এই বিল্ডিং এর সব ফ্ল্যাটগুলোতে দুটো করে বাথরুম। যাদব এখন বোসবউদির ফ্ল্যাটে কাজ করছে — ভেতরের বাথরুমটা সাফ করে বাইরেরটা ধরেছে। ওর একটু বিরক্তি লাগছিল। এ বাড়ির বৌদি অনেকদিন এটা সাফ করায় নি — নোংরা পেছল হয়ে আছে। সময় বেশি লাগছে এটা সাফ করতে। বৌদিটা কিপ্টে। ভেতরেরটা নিয়মিত করাবে — আর বলবে বাইরেরটা এখন থাক। অথচ এ বাড়িতে টাকা আসছে প্রচুর। দাদা, বৌদি — দুজনেরই ভাল নোকরি। একটা গাড়ি আগেই ছিল — এই মাস দুই হল আর একটা কিনেছে। অথচ যাদবের যাতে দুটো পয়সা আসে সেরকম কিছু করবে না।
অল্প একটু গুঁড়ো সাবান নিজের হাতে ঢেলে নিল যাদব। বাথরুমের মেঝেয় ফেলে ঘষতে লাগল ব্রাশ দিয়ে। ও যে-কোন কাজের ব্যাপারেই খুব খুঁতখুঁতে। কাজটা ভাল করে করতে না পারলে ওর শান্তি হয় না। আজ আবার ঘরে একটু কাজ আছে। সব্জী কিনে ঘরে রেখে এসেছে। ফিরে গিয়ে তা রান্না করবে, আর রোটি বানাবে। আজ লছমী আর গোপাল দেশ থেকে আসছে। সেজন্যে মনটা সকাল থেকেই আনচান করছে। প্রায় মাস ছয়েক হয়ে গেল বৌ ছেলের সঙ্গে দেখা হয় নি। টিরেনটা আবার চার ঘন্টা লেট আছে — গোপাল যাদবের মোবাইলে নিজের মোবাইল থেকে খবর পাঠিয়েছে। ওদের গাঁ থেকে যে-সব গাড়ি কলকাতায় আসে সেগুলোতে ভাল খাবার পাওয়া যায় না। ওরা কতক্ষণ না খেয়ে আসবে — গরম খাবারটা তৈরি থাকার দরকার।
যাদব দেশ ছেড়ে কলকাতায় এসেছে — সে আজ বিশ বছরের ওপর হয়ে গেল। ওকে কলকাতায় এনেছিল রামেশ্বর তিওয়ারি। ওর দেশের লোক। কলকাতায় ট্যাক্সি চালায় — যাদবের আস্তানার কাছাকাছিই থাকে। এমনিতে রামেশ্বরের খুব জাতের অহঙ্কার। ও উঁচু জাতের লোক — যাদবের সঙ্গে ওর জাতের প্রচুর ফারাক — যাদবের ছায়াও ওর মাড়াবার কথা নয়। কিন্তু সে-সব দেশ গাঁয়ে। এ কলকাতা শহর — দেশ থেকে অনেকদূর। এখানে রামেশ্বর ট্যাক্সি চালিয়ে খায় — রাস্তায় ঘাটে কত লোকের হাতের জল আর খানা খায়। এখানে জাতের কথা মনে রাখলে চলে না। তাছাড়া দেশে ওর বৌ বাচ্চা আছে; রামেশ্বর এখানে একটা মেয়েমানুষ রেখে নিয়েছে। মেয়েটা বংগালি, তবে নীচু জাতের — বর খেতে দিত না বলে তার কাছ থেকে ভেগে গিয়ে রামেশ্বরের ঘরে এসেছে। তবে রামেশ্বর দেশে বৌ বাচ্চাকে নিয়ম করে টাকা পাঠায়। ইচ্ছে আছে ছেলেটাকে লা পড়াবে — লা পাশ করে ছেলে কোন একটা পার্টিতে ঢুকে পড়বে — নেতা-উতা হয়ে যাবে। এমনকি চুনাবে লড়ে জিতেও যেতে পারে। তাহলে আর রামেশ্বরকে পায় কে!
যাদব তখন দেশে ভুখা পেটে বসে আছে। দুই ছেলেমেয়ে হয়ে গিয়েছে — ভরপেট খেতে না পেয়ে লছমীর দুই বুক শুকনো — বাচ্চা দুটো খাবে কি! রামেশ্বর যাদবকে বলেছিল, কলকাত্তা চল্। রাস্তা ঝাড়ু দেবার কাম করবি। বংগালিরা আজকাল রাস্তা সাফাই, ট্যাক্সি চালানো এসব কাম করে না।
যাদব একটু অবাক হয়েছিল। বংগালিরা তবে কি করে?
ওরা ঝান্ডা নিয়ে মিছিল করে। এক একবার মিছিলে গেলে পায় কুড়িটা করে টাকা — আর সেইসঙ্গে এক বান্ডিল বিড়ি। কলকাত্তায় হামি তুর নোকরি লাগিয়ে দিব — হামার চিনাজানা আছে। মগর হাঁ — পয়লা মাহিনার তনখাটা হামার ওই আদমি লিবে।
সেই থেকে যাদব লেগে গিয়েছিল এই কাজে। মাইনেপত্র ভাল — তার ওপর রোজ নিয়ম করে কাজ না করলেও হয়। এ তল্লাটে চারপাশে অনেক ফ্ল্যাটবাড়ি — নোকরির কাজে ডুব দিয়ে সে সময়টা এসব বাড়িতে বাথরুম সাফ করলে বাড়তি রোজগার। যাদব আর অন্যান্য ঝাড়ুদারদের নিজেদের মধ্যে চৌহদ্দির ভাগ আছে। এই জায়গাটায় অনেকগুলো বাড়ি যাদবের এক্তিয়ারে। এসব বাড়ির বৌদিরা যাদবের মোবাইলের নম্বর জানে। দরকার মত কাজে ডেকে নেয়। তবে এই বাড়তি রোজগারের একটা ভাগ ইন্সপেক্টার বাবুকে দিতে হয়। নইলে আদমিটা হাজিরা খাতায় লাল দাগ মেরে দেবে। ইন্সপেক্টারবাবু সব সাফাইওয়ালাদের থেকেই ভাগ নেয়। বাবুটাই বা কি করবে — খালি মাইনের টাকাতে তো আর সব খরচা চলে না। ছেলেকে পঢ়াই করতে ফোরেনে পাঠিয়েছে — একগাদা টাকা লেগেছে তাতে। মেয়ে ডাক্তার বনবে — তার পেছনেও অনেক খরচা। চারপাশে সব লোক চকচকে ঝকঝকে লাল নীল গাড়ি চড়ে ঘোরে — ইন্সপেক্টার বাবুর বিবিরও কি সেরকম একটা গাড়ি না হলে চলে? ইন্সপেক্টার বাবু মানুষটা ভাল। ভাগের টাকা নেবার সময় যাদবের সঙ্গে অনেক সুখ দু:খের গল্প করে। তাই তো যাদব এত কথা জানতে পারে।
যাদবদা, চা নাও। মেয়েমানুষের গলা — বাথরুমের বাইরে থেকে ডাকছে। যাদব হাতের কাজ থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। মানদা দাঁড়িয়ে আছে — এ বাড়ির রান্নার কাজের লোক। ওর দু হাতে প্লেটের ওপর রাখা দুটো কাপে ধোঁয়া ওঠা চা। কালো, মোটা, ধুমসো একটা মেয়েছেলে — যখনই যাদব এ বাড়িতে কাজে আসে ও এসে যাদবকে চা দেয়, এটা ওটা গল্প করে। হাসি মস্করা করতে করতে গায়ে গায়ে ছুঁয়ে দেয়। অবে ওর সঙ্গে মজে যাবার কোন ইচ্ছে যাদবের নেই। মাঝবয়েসী একটা আওরাৎ — ওর মরদটা মারা গেছে বহুকাল আগে। একটা মেয়ে আছে — তাকেও বিয়ে দিয়ে দিয়েছে বেশ ক'বছর আগে। একটা অল্পবয়েসী ছোকরা — বাজারে আলু পেঁয়াজ বিক্রী করে — তার সঙ্গে থাকত। কিছুদিন হয় ও ছোকরা ভেগে গিয়ে একটা অল্পবয়েসী মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছে। এখন মানদা আর একটা পুরুষ মানুষ খুঁজছে। ও জানে দেশে যাদবের বৌ ছেলে রয়েছে। তা নিয়ে ওর মাথাব্যথা নেই। যাদব তো দেশে যায় নমাসে ছমাসে একবার — সাত দশ দিনের জন্যে। বাকি সময়টা তো ও মানদার কাছেই থাকবে।
যাদব বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে মেঝেতে উবু হয়ে বসল — মানদার হাত থেকে চায়ের কাপ প্লেট নিল। কাপের পাশে প্লেটে দুটো বিস্কুটও দিয়েছে মানদা। ও থপ করে যাদবের পাশে নিজের কাপ প্লেট নিয়ে বসে পড়ল। একেবারে যাদবের গা ঘেঁষে বসেছে — দাঁত বার করে হাসছে। দাঁতে, মাড়িতে লাল ছোপ। মেয়েমানুষটা পান একটু বেশী খায়।
যাদব একটু অস্বস্তি বোধ করছিল। মানদা বসেছে যাদবের গা লাগিয়ে — ওর গায়ের একটা সুখজাগানো স্পর্শ পাচ্ছে যাদব। এ বাড়িতে এখন যাদবের সঙ্গে মানদা একা। বৌদি যাদবকে ওর মজুরির টাকা ধরিয়ে দিয়ে অফিসে বেরিয়ে গেছে। দাদা তার অফিসে আর ওদের ছেলেটাও ওর স্কুলে। এখন মানদা যদি যাদবের গায়ের ওপর গা দিয়ে পড়ে তাহলে যাদব ফেঁসে যেতে পারে। শত হলেও যাদব তো পুরুষ মানুষ — তায় আবার একা থাকে — রাতে একাই শোয়। আবার মানদা যদি ওর ওপর রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে লোক জড়ো করে বলে যে যাদব ওর গায়ে হাত দিয়েছে তাহলে তো যাদবের হয়ে গেল। কত বছর যে জেলখানায় আরশোলার লাদি মেশানো দানাপানি খেতে হবে তার ঠিক নেই।
যাদব চায়ের কাপ প্লেট মেঝেতে রাখল। উবু হয়ে বসে থাকা অবস্থাতেই একটু পাশের দিকে সরে গেল। এখান থেকে আর মানদার গায়ের ছোঁয়া পাওয়া যাচ্ছে না। মানদা ইঙ্গিতটা বুঝল — ওর মুখের হাসিটা ছোট হয়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, যাদবদা, চা খেয়ে কাপ প্লেট রান্নঘরে দিয়ে যেও। আমাকে ওসব ধুয়েটুয়ে রাখতে হবে।
যাদব ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে কাপটা তুলে চায়ে একটা চুমুক দিল। মানদা নিজের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেছে — যাদব এখন একটু শান্তিতে চা খেতে পারছে। মেয়েছেলেটা চা বানায় ভাল। চা গরম থাকে, আর তাতে দুধ চিনিও ঠিক মাপ মতই দেয়। চা বিস্কুট শেষ করে যাদব খালি কাপ প্লেট রান্নাঘরে দিয়ে এল। মানদা ওর হাত থেকে ওগুলো নেবার সময় ওর দিকে তাকিয়ে আবারও ইশারা করার মত হাসল। মাথা নিচু করে সরে এসে আবার বাথরুমে ঢুকল যাদব। জলদি জলদি কাজ শেষ করতে হবে — তারপর ঘরে ফিরে খানা পাকানো।
যাদব চিরকালই কলকাতায় এরকম সাধু হয়ে থেকেছে তা অবশ্য নয়। গোড়ার দিকে একটা মেয়েমানুষ নিয়েছিল ঘরে। রামেশ্বরের রাখেল মিনতির ছোট বোন। ডায়মন্ডহারবার লাইনে কোথায় একটা গাঁয়ে বিয়ে হয়েছিল। বরটা ছিল বেকার — তার ওপর মাতাল। বর, শাউড়ি খুব মারত ওকে। তাই ঘর ভেঙে চলে আসবার জন্যে ওকে ভালভাবে রাখবে এরকম একটা কলকাতায় থাকা পুরুষমানুষ খুঁজছিল। রামেশ্বর যোগাযোগ করে দিয়েছিল — আর আরতি এসে উঠেছিল যাদবের ঘরে।
তবে একসঙ্গে থেকে যাদব বুঝেছিল আরতির রাগ একটু বেশী। কখনো কখনো ছোটখাট ব্যাপারেই রেগে যেত — ভালমত কোন কারণ ছাড়াই। তখন চিল্লাত আরতি। দু চোখ কিরকম ঘুরত — আরে বাপরে বাপ। ঘরের জিনিষপত্র দুমদাম এদিক ওদিক ছুঁড়ত। একবার তো জলের কুঁজোটা ভেঙে ফেলে সারা ঘরে জল আর জল। মাঝে মাঝে যাদব ভাবত আরতি ওর শউরবাড়িতেও এরকম করত কিনা। আর তাতেই ওর বর আর শাউড়ি ওকে পিটাই করত কিনা। আরতির রাগ আবার ঠাণ্ডাও হয়ে যেত ঝটপট। তখন রাতে ঘন হয়ে কাছে এসে শুত — টেনেটুনে যাদবকে নিজের গায়ের ওপর তুলে নিত। বহুৎই রং ঢং জানত যাদবের ঐ আওরাৎটা।
বছর দশেক এরকম চলেছিল। তারপর দুটো ঘটনা ঘটল। দেশে ওর মেয়ে — বিন্দিয়া — মারা গেল। আর আরতি একটা মাশুক জুটিয়ে তার সঙ্গে পালিয়ে গেল।
বিন্দিয়ার মারা যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল না। আর পাঁচটা ছেলে মেয়ের সঙ্গে ইস্কুলে গিয়েছিল। ওদের দেশ গাঁয়ে আজকাল সবাই মেয়েদেরও ইস্কুলে পাঠায়। যাদবও মেয়েকে সরকারি ইস্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। মেয়ের লিখাপঢ়ি কতদূর হবে তা নিয়ে ওর খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। দুপুরবেলা রোটি সব্জী খেতে পাবে — সেটাই ছিল বড় কথা। একদিন ইস্কুল থেকে আর ফিরে এল না। ইস্কুলের অন্য বাচ্চারা বলেছিল — কারা সব ছুটির পর ওকে ইস্কুলের গেটের বাইরে থেকেই টেনে হিঁচড়ে একটা গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল। গাঁয়ের লোক খুঁজে খুঁজে হয়রান। দু দিন পরে একটা জঙ্গুলে জায়গায় মেয়েটার শরীরটাকে পাওয়া গেল। গায়ে কোন কাপড় জামা নেই। মেরেছে গলায় ওরই দুপাট্টাটা জড়িয়ে ফাঁস লাগিয়ে। মারার আগে অনেকে মিলে ওকে নিয়ে ফুর্তি করেছে। শরীর ছেঁড়া ফাঁড়ার ডাক্তার সেরকমই লিখে ছিল। সবাই বুঝেছিল এ কার কাজ। শ্যামসুন্দর সিং ওখানকার বড় নেতা। তার ছেলে রঘুনন্দন বড় গুন্ডা। কিন্তু শ্যামসুন্দর সিং-এর ছেলের নামে পুলিসে সানা লেখাতে গেলে বুকের পাটা দরকার। যাদবও ভয় পাচ্ছিল পুলিসের কাছে যেতে। তখন যাদবকে উস্কানি দিয়েছিল ওঙ্কারনাথ মিশির। লা পাশ করা লোক। সদর কাছারিতে ভকীল। তাছাড়া একটা এন. জ়ি. ও না কি বলে, তাও চালায়। যাদবকে বলেছিল, তুই নালিশ কর। ডরনা মৎ — আমি তোর পেছনে আছি।
তো যাদব গিয়েছিল পুলিস থানায় — গাঁয়ের দু চারজনকে সঙ্গে নিয়ে। ওঙ্কার মিশির সঙ্গে যায় নি। ব্যস্ত লোক — সদর কাছারিতে মামলা-টামলা থাকে। তবে ওঙ্কার মিশিরের নাম শুনে গেটের পুলিস ওকে থানার ভেতর ঢুকতে দিয়েছিল। কিন্তু যে অফসরের সঙ্গে ও কথা বলেছিল সে ওকে ধমকে ভাগিয়েছিল। তোদের ঘরের মেয়েদের তো হরবখৎ এরকম হয় — এ নিয়ে থানা পুলিস করার কি আছে?
চুপচাপ ফিরে এসেছিল যাদব। আর ফিরে আসার পর খুব ভয়ে ভয়ে ছিল। যাদব থানায় গিয়েছিল এ খবরটা রঘুনন্দন পাবেই। আর তারপর ও কি করবে? এক তুড়িতে গোপালকে তুলে নিয়ে যেতে পারে — গুলি মেরে যাদবের পেট ফুটো করে দিয়ে লছমীকে ঘর থেকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এখনও তো লছমী তেমন কিছু বুডঢি হয়ে যায় নি। আর সেরকম যদি কিছু হয়েই যায় তাহলে বড় জোর একটু হাল্লা হবে। লোকে দু একদিন চিল্লাচিল্লি করবে — আখবরে লিখবে আর টিভিতে দেখাবে। দু দিন পর লোকজন যাদবকে ভুলে যাবে — আখবর আর টিভি কোথায় নতুন কি খুন হয়েছে তাই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ওদেরও তো আম আদমিকে নতুন নতুন খবর দিতে হবে — রোজই সেই এক যাদবের খবর বেচলে তো ওদের চলবে না।
তবে সে সব কিছু আর হয় নি — রঘুনন্দন যাদবের মতো ছোটা একটা আদমিকে নিয়ে আর মাথা ঘামায় নি। কিন্তু যাদব তক্ষুনি কলকাতায় ফিরতে পারে নি। বিন্দিয়া মারা যাবার পর গোপালটা ধন্দ লাগার মত হয়ে গিয়েছিল — লছমীও একটু পাগল পাগল হয়ে গিয়েছিল। তাই যাদব থেকে গিয়েছিল দেশে — বৌ ছেলের সঙ্গে। মরদ কাছে থাকায় লছমী একটু ভরসা পেয়েছিল — গোপালটাও হয়ে পড়েছিল বাপের ন্যাওটা। যাদব ছেলেকে আদর দিতে কসুর করে নি। ও তখনই ঠিক করেছিল — ছেলেকে ও বহুৎ লিখাপঢ়া শিখাবে। ছেলে বড়া আদমি বনবে — নেতা উতারা ওকে খাতির করবে — ও পুলিস থানায় গেলে থানার দরজায় দাঁড়ানো হাবিলদার জুতোয় জুতো ঠুকে সেলাম দেবে — দারোগা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে ওর সঙ্গে হ্যান্ডশিক করবে।
দেশে মাস দুই কাটিয়েছিল যাদব। কলকাতায় আরতির জন্যে চিন্তা ছিল না। ওকে টাকা পয়সা দেয়া ছিল। তাছাড়া ও নিজেও এবাড়ি ওবাড়ি ঝাড়ুপোঁছা করে টাকা কামাই করত। কিন্তু তারপর কলকাতা ফেরার দরকার হয়ে পড়েছিল। নোকরিটা তো করতে হবে — টাকার কামাইটা তো জরুরী। ফেরার আগে খবর পেয়েছিল ওঙ্কার মিশির শ্যামসুন্দরের পার্টিতে ঢুকে পড়েছে। সামনের চুনাবে দাঁড়াবে — নেতা বনে যাবে। যাদব মনে মনে গাল দিয়েছিল ওঙ্কার মিশিরকে। বামহনটা কিতনা হারামি। এদিকে যাদবকে নাচিয়ে দিয়ে নিজে শ্যামসুন্দরের সঙ্গে ভিড়ে গেল।
কলকাতায় ফিরে যাদব হাওড়া স্টেশন থেকে সোজা নিজের ঘরে গিয়েছিল। শরীর খুব ক্লান্ত — সারা রাত ঘুম হয় নি। টিরেনে উঠে দেখেছিল ওর জায়গাটাতে রেলের এক সেপাই হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। লম্বা চওড়া চেহারার সেপাইজী সরকারী আদমি — তাকে জাগাতে সাহস করে নি যাদব। বসে বসে ঝিমোতে ঝিমোতেই রাতটা কাটিয়েছিল। কামরার পায়খানা ছিল অসহ্য নোংরা, আর সেখানে জলও ফুরিয়ে গিয়েছিল। সেজন্যে যাদব তা ব্যবহার করতে পারে নি— হাওড়া স্টেশনে এসে তবে সকালের বেগমোচন করতে পেরেছিল। তারপর বাস ধরে সোজা নিজের ঘর।
যাদব ঘরে ঢুকতে পারে নি। দরজায় একটা বড় তালা ঝুলছিল। যাদবের মেজাজ খিঁচড়ে গিয়েছিল। এই সকালবেলায় আরতি কোথায় গেল? ওর তো যাদবের ফেরার খবর জানা থাকার কথা — রামেশ্বরকে ফোন করে দিয়েছিল যাদব। ওর মনটাও ভাল ছিল না। এবার কলকাতা চলে আসার সময় লছমী শাড়ির আঁচলে বার বার চোখ মুছছিল — গোপাল বাপকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদছিল — ওকে ছেড়ে রেখে বাপকে কলকাত্তা যেতে দেবে না। যাদবের চোখও যে একেবারে শুকনো ছিল তা নয়। বিন্দিয়া মারা যাবার পর থেকেই নিজের পরিবার ছেড়ে থাকতে ওর একেবারেই মন লাগছিল না। একেই মনটা এত খারাপ, তার ওপর আবার ওকে এখন নিজের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।
রামেশ্বরের ঘর কাছেই। যাদবের কাঁধে খালি একটা ছোট ব্যাগ। হেঁটে যেতে অসুবিধে নেই। যাদব গিয়েছিল ওখানে। রামেশ্বর ঘরে ছিল না — ওর ট্যাক্সি নিয়ে সকালেই বেরিয়ে গিয়েছিল। মিনতি যত্ন করে বসিয়েছিল যাদবকে। বলতে গেলে যাদব তো ওর ছোট বোনের বরের মতই — বাড়ির জামাই-এর মতই যাদবের খাতিরদারি ছিল মিনতির কাছে। যাদবকে চা খাইয়েছিল মিনতি — সঙ্গে গরম গরম ফুলকো লুচি আর আলুর ছক্কা। কিন্তু সেই সঙ্গে দিয়েছিল একটা ধাক্কা মারার মত খবর। আরতি চলে গেছে যাদবের ঘর ছেড়ে। ও আর যাদবের ঘর করবে না। কোথায় গেছে? সে কি আর মিনতি জানে? তবে দরজার তালার চাবি আরতি দিদির কাছে রেখে গেছে। মিনতি সেই চাবি দিয়েছিল যাদবকে।
মিনতি কতটা মিথ্যে কথা বলছে সেটা বুঝে গিয়েছিল যাদব। আরতি একটা ছোকরার সঙ্গে পালিয়েছে। ছোকরা যাদবের চেনা — দু একদিন ডিউটি থেকে ফিরে ঐ ছোকরাকে ঘরে বসে থাকতে দেখেছিল যাদব। আরতি যাদবকে বলেছিল ছোকরা ওর দূর সম্পর্কের দেওর। ছোকরাও আরতিকে বৌদি বৌদি বলে ডাকছিল — আরতিও চোখ নাচিয়ে ওর সঙ্গে হাসি ঠাট্টা করছিল। যাদব ও নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবে নি। অনেক দেওর ভাবীর মধ্যে ওরকম একটু আধটু থাকে, তা নিয়ে বেশী মাথা ঘামালে চলে না। তবে আরতি একেবারে ভেগে যাবে এতটা যাদব ভাবে নি। যদিও আরতি এভাবে পালিয়ে যেতে ও আরতির ওপর একটু খুশিই হয়েছিল। এবারে দেশ থেকে চলে আসার সময় খালি লছমী আর গোপালের কথা মনে হচ্ছিল — কলকাতায় ফিরে আবার আরতিকে নিয়ে থাকতে হবে — সেটা ভাবতেই আর ভাল লাগছিল না। পালিয়ে গিয়ে আরতি ওকে বহুৎ আচ্ছা ছুটকারা দিয়ে গেছে। আরতি যদি ঐ ছোকরার সঙ্গে বিয়ে বসে যায় আর ও যদি তার খবর পায় তাহলে ও ওদের দামী কিছু উপহার দেবে — মিনতির দেয়া লুচি আলুর ছক্কা চিবোতে চিবোতে ও ভাবছিল।
মিনতির দেয়া চাবিটা ওর ঘরের দরজার তালার ফুটোয় ভাল করে ঘুরছিল না। এর মধ্যে ঝড় জল হয়েছিল — তালার ভেতর জল ঢুকেছিল। বেশ খানিকক্ষণ খুট খাট করার পর ঐ হারামি তালা খুলে গিয়েছিল — যাদব ঢুকেছিল নিজের ঘরে। ঘরটা ধুলোভর্তি — টুকিটাকি সব জিনিষ, যাদবের জামাকাপড় — সব মেঝেয় এদিক ওদিক ছড়ানো। রান্না করার স্টোভটা ঘরের এক কোণে কাত হয়ে পড়েছিল। যাদব স্টোভটা তুলে নিয়ে ঝাঁকিয়ে দেখেছিল। খালি স্টোভ — তেল নেই। সাল্লি রেন্ডি— যাদব মনে মনে আরতিকে গাল দিয়েছিল। ভাগবি তো ভাগ্ — স্টোভে তো তেল রেখে যাবি। কাছেই একটা সস্তার ভাতের হোটেল — যাদব সেদিনের খাওয়াটা সেখানে সেরেছিল।
তারপর কত বছর কেটে গেল। খুব তাড়াতাড়ি দৌড়ে চলে গেল বছরগুলো — মেল টিরেন যে রকম হুড়মুড়িয়ে ছুটে চলে যায় সে রকম। গোপাল ইস্কুল পাশ করে ওদের সদর শহরে ইঞ্জিনিরি ডিপ্লোমা পড়তে ঢুকল। গোপালকে ওখানে ঢোকাবার জন্যে একটা দালালকে দশ হাজার দিয়েছিল যাদব। টাকাটা একটু বেশী নিলেও দালালটা কাজটা ঠিকঠাক করে দিয়েছিল। ঐ টাকাটা দিতে অনেক ধার করতে হয়েছিল যাদবকে। ধার শুধবার জন্যে ও তার পরের তিনমাস খালি ছাতু আর লঙ্কা খেয়ে টাকা জমিয়েছিল। এখন গোপালের শেষ পরীক্ষাটাও হয়ে গিয়েছে। সেজন্যেই মা আর ছেলে এখানে ছুটি কাটাতে আসছে। ছুটির পর ফিরে গিয়ে গোপাল ওর পাশ করার কাগজ হাতে পাবে — তার পরেই একটা ভাল নোকরি। নোকরি পেলে ওর বিয়ে লাগিয়ে দেবে যাদব। বিশ্বেশ্বর ঠাকুর ওর লড়কি দেবার জন্যে মুখিয়ে আছে — সেই সঙ্গে পচাস হাজার দহেজ আর একটা দু চাকার ভটভটিয়া। টাকাটা যাদব নিজে নেবে — ভটভটিয়া গোপালের থাকবে।
আরতি চলে যাবার পর রামেশ্বর ওর জন্যে আবার একটা মেয়েছেলের খোঁজ এনেছিল। একদম কমবয়েসি একটা লড়কি — বাপ মা নেই, কলকাত্তায় দিদি জামাইবাবুর কাছে থাকে। কয়েকটা বাড়িতে ঘরের কাজ করে — যে কটা টাকা পায় সব দিদি নিয়ে নেয়। দিদির বরটা বহুৎ দারু পিয়ে রাতে ঘরে ফেরে — বেশী মাতোয়ারা হয়ে গেলে ছোকরি শালির ওপর হাসলে পরে বিছানায় পেড়ে ফেলার চেষ্টা করে। দিদিটা তখন ধাক্কা টাক্কা মেরে নিজের বরকে সরায় — মজা লুটতে না পারার রাগে লোকটা তখন বৌকে বেধড়ক পেটায়। দিদিটা এখন একটা লোক খুঁজছে — যার কাছে বোনকে গছিয়ে দিয়ে নিজে নিশ্চিন্ত হতে পারে। অল্পবয়েসী নরম সরম একটা লড়কি — যাদবের লোভ লাগে নি এমন নয়। কিন্তু ও মুখ ফুটে হ্যাঁ বলতে পারে নি। ও দেশে বৌ ছেলেমেয়েকে রেখে এসে কলকাত্তায় আর একটা মেয়েমানুষের সঙ্গে ফুর্তি করেছে। গুনাহ্ — ভারি বড়া গুনাহ্ করেছে যাদব। আর সেই গুনাহ্ ওর মাথায় জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসে আছে।
তবে নিজের পাপ কাটানোর চেষ্টা করেছিল যাদব। দীনদায়াল পাঁড়ে শিউজির মন্দিরে পুজো করে। লোকজনের ওপর শনিদেবতা, রাহুদেবতার নজর পড়লে তারা পাঁড়েজীর কাছে যায়। পাঁড়েজী তখন হরেক রকম গাছের ডাল আর পাতা জড়ো করে তাতে আগ লাগিয়ে যাগ করে। সেই আগে ঘি ঢালে আর মন্ত্র পড়ে — তাতে দেবতাদের বুরি নজর কেটে যায়। যাদবও গিয়েছিল তার কাছে। তার কথামতো বিন্দিয়ার শ্রাদ্ধশান্তি করেছিল। পাঁচটা বামহণকে খাইয়েছিল। এই এত এত খেয়েছিল এক একটা বামহণ। কিন্তু মেয়ের মুক্তি হয় নি। যাদবকে দেখা দিয়েছে বিন্দিয়া। মাঝরাতে যাদবের ঘুম ভেঙেছে। ঘর অন্ধকার — সেই অন্ধকারের ভেতরে একটা আরও গাঢ় অন্ধকারের তাল। কিন্তু যাদব দেখতে পেয়েছে — একটা বাচ্চা মেয়ে — দু হাঁটুর ভেতর মুখ গুঁজে বসে আছে। তারপর মুখ তুলে যাদবের দিকে তাকিয়েছে সেই মেয়ে — গলায় দু পাট্টার ফাঁস — দু চোখ আর জিভ বেরিয়ে এসেছে। বুক ধড়াস করে উঠেছে — ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসেছে যাদব। কোথাও কেউ নেই — ঘর খালি কালো আঁধার হাঁ হাঁ করছে। কিন্তু তারপরেই ওর কানের ভেতর গুনগুনানি — হেই বাপ তু গুণাহ করলি কেন? তোর ওই পাপেই তো আমি মরলাম।
বুকের ভেতর দুপদাপ আওয়াজ — নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আবার শুয়ে পড়েছে যাদব। কিন্তু চোখে ঘুম নেই — মাথায় চিন্তা — মরার সময় কত কষ্ট পেয়েছিস রে আমার গুড়িয়া — তু মুঝে মাফ কর — আমার গুণাহ ক্ষমা করে দে।
কিন্তু যাদব পুরুষ মানুষ — ওর শরীরের তো একটা খিদে আছে। রাতে ও বিছানায় শুলে ওর শরীর ওকে নিজের চাহিদা জানিয়েছে। তখন ও ভেবেছে পরের দিনই রামেশ্বরকে বলবে একটা আওরাতের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়েছে মরা মেয়ের কথা — তখন রাগ হয়েছে ভগবানের ওপর। এত মানুষ থাকতে পাপ দেবার জন্যে ভগবান কেন খালি যাদবকেই বেছে নিয়েছে! রাখেলের সঙ্গে থাকলে খালি যাদবেরই পাপ হবে কেন — খালি যাদবেরই মেয়ে খুন হবে কেন! এই যে রামেশ্বর — দেশে একটা বৌ আর কলকাত্তায় একটা মেয়েমানুষ নিয়ে দিব্যি আছে — ওর তো পাপ লাগে না! মনে মনে ভগবানকে গাল দিয়েছে যাদব — সাল্লা হারামি কাঁহিকা। কিন্তু তারপরেই ভয় পেয়েছে — গোপালের যদি খারাপ কিছু হয়? ছেলেটা যাদবের জান — ওর খারাপ কিছু হলে যাদব আর বাঁচবে না। তখন আবার ভগবানের কাছে মাফি মেঙে নিয়েছে। আমার ও সব কথা তুমি কানে নিও না ভগবান। আমাকে মাফ করে দাও — আমার ছেলেটাকে ভাল রেখো, সুখে রেখো। কিন্তু শরীরের চাহিদা ওকে কামড়াতে ছাড়ে নি — ও বিছানায় ছটফট করে এপাশ ওপাশ করেছে। তারপর কখন একসময় সকালের আলো এসে ঢুকেছে ওর ঘরে — ঘুম ভেঙে ও বিছানার ওপর উঠে বসেছে।
বাথরুম সাফাই এর কাজ শেষ করে যাদব হাত মুখ ধুয়ে নিল — পকেট থেকে একটা অনেকদিনের না কাচা রুমাল বার করে মুখ মুছল। মানদা রান্নাঘরে — রান্নার ছ্যাঁকছোঁক আওয়াজ আসছে। বেরোবার সময় ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে ঝামেলা হবে — ও একগাদা কথা বলতে শুরু করবে। যাদব চটপট ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসে সদর দরজা বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করে দিল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে একেবারে রাস্তায়। বাস ধরবে ঘরে যাবার জন্যে।
পকেটে টুংটাং আওয়াজ। মোবাইলটা বাজছে। গোপাল ফোন করছে নাকি? তাড়াতাড়ি যন্ত্রটা বার করে দেখল যাদব। না, গোপাল নয় — ইন্সপেক্টারবাবুর ফোন। এই সময়ে আবার ইন্সপেক্টারবাবু ফোন করছে কেন?
ইন্সপেক্টারবাবু তাড়াতাড়ি তার কথা বলে ফেলল। খুব জরুরী কাজ পড়ে গেছে। যাদবকে এক্ষুনি যেতে হবে আগের বড় রাস্তাটার মোড়ে — যেখানে ফি বর্ষায় জল জমে সেখানে। মাটির নিচের বড় ড্রেন সাফ করতে হবে— সাফ করার বাকি লোকজন এর মধ্যেই সেখানে জড়ো হয়ে গেছে।
যাদব খিঁচিয়ে উঠল — আমি পারব না। আমার ঘরে কাজ আছে। অন্য কাউকে লাগিয়ে দাও।
ফোনেই ইন্সপেক্টারবাবু যাদবের হাতে পায়ে ধরাধরি করতে লাগল। লক্ষ্মী বাপ আমার। আজকের মত আমাকে উদ্ধার করে দে। মিনিস্টার জল জমার জায়গাটা দেখতে আসবে — খানিকটা ময়লা তুলে ফেলে তাকে কিছু কাজ দেখাতেই হবে। আজকের কাজটা করে দে, তারপর তিনদিন কাজে না এসে প্রাইভেট কাজ করিস — তোর থেকে সে রোজগারের ভাগ নেব না। তোর মত ভাল কাজ করতে আর কে পারবে? আধঘন্টা কাজ করলেই হবে। আজ চলে আয়, আর দির্ করিস নে।
তোষামদে সবাই নরম হয়, যাদবও হল। তাছাড়া ইন্সপেক্টারবাবুকে একেবারে চটিয়ে দেয়াটাও ঠিক কাজ হবে না। যাদব মনে মনে একটু হিসেব করে নিল। গাড়ি চার ঘন্টা লেট আসছে। আরও আধঘন্টা কাজ করে ঘরে ফিরলেও রান্না বান্না করা জন্যে অনেক সময় থাকবে। বৌ ছেলেকে নিয়ে আসার জন্যে যাদবের নিজেকে হাওড়া স্টেশন যেতে হবে না। রামেশ্বর দায়িত্ব নিয়েছে। ও নিজের ট্যাক্সি নিয়ে হাওড়া যাবে — ওদের নিয়ে আসবে।
খোলা ম্যানহোলের গর্ত দিয়ে যাদব ঝুলে পড়ে পাতালে নামল। ওর কোমরে শক্ত মোটা কাছির দড়ি বাঁধা, তার এক দিক রাস্তার ওপরে খুঁটির সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা আছে। ওপরে উঠতে হলে যাদব ঐ দড়ি জোরে জোরে নাড়বে — আর ওর সাথীরা ওকে দড়ি ধরে টেনে ওপরে তুলে ফেলবে। নিচে অন্ধকার, হাওয়া ওই খোলা গর্ত দিয়ে যেটুকু ঢোকে তাই, পায়ের নিচে জঘন্য নোংরা তলতলে পাঁক। একজন একবারে বেশীক্ষণ কাজ করতে পারে না। দড়ি দিয়ে বেঁধে একটা বড় বালতিও নামানো হয়েছে। যাদব এই বালতিতে করে খপাখপ ময়লা পাঁক তুলে দেয় — ওপরের লোকজন বালতি ওপরে টেনে তুলে বালতির নোংরা ঢেলে ফেলে — খালি বালতি আবার নিচে নামিয়ে দেয়। কাজটা শক্ত — এর জন্যে অভিজ্ঞ লোক দরকার। তবে যাদব পাকা লোক। মিনিট পনেরোর ভেতরেই অনেক বালতি পাঁক তুলে ফেলল — রাস্তার একপাশে বেশ কয়েকটা ময়লার ঢিবি তৈরি হয়ে গেল। এবার ও উঠে পড়বে — ওপরে উঠে সাফ সুতরো হতেও বেশ সময় লাগবে।
একটা ঝাঁঝালো গন্ধ ওর নাকে এল। যাদব জানে ম্যানহোলের নিচে এসব জায়গায় অনেক সময় সব অজানা গ্যাস বেরোয় — তখন সঙ্গে সঙ্গে ওপরে উঠে পড়তে হয়। ও দড়ি নাড়তে চেষ্টা করল — পারল না। হাত দুটো পাথরের মত ভারি লাগছে। যাদব ঘাবড়াল — তবে কি ও ঐ গ্যাসটা নি:শ্বাসের সঙ্গে শরীরের ভেতর নিয়ে ফেলেছে? গ্যাসের ঝাঁঝটা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ছে — ও হাত, পা কিছুই আর নাড়তে পারছে না। ও চেঁচিয়ে ওপরে সঙ্গীদের ডাকতে গেল — গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। ওর বুকে খুব চাপ লাগছে — যেন বড় বড় পাথর ওখানে চাপানো আছে। ভগবান ওকে এখন শাস্তি দিচ্ছে — ঐ যে ও ভগবানকে কতদিন গালি দিয়েছে — তার জন্যে। ওর মাথা, চোখ মনে হচ্ছে ফেটে যাবে — এমনি এখন গ্যাসের ঝাঁঝ। ওপরে সঙ্গীরা হয়তো আরামসে বিড়ি খাচ্ছে — বুঝতেই পারছে না নিচে কি হচ্ছে।
যাদব মোক্ষম বুঝল যে ও আর এখান থেকে বেরোতে পারবে না। এখন ওর দম বন্ধ হয়ে গেছে — বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মাথার ভেতর সব কিছু মুছে যাচ্ছে। ঠিক তখনই একটা চিন্তা ওর মাথার ভেতর খেলে গেল — রান্নাটা করা হল না — গোপাল আর লছমী আসবে — ভুখা থেকে যাবে ওরা।
(পরবাস-৬৪, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)