষ্টা' বিজন ভট্টাচার্য রচিত 'নবান্ন' নাটকটি দেখে অন্তরাত্মার ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি আবেগপূর্ণ চিঠি লিখেছিলেন বিজন ভট্টাচার্যকে। শুধু বিলের চিঠিই নয়, এদেশে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষ সম্বন্ধে ব্রিটিশ সরকারের নীরবতায় ক্ষুব্ধ হয়ে সে দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানবতাবাদী নাগরিকদের বিভিন্ন সংবাদপত্রে একের পর এক লেখায় প্রকাশ পেতে থাকল পরিস্থিতির নির্মমতার কথা এবং তারই ফলে সৃষ্ট ব্যাপক জনমতের চাপে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্স্টন চার্চিল বাধ্য হলেন ১৯৪৪-এর 'দুর্ভিক্ষ তদন্ত কমিশন' গঠন করতে। কমিশনের রিপোর্টেও প্রতিফলিত হল বিল ও অন্যান্য সহমর্মী নাগরিকদের ক্ষোভের কথা—
'বাংলাদেশের পনের লক্ষ দরিদ্র নরনারী যে সর্বনাশের সম্মুখীন হয়েছিল, তার জন্য তারা নিজেরা দায়ী ছিল না। সমাজ তার দরিদ্র মানুষগুলিকে বাঁচাবার কোন ব্যবস্থা করে নি। প্রশাসনিক বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গেই এসেছিল নৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়।'
কমিশন শুধু পরিস্থিতির বিশ্লেষণেই আবদ্ধ থাকেনি, বরং ঘটনার নেপথ্য কারণ হিসাবে প্রকারান্তরে ইংরেজ সরকারকেও দায়ী করেছিল—
'বাংলার মন্বন্তরের জন্য দায়ী যুদ্ধের স্বার্থে ইংরেজ সরকারের সুপরিকল্পিত লুণ্ঠন ও কৃষকহত্যার নীতি, বেপরোয়া চোরাকারবার ও মজুতদারি।'
পৃথিবীর ইতিহাসে কোন নাটকের দ্বারা সামাজিক বিপর্যয়ের পিছনে ক্ষমতাসীন সরকারের মুখোশ উন্মোচন করার এ ছাড়া দ্বিতীয় নজির মেলে না। বিজন ভট্টাচার্য রচিত 'নবান্ন' নাটক সেই অর্থে পৃথিবীর নাট্যইতিহাসে বিরলতম এক কৃতিত্বের অধিকারী। ঐতিহাসিকভাবে আলোড়ন ফেলে দেওয়া এমন একটি নাটক কিভাবে বাংলা তথা ভারতীয় নাট্যমণ্ডলের আমূল দিকবদল ঘটিয়ে দিয়েছিল, সে স্বীকৃতি মেলে খ্যাতনামা নাট্যব্যক্তিত্ব উৎপল দত্তের কথায়—
"অমরেন্দ্রনাথের মঞ্চসজ্জা ব্যবসায়িক চটকে পরিণত হয়ে পরবর্তীকালে নাট্যশালায় বহু সস্তা জিনিসের প্রবেশপথ করে দিয়েছিল। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ স্রেফ চট টাঙিয়ে অভিনয় করে ঐ জীর্ণ ব্যবসায়িকতার মৃত্যুবাণ হানেন। বুর্জোয়া বাস্তববাদের বিরুদ্ধে 'নবান্ন' ছিল শ্রেণীসচেতন গণনাট্য সংঘের অভিযান।"
('থিয়েটারে গিরিশ' - উৎপল দত্ত)
ইতিহাসস্পর্শকারী 'নবান্ন' নাটকটি বিজন ভট্টাচার্যের তৃতীয় রচিত নাটক, তার আগে প্রকাশিত হয় অন্য দুটি নাটক। 'অরণি' পত্রিকায় ২৩ এপ্রিল ১৯৪৩-এ প্রকাশিত হল বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম নাটক 'আগুন', যে নাটকের বিষয়ের বিস্তারে পঞ্চাশের মন্বন্তরের জীবনব্যাপী হাহাকারের কথাই শুনতে পাওয়া যায়। দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে খাদ্যাভাবে সাধারণ মানুষের প্রাণান্তকর লড়াই চিত্রায়নের সূত্রপাত এই নাটক থেকেই। এরপরে ১৯৪৩-এরই ২৮ অক্টোবর 'অরণি' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বিজনের দ্বিতীয় নাটক 'জবানবন্দী', যেটি পরে নেমিচাঁদ জৈন হিন্দিতে অনুবাদ করেন 'অন্তিম অভিলাষ' নামে, 'নবান্ন' নাটকের বীজ যে নাটকগুলোর মধ্যে ছড়িয়েছিল বলে সমালোচকেরা অভিমত পোষণ করেন, তার অন্যতম হল এই 'জবানবন্দী' নাটকটি। একটা গ্রামের একটি কৃষক পরিবারের ছবির মধ্য দিয়ে নাটককার পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিতে গোটা গ্রামবাংলায় আছড়ে পড়া দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক দৃশ্য এঁকেছেন। একদিকে চিত্রিত হয়েছে দুর্ভিক্ষের হাহাকার, অন্যদিকে ফুটে উঠেছে আকালের করাল গ্রাসে মানুষের প্রাণ চলে যাওয়া ও জীবন থেকে সবকিছু হারিয়ে যাওয়া। 'জবানবন্দী' নাটকের সমালোচনায় আনন্দবাজার মন্তব্য করেছিল (৭ জানুয়ারি, ১৯৪৪)—
"অন্নসমস্যা অবলম্বনে রচিত শ্রীযুক্ত বিজন ভট্টাচার্যের 'জবানবন্দী' নাটকখানির রূপসজ্জা, বাকভঙ্গি, অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করে। পল্লীবাসী জীবনের ব্যথাবেদনাকে এমন সাফল্যের সহিত রূপায়িত করা কম কৃতিত্বের নহে।
প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা বলরাজ সাহানী নাটকটির অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন—"জবানবন্দীতে বাস্তব যেন একেবারে কথা বলে ওঠে"
('বহুরূপী', ৩৩ সংখ্যা, পৃ. - ১৯)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, 'অন্তিম অভিলাষ', কৃষণ চন্দরের 'জন্মদাতা' এবং বিজনের 'নবান্ন' নাটকের ভাবনায়, কল্পনায় জন্ম নেয় ভারতের ইতিহাসসৃষ্টিকারী চলচ্চিত্র—'ধরতি কে লাল'—যেটি পরিচালনা করেন খাজা আহমেদ আব্বাস ও সঙ্গীত নির্দেশনার দায়িত্বে ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, রশিদ খান, ডেভিড এবং বলরাজ সাহানী।
'নবান্ন'-র আগে পরে মিলিয়ে কুড়িটিরও বেশি নাটক রচনা করলেও বিজনের অন্য কোন নাটক 'নবান্ন'র উচ্চতা স্পর্শ করতে পারেনি। 'নবান্ন'-র সূত্রেই বিজন নাটককার হিসাবে আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছে যান, এর অন্যতম কারণ বিশ্লেষণ করে বাংলা তথা ভারতীয় নাটকের অন্যতম প্রাণপুরুষ শম্ভু মিত্র মত প্রকাশ করেন—
"'নবান্ন' নাটকের আগে আমাদের ট্রাজেডিই ডোমেসটিক ট্রাজেডি, 'নবান্ন'-এ এল এপিক নাটকের ব্যাপ্তি।"
এ হেন এপিক নাটকের রচনাকার বিজনের জন্মসন নিয়ে কিছুটা মতান্তর প্রচলিত আছে। ১৯১৫ সালের ১৫ জুলাই অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার খানখানাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন খানখানাপুর সুরাজমোহিনী ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক ক্ষীরোদবিহারী ভট্টাচার্য ও সুবর্ণপ্রভা দেবীর নয় সন্তানের অন্যতম বিজন। অন্য মতে সেই তারিখ শোনা যায় ১৯১৭ সালের ১৫ জুলাই। এ ব্যাপারে বিজনের লিখিত কোন প্রামাণ্য তথ্য না পাওয়া যাওয়ায় বহুপ্রচলিত ১৯১৫ সালকে জন্মবর্ষ বলে ধরে নেওয়া হলে এবছরই শতবর্ষ অতিক্রান্ত হলেন ক্ষণজন্মা নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য।
শিক্ষক পিতার সঙ্গীতপ্রীতি ও সাহিত্যচর্চার মানসিকতা গভীরভাবে সঞ্চারিত হয় ছেলে বিজনের মধ্যেও, ছোট থেকেই বিভিন্ন গ্রাম গ্রামান্তরে নানান কথকতা, যাত্রা, লোকসঙ্গীত শোনার মধ্যেই বীজ রোপিত হয়েছিল ভাবী নাট্যকার বিজনের নাটকের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মাটির টানের। শুধু 'নবান্ন'ই নয়, এই মাটির গন্ধ পাওয়া যায় পরবর্তীকালেও রচিত বিজনের যে কোন নাটকে—তা সে নাটকের প্রেক্ষাপটে শহর থাকলেও।
কেমন করে নাট্যের অন্দরে প্রবেশ করলেন বিজন ভট্টাচার্য, সে হদিশ পাওয়া যায় তাঁর নিজস্ব বয়ানে—
"১৯৩০ থেকে আমি কলকাতায়, তার আগে গ্রামে ছিলাম। অনেকদিন ছিলাম বসিরহাট সাতক্ষীরায়। সেইজন্য পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত আঞ্চলিক ভাষা আমার জানা ছিল। আমার ভীষণ ভালো লাগত ঐ গ্রামের মানুষদের সঙ্গে থাকতে, ওদের সঙ্গে মিশতে। আমি লক্ষ করেছিলাম ওদের রিএ্যাকশন কী হয়, ওরা কেমন করে কথা বলে। অসুখে কেমন করে কষ্ট পায়। এই মাটিটাকে খুব চিনতাম, ভাষাটাও জানতাম। আমাকে যা ভীষণভাবে কষ্ট দিত, কোন্ আর্টফর্মে আমি এদের উপস্থিত করতে পারব। তারাশঙ্কর বা শরৎ চাটুজ্জের মত আমার কলম ছিল না, কিন্তু আমি দেখতাম তাঁরা তো কিছুই করছেন না। আমার জ্বালা ধরতো কারণ আমি বরাবরই জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম, কখনো 'ফ্রিন্জ'-এ কখনো ভেতরে ছিলাম"
('গন্ধর্ব', বিজন ভট্টাচার্য বিশেষ সংখ্যা)
১৯৩০-এ কলকাতায় পদার্পণ ঘটে জীবনপথিক বিজনের। প্রথমে আশুতোষ কলেজ ও পরে রিপন কলেজ। ছাত্র আন্দোলনের উৎসাহী কর্মী বিজনের মহিষবাথানে লবণ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। এরপর ১৯৩৮-এ আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগদান করলেন সাংবাদিক হিসাবে। ১৯৪০-এ 'সরণী' পত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম গল্প—'জালসত্ত্ব', আনন্দবাজার পত্রিকায় কার্যকালীন সময়ে রেবতী বর্মণের সাম্যবাদ সম্পর্কিত গ্রন্থগুলি আলোচনার সময়ে বিজন মার্কসবাদী মতের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং যোগাযোগ ঘটে মুজাফফর আহমেদের সঙ্গে। ১৯৪২-এ পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হন এবং ১৯৪৪-এ ছেদ ঘটে আনন্দবাজার সম্পর্কের। অন্যদিকে ১৯৪২-এ শুরু হয় ভারত ছাড়ো আন্দোলন এবং একই সময়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে গঠিত হয় ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ। ১৯৪৩-এ বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলেন বিশিষ্ট লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে এবং সেই সম্পর্কের সূত্রে জন্মগ্রহণ করেন তাঁদের সন্তান, পরবর্তীকালে সাড়া জাগানো লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য।
বিজন ভট্টাচার্য যখন বাংলা মঞ্চে কাজ শুরু করেন তখন বাংলা রঙ্গমঞ্চে পেশাদারি বাণিজ্যিক নাট্যশালায় চলেছে সমাজজীবনের বিপর্যয় থেকে উটপাখির মত মুখ লুকিয়ে গতানুগতিক ঐতিহাসিক, পৌরাণিক এবং উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সমাজজীবনের রঙিন ছবিসর্বস্ব নাটকের রমরমা। আবেগসর্বস্ব জাতীয়তাবাদ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবপ্রবণতা, দেবলীলার ভক্তিভাষ্য, ধর্ম ও দেশাভিমান এবং সস্তা সেন্টিমেন্টের তরল আবেগসর্বস্বতার সীমাবদ্ধ গণ্ডিতেই চলছিলো বাংলা নাটকের চর্বিতচর্বণ।
অথচ কি অবস্থা ছিল সেই সময়ের বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থার? শতাব্দীর বীভৎসতম মন্বন্তরে যেখানে মৃত্যু হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের, শহর কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় 'ফ্যান দাও মা'-র মর্মভেদী চীৎকারে চরম বীভৎসার মুখোমুখি হয় বাংলার মানুষ, শিল্পী সাহিত্যিকরাও দলমত নির্বিশেষে পথে নেমে পড়েছেন সেই দুঃসময়ের দিনে, 'আমাদের নবজীবনের গান'-এর স্রষ্টা কালজয়ী সঙ্গীতস্রষ্টা জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর মরমী কলমে পাওয়া যায় সেই অবস্থানের ছবি—
"১৯৪৩ সাল, বাংলায় ১৩৫০। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে বিশেষ করে শহর কলকাতায়, মহামন্বন্তরের করাল ছায়া চারদিক অন্ধকার করে দিল। আর ঘরে থাকা যাচ্ছিল না। জমাট সাহিত্যিক আড্ডা ও রিহার্সাল ছেড়ে আমরা সবাই রাস্তায় নেমে পড়লাম, চরম বিপর্যয় ও বীভৎস মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ালাম।"
এমন একটা চরম দুঃসময়ের দিনে কি অবস্থান ছিল বিজন ভট্টাচার্যের? জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর মতে ভারতীয় ভাষায় গণ নাটকের প্রথম স্রষ্টার আর এক জীবনসংবেদী শিল্পী প্রবাদপ্রতিম চিত্রপরিচালক ঋত্বিক ঘটকের বয়ানে শোনা যাক সেই ভূমিকার কথা—
"বিজনবাবুই প্রথম দেখালেন কি করে জনতার প্রতি দায়িত্বশীল হতে হয়, কি করে সম্মিলিত অভিনয়-ধারার প্রবর্তন করা যায় এবং কি করে বাস্তবের একটা অংশের অখণ্ডরূপ মঞ্চের উপর তুলে ধরা যায়। আমরা যারা এমন চেষ্টা করেছিলাম, সেসব দিনের কথা ভুলব না। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড আলোড়ন বাংলার একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠবৎ শিহরিত করে তুলল।"
('গন্ধর্ব', বিজন ভট্টাচার্য বিশেষ সংখ্যা।)
ঋত্বিক ঘটক বর্ণিত সেই বিদ্যুৎশিখার নাম 'নবান্ন', যে নাটককে শম্ভু মিত্রও অভিহিত করেছেন 'এপিক নাটক' হিসাবে, যে নাটকে আঁকা রয়েছে মানুষের আত্মিক অপমৃত্যু, মনুষ্যত্বের চরম লাঞ্ছনার মর্মস্পর্শী ছবি, সে নাটক রচনার তাগিদ ও মানসিকতা বোঝাতে গিয়ে বিজন বলেছেন—"সেই সময় ডি. এন. মিত্র স্কোয়ারের পাশ দিয়ে রোজ আপিস যাই। রোজই দেখি গ্রামের বুভুক্ষু মানুষের সংসারযাত্রা, নারী-পুরুষ-শিশুর সংসার। এক একদিন এক একটা মৃতদেহ নোংরা কাপড়ে ঢাকা। মৃতদেহগুলো যেন জীবিত মানুষের চেয়ে অনেক ছোট দেখায়। বয়স্ক কি শিশু, আলাদা করা যায় না, ... আপিস থেকে ফিরবার পথে রোজই ভাবি, এইসব নিয়ে কিছু লিখতে হবে। কিন্তু কীভাবে লিখব? ভয় করে গল্প লিখতে, সে বড় সেন্টিমেন্টাল প্যানপেনে হয়ে যাবে।
"একদিন ফেরবার পথে কানে এলো, পার্কের রেলিঙের ধারে বসে এক পুরুষ আর এক নারী তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের গল্প করছে, নবান্নের গল্প, পুজো-পার্বণের গল্প। ভাববার চেষ্টা করছে তাদের অবর্তমানে গ্রামে এখন কী হচ্ছে। আমি আমার ফর্ম পেয়ে গেলাম। নাটকে ওরা নিজেরাই নিজেদের কথা বলবে।"
('গন্ধর্ব', বিজন ভট্টাচার্য বিশেষ সংখ্যা।)
মাত্র ন'দিনে লেখা হল 'নবান্ন'। প্রগতি লেখক সংঘে পড়া হল 'নবান্ন'। নাটক শুনে মরমী কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিজনকে বললেন—"আপনি তো জাত চাষা"। সত্যিই তো, বিজনই তো পারবেন এই নাটক লিখতে কেননা তিনি তো থাকেন মাটির কাছাকাছি। তিনি তো চেনেন মাটিটাকে, জানেন সেই ভাষাটাও। তিনি ঘুরে বেড়ান আখড়ায় আখড়ায়, মালো পাড়ায়, শোলার কারিগরদের ঘরে ঘরে। তিনিই অক্লেশে বলতে পারেন—"সব কিছুর মধ্যে গিয়ে বসতাম, প্রতিমা গড়া দেখতাম, একটু কাদা মেখে দেওয়ার সুযোগ পেলে খুব ভালো লাগত। আমার মাখা কাদা দিয়ে যদি প্রতিমার নাকটা হয় তাহলে আমার যেন ধন্য মনে হত।"
('গন্ধর্ব', বিজন ভট্টাচার্য বিশেষ সংখ্যা।)
মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ বিজন ভট্টাচার্যের লেখা নাটক 'নবান্ন' প্রথম অভিনীত হল শম্ভু মিত্র ও বিজন ভট্টাচার্যের যৌথ নির্দেশনায় ২৪ অক্টোবর ১৯৪৪-এ শ্রীরঙ্গম নাট্যগৃহে। প্রথম রজনীতে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তার মধ্যে প্রধান সমাদ্দারের মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিজন ভট্টাচার্য স্বয়ং, সে রাতের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যে তালিকা ভারতীয় গণনাট্য সংঘের স্যুভেনির থেকে পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়—
অভিনয়ে —
বিজন ভট্টাচার্য (প্রধান সমাদ্দার)বাংলায় ব্যবসায়িক থিয়েটারের তারকা প্রথা (Star System) 'নবান্ন' অভিনয়ের মাধ্যমে ভেঙে গেল। কোন একক নায়কচরিত্র বা নায়িকাকেন্দ্রিক অভিনয় নয়, বদলে প্রতিষ্ঠিত হল গ্রুপ এ্যাক্টিং বা সম্মেলক অভিনয়ের নতুন রীতি, নতুন ধারা। যে ধারা সম্ভব হয়েছিল জীবনের আবেগ থেকে, উদ্দেশ্য থেকে, কোন পেশার কারণে নয়। তাই বুঝি যুগান্তর লিখেছিল—
শম্ভু মিত্র (দয়াল ও টাউট)
সুধী প্রধান (কুঞ্জ)
জলদ চট্টোপাধ্যায় (নিরঞ্জন)
গঙ্গাপদ বসু (হারু দত্ত ও বরকত)
চারুপ্রকাশ ঘোষ (কালীধন ধাড়া)
সজল রায়চৌধুরী (রাজীব)
মণিকুন্তলা সেন (পঞ্চাননী)
শোভা সেন (রাধিকা)
তৃপ্তি ভাদুড়ী (বিনোদিনী)
চিত্তপ্রসাদ হোড় (বরকর্তা)
গোপাল হালদার (বৃদ্ধ ভিখারি)
শম্ভু ভট্টাচার্য (ডোম) প্রমুখ।
আবহসঙ্গীত - গৌর ঘোষ
মঞ্চাধ্যক্ষ -- চিত্ত ব্যানার্জী
উপদেষ্টা - মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য
পরিচালনা - শম্ভু মিত্র ও বিজন ভট্টাচার্য।
(৩০শে অক্টোবর, ১৯৪৪)
শুধু প্রশংসা নয়, 'নবান্ন'র কপালে বেশ কিছু নিন্দেমন্দও জুটেছিল। বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক হিরণকুমার সান্যাল নাটকটিকে আক্রমণ করে 'পরিচয়' পত্রিকায় (কার্তিক, ১৩৫১) লিখলেন—"নবান্ন নাটকের গুরুতর ত্রুটিগুলি অভিনয়ের গুণে অধিকাংশ ঢাকা পড়েছে। নাটক হিসাবে নবান্নকে মোটেই সক্ষম রচনা বলা চলে না।" কবিশেখর কালিদাস রায় এর উত্তর দিলেন পরিচয় (পৌষ, ১৩৫১) সংখ্যায়—"নবান্নের অভিনয় এতই চমৎকার হইয়াছে যে আমি যে নগরের রঙ্গালয়ে বসিয়া অভিনয় দেখিতেছি তাহা ভুলিয়াই গিয়াছিলাম। আমরা পাড়াগাঁয়ের লোক, কাঙাল চাষীদেরই প্রতিবেশী। কাজেই সক্ষম বা যথাযথ হইল কিনা বলিবার অধিকার আমাদেরই আছে—চিরনগরবাসীদের নাই।" 'নবান্ন' নাটকের প্রাসঙ্গিকতা বা যুগোপযোগিতা সম্পর্কে আজ এতদিন পরে শতবর্ষের বছরেও যখন নতুন করে বিতর্ক উঠেছে তখন বাংলা তথা ভারতের নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তী নট সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিশ্লেষণে দ্বিধাহীনভাবে দাঁড়ান বিজন ভট্টাচার্যের পক্ষে—
"নবান্ন বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উঠে আসা কাহিনি, চিরকালীন গ্রামবাংলার ছবি। শুধুমাত্র সময়ের দাবি মিটিয়ে কি একটি নতুন যুগের হোতা হওয়া সম্ভব? বিজন ভট্টাচার্য না থাকলে পরবর্তীকালে আই.পি.টি.এ তো বটেই, 'বহুরূপী' ও আসত না।"
('রবিবারোয়ারি', এই সময়, ১৯ জুলাই ২০১৫)
'নবান্ন'র পর একের পর এক নাটক লিখেছেন বিজন ভট্টাচার্য। 'জীয়নকন্যা', 'গোত্রান্তর', 'দেবীগর্জন', 'মরাচাঁদ', 'কৃষ্ণপক্ষ', 'আজ বসন্ত', 'লাশ ঘুইর্যা যাউক', 'সোনার বাংলা', 'চুল্লী', 'হাঁসখালির হাঁস'। নাট্যদলও তৈরি করেছেন একের পর এক—ক্যালকাটা থিয়েটার গ্রুপ, কবচকুণ্ডল।
বিজনের 'নবান্ন' পরবর্তী নাটকগুলির মধ্যে সমালোচকদের বিচারে সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা 'দেবীগর্জন' নাটক, যেটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৬তে কিন্তু নাটকটি আসলে লেখা ১৯৫০-এ লেখা 'কলঙ্ক' নামক একাঙ্ক নাটকেরই পূর্ণাঙ্গ বর্দ্ধিত রূপ। 'দেবীগর্জন' নাটক সম্পর্কে বিশিষ্ট বিজন গবেষক অধ্যাপক জগন্নাথ ঘোষের মন্তব্যে যথার্থ ব্যাখ্যা মেলে নাটকটির অভিনবত্বের—"চাষীরা একদিন চরম শোষণ ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দেয়। এই প্রতিরোধ আন্দোলনের কাছে হার মানে মহাজন আর জোতদারের যাবতীয় দুরভিসন্ধি। চাষীরা নবজীবনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। চেতনার এই উদ্বোধন গণনাট্যের প্রধান শর্ত। গণনাট্যের শর্ত মেনে 'দেবীগর্জন' হয়েছে যথার্থ কৃষিবিপ্লবের নাটক।"
(বিজন ভট্টাচার্যের নাটক - জগন্নাথ ঘোষ)
বিজন ভট্টাচার্যের অত্যন্ত প্রিয় নাটক 'মরাচাঁদ', যে নাটকের কথা উঠলেই তিনি বলতেন—"আমি মরবোও মরাচাঁদ করেই"। আশ্চর্য ব্যাপার, মৃত্যুর আগের দিন মুক্তাঙ্গনে 'মরাচাঁদ' নাটকেই তাঁর শেষ মঞ্চাবতরণ। মরাচাঁদের কেন্দ্রীয় চরিত্র অন্ধশিল্পী পবন অধিকারী, যার প্রেরণা তিনি পেয়েছেন অন্ধশিল্পী টগর অধিকারীর কাছ থেকে—"টগর অধিকারীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল পরিণত বয়সে। আমি টগরের মধ্যে দেখেছিলাম জনতার এক শিল্পীকে। সে আমার কাছে তার জীবনের সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণা খুলে বলে। আমি জানতাম 'টগর উইল স্পীক ইট আউট'। কারণ আমিই পারতাম টগরের সঙ্গে ঠিকঠাক মিশতে।" মরাচাঁদের পবন, যাকে অনেকেই বিজনের আত্মবিবৃতি বলেও ব্যাখ্যা করেন, যেখানে উঠে আসে বিজন-মহাশ্বেতার সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিবাহবিচ্ছেদ ও বিজনের নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের ছবি, সেই নাটকে বিজনের অভিনয় সম্পর্কে শম্ভু মিত্রের অনুভূতি পড়লে বোঝা যায় কেমন মাপের শিল্পী ছিলেন বিজন ভট্টাচার্য—
"বহুদিন আগে 'মরাচাঁদ' বলে একটা নাট্য প্রস্তুত করে। তাতে একটা দৃশ্যে, যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন, বিজন একটা ধাক্কায় পড়ে যায়। পড়তে পড়তে আর্তনাদ করে ওঠে এবং সেই আর্তনাদটা অবিচ্ছিন্নভাবে গানের সুরে রূপান্তরিত হয়। এমন একটা জিনিস কল্পনা করতে পারাটাই দুর্লভ ক্ষমতা। তাই এ দৃশ্য যখন হত তখন একটা অদ্ভুত শিহরণ লাগত দেহে, মনে। অনেক অনুভব আমাদের চেতনার গভীরতম স্তরে পর্যন্ত আলোড়ন জাগাত এমন করে আর্তনাদকে একজন গানে রূপ দিতে পারছে বলে। বাস্তবের সমস্ত নির্মমতার বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ।"
এতো গেল 'মরাচাঁদ'-এর অভিনয়। 'নবান্ন' নাটকে বিজনের অভিনয় দেখে মরমী কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ করেন তাঁর অন্তরের গভীরতম স্তর থেকে উঠে আসা কথা—"এর চেয়ে ভালো অভিনয় শিশিরবাবুই আর কী করতে পারতেন, জানি না।"
আর শিশির ভাদুড়ী? 'নবান্ন' নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য যিনি শ্রীরঙ্গমে নিজের নাটক বন্ধ করে পরপর সাতদিনের জন্য হল ছেড়ে দিয়েছিলেন অভিনয়ের জন্য। তাঁর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিজন ভট্টাচার্য নিজেই লিপিবদ্ধ করেছেন 'কমিউনিস্ট আন্দোলনই আমাকে নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য তৈরি করেছে' নিবন্ধে—"শিশির ভাদুড়ি আর বিশ্বনাথ ভাদুড়ি দিনের পর দিন আসতেন এই নাটকের অভিনয় দেখতে। সেদিন যে উইংস দিয়ে আমি প্রস্থান করব, তার মুখে দাঁড়িয়ে দুভাই তন্ময় হয়ে অভিনয় দেখছেন। আমি অভিনয়ের গতিতে ছুটে বেরিয়ে যেতে গিয়ে শিশিরবাবুকে দিলাম একটা ধাক্কা, বললাম, আক্কেল নেই, উইংস আটকে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখ তুলেই দেখি শিশির ভাদুড়ি, আমার তখন মা ধরিত্রী দ্বিধা হও অবস্থা। বারবার ক্ষমা চাইলাম, কিন্তু শিশিরবাবু আমায় সমর্থন করে বললেন— ঠিক বলেছ বিজন। আই হ্যাভ ক্রস্ড মাই লিমিট।"
(সূত্র - রবিবারোয়ারি, এই সময় পত্রিকা, ১৯ জুলাই ২০১৫)
জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, সময়ের প্রতি দায়বদ্ধতা বিজনকে কখনোই সংগ্রামের রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় হাঁটতে দেয় নি। আর এর জন্য তিনি সবসময়ই স্বীকার করেছেন বা বলা ভালো উচ্চারণ করেছেন কমিউনিজমের প্রতি তাঁর অটুট বিশ্বাস, অনড় আস্থার কথা—"কমিউনিস্ট পার্টি আমার বাহ্য ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের পিছনে, মানসিকতার দিক দিয়ে সেই দিব্যশক্তি কাজ করেছে"।
(বহুরূপী, সংখ্যা - ৩৩, পৃ: ১৭১)
এ স্বীকারোক্তি বিজন বারবার করেছেন, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাওয়ার পরও বলেছেন—"আমার নাটক যেমন হাজার হাজার দর্শককে আকৃষ্ট করেছে, তেমনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে না এলে নাট্যকার হতাম না।"
(দৈনিক কালান্তর, ৩১ জানুয়ারি ১৯৭৬)
ভালো নাটক, অসাধারণ অভিনয় এসব সত্ত্বেও বিজন ভট্টাচার্যের নাটক তাঁর রচনার ষাট, সত্তর বছর পরে কেমন বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেল। বিষয়টা রূঢ় হলেও ঘটনাটা বাস্তব, অথচ এমনটা তো হবার কথা ছিল না, তবু হল। কেননা তিনি তো জীবনযাপন আর নাট্যচলন দুয়ের মধ্যে কোন ফারাক ঘটাননি জীবনে। আজীবন বামপন্থায় বিশ্বাসী মানুষটির পাশে শেষ সময়ে তাঁর সাধের বামপন্থী বন্ধুদের ভিড় ক্রমশঃ পাতলা হতে হতে শেষ হয়ে গেছিল প্রায়। ভাঙা বাংলার পাঁজর খসিয়ে খসিয়ে ভেতরকার রক্ত-পুঁজ-মাছি দেখানোর বিজন-দক্ষতায় শরিক হতে চায়নি পরবর্তীকালে বাংলার নাট্যমহল। 'কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!' বাংলা রঙ্গমঞ্চে বিদেশি নাটক রূপান্তর বা অনুবাদের জোয়ার এল। হৈ হৈ করে প্রবেশ ঘটে গেল বিজয় তেণ্ডুলকর, গিরিশ কারনাড, হাবিব তনবির বা মহেশ এলকুঞ্চওয়ারের। ব্রাত্য হয়ে রইলেন বিজন ভট্টাচার্য। বঙ্গীয় নাট্যসমাজের এই দ্বিচারিতার কথা খোলাখুলি উচ্চারণ করেন বিশিষ্ট সমালোচক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়—
"বালুরঘাটের 'ত্রিতীর্থ' বিজনবাবুর 'দেবীগর্জন' মঞ্চস্থ করে যে সৎসাহস দেখিয়েছিলেন, আর কোন নাট্যসম্প্রদায়ের সে সাহস দেখি না কেন? যে শঠতায় 'নবান্ন' নিয়ে সেন্টিমেন্টাল স্মৃতিচারণার বাড়াবাড়িতে বিজনবাবুর পরবর্তী উত্তরণকে অস্বীকার করা হয়, তারই আরেক প্রকাশ বিজনবাবুর নাটক প্রযোজনায় তথাকথিত প্রগতিবাদীদের অনীহায়।"
(ঋত্বিক ঘটক সম্পাদিত 'অভিনয়দর্পণ' পত্রিকা)
বিজন ভট্টাচার্যের নাটকের প্রযোজনা সাফল্যের মুখ দেখবে কিনা এ ভাবনায় দ্বিধান্বিত বাংলার নাট্যমহলের দুই মহীরূহের উদ্ধৃতি পাশাপাশি পেশ করে দেখা যাক সংশয়টা কোথায়—
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত -- "সব নাটকেরই তো সাহিত্যমূল্য খুব গুরুতর হয় না, আর তখন সে নাটক ঐ থিয়েটারটা বাদ রেখে কেমন অপূর্ণ, অসহায়ও ঠেকে ... 'রাজা অয়দিপাউস'-এর শম্ভু মিত্রের করা অনুবাদ যখন আমরা পড়ি তখন বিভিন্ন নাট্যমুহূর্তের বহুচর্চিত স্মৃতির আভাসটাও ফুটে ওঠে। উৎপল দত্তের করা 'টিনের তলোয়ার' পড়তে পড়তে শেষ দৃশ্যে তিতুমীর হয়ে ওঠার সেই গায়ে কাঁটা-দেওয়া চমকের অন্তত শোনা কথাও একটি ছবি দেখতে সাহায্য করে বর্তমানের অতি স্বল্প নাট্যপ্রেমীদের, কিন্তু বিজনবাবুর ক্ষেত্রে এই কিংবদন্তীর অভাব।"
বিভাস চক্রবর্তী -- "বিজনবাবুর বিষয় ভাবনার সঙ্গে মেলে না তাঁর প্রয়োগভাবনা, জীর্ণ পুরাতন মঞ্চব্যবস্থায় ব্যতিক্রমী নতুন চিন্তার নাটক। আমাদের অনুন্নত মঞ্চে সবকিছু ঠিকঠাক ম্যানেজ করতে না পারার দরুনই তাঁকে আরো বেশি অগোছালো মনে হত।"
(দুটি উদ্ধৃতির সূত্র : রবিবারোয়ারি, এই সময় পত্রিকা, ১৯ জুলাই ২০১৫)
এবার আসা যাক শিশির পরবর্তী যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতীয় নাট্যপ্রতিভা, পৃথিবীর সর্বকালের সেরা নাট্যব্যক্তিত্বদের পাশে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয় যাঁর নাম, বাংলা তথা ভারতীয় নাট্যের সেই অনন্য প্রতিভাধর মানুষ শম্ভু মিত্রের বিশ্লেষণে, যেখানে তিনি বিজন ভট্টাচার্যের নাট্যপ্রতিভা, নাট্যবোধ নিয়ে নিজস্ব অনুভবের কথা উচ্চারণ করেছেন এক অতলান্ত বিশ্বাস থেকে—
"বিজন তো কবি ছিল, তাই তার অনুভবের তীব্রতা যখন প্রকাশ পেত অমন আমরা বিচলিত হতুম। কিন্তু আমার মনে হয়েছে যে, বাস্তবের (যে বাস্তবকে আমরা প্র্যাকটিক্যাল যুক্তির ধাঁচে ব্যাখ্যা করি) বিপরীতেই বিজন দাঁড় করাত তাঁর অনুভবের তীব্রতাকে। ঐখানেই তার বৈশিষ্ট্য, আর ঐখানেই তার সমস্ত জোর।
"প্র্যাকটিক্যাল বোধবুদ্ধির বিপরীতে বিরাট হয়ে দেখা দিত বিজনের তীব্র অনুভব। এইখানেই, আমি একদিন বুঝলুম, বিজনের সমস্ত শিল্পসৃষ্টির উৎস। আর ঐখানেই সে অতুলনীয়।
"সে মানুষ আর কারোর হিসেবের ছকের মধ্যে বিন্যস্ত হবে কী করে?"
(সন্সর্গ সপর্যা, পৃ: ২০৪)
শম্ভু মিত্রের ব্যাখ্যায় প্রকাশ পেয়েছে মধ্যমেধার ভীড় ছাড়িয়ে কোনপথে বিজনের প্রতিভা শীর্ষস্পর্শ করেছে। আর এ অনুভব হয়তো সম্ভব আর এক দিগন্তস্পর্শীর পক্ষেই শুধুমাত্র।
বাংলা সাহিত্যের বিরল প্রতিভাধর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বাংলা থিয়েটারের চক্রব্যূহে এই অভিমন্যুর কথাই বলতে চেয়েছেন তাঁর 'নীলকণ্ঠ তুমি, তুমি অভিমন্যু' কবিতায়, যেখানে অসীম ক্ষমতাধর এই প্রতিভার প্রতি বাংলা নাটক তথা সংস্কৃতি মহলের দীর্ঘ বিস্মৃতির কারণে যে কোন সৎ নাট্যমোদীর অন্তরের যন্ত্রণাও প্রকাশ পেয়েছে ছত্রে ছত্রে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মাধ্যমে আরও একবার প্রকাশ পেল বাংলা থিয়েটারের 'দীর্ঘতম বৃক্ষের' সত্যকার উচ্চতা—
অস্তিত্বের বড় কাছে, হে প্রিয় তোমার আক্রমণ!
বঙ্গরঙ্গভূমি রক্তে ভেসে গেছে সেদিন, একদা—
তুমি তরবারি নিয়ে নেমেছিলে সন্ধ্যায় প্রভাতে।
ঐ দীপ্তি, ঐ ক্ষোভ, ঐ মারাত্মক বিবেচনা
নিয়ে, প্রিয় সশরীর নবান্নের বিষন্ন প্রাঙ্গণে
নেমে এসেছিলে, সেই দৃশ্য এক কিশোর দেখেছে,
তারপর থেকে দীর্ঘপথ ছিলো পর্যটনময়
পথ ছিল, মত ছিল, ফুল ও পাথর ছিল কত।
মায়ের মমতা দিয়ে সবকিছু জড়িয়েছো বুকে
তুমি দীর্ঘতম বৃক্ষ, নাকি তুমি মাধবীর লতা-
বাংলার সন্ন্যাসে, গৃহে প্রাণময় জ্যোৎস্নায় জড়ানো?
নীলকণ্ঠ তুমি, তুমি অভিমন্যু ব্যূহের ভিতরে
দিগ্বিজয়ী, ঢুকে গেছো, কিছুতেই বেরুতে পারছো না-
এই ভালো, কাজ নেই, জীবনে ও নাট্যে দুঃখ আছে।
(পরবাস-৬১, ডিসেম্বর ২০১৫)
অলংকরণ : উইকিপিডিয়া থেকে