আমাদের ভেতর অন্ধকার নেমে আসে, নিস্তরঙ্গ অন্ধকার, যে অন্ধকারের কোন সীমা পরিসীমা নেই। আমরা অনুভব করতে থাকি যে একদল কালো ঘোড়া কোথা থেকে যেন উঠে এসেছে আমাদের ঢালু জমিতে এবং তাদের শক্ত পায়ের দ্বারা নিরন্তর আঘাতের মাধ্যমে আমাদের ভেতরটাকে জর্জরিত করে যাচ্ছে কোথাও। তারা কোথায় যাচ্ছে কিংবা কোথা থেকে এসেছে তা আমাদের জানার কোন উপায় ছিল না, কারণ ঘোড়াদের মাতৃভাষা আমাদের জানা নেই। জানা থাকলে আমরা তাদের জিজ্ঞেস করতে পারতাম এবং তারা হয়ত বলত যে তারা আরবদেশ থেকে কিংবা আব্দুল মান্নান সৈয়দের নির্বাচিত কবিতার বই থেকে উঠে এসেছে। তখন তারা এও নিশ্চিত বলত যে তারা কোথায় যাচ্ছে, এবং হয়ত আরো কিছু বলে ফেলত তারা যা শুধু ঘোড়ারাই জানে, আর কেউ জানে না। ফলত আমরা হয়ত যে অন্ধকার আমাদের মধ্যে নেমে এসেছে তাতে কিছুটা স্বস্তি পেতাম। হয়ত আমরা অনুমান-নির্ভর কোন ব্যাখ্যায় পৌঁছাতে পারতাম। আর যেহেতু সত্য বলে কিছু নেই, সবই বিভিন্ন ধরনের অনুমান বা মতামত, তাই অনুমানে কারো কোন আপত্তি থাকার কথা নয়।
আমাদের হৃদয়ে, আমাদের নিতান্ত ঢালু জমিতে, আমাদের তথাকথিত হৃদয়পুরে কেন সন্ধ্যার আসমানের মত কালো হয়ে যায় সবকিছু তা আমাদের যে ভাবিত করে না, এমন নয়। আমরা ভাবিত হই, আমরা বিব্রত হই। আমরা দুর্বিনীত অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বিস্ময় এবং হতাশার সাথে অনুভব করতে থাকি এইসব অন্ধকার যেন আমাদের নিজেদেরই প্রতিচ্ছবি, আমাদের এমন মনে হয়। আমাদের মনে হতে থাকে মহাকাশ থোকা থোকা অন্ধকার ছুঁড়ে দিচ্ছে যেন আমাদের উপরে আর সেই নিকষ কালো আঁধার মমতা কিংবা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার প্রবল প্রয়োজনে আমাদের জড়িয়ে রয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে।
এই শহরে, এই ইঁট-কাঠের নগরে আমরা বসবাস করি এবং আমরা আকন্ঠ ডুবে থাকি গাঢ় কিছু অন্ধকারে। আপনি আমাদের দেখতে পাবেন আমরা হেঁটে যাচ্ছি, হাস্যোজ্জ্বল মুখ, শ্যাম্পু করা ঝলমলে চুল।আমাদের দেখে আপনার বা আপনাদের হয়ত মনে হবে না অন্ধকারের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক আছে, নিকটবর্তী কিংবা দূরবর্তী। সম্পর্ক যেকোন ধরনেরই হোক, এক ধরনের বোঝা তা কিআলাদা করে বলার প্রয়োজন আছে? আমরা মনে করি নেই। কারণ এই সত্য সর্বখানে প্রতিষ্ঠিত, প্রতিষ্ঠিত মহাবিশ্বের প্রতিটি অলিতে গলিতে এবং তস্যগলিতে। সম্পর্ক এমন এক জিনিস যা আবদ্ধ করে, শৃঙ্খলিত করে, যেন এক-একটা সম্পর্ক এক-এক ধরনের শার্টের পকেট, যা প্রাণীকে পুরে রাখে তার ভেতরে। সযতনে কিংবা অযতনে। নিতান্ত অবহেলায়।
আমরা আপনাকে বা আপনাদের বোঝাতে পারব না কী হচ্ছে আমাদের ভেতরে কিংবা আমাদের চারপাশ এবং অস্তিত্বঘেরা অন্ধকারের রহস্য কী। আমরা বোঝাতে পারব না কারণ এ সম্পর্কে অনুমান-নির্ভর কথা ছাড়া আমরা কিছু বলতে পারি না। অনুমান হল সত্য সম্পর্কে এক ধরনের ধারণা এবং সত্য বলে অবিনশ্বর ও অপরিবর্তনীয় কোন জিনিসের অস্তিত্ব নেই। এটা আমাদের কথা না শুধু। আমাদের কথা হলে যে কেউ উড়িয়ে দিতে পারতেন এবং সত্যের ঝাণ্ডা তুলে ধরে আমাদের নিবৃত্ত করতে পারতেন যেমন উগ্র আগুনকে নিবৃত্ত করে পানিওয়ালা মানুষেরা।
এই কথাটি বলেছিলেন আমাদের সবচেয়ে প্রাচীন গুরু। যিনি তাঁর ধ্যানে পেয়েছিলেন কিছু জিনিস, যা তাঁর মতে সত্যের কাছাকাছি। ওঃ ঈশ্বর! এসব কথা বাইরে প্রকাশ করার রীতি নেই। কিন্তু আমাদের ভেতরটাকে টুকরে খাচ্ছে অন্ধকারের বিষপোকা। যদিও বাইরে থেকে হয়ত বোঝা যাচ্ছে না তথাপি আমাদের ভেতর ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে, আমাদের অন্তর নিরন্তর অনুভব করছে এক ধরনের ভয়াবহ অস্বস্তি। তাই আমরা বলে ফেলছি যে, আমাদের সেই গুরু হঠাৎ একদিন তাঁর ধ্যানে পেয়েছিলেন মানুষের আত্মার কোটা শেষ হয়ে গেছে। এখন আত্মাহীন মানুষেরা জন্ম নিবে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাঁর কথা শুনেছিলেন এবং তাঁরা স্বভাবতই বিশ্বাস করেন নি। এমন উদ্ভট কথা কখনো কি হয় আর? তাঁরা একে হেসে উড়িয়ে দেন, অতঃপর তাঁরা রাগে ফেটে পড়েন এবং সেই মহান গুরুকে সবাই মিলে ধরে নিয়ে ফেলে দেন এক অন্ধকার কুয়ায়। আমাদের ধারণা তিনি সেই অন্ধকারে এখনো বসে আছেন, ধ্যানে আছেন।
আর তাঁর কথা, তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছে আমাদের এখানে। আজ আমাদের আত্মার জায়গাটাতে প্রবল শূন্যতা। আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি দিন রাতের পুরোটা সময় যেন এক অন্ধকারের ক্রান্তিবৃত্তে। কুশিকাঠি নিয়ে তাড়া করে আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সময়। আমাদের জীবনবেদ, আমাদের অন্তঃস্থ সব কোমল অনুভূতি হ্রাস পেতে পেতে নাই হয়ে গেছে এবং সে স্থলে আমরা প্রত্যক্ষ করছি ঘৃণা, হতাশা আর স্বার্থপরতার নবাঙ্কুর।
এইতো কিছুকাল আগে আমাদের এলাকার একজন লোক তার নীরব কুটিরে ঝুলে গেল ফ্যানের সাথে। আমরা তাকে দেখতে গেলাম তার বাড়িতে। গিয়ে দেখি সে একা ঝুলে আছে। শান্ত নিথর দেহ। তার ছেলে মেয়ে বউ কোথায় যেন চলে গেছে। তারা কি মৃতদেহ দেখে চলে গেল না তারা চলে যাবার শোকেই আমাদের এই লোকটি ঝুলে পড়েছিল, তা আর জানা হল না। এ এমন এক সময়। কিছুই যেন জানা হয় না।রহস্যের পর রহস্য আমাদের বুনো লতার মত জড়িয়ে রাখে।
আপনারা হয়ত জানেন না আমাদের সেই ইউনিভার্সিটি প্রফেসরের কথা। নামকরা লোক। কত ভারী ভারী কথা বলতেন। তাঁর কথা শুনতে শুনতে আমাদের মনে হত আমরা অনেক কিছু বুঝতে পারি। কঠিন নিয়ম মানা লোক। পড়া, ক্লাস ইত্যাদি ছাড়া আর কিছু যেন ভাবতেই পারতেন না। এমন জ্ঞানী লোক ছিলেন তিনি। কাজ ও পড়ার চাপে শেষ কবে আয়না দেখেছিলেন নিজেই ভুলে গিয়েছিলেন। তারপর সেদিন সকালে, যেদিন আমাদের এখানে টোটালিটারিয়ানিজম নিয়ে একটা কনফারেন্স ছিল; সেদিন তিনি হঠাৎ তাঁর বাড়িতে আয়নার সামনে দাড়ালেন। আয়না দেখেই তাঁর মাথা ঘুরে গেল। তিনি দেখলেন আয়নার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে অন্য লোক। ভিন্ন এক লোক। তিনি চোখ কচলে, মাথা ঝাঁকিয়ে আবার তাকালেন, গায়ে চিমটি কেটে দেখলেন স্বপ্ন দেখছেন কি না। কিন্তু ঘটনাটা ছিল বাস্তব। তিনি বদলে গেছেন অথবা নিজেকেই নিজে চিনতে পারছেন না। এমন কি হয়? এর কারণ কী? তিনি কি তাঁর দীর্ঘ দিনের পঠন পাঠন ও জ্ঞান চর্চার ফলে আপন মনে নিজের ভিন্ন এক চিত্র তৈয়ার করে নিয়েছেন? নাকিতাঁর স্মৃতিবিভ্রম হয়েছে, ভুলে গেছেন সব কিছু?
কোন প্রশ্নেরই উত্তর জানা গেল না। কারণ আয়না দেখেই উদ্ভ্রান্তের মত তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হারিয়ে গেলেন। তাঁকে আর পাওয়া যায় নি।
আমরা তাঁকে কত খুঁজলাম। আমরা বিভিন্ন ধরনের লাইট, হারিকেন, মোমবাতি নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত জলার কাছের ঝোপঝাড়ে, ট্যানারির বর্জ্য দ্বারা দূষিত নদীর পাড়ে, শহরের সব চিপাগলিতে, কোথায় না খুঁজেছি তাকে। কিন্তু পাওয়া গেল না।
আমাদের একজন লোক, শামসুদ্দিন আহমদতাঁর কপাল কুঁচকে বলেছিলেন, “গুম অই গেল নি, প্রফেছার!”
গুম হবার গুজবে আমরা যে একেবারে বিশ্বাস করি নি এমন নয়। আমাদের অবস্থান এমনই এক সময়ে যে সব কিছু বিশ্বাস করতে হয় আবার অবিশ্বাসও করতে হয়। কোন কিছু ছেড়ে দেবার উপায় নেই। কেননা অন্ধকারে যেকোন কিছু সম্ভব।
তাই যখন আমরা শুনতে পেলাম আমাদের এইসব অন্ধকার, এইসব দুঃখভারাক্রান্ত দিনগুলোর পেছনে আছে ঈশ্বরের ক্রোধ সেদিন আমরা আশ্চর্য হই নি। সেকথা শুনে আমাদের কেউ কেউ তাদের বড় বড় দুই চোখ আসমানের দিকে এবং কেউ কেউ মাটির দিকে রেখে ধারণা করতে চেয়েছিলেন যেন ঈশ্বরের ক্রোধের তীব্রতা, যা অবশ্যই হাস্যকর। আমাদের আরো বলা হলো ঈশ্বরের এই ক্রোধের কারণ হলো আমাদেরই কিছু লোক, যারা দিন নেই রাত নেই, বসে থাকে ঘরে এবং ছবি আঁকে। আমরা তাদের চিনতাম। তারা বিভিন্ন ধরনের উদ্ভট ছবি এঁকে এঁকে ঝুলিয়ে রাখত এখানে সেখানে। তাদের ছবিগুলোর বর্ণনা করা সম্ভব নয় ভাষায়, ওসব বর্ণনা করার মতো ভাষা নেই কোথাও, এমনই অদ্ভুত, অদ্ভুত তাদের রঙের ব্যবহার। এই দলের লোকেরা খালি যে ছবিই আঁকত এমন নয়, একটা দীর্ঘ সময় এরা বিরতিহীনভাবে অনর্থক এক বিতর্ক এগিয়ে নিয়ে যেত। তারা নিজেদের মধ্যে তুমুল তর্কে লিপ্ত হত ঈশ্বরের প্রকৃতি নিয়ে। ঈশ্বর একজন ফবিস্ট এই নীতির পক্ষে এবং বিপক্ষে গিয়ে তাদের তর্কই ছিল আমাদের এখানে একমাত্র দীর্ঘ তর্ক। যখন কেউ তা প্রথম প্রথম শুনত তখন বেশ ভালোই লাগত। তাদের একদল বিভিন্ন ধরনের যুক্তি ও অযুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেই ফেলত ঈশ্বর একজন ফবিস্ট। পরে অন্যদল এসে তাদের যুক্তি ও কুযুক্তির মাধ্যমে বুঝিয়ে দিত প্রমাণ হয় নি, বড় নড়বড়ে। ফলে আবার প্রথম দল নয়া নয়া যুক্তি নিয়ে আসত। প্রথম প্রথম দেখলে মনে হতে থাকে এই বুঝি জিতে যায় একদল আর উন্মোচিত হয় ঈশ্বরের প্রকৃতি বিষয়ক এক নিগূঢ় সত্য। তখন উত্তেজনার বোধ হয় এবং রক্ত সঞ্চালিত হতে থাকে শিরা উপশিরা দিয়ে দ্রুত থেকে দ্রুততর বেগে। মাঝে মাঝে প্রথমদিকে রাতে ঘুম হবে না হয়ত, মনে হবে আগামীকালই হতে যাচ্ছে বিতর্কের শেষ। ঈশ্বরকে ফবিস্ট মনে করা দল যে মোক্ষম যুক্তির অবতারণা করেছে এবং যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাতে এবার আর অন্য দলের রক্ষে নেই। কিন্তু পরদিন বিতর্কেও কোন ফল হতো না। এক দলের মোক্ষম যুক্তির বিপরীতে অন্যদল মহামোক্ষম যুক্তি যেন ছুঁড়ে দিত। তখন উপস্থিত দর্শকমহলের মনে হতে থাকত ঈশ্বর বোধহয় ফবিস্ট নন এবং সন্দেহ হত কাল রাতে তিনি হয়ত সশরীরেই এসে এই নন-ফবিস্টের পক্ষের দলকে এই অসামান্য যুক্তি শিখিয়ে দিয়ে গেছেন।
এভাবেই চলে আসছিল দীর্ঘদিন। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই একজন দর্শক এই দীর্ঘ তর্কের অর্থহীনতা উপলব্ধি করতে পারত। সে তখন একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে বসত এই ফালতু বিতর্ক শুনে সে তার কত মূল্যবান সময় নষ্ট করেছে। সময়! সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু! সময়কে এভাবে নষ্ট করে ফেলার জন্য তার খারাপ লাগতে শুরু করত এবং সে এর জন্য মনমরা হয়ে ঘুরত কিছুদিন। এমন লোককে দেখলেই বয়স্করা বুঝতে পারতেন। তাঁরা নতুন উৎসাহী বিতর্ক শ্রোতা এবং নতুন মনমরা বিতর্ক শোনা ত্যাগকারী দুই দলকে দেখেই মুচকি হাসতেন আর নিজেদের সেইসব সময়ের কথা তাদের মনে পড়ত। তাঁরা তখন রাস্তার পাশের বিলবোর্ডে কিছুটা বাঁকা হয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে নিজেদের মন অন্যদিকে নেবার চেষ্টা করতেন। কেউ কেউ অবশ্য গুন গুন করে গান ধরতেন, যে গুণে বন্ধুরে পাবো সে গুণ আমার নাই গো...। গান মনকে অন্যদিকেনিয়ে যাবার এক মহাঔষধ এমন উল্লেখ আছে প্রাচীন পুস্তকে।
ঈশ্বরের ক্রোধের কারণ হিসেবে সেইসব চিত্রকরদের নাম উল্লেখিত হলে তাদের আবাসস্থলে যাওয়া হল আমাদের। তখনো আমাদের ভিতরে বাহিরে অন্ধকার। আমরা মোমবাতি নিয়ে, হ্যাজাক লাইট নিয়ে, ব্যাটারি চালিত লাইট হাতে নিয়ে গিয়েছিলাম চিত্রকরদের ওখানে। তাদের আবাসস্থলের সামনে যখন আমরা পৌঁছলাম তখন আমরা অবাক হয়ে গেলাম। কারণ ভেতর থেকে কোন ধরনের কথাবার্তার শব্দ আসছিল না। এমন হবার কথা না কখনোই। কারণ এরা বেশিরভাগ সময়ই বিতর্কে লিপ্ত থাকে এবং বাকি সময়ে ছবি আঁকে। ছবি আঁকার সময়েও তারা বিভিন্ন অদ্ভুত বিষয়াদি নিয়ে আলাপ করে। যেমন একবার একজন শুনেছিল ছবি আঁকার সময়ে এরা নিম্নরূপ আলাপ করছেঃ
— না, না, ব্যাঙের ট্যাঙ দিয়ে হবে না। ব্যাঙের ট্যাঙ আমাদের অন্তরে কয়েকটি গেলাসে করে ভরে রাখা হয় ক্লোরোফরমের ভেতরে। যাতে নষ্ট না হয়।
— সেটা ঠিক আছে। তবে আমি বলতে চাচ্ছি এর সাথে আমাদের সংলগ্নতা বিষয়ে। আমাদের অস্তিত্বের সাথে যেহেতু তারা যুক্ত অতএব আমরা নিজেরাই ব্যাঙ। অথবা আমাদের পূর্বপুরুষেরা ব্যাঙ ছিল।
— কিন্তু সেরকম কিছু তো আমরা পাই নি এখনো। আমরা কিছু আরশোলা, গুবরেপোকা আর তেলাপোকার অস্তিত্ব দেখেছি এখন পর্যন্ত।
— পাই নি বলে কি একেবারে ছেড়ে দিতে হবে? এটা কেমন কথা বললে হে?
এরকমই তারা কথা বলে যেত অনর্গল। কি নিয়ে কথা বলছে, এর অর্থ কি বুঝার উপায় নেই। কিন্তু তাদের বলার ভঙ্গি, গলার স্বর শুনলে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকত না যে বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন ভেতর থেকে কোনরূপ কথাবার্তার শব্দ শুনতে না পেয়ে আমরা তাই কিছুটা উদ্বিগ্নও হয়ে পড়লাম। আমরা আমাদের নিজস্ব হাতে ধরা আলো নিয়ে ধীরে ধীরে তাদের আবাসস্থলের ভেতরে প্রবেশ করলাম এবং চলে গেলাম তাদের বৃহৎ হলরুমে। যেখানে তারা ছবি আঁকত। গিয়ে আমাদের হাতে ধরা আলোতে দেখলাম আমাদের এই চিত্রকরেরা, আমাদের ক্লান্তিহীন বিতার্কিকেরা একেকটা ছবি সামনে রেখে পড়ে আছে নিস্তেজ।
তারা ছবি আঁকা শেষ করেছে এবং তারপর কোন কারণে এভাবে পড়ে আছে, এমন ধারণা হয়েছিল আমাদের প্রথমে। কিন্তু এগিয়ে গিয়ে বুঝতে পারলাম এদের সমস্ত মুখজুড়ে লেগে আছে শুকিয়ে যাওয়া রঙ। রঙ খেতে খেতে এরা সবাই নিজেদের ছবির সামনে মরে পড়ে আছে। কি ভয়ানক দৃশ্য!
আর আমরা দেখতে পেলাম কিছু কিছু ব্যাঙ হলরুমের ফ্লোরে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। কিছু কিছু উড়ন্ত চামচিকা তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে অদ্ভুত শব্দে। কয়েকটি টিকটিকি বেরিয়ে আসছে একেকজন শিল্পীর পকেট থেকে।
সমস্ত দৃশ্য দেখে আমাদের গা গুলিয়ে এলো। আমাদের সহ্য হলো না। আমাদের মনে হতে লাগল যে অন্ধকার আমাদের উপর নেমে এসেছে তার তীব্রতা আমরা যা ধারণা করেছিলাম তার চেয়ে অনেক তীব্র, অনেক গভীর।
(পরবাস-৬৫, ডিসেম্বর ২০১৬)