"উফ্ফ।
পার্কের ধারের ওনার প্রিয় বেঞ্চটায় এসে বসেই পড়লেন অনিমেষবাবু। হেলান দিয়ে, গা এলিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আজকে বড্ড গরম।
বিকেলের দিকে দিল্লির গরমটা যেন আরো বেশি মনে হয়। সারাদিন চড়া রোদের পর বিকেলে যেন মাটি থেকে তাপ উঠতে আরম্ভ করে। হাওয়া চলে না, একটা চাপা গুমোট ভাব চারিদিকে ছেয়ে থাকে। তাপমাত্রা চল্লিশের ওপরেই থাকে।
সচরাচর অনিমেষবাবু আরেকটু বেলায় বেরোন। দুপুরে ঘুমোন না, জাস্ট একটা আধঘন্টার 'পাওয়ার ন্যাপ' নিয়ে থাকেন। তারপর উঠে কিছুক্ষণ বই পড়েন, প্রযুক্তি বিজ্ঞানের ম্যাগাজিন পড়েন, বিদেশী ক্লাসিকাল গান শোনেন। একটু বেলা বাড়লে এক কাপ চা খেয়ে হাঁটতে বেরোন। তখন গরমটা একটু কমে আসে। পার্কে তিন রাউন্ড হেঁটে চলে যান সোসাইটির মিনিমার্কেটে। হালকা বাজার করে নেন — মানে এই দুধ, ডিম, পাঁউরুটি আর কি। কখনো বা একটু কাঁচা সবজি। আজ একটু আগে বেরিয়ে গরমের প্রবল ধাক্কা অনিমেষবাবুকে দু'রাউন্ডের মাথায় থামতে বাধ্য করলো।
অনিমেষবাবু থাকেন পার্কের পাশের বাড়িটার পাঁচতলায়। দক্ষিণ খোলা ফ্ল্যাট, বারান্দায় বসে পার্কটা দেখা যায়। পার্কের পাশে অমলতাস গাছের সার, তার উপচে পড়া হলুদের উচ্ছ্বাসের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে সবুজ ঘাস দেখতে অনিমেষবাবু বড়ো ভালবাসেন।
অনিমেষবাবু রিটায়ার করেছেন মাসছয়েক আগে, তার আগে একটি বহুজাতিক সংস্থার উঁচু পদে ছিলেন। চাকরি জীবনের শেষ দশ বছর দিল্লিতেই পোস্টেড ছিলেন, রিটায়ার করে তাই দিল্লিতেই থেকে গেলেন। স্ত্রী মারা গেছেন বছর তিনেক আগে। এখন সংসারে উনি ছাড়া আছে ছেলে আর ছেলের বউ। ছেলের বউটি নিতান্ত ছেলেমানুষ, কিন্তু ভারী মিশুকে আর হাসিখুশি। অনিমেষবাবুর দেখাশোনা যথেষ্ঠই করে। আজ দুপুরের রান্নাটা ওই করেছিলো।
আঃ — রান্নাটা বড্ড ভালো হয়েছিল। কষা মাংস, সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট সাদা সাদা লুচি — ওই কাজের লোকের করা “পুরি” নয় — আসল লুচি, মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। শেষ পাতে আবার রাবড়ি ছিলো, সেও একটা স্বর্গীয় ব্যাপার। তাই তো আজ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন অনিমেষবাবু। তারপর হঠাৎ উঠে ঘড়ি না দেখেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লেন, তাই সময়টা গোলমাল হয়ে গেল। কিন্তু আজ বড্ড গরম।
"নমস্কার। বিরক্ত করলাম কি?"
অনিমেষবাবুর চটকা ভেঙে গেল। বসে থাকতে থাকতে কেমন ঝিমুনির মতন এসে গিয়েছিলো। ধড়মড় করে উঠে দেখলেন সামনে এক বয়স্ক ভদ্রলোক তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। ঠোঁটের কোণে একটু মৃদু হাসি।
"স্যরি — আপনি বোধহয় বিশ্রাম করছিলেন।" ভদ্রলোক বললেন। ভারী মার্জিত কথা বলার ভঙ্গি। চেহারায় একটা বনেদী ভাব — ধবধবে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি, মাথার চুল পরিপাটি করে ব্যাকব্রাশ করা, ক্লিন শেভ, ঘাড়ে একটু পাউডারের আভাস।
"না না, আমি উঠতেই যাচ্ছিলাম," বললেন অনিমেষবাবু।
"আপনার সঙ্গে আলাপ হয়নি। আমি এই সোসাইটিতেই থাকি। আপনি রিটায়ার করেছেন বোধহয়?"
"এই বছরখানেক হলো।"
অনিমেষবাবু উঠে পড়লেন। টিপিকাল বাঙালিদের মতো খেজুর করার অভ্যাস ওনার নেই। যদিও এই ভদ্রলোক দেখতে শুনতে ভারী ভদ্র, তবুও প্রথম আলাপেই একরাশ কথা উনি বলতে পছন্দ করেন না।
"আপনার সঙ্গে হাঁটলে আপনার আপত্তি নেই তো?" মার্জিত এবং ভদ্র কন্ঠস্বর ভদ্রলোকের।
"আসুন," বললেন অনিমেষবাবু, কিছুটা গররাজি হয়েই। হাঁটার সময়টা অনিমেষবাবুর কাছে একটা একান্ত ব্যক্তিগত সময়; এই সময় উনি কারোর সান্নিধ্য পছন্দ করেন না।
"আসলে কী জানেন তো, এই সময় বড্ড ফাঁকা লাগে। আপনার স্ত্রীও তো বেঁচে নেই, কাজেই আরো বেশি লাগে নিশ্চয়ই।“
অনিমেষবাবু উত্তর দিলেন না।
“আমরা ক'জন মিলে একটা দল পাকিয়েছি। সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে পার্কের এককোনায় বসে আড্ডা হয় — প্রায় দশটা এগারোটা অব্দি। সন্ধেবেলায় আবার বসি আমরা — এবার গান, কবিতা আর তাস। আপনিও চলে আসুন না!"
অনিমেষবাবু প্রমাদ গুনলেন। এই ব্যাপারটাই ওনার পছন্দ নয়। বাঙালির আড্ডা মানেই পরনিন্দা-পরচর্চা, তারপর দুর্গাপূজা, প্রতিবেশির কন্যার বেসুরো রবীন্দ্রসঙ্গীত, তারপর দলভাগ, দলাদলি — এসব থেকে অনিমেষবাবু চিরকাল একশোগজ দূরে থেকেছেন। এখন আবার এসব ঝামেলায় টানা কেন বাপু।
ভদ্রলোক অনিমেষবাবুর মনের কথা যেন বুঝে ফেলে বললেন, “আড্ডাটা সত্যি ভালো হয়। সাহিত্য আলোচনা হয়, ভালো গান হয়। বড় একটা দলবাজি হয় না। আপনার খারাপ লাগবে না।"
অনিমেষবাবু একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন, “আসলে আমি তা ভাবছিলাম না। রিটায়ার করলেও আমি কিন্তু নানান কাজের মধ্যে থাকি। ধরুন সকালে উঠে চা বানাই, ব্রেকফাস্ট বানাই। তারপর কাজের লোক এসে পড়ে, তাকে দিয়ে কাজ করাই... "
“বউমা করেন না বুঝি এসব ?”
অনিমেষবাবু একটু বিরক্তই হলেন, যদিও ভদ্রলোক কথাটা খুবই ভদ্রভাবে বললেন। বউমার ব্যাপারে অনিমেষবাবুর একটু দুর্বলতা আছে, তার সমালোচনা শুনতে ভালো লাগে না ওনার।
“বউমা করে। যথাসাধ্য করে। কিন্তু ও তো চাকরি করে, ফিরতে অনেক রাত হয়। সকালে উঠতে পারে না। রাতের খাবার বাড়ার দায়িত্বও তাই আমার। ফ্রিজ থেকে বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে দি। এটুকু না করলে চলবে কেন।"
“এগুলো বউমা করে নেবেন। কি আর এমন শক্ত কাজ। অভ্যাসের ব্যাপার।"
“তারপর ধরুন ছেলেও দেরি করে ফেরে। বাজারটাও আমাকে সামলে দিতে হয়। ওর আসতে আসতে তো দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।"
“তা আজকালকার শপিং মলের দোকানগুলো বেশ রাত অব্দি খোলা থাকে। ওটা খুব শক্ত নয়। অভ্যাসের ব্যাপার।"
“যাই হোক, মানে কথা হচ্ছে কী, এসব নিয়ে এমন জড়িয়ে আছি যে সকাল বিকেল আড্ডা দেবার সময় বের করা শক্ত।"
“আসলে কী জানেন – এই সময় বড্ড ফাঁকা লাগে। কাজের মানুষ তো আমরা, হঠাৎ খালি খালি লাগে। একদিন আসুন না সময় করে। খুব খারাপ লাগবে না মনে হয়।"
“দেখি,” বলে অনিমেষবাবু হাঁটার স্পিড একটু বাড়ালেন। ভদ্রলোক একটু পিছিয়ে গেলেন। বাঁচা গেল। ভদ্রলোক এতো মার্জিত ভাবে কথা বলেন যে রূঢ় ব্যবহার করতে খারাপ লাগছে অনিমেষবাবুর।
রাউন্ড শেষ হয়ে এলো। পার্কের তিন নম্বর অমলতাস গাছটার পাশ দিয়ে ডানদিকে গেলেই অনিমেষবাবুর বাড়ি। আর ওই অমলতাস গাছের নিচেই ওনার প্রিয় বেঞ্চি।
এখন বেঞ্চের চারপাশে বেশ কিছু লোক ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। এমনকী সোসাইটির দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেক্রেটারি মশাইও হাফ প্যান্ট পরে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। কী ব্যাপার বুঝতে অনিমেষবাবু এগিয়ে গিয়ে ভিড় ঠেলে উঁকি মারলেন।
প্রথমেই চোখে পড়লো বউমা বেঞ্চের একপাশে বসে, চোখে রুমাল। তার কাঁধে হাত রেখে ওনার ছেলে দাঁড়িয়ে বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে। বেঞ্চের আরেক পাশে বসে আছেন সোসাইটির রেসিডেন্ট ডাক্তারবাবু, এক হাতে নাড়ী দেখার চেষ্টা করছেন। আর যার নাড়ী দেখার চেষ্টা করছেন, সেই অনিমেষবাবু বেঞ্চে এলিয়ে পড়ে আছেন। মুখটা সামান্য হাঁ।
অনিমেষবাবু তার ঘাড়ের কাছে সেই শান্ত, মার্জিত, অতীব ভদ্র কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন “অনিমেষবাবু, আপনি কি এখনো কিছুই বুঝতে পারেননি?”
(পরবাস-৬৩, ৩০ জুন, ২০১৬)