কমরেড শাফায়াত ক্রস ফায়ারে যেদিন মারা গেলেন সেদিনই আমার মনে হয়েছিল বিপ্লব আর হবে না। আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিতে বাইশ বছরের অভিজ্ঞ কারো মুখে এমন কথা মানায় না জানি। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল। তাই আমি সব ছেড়েছুড়ে চলে আসি। কাউকে কিছু বলি নি। বলার প্রয়োজনও বোধ করি নি। আমার কখনো ছিল না কেউ। তখনো ছিল না। সাথে ছিল রিভলবার। তাতে গুলি একটাই।
অভিজ্ঞ পাঠকের মাথায় হয়ত একটি সম্ভাবনার কথা উঠতে পারে একটা গুলির কথা শুনে। হ্যাঁ পাঠক, আপনার সেই সম্ভাবনাই ঠিক। সেই গুলিতেই আমি আমার তখনকার দুঃসহ জীবনকে শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগে আমার মনে হয়েছিল নির্জনতা দরকার। কিছু কোমল নিস্তব্ধতা। প্রতিটি মানুষ নিস্তব্ধতার মধ্যে মরে যেতে চায়। আপনারা নিশ্চয়ই সক্রেটিসের বয়ানে তা পড়েছেন। এর কারণ কী হতে পারে? হয়ত সেই নিস্তব্ধতার ভেতর দিয়ে নিজের দেহ-বিচ্ছিন্ন আত্মার চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে আগ্রহী মানুষের অবচেতন মন। মরে যাবার পরে কি চেতন-অবচেতন মনের অস্তিত্ব থাকে?
আমি মরতে কেন চেয়েছিলাম? একজন বিপ্লবী কি কাপুরুষের মত নিজেকে হত্যা করে? করে না। কিন্তু আসলে সত্যি বলতে কী আমি তখন বিপ্লবী ছিলাম না।সরকারের রাষ্ট্রীয় নৃশংস সন্ত্রাস, পার্টির ভেতরে বাহিরে, অতিবিপ্লবী, প্রতিবিপ্লবী...থাক সেসব কথা। এসব আমি ছেড়ে এসেছি। বলতে চাই না।
আমি নির্জনতা খুঁজতে একটি গ্রামে চলে যাই। গ্রামের এক কোণে একটি ভগ্ন বাড়িতে গিয়ে স্থান নিই। যেরকম নিস্তব্ধতা আশা করেছিলাম ঠিক সেরকমই জায়গাটি। দিনের বেলাতেও ভূতের ভয়ে ভগ্ন বাড়ির আশপাশে কেউ আসে না। গ্রামের বাজারের দূরত্বও সেখান থেকে কয়েক মাইল। পায়ে হাঁটা পথ।
প্রথমদিন গিয়ে ক্লান্ত ছিলাম। ভগ্ন বাড়ির মেঝেতে শুয়েই রাত কাটাই। পরদিন সকালে মরে যাবার একটা সুযোগ ছিল। কিন্তু কেন যেন মরতে ইচ্ছে হল না। সকালে হেঁটে হেঁটে বাজারে চলে গেলাম। জীবিত লোকের খাদ্যের দরকার। পকেট হাতড়ে কিছু টাকাও পাওয়া গেল। তাতে খাওয়া সম্পন্ন করে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে গ্রামের বাজারে হাঁটাহাঁটির পর ফিরে এসেছিলাম সেই ভগ্ন বাড়িতে।
তখন আবার আমাকে ঘিরে ধরেছে বিষন্নতা। ঠিক করলাম আজ রাতেই মরে যেতে হবে। সন্ধ্যার দিকে রিভলবার মাথায় ঠেকিয়ে গুলিও করে ফেলেছিলাম। কিন্তু একটা ধাতব শব্দ হল শুধু। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে রয়েছিলাম কিছুক্ষণ। যখন বুঝতে পারলাম মরি নি তখন অবাক হলাম খুব। কিন্তু আসলে অবাক হবার মতো কিছু ছিল না। গুলিটা দেখলাম টেবিলের উপরে। কখন খুলে রেখেছি কে জানে!
মন্দভাগ্য! মরতে গিয়েও প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ। অতি কষ্টেও হেসে ফেলললাম আমি। আর ঠিক তখনি বুঝতে পারলাম আমার ঠিক পেছনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। আমি ক্ষীপ্রতার সাথে ঘুরে দাঁড়ালাম। দেখতে পেলাম আবছা আলোর মত এক বিশাল ছয়ফুট লম্বা খরগোশ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে!
প্রথমে কিছুক্ষণ বিস্ময়ে দম বন্ধ হয়ে এল। তারপর একটু খেয়াল করে দেখতে লাগলাম। সামনে যে বস্তু দাঁড়িয়ে আছে তা রক্ত মাংসের বলে মনে হচ্ছে না। বিপ্লবী রাজনীতির কারণেই হোক বা অন্য কোন কারণে আমার অনেক সাহস ছিল। সামনে হাত বাড়িয়ে তাই বস্তুটাকে ধরতে চেষ্টা করলাম। দেখলাম যা ভেবেছি তাই। এটি একটি ছায়া!
আমার তখন মনে হল আমি বোধহয় পাগল হয়ে গেছি। তা নাহলে এসব দেখার কথা না। এমন হ্যালুসিনেশন আমার হয় নি কখনো। ঘুরে বসে পড়লাম চেয়ারে আবার। একে পাত্তা দেয়ার কিছু নেই। পাত্তা দিলে হ্যালুসিনেশন বেড়ে যায়।
উন্মাদ হওয়ার আগে আগেই মরে যাওয়া ভাল চিন্তা করে রিভলবারে গুলিটা ভরলাম। কিন্তু এবার সেটা মাথায় ঠেকানোর সময় পেলাম না। দেখলাম আমার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে খরগোশটা। তার কানদুটি নড়ছে।
আমি যন্ত্রের মত বলে ফেললাম, কে তুমি? কী চাও?
ছয়ফুট লম্বা খরগোশ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কমরেড শামসোজ্জোহা, আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী কথা?
খরগোশ কান নাচিয়ে বলল, এখানে হবে না। তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।
জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যেতে হবে?
খরগোশ বলল, এই তো সামনে।
আমার খুব কৌতূহল হল। আমার খরগোশের কথাটা শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিল। তার চেয়ে বেশি আমি বুঝতে চাচ্ছিলাম কী ঘটছে। এটা কি আমার হ্যালুসিনেশন নাকি অন্যকিছু। আমি রিভলবার কোমরে গুঁজে ছয়ফুট লম্বা খরগোশের সাথে বেরিয়ে পড়লাম। সে আমার সাথে সাথে হাঁটতে লাগল। তাকে আবছা ধূসর ছায়ার মতো লাগছে।
হাঁটতে হাঁটতে সে জানতে চাইল আমার কথা। তার বাচনভঙ্গি এবং কথাবার্তা ছিল অসাধারণ। আমি এতে আকৃষ্ট হই। আমার মনে হতে থাকে এমন কারো সাথে আমি কখনো কথা বলি নি এর আগে। আমি তাকে বলতে লাগলাম আমার কথা, আমার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য এবং বিপ্লবের কথা। আমি তাকে বললাম আমার স্বপ্ন আশা এবং নিদারুণ হতাশার গল্প। আমি তাকে বলে গেলাম অবিশ্বাস, স্বার্থপরতা, ক্রূরতা ও নৃশংসতায় মোড়া এক ঘৃণ্য পৃথিবীর উপ্যাখ্যান, যার ভিতর দিয়ে দগ্ধ হতে হতে আমি বের হয়ে এসেছি আকস্মিক দৈব দুর্বিপাকে নিভে চাওয়া উনুন থেকে বেরিয়ে আসা আধপোড়াএক টুকরা কাঠের মতো।
খরগোশ আমার সব কথা শুনল। মনোযোগ দিয়েই শুনল। আমি টেরও পেলাম না কখন আমরা এক বিরাট দীঘির পাশে চলে এসেছি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
আমি খরগোশকে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু তুমি কে আসলে? কী চাও তুমি?
খরগোশ স্মিতহাস্যে বলল, আমি একটি খরগোশ, দেখতেই পাচ্ছো। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে কমরেড। ঐ যে দেখছ একটা বৃদ্ধ লোক ছিপ ফেলে মাছ ধরছেন, একটু পর একটি বড় মাছ তার ফাঁদে আটকা পড়বে। কিন্তু ওকে টেনে তুলতে পারবেন না তিনি।তাঁর সে শক্তি নেই। তুমি উনাকে সাহায্য করবে।
খরগোশ তার কথা শেষ করার সাথে সাথেই আমি বৃদ্ধ লোকটিকে দেখতে পাই। সত্যি সত্যি তার ছিপে মাছ লেগেছে মনে হলো। লোকটি টেনে তুলতে পারছে না। আমি তাকে সাহায্য করতে গেলাম। প্রায় দশকেজি ওজনের বিরাট রুইমাছ টেনে তুললাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। লোকটি আমার সাহায্যে অনেক খুশি হল এবং আমাকে এক রকম টেনেই তার বাড়িতে নিয়ে গেল। এই মাছ না খাইয়ে ছাড়বে না।
আমি ভেবেছিলাম খরগোশকে হারিয়ে ফেলব। কিন্তু দেখলাম সেও আসছে আমার পিছু পিছু। সেদিন রাতে অনেক অনেক দিন পর আমি কিছু সহজ মানুষের সাথে খেলাম। তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে কথাবার্তার এক পর্যায়ে বাড়ির কর্তা অর্থাৎ সেই বুড়ো লোক জানতে পারলেন এই গ্রামে আমি পর্যটকের মত এসেছি। থাকার জায়গা নেই। তিনি তাঁর বাড়ির সামনে, বাহির ঘরের একটা কক্ষে আমার থাকার জায়গা করে দিলেন।
খরগোশ আমার সাথে সাথেই ছিল। মজার ব্যাপার অন্যেরা তাকে দেখেনি। কিন্তু ঘুমানোর আগে তাকে আমিও আর দেখতে পেলাম না। পরদিন ঘুম থেকে উঠেও তাকে দেখলাম না আর। আমার মন কিছুটা প্রফুল্ল হয়ে উঠেছিল। খরগোশের দেখা পাবার কারণে না এই বাড়ির হৃদয়বান মানুষদের সাহচর্যে বুঝলাম না ঠিক।
ঠিক করলাম, মরব না আর। ফিরে যাব শহরে। এক ধরনের বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে। অন্য ধরনের বিপ্লব করা যাবে। আর শুধু বিপ্লবই তো সব না। ছিপ দিয়ে মাছ ধরাও অনেক কিছু।
শহরে ফিরতে গ্রামের বাজারের পথ ধরে যেতে হয়। আমি সেখানকার একটা চায়ের দোকানে বসেছিলাম বাসের অপেক্ষায়। তখন শুনলাম চায়ের দোকানে বসা কয়েকজনের কথাবার্তা। তাদের কথার সারমর্ম হল — গতকাল রাত আটটার দিকে ভগ্নপ্রায় সেই বাড়িতে পুলিশ এসেছিল ডাকাতের খোঁজে!
কিন্তু আমি আসলে বুঝতে পারলাম এর তাৎপর্য। পুলিশ আমার খোঁজেই এসেছিল, হয়ত তারা কোনভাবে জানতে পেরেছিল আমি এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছি। তখনআমার মনে এই প্রশ্নের উদয় হল, কে ছিল এই ছয়ফুট লম্বা খরগোশ? বাঁচিয়ে দিল আমাকে। আত্মহত্যা থেকে এবং পুলিশের হাত থেকে। আমি কি আসলে নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দ্বারা বুঝতে পেরেছিলাম আগমনী বিপদের বার্তা, না কি আসলে অতিপ্রাকৃতিক কিছু ঘটেছিল সেই সময়ে?
এর পরে অনেক সময় গিয়েছে। অনেক বছর। দেশে বিপ্লবীদের ধরপাকড় বন্ধ হয়েছে। আমি একটা শিশুদের স্কুলে শিক্ষকতা করে যাচ্ছি। মরি নি। হতাশও হই নি আর।
বৃহৎ খরগোশের একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছি। আইরিশ পুরাণ মতে একে বলে পুকা। এক ধরনের আত্মা যা প্রাণীদের, বিশেষ করে খরগোশ, ঘোড়া ইত্যাদির রূপ ধরে আসে।
এই তীব্র অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক এবং প্রায় হাস্যকর একটি বিষয়কে আজন্ম র্যা শনালিস্ট আমি নিজের ভেতরে নিয়ে আছি। বেঁচে আছি।
সেই খরগোশকে আমি আর কখনো দেখি নি। তবুও আমার মনে হয়, আমার ভেতরে সে এখনো বসবাস করে।
(পরবাস-৬৪, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)