Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines





পরবাসে
রাহুল রায়ের

লেখা

বই


ISSN 1563-8685




অপুর জ্যাঠামনি

ক্ষিণ কলকাতায় অপুদের মস্ত দোতলা বাড়িটা বেশ পুরোনো। আর নিয়মিত মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তার এখানে-ওখানে ছাল-ছাড়ানো মুরগীর মত লাল-গেরুয়া ইঁট দাঁত বার করে রয়েছে। তাছাড়া আছে দখলদারি বট-অশ্বথের দল। যেখানেই সুযোগ পেয়েছে তারা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বড় রাস্তা থেকে একটা লম্বা পাথরের নুড়ি আর এখানে-ওখানে আগাছা-ভরা গাড়ি চলার রাস্তা একটা মস্ত গাড়ি-বারান্দার তলায় গিয়ে থেমেছে। কয়েকটা চওড়া চওড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাড়িতে ঢোকার বিরাট দরজা। বোঝা যায় যে এককালে এ বাড়ির সুদিন ছিল। এখন তার কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই।

এই বাড়িতে ঘরের সংখ্যা অনেক, কিন্তু বর্তমানে এই বাড়ির বাসিন্দা মোটে চার — অপুর মা-বাবা, অপু আর এই বাড়ির বহু পুরোনো এক কাজের লোক, হরিদা। অপুর ঠাকুমা বেঁচে ছিলেন অনেক বয়স অবধি। বছর তিনেক আগে তিনি গত হয়েছেন। তাঁর মুখে শোনা যে একসময় নাকি এই বাড়িটাতে লোকে একেবারে গম গম করত বাড়ির মালিক, রায় বাহাদুর ব্রজেন্দ্রকিশোর আর তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, ঠাকুর-চাকর, এদের সব নিয়ে। আর ছিল কর্তামশাইয়ের মোসাহেবের দল। সে প্রায় দু-তিন পুরুষ বা তার আগের ব্যাপার। অপুদের বাড়ির একতলায় একটা মস্ত বড় হল ঘর আছে। সেখানে নাকি একসময় নিয়মিত নাচ-গান-বাজনার আসর বসত। ঠাকুমার মুখে শোনা, সেই সব আসরে সাহেব-টাহেবরাও যাতায়াত করত।

এখন সেই হল ঘরটা সবসময়ই বন্ধ থাকে। তবে একদিন কী কারণে সেই ঘরের দরজাটা খোলা ছিল। আর তখন অপু বড়দের নজর এড়িয়ে উঁকি মেরে দেখেছে ঘরের মধ্যিখানে আছে একটা মস্ত ঝাড়-লন্ঠন, আর দেওয়ালে ঝুলছে বড় বড় সব ছবি। মাকড়শার জাল আর আলোর অভাবে এর বেশি সে দেখতে পায়নি। ঠাকুমাকে এ কথা বলতে তিনি বলেছেন ওগুলো নাকি অপুর পূর্বপুরুষদের ছবি। এর কয়েক মাস পর দুজন মুটে নিয়ে এক ভদ্রলোক এসে হাজির। তার সেই হলঘর থেকে ঝাড়লন্ঠনটা খুলে নিয়ে গেল। নিয়ে গেল ছবিগুলোও। অপুর বাবা গম্ভীরমুখে এসবের তদারকি করছিলেন। অপুর নজর এড়ায়নি যে বাবার চোখে জল চিক-চিক করছে। সেদিন সন্ধেবেলা ঘরের দরজা বন্ধ করে বাবা আর ঠাকুরমার কথা হচ্ছিল, অপু আড়ি পেতে শুনেছে — বাবা ধরা-ধরা গলায় ঠাকুমাকে বলছে — ‘আমাদের পুরোনো ঐতিহ্যের আর কিছুই রইল না, খালি এই ভাঙা-চোরা বাড়িটা বাকি। তাও কতোদিন ধরে রাখতে পারব তা জানি না’।

একটা ব্যাপারে অপু বেশ আশ্চর্য হয়েছে। লোকদুটো ছবিগুলো দেওয়াল থেকে নামিয়ে, ঝুল ঝেড়ে উঠোনে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল নিয়ে যাওয়ার আগে। অপু তার ঠাকুমার মুখে শুনেছে এই ছবিগুলোকে অয়েল পেইন্টিং বলে। কোনো কোনো ছবি নাকি নামকরা সাহেব আর্টিস্টদের আঁকা, অনেক দামের। অপু বিস্ফারিত চোখে ছবিগুলো দেখছিল আর আশ্চর্য হচ্ছিল--এরা তার পরিবারের লোক! প্রায় সবায়ের পরনেই জমকালো পোষাক। একজনের কোমরবন্ধে আবার তরোয়াল ঝুলছে। বেশ রাজা-রাজা ভাব সবায়ের। তবে একজনের ছবি দেখে ভারি আশ্চর্য হল অপু। তার গায়েও জমকালো পোষাক। কিন্তু ভীষণ দুর্বল চেহারা। আর মুখের দিকে তাকালে মনে হয় যেন এক কঙ্কালের মাথায় পাগড়ি জড়ানো। বিশেষ করে দুটো কষের দাঁত যেন ঠোঁটের ফাঁক ঠেলে বেরিয়ে আসছে। বেশ অবাক হল অপু — জীবন্ত লোকের এ কেমন ছবি! অপু ভাবলে — হয়তো লোকটার খালি অসুখ করত, আর তাইতেই তার চেহারার এমন অবস্থা।

অপুর সাথে তার ঠাকুমার ভারী ভাব। আর অপুকে পেলেই তিনি সে গল্পের ঠাকুরমার ঝুলির মত এই বাড়ি এই পরিবারের নানা গল্পের পসরা খুলে বসেন। এক সময় এই বাড়ির কত জাঁক-জমক ছিল সে সব তাঁর নিজের চোখে দেখা। আবার সেই জৌলুষ আস্তে আস্তে কমতে আরম্ভ করল, তারপর একসময় সবই শেষ হয়ে গেল। এই বলতে বলতে ঠাকুমা চোখ জলে ভরে আসে। বাড়ির পুরোনো জৌলুষ ছাড়া এই পরিবারের নানান লোকের কথাও অপুর ঠাকুমার মুখে শোনা। অপুর দেখা অয়েল পেইন্টিংগুলোর মধ্যে সবথেকে বড়ো ছবিটা রায় বাহাদুর ব্রজেন্দ্রকিশোরের। সবচেয়ে জমকালো। তারপর তার পুত্র-প্রপৌত্র থেকে আজকের দিনে এসে ঠেকেছে। অপুর বাবার দুই ভাই আর এক বোন। সে বোনটি বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। খুব বেশি বাপের বাড়ি আসে না। আর বাবার বড় দাদা, বা ঠাকুমার বড় ছেলের কথা বলতে গিয়েই প্রতিবারই অপু তাঁর চোখে জল চিক-চিক করতে দেখেছে। অপু তার পাঁচ বছরের জীবনে তার জ্যাঠাকে কোনদিন দেখেনি। অপু ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করেছে — ‘জ্যাঠামনি কোথায় ঠামা?’ ঠাকুমা বলেছেন --

—‘এই বাড়িতেই সে আছে। কিন্তু তার সাথে দেখা হওয়া মুশকিল। ছোটবেলা থেকে কী যে তার এক রোগ হল। একটু বড় হতেই সে কারোর কাছে আসতে চাইত না, কোথাও যেত না। বলে সে একদম আলো সহ্য করতে পারে না’।

‘তা, ডাক্তার দেখানো হয়নি?' অপুর প্রশ্ন।

‘তা আর হয়নি! নানান ডাক্তার দেখান হয়েছিল। কিন্তু কেউই কিছু ঠিক মতো ধরতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত একজন বলেছিল তার কী এক বিদ্‌ঘুটে অসুখ হয়েছে। যত বয়স বাড়বে তার মুখ-চোখ পালটে যাবে। তাকে দেখতে নাকি রক্তচোষা বাদুড়ের মত হয়ে যাবে।'

রক্তচোষা বাদুড়! মানে ভ্যাম্পায়ার? কিছুদিন আগেই সে টিভিতে ড্রাকুলা মুভিটা দেখেছে। ড্রাকুলা ছিল মানুষরূপী ভ্যাম্পায়ার। সিনেমাটা দেখতে দেখতে অপু বার-বার ভয়ে চোখ বন্ধ করেছিল। আর তার জ্যাঠামনিকে দেখতে ভ্যাম্পায়ারের মত? মুখের দু-পাশে বড়-বড় কষ দাঁত বেরিয়ে আছে, আর তা রক্তে-রক্তে লাল! মানুষের রক্ত খেয়েই তারা বেঁচে থাকে। যা: তা হতে পারে নাকি? যতসব আজে-বাজে বাড়ানো কথা! কিন্তু ঠামা নিজের ছেলের সম্বন্ধে খারাপ কথা বলবে কেন? তা ছাড়া অপুর কিছুদিন আগে দেখা তার এক পূর্বপুরুষের ছবির কথা মনে পড়ে গেল। তার মুখের চেহারা দেখেও অপুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল।

জ্যাঠামনির কথা বলতে গিয়ে ঠামার দু-চোখ ভরে এলো জল। ভাঙা-ভাঙা গলায় বললেন, ‘শেষে ছাদে চিলেকোঠার ঘরে সে স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়েছে। ওখান থেকে সে নিচে নামে না। সেখানেই খাওয়া-দাওয়া সব সেবা দেওয়া হয়। ইদানীং আমার সাথেও সে দেখা করতে চায় না। বলে তাকে দেখলে আমার নাকি কষ্ট হবে। কিন্তু আমি তো মা। আমার কষ্ট কে দেখবে!’ এই বলে ঠামা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।

তারপর ঠামাও একদিন চলে গেলেন। আর, এই বাড়িটার কথা, তার পূর্বগৌরবের কথা, অপুর জ্যাঠামনির কথা বলার আর কেউ রইল না।


ঠামা চলে যাওয়ার পর প্রায় বছরখানেক কেটেছে। ঠামার স্মৃতিও অপুর মনে ফিকে হতে আরম্ভ করেছে। আর সঙ্গে-সঙ্গে জ্যাঠামনির কথাও বিলকুল ভুলে গেছে। সেদিন অপু বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখে বাবা-মা দুজনেই বাড়িতে। মা স্কুলে পড়ান, সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু বাবার ফিরতে সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়ে যায়। তারা এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরল কেন? এদিকে অপুর পিসি যিনি সচরাচর বাপের বাড়ি আসেন না, তিনিও হাজির। কিন্তু অপুর দিকে কেউই নজর দিচ্ছে না। খালি মা বললেন, ‘যাও, হাত-মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে গিয়ে পড়তে বসো, আমি জল-খাবার ওখানে দেওয়ার কথা বলে দিচ্ছি।’ অপু নিজের ঘরে গিয়ে বই-পত্রে মন দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তা কি সম্ভব! এইতো সে সবে স্কুল থেকে এসেছে। কোথায় একটু খেলবে-টেলবে তা না আবার পড়তে বসা। সুতরাং বইয়ের পাতা কয়েকবার উলটে-পালটে দেখার পর সে খুঁজতে বেরোলো। কী হয়েছে বাড়িতে? সবাই এসেছে, কিন্তু খুব চুপ-চাপ। মনে পড়ে গেল স্কুল থেকে বাড়ি ঢোকার মুখে ডাক্তারদাদুর গাড়িটা বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছে। তখন কিছু মনে হয়নি। তাহলে কারো কিছু হয়েছে? কিন্তু কাকে জিজ্ঞাসা করে, আশেপাশে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

অপু আর ওর মা-বাবার ঘর দোতলায়, আর ঠামার ঘর নিচে, একতলায়। অপু দেখলো ওপরের ঘরে কেউ নেই। আর নিচে গিয়ে দেখে ঠামার ঘরের দরজা বন্ধ। এই সময় তো মা স্কুল থেকে এসে ওই ঘরে বসে চা খেতে খেতে টিভি দেখেন। দরজা তো খোলাই থাকে। দরজায় অল্প চাপ দিতে সে বুঝল যে সেটা ভিতর থেকে বন্ধ। দরজার গায়ে কান পাততে অপু শুনতে পেল ঘরের ভিতরে চাপা গলায় কথা চলছে। অপুর মনে হল কে যেন মৃদুস্বরে কাঁদছে। এ মার গলা নয়। তবে পিসি হবে। কী হল? কিন্তু জানার কোনো উপায় নেই। অপু নিজের ঘরে ফিরে যাবে বলে পা বাড়িয়েছে তখন হঠাৎ দরজা খুলে বাবা বেরিয়ে এলেন। অপুকে দেখে তিনি বেশ হতচকিত হয়ে ভাল করে দরজাটা বন্ধ করলেন। তারপর বললেন, ‘যাও, তুমি নিজের ঘরে যাও। আজ একটু নিজে-নিজে থাকো। আমরা একটু ব্যস্ত আছি। হরিদা তোমার ঘরে রাতে খাবার দিয়ে আসবে।’

অগত্যা অপু নিজের ঘরে ফিরে আবার বই-খাতা নিয়ে পড়তে বসল। ততক্ষণে সন্ধে কাটিয়ে অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পর বাড়ির পুরোনো কাজের লোক হরিদা অপুর রাতের খাবার নিয়ে হাজির।

‘বাড়িতে কী হয়েছে, হরি-দাদা?’ অপুর প্রশ্নে হরিদা বেশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তারপর সামলে নিয়ে বলল, ‘না, না সেরকম কিছু নয়। তুমি খেয়ে-দেয়ে, বাথরুম সেরে ঘুমিয়ে পড়, কাল সকালে তো আবার তোমার স্কুল আছে।’

অপু ঘুমিয়ে পড়েছে, হঠাৎ খুব চাপা গলায় ‘বল হরি, হরি বোল’ ধ্বনিতে ওর ঘুমটা ভেঙে গেল। ওই মৃদু গলায় কান্নাও আবার শোনা গেল। কিছু বোঝার আগে সারা দিনের ক্লান্তিতে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। তার পরের দিন উঠে দেখে সবই একেবারে স্বাভাবিক, যেন আগের দিন কিছুই হয়নি। এ কী করে হয় — অপু ভাবল, কিন্তু কাউকে জিজ্ঞাসা করতে সাহস পেল না।


সেই দিনের পর মাস খানেক কেটেছে। অপুদের স্কুলে গরমের ছুটি। পড়াশুনো কিছু নেই। মা-বাবা কাজে গেছেন। এদিকে সন্ধে হতে হতেই সারা আকাশ জুড়ে ধেয়ে এল কালো মেঘ। শীগগিরই ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবে। অপুর ঝড় দেখতে আর বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভাল লাগে। বাড়িতে বড়রা থাকলে অবশ্য তা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। অপুর সহজে ঠান্ডা লাগার ধাত আছে। মা পই-পই করে বারণ করে দিয়েছেন যেন কিছুতেই সে বৃষ্টিতে না ভেজে। আজ বাড়িতে কেউ নেই। তাই অপু আনন্দে একেবারে আটখানা হয়ে ছুটত ছুটতে ছাদে গিয়ে হাজির। কিন্তু সেখানে গিয়েই বুঝল কাজটা ভাল করেনি। চারদিক থেকে ঘন কালো অন্ধকার যেন তাকে গিলে খেতে এল। মাঝে-মাঝে পিলে চমকানো কড়-কড়াৎ করে বাজ আর এ ধার থেকে ও ধার ছোঁয়া আঁকা-বাঁকা ছুরির মত বিদ্যুৎ আকাশটা ফালা-ফালা করে দিচ্ছে। তখনো বৃষ্টি নামেনি, কিন্তু ঝড়ের গোঁ-গোঁ আওয়াজে কান পাতা দায়। প্রচণ্ড একটা ভয় অপুকে ঘিরে ধরল।

সিঁড়ির দিকে ঘুরে নিচে নামার চেষ্টা করতেই অপু দেখতে পেল যে সে চিলেকোঠার জ্যাঠামনির সেই ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ কোথায় বাজ পড়ল বিকট স্বরে আর বিদ্যুতের আলোতে সেই অন্ধকারেও অপু দেখতে পেল সেই ঘরটার বাইরে কোনো তালা লাগানো নেই। বেশ আশ্চর্য হল অপু। এর আগে দিনের বেলা সে কয়েকবার ছাদে এসেছে, আর দেখেছে যে ঘরটার বাইরে একটা মস্ত তালা ঝুলছে। ঠামার মুখে শুনেছিলো যে চিলেকোঠার ঘরেই জ্যাঠামনি থাকেন। একদিন বাবাকে সেই তালা খুলে ভিতরে ঢুকতেও দেখেছিল। বুঝেছিল যে ওই তালা খুলেই তার জ্যাঠামনিকে খাবার-দাবার দেওয়া হয়। আর কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করতে পারে তার জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু জ্যাঠামনিকে দেখার কৌতূহলের কোনদিনই নিরসন হয়নি। ভ্যাম্পায়েরের মত দেখতে কোন মানুষ হয় নাকি, যতো সব বাজে কথা। এই দুর্যোগের মধ্যেও অপু ভাবল এতোদিনে সেই সুযোগ এসেছে। এদিকে মনে ভয়, আবার মনে মনে উল্লাসিত হলও কম নয়।

এক-পা এক-পা করে এগিয়ে সে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঢুকবে? জানি না কী দেখবে। দরজা একটু ফাঁক করে দেখে ভিতরটা একেবারে নিকষ অন্ধকার। বাইরে তবু চারপাশের বাড়ির আলো দেখা যায়, তাছাড়া আছে বিদ্যুৎ। কিন্তু এই ঘরের অন্ধকার বাইরের অন্ধকারের চেয়ে অনেক বেশি কালো। লাইট সুইচটা খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ে গেল জ্যাঠামনি একেবারে আলো সহ্য করতে পারেন না। ইতিমধ্যে তার চোখ অন্ধকারে অনেকটা ধাতস্থ হয়ে গেছে। হঠাৎ মনে হল ঘরের এক কোণে কে যেন বসে আছে। অপু দরজা খুলতে আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে সে তার দিকে তাকাল। খর-খর করে ইঁদুরের মত কী একটা জন্তু অপুর পায়ের ওপর দিয়ে ছুটে গেল। ভয়ে পা সরিয়ে নিতে গিয়ে সে দেখতে পেলো সেই কালো অন্ধকারটা তার দিকে এগিয়ে আসছে। এতক্ষণে অপুর ভয়টা আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ছুটে পালাবে তার উপায় নেই, পা দুটো কে যেন মাটির সাথে গেঁথে রেখেছে।

এদিকে সেই কালো অন্ধকারটা আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে আসছে। কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না, পুরো শরীরটা কালো কাপড়ে ঢাকা, খালি মুখের কাছটা আবছায়া দেখা যাচ্ছে। লোকটা ওর কাছে এসে মুখ নামাতেই অপু দেখতে পেলো দুটো আগুনের ভাঁটার মত চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর মুখের দু-পাশে ও দুটোকে কি দাঁত বলা যায়? এতো সেই টিভিতে দেখা ড্রাকুলার মত। তাহলে এটা কি সত্যিই এক ভ্যাম্পায়ার! চেঁচাতে গিয়ে তার গলা দিয়ে খালি একটা ঘড় ঘড় আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বেরোলো না। হঠাৎ অপুর পা দুটো মাটি থেকে খুলে এল, আর ও এক চোখ সেই ভ্যাম্পায়ারটার দিকে আর এক চোখ দরজার দিকে রেখে এক-পা এক-পা করে সরতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু তার আগেই ওর কাঁধে কেউ যেন একটা মোটা সূচ ঢুকিয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে দরজার কাছে পৌঁছতেই বাইরে বিকট আওয়াজে বাজ আর তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ আকাশটা ফালা-ফালা করে দিতেই ভ্যাম্পায়ারটা ছিটকে সরে গেল।

কী ভাবে যে সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে এসেছিল অপুর কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান এল তখন সে দেখল বাবা-মা তার দিকে তাকিয়ে আছেন। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বাড়ির ডাক্তারদাদু। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছিল অপু? কাঁধে এত গভীর ভাবে ক্ষত হল কী করে? কোথাও পড়ে গিয়েছিলে নাকি? কিন্তু, পড়ে গেলে তো এরকম ক্ষত হয় না। দেখে তো মনে হচ্ছে কোন কুকুর বা ঐ জাতীয় কোন জন্তু কাঁধে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে।’

প্রচণ্ড ব্যথা সামলিয়ে অপু জড়িয়ে-জড়িয়ে উত্তর দিল, ‘না পড়ে যাইনি। তবে বৃষ্টি দেখতে গিয়ে ছাদে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি জ্যাঠামনির ঘরে কে যেন আছে। সে আমাকে জড়িয়ে ধরার পর আর কিছু মনে নেই।’

অপুর উত্তরে সবাই ভীষণ আশ্চর্য হলেন। শেষে বাবা বললেন, ‘জ্যাঠামনির ঘরে কেউ? ওখানে তো কেউ নেই! দাদা তো মাসখানেক হল মারা গেছেন!’

অপু আবার যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে উত্তর দিল, ‘অবশ্যই কেউ ছিল। আমি একটুও ভুল করিনি। তাকে দেখতে ভ্যাম্পায়ারের মত।’

অপু প্রবল যন্ত্রণার মধ্যেও দেখতে পেল সবায়ের মুখে ভীষণ আশ্চর্য হওয়ার ছাপ সুস্পষ্ট।

‘তুই ঠিক দেখেছিস?’ বাবার প্রশ্ন।

‘হ্যাঁ। চোখগুলো অন্ধকারে ভাঁটার মত জ্বলছিল। আর কষের দু-পাশে বেরিয়ে আসা দাঁত। ঠিক যেন সিনেমায় দেখা ভ্যাম্পায়ার।’

সবাই মাথা নিচু করে একেবারে চুপ। মুখে আশ্চর্য হওয়ার বদলে প্রচণ্ড ভয় যেন ফুটে বেরোচ্ছে। শেষে মা নীরবতা ভেঙে প্রায় ককিয়ে উঠে বাবাকে বললেন, ‘আমি তোমাকে বলিনি, তোমার দাদার মৃত্যু অপঘাতে মারা যাওয়ার মতোই। বলিনি গয়ায় পিণ্ডি না দিলে তাঁর আত্মার শান্তি হবে না! আমার কথা শোনোনি, এখন দেখো কী হয়!’

বাবা প্রায় চুরির দায়ে ধরা পড়ার মত গলায় বললেন, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে। ঠিক বুঝতে পারিনি যে এই যুগেও এরকম হতে পারে। আমি আজই গয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।’

খালি বাড়ির বহু দিনের পারিবারিক চিকিৎসক ডাক্তারদাদু মাথা চুলকিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিন্তু অপুর আমি কী চিকিৎসা করি? আমাদের মেডিকাল সায়েন্সে তো ভ্যাম্পায়ার কামড়ালে কী করতে হয় তা বলা নেই। সত্যি কথা বলতে কী আমি বিশাল ধাঁধায় পড়েছি। কারণ অপুর জ্যাঠামনির অসুখটা, যার নাম কিউটোনিয়াস পরফাইরিয়া খুব বিরল হলেও মেডিক্যাল সায়েন্সে তার উল্লেখ আছে। তোমার দাদাকে চিকিৎসা করতে গিয়ে কিছু কিছু কেস-এর কথাও আমি পড়েছি। এটা একটা জেনেটিক ডীসীস বা বংশগত রোগ।’

‘তার মানে?’ মা’র আতঙ্কিত প্রশ্ন।

‘তার মানে এটা মা-বাবার থেকে তাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সংক্রমিত হয়।’

‘আর কোনো রোগী যদি কাউকে কামড়ে দেয়, তাহলে কী এই রোগ হতে পারে?’

মা’র এই প্রশ্নে ডাক্তারদাদু এই বিপদের মধ্যেও প্রায় হেসে ফেলে বললেন, ‘না, না, এটা কোনো ইনফেকসাস ডিসীস নয়। তাই কামড়ালে রোগ সংক্রমিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে জেনেটিক ডীসীস হলেও প্রত্যেক জেনারেশনে এটা হবে মনে করার কোনো কারণ নেই। এমন কী একই জেনারেশনের সব ছেলে-মেয়েদের মধ্যে হবে এমন মনে করারও কোনো কারণ নেই।’

‘তাই দাদার হয়েছিল, কিন্তু আমি এ রোগ থেকে মুক্ত;’ বাবা বলে উঠলেন, ‘কিন্তু কী ভয়ঙ্কর রোগ। আমি তো দাদাকে দেখেছি।’

বাবার প্রায় মুখের থেকে কথা কেড়ে নিয়ে ডাক্তারদাদু বলে চললেন, ‘ছোটবেলায় খুব বোঝা যায় না, কিন্তু বয়স যত বাড়ে ততই মুখ-চোখ বিকৃত হতে থাকে। রোগী একেবারে আলো সহ্য করতে পারে না। ঠিক যেন সেই গল্পের ভ্যাম্পায়ারের মত। আর কোনো কোনো সময়ে রোগীর মূত্রের সাথে এক ধরনের পদার্থ বেরোয় যা আলো পড়লে ঝিকমিক করে। দু:খের কথা এ রোগের কোন চিকিৎসা নেই।’

এসব বলে ডাক্তারদাদু চুপ করলেন। তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। কিছুক্ষণ পর তিনি মাথা চুলকে বললেন, ‘এ সবই জানা, কিন্তু ভ্যাম্পায়ার বলে তো আসলে কোন জীব নেই, সবই মানুষের কল্পনা। তাহলে অপুর কাঁধের এই গভীর ক্ষতটা হল কী করে!’
মা ডাক্তারদাদুকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘ভ্যাম্পায়ার আছে কী নেই তা জানি না, সে গবেষণায় আমি যাব না। কিন্তু এইটুকুই বুঝি যে এই বাড়িতে দাদার অস্তিত্ব রাখলে গভীর অমঙ্গল হবে। দাদার ঐ ঘর আমি রাখতে দেব না।’


চিলের ছাদের ঘর ভেঙে ফেলা হয়েছে। ইঁট-কাঠের স্তূপের মধ্যে ভ্যাম্পায়ারের কোন চিহ্নই পাওয়া যায়নি। খালি অপুর জ্যাঠামনির জামা-কাপড়, বই-পত্র ইত্যাদির সাথে পাওয়া গেছে একটা ডায়েরি। উনি যে ডায়েরি লিখতেন তা কেউ জানতো না। সেই ডায়েরির পাতায় পাতায় তিনি নিজের ক্রমবর্ধমান শারীরিক বিকৃতি ও তাই নিয়ে তাঁর মানসিক যন্ত্রণার কথা লিখে গেছেন। এ কথাও লিখে গেছেন যে তিনি নিজের শরীরটা দান করে দিতে চান চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষকদের জন্য, যাতে তারা এই অসুখের কোনো সুরাহার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু তার আর এখন উপায় কী।

ছাদে এখন নানান ফুলের বাগান করা হয়েছে। এই বাগানটা এখন সবায়ের খুব প্রিয়। যখন দোপাটি, গোলাপ, গাঁদা ফুলে বাগানটা ভরে যায়, যখন মালতীলতায় ফুল আসে, আর যখন জুঁই আর বেল ফুলের গন্ধে সমস্ত ছাদটা সুগন্ধে আমোদিত হয়ে থাকে তখন ঠামার মুখে শোনা জ্যাঠামনির কথা মনে পড়ে যায়। সেই ভ্যাম্পায়ারের ঘটনাটাও তার কাছে যেন সত্যি বলে মনে হয় না। সবই মনে হয় তার মনের ভুল। কিন্তু তা কী করে হবে? কাঁধের ক্ষতটা তো মিথ্যে নয়। অনেক ভেবেও অপু এর কোন কূল-কিনারা পায়নি। বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও বেশি দূর এগোয়নি। ওরা পুরো ব্যাপারটাই এড়িয়ে যেতে চান। যেন অপুর জ্যাঠামনি বলে কেউ কোনদিন ছিলই না।

সেদিন অপু সন্ধের দিকে ছাদে এসেছে। রোদ আর নেই, বরং শীত পড়ব পড়ব করছে, তাই ছায়া বড় হতে আরম্ভ করেছে। নানান ফুলে-ফুলে বাগানটা যেন হাসছে। আর ছোট-বড় নানান প্রজাপতি আর ফড়িং ফুলের মধু খেতে এ ফুল থেকে ও ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ অপুর নজর পড়ল একটা মস্ত প্রজাপতির দিকে। এত বড় প্রজাপতি সে আগে কোনদিন দেখেনি। আর তার ডানায় রঙের বাহারই বা কতো! দুটো ডানায় চোখ আঁকা। প্রায় মানুষের চোখের মত। অপু একটু কাছ থেকে ভালে করে দেখার চেষ্টা করতেই প্রজাপতিটা যেন তার দিকে চেয়ে আছে। সেই শীতের সন্ধেতেও অপু ঘামতে লাগল কুলকুল করে। আর কোনো দিকে না তাকিয়ে সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছাদ থেকে নেমে এলো।

নিচে নেমেই অপুর মনে পড়ে গেল বছর দুয়েক আগে এই সময়ই একদিন জ্যাঠামনি মারা যান। তখন অপুকে কিছু জানানো হয়নি। কিন্তু এখন সে সবই জানে। এও জানে যে দিন দুয়েক আগে বাবা জ্যাঠামনির বাৎসরিক পিণ্ড দিতে গয়ায় গেছেন। বাড়ির পুরোহিত নাকি বলেছেন যে তিন বছর এ রকম গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধ-শান্তি করলে জ্যাঠামনির আত্মা আর ফিরে আসবে না। এখন ভয়টা কাটিয়ে বেশ একটু হাসিই পেল অপুর। যতই তোমরা পিণ্ড দাও আর শ্রাদ্ধ-শান্তি করো জ্যাঠামনি কিন্তু এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যায়নি। বলা তো যায় না পরের বার ভ্যাম্পায়ারের বদলে অন্য কী সেজে এসে কী করে!




(পরবাস-৬৩, ৩০ জুন, ২০১৬)