Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়ের
লেখা




ISSN 1563-8685




ব্লাড মুন

|| ১ ||

রজায় গিয়ে মৃদু টোকা দিলাম।

আলতো ছোঁয়ায় খুলে গেল। ছোট্ট ঘরটা, বদ্ধ বাতাসে একটা শিরশিরানি, ঘরের ত্রিমাত্রিক দাঁড়িয়ে থাকা হাওয়াতে একটা মৃদু স্তর পরিবর্তন। একপাশে খাটে একটা আবছায়ার মত শুয়ে আছে ও।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে, আর একজন মানুষের শারীরিক উপস্থিতি কী করে যে একটা সংকেত পাঠিয়ে দেয়, একটা ঘুমন্ত শরীর থেকেও বিচ্ছুরণ হয় এনার্জির--ঘরের বদ্ধ হাওয়ার অণুগুলোকে আন্দোলিত করে এসে ধাক্কা দিলো ... স্নায়ুর স্পর্শকাতর মুখগুলোতে।

ঘুমোচ্ছে ও... পাশে ওর সন্তান।

উল্টো দিকে জানালা।

মেপল গাছের ডালগুলোর মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে আর্ত হাওয়া। ভেসে যাচ্ছে। ঘুরছে ডাল ছেড়ে উড়ে যাওয়া শেষ-হেমন্তের অবশিষ্ট মরচে রঙের পাতারা।

রক্ত চাঁদের রাত... বারবার ফিরে আসে না তা। ইচ্ছে করে এই রাতই হোক সব পাবার, বা সব শেষ করে দেবার রাত...

ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরল ও। পাশের আকৃতিটুকু নড়ে উঠলো, আবার একটা সূক্ষ্ম তরঙ্গ খেলে গেল ঘরের হাওয়ায়। এক পা এক পা এগোলাম ওর দিকে। চুম্বকটান।

একবার দেখতে ইচ্ছে করছে ওর মুখ... চোখের পাশে, ঠোঁটের পাশে সূক্ষ্ম রেখাগুলো, বালিশের ওপরে ছড়িয়ে থাকা ওর চুলগুলো স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে। হাত বাড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে ওর হাত; না, পেলবতা নেই আর — প্রাত্যহিকতায় ক্ষয়ে যাওয়া কর্কশতাটুকুকেই ছুঁতে ইচ্ছে করছে।

ওর হাতে একটা চুড়ি, যেটা পরে থাকে সবসময়। আঙুলে একটা আংটি, সারা জীবনের প্রতিশ্রুতির বন্ধন।

ওর, এই জীবনের বন্ধনগুলো খুলে দিতে ইচ্ছে করছে। দেওয়া যায় না আজ রাতে? চলে যাওয়া যায় না? সব কিছু ছেড়ে ? হঠাৎ চোখ পড়ল... ঠিক পেছনেই একটা আয়না; দেখলাম খুব কাছে চলে আসা চাঁদ আর একটা মেপল পাতা, জানলার ফ্রেমে। চাঁদের ওই রুপোগলা আলোও ওর লালটাকে মরচে রং করতে পারেনি।

|| ২ ||

সলে সোফার পাশে দাঁড়িয়ে আমি, নিজের ঘরে, নিজের বৃত্তে, নিজের পরিধিরেখার সীমায়।

জানালার বাইরে মেঘ আর চাঁদের এক আলো-আঁধারী রাত, চাঁদ ঢেকে যাওয়ার এক মায়াজাগরী রাত। হাওয়াতে, আলোয় অন্ধকারে এক জন্মান্তরের ডাক আসার রাত...

শুধু চিন্তায় পৌঁছনো যায় ওর ঘরে... শুধু কল্পনায় ছোঁয়া যায় ওকে। শুধু একটা পরজগতেই ভাগ করে নেওয়া যায় একটা নিজস্ব পৃথিবী, যা তাদের দুজনের।

প্রখর বাস্তবের আলোয় দেখা হয় যখন, তখন তারা পারিবারিক বন্ধুত্বের বাঁধনে বাঁধা। এই মুক্ত হাওয়ার দেশেও তারা দুটো আলাদা সংসারে সম্পৃক্ত পরিণত মানুষ, এই অবেলায়, ভুল পরিস্থিতিতে, ভুল সময়ে খুঁজে পেয়েছে নিজের সত্ত্বার বাকি অংশকে, ... সেটা সুদূরতম কল্পনার বাইরে, তাদের বৃত্তের মানুষজনের। সবার ওপরে, যেখানে তাদের সামাজিক পরিচয়—

মিসেস এক্স আর মিসেস ওয়াই ...

চাঁদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ল ।

একে একে ফিরে আসতে লাগলো রাতের বাকি কাজ... খাবার রেফ্রিজারেটরে তোলা, টিভিতে আসছে রাতের খবরের আওয়াজ।

মেয়ের ঘর থেকে কি যেন একটা প্রশ্ন ভেসে এলো, ঠিক মাথায় ঢুকলো না আমার। হাত কাজ করতে লাগলো, চেনা প্লেট, সাদা কোরেল, সবুজ ফুলের ডিজাইন ধারে, একে একে ঢুকতে লাগলো ডিস ওয়াশারের নিচের র‍্যাকে। একে একে স্পুন, সারভিং স্পুন, ফর্ক, স্প্যাচুলা।

কল থেকে ঝাঁপানো আকস্মিক গরম জলে সম্বিৎ ফিরে আসা, তারপর গরম জল, ডিটারজেন্ট, স্ক্রাব একটা ক্যাথারসিস্‌; ক্লান্ত শিরদাঁড়া বেয়ে নামে একটা আলগা আরাম।

আজকের দিন শেষ...

আর এক ঘরে কম্পিউটারে নিমগ্ন মানুষটাকে কিছু প্রাত্যহিক প্রশ্ন। কিছু জরুরি জিনিস মনে করানো। কাল আবার আর একটা কাজের দিন...

অন্যমনস্ক ভাবে দাঁড়ালাম আয়নার সামনে, ক্রিমের কৌটো খুলতে গিয়ে চোখ পড়ল আয়নায়।

ফ্রেমে একটা মেপল পাতা আর রক্ত চাঁদ। সর্বনাশা চাঁদ। সবকিছু ভাসিয়ে দিতে পারতো ... কিন্তু। ...



(পরবাস-৬৩, ৩০ জুন, ২০১৬)