তহ্জীব-এ-মৌসিকী; জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ; রেখাচিত্র ও প্রচ্ছদ: এস্. শঙ্কর; প্রথম প্রকাশ: 'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রথম প্রকাশিত (১৯৮৪), পরে গ্রন্থিত হয় ১৪০১-সালে (ইং ১৯৯৪; বাউলমন প্রকাশন; কলকাতা); ISBN: নেই
‘তহ্জীব-এ-মৌসিকী’ অর্থাৎ উর্দু থেকে বাংলায় লেখকের নিজের অনুবাদে ‘সঙ্গীত সংস্কৃতি’, ফেলে আসা শতকের ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের রসময় বর্ণচ্ছটা। এই বইয়ের আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই এর বেশ কিছুকাল পরে লেখা এবং প্রকাশিত সঙ্গীত বিশারদ কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের “কুদ্রত্ রঙ্গিবিরঙ্গী” (১৪০২/১৯৯৫ ইং) মনে আসতে বাধ্য। তবে জ্ঞানবাবুর অথেন্টিসিটি স্বাভাবিক ভাবেই অনস্বীকার্য! এই বই ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের পরম গুরু শ্রীযুক্ত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের (১৯০৯-১৯৯৭) আত্মজীবনীর সাঙ্গীতিক যাত্রার বর্ণনা। আর লেখক খুব সহজেই পাঠককে হাত ধরে আসরের ভেতরে নিয়ে বসিয়ে দেন যেখানে “হোরি কে ভেদ না পায়ো রামা কুদ্রত্ তোরি রঙ্গি-বিরঙ্গী"! এই বইয়ের পাতায় পাঠকদের ট্রিটমেন্ট ঠিক শ্রোতার মতো। আসরের ভিতরের কুশীলবের দল এতই বেশি স্বনামধন্য মহাজনস্থানীয় যে (এই অধম লেখকের মতোই) সাধারণ অদীক্ষিত পাঠকের স্পর্ধা জন্মায় না চরিত্রের হাত ধরার, বরং তাঁরা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে স্মৃতিকথার মঞ্চে অভিনীত হতে দেখেন জ্ঞানবাবুর জীবনীর অভিজ্ঞতার পালা যার সূত্রধর স্বয়ং জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ।
সে এক ঘরানাদার ওম যার শাগীর্দ হওয়ার উষ্ণ অবকাশ আসে এই বইয়ের পাঠকের কাছে। যথেষ্ট কম বয়স থেকেই জ্ঞানপ্রকাশরা বাড়িশুদ্ধ সব ভাইই পাখোয়াজ, তবলা, ক্ল্যারিনেট, পিয়ানো, অর্গ্যান কিম্বা কর্নেট প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র বাজানোয় পারদর্শী ছিলেন। হারমোনিয়ামের তো কথাই নেই। কুমারপ্রসাদ তাঁর বইয়ে উস্তাদ আমীর খাঁর গায়নের সঙ্গে জ্ঞানবাবুর হারমোনিয়াম সঙ্গতের অলোকসামান্য অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। কেননা যে কোনো সারেঙ্গীবাদক কূল পাবে না (কুমারপ্রসাদের ভাষায় ধ্যাড়াবে) তাঁর গানের সঙ্গে সেইটি আমীর খাঁ সাহেব যথেচ্ছ জানতেন এবং প্রতিকার হিসেবে শুধুমাত্র জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষকেই তিনি খুশিমনে হারমোনিয়ামে সাথে নিতেন। কারণ একমাত্র জ্ঞানবাবুর ‘তেজ দিমাক্’কে আমীর খাঁর গানের ধোঁওয়াজাল কখনো দিশেহারা করে তুলতে পারেনি।
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ জন্মেছিলেন ৩৮ নং ক্রীক রো-র বাড়িতে, কলকাতায়। বাবা কিরণ চন্দ্র ঘোষ, মা নলিনী দেবী। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষকে তাঁর বাবা (একদমই অন্যান্য বাঙালি বাবাদের মতন নন) আজীবন স্বাধীনতা এবং স্বীকৃতি দিয়েছিলেন চাকরি না করে সঙ্গীত সাধনা করার। পরে বাবা না থাকাকালীন সময়ে জ্ঞানবাবু চাকরি করতে বাধ্য হন। তিনি আকাশবাণীতে প্রোডিউসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেই সময় ‘সুগম সঙ্গীত’ নামক একটি নব্যধারাও প্রবর্তন করেছিলেন। বাঙালি ঐতিহ্যের সঙ্গে জুড়ে থাকা ডোয়ার্কিনের হারমোনিয়াম যাঁর নামে সেই দ্বারকানাথ ঘোষ ছিলেন জ্ঞানবাবুর পিতামহ। দ্বারকানাথ থেকে ‘ডোয়ার্কিনস্’ এই নামের উৎপত্তির সঙ্গে দ্বারকানাথের বন্ধুবর সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির যোগ ওতপ্রোত। আবার ঠাকুরবাড়ির সঙ্গেও দ্বারকানাথ এবং তাঁর পরিবারের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল সঙ্গীত এবং বাদ্যযন্ত্রসূত্রে। ফলে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষরা ছেলেবেলা থেকেই উন্নত মার্জিত সংস্কৃত পরিমণ্ডলে বড় হয়ে ওঠার সু্যোগ পান। ডোয়ার্কিনের মতো বাঙালি প্রতিষ্ঠানের উচ্চমার্গীয় ঐতিহাসিক এবং সঙ্গীতময় লেগ্যাসির হাত ধরে শুরু হয় ‘তহ্জীব-এ-মৌসিকী’-এর পথ চলা। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের জন্ম, বড় হওয়া, ক্রমশই বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে আশ্চর্যভাবে পারদর্শী হয়ে ওঠা, ডিক্সন লেনের প্রিয়তম বাড়ি, ওস্তাদ আজীম খাঁ এবং মসীত খাঁ, প্রেসিডেন্সীর ছাত্র হিসেবে গ্র্যাজুয়েশনে পালি ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ এবং মাস্টার্সের সময় ফুটবলার হিসেবে দারুণ খ্যাতিলাভ করা ছাত্র জ্ঞানবাবুর ফুটবল ম্যাচ খেলতে গিয়ে বিপক্ষ খেলোয়াড়ের আক্রমণে চিরতরে চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া, সম্পূর্ণভাবে তবলায় আত্মনিয়োগ করা, সর্বোপরি চিরজীবন নিজেকে সঙ্গীতের ‘ছাত্র’ মনে করা (তাঁর বাবা তাঁকে এভাবেই ভাবতে শিখিয়েছিলেন), ঝংকার গোষ্ঠী, বোম্বাইয়ে (বর্তমান মুম্বই) ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ, রেওয়াজ, উস্তাদ, ঘরানা-আসর-ছাত্রছাত্রী-বন্ধু থেকে সুর-সাধনার উন্মাদনা-ভারতবর্ষীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সমাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ আর স্নিগ্ধ ভালোবাসায় তাঁর বাবার কথা বারে বারে বলে যাওয়া, স্মরণ করা... তহজীব এর হলদে হয়ে আসা পাতায় এখনো হৃদযন্ত্রের আবেগ ধরা পড়ে।
এর সঙ্গে আছে স্মরণীয় বরণীয় সব অভিজ্ঞতা! বইটি প্রকাশের আগে দেশ পত্রিকায় যখন ধারাবাহিক ভাবে এই লেখা বেরোচ্ছিল সেসময় লেখাটি অনুলিখিত ছিল অর্থাৎ লেখক বলে গিয়েছিলেন, অন্য কেউ লিখে নিয়েছিলেন শুনে শুনে। বই হয়ে বেরোবার সময় স্বভাবতই সেই আদি লেখার কিছু পরিমার্জন সম্পাদন সাধিত হয়েছে। সমস্ত বইটি বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভাজিত; যেমনঃ ‘সাধনা’, ‘বড়ে গোলাম আলী খাঁ’, ‘তবলা প্রসঙ্গ’, ‘আমীর খাঁ’, ‘ওস্তাদ বিচিত্রা’, ‘আলি আকবর’ ‘রবিশঙ্কর’, ‘বাজ’, ‘ধ্রুপদ ধামার’, ‘ভীমসেন যোশী সুনন্দা পট্টনায়ক ও মুনাব্বর খাঁ’, ‘জ্ঞান গোস্বামী ভীষ্মদেব’, ‘পালুসকর’, ‘ফৈয়াজ খাঁ’, ‘এ.টি. কানন’, ‘রাধিকামোহন মৈত্র সুরেশ চক্রবর্তী’, ‘ঘরানা শিল্পীরা’, ‘হারমোনিয়াম প্রসঙ্গ’, ‘উত্তরাধিকার’ ইত্যাদি। যে সময়ের বর্ণনা আছে এই লেখায় তা জ্ঞানবাবুর লেখার মতই আন্তরিক এবং ইমোশনে ভরপুর, বর্তমানের মতো কেজো কাঠখোট্টা সঙ্গীত ব্যবসায়ের ছায়াপাতমাত্র তখন ছিল না আশেপাশে। টাকার নয়, ছিল গুণের কদর, গুণীর আদর। আবার কিঞ্চিৎ বক্ররসসিক্ত সামান্য পরনিন্দাচর্চাও এই বইয়ের স্বাদ বাড়িয়েছে। গুণীজনের গুণের কথায় কোথাও কোথাও উঠে এসেছে শিল্পীর দম্ভ, অন্যায় অহংকারের ছবি; এবং অবশ্য বক্তব্য এই সব প্রসঙ্গ এসেছে পাঠকের শিক্ষার জন্যই, সততার মূল্য অনুধাবনের পথ হিসেবে। শিল্পের পথিক গায়ক এবং বাদকেরা কিভাবে পরস্পরকে সুকৌশলে অসম্মান করেন তার উদাহরণ হিসেবে এসেছে গায়ক ওঙ্কারনাথ ঠাকুর এবং তবলিয়া অনোখেলালের কথা। গায়ক নাকি তবলিয়াকে বিশেষ কিছু শো-এর আগে পকেটে টাকা ঢুকিয়ে দিয়ে বলতেন তবলায় তাঁর অপারগতা প্রকাশ করতে, তারপর গায়ক নিজে তাকে পারঙ্গমতার স্তরে নিয়ে গিয়ে শ্রোতার কাছে চূড়ান্ত সম্মানের আসনটি দখল করে নিতেন! এমনকি শ্রদ্ধেয়তম বাবা আলাউদ্দীন খাঁ-ও এই প্রচলের বাইরে ছিলেন না। জ্ঞানবাবুর সঙ্গেই এক আসরে তিনি নিজে বেতালা হয়ে জ্ঞানবাবুকে বেতালা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন সাংঘাতিক ভাবে। জ্ঞানবাবু প্রবল প্রতিরোধ করে আসর ছেড়ে উঠে আসার সময়ে নিস্তব্ধ সভার পিনড্রপ সাইলেন্স ভেদ করে বাবা মাউথপিসের সামনেই বলে ওঠেন “আপনার সঙ্গে আমি কি বাজাইব। তবলায় আপনার ডাঁয়া বাঁয়া কোনোটাই তো ঠিক হয় না অথচ আপনি তো কলকাতার ওস্তাদ হইয়া বইসা আছেন।” অতঃপর জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ উকিলের চিঠি ধরিয়েছিলেন বাবা আলাউদ্দীন খাঁ সাহেবকে যার মীমাংসা হয় কলকাতার তৎকালীন অ্যাম্বাসাডর হোটেলে রবিশঙ্কর এবং আলি আকবরের মধ্যস্থতায়। আর এ বিষয়ে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ অত্যন্ত সৎসাহসী এবং অকপট। এভাবেই এসেছে বিলায়ৎ খাঁর ভাগ্নে বর্তমানে বিপুল জনপ্রিয় রইশ খাঁর অনুষ্ঠানের আগেই ব্যাকস্টেজে মাতুল বিলায়ৎ কর্তৃক চরম অপমানিত এবং লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাটি। তবে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের স্পোর্টিং স্পিরিট এবং মানবিক মূল্যবোধ দুইই পাঠককেও মূল্যবোধী হবার আহ্বান জানায়।
বইয়ের পাতায় পাতায় আছে সঙ্গীত সমাজের (এমনকি পারিবারিক) অন্তরঙ্গ পরিচয়, শ্রুতির কথা, স্মৃতির কথা। গায়ক-গায়িকার দীক্ষা শিক্ষা নিষ্ঠা এবং ঘরের কথা। কিছুক্ষেত্রে জ্ঞানবাবুর নিজের ছাত্রদের কথাও উঠে এসেছে। তবে এই সবসময়েই নিজেকে একেবারে নির্লিপ্ত করে লুকিয়ে রেখেছেন বিরল পরিপূর্ণতা সম্পন্ন শিল্পী এবং শিক্ষক শ্রীযুক্ত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। সঙ্গীতের সব ধারাতেই তিনি সমান ভাবে সার্থক। তালবাদ্য, কণ্ঠসঙ্গীত, যন্ত্রসঙ্গীত সবেতেই তাঁর অসামান্য প্রতিভার বিকাশ। সঙ্গীতের বিভিন্ন ঘরানায় তাঁর গতায়াত অনায়াস। ফলে ভারতবর্ষের তাঁর সমসাময়িক এবং পূর্বাপর সব রকম শিল্পীরাই তাঁর উপলব্ধির অনুবীক্ষণের অন্তর্গত হয়েছেন বলাই বাহুল্য। যে কারণে তিনি মনে করেন “সঙ্গীত-সৌন্দর্য এমন একটা জিনিস, যেটা শিক্ষা-দীক্ষা, সাধনা ছাড়া বিশেষ স্বকীয়তার পরিচয় দানের বস্তু, ... শুধু গান কেন, পৃথিবীর সব সৌন্দর্যের মধ্যে পরিমিতিবোধ সবচেয়ে মূল্যবান।” গুরু মসীত খাঁ, গিরিজাশঙ্কর, করামৎ খাঁ, কিষেণ মহারাজ, আল্লারাখা, কানাই দত্ত, আহমদজান থেরকুয়া, আবিদ হুসেন সাহেব, হীরু গাঙ্গুলি, শামতাপ্রসাদ, হাফিজ আলী খাঁ সাহেব, এনায়েৎ খাঁ সাহেব, ইমরাৎ খাঁ, আব্দুল করিম খাঁ সাহেব থেকে জাকির হুসেন হয়ে অধুনার অজয় চক্রবর্তী বা রাশিদ খাঁ প্রমুখ শিল্পীর সাধনার দিকচক্রবালে মিশেছে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সঙ্গীত চেতনা। আর এই চর্যার প্রকাশ তাঁর এই লেখা। বিদগ্ধ সঙ্গীত মহলের নির্যাস তিনি পরিবেশন করেছেন পাঠকের করকমলে। এ লেখায় কুমারপ্রসাদের লেখার মত মজলিশ-ইয়ারি লচক নেই, কিন্তু এ লেখা গভীর দরদী গমক-তান-মীরখণ্ডের মাধুর্যে সু-রসায়িত, ধ্রুপদ ধামারের বিশিষ্ট গাম্ভীর্যে চিরউন্নতশির।
(দ্রঃ জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের উপর পূর্ণিমা সিংহের স্মৃতিচারণা ও সাক্ষাৎকার (পরবাস-৫৪, ৫৫))
(পরবাস-৬৪, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)