Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে সুনন্দন চক্রবর্তীর
লেখা



ISSN 1563-8685




বাইক আর বিপত্তি


নাথাং থেকে কুপুপ যাওয়ার পথে

দোষের মধ্যে আমরা একবার বাইক নিয়ে লাদাখ গেছিলাম। আর পাঁচটা লোক যেমন যায়। কিন্তু বাঙালিরা অত সহজে ছাড়বে কেন। তারা খালি বলে এই বৃষ্টির সময় যাচ্ছ? আমরাও কম যাই না। ক্লাস সেভেন অবধি ভূগোলে ছিলাম যাকে বলে হেভি স্ট্রং। মুচকি হেসে বলতাম বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল বোঝো? লাদাখ হল তাই। ওখানে বৃষ্টি হলে ইতিহাস হয়ে যাবে। হোলও তাই। আমরাও খারদুং লা পার হলাম আর আকাশ ভেঙে পড়ল। বাংলায় যাকে বলে ক্লাউডবার্স্ট।

সেই ইস্তক আমরা বাইক নিয়ে বেরোলেই সবাই আমাদের পানে আড় নয়নে চায় আর ঠোঁট চাটে। জানে এদের অঘটন কিছু ঘটবেই। গ্যাংটকে জনা তিরিশেক মদ্দা মাদী জড়ো হয়ে দিন দু চার গুষ্টিসুখ করার কথা। আমি রাণা আর চির — চিরঞ্জীব — ঠিক করলাম অন্যদের সঙ্গে ট্রেনে না গিয়ে বাইক নিয়ে একটু ইধার-উধার ঘুরে আমরা গ্যাংটক যাবো। ব্যাস, শুভার্থীদের মধ্যে অর্থপূর্ণ চোখাচোখি হয়ে গেল। কুণ্ডু স্পেশালে যারা উপমহাদেশখানি চষে ফেলেছেন তাঁদের থেকে নানা মূল্যবান সদুপদেশও পেলাম — আরনিকা টু হান্ড্রেডটা ভুলিস না কিন্তু। বাঁদুরে টুপিটা গজকুমার থেকে কিনিস। ওদের মাইনাস টেন থেকে মাইনাস ফরটি পর্যন্ত আলাদা আলাদা প্যাক। হাবুল যখন শিকাগো গেল ওখান থেকেই তো সব কেনা হোল।

তো বেরোবার আগের রাতে আমি ছিলাম শান্তিনিকেতনে আমার এক বন্ধুর বাড়ি আর রাণা আর চির ছিল বনগ্রামের সুখাশ্রমে। কথা ছিল আমরা মোরগ্রাম-এর কাছাকাছি কোথাও দেখা করব। ওদের রাস্তাটা কম আর চির চালায়ও আমার থেকে জোরে। তাই আলো ফোটে কি না ফোটে বেরিয়ে পড়লাম। শান্তিনিকেতন থেকে আলমবাজার যাওয়ার পথে একটা চমৎকার বন পেরোতে হয়। নিঝুম সেই বনকে বাইকের আওয়াজে চমকে দিতে লজ্জাই করছিল কিন্তু উপায় নেই। আলমবাজার থেকে মোরগ্রামের দিকে মোড় নিয়ে দেখলাম দু পাশে সবুজ চিরে চলে গেছে কালো রাস্তা। কিন্তু মিনিট কুড়ি যাওয়ার পরেই দেখা গেল সে রাস্তা গেছে ভেঙে চুরে। একটা খন্দ ওয়ালা জায়গা পেরিয়ে যেই মনে হয়, যাক, ওমনি আবার সে এবড়ো-খেবড়ো হয়ে যায়। এই যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে একটা ধাবায় চা খেতে থামলাম। আমাদের হাইওয়ে গুলোর দুপাশে যত খাবার দোকান আমরা তাদের ধাবাই বলি, নাই বা থাকলো তাদের পাঞ্জাবি ঘরানা। কে না জানে এই ধাবাগুলো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া বাবু-বিবিদের আর ট্রাক-ড্রাইভার আর ট্রাক এর খালাসিদের মিলনতীর্থ। আজকাল আমার মত কিম্ভুত কিছু লোকও বাইক ফটফটিয়ে হাজির হয়। এসব আদিখ্যেতা ধাবার লোকেদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। তারা বেশ নির্বিকার ভাবেই আপ্যায়ন করল। কানের কাছে গলা নামিয়ে কোন তান্ত্রিকের কাছে ঝাড়ফুঁক করান উচিৎ সে পরামর্শ দিল না।

মোরগ্রাম-এ পৌঁছোবার পর প্রত্যেকটা বাঁ দিকের দোকানে নজর দিতে দিতে চললাম। দ্বিতীয় দোকানটায় বসবার কথা রাণাদের। কিন্তু কোথাও তাদের নাম-নিশান নেই। আর এদিকে রাস্তা চওড়া করার কাজ চলছে। দুপাশের অনেক জায়গা ফাঁকা করে ফেলা হয়েছে। সুতরাং বোঝাও যাচ্ছে না যে দোকানটার কথা হয়েছিল সেটার আর অস্তিত্ব আছে কিনা। শেষমেশ একটা বড় দোকানে থানা গাড়লাম। এটার সামনে অনেক দূর পর্যন্ত রাস্তা দেখা যাচ্ছে। চোখে যদি রুমাল বেঁধে না বেরিয়ে থাকে তাহলে দেখতে পাবেই। ফোন করে বোঝা গেল চির যথারীতি দেরি করে উঠেছে, ফলে ওরা একটু পিছনে রয়ে গেছে। রুটি ভাজি ওমলেট খেতে খেতে ওরা এসে পড়ল।

একটা দার্শনিক জিজ্ঞাসা হচ্ছে আমরা কী ভালবাসি — নতুন না পুরনো? সব প্যাঁচোয়া প্রশ্নের মতই এটারও কোন সরল উত্তর নেই। কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি এই প্রায় সাতশো কিলোমিটার রাস্তা যাওয়ার কতগুলো রিচুয়াল আছে। বনগ্রাম-এ রসগোল্লা, পুরশুন্ডায় মাংসভাত, মালদহে ময়ূখের সঙ্গে আড্ডা, তারপর বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাও রায়গঞ্জের সরকারি পর্যটন আবাস। সেখানে বাপ্পা আসবে, গণেশ আসবে, রাত অবধি আড্ডা, জমিয়ে খাওয়াদাওয়া, আর সবাই সবাইকে বার বার মনে করিয়ে দেবে বেশী রাত করা যাবে না, কাল আবার ভোর ভোর বেরোতে হবে। মধ্যরাত অবধি বার বার শুনতে হবে এই সৎ পরামর্শ। সেই কাকভোরে হাজির হবে গণেশ। তারপর জোর করে টেনে নিয়ে যাবে স্টেট ট্র্যান্সপোর্ট গুমটির উল্টোদিকে সেই স্বর্গীয় সরটোস্ট খাওয়ার জন্যে। এই অবধি হুবহু মিলে গেল। তারপর-ই বাধল বিপত্তি। হাইওয়েতে পড়ার একটু পরেই রাণার চাকার হাওয়া বেরিয়ে গেল। সঙ্গের যন্ত্রপাতিতে কুলোল না। বাপ্পাকে ফোন করা হল যদি রায়গঞ্জ থেকে কোন মিস্ত্রি ধরে আনতে পারে। আর আমি সামনে এগোলাম দেখতে কোন টায়ার সারানোর দোকান পাওয়া যায় কিনা। পেলাম প্রায় পাঁচ ছ কিলোমিটার দূরে। আমিও সেখান থেকে একজনকে নিয়ে ফিরলাম আর বাপ্পাও একজনকে নিয়ে এসে পৌঁছল। বিশ্বকর্মা যৌথ কমিটি ঠিক করল চাকা খুলে দোকানে নিয়ে যাওয়াই তাড়াতাড়ি হবে। সুতরাং আবার চাকাসমেত সেই মিস্তিরিকে পিছনে বসে গেলাম সেই টায়ার সারার দোকানে। আবার ফিরলাম। ঘন্টা দুয়েক এই ধস্তাধস্তির পর আবার রওয়ানা হওয়া গেল।

সময় নষ্ট হছে বিস্তর, তাই থামা হল কম। তীরবেগে ডালখোলা পৌঁছে ফোর লেন ধরে উড়ে চলো। কিষেনগঞ্জে একটা খুচরো ঝামেলায় প্রায় ফেঁসে গেছিলাম। কী একটা কারণে সেখানে পথ অবরোধ। থেমে থাকা গাড়ি আর লোকজনের ভিড়ে খিচুড়ি পাকিয়ে আছে। কিন্তু কে না জানে ভারতীয় অবরোধকারীদের মত যুক্তিবাদী মানুষ খুব কম হয়। তারা পরিষ্কার বুঝতে পারল যে উড়নচণ্ডেরা সাত সকালে ধড়াচূড়া পরে বাইক হাঁকিয়ে বেরিয়ে পড়েছে তারা কিছুতেই খারাপ লোক হতে পারে না। প্রচণ্ড জঙ্গি একদল স্বেচ্ছাসেবক এটা ঠেলে, ওটা সরিয়ে, সেটা তুলে ধরে নানা ফাঁক ফোকর তৈরি করে দিয়ে সেই চক্রব্যূহ থেকে আমাদের বেরোবার পথ করে দিল। আমরাও ফের ছুট দিলাম শিলিগুড়ি লক্ষ্য করে। যতক্ষণ এই ফোর লেন রাস্তা আছে ততক্ষণ ক্যেয়ার করে কোন বুজদিল।

বাগডোগরার আগে একটা দোকানে চা-জলখাবার খেতেই মাথা সাফ হয়ে গেল। ঠিক হল কালিম্পং-এর ভিড় রাস্তায় না গিয়ে আমরা যাবো ডামডিম-এর রাস্তায়। অতএব সেই চমৎকার বনের রাস্তা ধরে এসে রেলগেট পার হয়ে কালিম্পং সিকিমের মূল রাস্তা ছেড়ে আমরা ডান দিকে মোড় নিলাম। ডামডিমের এই রাস্তা গেছে চা-বাগান আর জঙ্গল চিরে। ট্র্যাফিকও কম এই রাস্তায়। তদুপরি এখানে রাস্তার পাশে দুটি দোকানে ভারী ভালো মাংস রান্না করে। এক পেট খেয়ে ফুরফুরে মেজাজে গরুবাথান। এরপর মিনগ্লাস চা বাগানের গেট পেরিয়ে একটা নিরিবিলি বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তাটা উঠে যাবে। আসবে সেই অশ্বখুরাকৃতি ঝর্ণাটা। তারপর পথ হবে বেশ খাড়াই। ঝর্ণাটার পরেই আমাদের প্রিয় চায়ের দোকান। চা খেতে খেতেই আকাশ কালো করে এল আর বৃষ্টি নামল। এমন ঝপাস করে বৃষ্টি নামল যে ধড়াচূড়া চাপাবার আগেই খানিক ভিজে গেলাম। রওনা হতে গিয়েই বোঝা গেল কু-নজর লেগেছে। চির-র বাইক স্টার্ট নিচ্ছে না, নিলেও একটু গিয়েই মিইয়ে যাচ্ছে। গতি ধীর হয়ে যাচ্ছে যাক। আসল দুশ্চিন্তা হোল অন্ধকার জেঁকে নেমে আসছে। পাহাড়ের এনারা তো খেয়েদেয়ে আলো নিবিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে এখুনি। তখন রাতের আস্তানা খুঁজে বের করাই মুশকিল। তবে আমরা জানি চলতে থাকলে—তা সে যত ধীরেই হোক— পথ একসময় ফুরোবেই। বুঝতে পারলাম লাভার থেকে দু তিনটে বাঁক দূরে আছি। ঠিক হল আমি এবার এগিয়ে গিয়ে থাকার জায়গা ঠিক করব আর রাণা চিরর সঙ্গে সঙ্গে আস্তে আস্তে আসবে।

জায়গা পেলাম ইয়াঙ্কি হোটেলে। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে খানিকবাদে রাণারাও পৌঁছে গেল। বলাই বাহুল্য লাভায় ঐ বাইক সারাবার কোন লোক নেই। সবাই বলছে কালিম্পং থেকে লোক আনতে হবে। রাণা ফোনে কৃষ্ণনগরের যে বাইকের বিধান রায় তাঁকে রোগলক্ষণ বর্ণনা করল। জবাব এল কোন রকমে বৈদ্যুতিক ব্যাবস্থাটা ভিজে গিয়ে ঠিক মত কাজ করছে না। চির চান করল কিনা এখন ঠিক মনে করতে পারছি না, ফসফস করে বাইকের ওপরের খোলসটা ছাড়িয়ে ফেলল। মাঝে চা, এটা-সেটা আসছে আর লাভায় জেগে থাকা লোকেদের নব্বই ভাগ লোক ইয়াঙ্কি হোটেলের এক চিলতে উঠোনে মহোৎসাহে চিরর বাইক সারানো দেখছে। দিব্যি গেলে বলতে পারি দশাই ছাড়া অন্য কোন দিন লাভায় অত রাত্রি অবধি অত লোক জেগে থাকেনি কখনো। অবশেষে সারানো শেষ হল, আমরা খেয়েদেয়ে শুতে গেলাম। ভোরে উঠে দেখলাম চির বাইকের ঘোমটা খুলে আরেকপ্রস্থ নিভৃত আলাপ সেরে নিচ্ছে। গোটা লাভার মুখে হাসি ফুটিয়ে অতঃপর ইঞ্জিন জলদমন্ত্র স্বরে বেজে উঠল। ঠিক দুপুরবেলা আমরা ওপরে যাওয়ার রাস্তা ধরলাম টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। এখন এই রাস্তায় ভ্রমণার্থীদের ভিড় বেড়েছে। যত জিপ তাদের নিয়ে ওপরে যাচ্ছে তাদের ড্রাইভারেরা আমাদের বলতে থাকল জালুক পেরিয়ে বাইক নিয়ে যাওয়া এখন অসম্ভব। রাস্তায় বরফ পড়ছে। দেখা যাক বলে পৌঁছে গেলাম জালুক। এখানে সামরিক বাহিনীর বড় ঘাঁটি। এখানে রয়েছে অস্লি বাবা মন্দির। আর একটা মুফৎ চা খাওয়ার বন্দোবস্ত। দুই বিশাল ডেকচিতে সমানে চা বানাচ্ছে দুই জওয়ান আর কল লাগানো একটা ড্রামে ঢেলে দিচ্ছে। অনেকগুলো স্টিল-এর গ্লাস রাখা আছে। যতটা খুশি যতবার খুশি চা ঢেলে খাও, তারপর বেসিনের কলে ধুয়ে রেখে দাও। অপূর্ব ব্যবস্থা। আগেরবার যখন এ পথে এসে ছিলাম সেবারও খুব খাতির করেছিলেন ফৌজি ভাইয়েরা। গুঁড়ি গুঁড়ি বরফপাতের মধ্যে ওঁদের ছাউনিতে টেনে নিয়ে গিয়ে কফি-বিস্কুট খাইয়েছিলেন, পীড়াপিড়ি করেছিলেন দুপুরে খেয়ে যাবার জন্যে। জওয়ানদের ওপর আমাদের অগাধ ভরসা। চা খাওয়া হতে না হতে বরফ পড়তে না পড়তে একটা আর্মি ট্রাক এসে দাঁড়াল। তাদের জিজ্ঞেস করলাম আগে যাওয়া যাবে কিনা। আমরা আজ যেতে চাই নাথাং পর্যন্ত।

ওঁরা বললেন আরে কিঁউ নেহি ভাইয়া, এই তো আমাদের লরি গেছে একটু আগে। বরফ পড়ে আছে ঠিকই। লরির চাকার দাগ ধরে ধরে চলে যাও। এই শুনে আমরা আরো একবার চা খেয়ে আর বরফ পড়ে যাতে লরির চাকার দাগ মিলিয়ে না যায় চটপট ওপরের রাস্তা ধরলাম।

জালুক থেকে নাথাং যাওয়ার পথে চৌষট্টি বা চুয়াত্তর বা চুরাশি, মোট কথা অগুন্তি বাঁক পড়ে। বাঙালি তো চিনেছে কেবল বাতাসিয়া লুপ। চিন সীমান্তের লাগোয়া এই রাস্তা সামরিক বাহিনীর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে তারা একে সবসময় খুব দুরুস্ত রাখে। বাঁকগুলোর মাথায় পৌঁছনোর পর বরফের দেখা মিলল। দস্তানা ভেদ করে ঠাণ্ডা মালুম দিচ্ছে। দৃশ্যপট ইংরেজি সিনেমায় যেমন দেখেছি — সব সাদা। এমনকি কুয়াশাটাও যেন গুঁড়ি গুঁড়ি সাদা বরফ দিয়ে তৈরি। কেবল রাস্তার দু্পাশে দুটো কালো ফিতে — আমাদের ভরসা। খানিকটা চালানোর পর বোঝা গেল বরফের সব প্যাচগুলো বিশ্বাসঘাতক নয়। নরম, ঝুরো, সদ্য পড়া বরফে চাকা তেমন পিছলায় না। মহা ফুর্তিতে পৌঁছনো গেল নাথাং। আপাদমস্তক তার তখন বরফে মোড়া।


বরফে ঢাকা কর্মার হোটেল
কর্মার হোটেলও বরফে আবৃত। তার সামনের টানা বারান্দায় বাইকগুলোর জায়গা হয়ে গেল। অদ্ভুতভাবে এই সব ছোট ছোট নেপালি বা সিকিমি হোটেলগুলোর রসুইঘরের দায়িত্বে প্রায় সবসময়েই থাকে কোনো ঝলমলে হাসিখুশি তরুণী। আমার ধারণা পঁয়ত্রিশ হলেই তারা রিটায়ার করে যায় নয়তো কোনো বিদেশী পর্যটককে বিয়ে করে চলে যায়। যাই হোক, কর্মার মেয়ে আমাদের দেখভালের দায়িত্ব নিল। চির ফলত, বলাই বাহুল্য, প্রায় পুরো সময়টাই রান্নাঘরে থাকল। রাত্তিরে কোনক্রমে তাঁকে ঘরে আনা গেল।


বরফে মোড়া নাথাং যেন সুইজারল্যান্ড!!
সকাল হোল তাজা, মুচমুচে। বরফ ঢাকা নাথাং-কে মনে হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের কোন গ্রাম। অবিশ্যি স্কটল্যান্ডের বা পোল্যান্ডের কোন গ্রামও হতে পারে। এ-সব কোন জায়গাতেই আমি যাইনি। জলখাবার তৈরি হতে হতে আমরা বরফের গলিপথ ধরে গিয়ে যুদ্ধে মৃত ব্রিটিশ সৈনিকদের সমাধি ঘুরে এলাম। সাদা বরফের উঁচুনিচু মাঠের মধ্যে কতগুলো ক্রুশ কেবল জেগে আছে। ফিরে আসার পর কর্মা খবর দিল জালুক থেকে বেরিয়ে সামরিক কনভয় কুপুপের দিকে গেছে। অর্থাৎ কেল্লা ফতে। আমরা আবার তাদের চাকার দাগ ধরে এই বরফসঙ্কুল পথটা পেরিয়ে যেতে পারব।

তুষাররাজ্য ছেড়ে কুয়াশা ঢাকা কুপুপে নেমে এলাম। ছাউনিতে অনুমতিপত্র দেখাতে হল এখানে। পুরোনো রেশমপথের ওপর এই কুপুপ গ্রাম। বিশাল কুপুপ হ্রদের তীরে এই বসতিতে থাকেন মূলত তিব্বতি সম্প্রদায়ের লোকজন। কথিত আছে এই রেশমপথ ব্যবহারকারী একদল তিব্বতি ব্যবসায়ী নাকি চিন-ভারত যুদ্ধের সময় এখানে আটকা পড়ে যায়। তাদের আর ফিরে যাওয়া হয়নি। সেই থেকেই এই বসতি। গল্পটা এত সুন্দর যে আমরা আর এর ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই করতে চাইলাম না। জালুক থেকে কুপুপ আসার এই রাস্তা দিয়ে আসার সময় দিগন্ত জুড়ে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। এবার একবারের জন্যেও তাঁকে আমরা দেখতে পাইনি। কিন্তু তুষারাবৃত নিসর্গ সে দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে।


বরফে অল্প জমে যাওয়া বিশাল কুপুপ হ্রদ

কুপুপ থেকে বাবা মন্দির পেরিয়ে বরফ-ছিটোন রাস্তা তেমন বেগ দিল না। এবার ডান দিকে নাথু-লা যাওয়ার রাস্তা ছেড়ে নীচে নামা। মনে হল অবস্থা একটু জটিল। গ্যাংটক থেকে আসা পর্যটকদের গাড়িগুলোকে সেনারা এখানেই আটকে দিয়েছেন। পুরু হয়ে পড়ে আছে বরফ। আর গাড়িগুলো থেকে নেমে আসা বাচ্চা-বুড়ো মহোল্লাসে বরফ ছোঁড়াছুড়ি করছে। আমাদের চাকা হড়কাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, হ্যান্ডলবার নিয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছি, প্রাণপণে চাইছি শুকনো রাস্তায় পৌঁছতে। এইভাবে বরফ ঠেলে চলতে চলতে রাণার বাইকের স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। আমারটাও একটু হেঁচকি তুলছে। কোনোরকমে পিছলে, গড়িয়ে, হিঁচড়ে পৌঁছন গেল ছাঙ্গু। সে জায়গা ততক্ষণে ফাঁকা হতে শুরু করেছে। অচল বাইক ঘিরে আমোদ আহ্লাদ প্রচুর হল। কিন্তু আশার আলো কেউই দেখাতে পারল না। ওখানে নাকি কেউই থাকে না। দিনে সওদা করতে আসে তারপর নিচের বস্তিতে ফিরে যায়। সেখানে থাকার কোন জায়গা নেই। তবে সবার সুচিন্তিত মতামত আরেকটু নেমে গেলেই সেনাবাহিনীর ছাউনি। সেখানে আশ্রয় মিলবে নিশ্চয়। কিন্তু সেই অবধি যাব কি করে? সবাই বলল কেন, পুরো রাস্তাটাই তো গেছে নিচের দিকে। সুতরাং বাইক স্টার্ট না নিলেও কোন সমস্যা নেই। ব্যালান্স রেখে গড়িয়ে নিচে নেমে গেলেই হল।


কুপুপ থেকে ফেরার পথে
গড়াতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু ইঞ্জিন চালু না থাকা মানে বাইক হয়ে যাবে পরিভাষায় যাকে বলে ডেডওয়েট। তার ওপরে স্যাডল ব্যাগ-এর ভার। এই পিচ্ছিল সর্পিল রাস্তায় সামান্য ভুল হলেই পতন নিশ্চিত। কিন্তু উপায়ও নেই। তাই জীবনের সবচেয়ে বিপদসংকুল পিছলে পড়ার খেলা খেলতে খেলতে কিলোমিটার দুই পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম সেনাছাউনি।

বরফে সেটা প্রায় চাপা পড়ে আছে। কোথাও প্রাণের কোন চিহ্ন নেই। বিভিন্ন বন্ধ দরজা হাতড়ে শেষে পেলাম এক আগুন জ্বলা গুমটি। তাতে জনা চারেক জওয়ান আগুন পোহাচ্ছেন। তাঁরা একমত যে খাবারের কোন অভাব হবে না। কিন্তু ক্যাম্পের অধিনায়ক অফিসার আজই গ্যাংটক নেমেছেন। তাঁর অনুমতি ভিন্ন অসামরিক কাউকে ছাউনিতে রাখতে পারবেন না সুবেদার সাহেব। কিন্তু বাহাদুর লোকেদের তো আর বিপদে ছেড়ে দিতে পারে না সেনারা। তাই আমাদের অচল বাইক তাঁরা নিজেদের জিম্মা করে নিলেন। তারপর হাত পা ছুঁড়ে ছাঙ্গু থেকে গ্যাংটক ফিরে যাওয়া গাড়িগুলোর পাঁচ-ছটাকে তাঁরা থামিয়ে ফেললেন। মুম্বাই থেকে মধুচন্দ্রিমা করতে আসা দুই যুগল সানন্দে তাঁদের গাড়িতে তুলে নিলেন আমাকে আর রাণাকে। পৌঁছে দিলেন গ্যাংটক পর্যন্ত। তাঁদের বরফ দেখতে পাওয়ার উত্তেজনা আমাদের গ্যাংটক অবধি টইটুম্বুর করে রাখল। পরের দিন যে পিক আপ ভ্যান নিয়ে বাইক উদ্ধারে এলাম সে আরেক গপ্পো।



(পরবাস-৬৫, ডিসেম্বর ২০১৬)