Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে মীরাতুন নাহারের
লেখা


ISSN 1563-8685




ইস্‌মত চুঘতাই-এর "মাসুমা" উপন্যাসে লেখিকার বার্তাবলী

মীরাতুন নাহার



(ইস্‌মত চুঘতাই; ১৯১৫ - ১৯৯১)


Masooma: A Novel—Ismat Chughtai; Translated from Urdu by Tahira Naqvi; Women Unlimited (Publisher); Pgs. 152; ISBN: 978-8188965663

স্বনামখ্যাত এবং বিতর্কিত উর্দু লেখিকা ইসমত চুঘতাই (১৯১৫-১৯৯১)-এর 'মাসুমা' উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে এবং ইংরেজি ভাষায় সেটি অনুবাদ করেন ইংরেজি ছোটগল্প লেখিকা ও উর্দু রচনাদির অনুবাদিকা তাহিরা নাকভী। অনুবাদটি ভারতে প্রথম প্রকাশিত হয় নিউ দিল্লিতে ২০১১ সালে। উপন্যাসটিতে লেখিকার অভিনব লেখনভঙ্গি, গভীর রসবোধ, কঠোর-কঠিন বাস্তবকে উপস্থাপন করার মুন্সিয়ানা এবং ভারতীয় নারীজীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত দেশ-কালোত্তীর্ণ ভাবনা প্রকাশ করার অর্ন্তদৃষ্টি ও সক্ষমতা চমকে দেওয়ার মতো। উপন্যাসটিতে ব্যক্ত বার্তাবলীর প্রাসঙ্গিকতা বিশেষভাবে ভাবায় পাঠক ও সমালোচকসহ সকল সাহিত্যানুরাগী দেশবাসীকে। বর্তমান নিবন্ধে সেই সত্যকেই তুলে ধরার প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছে গ্রন্থ-আলোচনার সংক্ষিপ্ত পরিসরে।

মাসুমা কাহিনীর মূল চরিত্র। সে ভারতের এক উচ্চপদস্থ ধনী পিতার সন্তান। তরুণী বয়সে তার বাবা নতুন জায়গায় বদলির সুযোগ নিয়ে তাদের তিন বোন-সহ মাকে ছেড়ে কেবল পুত্রদের নিয়ে চলে যায় এবং আর তাদের কাছে ফিরে আসেনি। তার মা কিছুদিন গহনা ও জিনিসপত্রাদি বিক্রি করে সংসার চালায়। তারপর আর না পেরে মেয়েদের নিয়ে বোম্বাই শহরে চলে যায়। সেই শহর কেমন? লেখিকা পাঠককে জানিয়েছেন, এই শহর এমন যেখানে পুরনো গাড়ি, গহনা, কর্মক্ষম পুত্র এবং রূপমতী কন্যা--এসব কিছুর বিনিময়ে মোটা অর্থমূল্য মেলে। মাসুমার মাকেও শেষমেশ রূপমতী কন্যার উপরই নির্ভর করতে হলো। সেই কন্যা মাসুমা। মাসুমার জীবনের রূপবদল ঘটলো। সেই বদলের নানা পর্বের রোমহর্ষক, বেদনাদায়ক এবং একই সঙ্গে ভাবনার খোরাক জোগানো কাহিনী হলো মাসুমা। নতুন জীবনে মাসুমার নাম-বদল ঘটেছে। সে হয়েছে নিলোফার। সেই নিলোফারের বাড়ি যাওয়ার পথের বর্ণনা দিয়েছেন লেখিকা অননুকরণীয় ভঙ্গীতে। দুয়েকটি নমুনা তুলে ধরা যাক।

শুরুতেই প্রথম বাক্যে লেখিকা বলে দিলেন—"হ্যাঁ, এটা বোম্বাই-এর চার্চগেট। না, বলার মতো চার্চ এখানে কাছে-পিঠে নেই, কিন্তু এখানে অনেকগুলো গেট আছে।" পাঠক বুঝে ফেলবেন মুহূর্তে যে, লেখিকা কঠিন কিছু যদি শোনাতেও বসেন তাহলে তার পরিবেশনে যথাপরিমাণ রস মেশানো থাকবে। তিনি এরপর পড়বেন, ট্রেন থেকে নেমে এগিয়ে যাওয়া পথচারীর চোখে পড়বে যে-অভাগিনীর বসে থাকা মূর্তি তার বর্ণনা—পাতলা হয়ে যাওয়া রুক্ষ চুলের মধ্য থেকে উকুন খুঁজে বের করে আনার সাফল্যে সে এমনভাবে হাসে, যেন সে গভীর সমুদ্র থেকে জীবন বাজি রেখে মুক্তো তুলে এনেছে। তারপর সেগুলোকে সুকৌশলে বাঁহাতে রেখে একটা একটা করে ডানহাতের নখ দিয়ে মারতে থাকে গভীর মনোযোগ সহকারে যেন সে সৌখিন একটি আংটিতে দুর্লভ পাথর বসানোর কাজে ব্যস্ত।

কেবল রসবোধ সঞ্চার করা লেখিকার মনঃপূত নয়, তিনি তাই এরপরই নিষ্ঠুর বাস্তব চিনিয়েছেন পাঠককে। তিনি পথচারীকে সাবধান করে দিয়েছেন যেন তিনি দুখিনী মেয়েটির ময়লা ন্যাকড়া ও অন্যান্য জিনিসপত্র যা আছে সেসবের কাছ দিয়ে না যান! যদি কোনোভাবে তিনি তা করে ফেলেন তবে সে এমন দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকবে যেন তিনি জোর করে কোনো তরুণীর শোওয়ার ঘরে ঢুকে পড়েছেন। দরিদ্রজীবন ও নারীজীবন, উভয় জীবনের বাস্তবতা প্রকট করে তুলেছেন তিনি এভাবে সামান্য কটি কথা দিয়ে ছবি এঁকে!

স্টেশনে কর্মরত টিকিট কালেক্টরদের কর্তব্যজ্ঞানহীনতাকে তিনি কটাক্ষ করেছেন—তারা নিজেদের মধ্যে এমন খোশগল্পে মেতে থাকে যে, রেলযাত্রী পথচারী যদি পুরনো টিকিট অথবা ওজনযন্ত্রে শরীরের ওজন মেপে পাওয়া টিকিটের মতো বস্তুটি তাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে যায় তাহলে তা নির্বিবাদে নিয়ে তারা আলাপের আনন্দেই ডুবে থাকবে।

লেখিকা নির্দেশ দিয়ে চলেছেন পথচারীকে—সরকার হোটেলে পৌঁছে পচা, বাসি ইডলির গন্ধ থেকে নাকটাকে বাঁচাতে হবে এবং কিছুদূর পেরিয়ে ভেলপুরীওয়ালার ঝুড়ির উপর দিয়ে তাঁকে লাফ দিতে হবে। এমন সতর্কবার্তা দিতে দিতে লেখিকা যেন পাঠকের সঙ্গে সাক্ষাৎ কথা বলছেন এমন ভঙ্গিতে বলে ওঠেন 'বাহ্‌, এক্কেবারে সঠিক হয়েছে!' অথবা 'এবার থামুন!'

পথচারী চলতে চলতে ইন্দ্রকোর্টে উপস্থিত হবেন। ইন্দ্রকোর্টের একতলায় গুরু গ্রন্থজীর কবর। তার সিঁড়িতে বসে থাকা ভুঁড়িওয়ালা পুরুতের চেহারার বর্ণনা অতি উপভোগ্য এবং সেইসঙ্গে লেখিকার টিপ্পনীও—প্রতিদিন একই স্তোত্র গাইতে গাইতে বিরক্ত হয়ে পুরোহিতটি ফিল্মি গানের সুরে মন্ত্র গাইতে থাকে এবং বিপুল উদ্যমে শেষরাত পর্যন্ত ঢোলক বাজায়।

এ যেন কঠিন কথা শোনাবার আগে পাঠকের মনকে মজার কথা শুনিয়ে প্রস্তুত করে নেওয়া! যথার্থই অভিনব এই গল্প বলার ধরন তাঁর।

এরপর শুরু হয়েছে কাহিনী। ধনীকন্যা, আদরে প্রতিপালিত, তরুণী মাসুমার দিনে দিনে নিলোফার হয়ে ওঠার নিষ্ঠুর বাস্তব-চিত্রের কোলাজ; দেখা নয়, পড়তে পড়তে পাঠক ফিরবেন গল্প পড়ার মজা উপভোগ করা থেকে মোচড় তৈরি করা বেদনানুভবে। স্বামী-পরিত্যক্তা মাসুমার বিগতযৌবনা গর্ভধারিণী বেগম নিজেকে সমেত তার অন্য কন্যাসন্তানগুলোকে বাঁচানোর জন্য প্রধান সম্বল ভেবে নিল তরুণী মাসুমাকে। শুরু করলেন লেখিকা তরুণী বিকি-কিনির চিরন্তন অথচ অতি নিষ্ঠুর বাস্তবতার কাহিনী-চিত্র।

মাসুমা বোম্বাই শহরের পরিমণ্ডলে মূল্যবান পণ্য বলে গণ্য হল আপন জন্মদাত্রীর কাছে। এই তরুণী তার স্রষ্টা লেখিকার কলমে সৃষ্ট তাঁর নিজ-সত্তারই প্রতিমূর্তি যেন। সে প্রথমেই যা-কিছু জীবন আগে মেনে নিতে পারে না। প্রতিবাদ করে। প্রতিআক্রমণ শানিয়ে তোলে। কেন? কেন? কেন?--প্রশ্ন তুলে জেরবার করে দেয় কাছে আসা মানুষগুলোকে। ইসমত চুঘতাই নিজে জানিয়েছেন, তিনি 'কেন?' প্রশ্ন মুখে নিয়েই যেন জন্মেছিলেন! তেমন চরিত্র যেন মাসুমাও। নতুন জীবন যেন নিলোফারের আর সে-জীবন মেনে নিতে নিতান্তই অনিচ্ছুক প্রতিবাদী মাসুমা।

নিলোফার মায়ের ইচ্ছায় বলিপ্রদত্ত হলো। একের পর এক হাত বদল হতে হতে বেশ কিছু মালিক তার জীবনের মালিকানা হাতে নিতে আগ্রহী হয়ে এগিয়ে এসে মাসুমার কাছে কম নিগ্রহ লাভ করেনি! তবুও তারা নিরুদ্যম হয়নি কেউ। কেটেছে সময় সেভাবে। কেটে গেছে নিলুফারের জীবনের ধারাবদলের গতিময়তা। ফিল্মি দুনিয়ার হোমরা-চোমরা ব্যক্তিত্ব, হোটেল মালিক, শিল্পপতি—এমন বিভিন্ন ক্ষমতাধারী ব্যক্তির কামনাতুর জীবনের মক্ষীরাণী হলো সে এক এক করে। বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্ভারে ভরে উঠলো তার জীবনের সাজি। কতো জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজে ফিরল তার তরুণী মন! মস্ত বড়ো এক জিজ্ঞাসা-চিহ্ন সৃষ্টি হল তার নিজের জীবন সম্পর্কে! নিজের একান্ত আপনজন গর্ভধারিণী সম্পর্কে। দায়িত্বজ্ঞান, বিবেক, নৈতিকতা ছুঁড়ে ফেলে পালিয়ে যাওয়া জন্মদাতা সম্পর্কে। কেমন সেই প্রশ্নগুলো?

কথায় কথায় তার মা নিলোফারকে 'নির্লজ্জ মেয়ে' বলে ওঠে বিশেষত সে যখন তার মালিকের কাছে প্রথম পর্বেই আত্মসমর্পণ না করে তাকে অপমান করে, হাসে, তাড়িয়ে দেয় এবং কটূক্তি করে। মাসুমা প্রশ্ন তোলে—

নির্লজ্জ না হতে পারার জন্য নির্লজ্জ হওয়ার অপবাদ তাকে কেন সইতে হয় মায়ের কাছে? নিলোফার কি তাহলে বলির পাঁঠা? তা নাহলে সে যতো অবাধ্য হয় মা ততোই নিষ্ঠুর হয় কেন তার প্রতি?

আত্মজনেদের সঙ্গে সম্পর্কের আসল প্রকৃতি কী রূপ? মাসুমা নিলোফার হয়েছে। মা হয়েছে ম্যাডাম। বাবা সবকিছু ভুলেছে তাদের। ভাইরা বাবার সঙ্গে চলে গিয়ে মাসুমাদের ত্যাগ করেছে। তবু কেন মা তার সঙ্গে আপনজনের সম্পর্কের দাবিদার হয়? মা কি সত্যিই তার আপনজন?

তার বোনদের ভালো থাকা, পড়ার খরচ ও বিয়ের জন্য তাকে রোজগার করতে হবে। মা শেখায় এই মন্ত্র। মাসুমা ভাবে, কেন? সে কি তার মায়ের স্বামী, যে তাকে মায়ের সন্তানদের জন্য নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে উপার্জন করতে হবে?

তার জন্মদাতা মা সমেত তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তারই বয়সী মহিলার প্রেমিক হয়েছে। কিন্তু তার জন্য কেউ এমন সবকিছু বিসর্জন দিতে পারে না তো! কেন?

মাসুমা আরো বহু বিষয়ে প্রশ্ন তোলার মাধ্যমে বার্তা পেয়েছে নিজে, যেগুলি লেখিকা তুলে ধরেছেন সুকৌশলে, সুনিপুণ দক্ষতায়।


বহু বিষয়ে প্রদত্ত বার্তাগুলো আজও প্রাসঙ্গিক

বিভিন্ন মালিকের কণ্ঠলগ্না হওয়ার বাস্তবতা মেনে নিতে নিতেও প্রশ্ন তুলেছে মাসুমা। নারীজীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কিত সেসব প্রশ্ন তুলে ধরে লেখিকা বিবিধ বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর পাঠক-সমীপে। সেগুলোতে এবার নজর দেওয়া যাক।

ফিল্ম-জগতের সকল সফল এবং বিখ্যাত ব্যক্তিই এই দুনিয়ায় 'কিছু নয়' থেকে 'সবকিছু' হয়ে ওঠে।

একজন প্রযোজক তেমন তরুণী দেখলে পছন্দ করে এবং বিয়ে করে ফেলে এবং সেই তরুণীও প্রযোজকের পত্নী হতে পেরে গর্ববোধ করে। তারপর পশ্চাতে চলে গিয়ে নিন্দা কিন্তু মুখের সামনে মধুর সম্ভাষণ।

এই জগতে প্রেম ও ব্যবসা মিলে-মিশে যায়।

সেন্সরবোর্ডের খেলাও বিচিত্র। সেন্সরকে কেউ বিশ্বাস করতে পারে না। কোনো ফিল্ম যদি বোর্ড বাতিল করে দেয় তাহলে অকস্মাৎ খবর হয়ে যাবে সেটি রাষ্ট্রপতির পুরস্কার পেয়েছিল প্রায় এবং এখন বিভিন্ন ফিল্মোৎসবে সেটি পুরস্কৃত হচ্ছে।

হোটেল ম্যানেজারের জীবনে ঢুকে পড়ে মাসুমা, বিভিন্ন সময়ের কথোপকথনে জানতে পারে যে, দুর্নীতি এবং দুর্নীতি-বিরোধিতা দুটোই তাদের সামলাতে হয়। জিজ্ঞাসু হয়ে প্রশ্ন করে করে মাসুমা জানতে পারে বহু কিছু তার এই বৈচিত্র্য-ভরা পরিবর্তিত জীবনে।

যেমন, ঘুষ নামক সর্বজনবিদিত দুর্নীতি সম্পর্কে মাসুমা জানতে পারেঃ

—ঘুষ কিভাবে, কাকে, কতটা এবং কি প্রণালীতে দিতে হত তা জানতে হয় যারা ঘুষ দেয় তাদের।

—যারা নেয় তারা প্রায় সকলেই বলে; বিধবা ও অনাথদের পোষণ করতে হয় পরিবারে।

মাসুমা জানতে চায়, কেউ তাদের ধরে না?

জবাবে শুনতে পায়, কে ধরবে?

জমি দখল-করা নামক দুর্নীতির কথা মাসুমা মন দিয়ে শোনে। বালিকাবিদ্যালয়ের জমি দখল করে বাতানুকূল সিনেমা হল বানানো হবে। বাধা হচ্ছেন প্রধান শিক্ষিকা। বেঁকে বসেছেন তিনি। মাসুমা শুনতে পেলো, তাঁকে কোনোভাবে বশ করতে হবে। কীভাবে? প্রক্রিয়াটি সহজ হবে না জেনেও তা ভাবতে হচ্ছে। এবং এ ব্যাপারে সফল হবেনই তিনি, জানালেন নিলোফারের মালিক রাজাসাহেব।

বিভিন্ন বিশেষ উচ্চপদাধিকারীরা যখন অবসরপ্রাপ্ত হন তখন তাঁরা কিভাবে তাঁদের হিসেবি বুদ্ধি প্রয়োগ করেন তাও জেনে ফেলেছে নিলোফার। ক্ষমতাধর বন্ধুদের প্রভাবিত করার জন্য সরকারবিরোধী অবস্থানে থেকে বক্তৃতা করা তাঁদের একটি অন্যতম পন্থা। সেই কৌশল অবলম্বন করে উপাচার্য অথবা রাষ্ট্রদূত হওয়ার পথ খোলা পাওয়া যায়।

যারা জীবনে যতো বেশি পায় তারা আরো বেশি পাওয়ার জন্য হীন কৌশল অবলম্বন করতে পিছ-পা হয় না।

শিল্পপতি কারখানার মালিক শ্রমিক-বিদ্রোহ দমনে কুকীর্তি কি করেছে তা খোলা পাতার মতো খুলে মেলে দেয় নিলোফারের সামনে। নিলোফার আঁতকে উঠেছে দেখে যে বার্তা শোনানো হল, সেটি জেনে রাখার মতো—

আমরা কারখানা গড়েছিলাম, এতিমখানা তো করিনি! নইলে শিল্প হবে কিভাবে?

মাসুমা প্রশ্ন করে—নেতারা কিছু করে না? কী বার্তা শুনতে পায় সে উত্তরে?—

নেতাদের কথা যত কম বলা যায় তত ভালো। তারা নিজের পেট ভরায় আগে তারপর জনগণের সমস্যার কথা ভাবে।

মালিক দেশের শিল্প গড়ছেন। তিনি পরবর্তী নির্বাচনে লড়তে চলেছেন এবং জনগণের জন্য সব করে দেবেন। পোস্টারে পোস্টারে তার জাতিসেবামূলক কাজের লম্বা তালিকা। কেবল হতভাগা শ্রমিক ও তার পরিবারের সদস্যদের উপর অত্যাচারের উল্লেখ কোথাও নেই।

কারখানার দ্রুত উন্নতিতে দেশের শিল্পোন্নয়ন ঘটবে।

মাসুমা বুঝে ফেলে শ্রমিক-জীবনের সারকথা এবং সেই সঙ্গে তার জীবনেরও। কি সেই বার্তা?

ফ্যাক্টরি-বিরোধীরা দেশ ও জাতির শত্রু। বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছে তার যে বোন তারও শত্রু তারা। কেননা যোগ্য স্বামী না পেলে তারও নিলোফারের দশা হবে এবং তাদের পুরো পরিবার পথে বসবে। রাজাসাহেবের 'দয়া'তেই তো সবকিছু সম্ভব হচ্ছে!

অনাথ শিশুদের জন্য দানের সভা চলছে। সে সভায় রাজাসাহেব 'জাতির সেবক' বলে বরণীয় এবং নিলোফার 'দেবী' বলে গণ্য হল। দুজনের সমাজসেবা উচ্চপ্রশংসিত হল।

সমাজসেবার এই চিত্রে কালিমা লেপন করে সাধ্য কার? চলছে আজও এমন সুপ্রশংসিত 'সমাজসেবা' সর্বত্র!

ছাত্র-আন্দোলন বিষয়েও বার্তা মেলে। ছাত্রদের নিজেদের বিবাদ না দেখে সংবাদপত্র সেসব ছাত্র আন্দোলন বলে গণ্য করে বড় করে দেখায়। পুলিশের ভূমিকা জানতে চায় নিলোফার। অবশেষে শুনতে পায়, তারা কি করবে? সবটাই পরিকল্পিত করে ঘটানো হয়েছে। বার্তা শোনায় রাজাসাহেব নিলোফারকে—

ছোটোলোকেরা নিজেরা মরে ও ধ্বংস করে। একে অপরকে তারা কুকুরের মতো কামড়ায়। সম্ভ্রান্ত যারা তারা পরস্পরের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করে।

এমন সব বার্তা পেতে পেতে মাসুমা বুঝে নেয়, বৃথাই সে নিজের জীবনের কথা ভেবে উদ্‌ভ্রান্ত হয়, খেপে যায় মাঝে মাঝে! পাপের উত্তাল সমুদ্রে সে একটি বিন্দু মাত্র। প্রত্যেকেই আসলে হয় কিছু বেশি অথবা কিছু কম শক্তিহীন তার থেকে। বার্তা পায় নিজের কাছেই—

প্রকাশ্য স্থানে স্নানের সময় যখন সকলেই বস্ত্রহীন তখন কেবল সে কেন তার নগ্নতার জন্য অস্বস্তি বোধ করবে?

মাসুমা যখন নিলোফার হয় তখন মনুষ্যত্ব কোথায় মুখ লুকিয়েছিল? কে রেখেছিল তখন তার মাথায় একটু হাতের ছোঁওয়া?

সে তো আজ যত বিষ তৈরি করেছিল তার পরিবারের সদস্যরা সব গিলে ফেলে জীবন্ত মৃত্যু দেখে ফেলেছে!

মাসুমার আর কিছু চাওয়ার নেই। সব চাওয়া-পাওয়া তার শেষ। আজ সে কেবল এটুকু চায়—"আমার ষোড়শী কন্যা বেঁচে রয়েছে, নিঃশ্বাস নিচ্ছে, তার কিশোরী বন্ধুদের সঙ্গে স্কিপিং খেলছে। আমার ইচ্ছে, আমি তাকে আমার গর্ভে ফিরিয়ে নিয়ে লুকিয়ে রাখি!"





(পরবাস-৬২, মার্চ - এপ্রিল, ২০১৬)