ISSN 1563-8685




গলি দিয়ে ডিগলিপুর


রোস ও স্মিথ আইল্যান্ড

ময়টা ২০১৫র এপ্রিল মাস। আন্দামানে গেছি বেড়াতে। প্রথমবার। আমার কাছে তখন আন্দামান মানে পোর্ট ব্লেয়ার, হ্যাভলক, নীল, বারাটাং — সঙ্গে সেলুলার জেল, রস আইল্যান্ড ইত্যাদি। সেই জানা সীমানার মধ্যে সে এক বিকেলে আমি তখন হ্যাভলকের ব্লু বার্ড রিসর্টে। এখানে ব্যবস্থাপনা এতটাই ভালো যে আপনি “জ” বলতে বলতেই জল নিয়ে কেউ একজন আপনার সামনে দাঁড়িয়ে যাবে। তো, এরকমই একজন জল দিতে এসেছিল সে বিকেলে। আমার বেশ ভালো লাগে হোটেলের স্টাফ মেম্বারদের সঙ্গে গল্প করতে। সেই ভালোলাগা থেকেই জল দিতে আসা ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাড়ি কোথায়? উত্তর পেলাম, নর্থ আন্দামান। আমি নিজের ভূগোলের “জ্ঞান” নিয়ে একটুও লজ্জা না পেয়ে বললাম, আমি এ মুহূর্তে ঠিক কোথায় বসে আছি?

— সাউথ আন্দামান। ছেলেটির সংক্ষিপ্ত জবাব।

— তাহলে উত্তর আন্দামান ব্যাপারটা কী? সেটা কোথায়?

— সেখানে যেতে হলে আপনাকে প্রথমে পোর্ট ব্লেয়ার যেতে হবে। সেখান থেকে পথে পড়বে রঙ্গত, মায়াবন্দর আর একদম শেষে ডিগলিপুর। আমার বাড়ি স্মিথ আইল্যান্ডে। রস অ্যান্ড স্মিথ আইল্যান্ডের নাম শুনেছেন তো? ভাঁটার সময় দুটো দ্বীপের মাঝখান দিয়ে বালির রাস্তা আবার জোয়ার এলে দুটো দ্বীপ আলাদা হয়ে যায়। অন্য ভাবেও যাওয়া যায়। এই হ্যাভলক থেকে জাহাজে করে রঙ্গত, পথে পড়বে লং আইল্যান্ড —তারপর সেখান থেকে বাসে বা জীপে ডিগলিপুর।

— আরে রস আইল্যান্ড তো পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ঘুরে এলাম আমি। বেমক্কা বিলকুল বোকার মতো একটা কথা বলে ফেললাম আমি।

— না, না, ওটা আলাদা। আমি থাকি স্মিথ আইল্যান্ডে। অনেক দূর এখান থেকে। সে ছেলে ঠোঁটে একটা হালকা হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলে।

আন্দামানের ভূগোল সম্বন্ধে আমার জ্ঞান নিয়ে আমি ততক্ষণে নিশ্চিত হয়ে গেছি। ফলে একটুও লজ্জা না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এখান থেকে তোমার বাড়ি যাও কী করে? “প্রথমে এখান থেকে জাহাজে পোর্ট ব্লেয়ার যাই, রাতে পোর্ট ব্লেয়ারেই থাকি। পরদিন ভোরবেলা বাস — সন্ধ্যা নাগাদ ডিগলিপুর। সে রাতটা ডিগলিপুরের লজে কাটিয়ে পরদিন ভোরবেলা নৌকা ধরে বাড়ি।" একটানা বলে থামল সে ছেলে। বললাম, তুমি যখন পাড়ার ঘাটে পৌঁছাও — লোকজন কি মালা-টালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে...?

— কী যে বলেন স্যার। দৃশ্যত ও লজ্জা পেয়ে যায়।

— আরে তোমার নামটাই তো জানা হয়নি। কী নাম তোমার?

— প্রহ্লাদ।

— প্রহ্লাদ তুমি এখানকার আর কোন দ্বীপে গেছ।

— আমার দিদির বিয়ে হয়েছে “লিটিল” আন্দামানে। আমি ওখানে গেছি স্যার।

রঙ্গত, মায়াবন্দর, লিটিল আন্দামান, লং আইল্যান্ড — ও ছেলের মুখে যত শুনছিলাম — টের পাচ্ছিলাম আমার ভিতরে ভিতরে কি এক পরিবর্তন হাঁটা-চলা শুরু করেছে। আরও দু-চার কথার পর বুঝলাম প্রহ্লাদ, আন্দামানের বাইরে যেটাকে ওরা বলে “মেন ল্যান্ড”, সেখানে কখনই যায়নি। বলব না-বলব না করেও ওকে বলেই ফেললাম, তার মানে তুমি ট্রেনে চড়া দূরে থাক — ট্রেনই দেখোনি কখনও — তাই তো? “হ্যাঁ স্যার, দেখিনি। ক্লাস থ্রি-ফোরে ওঠার পর প্রথম জেনেছিলাম পোর্ট ব্লেয়ারের কথা, তারপর কলকাতা।” প্রহ্লাদের উত্তর।


টারটেল ওয়াচ হাট
আমাকে রস অ্যান্ড স্মিথ আইল্যান্ডে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রহ্লাদ বিদায় নিল। কিছুক্ষণ পরেই রিসর্টের জেনারেল ম্যানেজার দেবাশিসের সঙ্গে দেখা। ওঁকে প্রহ্লাদের কথা বলা শুরু করতেই — দেবাশিস বলল, স্যার আমিও ডিগলিপুরেই থাকি। দেবাশিস, ততক্ষণে জেনে ফেলেছি — বিবাহিত। বললাম, তোমার বউ ডিগলিপুরে, তুমি এখানে...।

— না স্যার, বউকে এখানে এনেই রেখেছি। দেবাশিস হেসে বলল।

— ভালোই করেছে...নইলে...

দেবাশিস আর প্রহ্লাদ আমার মনের গভীরে রঙ্গত, মায়াবন্দর আর কিছু কাল্পনিক ছবি ঢুকিয়ে দিয়ে বিদায় নেবার পর থেকেই আমি ঠিক করেছিলাম — ডিগলিপুর যেতেই হবে।


২০১৬র মার্চ মাস। পোর্ট ব্লেয়ার এয়ারপোর্ট থেকে প্রি-পেড ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে যাবার পথে ট্যাক্সিওয়ালা জানালো ডিগলিপুর, তিন রাত — নন এসি — হাজার নয়েক টাকা আর এসি হলে পনের হাজার মতো লাগবে। অমন ভারী টাকা-পয়সার কথা শুনে মনে হল গত ত্রিশ বছর তো “গাড়ি” করে অনেক ঘোরা হল--একবার জানালার শিক টিপ করে কাগজের টুকরো ছুঁড়ে দেখাই যাক না সে টুকরোটা ঠিকঠাক বাইরে গিয়ে পড়ে কিনা।

হোটেলে পৌঁছেই আমার “উনি”কে বললাম, চলো, বাস স্ট্যান্ড যেতে হবে। কুড়ি টাকা অটো ভাড়া দিয়ে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দুটো টিকিট কাটলাম ডিগলিপুরের। সরকারী বাস। দুজনের টিকিটের দাম সাকুল্যে পাঁচশ দশ। এসি বাস ছিল — টিকিট জনপ্রতি ৫০০ টাকা। কিন্তু সে বাস বেসরকারী বলে উৎসাহ দেখাইনি। পরের দিন সকাল সোয়া সাতটা নাগাদ বাস ছাড়ল। ঝড়ের গতিতে এসে বাস প্রথম থামল এসে ঝিরকাটাঙে। তখন সময় সকাল আটটা কুড়ি। ড্রাইভার সাহেব জানালেন বাস ছাড়বে ঠিক ন’টায়। এরপর জারোয়াদের এলাকা। দেখলাম সার দিয়ে প্রচুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সে সমস্ত গাড়ির দঙ্গলকে অতিক্রম করে আমাদের বাস একদম সামনে। হুঁ, হুঁ, বাবা, সরকারী এক্সপ্রেস বাস বলে কথা। আমরাও হৈ হৈ করে নেমে চা, সিঙাড়া, কচুরি ইত্যাদির সদ্‌গতিতে মন দিলাম।

এখান থেকে দিনে চারবার গাড়ির কনভয় ছাড়া হয়। সময় ৬টা, ৯টা, ১২টা এবং ৩টে। উল্টোদিক, মানে বারাটাঙের দিক থেকে গাড়ি ছাড়বে ৬-৩০, ৯-৩০, ১২-৩০ এবং ৩টের সময়। খুব স্পষ্ট করে এখানকার নিয়মে বলে দেওয়া আছে ১) কোনও গাড়ি ঘন্টায় ৪০ কিমির উপর স্পীড তুলতে পারবে না, ২) ওভারটেক করা চলবে না, ৩) জারোয়াদের ছবি তোলা যাবে না, ৪) জারোয়াদের খাবার দেওয়া যাবে না... ইত্যাদি। ঠিক ন’টার সময় বাস ছাড়ার আগেই একজন খাকি পোশাক আমাদের বাসে ড্রাইভারের পাশে এসে বসে পড়লেন। খেয়াল করলাম সামনে আরেকজন খাকি পোশাক পিঠে বন্দুক মোটর সাইকেলে চলেছেন। পথে একবারই এক দল জারোয়াদের দেখা পেয়েছিলাম। ওরা রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওদের দেখে সামনের মোটর সাইকেল দাঁড়িয়ে পড়েছিল — পিছনে আমরা বাকি সব। মিনিটখানেকের মধ্যে ওরা উধাও, আমরা বারাটাঙ-মুখী। ফেরার সময় অবশ্য আরও স্পষ্ট দেখেছিলাম জনা কয়েক জারোয়াকে, দেখেছিলাম কিছু হরিণের ছোটাছুটি।

বাসের ভিতরে বেশিরভাগই লক্ষ করেছিলাম বাঙালি। আসলে ডিগলিপুরের ৯৫ শতাংশ লোকজনই বাঙালি, আরও পরিষ্কার করে বললে বাঙাল এবং তাঁদের ৯৫ শতাংশের আবার আদি বাড়ি বরিশালে। আমাদের পাশে বসা একটা অল্পবয়েসী মেয়ে একা একাই বাড়ি ফিরছিল। ওর সঙ্গে কথা বলে জানলাম, ও তামিল কিন্তু বাংলাই বেশি বলতে হয়। খেয়াল করলাম মেয়েটা একবার ফোনে কাউকে গান শোনাচ্ছে। সুন্দর মিষ্টি গলা।

সে যাক, প্রথমে বারাটাঙ পৌঁছেও দেখলাম সরকারী এক্সপ্রেস বাসকে সবার আগে জায়গা করে দেওয়া হল বোটে করে ওপারে যাবার জন্য। ওখান থেকে কিছুটা যাবার পর এবার কদমতলা। এখানেও বোটে প্রথমে তুলে দেওয়া হল আমাদের সরকারী বাস। বাসের ভিতরে মালপত্র রেখে আমরাও ওই বাসের সঙ্গেই বিন্দাস খুব তাড়াতাড়ি কদমতলাও পার হয়ে গেলাম।

পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ডিগলিপুর — প্রায় ৩২৫ কিমি এই রাস্তার পোশাকী নাম আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড, সংক্ষেপে এটিআর। সমস্ত নিয়ম-কানুন মেনে ডিগলিপুর পৌঁছতে প্রায় দশ ঘন্টা সময় লাগে। হ্যাঁ, সরকারী বাসে এই সময়টাই লাগে, প্রাইভেট গাড়িগুলোতে সময় আরও বেশি লাগে।

বেলা দুটো নাগাদ রঙ্গত সরকারী বাস স্ট্যান্ডে আমাদের নামানো হল দুপুরের খাবারের জন্য। খাওয়া বলতে “প্রায়” তামিল প্লেট। প্লেট প্রতি ৮০টাকা দিয়ে খেতে বসে লক্ষ করলাম ডিমের ঝোল আর ভাত আমি চিনতে পারছি — বাকি কিছু চিনি না। ফলে ডিমের ঝোল দিয়ে পুরো ভাত মেখে “তুফান মেল” চালিয়ে দিলাম। খাওয়া যখন প্রায় শেষ, একটা ছেলে ডাল, ভাত, চাটনি আর সিমুই নিয়ে হাজির। মানে ওই ৮০টাকায় পেট চুক্তি, পেট ভরে খাওয়া। ফের নিলাম ডাল, ভাত, চাটনি আর সিমুই এবং বলতেই হবে যথেষ্ট ভালো ছিল সে খাবার। আগে ডিমের ঝোল-ভাত (বা মাছ-মাংস), পরে ডাল — শুনেছি এটা চট্টগ্রামের স্টাইল। ওই হোটেলের তামিল মালিক কি তা জানে...। খাওয়া শেষ করে বাসে ওঠার আগে একটা কোল্ড ড্রিংকসের বোতল নিয়ে নিলাম। এবং কিছুক্ষণ পরে মনে হল “ওটা” নেওয়ার কোনও দরকার ছিল না কারণ কিছুক্ষণ পরেই বাস দাঁড়ালো মোহনপুরে। এখন বাস আর মায়াবন্দর হয়ে যায় না। মোহনপুরের রাস্তা ধরে আরও তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায় ডিগলিপুর — তাই এ রাস্তা। মোহনপুরে ডাব খেলাম। আহা, ডাব তো নয় যেন মোহনভোগ।


ডিগলিপুর
পাঁচটা বাজার মিনিট পাঁচেক আগেই আমরা ডিগলিপুরে পৌঁছে গেলাম। বাস থেকে নেমে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। অপূর্ব জায়গা। সদ্য পরিচিত এক বাস যাত্রী, সঙ্গে তাঁর মেয়ে বলল, আমাদের গ্রামে আসবেন। আমাদের গ্রামের নাম আর কে গ্রাম, মানে রামকৃষ্ণ গ্রাম। পৌঁছনোমাত্রই এমন আতিথেয়তায় মুগ্ধ আমি বললাম, নিশ্চয়ই যাব। যাওয়া হয়নি। হাতে সময় ছিল না। তবে ভুলিনি তাঁদের। ফের কখনও গেলে...

ডিগলিপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে অটো নিয়ে গেলাম তিতলি লজে। খুব সাধারণ একটা লজ। দোতলার ব্যালকনিওয়ালা একটা ঘর নিলাম তিন রাতের জন্য। ডিগলিপুরের লোকজন কেমন ফের তা টের পেলাম যখন লজ কর্তৃপক্ষ এক পয়সাও অ্যাডভান্স হিসেবে নিলেন না। পরে দেখেছি, এখানে লোকজন ঘরে তালা দেয় না, রাতের বেলা মেয়েরা নিশ্চিন্তে বাইরে বেরতে পারে। এখানে পুলিশের হাতে বন্দুক নেই। যদি কোনও পুলিশের হাতে বন্দুক দেখা যায় — সেটা দেখার জন্য মোটামুটি ভিড় জমে যায়।

ডিগলিপুর থেকে কিছুটা দূরে কালীপুরে দুটো ভালো রিসর্ট আছে। একটা সরকারী, নাম, টার্টল বীচ রিসর্ট। অন্যটা প্রাইভেট, নাম প্রিস্টিন বীচ রিসর্ট। কিন্তু ওখানে আশে-পাশে দোকান-পাট কিছুই নেই। সন্ধ্যা নামলে মোটামুটি গৃহবন্দী। সে জন্যেই খুব ভেবেচিন্তে ডিগলিপুর টাউনেই থাকব স্থির করেছিলাম।

তিতলি লজে মালপত্র রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে সরকারী কাউন্টারে গিয়ে তিন দিন পরের বাস-টিকিট বুক করে নিলাম। ভাড়া এবারে কুড়ি টাকা বেশি, মোট পাঁচশ ত্রিশ, কারণ বাসটা ছাড়ে সেই এরিয়াল বে থেকে।

পরদিন সকালে স্থানীয় গাড়ি (টাটা সুমো) ধরে রওয়ানা দিলাম এরিয়েল বে-র পথে। ভাড়া জনপ্রতি কুড়ি টাকা। মিনিট দশেকের পথ। এরিয়েল বে-তে এখানকার বন দপ্তরের একটা অফিস আছে। এই অফিস পরিচয় পত্র দেখে নিয়ে রস অ্যান্ড স্মিথ আইল্যান্ডে যাবার অনুমতি দেয়। স্পীড বোটের ভাড়া জনপ্রতি ৫০০ টাকা। মোট ২৫০০ টাকা দিয়ে পাঁচ জন যাওয়া যায়। আমরা আরও তিনজন আসার অপেক্ষা করব বলে ঠিক করলাম। এবং মিনিট দশেক পর অন্তত ত্রিশ জন এসে হাজির হল টেম্পো ট্রাভেলার আর গাড়ি করে। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা স্পীড বোটে।

রস অ্যান্ড স্মিথ আইল্যান্ডে কোনও দোকান নেই। ওখানে যাওয়ার আগে তাই খাবার জল আর প্রয়োজনে খাবার নিয়ে গেলে ভালো হয়। ওখানে ঘন্টা তিনেক অপেক্ষা করে স্পীড বোটগুলো। আমরা দু বোতল জল কিনে নিলাম এবং নৌকায় ওঠার আগে এখানকার খাকি পোশাক সেই বোতল খুলে পরীক্ষা করে নিদান দিল যে ইহা মদ নয় — বিশুদ্ধ জল। হ্যাঁ, ওই দ্বীপে মদ খাওয়া বারণ।


স্মিথ আইল্যান্ড
পনের মিনিট পর আমরা পৌঁছে গেলাম রস অ্যান্ড স্মিথ আইল্যান্ডে। আরও পরিষ্কার করে বললে, আমরা পৌঁছে গেলাম স্মিথ আইল্যান্ডে। তখন ভাঁটার টান, তখন দুটো দ্বীপের মাঝখানে বালির রাস্তা, তখন দুটো দ্বীপ মিলেমিশে একাকার। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেলাম এমন প্রকৃতির। এখানে সাধারণের জন্য বসার জায়গা, পোশাক বদলানোর জায়গা, সমুদ্র স্নানের পর সাধারণ স্নানের জায়গা — সব, সব আছে খুব গুছিয়ে। জনগণ এখানে পৌঁছেই ঝাঁপ মারা শুরু করে সমুদ্রে। মনে আছে, আমাদের দুই বিদেশী সহযাত্রী সভয়ে বলেছিল, হোপ, দেয়ার ইজ নো ফিয়ার অফ ক্রোকোডাইল হিয়ার। ওঁদের বলেছিলাম, না, কুমীরের ভয় নেই। কিন্তু বালির রাস্তা ধরে রস আইল্যান্ডে গেলে এদেশের জনগণের জন্য পঞ্চাশ টাকা ফাইন আর বিদেশীদের জন্য সেটা পাঁচশ টাকা — যদিও ওদিকে জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই দেখার নেই।

ওঁরা জলে নেমেছিল, আমরা নামিনি। প্রচুর বাঙালির পর্যটকের দেখা পেয়েছিলাম এখানে এবং ওঁরা প্রায় সকলেই সমুদ্রে ঝাঁপ মেরেছিল নীলে মিশে যাবার জন্য। আমি বসেছিলাম। আমার “উনি”, হাতে ক্যামেরা — উফ্‌ কত যে ছবি, কত যে উচ্ছাস, কত যে মেমোরি কার্ডের দীর্ঘশ্বাস...

ঘন্টা তিনেক পর ফের এরিয়াল বে। এবারে বাসে ফিরলাম। ভাড়া জনপ্রতি ১৪ টাকা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডিগলিপুর বাজার। এখানে প্রপার বাঙালি খাবারের একটা ব্যাপক হোটেল আছে। পেট ভরে ভাত, ডাল, তরকারি, ভাজা, পার্শে (মিষ্টি জলের), চাটনি — সব খেয়ে দাম দিতে হল জনপ্রতি ১৫০ টাকা।

পরের দিন ডিগলিপুর বাজার থেকে বাস ধরলাম। আমাদের গন্তব্য কালীপুর সী বীচ। বাসে মিনিট পাঁচেক কাটানোর পর দেখি একজন মাছওয়ালী ঝাঁকা ভর্তি মাছ নিয়ে বাসে উঠছে। এবং কী আশ্চর্য, অন্তত পাঁচজন ওই চলন্ত বাসেই — কেউ পাঁচশ গ্রাম, কেউ আটশ গ্রাম মাছ কিনে নিলেন। অবাক হয়ে দেখলাম এখানকার লোকজনের ধৈর্য। কেউ কিচ্ছুটি না বলে হাসিমুখে সেই বেচা-কেনার সাক্ষী থেকে গেল। কালীপুর সী বীচে সীজনে মা কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে দলে দলে। সে জন্য এর অন্য নাম টার্টল বীচ। বাস থেকে নেমে বীচের দিকে যাওয়ার পথে এখানে একটা “ভ্যান রিক্সা দোকান” আছে। এখানে চা পাওয়া যায় না কিন্তু কোল্ড ড্রিংকস, মিনারেল ওয়াটার, বিস্কুট পাওয়া যায়। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক সে দোকানের মালিক। কথায় কথায় উনি জিজ্ঞেস করলেন, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের পে কমিটির ব্যাপারটা কবে মিটবে বলুন তো? প্রশ্ন শুনে চমকে যেতে যেতে মনে পড়ল, আন্দামানে সরকারী চাকরি মানে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি। উনি অবসর গ্রহণ করেছেন সরকারী চাকরি থেকে —এখন দেখার ক’ পয়সা বাড়ে পেনশন নতুন পে কমিশনের দৌলতে। উত্তর আমার জানা ছিল না, ফলে কিছুই বলতে পারিনি। এই কালীপুর বীচে একটা “টার্টল ওয়াচ হাট” আছে — যেখানে দেখা হল জনা তিনেক বাঙালির সঙ্গে। ওঁরা লিটিল আন্দামান ঘুরে আপাতত ডিগলিপুরে।

কালীপুর থেকে ডিগলিপুর ফেরা সেই বাসে। এবং ফেরার পথেও দেখা সেই মাছওয়ালীর সঙ্গে — শূন্য ঝাঁকা, মাছ শেষ, হাসিমুখ।

ঠিক পরের দিন ভোরবেলা আমরা ফের বাসে। ডিগলিপুর থেকে পোর্ট ব্লেয়ার। ফেরার গল্প না হয় অন্য কোনও দিন।



(পরবাস-৬৫, ডিসেম্বর ২০১৬)