Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines





পরবাসে
সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়ের

লেখা


ISSN 1563-8685




আধুনিক বাংলা কবিতায় দুর্বোধ্যতা

গত শতাব্দীর শেষ কয়েক দশকে বাংলা কবিতা ধারাবাহিকভাবে রূপ বদল করেছে এবং এখনও করছে। এই অধৈর্য পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্য যে পরিমাণ নিষ্ঠার প্রয়োজন তা বাঙালি পাঠক জুটিয়ে উঠতে পারছে না। সাধারণ সাহিত্য পাঠকের অভিযোগ আধুনিক বাংলা কবিতা দুর্বোধ্য। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর “ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো” কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন “আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্য পাঠকের হাতে”। উৎসর্গে পাঠকের প্রতি তাঁর অভিমান পরিষ্কার। আধুনিক কবিতা দুর্বোধ্য নয়, তার প্রতি পাঠকের অনীহা দুর্বোধ্য। আলোচনা শুরু করার আগে একটা ব্যাপার অবশ্যই বুঝে নিতে হবে যে চলচ্চিত্র বা চিত্রকলার যেমন নিজস্ব ভাষা থাকে কবিতারও তেমনই। সেই ভাষার সিনট্যাক্স গদ্যসাহিত্যের থেকে কিছু আলাদা। বাংলার আদি কবিতা বলে স্বীকৃত চর্যাপদের ভাষাকে বলা হয় সন্ধ্যাভাষা। তাতে দিনের আলোর সুস্পষ্টতা নেই। আছে গোধূলির মায়াবী আবছায়া। তাই বলা যায় দুর্বোধ্যতায় বাংলা কবিতার জন্মসিদ্ধ অধিকার। এমন কি আন্তর্জাল থেকে জানলাম যাঁর কবিতা সব বাঙালিই সম্যক বোঝে বলে মনে করে সেই রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক কবিতার চিন্তা ভাবনায় ‘ambiguity’ খুঁজে পেয়েছেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। কবিতা আদতে কবির নিভৃত অনুভূতির ফসল। তাই তাতে শৃংখলা কম, অস্থিরতা বেশি। তবু সব শিল্পের মত কবিতারও দায়বদ্ধতা থাকে পাঠকের উপলব্ধির কাছে পৌঁছোনর, কম্যুনিকেট করার। অন্যদিকে কবিদের বাসি ফর্মের চর্বিতচর্বণে অরুচি। তাই তারা সর্বদাই পুরনো প্রকাশভঙ্গীকে নস্যাৎ করে নতুন বাগ্‌ধারার সন্ধানে অসহিষ্ণু। ফলতঃ দুর্বোধ্যতার উৎস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিকাঠামোগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আপাত দুর্বোধ্যতার এই প্রাসঙ্গিক কারণগুলি এবার আর একটু বিশদে খতিয়ে দেখা যাক।

১। সাহিত্যের সব শাখাগুলির মধ্যে কবিতা সর্বাপেক্ষা পরিশীলিত। স্বভাবতই তার ধর্ম মিতকথন। সৎ কবি কখনোই অতিকথনে বিশ্বাসী নয়। “ঘরে ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হলো?/ চতুরতা ক্লান্ত লাগে খুব?” (মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়, শঙ্খ ঘোষ, ১৯৭৪) প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দ পাঠককে ক্লান্ত করে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় কম শব্দ ব্যবহার কবিতাকে কখনও কখনও ধাঁধাঁ বা রিড্‌লে পর্যবসিত করে। কবির মনে রাখা জরুরী যে সে কবিতা লিখতে বসেছে, ধাঁধাঁ তৈরি করতে নয়।

২। ইঙ্গিত এবং সংকেত কবিতাকে রহস্যময় করে। সার্থক কবিতায় তাদের ব্যবহার অপরিহার্য। অথচ পাঠক যদি সেগুলি ডিসাইফার করতে অপারগ হন তাহলে সে কবিতা অচেনাই থেকে যায়। অন্যদিকে কবির দায়িত্ব সেই সঙ্কেতগুলি এমনভাবে ছড়িয়ে রাখা যাতে সেগুলি নিরবচ্ছিন্নভাবে এবং নির্দ্বিধায় পাঠককে সমাধানের দিকে নিয়ে যায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “এক অসুখে দুজন অন্ধ” কবিতার শেষ দুটি লাইনে পৌঁছোতে পৌঁছোতে ঠিক কোন দু’জন একই অসুখে অন্ধ পাঠক মোটামুটি আন্দাজ করে ফেলে। “এক অসুখে দুজন অন্ধ! / আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ।” (হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান, ১৯৬৮) একজন বহির্মুখী বোহেমিয়ান বালিতে আধ-কোমর বন্ধ করে রোদ পোহায়। অন্যজন হল্লা-হাওয়া সামলে, পাল্লা-আগল বন্ধ করে মাটিতে শিকড় নামায়। সমুদ্রের আমিষ গন্ধে দুজনেই তোলপাড়, কবির বুকের ভিতর।

৩। কবিতায় প্রতীকের ব্যবহার চলে আসছে আদি অনন্তকাল ধরে। তবে আধুনিক কবিতায় প্রতীক চোখে আঙ্গুল দিয়ে উপমাটি চিনিয়ে দেয় না। বরং যে-দুটি বস্তুর মধ্যে তুলনা করা হচ্ছে তার মধ্যে একটিকে অনুক্ত রাখতেই সে বেশি আগ্রহী। এই কুয়াশার মধ্যে দিয়ে গন্তব্যর রাস্তাটি খুঁজে নেবার দায়িত্ব কিন্তু সংবেদী পাঠকের। যেমন ধরা যাক শ্রীজাতর “এই শহর, এই সময়/ নিয়মমাফিক” কবিতার প্রথম দু লাইন। “কলকাতায় নিয়মমাফিক সন্ধে হলেই/ পাথর নেমে আসবে বুকে সন্দেহ নেই।” (উড়ন্ত সব জোকার, ২০০৩) পাঠক অনুমান করে নেয় এই পাথর হয়তো আদতে বিষাদ।

৪। অতিরিক্ত মাত্রায় প্রতীকের ব্যবহার কবিতাকে অর্থহীন করে তোলে। সঙ্গতিহীন বিকল্প শব্দের ব্যবহার তাকে ভারাক্রান্ত করে। প্রয়োজন হয়ে পড়ে কবিতা অভিধানের। তাই শব্দ যতই অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত হোক না কেন, তার অর্থবহ হয়ে ওঠা অত্যন্ত আবশ্যিক। তবে রুমালের বদলে বিড়াল লিখলে আপত্তির কারণ নেই। এই প্রসঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “না লেখা কবিতা” কবিতাটির কথা মনে পড়লো। “কুসুমের বুক থেকে ঝরে গেছে সব পবিত্রতা; এই লাইনটা নিয়ে মহা মুস্কিলে পড়েছি। লিখেই মনে পড়ে, না না, আমি বলতে চাই স্ত্রীলোকের শরীর থেকে সব রূপ উবে গেছে।” (আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি)

৫। কবিতা এক অর্থে সমাজ এবং সভ্যতার দর্পণ। তার ব্যাপ্তি ঐতিহাসিক যুগ পার করে প্রত্নতাত্ত্বিক পৃথিবীতে। সার্থক কবিতার জিন-কোডে প্রস্তরযুগের মানুষ এবং মানুষীর প্রবৃত্তি প্রোথিত থাকে। তাই তার মধ্যে উঠে আসে পূর্বজদের কর্মকাণ্ডের রেফরেন্স। “টান রাখে মৃত ও জাগ্রত পৃথিবীকে।/ টান রাখে জীবনের ধনুকের ছিলা।/ শ্লোক আওড়ায়ে গেছে মৈত্রেয়ী কবে;/ রাজ্য জয় করে গেছে অমর আত্তিলা।" (রাত্রি, জীবনানন্দ দাশ, সাতটি তারার তিমির) মুস্কিল হল এই যে কবিতার শেষে পাদটীকা লাগানোর প্রচলন নেই। সুধী পাঠকের দায়িত্ব সেগুলি খুঁজে পেতে নেবার। বিষ্ণু দে’র কবিতার ইতিহাস ও সমাজচেতনার নাগাল পেতে হলে পাঠককে শিক্ষিত হতে হবে। সুধীন্দ্রনাথের ‘নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনার’ কাছাকাছি পৌঁছোতে হলে পাঠককে তৎসম শব্দ ভেদ করার মানসিক পরিশ্রম করতে হবে। বোধগম্যতার নিরিখে এগুলিকে কবির স্বার্থপরতা বলা ঠিক নয় বরং বলা উচিত আধুনিক পাঠকের মেধা ও মননের কাছে দাবি।

৬। আশির দশকে উত্তরাধুনিক ভাবনায় ভাষাকে মনে করা হয় কেবল মাত্র চিহ্নর সমাহার। শব্দর অর্থ নির্ভর করে দুটি শব্দর চিহ্ন কতখানি আলাদা তার উপর। ডিকন্সট্রাকশন যে শুধু দুটি শব্দের চিহ্নকে পৃথক করে তাই নয়, নতুন শব্দ সৃষ্টির দাবি রাখে। শব্দের পারস্পরিক সম্পর্ক কিছু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠিত কার্য কারণ মেনে চলে। সেগুলিকে অতিক্রম করতে গেলে সযত্ন চিন্তার প্রয়োজন। অকারণ এবং উদ্দেশ্যহীন প্রয়োগ কবিতাকে অনর্থক অক্ষরমালায় পরিণত করে। পরিচিত ভাষায় চিন্তা করতে না পেরে পাঠক অস্বস্তিতে পড়ে যায় এবং কবিতাকে দুর্বোধ্য বলে চিহ্নিত করে। শ্রীজাতর উড়ন্ত সব জোকার কবিতার শেষ দুলাইন সম্ভবত এই সতর্ক প্রয়োগের কথাই মনে করিয়ে দেয়, ‘জীবন কিন্তু প্রেমদিওয়ানা সাবধানে তার গায়ের গন্ধ শুঁকো -’/ বলছে আমায় উড়ন্ত দুই পাগলা জোকার – দেরিদা আর ফুকো। (উড়ন্ত সব জোকার, ২০০৩) প্রত্যেক সত্যের উলটো পিঠে কিন্তু অসত্য থাকে না। থাকে অন্য সত্য। তাই এই সতর্কীকরণ সাধারণ পাঠকের জন্যও। শব্দ ব্রহ্ম; ব্রহ্ম নিরাকার। তাকে আকারে আবদ্ধ করে মানুষ। মানুষের সঙ্গে সঙ্গে সেই আকার বদলে যায়। চেনা আকারের বাইরে তার যে রূপ তাকে উপলব্ধি করার দায়িত্ব উত্তরাধুনিক পাঠকের। বাংলা কবিতায় হাংরি আন্দোলন সমকালীন আধুনিকতাকে অস্বীকার করতে চেয়েছিল। সেই আন্দোলনের সাফল্য বা অসাফল্যর আলোচনায় না গিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’ কবিতার একটি লাইন পড়া যাক, “ভাত খেয়ে আচাবার পর পরিষ্কার নখগুলোকে কেমন মহানুভব মনে হচ্ছে”। এই লাইনে ‘মহানুভব’ শব্দটির অর্থ সমগ্র কবিতার প্রেক্ষিতে বুঝে নিতে হয়। আমি আলাদা করে এই ছত্রের মানে বুঝতে পারি না।

৭। এ’কথা বলাই বাহুল্য যে পরিকাঠামো দাবি করে লেখার একটি বিশেষ ধারা বা প্যাটার্ন। প্রায়শই কবি এবং কবিতা তার মধ্যে আটকে পড়ে যায়। ফলতঃ বোধ দুর্বোধ্যতাকে জায়গা ছেড়ে দেয়। কবি ভুলে যায় যে কবিতার প্রয়োজনে পরিকাঠামোর আয়োজন। পরিকাঠামোর স্বার্থে কবিতা নয়। বিষয় বিচারে সঠিক পরিকাঠামো বেছে নেবার দায় কবির। বিষয় যদি পরিচিত পরিকাঠামো অতিক্রম করতে চায় নতুন পরিকাঠামো গড়ার দায়িত্বও তার।

৮। অনেক সময় কোনো অপরিণত কবি বা কবিগোষ্ঠী ইচ্ছাকৃত দুর্বোধ্যতার আড়ালে নিজের (নিজেদের) অক্ষমতা ঢেকে রাখতে চান। গোষ্ঠীর একে অন্যের পৃষ্ঠ কণ্ডূয়ন করে নাবালক মতটিকে প্রতিষ্ঠা করতে চান। এটি পাঠকের সঙ্গে তঞ্চকতা এবং নিন্দনীয়।

আমি ইচ্ছা করেই শেষ দুই ধরনের অসার্থক কবিতা বা অকবিতার উদাহরণ দেওয়া থেকে বিরত থাকলাম।

পরিকাঠামো বিষয়ক আলোচনা ছন্দ এবং অন্তমিলের কথা ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ছন্দ এবং অন্তমিল পাঠকের শ্রুতিকে স্বাচ্ছন্দ্য দেয়। প্রচ্ছন্নতাকে সহনীয় করে। আধুনিক কবিরা একে অচ্ছুৎ করেছেন। কবিতা যে ছন্দ মেনেই লিখতে হবে এমন কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। আবার ভিন্নমতে যে কোনও লেখার নিজস্ব চলন-ছন্দ থাকে। তাকে অমান্য করা যায় না। আধুনিক সময়েও অনেক কবিতা নজরে আসে যেগুলি মূলত বৃত্ত ছন্দে লেখা। বৃত্ত ছন্দ মানে ঘুরে ফিরে একই জায়গায় প্রত্যাবর্তন। বৃত্ত ছন্দের এই এক বিড়ম্বনা। অনেকটা ট্র্যাক কাটা পুরোন দিনের লং প্লেয়িং রেকর্ডের মত। তাই অনেকে চেয়েছেন বৃত্ত ছন্দর মধ্যে থেকেই তার শৃঙ্খল ভাঙতে।

ছোটবেলায় “সরল কর” দেখেই কে যেন ব্র্যাকেট ট্র্যাকেট ভাঙছিল। অঙ্কের স্যার তেড়ে উঠলেন, “আরে করো কী, করো কী? এ কি কয়লা? দেখেই ভাঙতে শুরু ক’রে দিলে?” ছন্দের ব্যাপারটাও অনেকটা “সরল কর” অঙ্কের মতন। “ভাঙারও নিজস্ব এক ছন্দ আছে, রীতি প্রথা আছে।” যে সে নয়, বলে গেছেন খোদ শক্তি চট্টোপাধ্যায়। “কে জানে কেমন করে ছন্দের বারান্দা ভাঙা হবে?/ মিস্তিরি মজুত, কাছে শাবল গাঁইতি সবই আছে।/ লোকবল আছে, আছে ভাঙ্গনের নিশ্চিত নির্দেশ,/ ভাঙার ক্ষমতা আছে, প্রয়োজনও আছে।” (ভাঙা গড়ার চেয়েও মূল্যবান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, যেতে পারি কিন্তু কেন যাব) শক্তির লেখা অধিকাংশ কবিতাই বৃত্ত ছন্দে। কিন্তু পড়তে একটুও ক্লান্তি আসে না। কেন না তিনি জানেন, “অপরূপভাবে ভাঙা, গড়ার চেয়েও মূল্যবান/ কখনো – সখনো।”

আধুনিক বাংলা কবিতা মূলত জটিল নাগরিক জীবন যাপনের প্রতিচ্ছবি। তাই বিষয় ও গঠনের বিচারে তার সহজ সরল না হওয়াই স্বাভাবিক। যাপনের যান্ত্রিক মনোটোনি তাকে বিরক্ত করে। মেকি সামাজিকতা তাকে একাকী ও বিষণ্ণ করে তোলে। সে ক্রমাগত বহির্বিমুখ, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। “-তোমাকে আজকাল এত রোগা লাগে কেন শুভঙ্কর?/ খুব ম্রিয়মাণ লাগে/ যেন ঘন বর্ষাকাল, মেঘের ধূসর ডানা, জল কোলাহল/ ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেছে তোমাকে।” (কথোপকথন ২৪, পূর্ণেন্দু পত্রী, কথোপকথন, ১৯৮১) এই ব্যাপারটি মেনে-বুঝে নিলে কবিতার দুর্বোধ্যতার কারণ খোঁজা সহজ হয়ে যায়। পাঠক যদি কবিতার সঙ্গে সরাসরি রিলেট করতে পারে তবে কবিতাকে তার আর দুর্বোধ্য মনে হয় না।

“Man is least himself when he talks in his own person. Give him a mask, and he will tell you the truth.” (Oscar Wilde) অসাধারণ কথা। মুখোসের আড়ালে থেকে লেখা যায় বলেই কবিতা সৎ। লেখকের কাছে। এবং পাঠকের কাছেও বটে। না’হলে কবিতা সর্বজনীন হয় না। কবিতা তো শুধু আলোকোজ্জ্বল রাস্তা হাঁটা নয় তার মধ্যে ডার্কনেসও থাকে। কিন্তু উত্তমপুরুষে তা স্বীকার করা মুস্কিল। করলেও সে স্বীকারোক্তি ব্যক্তিগত লেখা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তিগত লেখার যতই গুণ থাকুক সে কবিতা নয়। অন্যদিকে যতক্ষণ না পাঠক কবিতার মধ্যে নিজের আলো-কালোর সন্ধান পাচ্ছে, ততক্ষণ সেই কবিতা তার কাছে দুর্বোধ্য। রিলেট করার জন্যও তারও ওই আড়ালটুকুর নিতান্ত প্রয়োজন। অন্তরাল তাকে স্বস্তি দেয়। অবশ্য পাঠকের দেখা সম্পূর্ণভাবেই তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং মানসিকতা নির্ভর। নিজের সঙ্গে রিলেট করে কবিতা বোঝার এটা একটা সমস্যা বটে। তাই কবিতা বোঝার জন্য নির্লিপ্তি জরুরী। হৃদয় দিয়ে অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্ক দিয়ে যাচাই করে নেওয়াও দরকার। বুদ্ধিবেত্তা ও আবেগের যথাযথ এবং তুল্যমূল্য সংমিশ্রণ কবিতার অন্তর্লীন বোধ ও বোধির সন্ধান দেয়।

আপাত প্রলাপের মধ্যে কবিও কি যৌক্তিকতার সন্ধান করেন না? “...পতনের দৃশ্যের বদলে/ মৃত্তিকার থেকে উঠে ওই ফুল বৃন্তে লেগে গেলো -/ এই দৃশ্য হলে বড়ো ভালো হতো, বড় ভালো হতো!” (একটি ফুলের বিষয়ে, বিনয় মজুমদার, ঈশ্বরীর) স্মৃতি যখন তীব্র বেদনাদায়ক হয় তখন কবি নিষ্কৃতি চান – “কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?” তাই হয় তো কবি চাইছেন সময় ভাঁজ হয়ে পিছু হাঁটুক। কিন্তু যৌক্তিকতা তাঁকে রূঢ় বাস্তবে ফিরিয়ে আনে, “বারম্বার ভেবে ভেবে কেবলি বিফল হতে থাকি।/ যন্ত্রণাদায়কভাবে কেবলি বিভ্রম হতে থাকে।” দ্রব মন আর শাণিত মননের এই টানাপোড়েন কবির বিজ্ঞান ও কারিগরী শিক্ষালব্ধ চেতনার ফসল। শেষে হাল ছেড়ে অসহায় কবি অলৌকিকের যাচঞা করছেন, “স্মৃতি পরিবর্তনের মতো প্রিয়তর কীর্তি করায় সক্ষম কোন পাখি?” এখানে প্রশ্ন হল কবিতা বুঝতে হলে কবির জীবন সম্বন্ধে জানা কি একান্তই জরুরী? উত্তরে ফিরে আসতে হবে একটু আগের আলোচনায়। পাঠক কি কবিতার সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে পারলেন? না পারলে তাঁর সে দায় নেই। কবিতার বিষয় ও গঠনপ্রণালীতে কবির জীবনযাপনের প্রভাব সন্ধান করার দায়িত্ব সাহিত্যর নিবিষ্ট গবেষকের। সাধারণ পাঠকের নয়।

পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন আমি যে কবিতাংশগুলি এই প্রবন্ধে ব্যবহার করেছি, আমার বক্তব্যের সমর্থনে, সেগুলি তেমন দুর্বোধ্য নয়। জনক কবিতাগুলি অবশ্যই কালোত্তীর্ণ। না’হলে আমি ফিরে পড়তাম না বা রেফার করতাম না। দুর্বোধ্যতার সংজ্ঞা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। আজ যে কবিতা দুর্বোধ্য বলে মনে হচ্ছে কাল হয় তো সেটি পাঠকের কাছে সাদরে গৃহীত হবে। যে ক’টি সূত্র এই প্রবন্ধে আলোচনা করেছি, সেগুলির আস্ফালন সম্ভবত কবিতার গায়ে দুর্বোধ্যতার তকমা এঁটে দেয়।

আমার নিজস্ব ধারণা - সৎ এবং পরিণত কবিতার মধ্যে সারল্য অনিবার্য। “সহজ কথা যায় না বলা সহজে।” তার জন্য অনেক পথ পরিক্রমা করতে হয়। দুর্বোধ্যতা পথ আগলে দাঁড়ায় গলি ঘুঁজি পার হয়ে রাস্তা খোঁজার সময়। একবার পাকা সড়ক পেয়ে গেলে সোজা সরল যাত্রা। অনেকের সারা জীবন লেগে যায় পৌঁছোতে। অনেকে চট করে খুঁজে পেয়ে যান। তাই “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”। বাকিরা শ্রমজীবী। তাঁদের পরিশ্রমের ফল নেন পরবর্তী প্রজন্ম। সে গল্প অন্য।



(পরবাস-৬৪, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)