উফ!
বাঁচা গেল!
কি শান্তি।
নিশ্চিন্তে থাকবো এবার।
ঠাকুর তোমায় কোটি কোটি প্রণাম।
বিশ বছর বাদে। পাক্কা বিশ বছর বাদে। আবার বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবো। মুখ তুলে তাকাতে পারবো। শান্তিতে ঘুমোতে পারবো। সবই তোমার দয়ায়।
এখন আর আমার কোনো ভয় নেই। যে কোনো মুহূর্তে জীবনটা তছনছ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। যখন তখন চরম অপমানে মাটিতে মিশে যেতে হতে পারে সেই কথা ভেবে কাঁপতে থাকার ব্যাপারটা আর নেই।
আমি এখন হইহই করে বাঁচবো। বুক চিতিয়ে ড্যাং ড্যাং করে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াবো। যেকোনো সময়ে যেকোনো লোকের দিকে সোজা তাকিয়ে জোর গলায় কথা বলতে পারবো।
আজ আমার দিকে আঙুল তোলার কেউ নেই। সন্দেহের বিষনজরে আমার দিকে তাকানোর কেউ নেই। “তুমিই তো একদিন”— বলে সেই পুরোনো কথা তুলে আমায় শেষ করে দিতে পারে এমন কেউ নেই।
তাই না মেজকাকা?
অথচ কদিন আগেই যখন কানে এল —“আর কতদিন আছি কে জানে — তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল বৌমা — বলে যাবো ঠিক করেছি —” তখন শুনে থরথর করে কেঁপে উঠেছিলাম — সর্বনাশ! মরার আগে সেই ঘটনাটা বলে যাবে না তো আমার বউকে? কি সাংঘাতিক লোক রে বাবা! মরতে বসেও জ্বালিয়ে যাচ্ছে! সারা রাত ছটফট করেছিলাম — বারবার উঁকি মেরে দেখেছিলাম আমার বৌয়ের ঘুমন্ত সুখীসুখী মুখটা। আর মনে হয়েছিল — কী হবে এই মুখটার? যখন শুনবে সেইসব কথা! জোর করে ঘুমোনোর চেষ্টা করছিলাম — আর ঠাকুরের কাছে বারবার বলছিলাম — “এই ঘুমের মধ্যেই যেন আমার মৃত্যু হয় ওইসব শোনার আগেই।” পরদিন সকালে অবশ্য এইসব কিছুই ঘটেনি। ঈশ্বর রক্ষা করেছিলেন। ওই সেরিব্রাল অ্যাটাকটা ঘটিয়ে।
ঠিক কিনা বলো?
মনে আছে তোমার? আমার বিয়ের পরদিন — এই একই রকম ঘটনা ঘটেছিল। “তুমি খুব ভালো মেয়ে বৌমা — তোমায় প্রাণভরে আশীর্বাদ করে গেলাম — আবার আসব — তোমার সাথে গল্প করে যাব—” এই কথাগুলো শুনেই হাড়ে কাঁপুনি ধরে গিয়েছিলো আমার। বিয়ের পরদিন মানুষ কত সুখে থাকে — আনন্দ করে — আর আমার সমস্ত সুখ শুষে নিয়েছিল ওই কথাগুলো।
কখনো জানতে পেরেছিলে সেসব?
মেজকাকা আমি ভুলিনি কিচ্ছু — যেদিন চাকরি পেলাম — বম্বে চলে যাব রাতে — বড়দা আর বাবা ছাড়তে যাবে আমায় এয়ারপোর্টে — সবার কি আনন্দ — ঠিক তখনই দুপুরবেলায় এসে হাজির হয়ে — “দিন সাতেকের জন্য এলাম — কলকাতায় কিছু কাজ আছে — তোমাদের সঙ্গেও কিছু আলোচনা আছে — সেগুলো সেরে যাব” কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে আমার শিরদাঁড়ায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। মনে হল কত স্বপ্ন কত আশা নিয়ে ওরা আমায় ছাড়তে যাচ্ছিল — সব চুরমার হয়ে যাবে আমি যাওয়ার সাথে সাথেই — যখন আমার সেই ঘটনাটা জানবে ওরা —
তাই না?
যেদিন হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট বেরোলো — পড়াশুনো তো খারাপ করতাম না, কিন্তু এত ভালো রেজাল্ট হবে নিজেও ভাবিনি — বাড়িতে হই হই পড়ে গেল — দাদা আমায় আর বোনকে নিয়ে সন্ধেয় বাইরে খেতে নিয়ে যাবে ঠিক করল — আর সেই সন্ধেতেই — “বড়দা তোমার আজ একটু সময় হবে?” — বলে যেন সেই ঝড়ের আগের একটি পাতার মতো যেই দেখা দিল — সঙ্গে সঙ্গে আমি আঁতকে উঠলাম — মনে হল — তাহলে? তাহলে কি আজই বলে দেবে সব কথা? সবাই যখন রেস্টুরেন্টে হই হই করছিল — আমি তখন জড়ভরতের মতো বসে ছিলাম। দাদা বলল — “কিরে শরীর খারাপ লাগছে নাকি? জ্বর আসছে বুঝি?” আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম — “না না — খুব ঘুম পাচ্ছে —” বাড়ি ফিরে সত্যি জ্বর এসে গিয়েছিল।
কি মনে হয় এর থেকে?
এইভাবে একটা দুটো দিন নয় — মাস নয় — বছরের পর বছর — ঠিক যেন একটা হিলহিলে সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছিলো আমার আশেপাশে — যেকোনো সময় আমায় ছোবল মারার জন্য তৈরি — অথচ আমি ছাড়া কেউ তাকে দেখতেই পেল না। আর এই আতঙ্ক আর অস্থিরতা আমাকেও একটা জন্তু বানিয়ে দিল ধীরে ধীরে—
আজব ব্যাপার ভাবছো?
তাই আমিও — আমিও প্রতিমুহূর্তে আমার সমস্ত ঘেন্না-রাগ-অভিশাপ উজাড় করে দিয়েছিলাম — অনবরত মৃত্যু কামনা করেছিলাম ঠাকুরের কাছে। বলেছিলাম — “এত লোকের জীবন চলে যায় অথচ এ কীভাবে বারবার ফিরে আসে সর্বনাশের মুখ থেকে — যমের দোর থেকে কোন গুণে? কোন পুণ্যে? কেন তোমার এত কৃপা ওর প্রতি? আমার যে কোনো মূল্যে ওকে শেষ করে দাও ঠাকুর।”
চিন্তাই করা যায় না এসব আমার কাছ থেকে — কি বলো?
তাই এতকাল বাদে যখন সেই মুহূর্তটা এল — দেখলাম কী চমৎকার ভাবে মৃত্যু আসে — শরীরের সব ধড়ফড়ানি চুপ করিয়ে দেয় — চোখের ভয়ঙ্কর দৃষ্টিকে ঘোলাটে করিয়ে দেয় — কী নিখুঁত ভাবে। কাছে গিয়ে দেখলাম — আঙুল দিয়ে খোঁচা মেরে দেখলাম — পাথর — পুরো পাথরের মতো হয়ে গেছে — ওই ভয়ঙ্কর চোখদুটো! তাহলে এটাই — এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন! এই নিঃসাড় শরীরটাকে হাতে ছোঁয়া — এই হাঁ করে থাকা মুখটাকে দেখতে পাওয়া — এই স্থির হয়ে যাওয়া চোখের মনিটায় আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে দেওয়া — আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত!
বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি?
মেজকাকা — বাঁচার জন্যে আমাদের শ্বাস নিতে হয় বুক ভরে। তাই গলাটা যখন কেউ চেপে ধরে — বুকের উপর যখন কেউ পাথর বসিয়ে দেয় — তখন কেমন লাগে শ্বাস নিতে? এটা আমি আজ দূর থেকে দেখলাম। কতক্ষণ ছিল সেই শ্বাসকষ্ট? পনেরো মিনিট? বড়োজোর কুড়ি মিনিট? তারপরেই তো সব শান্তি। কিন্তু আমি তো পাক্কা বিশ বছর এইভাবে ছটফট করেছি। আজ কিন্তু দেখছিলাম। চুপটি করে দূর থেকে দেখছিলাম। খুব নিষ্ঠুর ব্যাপারটা। অনেকটা মানুষ খুনের মত।
কি ভয়ঙ্কর তাই না?
সবসময় কি গলা টিপে কিংবা ছুরি মেরে বা বিষ দিয়ে কাউকে মারতে হয়? অন্তর থেকে ঘেন্না দিয়েও একটা মানুষকে মেরে ফেলা যায়। সেই মানুষটা তখন মরার ঢের আগেই কারো চোখে লাশ হয়ে যায়। যেটা আমি করেছিলাম সেই রাতটার পর থেকে। সেই রাতটা — যার কথা মনে করতে চাইতাম না কিছুতেই — কিন্তু এখন কি আশ্চর্য — এই পাথর হয়ে যাওয়া শরীরটার সামনে সেই ছবিগুলো কি নিশ্চিন্তে ভেসে আসছে—
ভাবা যায়?
সেই সরস্বতী পুজোর রাত — হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল মাঝরাতে — দৌড়ে ছুটলাম ছাদের ঘরে জানালা বন্ধ করতে — যেখানে পুজো হয়েছিল সেদিন সকালেই। গিয়ে দেখি রত্না আমার আগেই এসে জানালা লাগানোর চেষ্টা করছে — কিন্তু ঝোড়ো হাওয়ায় বেসামাল হয়ে যাচ্ছে বারবার। আমি গিয়ে হাত লাগালাম — হঠাৎ ও টাল খেয়ে পড়ে গেল আমার উপর — আমি দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে সামলাবার চেষ্টা করলাম।
তারপর কী ঘটলো — কী ভাবে ঘটলো — কিছুই বুঝতে পারলাম না — খানিকবাদে টের পেলাম আমরা যেন দুজনে দুজনের শরীরের ভিতর ডুবে আছি। আমার পিসতুতো বোন রত্নার শরীরে কতক্ষণ এভাবে কেটেছিল আমরা জানি না — হঠাৎ দেখলাম সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য — সেই দরজা ফাঁক করে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ানো — আর সেই অদ্ভুত চোখ করে হাড়-হিম-করা দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকানো! রত্না অবশ্য তখন কিছুই দেখতে পায়নি এসব। কারণ ওর মুখ ছিল আমার কাঁধের উপর। ফলে আমিই বিদ্ধ হলাম সেই বিষদৃষ্টিতে।
তাই কিনা বলো?
জানো মেজকাকা সে রাতটা আমার কিভাবে কেটেছিল? কতই বা বয়স আমার তখন? ইলেভেন-এ পড়ি। রত্না ক্লাস টেন-এ। উৎকণ্ঠায় হিম হয়ে গিয়েছিলাম ওই রত্নাটার জন্যে। লজ্জায় যদি কিছু করে বসে ওই মা-মরা সরল মেয়েটা! ঠিক করলাম পরদিন সকালে যদি ঘটনাটা সবার সামনে আসে, তখন বলব সমস্ত দোষ আমার — আমিই জোর করে... কিন্তু পরদিন সকালে বা বিকেলে এমনকি রাতেও কিছুই ঘটলো না। একইভাবে কেটে গেল আরো ক'টাদিন। আর এতেই আমার আতঙ্ক বাড়লো চরমে। একবার মনে হল — হয়তো বাবাকে জানানো হয়েছে চুপিচুপি — তাহলে নিশ্চয়ই বাবার থেকে মা — আর মার থেকে সারা বাড়িতে — নাকি এসব কিছু না করে কেবল রত্নার বাড়িতে জানিয়ে দিল রত্নার জেঠুকে! নাকি শুধু ছোটোকাকাকেই চুপিচুপি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে? যার দিকেই তাকাই মনে হচ্ছিল — ইনিও কি জেনে গেছেন ওই ব্যাপারটা? বাড়ির সবচেয়ে ভালো ছেলে হয়ে একটা ঘটনাতেই সমস্ত লোকজনের কাছে হঠাৎ এতোটা হীন হয়ে গেলাম?
সব তুমি লক্ষ্য করেছিলে আমার মনে হয়।
কয়েকদিন বাদেই সকালে আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সেই সাপের মতো ভয়ঙ্কর শীতল দৃষ্টিটা যেন ছুরির মতো আমার মুখে এসে পড়লো! মুখটা কোনক্রমে ঘুরিয়ে নিলাম। কিন্তু মনে হল কেউ ওটাকে পিঠের উপর ঠেকিয়ে রেখেছে!
তারপর এতকাল কেটে গেল তাও সবসময়ই টের পাই ওটা আমার পিঠে ঠেকানোই আছে। কোনো সুখ নয় — আনন্দ নয় — স্বস্তি নয় একমুহূর্তের জন্যেও। মাঝে মাঝে ভুলে থাকতে চেষ্টা করি — তখনই যেন ওটা আমায় ছুঁয়ে জানিয়ে দেয় — কাছেই আছি!
সবই তুমি জানতে — নিশ্চিত ভাবেই জানতে — আমি জানি।
আজ মুক্তি পেলাম। এই মাঝরাতে। এত বছরের যন্ত্রণার হাত থেকে। কিন্তু এই মুক্তি আমার একার নয়। যাকে ছোটোবেলায় অত ভালোবাসতাম — যার কোলে চড়ে প্রথম দিন স্কুলে গিয়েছিলাম — যে আমায় এনে দিয়েছিল আমার প্রথম ক্রিকেট ব্যাট — স্কেচপেন — সে আমার জীবনে হঠাৎ একটা মূর্তিমান শনি হয়ে গেল! যাকে প্রতিরাতে টুঁটি টিপে আমি খুন করতাম — আর প্রতিদিন সকালে সে বেঁচে উঠে আমার পাশ দিয়ে হিলহিল করে ঘুরে বেড়াতো!
এইভাবে সাপ হয়ে, শনি হয়ে বেঁচে থাকার থেকে তুমি মুক্তি পেলে আজ মেজকাকা!
কেন? কেন এসেছিলে সেইরাতে? সেইসময়ে? কেন তাকিয়েছিলে ওইভাবে? ওই দৃষ্টিটার কি খুব প্রয়োজন ছিল? কোনো দরকার ছিল সাক্ষাৎ শনি হয়ে বেঁচে থাকা কারো জীবনে? কিংবা হয়তো এসব আমারই ভুল। ওই দৃষ্টিতে হয়তো কোনো বিষই ছিল না কখনো। হয়তো নিতান্ত নিরীহের মতো নাকি অসহায়ের মতো তুমি বারবার এসেছো আমার আশেপাশে। আমিই আতঙ্কে সরে গেছি। আমিই আতঙ্কে মুড়ে ফেলেছি নিজেকে একা একা। আর তুমিই তো একমাত্র সাক্ষী ছিলে সেই ঘটনার, তাই তোমাকে শনি মনে করে তোমার সাক্ষাৎ অসহ্য ছিল আমার।
এখন তোমার এই বন্ধ চোখদুটো দেখে — সাদা ঠোঁটদুটো দেখে — হাঁ-করা মুখটা দেখে — মনে হচ্ছে — সেই শনি তোমায় ছেড়ে চলে গেছে। তাহলে তোমা্র পায়ে এখন নির্ভয়ে মাথা রাখি মেজকাকা।
কোত্থেকে একটা পাখি ডেকে উঠলো খুব মিষ্টি সুরে। জানালার ধারে এলাম। ভোর হচ্ছে। বাতাসে যেন শরীর জুড়োনো হাওয়া। আজকের দিনটা সত্যিই ভারি সুন্দর। এই সুন্দর দিনের শুরুটায় নিজের ঘরেই গিয়ে একটু বসি। মেজকাকার ঘরের বাইরে এলাম। বাইরের বারান্দায়। পরপর ঘরগুলোয় সবাই এখনো ঘুমোচ্ছে। কিন্তু বড়দার ঘরের দরজাটা ওভাবে লাগানো রয়েছে কেন? বড়দা মারা যাওয়ার পর তো এভাবে কেউ যায় না ও ঘরে। বড়দার সবকিছু ওখানে রাখা আছে যেমনটি ছিল ও মারা যাওয়ার সময়। কিন্তু এইভাবে তো লাগানো ছিল না পাল্লা দুটো। তাহলে?
হাত দিয়ে দরজাটায় চাপ দিতেই নিঃশব্দে খুলে গেল পাল্লাটা। দেখলাম ঘরের আধো অন্ধকারে রয়েছে আমার ভাইঝি বুবলু আর ওর মাসতুতো দাদা গৌরব, যে কদিন হল এসেছে এ বাড়িতে। চমকে উঠে বুবলু তাকালো আমার দিকে। ওর চোখে একটা বীভৎস আতঙ্কের দৃষ্টি!
বুবলু!
ও বুবলু!
তুই ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন আমার দিকে?
আমি তো তোকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি!
আমি তো এক্ষুনি চলে যাব নিজের ঘরে —
নতুন দিন শুরু করতে হবে তো বাকি জীবনটার জন্য?
নতুন ভাবে — তোর চোখে — আমৃত্যু আপদের মতো?
(পরবাস-৬৩, ৩০ জুন, ২০১৬)