জামিলুর রেজা একজন কঠোর নিয়ম মানা লোক এবং তাঁকে নিয়েই গল্পের শুরু। তিনি তাঁর গত জীবনের প্রায় প্রতিটি ব্যাপারে “রুলস এন্ড রেগুলেশনের” ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সজাগ। তাঁর সামাজিক স্ট্যাটাস উচ্চ। নর্থ আমেরিকা থেকে ডিগ্রী নিয়ে এসে দেশে স্বনামধন্য মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উঁচু পদ দখল করে নিয়ে বসেছিলেন তিনি। তাঁর সব কাজেই নিয়ম শৃঙ্খলার ছাপ।
সেই জামিলুর রেজা যখন একদিন অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়ে গাড়ি চালিয়ে নগরীর বাইরে উন্মুক্ত মরু প্রান্তরের মতো বালু এবং মিহি বালুমাটি সমৃদ্ধ জায়গায় এসে থামলেন তখন আমরা ভাবি জামিলুর রেজা সাহেব আজ কেন এখানে এলেন! এটা কি তাঁর কোন নিয়ম শৃঙ্খলার অংশ, না এই অফিস কামাই দিয়ে তপ্ত সূর্যের নিচে জনমানবহীন বালুকাপ্রান্তরে আসার অন্য কোন অর্থ আছে? আমরা জামিলুর রেজা সাহেবকে এইসময় প্রথমবারের মতো বুঝতে পারি না কারণ তাঁর পূর্বজীবন আমাদের এই নির্দেশ দেয় যে তিনি কোন অবস্থাতেই নিয়ম ভাঙার মতো লোক নন। কিন্তু আমাদের সাধারণ কমনসেন্স বলে যে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদস্ত কর্মকর্তার এই গরম বালুভূমিতে কোন কাজ থাকতে পারে না। আমরা দ্বিধা এবং ধন্ধে পড়ে যাই। আমাদের তখন মনে হয় জামিলুর রেজা একজন ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার।
আমরা জামিলুর রেজাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। আমরা তাঁর গত জীবন নিয়েও পর্যালোচনা করি। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় জামিলুর রেজা একবার তিন মিনিট দেরী করে ক্লাসে ঢোকেছিলেন। একবার তাঁর মেয়ের অসুস্থতার জন্য তিনি অফিসে যেতে তেরো মিনিট দেরী করেছিলেন। গত দশ বছরের মধ্যে মাত্র একবার তিনি অতিরিক্ত মদ পান করেছেন এবং সেদিন তাঁর প্রতিদিনের ঘুমের সময় বারোটা পঁচিশ মিনিটের মধ্যে তিনি ঘুমাতে পারেননি। এছাড়া তাঁর জীবনে উল্লেখ করার মতো কোন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে নাই। তাঁর অধীনস্তদেরও তিনি কঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে রেখেছেন। এহেন নিয়মানুবর্তীতার ইতিহাস দেখে আমাদের আবার মনে হল এইদিক দিয়েও জামিলুর রেজা একজন ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। এবং তিনি মনে হয় কোন সাধারণ লোক না, বিশেষ লোক।
জামিলুর রেজার অসাধারণত্ব আমাদের কাছে প্রকাশিত হবার পর তাঁর প্রতি আমাদের আগ্রহ বেড়ে গেল। আমরা উৎসাহের সাথে তাঁকে দেখতে লাগলাম।
জামিলুর রেজা মাটির রাস্তার একপাশে তাঁর দামী গাড়িটা রেখে নেমে এলেন। তিনি চারিদিকে তাকালেন। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বালুভূমিতে প্রবেশ করলেন। এই বালুভূমি মরুভূমি না। তবে মরুভূমির মতোই উন্মুক্ত ধূসর বালুকা প্রান্তর, যেখানে বালুর সাথে মিশে আছে মিহি মাটির কণা। স্থানে স্থানে সামান্য সামান্য ঘাস। সেইসব ঘাসের কোথাও কোথাও উজ্জ্বল বেগুনী রঙের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুল, যেগুলা যেন এই রুক্ষ, শুষ্ক বালুভূমিতে সাপের মস্তকের কল্পিত মুক্তার মতো ফুটে আছে।
জামিলুর রেজা হেঁটে হেঁটে বালুভূমির গভীরে চলে গেলেন। তাঁকে আমাদের এখান থেকে ক্ষুদ্র মনে হতে লাগল। আমরা তাঁর সাইড ভিউ দেখছিলাম। আমরা দেখলাম কিছুক্ষণ তিনি দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে এক পা মাটির সাথে লাগিয়ে অন্য পা দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। তাঁর ভাবভঙ্গি অন্যরকম দেখে আমাদের মনে ভাবনার উদ্রেক হল তিনি ঐখানে কী করেন। তাই আমরা ভিউ পরিবর্তন করে টপ ভিউয়ে গেলাম এবং জুম পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁর কিছু নিকটে যাওয়ার চেষ্টা করা হল। তখনি আমাদের চোখে পড়ল জামিলুর রেজা বৃত্ত আঁকছেন বালুভূমিতে। যদিও তাঁর বৃত্ত আঁকার কথা না। আমরা তাঁর গত জীবন পর্যালোচনা করে দেখলাম, ড্রয়িং তাঁর পছন্দের কোন বিষয় ছিল না কোন কালে।
জামিলুর রেজা তাঁর পা দিয়ে দীর্ঘ বৃত্ত আঁকছেন। তাঁর বৃত্ত গোল না হয়ে পেট মোটা খরগোশের মতো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি এক মনে বৃত্ত এঁকে চলেছেন। আমাদের প্রচণ্ড কৌতূহল হল তিনি কেন এই বৃত্ত আঁকছেন। আমরা তাঁকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম।
জামিলুর রেজা সূর্যাস্ত পর্যন্ত একটানা তপ্ত বালুভূমিতে তাঁর কাজ করে গেলেন। আমাদের কৌতূহল সময়ের সাথে সাথে বেড়ে এই মিহি মাটির কণা ও বালুকারাশির মতো বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল। তাই জামিলুর রেজা যখন সূর্যাস্তের সময় তাঁর দামী গাড়িটি নিয়ে পুনরায় নগরের দিকে চলে যান তখন আমরা ঠিক করি আমরা এই বালুভূমিতে আঁকা জামিলুর রেজার চিত্র পর্যবেক্ষণ করব এবং এতে নিশ্চয়ই আমাদের কৌতূহলের নিবৃত্তি হবে।
আমরা সারা রাত বালুভূমিতে আঁকা জামিলুর রেজার ছবি পর্যবেক্ষণ করলাম। কিন্তু তাতে এমন কিছু আমরা পেলাম না যাতে আমরা বুঝতে পারি তিনি কি করেছেন বা কেন করেছেন। আমরা হতাশ হয়ে পড়লাম।
আমরা ঠিক করলাম পুনরায় জামিলুর রেজা সাহেবের কাছে যাব কারণ তিনি আসলেই একজন ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার।
পরদিন সকাল নয়টার সময় আমরা জামিলুর রেজার বাড়িতে গেলাম। তাঁর বাড়ির বাইরের গেট বন্ধ ছিল। ভেতরে দারোয়ান আর চেইন দিয়ে বাঁধা বিদেশী কুত্তা। আমরা উঁকি দিয়ে দেখলাম জামিলুর রেজার দামী গাড়ি সেখানে নেই।
আমাদের তখন মনে হল, জামিলুর রেজা নিশ্চয়ই অফিসে চলে গেছেন। হয়ত গতকালের দিনটি ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত দিন। অথবা এমনও হতে পারে গতকাল আমরা যা দেখেছি তা এক ধরনের ইল্যুশন। কারণ চোখে যা দেখা যায় তা সব সময় সত্য হয় না এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলি চোখে দেখা যায় না।
আমরা জামিলুর রেজাকে পর্যবেক্ষণ করার বাসনায় তাঁর অফিসে গেলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমাদের দেখতে হল তাঁর চেয়ার খালি। তিনি অফিসেও নেই!
এইবার আমাদের মধ্যে কিছুটা দুশ্চিন্তা দেখা দিল। জামিলুর রেজা কি কাল বাসায় ফিরেছিলেন? নাকি তিনি কোথাও হারিয়ে গেলেন? জামিলুর রেজা কি ঐ বালুকাপ্রান্তরে তিনি কোনদিকে যাচ্ছেন তার ম্যাপ এঁকে কোথাও চলে গিয়েছেন?
এইসব চিন্তা আমাদের মধ্যে আসতে শুরু করল। আমরা তাই নগরের বাইরে যে জনমানবহীন বালুভূমিতে জামিলুর রেজা পা দিয়ে ছবি এঁকেছিলেন সেখানে চলে গেলাম।
আমরা গিয়ে দেখতে পেলাম মাটির রাস্তার একপাশে জামিলুর রেজার দামী গাড়িটি এবং অনেক দূরে জামিলুর রেজা গতদিনের মতো পা দিয়ে বালুভূমিতে ছবি আঁকছেন। আমরা দ্রুত টপ ভিউ-এ গেলাম এবং জুমিং-এর মাধ্যমে গতদিনের মতো তাঁকে দেখতে শুরু করলাম।
সেদিন সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত গতদিনের মতোই আমরা তাঁকে বালুভূমিতে ছবি আঁকতে দেখলাম। আমাদের মনে হল অবশ্যই এই ছবির কোন অর্থ আছে। আমরা সেইদিন রাত্রেও ছবির অর্থ খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছু না পেলেও আমাদের মনে হল আমরা অনেক এগুতে পেরেছি।
জামিলুর রেজা প্রতিদিন এরকম করে সকাল সাতটার দিকে গাড়ি নিয়ে বালুভূমিতে চলে আসতে লাগলেন। এসে তপ্ত সূর্যের নিচে হেঁটে হেঁটে বৃত্তের মতো কী যেন আঁকতে থাকেন। আর আমরা প্রতিদিন রাতে তাঁর সেই আঁকা চিত্রের উত্তর খুঁজতে থাকি।
এইমতো অনেকদিন চলে গেল। আমরা আমাদের বাকি কাজ ভুলে জামিলুর রেজার চিত্র আঁকা দেখা এবং চিত্রের অর্থ খোঁজার কাজে ব্যস্ত থাকতে লাগলাম। এবং এক সময় আমাদের মনে হল জামিলুর রেজার ছবিগুলো আমাদের এই তপ্ত বালুকাপ্রান্তরে আটকে ফেলেছে। আমরা ইচ্ছা করলেও বেরোতে পারছি না। আমাদের এখন প্রতিরাতেই এই ছবিগুলোর অর্থ খোঁজার কাজে বসতে হয়। ভয়ংকর আসক্তিযুক্ত মাদকের মতো এই ছবিগুলো আষ্টেপৃষ্ঠে আমাদের ধরে রেখেছে যেন। তখন আমাদের মনে হল হয়ত জামিলুর রেজাই আমাদের এখানে আটকে রেখেছেন। তিনি হয়ত কোনভাবে বুঝতে পারেন যে আমরা তাঁকে পর্যবেক্ষণ করছি এবং সেই বুঝতে পারায় তিনি মনঃক্ষুন্ন হন। এর জন্য এই বালুভূমিতে কৌশলে অতিপ্রাকৃতিক কোন চিত্র এঁকে আমাদের তিনি এখানে আটকে রেখেছেন।
জামিলুর রেজাকে আমাদের ভয় হতে শুরু করে কিছুটা এবং আমরা চিন্তা করতে লাগলাম জামিলুর রেজা কেন চান না আমরা তাঁর জীবন পর্যবেক্ষণ করি?
এর কারণ আমরা ভেবে বের করলাম দুইটা—
১। হয়ত জামিলুর রেজার জীবনে এমন কোন কুৎসিত বা লজ্জাজনক ঘটনা রয়েছে যা পৃথিবীর সব কুৎসিততা বা লজ্জার সমান।
২। হয়ত জামিলুর রেজা একজন বিশেষ কেউ যিনি বিশেষ কোন উদ্দেশ্যে এই ধরাধামে আগত এবং তিনি চান না তা প্রকাশ হোক।
আমাদের কৌতূহল, বিরক্তি এবং ভয় ক্রমেই বাড়তে লাগল। যদিও প্রশ্ন করা আমাদের নীতির বাইরে। এমন দুইয়ের অধিক প্রশ্ন আমাদের সব ধরনের ভাব প্রকাশকে স্তব্ধ করে দেয় তথাপি কৌতূহলের কাছে পরাজিত হয়ে আমরা ঠিক করলাম জামিলুর রেজাকে আমরা প্রশ্ন করব।
তাই একদিন জামিলুর রেজা যখন তপ্ত সূর্যের নিচের বালুকাপ্রান্তরে একাগ্রচিত্তে তাঁর কাজ করে যাচ্ছিলেন তখন আমরা আমাদের প্রথম প্রশ্ন করলাম--জামিলুর রেজা, আপনি এখানে কী করেন?
জামিলুর রেজা প্রশ্ন কোনদিক থেকে আসছে না ভেবেই উত্তর দিলেন, ড্রয়িং।
আমরা উত্তরে হতাশ হলাম। কারণ এতে কিছু বুঝা গেল না ভালোমতো।
আমরা দ্বিতীয় প্রশ্ন করলাম, জামিলুর রেজা, আপনি নিজের অফিসের কাজ ফেলে এখানে বসে আছেন কেন?
জামিলুর রেজা বালুভূমিতে পা দিয়ে বৃত্ত আঁকতে আঁকতে আগের মতোই বললেন, কোনটা কার কাজ তা তোমাদের জানার কথা না। মানুষের কাজ শুধুমাত্র মানুষ নিজেই জানে। অন্তরের উপরের বা ভিতরের খোলস এবং এদের উপরের মরচেপড়া স্তর যে কাজগুলাকে প্রধান কর্তব্য করে তোলে তা মাঝে মাঝে বুদবুদের মতো উবে যায় অন্তরের ভিতরবাড়ির কর্মের টানে।
এই প্রশ্নের উত্তরেও আমাদের হতাশ হতে হল। কারণ এই দার্শনিক প্রশ্নে জামিলুর রেজা হয়ত বুঝাতে চাচ্ছেন তাঁর অন্তরের কাজ এই বৃত্ত আঁকা। কিন্তু তাঁর পূর্বজীবন বিশ্লেষণ করে আমরা পাই না কোথাও তিনি ড্রয়িং পছন্দ করেন। তাঁর অন্তর সম্পর্কে আমাদের যা ধারণা তাতে তিনি কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখা একজন কঠিন মানুষ।
এইবার তৃতীয় প্রশ্ন করব কি না তা নিয়ে আমরা দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। কারণ তৃতীয় প্রশ্ন করার পর এর উত্তর পাওয়ার সাথে সাথে আমাদের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে। আমরা কোনভাবেই আর ভাব প্রকাশ করতে পারব না। সুতরাং গল্পেরও সমাপ্তি হবে উত্তরের মাধ্যমে।
আমাদের ভিতরে অদম্য কৌতূহল বিরাট পাহাড়ের মতো গজিয়ে উঠেছিল। পর পর দুটি প্রশ্নের বিভ্রান্তিমূলক উত্তর আমাদের ভিতর জেদ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
আমরা একটু কৌশলী পথে হেঁটে তাই তৃতীয় প্রশ্ন করতে মনস্থির করলাম এবং জামিলুর রেজাকে জিজ্ঞেস করলাম, জামিলুর রেজা, আমরা আপনাকে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি আপনি সাধারণ কেউ না। অতএব, আপনি আমাদের বলুন এমন কিছু যা আমরা জানি না?
জামিলুর রেজা পা দিয়ে বালুভূমিতে বৃত্ত আঁকা থামিয়ে মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর চিৎকার করে বললেন, এইসব বৃত্তের প্রাণ আছে মান্যবরেরা। এইসব বৃত্তের প্রাণ আছে। এইসব বৃত্ত প্রকৃতির হাসি কান্না আর আনন্দের সাথে বাঁচে।
(পরবাস-৬৩, ৩০ জুন, ২০১৬)