Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে অনন্যা দাশের
লেখা


বই


ISSN 1563-8685




বাঁশিওয়ালা

খেলার মাঠ ছেড়ে আমি যখন বাড়ির দিকে ছুটছি তখন রাগে আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে! অর্ক আর দীপ আমাকে আবার ‘লেংড়ু’ বলে ডেকেছে!

উফফ্‌, আসল কথাটাই তো বলা হয়নি। আমার নাম শীর্ষ। ছোটবেলা থেকেই আমার একটা পা অন্য পায়ের চেয়ে একটু ছোট, সেই জন্যে আমার হাঁটাটা একটু অন্যরকম। তাতে আমার কোন অসুবিধা হয় না। হাঁটতে, ছুটতে, ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং—সব কিছুই আমি করতে পারি। ফিল্ডিংয়ে বলটা খুব দূরে চলে গেলে দৌড়ে যেতে একটু সময় লাগে। কিন্তু তাতে কী? অর্কর ভাই অর্ঘ্যও তো একদম দৌড়তে পারে না, পা-টা ঠিক থাকা সত্ত্বেও। আমার যেটা সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে সেটা হল অঙ্কের হোমওয়ার্ক টুকলি করার সময় অর্ক আর দীপ আমার খাতাটা চাইবে আর বিকেলবেলা খেলার মাঠে আমি ‘লেংড়ু’ হয়ে যাই। ভীষণ রাগ হয় আমার। আজ কয়েকটা অন্য ছেলে চলে এল বলে আমাকে খেলা থেকে একেবারে বাদই দিয়ে দিল ওরা!

আর কী সব ভাষা,

“লেংড়ুকে টিমে নিয়ে কাজ নেই আর,
এক রানের বলটা হয়ে যাবে চার,
দুম দাম টুপ টাপ পড়ে যাবে ক্যাচ,
আর ওই করেই আমরা হেরে যাব ম্যাচ!”
ওরা ভাবছিল আমি শুনতে পাব না কিন্তু আমি ঠিকই শুনেছি। রাগে দুঃখে বুক ফেটে যাচ্ছে আমার। চোখে জলও এসে যাচ্ছিল। এখুনি বাড়ি গেলে সবাই দেখে ফেলবে বলে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে চট করে জামার হাতাটা দিয়ে চোখের জল মুছে ফেলছিলাম।

হঠাৎ কে যেন বলল, “শীর্ষবাবুর মনে দুঃখ হয়েছে বুঝি?”

আমি চমকে ফিরে তাকালাম। দেখি একটা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকে আমি মোটেই চিনি না। গায়ে একটা আধময়লা জামা আর তাপ্পি দেওয়া প্যান্ট। আমার দিকে তাকিয়ে আবার মিটিমিটি হাসছে। কে রে বাবা লোকটা? আমার নামই বা জানল কী করে? এর আগে একে কখনও পাড়ায় দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।

“ওই সব পাজি ছেলেগুলোকে পাড়া থেকে একেবারে সরিয়ে ফেললে বেশ হয়, তাই না?”

“কে তুমি? আমার নাম জানলে কী করে?”

আমার প্রশ্ন শুনে লোকটা বিশ্রী খ্যাক খ্যাক করে হাসল, “আমি রোজ মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে তোমাদের খেলা দেখি। তোমার বন্ধুগুলো বড্ড পাজি, বেশ কিছুদিন ধরেই দেখছি। তুমি বললেই কিন্তু ওদের অনেক দূরে সরিয়ে দিতে পারি!”

আমি ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকালাম, লোকটা বলে কী? “সরিয়ে দেবে মানে?”

লোকটা আমার কানে কাছে মুখটা নামিয়ে নিয়ে এসে বলল, “মানে গায়েব, হাপিশ, ভ্যানিশ, হাওয়া! আবার কী!” বলে ম্যাজিকের ঢঙে হাতদুটো হাওয়ায় ঘোরাল।

আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল। ফিসফিস করে বললাম, “কী করে করবে?”

লোকটা প্যান্টে গোঁজা একটা বাঁশি বার করে বলল, “কী করে করব সেই নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। এটাই আমার কাজ। সেই কবে থেকে করে আসছি!”

“সব দুষ্টু ছেলেদের হাপিশ করে দিতে পারো? ভারি মজা তো!”

“হ্যাঁ, মজা তো বটেই। তা হলে বলো রাজি তো?”

“অর্ক, দীপ, টিটু, নিকু কেউ থাকবে না বলছ? তোমাকে কী ওদের নামের লিস্ট করে দিতে হবে? নাহলে তুমি বুঝবে কী করে?”

“না, না, নাম লিখে টিখে দিতে হবে না। আমার বাঁশির আওয়াজ শুনেই সব দুষ্টু ছেলেমেয়েরা ছুটে আসে। একেবারে অব্যর্থ!”

আমি এবার বেশ উৎসাহিত বোধ করছিলাম, “কবে হবে?”

“পরশুদিন। তুমি খেলার মাঠে যখন যাবে তখন আর ওদের দেখতে পাবে না।”

“সত্যি?” আমি আনন্দে প্রায় চিৎকার করে উঠলাম।

লোকটা এবার গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, “ঠিক করে ভেবে বলো কিন্তু। একবার হ্যাঁ বলে কিন্তু আর পিছিয়ে যেতে পারবে না। তখন পিছিয়ে গেলে কিন্তু ‘মেহেঙ্গা পড়েগা’।”

“মানে?” আমার যে এবার একটু ভয় ভয় করছিল না তা নয়।

বাঁশিওয়ালা লোকটা বুঝল আমি ভয় পেয়েছি, তাই আশ্বাসের হাসি হেসে বলল, “না, না, তেমন ভয়ঙ্কর কিছু নয়। তুমি যদি একবার ‘হ্যাঁ’ বলে তারপর পিছিয়ে যাও তাহলে তোমার সব চাইতে প্রিয় জিনিসটা আমাকে দিয়ে দিতে হবে। মিথ্যে কথা বললে চলব না কিন্তু, কারণ আমি ভালই জানি তোমার সব চাইতে প্রিয় জিনিসটা কী!”

আমার কানে তখনও ওদের ‘লেংড়ু’ ডাকটা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তাই আমি আর কিছুই শুনতে পেলাম না। মাথা নেড়ে বলে দিলাম, “হ্যাঁ, আমি রাজি।”

লোকটা চট করে বাঁশিটা প্যান্টে গুঁজে ফেলে বলল, “ঠিক আছে, এবার আমি চললাম। ওদিক থেকে সরকারবাবু আসছেন। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা। কাউকে কিছু বোলো না যেন। তাহলে আর বাঁশির জাদু কাজ করবে না,” বলেই সুড়ুৎ করে কোথায় না জানি চলে গেল লোকটা।

লোকটা চলে যাওয়ার পরও দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। সরকারজেঠু পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললেন, “কী শীর্ষ কেমন আছো? কার সঙ্গে কথা বলছিলে?”

“ও কেউ না, এমনি একটা লোক ঠিকানা জানতে চাইছিল।”

“ও আচ্ছা। দেখো বাপু অচেনা লোকের সঙ্গে কথাটথা বোলো না, যা দিনকাল পড়েছে। তা তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”

“উঁ, ওহ হ্যাঁ, পড়াশোনা ভালই চলছে। আচ্ছা জেঠু আমি চলি। পরে কথা হবে,” বলে কোনোরকমে জেঠুর খপ্পর থেকে বেঁচে পালালাম।


বাড়ি যখন পৌঁছলাম তখন আমি হাঁপাচ্ছি।

তুলি আর ওর বন্ধুরা মনে হয় আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখেই তুলি ছুটে এল, “এই দাদা তুই এসে গেছিস। আমাদের পুতুলের বিয়ের জন্যে শামিয়ানা খাটিয়ে দিবি? আমরা উঁচু করে খাটাতে পারছি না,” বলে তুলি মার একটা দামি ভালো শাড়ি আমার দিকে এগিয়ে দিল।

“এ কী! তুই মার ভালো শাড়ি নিয়েছিস শামিয়ানা খাটানোর জন্যে? এটা মা কাল বিয়েবাড়িতে পরে গিয়েছিল না? মাকে জিগ্যেস করেছিস? মা তো ভয়ানক রাগ করবে রে!”

দুষ্টু তুলি ঠোঁট উল্টে বলল, “মা তো সীমামাসির বাড়িতে গেছে। হারুদা নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্ছে। কাকে জিগ্যেস করব?”

তুলির দুই বন্ধু সোনালি আর রেশমিও ওর সঙ্গে যোগ দিল, “হ্যাঁ, দাদা টাঙ্গিয়ে দাও না, এই দেখো পুতুলগুলোকে কী সুন্দর সাজিয়েছি বিয়ের জন্যে!”

পুতুলগুলোকে দেখে আরও চমকে উঠলাম আমি। মার ড্রেসিং টেবিল থেকে লিপ্‌স্টিক, ফেস পাউডার আরো কী কী সব নিয়েছে মেয়েগুলো!

তুলির ফর্সা টুকটুকে মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমার মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। কী যেন বলেছিল বাঁশিওয়ালা লোকটা? ... সব দুষ্টু ছেলেমেয়েদের গায়েব করে দেবে। আরে আমার সামনেই তো তিনটে দুষ্টু মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে! ঘুমন্ত হরিদাকে টিপ পরিয়ে দিয়েছে কপালে। মার ভালো শাড়ি, মেকাপ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছে।

এ বাবা, কী হবে এবার? রাগের মাথায় আমার বুদ্ধিসুদ্ধি সব লোপ পেয়েছিল মনে হয়, না হলে কিছুতেই এই রকম ভুল আমি করতাম না। আমার আশপাশেই তো কত দুষ্টু ছেলেমেয়ে আছে যাদের আমি ভীষণ ভালবাসি! আমার একটা ভুলের জন্যে ওদের সবাইকে বাঁশিওয়ালার সঙ্গে চলে যেতে হবে। হঠাৎ বইটার কথা মনে পড়ে গেল আমার।

তুলিকে বললাম, “দাঁড়া হরিদাকে তুলে দিচ্ছি। মার কোন একটা পুরনো শাড়ি দিয়ে শামিয়ানা খাটিয়ে দেবে। হরিদা তো আমার থেকেও লম্বা তাই আরো উঁচু করতে পারবে।”

হরিদাকে ঘুম থেকে তুলে ঘরে গিয়ে বইয়ের আলমারি থেকে বইটা বার করলাম আমি। হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা প্রথমে শহরের ইঁদুরদের তাড়িয়ে তারপর পয়সা না পেয়ে শহরের সব বাচ্চাদের কোথায় যেন নিয়ে চলে গিয়েছিল। অর্ক আর দীপ আমাকে জ্বালায় বটে কিন্তু কাকু-কাকিমা তো ওদের বকেন সেটা করার জন্যে। অর্ক আর দীপ দুজনেই হাওয়া হয়ে গেলে ওদের মা-বাবাদের কী দশা হবে। ছি ছি কী স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম আমি। না ভেবে কাজ করেছি, তাই তার খেসারত আমাকে দিতে হবে এবার।

নিজের সব চেয়ে প্রিয় জিনিসটা নিয়ে আমি যখন মাঠের ধারে গেলাম তখন সন্ধে প্রায় নেমে এসেছে। মাঠে যারা খেলছিল তারা সবাই বাড়ি চলে গেছে। আমি খানিক জোরে জোরে ‘বাঁশিওয়ালা’, ‘বাঁশিওয়ালা’ বলে ডাকলাম কিন্তু কেউ এল না। ভয়ে আমার হাত-পা হিম, আমি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলতে লাগলাম, “বাঁশিওয়ালা, তোমার কাছে যা চেয়েছিলাম সেটা আমার আর চাই না। আমার সব চাইতে প্রিয় জিনিসটাও এনেছি – মিথ্যে নয় সত্যি! কোথায় তুমি? বাঁশিওয়ালা ও বাঁশিওয়ালা!”

চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আমার গলা ধরে গেল কিন্তু বাঁশিওয়ালা এল না। কাঁদতে কাঁদতে কিসে একটা হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম আমি। দেখলাম জুতোর ফিতেটা খোলা। সেটা বাঁধতে গিয়ে হাতের জিনিসটা পাশে রাখলাম। এবার কী হবে, কী করব, ভাবতে ভাবতে ফিতেটা বেঁধে জিনিসটা তুলতে গিয়ে দেখি সেটা নেই! তার বদলে পড়ে রয়েছে এক টুকরো কাগজ! রাস্তার আলোতে দেখলাম কাগজে আর কিছু লেখা নেই শুধু একটা বাঁশির ছবি আঁকা। বাঁশিওয়ালা কী তার মানে সত্যি এসেছিল? কিন্তু তাহলে আমার সঙ্গে কথা বলল না কেন? যাক জিনিসটা যখন নিয়ে গেছে তখন কাজটা করবে না মনে হয়। কাগজটা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম আমি। খুব বকুনি খেয়েছিলাম সেদিন রাত অবধি বাইরে থাকার জন্যে।

তারপর বেশ কয়েকদিন ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছি—বাঁশিওয়ালা তার কথা রাখবে তো ভেবে, ভেবে। চার-পাঁচদিন পর আমার ভয়টা চলে গেল। তখন আমাকে ‘লেংড়ু’ বলে ডাকলেও আমার আর রাগ হত না।

###

“বাপি দেখো, ঠাম্মা তোমাকে যে পুরনো বইগুলো দিয়েছেন তার মধ্যে থেকে কী পেয়েছি!”

আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার মেয়ে তিন্নির হাতে সেই কত বছর আগে বাঁশিওয়ালার ফেলে যাওয়া বাঁশি আঁকা কাগজটা!

“দাও, আমাকে দাও ওটা,” বলে তিন্নির হাত থেকে কাগজটা নিয়ে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিলাম ওটাকে। কী যে বোকা ছিলাম! লোকটা বেদম বোকা বানিয়েছিল আমাকে। দুষ্টু ছেলেমেয়েদের গায়েব করে দেবে! যাক, তবে ঘটনাটা ঘটার পর অন্য ছেলেগুলোর ওপর থেকে রাগটা চলে গিয়েছিল আমার।

“বাপি তুমি স্ট্যাম্প জমাতে বুঝি?” তিন্নির হাতের জিনিসটা দেখে আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম। ওই স্ট্যাম্প অ্যালবামটাই তো আমার তখনকার সব চেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল—যেটা আমি বাঁশিওয়ালাকে দিয়েছিলাম ওর দুষ্টু ছেলেমেয়েদের গায়েব করার বীভৎস কাজটাকে আটকানোর জন্যে!



(পরবাস-৬২, মার্চ - এপ্রিল, ২০১৬)