গ্রামের নাম নীলমোহনপুর। থানা দুগনি। আধার কার্ডের কল্যাণে ডাকঘরের পিন নম্বরও একটা পাওনা হয়েছে। যদিও গাঁয়ে কোনো ডাকঘর নেই। জঙ্গলের শুরুতে মানে হাইওয়ের ধার ঘেঁষে পনের ষোলো ঘরের গ্রাম। ছোট একটা পুকুর। পুকুরধারে সারি দিয়ে তাল গাছ। বুনোখেজুরের ঝোপ। পুকুর আছে মানেই যে খুব ভালো চাষ, তা নয়। গতবছর তো গাঁয়ে ফসল ওঠেইনি। খরা-পীড়িত অঞ্চল ঘোষণা হয়েছিল।
গাঁয়ের শেষ আর জঙ্গল শুরু। বনের শুরুতেই রক্তপলাশের তিনটে গাছ, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। তারপর একটা সিমেণ্টের বেদী। বেদীতে ছায়া দিয়ে একটা বড় অশ্বত্থ গাছ। আর বেদীর ওপর নানা আকারের ঘোড়া। জোড়ায় জোড়ায় ঘোড়া। সাদা আর কালো জোড়। এখানকার লোকজন বলে, ঘোড়া-বাবা। তালবাসিনী ভগবান। লোকজন খুব মানে। যতদূর জানা ছিল, ধর্মঠাকুরের বাহন ঘোড়া। কিন্তু এদিকের লোক ধর্মঠাকুরের নাম জানে না। এদের ঘোড়াবাবার পুজোও হয় না। কেন যে এত ঘোড়ার মূর্তি! না, পুজো একটা হয়। পুরুষরা পুজো করে, মেয়েদের সে পুজো দেখাও বারণ। বছরে একবার। কেউ পরিষ্কার করে বলে না কারণটা। সম্ভবত পুরুষ প্রজাতির প্রজননশক্তি বৃদ্ধির কামনায় পুজো। তাই কথাটা তুললেই সবার মুখে কুলুপ।
একটা প্রচলিত গল্প আছে। রাতের বেলায় পাউড়ি মাতা ঘোড়ায় চেপে রাজ্য দেখতে বেরোন। সবাই সুখে শান্তিতে আছে কিনা দেখেন। পাউড়ি মাতা, রাজবাড়ির আরাধ্যা দেবী। পুরোনো রাজবাড়ির মধ্যে পাউড়ি দেবীর মন্দির আছে। কেউ নাকি মূর্তি দেখে নি। রাজা বা রাজ-পরিবারের লোকজন ছাড়া মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ। এমনকি যে পুরোহিত রোজ এসে সকাল সন্ধে পুজো করেন, তিনিও মন্দিরের বন্ধ দরজার বাইরে থেকে পুজো করেন। কিন্তু দেবীমাতাকে মন্দিরে না দেখলেও অনেকেই দেখেছে। বিশাল কালো ঘোড়ায় গভীর রাতে এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম। ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনে নি, এমন একজনও নেই। এসব গল্পে অবিশ্বাস প্রকাশ করলেও এলাকার লোকজন অবাক হয়ে যায়। ভয় পায়। দেবীমাতা এখানের আশ্রয়, মানুষের ভরসা। বনজঙ্গলের রক্ষক, বনদেবী।
এত যে গাছপালা, জঙ্গল, সবুজ মাঠ, কে করেছে এমন? কে রেখেছে এমন সাজিয়ে গুছিয়ে? কালো ঘোড়ায় চেপে দুষ্টের দমন করেন দেবীমাতা, তাই তো বনসম্পদ মানবসম্পদ রক্ষা পেয়ে এসেছে। আর সাদা ঘোড়ায় চেপে যখন আসেন, তার মানে সুখ সম্পদ আনন্দের বান। অনেক বছর আগে নাকি তেমন দৃশ্য দেখা গেছিল। সাদা ঘোড়ায় দেবীমাতা আসবেন, এই স্বপ্ন সবার।
ঘোড়া ছাড়া বাকিটা শুধুই সবুজ। চেনা অচেনা গাছ। আশপাশের গ্রাম থেকে আসা কাঠুরে মানুষজন। বুনো আলু খুঁজতে আসা গাঁয়ের মেয়েরা।
এ হেন জায়গায় ব্যাঙ্ক কেন যে একখানা ব্রাঞ্চ খুলে বসল কে জানে। অথচ আট কিলোমিটার দূরেই মান্নান খানের কাঠচেরাই কল। পাশে দানাশালের জঙ্গল। বনবিভাগের আইন অনুযায়ী জঙ্গল এলাকার দু’ কিমির মধ্যে কোনোরকম কাঠচেরাই কল বসানো যাবে না। জঙ্গল বা বনবিভাগের জমি থাকলেও একই কথা। কিন্তু দুগনি থানার এক নম্বর ক্যাম্প থেকে জানকিপুর গ্রাম যাওয়ার মোরাম রাস্তার উপর প্রকাশ্যেই এই কাঠচেরাই কলটি চলছে।
মোক্তার খান শাল বলেন না। বলেন, অশ্বকর্ণ গাছ। সংস্কৃতে শাল গাছের উল্লেখ অশ্বকর্ণ নামেই।
মান্নান খানের দাদা, জানকিপুর গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান মোক্তার খান। প্রথম আলাপে বলেছিলেন,‘দেখুন ম্যানেজার সাহেব, অশ্বকর্ণ আমাদের মাতা, পিতা দুইই। ওদিকে ঘোড়া-বাবা আর এদিকে অশ্বকর্ণ, এই দুটিকে মানিয়ে চলতে পারলেই আর সমস্যা নেই। জ্ঞানী মানুষ। রাজনীতি যেমন বোঝেন, অর্থনীতিও তেমন। মোক্তার খানই এলাকার প্রথম মানুষ যিনি ব্যাঙ্ক খোলার আর্জি জানিয়েছিলেন। জানকিপুরে ব্রাঞ্চ হলে মান্নান, মোক্তার দুই ভাইয়ের পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া যেত।
জানকিপুর আর নীলমোহনপুর ছাড়াও ছোট ছোট অনেকগুলো গ্রাম। গ্রাম না বলে এগুলো এক একটা পাড়া বললেই হয়। ভোলাডিহি আর গোপিডিহি দুটো পাশাপাশি গ্রাম, মাঝে বাঁশগাছের সীমানা। পুরোটাই নাকি আগে একটা বাঁশবাগান ছিল।
ভোলাডিহি কাহারদের গ্রাম। আগে এরা পালকি বইত, জনমজুরের কাজ করত। এখন পেশা বলতে দুধ নিয়ে জানকিপুরে বেচতে যাওয়া। হাইওয়ের ওপরে ধাবাগুলোতে দুধের জোগান দেওয়া। গোপিডিহি দোসাধ গ্রাম। নিচু জাতি। আগে বড় বাড়িতে বাসন মাজার কাজ করত, কিংবা রাখালের কাজ। এখন যে ঠিক কি কাজ করে বলা মুশকিল। পেশা বলতে উঞ্ছবৃত্তি। ইতিমধ্যেই গাঁয়ের বেশ কিছু লোক ব্যাঙ্কের কাজের জন্যে তদ্বির করে গেছে। চাপরাশির কাজ। কিংবা জমাদারের কাজ।
একটা একটু বড় গ্রাম আছে, ভগবানগঞ্জ। নামে গঞ্জ হলেও কোনো আলাদা বাজার নেই। আগে নাকি এখানে বড় হাট বসত। গাঁয়ে বেশ কয়েকটা পাকা বাড়ি আছে। আছে বিদ্যুত সংযোগ। আর যেটা আছে, সেটা টিভি। বেশ কিছু বাড়ির ছাদে টিভির ছোট ছোট ডিশ অ্যান্টেনা। গ্রামের মধ্যে ছোট একচালা দোকানেও মোবাইলের সিমকার্ড পাওয়া যায়। আর সবচেয়ে মজার কথা, ভগবানগঞ্জের এক জায়গায় একটি লেডিস বিউটি পার্লার। পুরোনো রাজা বা জমিদারের নায়েব বা খয়ের খাঁ জাতীয় লোকজনের ঘর এই গ্রামে।
ভগবানগঞ্জ আর জানকিপুরের মাঝে একটা ছোট শালবন। বীজাশাল। দুর্লভ শালগাছ। কতরকম শাল যে চেনা হল। শালবন পেরিয়ে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের মুখে আদিবাসী গ্রাম একটা। হো ভাষায় কথা বলে তারা। অদ্ভুত একটা নাম গ্রামের। জুনিখাস না কি যেন। ওই গ্রামটায় এখনো যাওয়া হয় নি।
জঙ্গলের এদিকে, মানে নীলমোহনপুরের দিকে শালবন ঘেঁষে দশ-বারো ঘরের কেন্দুহাট। লোকের মুখে মুখে কেঁদহাট। ধানুকদের গ্রাম। এ গ্রামের লোক রাজাদের বাড়িতে চাকরের কাজ করত আগে, এখন গাঁয়ের ছেলেরা বেশিরভাগই শহরে চাকরি করতে গেছে। যে দু’চারজন আছে, তারা আজও লোকের বাড়িতে বাড়িতে চাকরের কাজই করে। কেন্দুহাট নাম যখন, নিশ্চয় কেন্দু গাছের বন ছিল আগে। কিংবা একটা হাট বসত নিশ্চয়। কেউ খোলসা করে বলতে পারে নি। কারিয়া বলেছে, গাঁয়ে খবর নিয়ে জানাবে। ‘আমাদের গাঁয়ে কেউ না বলতি পাল্লেও নবীপুরের নূরসাহেব বলতি পারবে।'
নবীপুর। কারিয়ার মেটে বাড়ির পাঁচিলের ওপাশটা নবীপুর। অন্য পঞ্চায়েত। অন্য থানা। মুসলমান গ্রাম। মজার ব্যাপার হল, নবীপুরে একটা বলরাম জীউ মন্দির আছে। রোজ পুজো না হলেও বিশেষ বিশেষ পরবের দিন মন্দিরে কাঁসর ঘণ্টা ধূপ দীপ। নামোপাড়া জেলেপাড়া থেকে লোক আসে। নবীপুরের এদিকে, হাইওয়ে ধরে এগোলে নামোপাড়া আর জেলেপাড়া দুই গ্রাম। নদী। এখানের লোক বলে, খড়কে নদী। এই নদীটাই নবীপুরের পাশ দিয়ে চলে গেছে।
আর আছে একটা বেদীর ওপর দুটো ঘোড়া মূর্তি। একটা সাদা, একটা কালো। বেদীটার ওপরে লেখা,‘চাধারী পাট’। হয়ত নবীপুর আগে চৌধুরীপাড়া ছিল। চাধারী পাট-এর অন্যদিকে মসজিদ। জঙ্গলের সঙ্গে মানানসই সবুজ রঙের গম্বুজ।
নবীপুরের আজান ধ্বনি নীলমোহনপুর ছাড়িয়ে ভেসে যায় পাতায় পাতায় ঘাসে ঘাসে। এদিকের আরতির ঘন্টার শব্দ, শঙ্খের আওয়াজ, ধূপের সুবাস ওদিকের হাওয়ায়। নবীপুরের মাথায় ছোট নদী, শ্মশানঘাট। নীলমোহনপুরের পলাশবন পার হলেই কবরস্তান। দুই ধর্মের বিদেহী পূর্বপুরুষরা করমর্দন করে আছেন বহুকাল ধরে।
বদলি হয়ে আসার পর পুলক বোস বলেছিলেন, ‘যেমনটা দেখছেন তেমন ছায়া-সুনিবিড় পল্লী নয়। হাড়বজ্জাত সব লোকজন। খুব সাবধান।' পাঁচ বছরের পুরোনো ব্যাঙ্কের এই শাখাটির অস্বাস্থ্যের একটি বড় কারণ অনাদায়ী ঋণ, যার পোশাকি নাম নন পারফর্মিং অ্যাসেট। এনপিএ। পুলক বোস গত তিনবছর ধরে চেষ্টা করেও ঋণ-খেলাপি তালিকা কমাতে পারেন নি। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে শতকরা হিসেব। মানব চক্রবর্তীর এখানে বদলি হয়ে আসাটা এই অসহ্য অবস্থা থেকে মুক্তি যদিও, তবু অপমানের ধারটা থেকেই গেছে। রিজিওনাল ম্যানেজার এই মানব চক্রবর্তীর সামনেই বলেছিলেন,‘ছাগল দিয়ে হাল চাষ হয় না। তিনবছর ধরে ভ্যারেণ্ডা ভেজেছেন। আর পকেটভারি করেছেন। সব খবর আছে আমার কাছে।'
ইনক্রিমেণ্ট বন্ধ হয়েছে, বন্ধ হয়েছে পরের প্রোমোশনের রাস্তা। পুলক বোসের রাগ দু:খের যথেষ্ট কারণ আছে।
‘দেখুন চেষ্টা করে। অনেক বছর চাকরি করছি। আইআরডিপি অর্থাৎ ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট দেখেছি। মিনিস্টারের সামনে বাহবা নেবার জন্যে সাতদিনে অসম্ভব সব টার্গেট রাখা হত। তাতে না কোনো গ্রাহকের ঠিক করে স্ক্রুটিনি সম্ভব হত, না অ্যাসেট কোয়ালিটি যাচাই করে দেখা সম্ভব হত। সরকারি আমলারাএনভায়রনমেন্টাল ফ্যাক্টরকে না দেখে যা ইচ্ছে তাই অ্যাক্টিভিটি ঠিক করতেন। কেউ হয়ত মাটির পুতুল তৈরী করে, তাকে দুধেল গাই দেওয়া হল। ভাতুয়ার কাজ করে ক্ষেতে, তাকে দেওয়া হল মুদি দোকানের চেক। শিবির করে অ্যাসেট দেওয়া হত। দুধেল গাই-মোষ, সাইকেল, রেডিমেড কাপড়ের স্টক, মুদি দোকানের সাপ্লায়ারকে চেক। সরকারি আমলা আর ফড়ে-ব্যাপারিদের মধ্যে কম অশুভ আঁতাত দেখেছি? সাবসিডির গুড়ের অধিকাংশই এইসব পিঁপড়ে খেয়ে যেত। আমাদের বিগ বস নিজে ধোয়া তুলসীপাতা? কিভাবে লোন দিয়ে আবার সে লোন রাইট-অফ করা হত, আমি দেখি নি?’
'জানি। সেইজন্যেই ইন্ডিভিজুয়াল লোন কমে গিয়ে আইডেন্টিফায়েড সেল্ফহেল্প গ্রুপকে লোন দেওয়া শুরু। ফলে লোনের এন্ড-ইউজ্, রিকভারি ইত্যাদির মান বেড়েছে। তবু বলব,সাধারণ গরীব মানুষকে দেওয়া লোনগুলোর পরিমাণ অনেক ছোট। গরীবরা ওই সব প্রোজেক্টে যা ঋণ-খেলাপি,তা ধূর্ত শিল্পপতি-ফড়েরা মিলে যা ডুবিয়েছে তার ভগ্নাংশ মাত্র।'
'আমাকে যা বললেন, বললেন। ভুলেও এ কথাটা আর বলবেন না। আপনারও আমার অবস্থাই হবে। আমাদের ডিজিএম সাহেব কাদের কল্যাণে বিগ বস হয়েছেন, কত পার্সেণ্ট এনপিএ-র জন্যে দায়ী, সে হিসেব আমার কাছে আছে। কিন্তু ওই যে ব্যাঙ্ক মানেই আর-এম, ডিজিএম, সিজিএম, জিএম। আপনি আমি স্রেফ কলুর বলদ। এই যে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান। মনরেগা। জন-ধন। এক পয়সা আয় নেই ব্যাঙ্কের, গাদা গাদা অ্যাকাউন্ট খোলো। কার যে লাভ হচ্ছে কে জানে। আর এখন এই কেসিসি। কিষান ক্রেডিট কার্ড। মন্ত্রী এসে বলে গেলেন, এক মাসের মধ্যে এক লক্ষ কেসিসি দিতে হবে। জিএম ডিজিএম বিডিও এসডিও কালেক্টর নিয়ে মিটিং। ব্যস, আগু পিছু ভাবনা নেই, টার্গেট দিয়ে দিল। এই ক’টা তো গ্রাম। লোক কোথায় যে এক লাখ কেসিসি দেব? জানেন, জেলেদের মৎস্যচাষী বলে কেসিসি দিতে হয়েছে? এনপিএ হবে না? এখন যত দোষ, এই পুলক বোস?’
'নন্দ ঘোষ’-এর জায়গায় অন্ত্যমিল বসিয়ে বেশ পরিতৃপ্তির আমেজ এল গলায়, ‘দেশ মানেই মন্ত্রী আমলা, ব্যাঙ্ক মানেই বিগ বিগ বস, শহর মানেই প্রতিযোগিতা। শহরে ঠাণ্ডাঘরে বসে দু’ পাঁচ লাখ কেসিসি বিলিয়ে দেওয়া আর এমন কী? যাক গে, আমি তো চললুম। রিটায়ার করতে আমার আর দু’বছর। যে পানিশমেণ্ট পোস্টিং-ই হোক, চালিয়ে নেব। আপনি ইয়ং ব্লাড, আর-এম সাহেবের চোখের মণি, দেখুন কি করতে পারেন!’
পাতঝড়ি। ন্যাড়া গাছগুলোর দিকে চাইলে কারিয়ার মন হু হু। শুখনা পাত এড়ির নিচে মচ মচ। দু’ চারটে পাখি এখানে সেখানে। গাছের ছায়া খুঁজতেছে। নির্জন দুপহরে বাইরে বড় একটা জনমনিষ্যি থাকে না। দুপহরিয়া খেয়ে সকলেই ঘরে নিদায়। দুপহরে পাত কুড়ায় মোংলি। ধানসিঝা ভালো হয়। পাতের আঁচে জলদি জলদি ঝিক উঠে, হাঁড়ির ধান পুড়ে না। যেমন খুশি আঁচ কম বেশি করাও যায়। কোলে ছেল্যা, মাথায় খাঁচিলা। কারিয়াকে দেখে দূর থেকেই ডাকল, ‘ঘর যাবি? তাইলে ইয়ারে লিয়ে যা।'
মানজর সাহবকে লিয়ে মোংলির গাঁয়ে যাতি হবে। উ গাঁপথে সবাই যায় না। দিকু তো নয়ই, অন্য গাঁয়ের লকও না। বাইরের লক মানেই দিকু। মোংলি রাজি হবে কিনা কে জানে।
জাহিরা থানের শাল গাছালি পার হয়ে মোটা আলের ধারটায় এসে বসল কারিয়া। এখানেই তো ঘটেছিল ঘটনাটা। মোটা আলের নিচে বড় ক্ষেতটা কারিয়াদের। এখন দুই ভাইই চাষ করে। পাশের ক্ষেতটা মুখিয়াকে বিকে দিয়েছে দাদা। ভরখরি শ্রাবণ ছিল সেদিন,একা একাই ক্ষেতে হাল চালাচ্ছিল কারিয়া। গাছগাছালির পাশ থেকে একটা ছাগল পাঁঠির ভ্যা ভ্যা আর্ত চিত্কা্র। আশপাশের ক্ষেতে কামিনগুলো বলাবলি করতে লেগেছে, ‘ইত শিয়ালে ধরার মত লয়...’ কারিয়া উঠে এসেছিল এই মোটা আলে।
ওই অর্জুন গাছটার কাছে পড়েছিল মোংলি। পড়ন্ত সূর্যের আলো গায়ে মেখে। পায়ের কোণ থেকে ঝিরঝির রক্তধারা বৃষ্টির জলে মিশে নেমে আসছে মাটির বুকে। ভিজে মাটিতে ছোট বড় মাঝারি অনেকগুলো পায়ের দাগ।
বড় আলগা জীব এই মেয়েছেল্যা গুলান। মুখে কথা নেই। যখন তখন শিকার হয়ে যায়।
অনেকদিন কথা বলে নি মেয়ে। শুধু নিদায়, আর জেগে থাকলেই চোখ টসটস। দু’ মাস নাকি তিনমাস ফি হপ্তা জানকিপুরে ডাক্তারখানা। তারপর বিয়া। মা বুড়ি ছিল তখন, মুখিয়ার সঙ্গে কথা বলে বিয়া দিয়ে দিল। না দিয়ে উপায় ছিল না, বড় ছেল্যাটা পেটে আসি গেছে ততদিনে। বনি ঢেপচু পাখি মোংলির কোলে বীজ ফেলে দিয়ে উড়ে গেছে। কোথা থেকে এসেছে মোংলি, কিছু জানা নাই তখনও। আরো চার মাস পর, হো ভাষায় কথা বলে উঠেছিল মোংলি। শালজঙ্গলের গাঁয়ের ভাষা। ওদিকটা তখন আরো দুর্গম ছিল।
ওই গাঁয়ে যেতি চায় মানজার বাবু। গাঁয়ের নাম জুগনিখাস। মানজার বাবু তো নামটো বুলতেই পারে না। এখনো ও গাঁয়ে লক যায় না বেশি। এই তো দু’ হপ্তা আগে কেঁদহাট গাঁয়ের মুখে রাস্তার ওপর তীর-বেঁধা লাশ পড়েছিল। সারাদিন কেউ ওদিকপানে যায় নি। সন্ধেবেলা পুলিশ এসে লাশ নি গেল। শোনা গেছে লকটা নাকি জানকিপুরের। কে জানে গাছ কাটা নি ঝামেলি, নাকি হো-গাঁয়ের কুনো বিটিছেল্যা নি ধান্দা। এখন এত বাইরের লক আসিছে, ব্যাঙ্ক হবার পর বড় রাস্তার ও ধারটা তো বিলকুল শহর। ফটোকপি দোকান, জেনারেটর, একটা ওষুধের দোকানও হইছে। এদিকেও গাঁয়ের ছেল্যারা সব শেয়ানা হইছে। আগে দিকু দেখলি জঙ্গলে পালাই যেত। এখন লড়াই করে। বীজাশাল জঙ্গল বাঁচাবার জন্যি মরণপণ লড়াই।
যত দিকু আসছে এদিকে, তত ঝামেলি বাড়ছেই।
এই তো কদিন আগে, মোংলি গেছিল বাপের গাঁয়ে। এসে বলছিল, কিভাবে দিকুরা উয়াদের গাঁ নিয়ে নানা ঝামেলি করছে। উ গাঁয়ের বড় দীঘিটা, পদ্মপাতা আর জলের শ্যাওলা দিয়ে ঢেকে রাখা থাকত দীঘির জল, হো গাঁয়ের একমাত্র পানীয় জলের দীঘি, সি দীঘির জলে কেউ পানার বীজ ছড়িয়ে দিয়েছে। পচা পানায় ভরে গেছে দীঘি।
বলতে বলতে মোংলির চোখ টস টস। হো গাঁয়ে ঢুকতে না পারুক, কেঁদহাটের সীমানায় ইউক্যাল্পিটি গাছ লাগিয়েছে জানকিপুরের মান্নানসাহেব। হো-গাঁয়ের লায়াবুড়া বলেছে, শালজঙ্গলের ক্ষতি করবার জন্যি এই কাজ। মান্নান সাহেবের লোকজনের সঙ্গে ফরেস্টার ছিল, পুলিশ ছিল। তাই গাঁয়ের ছেল্যারা তীর ছুঁড়তেও পারে নি।
পাহাড়ের কোল এখন লাল, জঙ্গলের মায়া রুখা শুখা। কালো চিক্কন হাত পা মুখে দুখী দুখী ছাপ। মানুষগুলান সব অচেনা।
দুসার হাতের ছো-মুখোশের মত। মকর সংক্রান্তির দিন হো-গাঁয়ের সানথাল ছেল্যারা, কাঁধে মস্ত ঢাক, গেদা গেদা ধা, গেদা ধিনি ধা, ধিন ধিন তা.. পাশে মোংলির বড় ছেল্যা দুসা নাচতে নাচতে যাচ্ছিল। হাতে চড়কি, পায়ে ঘুঙুর, মুখে ছো-মুখোশ।
দুসাকে চিনতেই পারে নি কারিয়া। মামাঘরে যাই ছেল্যাটা বদলে গেছিল। সি রকম। একই লক এক এক জায়গায় এক এক রকম।
এই যে মান্নানসাহেব, ব্যাঙ্কে মানজার সাহেবের সামনে কত হাসিমুখে কথা বলল, নবীপুরে মিটিং করার সময় তার আরেক রকম। আর হো-গাঁয়ে পুলিশ লিয়ে যায় যখন, তখন দেখলি ভয় করবে। মান্নান সাহেবের সামনে কেন যে মানজার বাবু হো-গাঁয়ে যাবার কথাটো বলল!
এমনিও গাঁয়ের লকজন ব্যাঙ্কের লক দেখলেই ডরায়। পরথম পরথম ব্যাঙ্ক হল যখন, সকল গাঁয়ের মুখিয়াই বুলেছিল খাতা খোলার কথা।
চার-পাঁচ বছর আগের কথা। নীলমোহনপুর তো ছিলই, ভোলাডি গোপিডি কেঁদহাট নবীপুর থেকে মানুষজনকে লাইন করে নিয়ে গেছিল মুখিয়া আর পঞ্চায়েতের সর্দাররা। সরকার সকল মানুষকে পঁচিশ পঁচিশ হাজার টাকা লোন দিবে। কেসিসি দিবে। কেসিসি মানে কী, লোন মানে কী, কেউ বুঝায় নি। মুখিয়া বুলেছিল, সরকার টাকা দিছে। বীজা কেনো, খাদ কেনো, জমিনের কাজ করো। সরকার তো মেলা ভালো আছে! সবাই অবাক।
খাতা খোলার কাগজে টিপ ছাপ। আর দুটা করে ফটোক। ভাগবানগঞ্জ গিয়ে লাইন দিয়ে ফটোক তুলে আসা হইছিল। ব্যাঙ্কে যাই করি লাইন দিয়ে খাতা খোলা। তারপর নগদ নগদ টাকা। ব্যাঙ্কের দরজার সামনে ধুলো মাটিতে আশপাশের সকল গাঁয়ের লক। ঠিক যেন পরবের মেলা।
কারিয়া গম্ভীর দুই ভাইই টাকা নিতে গেছিল। পঁচিশ হাজার টাকা থেকে হাতে পেয়েছিল পাঁচ হাজার। মুখিয়া আর পঞ্চায়েত কিছু নিয়েছিল। ব্যাঙ্কের মানজারকেও নাকি কিছু টাকা দিতে হয়েছিল, মুখিয়া বলেছিল তেমন। বাকি টাকা জমা রেখেছিল মুখিয়া। গাঁয়ে ধানের গোলা বনবেক, পুকুর কাটা হবেক, সিঞ্চাই-এর জন্যে খড়কি নদী থেকে খাল কাটা হবেক। সরকার নাকি বলেই দিছিল সব। গম্ভীর জোরাজুরি করে আরো পাঁচশ টাকা নিয়েছিল মুখিয়ার কাছ থেকে। সেই দিয়ে বাড়িতে মাংস ভাত হয়েছিল পরবের মত। সবাই মিলে বাসে করে সিনী শহরে গিয়ে সিনেমা দেখা হইছিল। কেঁদহাটে তো হাঁড়িয়া মহুলের বান এসেছিল। হপ্তাভর মাতাল হইছিল সব।
নবীপুরের নূরসাহেব অবশ্য বারণ করেছিল। বুঝায়েছিল, সরকার লোন দিছে। টাকাটা বেবাক দিই দেয় নাই। লোন মানে ব্যাঙ্কে শোধ দিতে লাগবে।
মুখিয়া বুলেছিল,‘কুনো ডর নাই। আমি আছি। তুদের লোন শোধ করতে হব্যাক নাই। ই লোনটা ইমনই বঠে। মানজার সাহেবের সঙ্গে আমার সকল কথা হয়ে গেছে। তুরা নিশ্চিন্তে আপন আপন কামকাজ কর।'
নিশ্চিন্তেই ছিল গাঁয়ের লক। সরকারের ওপর খুশি। ঘোড়াবাবার পাটে গিয়ে বসত সকলে, সকাল সন্ধে। সকলই তো পাউড়ি মাতার দয়া। পাউড়িমাতার দয়ায় এককালে দেশের রাজা ইমন দান ধরম করত, গাঁয়ের বুড়ারা বলে। সি ছিল কোলহানের রাজা অর্জুন সিং-এর সময়। খাবার নিই, কাজকাম নিই, বেঁচে থাকা নিই কারো কুনো ডর ছিল নাই। হা ভগবান, আবার বুঝি সেসব সুদিন ফিরা এল।
বছর ঘুরতেই ব্যাঙ্ক থেকে চিঠি। দলে দলে মুখিয়ার কাছে চিঠি পড়াতে গেল সকলে। মুখিয়া বলল,‘আমি কি কইরব? তুরা লোন লিয়েছিস। ব্যাঙ্ক ধইরবে না? আমি তো কেবল গ্যারেন্টার হইছি। তুরা লোন শোধ না দিলে আমাকেও তো পুছাবে ব্যাঙ্ক।'
মান্নানসাহেব এসে নবীপুরে মিটিং করে বুঝায়েছিল, লোন মানে কেবল পঁচিশ হাজার না। সুদে আসলে আরো অনেক। সরকারের টাকা, শোধ না দিলে ব্যাঙ্কের কিছু করার থাকবে না। ঋণ-খেলাপি মানেই ঘর, ঘরের সকল জিনিস, খেত, জমিন সকল ব্যাঙ্ক বাজোয়াপ্ত করবে। না হলে জেল। ঘানি। সরকার মানে জানিস তো? পুলিশ ।
পুলিশ! পুলিশকে গাঁয়ের লক খুব ডরায়। যখন তখন ডাণ্ডা দিই খুব পিটে। কিছু না পেলে কাঠচুরি বলে থানার লক-আপ, জেল যখন তখন। গাঁয়ের বিটিছেল্যারা তো পুলিশ দেকলেই লুকায়ে থাকে।
মান্নান সাহেব বুলেছিল, জমিনগুলান উয়ার নামে লিখে দিলে কিছুটা ব্যবস্থা করবে। গোটগুটি লিখে দিলে ব্যাঙ্কের টাকা দিই আরো কিছু টাকা দিবেক, কাঠচেরাই কলে কামও মিলবেক। গোটগুটি না দিই বন্ধক দিলেও চলবেক। ব্যাঙ্কের ডর তো থাকবে না। নিজের জমিনেই ভাতুয়া খাটতেও পারবে। পরে টাকা দিই বন্ধক ছাড়লেই জমিন আবার আগের মত।
কেঁদহাটের জমিন বেশির ভাগ সেই থেকে মান্নানসাহেবের।
গাঁয়ে গাঁয়ে মুখিয়ারা বলেছিল, জানকিপুরের লক আসি ইদিকে কি ভালা করবে? আমি আছি কিসের লেগে?
খেতির জমিনও লিব না। বাদা জমিনগুলো, মানে যে খেতে ফসল ফলে না, লিখিয়ে দিলেই হবেক। নইলে সুদে আসলে ভিটেমাটি সব ব্যাঙ্ক লিয়ে লিবে।
এমনিও গাঁয়ে জলের খুব কষ্ট। কুন রকমে একটা ফসল ওঠে বছরে। সিঞ্চাই ভালা হলে তবে তো অন্য ফসল। বাদা জমিন আছেই। সেই সময় থেকেই তো বড় জমিনটা, যেটা গম্ভীর চাষ করত, মুখিয়ার নামে। একটা জমিনই দু’ভাই চাষ করে।
গাঁ নয় তো, ভুরসির আঁচ। ধিকিধিকি সানঝা চুলহা। গাঁয়ের বুকে চাপা আগুন।
এতদিন পর আবার গাঁয়ে ব্যাঙ্কের লক ঘুরছে। নতুন মানজার সাহেব। গাঁয়ের লক আর ব্যাঙ্কে যায় নি, মানজার সাহেব নিজেই ঘর ঘর ঘুমতে লেগেছে। ঘোড়াবাবার পাটে বস্যে একদিন মিটিং করল। মুখিয়াকে নেয় নি, ব্যাঙ্কের লক ঘর ঘর গিয়ে নৌতা দিই এসেছিল।
মুখিয়াকে নেয় নি দেখে একটু ভরসা হয়েছিল, কিন্তু আজ আবার মান্নানসাহেব ব্যাঙ্কে কেন?
গাঁয়ে গাঁয়ে মিটিং করেছে নতুন মানজার। বুঝায়েছিল, ঋণ-খেলাপি মানে কি? ঋণ-খেলাপি হলে গাঁয়ের মানুষের যেমন বিপদ, ব্যাঙ্কেরও তাই। গাঁ মানে কি, দেশ মানে কি, সরকার মানে কি, কেসিসি কি, লোন কি, সকল কথা বুঝয়ে বুলেছে।
দেখেশুনে সাহস বেড়েছে সবার। ঋণ-খেলাপি হলেও অনেক অধিকার আছে। ঘর সম্পত্তি বাজোয়াপ্ত করারও নিয়ম আছে। এমনি এমনি সব ব্যাঙ্কের হাতে চলে যাবে, ই ডরটা ভুল। সময় দিবে, টাকা দিবে, জমিনের হালত দেখে বেশি টাকাও দিতে পারে। আর ব্যাঙ্কের শর্ত না মানতে চাইলে আপত্তি করার অধিকারও আছে।
আর সবচেয়ে বড় কথা যেটা বুলেছে, কোনভাবেই ঋণ-খেলাপি বা তার ঘরের জনকে হেনস্থা বা অপমান করার নিয়ম নাই। আগে আগে যে মানজার আর তার লকজন চোখ রাঙাইছে, ডর দেখাইছে, সকলকে ব্যাঙ্ক শাস্তি দিয়েছে। নতুন মানজার সাহেব বারবার বুঝায়ে বলেছে, কুনো ডর নাই।
গাঁয়ের লক সত্যি সত্যি ভরসা পেয়েছে এতদিনে। আর ব্যাঙ্কের লক দেখে পলাই পলাই থাকে নি। কেউ কেউ গিয়ে টাকা জমা দিয়েছে। পুরানা লোন শোধ না করেও লোন পেয়েছে কেউ কেউ, সেই টাকা দিয়েই পুরানা লোনের কিছু শোধ। ভালো বুদ্ধি দিয়েছে মানজার সাহেব, মুখিয়া বা নূরসাহেবও এমন বুদ্ধি দিতে পারে নি। ভাই গম্ভীর তো নতুন একটা লোন পেয়েছে। নতুন হাল লাঙল, গরু কিনেছে।
দেখেশুনে ভরসা হচ্ছিল। জুগনিখাস গাঁয়ে কারিয়ার শ্বশুরঘর, গম্ভীরই বলেছে মানজার সাহেবকে।
'সাহেব টো ভালা বঠে, গাঁয়ের দুশমন নয়...’ ঘোড়াবাবার পাটে বসে সুধীর মোহন পীতাম্বর সকলেই বলেছে।
সরকারের নতুন সুবিধে—জনধন,প্রধানমন্ত্রী বীমা, মুদ্রা লোন—সব বুঝায়ে দিয়েছে মানজার সাহেব। মুদ্রা লোন নিই ভোলাডিহির সামু ব্যাঙ্কের পাশে ফ্যাক্স-মেশিনের দোকান বসাইছে। গোপিডিহি গাঁয়ের বিটিছেল্যারাও জনধন খাতা খুলেছে। নবীপুরের বিটিছেল্যাগুলান সেলফ-হেল্প-গ্রুপ নামে একটা খাতা খুলে কেমন জরির কাজ, ডিমের ব্যবসা করছে। কেঁদহাটে নামোপাড়ায় জেলেপাড়ায় কত ছোট ছোট লতুন দোকান হইছে। বাসনের দোকান, গাড়ির চাকা সারাইয়ের দোকান, লোহার জিনিসের দোকান, মাছ ধরার জালের দোকান। গাঁয়ের লকই ব্যাঙ্কের থেকে টাকা নিই ব্যবসা করছে। গম্ভীরের সম্বন্ধী, গোপিডির সমীর তো কম্পুটার শিখে ফেলেছে। কেঁদহাটের ছোকরাগুলানও কম্পুটার চালাইতে শিখছে।
দেখেশুনে ভরসা হয়েছে সকলের।
জুগনিখাস গাঁয়ে ঢোকা সহজ নয়, উ গাঁয়ে মান্নান সাহেবই ঢুকতে পারে না। মানজার সাহেব তাই কারিয়ার সঙ্গ সঙ্গ যাতি চায়।
সব তো ঠিকই ছিল, আজ তবে কেন মনটা কু গাইছে? মান্নানসাহেবকে মানজারসাহেবের সঙ্গ সঙ্গ দেখে?
ঘরপোড়া গরু সব, সিন্দুরে মেঘ দেখলেই ডর লাগে।
কারিয়ার সঙ্গে যুগ্মগমন। জুগনিখাস গাঁয়ের পথে। এখানের ব্রাঞ্চে বদলি হয়ে এসে আশেপাশে গ্রাম প্রায় চষে বেড়িয়েছে মানব। মানব চক্রবর্তী। এনপিএ কমেছে ব্রাঞ্চের, নতুন সরল লোন, নতুন নতুন অ্যাকাউন্ট। ক্রস-সেলিং বিজনেস, যেমন এটিএম কার্ড, ইনসিওরেন্স বা মোবাইল-ব্যাঙ্কিংও হচ্ছে। ব্রাঞ্চে একটা, জানকিপুরে একটা, দুটো এটিএম হয়েছে। আরো হবে শিগগির। রিজিওনাল অফিস খুব খুশি। ইনক্রিমেণ্ট, ইনসেনটিভ, অ্যাওয়ার্ড। জিএম,ডিজিএম এসে পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। চেয়ারম্যান’স ক্লাবের সদস্য হবার জন্যে নাম সুপারিশ করেছেন। দেড়বছর কেটেই গেছে। আর এক-দেড় বছর কাটিয়ে দিতে পারলেই এখানের পালা শেষ। পরের প্রমোশন নিয়ে এবার একেবারে মুম্বাইয়ে কর্পোরেট অফিসে।
জুগনিখাস না গেলেও হত। এতগুলো গ্রামে কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়েছে, একটা গ্রাম বাদ গেলেই বা কি! কিন্তু কাজের একটা নেশা আছে। হয়ত সেই নেশায় আজ এই যাত্রা।
আরেকটা কারণ আছে। এতদিন এদিকে একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও হাওয়া বদলাচ্ছে। সরকারি বেসরকারি দুটি ব্যাঙ্কের শাখা খুলেছে এদিকে। আসলে ব্যাঙ্ক হবার পর এখন তো এদিকে নানারকম আনুষঙ্গিক ব্যবসা, যাকে বলে অ্যান্সিলিয়ারি বিজনেস বেড়েছে। ফ্যাক্স-জেরক্স ইত্যাদির দোকান,কুরিয়ার কোম্পানীর ব্যবসা,ছবি তোলার স্টুডিও, ছোট হলেও ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা, হয়ত ব্যাঙ্কে চলছে সেই গাড়িগুলো, নতুন নতুন রাস্তা হচ্ছে, লোন নিয়ে মোটরবাইক, গাড়ি সারানোর দোকান।
টুকটুক করে বেড়ে চলেছে কর্মকাণ্ড। অন্য ব্যাঙ্ক শাখা খোলায় কম্পিটিশন বেড়েছে।
জুগনিখাস যাওয়া সেইজন্যেই। ওদিকটা এখনো যাকে বলে আনএক্সপ্লোরড। হো-গ্রামের মানুষ এই কর্মকাণ্ডে শামিল নয়।
কারিয়ার কাছে গ্রামের খানিক ছবি পাওয়া হয়েছে। হেড অফিস থেকে ব্যবস্থা করা হয়েছিল একটা হেলথ-ক্যাম্পের। একজন ডাক্তার সহ পাঁচজন স্বাস্থ্যকর্মী এসেছিলেন। জুগনিখাস গ্রামেও গেছিলেন ওঁরা। ড: মিত্র বলছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। খুব অবাক হয়েছিলেন জুগনিখাস দেখে। বিস্তারিত শুনে আগ্রহ বেড়েছে মানবের। নাহ, এখানে থাকতে থাকতেই একবার গ্রামটা দেখতে হবে। প্রায় আড়াইশ’তিনশ’ লোকের গ্রাম। অন্তত ড: মিত্র যেমন বলেছেন।
‘প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলাম, জানেন? খালি বাড়িগুলো পড়ে আছে, একটা লোক নেই। আসলে আমাদের দেখে ওরা লুকিয়ে পড়েছিল। ক্যাম্পখাট পেতে ওষুধ সাজিয়ে রাখলাম আমরা। অনেকক্ষণ বসে আছি। তারপর এক এক করে বেরোতে লাগল। সা-জোয়ান সব বিশাল বিশাল পুরুষ। হাতে গাছের ডাল, ধারালো অস্ত্র। অনেক লোক। এ গ্রামে কোনোদিন সভ্য মানুষের পা পড়ে নি।'
সঙ্গী ভদ্রলোক বলে উঠেছিলেন, ‘বোঁটকা গন্ধ, যেন সারা গ্রাম গায়ে নিমতেল মেখে আছে। বুড়ো-বুড়ি, স্ত্রীলোক, বাচ্চা, বালক-বালিকা... কিন্তু কেউ কথা বলে না। হল্লা নেই, জোরে কথা নেই। আমরা ইশারায় বোঝালাম, ওষুধ ইনজেকশন দেখালাম। বোধহয় বুঝল যে, আমরা ক্ষতি করতে আসি নি।'
কারিয়াও বলেছে, ‘উ গাঁয়ে কুনো ঝামেলি নাই।'
ভোর হবার অনেক আগে উঠে গাঁয়ের পুরুষরা জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। দুপুরবেলা শিকার নিয়ে ফিরে আসে। কিছু কিছু চাষের কাজ। লম্বা লম্বা ধানের শিসের মত ঘাস, কারিয়া বলল ‘তিসি’, সেই তিসি ধানের চাষ। আলু চাষ। শিকড় বাকড় দিয়ে ঝোল রেঁধেছে, ঘন খয়েরী রঙ, এসবেরও চাষ হয় নিশ্চয়।
গাঁয়ের সব মেয়েরা এক জায়গায় রাঁধে বাড়ে, তারপর তিন'শ লোকের একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া। সন্ধে নামার আগেই সব যে যার ঘরে ঢুকে গেছে।
চাষ হয় যখন, ব্যাঙ্কের কিছু বিজনেস তো আছেই। ও গ্রামে এখনো শহুরে মানুষের পা পড়ে নি। কিন্তু শুধু ব্যাঙ্কের বিজনেস বাড়ানো নয়, মনের কোণে তো লুকোনো নেই, কেমন একটা চোরা টান। পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘন সবুজ জঙ্গল। কালচে পাথুরে জমিতে সবুজের মেলা। ব্যাঙ্ক শুরু হবার সময় লোকজন ছিল না বললেই চলে। ঘোড়া-বাবার পায়ের কাছে সুখ-দু:খের গল্প। মূর্তিগুলো নির্নিমেষ চেয়ে থাকত। প্রকৃতির রাজ্যে সভ্যতার পদক্ষেপ শুরু হতেই মানুষের প্রকৃতির কত বদল। আর ঘোড়া-বাবার কাছে কাজ নেই কারো। টাকা চিনেছে মানুষ। সেটা ভালো কি মন্দ, তা নিয়ে ভাবনা আসে আজকাল। সত্যিই কি সারল্য শব্দটা মূল্যহীন?
এদিকের মানুষের প্রকৃতির বদলের সঙ্গে সঙ্গে মানবের প্রকৃতিও কি বদলে যাচ্ছে?
উন্মুক্ত প্রকৃতিতে বুঝি হৃদয়ের প্রসার ঘটে? কত মানুষ, কতগুলো গ্রাম, হিন্দু ইসলাম সরনা কতগুলো ধর্ম, চাষি কাঠুরে কাহার দোসাধ জেলে কতগুলো বৃত্তি, তবু দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে কেমন বিচ্ছিন্ন এখানের লোকজন। বিচ্ছিন্ন নিজেদের মধ্যেও।
দূর থেকে গান ভেসে আসছে। ‘আকাল বছর আল্য ঝড় উড়াঁই লিল চালহের খড়... খুদ কুঁড়া ঢুকেঁ গেল চঁড়রে...’
শব্দ আর অর্থ দুইই বুঝিয়ে দিল কারিয়া। মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল। আকাল বছর, অথচ ঝড়ে চাল উড়ে গেল। অভাবের তাড়নায় খুদ কুঁড়ো খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি মেটাতে হয় এখানের মানুষকে। বৈচিত্র্যময় জীবন, উদার বিশাল অরণ্যভূমি। কিন্তু দারিদ্র্যের অভিশাপে বিপর্যস্ত মানুষ। কৃষির ফলনও ভালো নয়। গানের সুরেও তাই বেদনার বার্তা।
কেন্দুহাট গ্রামের মুখটায় একটা সরু খাল। গ্রামের লোক একটা পলকা সেতু তৈরী করেছে পারাপারের জন্যে। খানিক দূরে খালের জল গিয়ে বাঁক নিয়েছে পাহাড়ের মধ্যে। ঠিক সেখানটায় বিকেলের সূর্য ঢলে পড়েছে। তেরচাভাবে শেষ বিকেলের রোদ্দুর গিয়ে পড়েছে জঙ্গলের মাথায়।
ঠাণ্ডা শিরশিরে হাওয়া। শহরের কোলাহল,হেড-অফিস রিজিওনাল-অফিসের কর্পোরেট রাজনীতি, ব্যাঙ্কের বিজনেস, প্রোমোশন, অ্যাওয়ার্ড, অ্যাপ্রিসিয়েশন... বড্ড অলীক ভাবনা এখানে। অনেকখানি আলাদা, নিজেকে যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে।
ব্যাঙ্ক, টাকা, লোন, ডিপোজিট। টাকা দিয়ে কি সব সুরক্ষার ব্যবস্থা হয়? বিচ্ছিন্ন অশিক্ষিত এই সরল মানুষদের সুরক্ষার ব্যবস্থা? দেশের কর্মকাণ্ডে এ দেশের কত মানুষই যে ব্রাত্য হয়ে রইল!
ধানক্ষেত,তাল গাছ, বুনো খেজুরের ঝোপ, মহুয়া, অশ্বত্থগাছ একে একে পার। গাঁয়ের দেখা নেই। এত গাছ, তবু মাঝে মাঝেই গরম হাওয়ার ঝোঁক। অনেকটা পথ জুগনিখাস। একটা গাঁয়ের মুখে, যদি অবশ্য এটাকে গাঁ বলা যায়, চার পাঁচটা মাটির ঘর, একটা পাতকুয়ো। কুয়োর ওপর লম্বালম্বি একটা কাঠ। বৃত্তের ব্যাসের মতো। তার ওপর দাঁড়িয়ে একটা কমবয়সী মেয়ে বালতিভর্তি জল তুলছে। অচেনা লোক দেখে ত্রস্ত, ভীরু চোখে তাকিয়ে থাকল। তারপর অদ্ভুত কায়দায় লাফ দিয়ে নেমে প্রায় ছুটেই চলে গেল। কুয়োর সামনে একটা বড় পাথর, মাঝখানে ফুটো। কারিয়া বলল, ‘ইয়াকে কাঁড়ি পাথর বলে। বসবেন টুকু?’
না, এখন বসা নয়। ‘ই জায়গাটা বিরামডি। লিচু জাত।' মানে বিরামডিহি, লিচু জাত মানে নীচু জাতের লোকজন থাকে। এ গ্রামটার নামই আগে শোনে নি মানব। কে জানে আরো কত এমন গ্রাম আছে এদিকে। ফিরে গিয়ে ঋণ-খেলাপি লিস্টটা ভালো করে দেখতে হবে। বিরামডিহি গ্রামের ঠিকানা থাকে যদি!
আপাতত সন্ধে নামার আগেই জুগনিখাস গাঁয়ে ঢুকে পড়তে হবে। কারিয়ার বউ ছেলেদের নিয়ে আগেই এসে পড়েছে। ‘মানজার সাহেব’ আসছে, না বুঝেই গাঁয়ের ছেল্যারা যদি তীরধনুক চালিয়ে দেয়!
পাল্লাবিহীন চৌকাঠ, গোময় লেপা দেয়াল, কাঁকুড় ঝিঙে লাউয়ের লতা এদিক সেদিক, খড়ের ঘর। মাটির ঘর। ঘরের সামনে মাটির কালো হাঁড়ি। মসৃণ মাটি লেপা চত্বর। থালায় কালো মত ভাজা জাতীয় কিছু, হাতে জলের ঘটি। একজন বৃদ্ধা। কারিয়া বলল,‘আমার শাউড়ি বটেক।'
হাত তুলে নমস্কার জানালো মানব। কিছুই না বলে বৃদ্ধা বেরিয়ে গেলেন। ‘ই গাঁয়ের লক বেশি কথা বলে না। কিছু মনে করবেন না সাহেব।' হাত বাড়িয়ে কারিয়ার হাত ছুঁয়ে ফেলল মানব। থাক, এখানে এত ভদ্রতা দেখানোরও দরকার নেই।
রাতে মোটা মোটা ভাত, ডালের মতো থকথকে একটা জিনিস, শামুক গুগলি ভাজা। ‘মানজার সাহেব’ আর গাঁয়ের জামাইয়ের সম্মানে ভোজ। গ্রামের পুরুষরা সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। মশালের আলোয় উত্সুক চোখ। পাশেই একজন বৃদ্ধ পাতায় জড়ানো তামাক বিড়ির মতো পান করছে। উদ্ভট গন্ধ। এ গাঁয়ের লায়া বুড়া। সবাই মান্য করে। খানিক আগেই আলাপ হয়েছে।
কারিয়া বলল, ‘চুঁটা খাচ্ছে।'
মহুল পাতার দোনায় পবিত্র পচন শস্যের তরল পানের নিমন্ত্রণ। হাতে হাতে এগিয়ে দিল কারিয়ার দুই শ্যালক। কাঠের বড় বাটিতে জল নিয়ে মেয়েরা বসেছে আরেকদিকে। কারিয়া বুঝিয়ে বলল, বৃদ্ধা মহিলাটি ঝুপানে বসেছে। গ্রামের সীমা থেকে নাজমোন দূর করার মন্ত্র পড়ছে দুলে দুলে। নাজমোন, মানে অপদেবতা। পরম্পরা জুড়ে এই লৌকিকতা। বাইরের লোক এসেছে, তাই বুঝি? হাঁড়িয়া রসসি মহুয়ায় মাতাল পুরুষরা নীরব। কারিয়া বলল, ‘কুনো ভয় নাই।'
দিগন্ত জুড়ে বাঁশির ডাক। কে বাজায় এমন বাঁশি? শালপাতায় হাওয়ার শব্দে এমন সুর উঠেছে? ধামসা বেজে উঠল। একটু পরেই অনেক দূরের কোনো গ্রাম থেকে ভেসে এল ধামসার বোলের শব্দ। এ কি প্রতিধ্বনি? নাকি কোনো সঙ্কেত? আশেপাশের মুখগুলো কঠিন, নিরাবেগ, ভাষাহীন। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ।
এ কোথায় এসে পড়েছি আমি! গুগল সার্চ ইঞ্জিন, উইকিপিডিয়া। খবর রাখে এই বন্য প্রকৃতির? সরব হতে চাইল মানব, জোর করে। কিন্তু নি:শব্দ প্রকৃতির অদ্ভুত এক শব্দ জড়িয়ে ফেলছে চেতনা। শব্দের ওপর শব্দ, অদ্ভুত মাদকতা।
খুব আরাম হচ্ছে, কিন্তু বড্ড একা একা লাগছে। ফরফর করে একটা দুটো পোকা উড়ছে ঘরে। ঘুমোয়নি মানব। অসাড় হয়ে পড়ে আছে। চোখ বন্ধ করতেও ভয় করছে। যদি কোনো নেকড়ে বা বুনো জন্তু চলে আসে। মাঝে মাঝেই রাতজাগা পাখি বা বন্যপশুর ডাক ভেসে আসছে।
বাইরে জ্যোত্স্না । খোলা দরজা দিয়ে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া। চোখের পাতা ভারী। ঘুম এসে চিন্তা ভাবনাগুলো সব মুছিয়ে দেবে। যে কাজে আসা, তা হয় নি। ব্যাঙ্ক কথাটাই বোঝানো যায় নি। অদ্ভুত একটা আলস্য। কি হবে এত হিসেব করে? আরো ইনক্রিমেণ্ট, ইনসেনটিভ, অ্যাওয়ার্ড, প্রোমোশন? জীবন মানে সত্যিই এই?
পায়ে জোর এনে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল মানব। জোছনায় ভেসে যাচ্ছে বন্যপ্রকৃতি, জুগনিখাস। একটা খণ্ড মেঘ চাঁদের গায়ে। পাহাড়ী ঠাণ্ডা হাওয়া। এই বুঝি জোছনার সঙ্গে চাঁদের মধ্যে থেকে নেমে আসবে ছোটবেলার স্বপ্নের পরী।
ও কী? জঙ্গলের মধ্যে কী ওটা? একটা কালো ঘোড়া না? দুলকি চালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন পাহারা দিচ্ছে জুগনিখাসকে। টানটান গ্রীবা, রাজকীয় ভঙ্গী। চকচকে কালো গা দিয়ে পিছলে পড়ছে চাঁদের সাদা আলো। অপরূপ দৃশ্য। কোথা থেকে এল ঘোড়া? মহুলের নেশায় ভুল দেখা হচ্ছে না তো? একটু জল পেলে হত। ঘুমচোখটা বেশ করে ধুয়ে নিলে হত। এখানেই ছোট একটা নারকোলের খোলে জল রেখে গেছিল না কারিয়ার শাশুড়িমা?
মুখ ফেরাতেই... সামনে ধু ধু জ্যোত্স্না। ঘরগুলো গেল কোথায়? একটা গরু বাঁধার জায়গা ছিল না এখানে? গরুগুলোই বা গেল কোথায়?
ফুটফুটে জ্যোত্স্নায় ধবধবে সাদা ঘোড়ায়... কে? মাথায় উষ্ণীষ, লম্বা একটা সোনালী চাদর পিঠ থেকে নেমে ছড়িয়ে আছে মাঠের পথে, উজ্জ্বল সোনালী একটা রেখা হয়ে। হাতে খোলা তরোয়াল। না, তরোয়াল নয় তো! সোনালী একটা লম্বা জিনিস। ওটাকেই কি রাজদণ্ড বলে? কে ইনি? কোনো রাণী? জঙ্গলের রাণী? বনদেবী? এখানের মানুষজন যেমন বলে? ঘোড়ায় চেপে রাজ্য পরিদর্শনে বেরিয়েছেন? ঘোড়া। সাদা ঘোড়া, কালো ঘোড়া। কালো ঘোড়ায় চেপে দেবী দুষ্টের দমন করেন, সাদা ঘোড়ায় চেপে প্রসন্ন আশীর্বাদ। সুজলা সুফলা ধনধান্য প্রকৃতি, সবুজ অরণ্য, অরণ্যের মানুষ। পাউড়ি মাতা! মুখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না।
মা কি হাসিমুখ? নাকি ক্রুদ্ধ? জুগনিখাসে বাইরের সভ্যতার আঁচ আসা পছন্দ করেন নি?
মানবের বুকের মধ্যে অস্বাভাবিক লাবডুব লাবডুব। কাঁপুনি, যেন জ্বর আসছে হু হু করে। সাদা ঘোড়াটা এগিয়ে আসছে এদিকেই। পাউড়ি মাতার হাতের দণ্ড এগিয়ে আসছে।
কিন্তু আর ভয় করছে না তো। অস্বাভাবিক অপরূপ আনন্দ। সমস্ত ইচ্ছে কামনা বাসনা লোভ লালসা বদলে গিয়ে অপরূপ এক অনুভূতি। কিসের নেশায়, কিসের আশায় এত ছোটাছুটি? এমন দৌড়? সেই কবে থেকে দৌড়, দৌড়, আর দৌড়। অসংখ্য শব্দ, কোলাহলের মধ্যেও বিচ্ছিন্ন প্রতিটি মানুষ। প্রতিযোগিতায় বিচ্ছিন্ন।
অকৃত্রিম ভালবাসায় বুকের মধ্যে টলটল। ঠিক জুগনিখাসের প্রকৃতির মতো অকৃত্রিম। কালচে সবুজ জঙ্গলে উজ্জ্বল চাঁদের আলোর মতো অকৃত্রিম। বড্ড অলীক। শরীরটা এত হালকা হয়ে গেছে যে ইচ্ছে করলেই এক লাফে চাঁদটাকে ছুঁয়ে ফেলবে মানব।
(পরবাস-৬৩, ৩০ জুন, ২০১৬)