ISSN 1563-8685




একটা ভণ্ডুল ভ্রমণ


পোখরা

অক্টোবর ২০১৪, দুপুর সোয়া দু-টো

শতাব্দীর সওয়ার কাকা–ভাইপো। উদ্দেশ্য অ্যারাউন্ড অন্নপূর্ণা। বিধাতার বিধেয় ভবিষ্যতের গর্ভে।

রাত সাড়ে দশটা

প্রভূত খেতে খেতে নিউজলপাইগুড়ি।

রাত পৌনে এগারোটা

তিরুপতির আশ্রয়ে রাত্রিবাস।

৭ অক্টোবর, সকাল ন-টা

পানিটাঙ্কির বাসে সওয়ার হওয়া গেল। স্টেশন চত্বর এখনই জমজমাট। ট্যাক্সি, অটো, রিকশা, বাস — একেবারে হাঁসফাঁস অবস্থা। দিব্বি গরম।

সকাল ন-টা দশ

যাত্রা শুরু।

সকাল সোয়া দশটা

একুশ বছর পর পানিটাঙ্কি। আগেকার সেই মেঠো গ্রাম্যভাব উধাও — পাক্কা বাজারী রূপ – গরম, ধুলো, দালাল।

সকাল দশটা পঁয়ত্রিশ

কোনওরকম চেকিং ছাড়াই রিকশা চড়ে নেপালে। কাকড়ভিট্টাও অনেক বদলে গিয়েছে। গাছপালার মাঝে ছোট্ট বাসগুমটি, ব্যাঙ্ক, গোটাকয় অতিসাধারণ হোটেলের জায়গায় রীতিমতো জম্পেশ শহর! দালাল রাজত্ব।

বেলা একটা পাঁচ

গরমের রাজত্ব। বাস সেই বিকেল পাঁচটায়। আমাদের হিসেবে পৌনে পাঁচটা। তাই টাকা বদল করে একটা হোটেলে বিছানাস্থ হওয়া গেল।

বিকেলে পাঁচটা পাঁচ

বাস ছাড়ল — ডেস্টিনেশন পোখরা।

বিকেল পাঁচটা পঞ্চান্ন

ধূলাবাড়ি — ‘ফরেন মাল’ কেনার একেকালের স্বর্গ। ধানক্ষেতের সবুজ ঢেউয়ের পাশে কাশের শ্বেতসমুদ্র।

বিকেল পাঁচটা আঠাশ

ডানদিকে মোচড় মেরে বাস এলো বিরতা মোড়।

বিকেল ছ-টা সতেরো

দমকে থমক। কার ধমকে কে জানে!

বিকেল ছ-টা বত্রিশ

আবার চলনদার হলো বাস।

রাত আটটা চব্বিশ

চা-টা চাপালাম। গরমটা কমেছে।

রাত দশটা একান্ন

লালগড়ে উদর–শান্তি।

৮ অক্টোবর, শেষরাত দু-টো বত্রিশ

এবার বাসের ডিনার।

রাত তিনটে তিন

ডিনার শেষ।

ভোর পাঁচটা আঠারো

আবছা আলোয় পার হলাম নদী। গরম উধাও।

ভোর পাঁচটা সাতচল্লিশ

ডুমরে। এখান থেকেই অ্যারাউন্ড অন্নপূর্ণা–র পথবদল। আমরা অবশ্য এই মুহূর্তে পোখরাপন্থী। কিছু চায়ের দোকানসহ ছোট্ট বসতিটা আজ মেজো শহর।

সকাল ছ-টা দশ

দেওরালি। চা খেতে খেতে আকাশের গোমড়ামুখ দর্শন।

সকাল সোয়া আটটা


পোখরা থেকে মাছাপুছারে

রোদ ঝলমলে পোখরা। অন্নপূর্ণা আর মাছাপুছারের অনাবিল হাসি দিল খুশ করে দিল।

সকাল আটটা উনচল্লিশ

হুশ করে ট্যাক্সি চেপে লেকের কাছাকাছি হোটেলে।

সকাল এগারোটা

অ্যারাউন্ড অন্নপূর্ণার ট্রেকিং পারমিট পেলাম। ACAP-য়ের দপ্তরে নির্দিষ্ট ফর্মে ছবি লাগিয়ে, সচিত্র পরিচয়পত্রের XEROX আর নির্দিষ্ট ফী জমা দিয়ে। যাওয়া আসার পথের ধারে ফেওয়া তাল অনেকটা সময় কেড়ে নিল।

দুপুর একটা একুশ

শুয়ে শুয়ে পোখরার চমকে দেওয়া বদলটা ভাবছি। তিরাশি, অষ্টআশির কথা বাদই দিলাম, তিরানব্বইতেও ফেওয়া তালের ধারটা ছিল শান্ত, নিরিবিলি। আর এখন! এককথায় গমগম করছে । আগে ছিল কাঁচা রাস্তার ধারে একতলা, মেরেকেটে দোতলা হোটেল। এখন চারতলার কম হোটেল চোখেই পড়ে না। এই কিংক্রীটের জঙ্গলের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া ফেওয়াতালকে খুঁজে নিতে কষ্ট হয়।

৯ অক্টোবর, ভোর ছ-টা চার

ট্যাক্সিতে বসলাম বাসস্ট্যান্ডে যাবার জন্য। পোখরা সবে আড়মোড়া ভাঙছে। মাছাপুছারে প্রথম সূর্যকিরণের সোনা মাখছে।

সকাল ছ-টা উনচল্লিশ

বাস ছাড়ল বেসিশহরে। ঠাণ্ডা তেমন বেশি নয়। অন্নপূর্ণা শৃঙ্গমালা দিগন্তে উদার।

সকাল সাতটা সাঁইত্রিশ

অকলা। চাচা-ভাতিজায় চা-পান পর্বে যোগ দিলাম।

সকাল আটটা আঠারো

দমৌলি দেখে দমল না বাস, দম ধরে ছুটে চলল।

সকাল আটটা পঞ্চাশ

ডুমরে। গাড়ি এবার বাঁয়ে মুড়।

সকাল ন-টা চোদ্দো

খহরে। তেমন বড় নয় আড়ে বহরে।

সকাল ন-টা সোলো

তুরতুরে। তুরতুর করে পেরিয়ে গেলাম।

সকাল ন-টা একত্রিশ

পিতাপানি। পীতা পানি, না, পিতা পানি ? বড্ড ঘোলা প্রশ্ন।

সকাল ন-টা একচল্লিশ

কালামাটি চৌক। আমার তো মাটি দিব্বি ফরসাই লাগল।

সকাল ন-টা চুয়াল্লিশ

পাঁউদি পুল পেরিয়ে লামজুং জেলায় ঢুকলাম।

সকাল ন-টা চুয়ান্ন

ভোটেওডার। কত ভোটে, কে জানে ?

সকাল ন-টা উনষাট

বালুনে। বয়ে গেছে বালু নিতে।

সকাল দশটা তিন

বগৈঁচা। এ আবার কেমন চা!

সকাল দশ টা উনিশ

ঘৈরি। সকালের আলোয় তৈরি।

সকাল দশটা তেইশ

গাঁউশহর। গাঁও, না শহর?

সকাল দশটা একত্রিশ

তালফাঁটে। তাল ফাটে, না কাটে?

সকাল দশটা তেত্রিশ

রাণীকুওয়া। রাণীর কুঁয়ো — কোথায়?

সকাল দশটা আটত্রিশ


বেসিশহর

বেসিশহর — বেশ শহর। ছিমছাম শহর।

সকাল দশটা বাহান্ন

ট্রেকরুট পারমিট পাঞ্চ হলো। এবার লাঞ্চ। তবে তার আগে চ্যামেজ–র গাড়িতে আসন সংরক্ষণ। এখন আর পায়ে পায়ে নয়, অনেকদূর অবধি চাকায় চলন।

সকাল এগারোটা তেত্রিশ

মানালসু পরিক্রমা করে ষাটোর্ধ যুবক মি. শ্রীনিবাসনের শুভেচ্ছা পাওয়া গেল।

দুপুর বারোটা পাঁচ

চলল গাড়ি, সুদূর পাড়ি।

দুপুর বারোটা তেত্রিশ

মার্সিয়াংদি খোলার গান শুনতে শুনতে, নাচ দেখতে দেখতে এবার তাকে ডিঙিয়ে ঢুকে পড়েছি ‘অন্নপূর্ণা সংরক্ষিত অঞ্চলে’ দু-দিকে সবুজ পাহাড় আর পিছন থেকে মানালসু নজর রাখছে।

দুপুর বারোটা পঞ্চাশ

পাদি (Ngadi) বাজার। ছোট্ট মিষ্টি জায়গা। এখানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে।

বেলা একটা এক

খুদি চেকপোস্ট। সামনের পথ সরু। এবার কষ্ট আছে গুরু।

বেলা একটা দশ

বাহুনপাঁড়ার পায়ে হাঁটা পথ এড়িয়ে হেলেদুলে নেচেকুঁদে চলা।

বেলা একটা কুড়ি

নাচের বিরতি। চা দিয়ে সাহস সংগ্রহ। এবারের পথ সন্দকফু – পথের ‘বাপরে’ সংস্করণ।

বেলা দুটো

কাপরেদাঁড়া। ।বাপরে! দাঁড়া। গাড়ি কানে গুঁজেছে তুলো। অতএব ডিস্‌কো অব্যাহত। মার্সিয়াংদির নাচও অব্যাহত।

বেলা দু-টো বাইশ

স্যয়াঙ্গে পেরিয়েই মন ভালো করা ঝরনা।

বেলা দু-টো ছত্রিশ

সিরচৌর। শুধু শির কেন, গোটা শিরদাঁড়া চুরচুর হবার যোগাড়।

বেলা তিনটে

জগত।পথ আবার ইহজগতে ফিরেছে।

বেলা তিনটে একুশ

চ্যাম্‌জে ফল্‌স সব ব্যথা ভুলিয়ে দিয়েছে। চা খেতে খেতে তার রূপ দর্শন - আ হা হা।

বেলা তিনটে চুয়াল্লিশ


চ্যামেজে

চ্যামজে। ডিস্কো খতম। ছোট্ট কিন্তু খাসা জায়গা। সরু গর্জের মতো হলেও মন ভালো হয়ে গেল। এক ফালি চড়াই উৎরাইমাখা পথের দু-ধারে বাড়িগুলো সব শান্ত ছেলের মতো বসে আছে।

‘সন্ধে’ সাড়ে ছ-টা

দু-দিকের পাহাড়ের গা বেয়ে আঁধার নেমে এসেছে। মার্সিয়াংদি সশব্দে জানান দিচ্ছে, 'আমি আছি’ ।

১০ অক্টোবর, ভোর পৌনে ছ-টা

ভোরের আলো ঠাণ্ডা পরশ মেখে ছড়িয়ে পড়ছে। দু-পাশের পাহাড় তাদের কালচে সবুজ আলাখাল্লা সরিয়ে ঝলমলে সবুজের পোশাকগুলো পরে নিচ্ছে। পাখিরা ভারি ব্যস্ত হয়ে ওড়াউড়ি করছে। আজ ‘পদযাত্রা’–র শুরু।

সকাল সাতটা ছত্রিশ

বোঁচকা পিঠে তৈরি মুসাফির। মার্সিয়াংদি নিচের থেকে মহা কোলাহলে আহ্বান জানাচ্ছে — তাকে পেরিয়েই তো পথ।

সকাল সাতটা চল্লিশ

হুড়মুড়িয়ে পাথুরে সিঁড়ি ছুটেছে মার্সিয়াংদি পানে।

সকাল সাতটা সাতান্ন

ও বাবাগো, কাঁধে বড্ড লাগছে যে গো ! বোঝাটা বেশ ভারিই হয়েছে মনে হচ্ছে।

সকাল আটটা সাত

পুলের নিচে মার্সিয়াংদি তাণ্ডব নৃত্য করছে। তা করুক, পুলকিত মনে পার হয়ে এলাম। এবার সরু পাক্কা ট্রেকিং পথ। একটু দূরে একটা জলপ্রপাত হাতছানি দিচ্ছে।

সকাল আটটা তেরো

বড্ড গরম লাগছে। পায়েও বড্ড চাপ লাগছে। স্যাকের ওজনে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দিব্বি টের পাচ্ছি।

সকাল আটটা তেত্রিশ

তিন পাথরের নকল টানেলের ফাঁক গলে একেবারে প্রপাত সুন্দরীর মুখোমুখি। ওপারে ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মার্সিয়াংদির বুকে, সূর্যের কিরণ মেখে হীরের মতো ঝলমল করছে।

সকাল আটটা উনপঞ্চাশ

হলো না। পারলাম না। বাঁ পায়ের কাফ– মাস্‌লে ক্র্যাম্প ধরেছে। পা ধরে বসে পড়েছি পথের ধারে। সামনে মার্সিয়াংদি ভ্যাঙচাচ্ছে। কুড়ি বছরের আকাঙ্ক্ষার সোয়া ঘন্টায় জলাঞ্জলি।

সকাল ন-টা বারো

কাকার পরিচর্যায় খাড়া হওয়া গেল। ভগ্নমনোরথ হয়ে ভগ্নদূত রণে ভঙ্গ দিল। তার পাপে কাকারও শান্তি।

সকাল ন-টা আটত্রিশ

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্রপাতের খ্যাকখেকে হাসি না শোনার ভান করে ফিরে চলেছি। উজান–পথিকেরা অবাক হয়ে এই বেতালাকে দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছে তালের পথে।

সকাল ন-টা সাতচল্লিশ

পুল পেরিয়ে চড়াইয়ে পা রেখেই শরীর টলমল। ফলং ধপাৎ করে পথপার্শ্বে উপবেশন হস্তপদ এলায়িত করে। স্যাকমুক্ত হয়ে খাবি খাচ্ছি।

সকাল ন-টা চুয়ান্ন

কাকার প্রেরিত দেবদূত আমার পিণ্ডি (স্যাক) নিজের ঘাড়ে তুলে নিল। আমি তার পিছু পিছু মূর্তিমান বস্তার মতো নিজেকে টেনে নিয়ে চলেছি।

সকাল দশটা চার

আবার চ্যামেজে। বেসি শহরের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সীট দখল করতে হবে।

বিকেল চারটে বারো

আবার বেসি শহর। এবার মাথা নিচু করে। আজ এখানেই রাত্রিবাস।

রাত আটটা

চমৎকার হোটেল। দু-জনে মিলে ঠিক করলাম, অন্তত মুক্তিনাথটা ঘুরে আসব। এখন তো ওই পথে গাড়ি চলে।

এগারোই অক্টোবর; বেলা এগারোটা একচল্লিশ

পোখরার মাইক্রো বাসের সিট বুক করা গেল। সকালবেলা মানালসু মন ভালো করে দিল। থোরাং–লা পার করতে না পারার দু:খটা অনেকটাই কমে গেল।

বেলা দুটো

বাস ছাড়ল।

বেলা পাঁচটা একচল্লিশ

পুনরায় পোখরা। এবার অন্য এক হোটেলে। লেকের অনেক কাছে।

বারোই অক্টোবর; সকাল সাতটা পাঁচ

মন্দ ঠাণ্ডা নয়। একটু লেক দর্শন করে আসা যাক — সঙ্গে চা-পান।

সকাল ন-টা চল্লিশ

মুক্তিনাথ রুটের পারমিট করতে হাজির হয়েছি ACAP অফিসে ।

সকাল দশটা দশ

নতুন পারমিট হস্তগত করে ট্যাক্সি ধরলাম বেনি-র । আজই যতদূর এগিয়ে যাওয়া যায় ।

সকাল এগারোটা এগারো

পাকা পিচরাস্তা ধরে নঊদাঁড়া । তিরিশ বছর আগে এটাই ছিল ধুলোমাখা পায়ে হাঁটা পথ ।

সকাল এগেরোটা বাইশ

কান্‌ডে। এখানে নাকি শীতকালে কখনও সখনও বরফ পড়ে! কী কাণ্ড!

সকাল সাড়ে এগারোটা

হামলে পড়ে লুমলে পেরোলাম ।

সকাল এগারোটা একান্ন

নয়া পুল । যদিও এ পুলেরও বয়স কুড়ি পেরিয়েছে ।

দুপুর বারোটা চোদ্দো

দিমুওয়াতে মোদীখোলাকে টপকালাম। এখানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হয়েছে দেখলাম।

দুপুর বারোটা সতেরো

পাতিচৌর। পাতি চোরের জায়গা নাকি? মনে তো হচ্ছে না ।

দুপুর বারোটা বাইশ

আম্বোট। আম, বোট কিছুই চোখে পড়ল না।

দুপুর বারোটা চব্বিশ

কুশমা। সরাসরি সীতা বললেই হয়, কুশ-মা বলার কোনও মানে হয়! কালীগণ্ডকীর উঁকিঝুঁকি ।

দুপুর বারোটা সাতচল্লিশ

বাগলুং পুল ছোঁয়ার আগেই (এখান থেকেই একুশ বছর আগে পোখরা ফেরার ট্রাক ধরেছিলাম) ডাইনে মোচড় মেরে বেনির চড়াই ধরল গাড়ি।

দুপুর বারোটা একান্ন

দম্‌ভেখোলা পেরোলাম পুলে চড়ে। ১৯৯৩ তে একে পায়ে পায়ে পার করতে বাইশ মিনিট লড়াই করতে হয়েছিল।

দুপুর বারোটা বাহান্ন

ধসের জন্য জ্যাম। বেশ ঘ্যাম জ্যাম।

বেলা একটা বেয়াল্লিশ

অবশেষে জ্যামবাবার দয়া হয়েছে । গাড়ি আবার নড়েছে ।

বেলা একটা ছেচল্লিশ

লস্তিখোলা পুল পেরোলাম ।

বেলা একটা সাতান্ন

লুংদীখোলা পুল। না, বানান ভুল নেই ।

বেলা দু-টো সাত

বেনি। ঘাসার শেষ বাস ছাড়ছে।

বেলা দু-টো একুশ

রেকর্ডভাঙা স্পীডে টিকি কেটে বাসে উঠে আক্কেল গুড়ুম। ঘাসার বাস ভিড়ে ঠাসা। সীট, মেঝে, বনেট এমনকী কোলে কাঁখেও মানুষ! ড্রাইভার, কনডাক্‌টর কোন মন্তরে সেঁধুলো বলতে পারব না ।

বেলা দু-টো ছাব্বিশ

ও বাবা! ই কী পথ গো! মুরগিঠাসান ঠাসা বাস চলেছে যেন সমুদ্রে ঝড়ে পড়া নৌকো! এই বাঁদিকে হেলে, তো পরমুহূর্তেই ডাইনে কাত — সেদিকে আবার বাগলুংখোলা — খলখল করে হাসতে হাসতে ছুটতে ছুটতে হাততালি দিচ্ছে — ‘আয় কোলে আয়’। মা কালী মৌলা আলী সবার নাম ভুলে গিয়েছি। আস্ত অবস্থায় পৌঁছলে হয়।

বেলা দু-টো পঁয়ত্রিশ

গলেশ্বর ধাম। বাবা গলেশ্বর, প্রাণ কন্ঠাগত — বাঁচাও বাবা!

বেলা তিনটে তিন

বৈঁসরি। যতই সুন্দর হোক, এখন সবই বেসুরো।

বেলা তিনটে তেত্রিশ

বেগখোলা। বেগ যা আছে থাক, একটু খোলা বাতাস দাও মা।

বেলা তিনটে বেয়াল্লিশ

তিপল্যাং। বাসটা যে অনবরত ল্যাং খেতে খেতে চড়াই ভাঙছে!

বেলা চারটে চোদ্দো

রাতোপানি। গতবার ঘোড়েপানি থেকে এখানে নেমে আসতে আক্ষরিক অর্থে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল।

বেলা চারটে চব্বিশ

ঘারখোলা সঙ্গম। দেখব কী, ঘাড় নাড়ানোই মুশকিল। আবার কালীগণ্ডকী, এবার আর ওর সঙ্গ ছাড়া নেই।

বেলা চারটে চৌত্রিশ

তাতোপানি। তিন দিনের পথ তিন ঘন্টায়। ভাবা যায়! তবে কইটা একটুও কম হয়নি। এখানে দশ মিনিটের বিরতি। বাস থেকে নেমে দেখলাম, বেঁচে আছি। নিজেদের জ্যান্ত দেখে খুশিতে চা খেয়ে ফেললাম।

বিকেল চারটে চুয়ান্ন

নাচতে নাচতে চলেছি — হাত পা ছড়িয়ে। তাতোপানিতেই বাস অর্ধেক ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।

বিকেল পাঁচটা এগারো

দানা। পাখিরা ভাগ্যিস খোঁজ পায়নি।

বিকেল পাঁচটা আঠাশ

তিতর দানা। তিতির পাখি আর দানা একসাথে!

বিকেল পাঁচটা চল্লিশ

পাথুরে পথের ওপর ঝোরার জল। বাসের চাকা পিছলোচ্ছে। উঠতে গিয়ে গড়িয়ে আসছে নিচে।

বিকেল পাঁচটা পঞ্চাশ

পেরেছে, বাস ঝোরাপার করতে পেরেছে। জয় বাবা সত্যপীর, সিন্নী তোমার বাঁধা ।

বিকেল পাঁচটা বাহান্ন

সিন্নিটা বোধহয় বড্ড তাড়াতাড়ি কবুল করে ফেললাম । পরের বাঁকেই আবার হড়কানো। এই ঠাণ্ডাতেও ঘাম হচ্ছে ।

সন্ধে পাঁচটা আটান্ন

এটাও পার হলো বাস। ড্রাইভারকে ভারতরত্ন, থুড়ি, নেপালরত্ন দেওয়া উচিত। রোজ এ পথে যাতায়াত করে!

সন্ধে ছ-টা ছয়

কাবরে। হাঁফ ছেড়ে বাচলাম, বাপ্‌রে! পথ এখন আর ততটা অ্যাডভেঞ্চারাস নয়, তবে আঁধার বটে। হেডলাইট আর ড্রাইভারের হাতযশ ভরসা।

‘রাত’ ছ-টা চুয়াল্লিশ

ঘাসা। আবার মাটিতে পা রাখতে পেরে খাসা লাগছে ।

'রাত' ছ-টা বাহান্ন

এই মরেছে! হোটেলে ঠাঁই নেই যে।

রাত সাতটা সাত

অবশেষে মিলল ঠাঁই। আঁধারে আন্দাজে নেমে অন্য গেস্ট হাউসে দু-বেডের ‘কামরা’য় ঠাঁই পেলাম। চওড়ায় পাঁচ ফুট হলেও ঘর তো!

তেরোই অক্টোবর; সকাল ছ-টা ছত্রিশ

এক ঘুমে রাত কাবার। শেষভোরের আলোয় মন্দ লাগছে না ঘাসাকে। ছোট্ট একটা ঝোরাও আছে।

সকাল সাতটা একুশ

জুমসুম-য়ের বাসে বসেছি । খানিক আগে টিকিট কেটে মাল ঘাড়ে করে বাসস্ট্যান্ডে এসেছি । আকাশ এখন দিব্বি ফরসা ।

সকাল সাতটা পঞ্চাশ

বাস ছাড়ল । রাস্তা তো ভালোই মনে হচ্ছে ।

সকাল আটটা দুই

থামল বাস; নেমে ছুটলাম চেকপোস্টে ‘খোদায় মালুম কিসের’ পারমিট করতে ।

সকাল আটটা দশ

নগদমূল্যে পারমিট পকেটস্থ করে আবার বাসে । এবার বাস চলল বেশ মেজাজেই । সকালের ফুরফুরে হিমেল বাতাসে মন চাঙ্গা ।

সকাল আটটা আট

লেতে। যাব্বাবা! সেই রক্ত জমিয়ে দেওয়া বিশাল ধ্বসটা কোথায় গেল?

সকাল আটটা বত্রিশ

হুশ করে পেরিয়ে যাচ্ছি কালোপানি। প্রাণ ভরে ধৌলাগিরি, টুকুচে, ধামপুস, অন্নপূর্ণাদের দেখতেই পারছি না।

সকাল ন-টা

কালীগণ্ডকীর অববাহিকায় উপবাস-ভঙ্গের বিরতি। চা-সিঙাড়া খাবো কী, কালীগণ্ডকীর বিস্তার দেখেই পেট ভরে গেল। তার ওপর একদিকে টুকুচে, ধামপুস, অন্যদিকে অন্নপূর্ণা, নীলগিরি; কাকে ছেড়ে কাকে দেখি!

সকাল ন-টা বারো

কালীগণ্ডকীর সঙ্গী হয়ে তার উজানে চলা। তুষারশিখরের মাথায় মেঘের বিচিত্র মুকুট।

সকাল ন-টা বত্রিশ

লারজুং। গতবার এখানে এক টাকা কিলো দরে (আমাদের হিসেবে ৬০ পয়সা) আপেল কিনেছিলাম।

সকাল ন-টা চল্লিশ

কোবাং ।

সকাল ন-টা বাহান্ন

টুকুচে। দু-টো নতুন টায়ার সহযাত্রী হলো।

সকাল দশটা বারো

রতনপুর। বাস পুরে লোক উঠল। কোনও উৎসবে চলেছে মনে হয়। সবচেয়ে নজরকাড়া টকটকে লাল সাটিনের পোশাকপরা একজন আশি পেরোনো ‘যুবতী’।

সকাল দশটা ষোলো


মারফা
মারফা । আরও লোক, কে জানে কোন মন্ত্রে, বাসে উঠল ।

সকাল দশটা একত্রিশ

স্যাং । ড্যাং ড্যাং ড্যাং করে পেরিয়ে এলাম । বহুক্ষণ ধরে ন্যাড়া পাহাড় আমাদের পাহারাদার ।

সকাল দশটা ছেচল্লিশ


জোমসোম, হোটেল ম্যাজেস্টির ঘর থেকে

জুমসুম। বাসযাত্রার ইতি। পিছন ফিরলে টুকুচের ওপর দিয়ে ধৌলাগিরির উঁকিঝুঁকি। অন্যদিকে দূর থেকে ইয়াকাওয়া কাং ‘টুকি’ বলছে, আর ঘাড়ের ওপর সহাস্য নীলগিরি। মাঝে শুধু একটা খেলনা এয়ারপোর্টের ফারাক ।

বেলা এগারোটা পঞ্চাশ

খেয়েদেয়ে হোটেল ছেড়ে খানিক এগোতেই দেখতে পেলাম সেই হোটেলটা, যেখানে ১৯৯৩-তে এসে উঠেছিলাম। মুহূর্তে কত স্মৃতি ভিড় করে এলো। পাথরবাঁধানো জুমসুমের এই এক মাত্র পথটা গিয়ে শেষ হয়েছে হাসপাতালের কাছে। গাড়ির দৌড় এ পর্যন্তই। এরপর কালীগণ্ডকীর ওপর পুল পেরিয়ে পুরোনো জুমসুম গ্রাম পেরোলেই আবার গাড়িপথ — এবার একেবারে মুক্তিনাথ পর্যন্ত। আগামীকাল আমরা এ পথেরই যাত্রী হব। পুলের ওপর থেকে কালীগণ্ডকীর বাঁক খাওয়া চেহারা, তার পারে হলদে, তামাটে, সবুজ গাছের সারি, তার পিছনেই ন্যাড়া পাহাড় — আর সবার ওপরে নীলগিরি পাহারায়। মুস্তাং জেলার দুরন্ত বাতাসে রঙীন নিশানগুলো অদ্ভুত সব বক্ররেখা সৃষ্টি করেছে। সব মিলিয়ে মন ভুলানো ছবি। মাঝে মধ্যে মেঘ এসে সূয্যিমামাকে আড়াল করলেও সে পরদা সরাতে মামার বেশি সময় লাগছে না ।

দুপুর দু-টো বাইশ


'নীলগিরি' জোমসোম থেকে

হোটেলেই এয়ারলাইন্সের অফিস। কোন কথায় মজে কে জানে, পরশুর দু-খানা টিকিট কেটে ফেললাম। মনের ভেতর বোধহয় বেনি-ঘাসা বাসযাত্রাটা বাসা বেঁধে ছিল। আগামীকাল সক্কাল সক্কাল রওনা হয়ে মুক্তিনাথ দর্শন সেরে সন্ধেবেলা জুমসুমে ফেরৎ; পরশু পোখরা। পারমিটও চেক করিয়ে রাখলাম। এখন খানিক বিশ্রাম। জানালা দিয়ে তাকালেই এয়ারপোর্টের ওধারে নীলগিরির সুবিশাল উপস্থিতি; ডানদিকের কোণায় টুকুচের মাথা ছাড়িয়ে ধৌলাগিরির উঁকি। তবে, সেখানে এখন মেঘেদের ভাতঘুম চলছে। আর দূরে অন্নপূর্ণা । লেপ গায়ে দিয়ে এমন দিন কাটানো সহসা কপালে জোটে না। ঘরের ভিতরেই এখন সতেরো ডিগ্রি।

বেলা চারটে চুয়াল্লিশ


জোমসোম থেকে মুক্তিনাথের দিক

বেরিয়েছিলাম ‘ইভনিং ওয়াকে’। আকাশে মেঘেরা মৌরসীপাট্টা জমাচ্ছে। ধৌলাগিরি, টুকুচে, এমনকী নীলগিরিও হাপিস। তাপমাত্রা সাতে নেমেছে, আর দ্রুত নেমে চলেছে।

বেলা পাঁচটা পাচ

বৃষ্টি পড়তে শুরু করতেই ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। ঘরের ভিতরেই এখন ছয় - বাইরে না জানি কত! লেপ জড়িয়ে চা-পকোড়ায় কালকের পরিকল্পনা চলছে।

রাত আটটা

রাতের খাবার সারছি ডাইনিং হলে বসে। সারা দুনিয়া বুঝি প্রতিনিধি পাঠিয়েছে জুমসুমে। ভারতের প্রতিনিধি আমরা। বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই, উলটে তার বেগ যেন বাড়ছে ক্রমশ। কাল সকালে ক্লিয়ার হবে তো?

চোদ্দোই অক্টোবর; সন্ধে ছ-টা ছয়


বৃষ্টিস্নাত জোমসোমে মাটির পাহাড়

চব্বিশ ঘন্টার ওপর ‘অবিরাম সাইকেল চালানো প্রতিযোগীতা' – র মতো বৃষ্টি চলছে। ঘরের ভিতরেই তিন ডিগ্রি। দুপুরে একবার বেরোবার চেষ্টা করেছিলাম। বৃষ্টি আর ঠাণ্ডার থাপ্পড় খেয়ে সুবোধ বালকের মতো ব্যাক টু দ্য লেপল্যান্ড। দিনটা কাটল লেপের তলায়, রাতটাও তা-ই হবে। কালকেও যদি দুর্যোগ না কমে, যে ভাবেই হোক নেমে যেতে হবে। প্লেন না এলে বাসে, ভাড়াগাড়িতে — এমনকী পায়ে হেঁটে (জানি না সেটা পারব কী না) হলেও এবার নেমে যেতে হবে। ছুটি, পয়সা, ভরসা, উদ্যম, সাহস সব কিছুতেই ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।

পনেরোই অক্টোবর; ভোর ছ-টা

আকাশে নীলের ছটা। ধৌলাগিরি, নীলগিরির মাথায় আগুন লেগেছে। পূষণের আশিসকিরণ সমস্ত ভয়ডর মুছে দিয়েছে। তাপমাত্রাও উৎসাহব্যঞ্জকে - ৫ ডিগ্রির ওপর।

সকাল সাতটা সাতচল্লিশ

প্লেনের অপেক্ষা বোধহয় শবরীর প্রতীক্ষা হতে চলেছে। এখানে আকাশ পরিস্কার হলেও পোখরার আকাশ নাকি মেঘলা। সেখান থেকে প্লেন উড়তে না পারলে এখানে অশ্বডিম্ব।

সকাল ন-টা নয়

আর বিলম্ব নয় নয়, আর বিলম্ব নয় —। আজকের বিমানযাত্রা বাতিল। অতএব, মারফা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া যাক।

সকাল দশটা চার

পুরোনো পথে পদচারণা! আহ্, কী আরাম! নীলগিরি থেকে শুরু করে অন্নপূর্ণা, ধৌলাগিরি, টুকুচে, ধামপুস — সবাই নিষ্কলঙ্ক শুভ্রতার প্রতীক। এমনকী, কিছু ন্যাড়া পাহাড়ও মাথায় গান্ধীটুপি পরেছে। স্যাং পেরিয়ে আমরা মারফার দিকে মার্চ করছি। খালিপিঠে হাঁটার আনন্দই আলাদা। একটা অন্য এয়ারলাইন্সের প্লেন জুমসুমে নামতে চলেছে।

সকাল দশটা ছাপান্ন

কালীগণ্ডকীর সঙ্গে কাটাকুটি খেলে ছোট্ট চড়াইয়ের দোরগোড়ায়। এর ওপারেই মারফা — হেরিটেজ গ্রাম ।

সকাল এগারোটা এগারো

মণিদেওয়াল পার করে বাসপথ ছেড়ে তোরণ পেরিয়ে মারফার পাথুরে পথ পিছিয়ে নিয়ে গেল একুশ বছর। মারফার রূপ থমকে আছে একইভাবে।

দুপুর বারোটা সাত

সেই গলি, সেইসব বাড়ি — হাজার বছর ধরে এখানে থমকে আছে সময়। একুশ বছর আগে দেখা আপেলবাগান, পাথুরে বাড়িঘর, ছোট্ট পোস্ট অফিস, দোকানপাট, কিচ্ছু পাল্টায়নি। শুধু হোটেলগুলোর সাইন বোর্ড আরেকটু আধুনিক হয়েছে। তাড়াহুড়ো শব্দটা এখানে অচেনা, আগের মতোই। এই ফসিল শহরে মানুষের যাতায়াত কৃচিৎ।

দুপুর বারোটা বত্রিশ

চায়ের সুশোভন কাপে শেষ চুমুকটুকু দিয়ে এবার ওঠার পালা।

দুপুর বারোটা তিপান্ন

অলস কদমে ফেরার পথে দেখতে পেলাম একটা হেলিকপ্টার। বোধহয় কোনও এক্সপিডিশনে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। রেসকিউ করতে এসেছে। এছাড়া এদিকে হেলিকপ্টার আসার অন্য কোনও ব্যাখ্যা নেই।

দুপুর একটা সাতাশ

স্যাং পেরোচ্ছি। আবার হেলিকপ্টার! দুর্ঘটনাটা বেশ বড়সড়ই মনে হচ্ছে।

দুপুর একটা তিপান্ন

জুমুসুম। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি এসেই জানতে পারলাম, দুর্ঘটনাটা ঘটেছে থোরাং-লায় । কালকের ওই ঝড়বৃষ্টি ওখানে তুষারঝঞ্জার চেহারা নিয়েছিল। হতাহত যে কত, কেউ জানে না। তবে আজ দুপুর পর্যন্ত উনিশজনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। সেইসব মৃতদেহ আর আহতদের উদ্ধার করতেই হেলিকপ্টারের যাতায়াত। জুমসুম হাসপাতালেই তিনজন বিদেশীর চিকিৎসা চলছে। তাদেরও হেলিকপ্টারে পাঠানো হচ্ছে কাঠমান্ডুতে। এতগুলো নিরীহ প্রাণ – ও:।

বেলা দু-টো বাইশ

হোটেলের ডাইনিং হলে বসে আছি টি. ভি. তে চোখ রেখে। এই দু:সংবাদ আমাদের কাছে যেমন অসম্ভব বেদনার কারণ, তেমনই স্বস্তিরও — আমার কাফ মাস্‌লে টান না ধরলে আমরাও ঠাঁই পেতাম ওই মৃতদেহের স্তূপে — কালই ছিল আমাদের থোরাং-লা পেরোবার দিন। এই অসহায় মানুষগুলোর মতো আমাদের দেহও কফিনবন্দী হয়ে ফিরত। বরফ চাপা পড়ে মৃত্যু কী মর্মান্তিক!

‘বিকেল’ ছ-টা সাতাশ

থোরাং-লা থেকে প্রায় অক্ষত অবস্থায় বেঁচে ফেরা একজন আমাদের পাশের ঘরেই উঠেছেন। তাঁর বয়ান অনুযায়ী — পরশু রাত থেকেই আবহাওয়া খারাপ ছিল। উনি ছিলেন হাইক্যাম্পে। পরদিন রাত তিনটেয় লক্ষ করেন থোরাং ফেদি থেকে অভিযাত্রীরা রওনা দিয়েছেন। আবহাওয়া তখনও খারাপ — হালকা তুষারপাতও হচ্ছে। পাঁচটা নাগাদ যখন নিচের লোকেরা হাইক্যাম্পের কাছে পৌঁছে গেল, কপাল ঠুকে উনিও বেরিয়ে পড়লেন। পাসের কাছাকাছি পোঁছতেই আবহাওয়া আরও খারাপ হয়ে গেল — কমপ্লিট হোয়াইট-আউট। পাসে যখন পৌঁছলেন, হাওয়ার বেগ বেড়েছে, বেড়েছে তুষারপাতও। অভিযাত্রীরা খানিকটা আতঙ্কিত হয়েই তাড়াতাড়ি পাসের ওপারে চলে যেতে চাইলেন, এই তুফানের হাত থেকে রক্ষা পেতে। ওপারে আবহাওয়া নিশ্চয়ই এমন নয়। কিন্তু ঘটল ঠিক উল্টোটা। পাস থেকে নামা শুরু করতেই ৭০-৮০ কি.মি. বেগে তুষারঝঞ্জা আছড়ে পড়ল। মুহূর্তে দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক ছিটকে পড়লেন অধিকাংশ অভিযাত্রী। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় এক হাঁটু বরফ জমে গেল পাহাড়ের ঢালে — তুষারঝঞ্জা অব্যাহত। অনেকেই সেই তুষারে চাপা পড়ে গেলেন। অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবানেরা এরই মধ্যে নেমে চললেন — মুক্তিনাথ ফেদির আগে কোনও আশ্রয় নেই। প্রায় ১৭৭০০ ফুট থেকে এই মারাত্মক ঢাল বেয়ে অন্তত ১৩০০০ ফুট নামতে পারলে, তবেই প্রাণে বাঁচার আশা আছে। বক্তা অভিজ্ঞ পর্বতারোহী হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় মুক্তিনাথ পৌঁছতে সক্ষম হন বিকেল তিনটেরও পর। উনি বললেন, 'ভগবানকে ধন্যবাদ যে, আমি এখনও বেঁচে আছি’।

ষোলোই অক্টোবর; ভোর পাঁচটা তেত্রিশ

সূর্যোদয়ের আগুন তুষারশৃঙ্গের মাথায়। আবহাওয়া পরিষ্কার। তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি, আজকের প্লেনে নাকি জায়গা পাব।

সকাল ছ-টা ছেচল্লিশ


জোমসোম থেকে 'নীলগিরি'

রোদ মাখতে সবাই বাইরে বেরিয়েছে। এমনকী নীলগিরি পর্যন্ত রোদ্দুর মেখে খুশিতে ঝলমল করল। দু-দিন আগের ভয়ানক ঘটনাটা যেন ঘটেইনি। একটা নেপালী ছেলে দু-পায়ে ফ্রস্ট বাই্ট নিয়ে অপেক্ষা করছে ফেরার প্লেন ধরার। চোখেমুখে এখনও আতঙ্কমাখা। ও বলছিল, 'আমরা চারভাই বেরিয়েছিলাম। বাকি তিনভাই কোথায় আমি জানি না’। বলার সময় ওর মুখটা যন্ত্রণায় নীল হয়ে উঠেছিল। তাপমাত্রা এই রোদ্দুরেও ২ ডিগ্রি।

সকাল সাতটা সাঁইত্রিশ

হেলিকপ্টারের আনাগোনা চলছে — তার মানে রেসকিউ চলছে। আজ এখন পর্যন্ত ২০ তা মৃতদেহ এসেছে। আরও নাকি আসবে । এই মৃত্যুমিছিলের কি শেষ নেই!

সকাল দশটা দুই

চেক ইন হয়ে গেছে। এয়ারপোর্ট ভরতি যাত্রীতে। বেশিরভাগই বিদেশী। বেশিরভাগই আহত নয় আতঙ্কিত।

সকাল দশটা উনিশ

খেলনা টারম্যাকে খেলনা প্লেনের অপেক্ষায়। ওধার থেকে নীলগিরি মজা দেখছে।

সকাল দশটা পঞ্চাশ

ফ্লাইট উড়ল। জানালা দিয়ে নীলগিরি, টুকুচে আর ধৌলাগিরি বিদায় জানাচ্ছে। জুমসুম ছোট হতে হতে ছবি হয়ে গেল।

সকাল দশটা পঞ্চান্ন

অন্নপূর্ণা উঁকি মারছে জানালা দিয়ে।

সকাল এগারোটা সাত

মাছাপুছারে বলল, পোখরা এসে গেছে।

সকাল এগারোটা দশ

পোখরা। একটা দুখস্মৃতি জড়ানো ভণ্ডুল ভ্রমণের ইতি ঘটল।



(পরবাস-৬২, মার্চ - এপ্রিল, ২০১৬)