Autumn Annual (Vol. XLV 2016-2017): Celebrating 200 Years of Excellence.; প্রধান সম্পাদকঃ Nabaneeta Dev Sen; প্রকাশনালয়ঃ Presidency Alumni Association, Kolkata; প্রকাশঃ জানুয়ারি, ২০১৭; ISBN: নেই
দিল্লির জাকির হুসেন কলেজের নাম আমরা বিশেষ শুনি না। কলেজটির আদত প্রতিষ্ঠা ১৬৯২ খৃ., হ্যাঁ, আওরঙজেব বাদশা তখনও দিল্লির মসনদে! আজকের ভারতে একাদিক্রমে চলা প্রাচীনতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাই এই কলেজের নামটাই বলতে হবে (পূর্বনামঃ মাদ্রাসা গাজীউদ্দিন খান/ এংলো আরাবিক কলেজ/দিল্লি কলেজ)। আমরা বাঙালিরা, অবিশ্যি, হিন্দু কালেজের (প্র. ১৮১৭খৃ.) নামে নালেঝোলে হই।
বেশ।
উপরোক্ত তথ্যে অবশ্যই হিন্দু/প্রেসিডেন্সি কলেজের মাহাত্ম্য বা কৃতিত্ব বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় না। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাস আসলে প্রেসিডেন্সিরই ইতিহাস---বললে সামান্য অত্যুক্তি হয় (পড়ুনঃ এই সংখ্যায় শ্রী হিরন্ময় কার্লেকার মহাশয়ের Creating History: Presidency Alumni and the Transformation of India)। যদিও, আসলে এই কলেজ এলিটিজম ও উন্নাসিকতারই মাত্র জন্ম দিয়ে এসেছে---একটা স্কুল এই মত দিয়ে আসছে বহুকাল।
***
উপরোক্ত আলোচনার সঙ্গে বর্তমান গ্রন্থ-সমালোচনাটির অপ্রত্যক্ষমাত্র যোগাযোগ রয়েছে। প্রচ্ছদে বড় বড় করে দুশো বছর লেখা-আঁকা থাকলেও এ’খানি পত্রিকাটির ৪৫তম সংখ্যা (ছোট হরফে লিখিত)। নামে শরৎ হলেও ‘অটাম এনুয়াল’ পত্রিকা দীর্ঘকাল ‘প্রতিষ্ঠাতৃ দিবস’ ২০শে জানুয়ারিতেই প্রকাশিত হয়ে আসছে, কলেজের ২০০তম বর্ষে এসেও তার ব্যত্যয় হয়নি। পত্রিকাখানির প্রকাশক কলেজের প্রাক্তনী সমিতি। ‘অটাম এনুয়াল’ পত্রিকাখানিকে কেউ বিশেষ সিরিয়াসলি নেয় বলে মনে হয় না (কোনো ISSN নং নেই), সম্পাদনার ঢিলেঢালামির ছাপ স্পষ্ট, যখন যেমন লেখা এলো ছাপা হয়ে গেলো মার্কা ব্যাপার। বর্তমান সংখ্যাটি, অবশ্য, কলেজের ২০০ বছর পূর্তি বলেই বোধহয়, কেবলমাত্র কলেজী-স্মৃতিচারণেই পূর্ণ। যদিও, দু’চারটি চমৎকার লেখা ছাড়া, তাদের একাদিক্রম পাঠ যথেষ্ট একঘেয়ে।
*
যদিও এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। প্রেসিডেন্সি-হেন মহীরুহের ২০০ বছর পূর্তি সংখ্যা---সে তো এক Collector’s Issue হবে। তা না হয়ে অন্যান্য বছরের ‘অটাম এনুয়াল’ যেমন হয়ে-টয়ে থাকে তেমন এ’খানিও। অবশ্যম্ভাবী তুলনা চলে আসে দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের শতবার্ষিকী ভল্যুমের (১৯৮১) সঙ্গে (সম্পা. হরিশ ত্রিবেদী)। । সে যে কী এক অসাধারণ সংখ্যা ছিল, ধারে-ভারে-অলংকরণে... যে না-পড়েছে তাকে বোঝানো শক্ত (দেখুনঃ www.worldcat.org list https://www.worldcat.org/title/st-stephens-in-our-times-reminiscences-of-st-stephens-college-by-old-students-former-teachers-and-some-others-written-on-the-occasion-of-the-centenary-of-the-college-1-february-1981/oclc/221167790) প্রেসিডেন্সির যে দু’শ বছরের পথচলা তার কোনো রূপরেখা থাকবে না ‘অটাম এনুয়াল’-এর এই বিশেষ সংখ্যায়, কেবল পরের পর ‘আমার কালের প্রেসিডেন্সি’-গোত্রের লেখায় ভরা হলেই চলবে? এবারেই, পাশাপাশি, হিন্দু স্কুলেরও দু’শো বছর পূর্তি হলো। এতদুপলক্ষ্যে, দে’জ পাবলিশিং থেকে স্কুলের এক স্মারকগ্রন্থ বেরিয়েছে, priced edition. অতীব চমৎকার গ্রন্থখানি, অবশ্যই সংগ্রহযোগ্য। ‘অটাম এনুয়াল’-এর কাছেও এই প্রকারই আশা ছিল, আশাভঙ্গে দুখী। রথীন মিত্তির মশায়ের কয়েকটি ইলাস্ট্রেশন দেখার কত আশা করেছিলুম!
*
এ’হেন বিশেষ সংখ্যা সমালোচনার এক প্রধান বাধা হলো, কন্টেন্টের সমালোচনা করাই যায় না। মাননীয় হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত বা শঙ্খ ঘোষ মহাশয়ের লেখার ওপর দু’-এক কথা বলার মতও এলেম নেই। সেইসব লেখাগুলি তাই মুগ্ধ হয়ে পড়ি, যদিও এ’গুলি ‘অটাম এনুয়াল’-এর পুরনো পুরনো সংখ্যা থেকে নিয়ে পুনঃপ্রকাশিত। ‘প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনের ইতিহাস’ লিখেছেন প্রাক্তন অধ্যক্ষ শ্রী অমলকুমার মুখোপাধ্যায় মহাশয়, যাঁর চাইতে যোগ্যতর মানুষ এই রচনার জন্য আর হতে পারতো না। প্রখ্যাত রাশিবিজ্ঞানী শ্রী বিশ্বনাথ দাস মহাশয়ের অনন্য গ্রন্থ ‘প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিবৃত্ত’-এর রিভিউ আমরা পড়েছিলাম পরবাস-৫০ সংখ্যায়। বর্তমান সংখ্যায় তাঁর স্বামী বিবেকানন্দের উপর রচনাটি খানিক অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে, কারণ নরেন্দ্রনাথ দত্ত হয়তো কয়েকমাস এই কলেজে ক্লাস করে থাকবেন কিন্তু তিনি স্কটিশেরই প্রাক্তনী। প্রেসিডেন্সিয়ানরা তো গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকেও তাদের ‘প্রাক্তনী’ বলে প্রচার করতে ভালোবাসে। উনি নাকি একদিন কলেজে ক্লাস করেছিলেন (এ’মতের পুষ্টি মিলবে অধ্যা. রজতকান্ত রায়ের লেখাটায় ও সম্পাদকের সমর্থনে, পৃ. ১১)।
***
এমনিতে ছড়ানো-ছিটোনো মণিমুক্তে ভরা সংখ্যাখানি, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ অবশ্যই দিলীপদার সাক্ষাৎকারটি। একজন ‘সামান্য’ অফিস-এসিস্ট্যান্ট কতখানি উচ্চতায় উঠলে এক ‘এমিরেটাস প্রফেসর’ (নান্ আদার দ্যান্ অধ্যা. প্রশান্ত রায়) তাঁর সাক্ষাৎকার নেন, বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। বুঝতে যেটা অসুবিধার সেটা হলো ‘অটাম এনুয়াল’-এর লিখন-চয়নের অস্বচ্ছতা নিয়ে একাধিক প্রাক্তনীর অভিযোগ কেন থেকেই যায়? আজ এই নেটের যুগে প্রাক্তনী-সাইটে এ’বিষয়ে পরিষ্কার নীতি-ঘোষণা থাকে না কেন? নাঃ, এখানে এ’ বিতর্ক বাড়িয়ে লাভ নাই, বরং দু’একটি লেখার কথা বলি অতি সন্তর্পণে (কারণ, প্রত্যেকেই খ্যাতকীর্ত! তাঁরা কিছু মনে না করেন।)
***
কথাটা ঠাট্টার সুরে বললেও এক নামী প্রাক্তনীদাদা পরশুবছর ‘অটাম এনুয়াল’ খুলে যা বলেছিলেন সেটা এ’বছরও সত্যিঃ ‘আমার কালের প্রেসিডেন্সি’---এই থিমটাকে বছর দশেকের জন্যে ব্যানিশ্ড্ করে দেওয়া উচিত। এতো এতো লেখা প্রতিবার এই থিমের ওপর থাকে...! কিন্তু তাহলে যে এ’বারে মৈত্রীশের লেখাটাও বাদ চলে যেতো! এটিকে এবারের ‘শ্রেষ্ঠ’ না বলে ‘প্রিয়তম’ বললাম, নৈলে...। স্বনামখ্যাত বিপ্লবী অসীম চট্টোপাধ্যায়ের নকশালী চর্বিতচর্বণ কেন বারেবারে পড়তে বাধ্য থাকব, বুঝি না। সম্পাদক লিখেছেন, ‘এবারের প্রতিটি লেখাই কলেজের সঙ্গে জড়ানো’ (পৃ. ১১)। তা, মার্কিন পরিসংখ্যানবিদ্ মার্থা জোন্স, বা রবীন্দ্রনাথের চীনসফর কী করে কলেজের সঙ্গে যুক্ত বুঝতে পারলুম না।
*
শেষের দিকে থোক্ থোক্ কিছু ফটো ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনার অভাব। সূচিপত্রে ‘Presidency Alumni Association 200’-র অঙ্গে অঙ্গে যেভাবে 1817 - 2017 লিখে দেওয়া হয়েছে তাতে মনে হয় এই সমিতিও যেন দু’শো বছর প্রাচীন। তা তো নয়। যেমন, এখানে ‘২০১৬-১৭’র বিষয় বলে পুরনো পুরনো সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত লিখনগুলিকেও ঢোকানো হয়েছে, যাদের একটা আলাদা উপ-বিভাগ থাকা উচিত ছিল।
শুরুর দিকে সেক্রেটারি-সাহেবের L-এর অনুপ্রাসচর্চিত লিখনটি বরঞ্চ বিশেষ সুগ্রথিত লাগলো।
পুন: প্রচ্ছদটিকে ঘোর কৃষ্ণবর্ণে লিপ্ত করার কারণ বোধগম্য হৈল না।
আমলার মন; আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়; দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা-৭৩; প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০১৬; ISBN 978-81-295-2759-2
বাঙলার কথা নয়।
কাশ্মীরের এক কিংবদন্তীসম অফিসার মহারাজ কৃষ্ণ কাও। ষাটের দশকে তিনি তখন সবে আইএএসে ঢুকেছেন। পার্লামেন্ট ঘেরাও করতে আসছে শত শত নাগা সন্ন্যাসীর দল! বিপাক বুঝে সিনিয়র কমিশনার সাহেব ‘আমি আরও পুলিশ ফোর্স আনতে চল্লুম’ বলে কেটে পড়ছেন। জুনিয়ার কাও থরোথরো কেঁপে শুধোয়, ‘স্যর এই এতো জনতা আমি কী করে সামলাবো?’
‘শোনো বৎস, আমি ১৪৪-ধারা জারি করে ফেলেছি। কী করে সেটা বলবৎ করবে সেটা তোমার দায়িত্ব।’
জিপ স্টার্ট।
সেদিনই শিশু-কাও অফিসার-জীবনের প্রথম পাঠ পেলেন, ‘জ্ঞানগম্যি আসলে presence of mind-এর বিষয়, শারীরিক উপস্থিতির নহে!’ (হেঁ হেঁ হেঁ!)
*
মন! প্লেটোর ‘দার্শনিক’ (শাসক)-এর ‘মন’ থাকার কথা ছিল না। থাকলে সে নৈর্ব্যক্তিকভাবে রিপাবলিকের শাসন করবে কী করে? উল্লেখটা এলো এই কারণে যে, যে ইস্পাত-কাঠিন্য নিয়ে বৃটিশভারতে আইসিএসের সৃষ্টি, তার সঙ্গে ঐ প্লেটোর ফিলজফার ছাড়া আর কোনো বিজ্ঞলোকের মিল তো কৈ খুঁজে পাইনে। আর আজকের আইএএস তো সেই সার্ভিসেরই উত্তরসূরী, যদিও স্বাধীনভারতে জনপ্রতিনিধিত্বের শাসন এসে পড়ায় এঁদের দাপট অনেক ঘেটেছে, কিন্তু বাঁ-ভুরুর আড়াই সেন্টিমিটার উত্তোলনটা ঘাটেনি!
*
হাজির-হিসাব তৈয়ার নেই, তবু অনুমান, একক এক গোষ্ঠী হিসেবে ভারতের রাজপুরুষগণ যত যত আত্মজীবনী লিখিয়াছেন, শিল্পী/রাজনীতিক/সাংবাদিককুল তত-সংখ্যায় পারেননি। বোধহয়। না, এ’দিয়ে ‘প্রমাণ’ (বা, অ-প্রমাণ) কিছু হয় না, অবিশ্যি। কিন্তু আমলাগণের এতো এতো পুস্তকের মধ্যেও ‘আমলার মন’, হ্যাঁ, ‘মন’, নিয়ে আগে কোনো বই লিখা হইয়াছে কিনা জানিনে, নিদেন গোচরে আসে নাই। তাই কেতাবখানি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে পড়তে বসতে হলো।
*
পড়া শুরু করিঃ
‘....সব মিলিয়ে, মোটের উপর যদি কোনও একটা গল্পকে একরৈখিক সূত্রে এই বইয়ের সংক্ষিপ্তসার হিসেবে পেশ করতে হয়, তাহলে সেটা এই রকমঃ বঙ্গদেশে রাষ্ট্রগঠনের আদি পর্বে রাজপুরুষদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল; পরে ঔপনিবেশিক আমলে সাহেব সিভিলিয়ানরা তো অপ্রতিহত রাজপুরুষ ছিলেনই, পাশাপাশি ভারতীয় প্রশাসকরাও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে গড়ে ওঠে এবং সাহিত্য থেকে সমাজকর্ম পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রে তাঁরা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন...’
বা,
অন্যত্র, পূর্বসূরী প্রসঙ্গে আলাপন লেখেনঃ
‘আইসিএসরা ভাইসরয়-গভর্নরের স্টিল ফ্রেম বুঝতেন, কিন্তু সার্বিক ভোটাধিকারের গণতন্ত্রে যে-সব লক্ষকোটি টানাপোড়েন তৈরি হয় সেগুলির সঙ্গে যুঝবার প্রস্তুতি তাঁদের হয়নি। গণতন্ত্র যে হরেক রকম দুর্দান্ত ও সপ্রতিভ রাজনীতিকের জন্ম দেবে এবং রাষ্ট্রবৃত্তে তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য যে প্রশাসকদের ছল-বল-কৌশল লাগবে, এই শিক্ষা আইসিএসদের ছিল না।’
পড়তে পড়তে অন্য একটা গল্প মনে পড়ে গেলোঃ ‘ইমনকল্যাণে’ আগ্রা ঘরের জোহ্রাবাঈ-এর ‘গা’ আর ‘নি’-লাগানো শুনে দিলীপ বেদী হেন মানুষ নালেঝোলে হতেন। ললিতা উভয়কর তো বলেই ছিলেন, ‘এতো বছর রাগরাগিণীর চর্চা করছি, এখনও সুর লাগাতেই শিখলাম না।’
না, এ’বই পড়ছিলুম যখন, কোনো গুরু কুমারপ্রসাদ পাশে ছিলেন না অনুভূতিটাকে লিপিবদ্ধ করে রাখতেঃ এতোদিন কলম ঘষাঘষি করছি, এখনও বাঙলা বাক্য গঠন করতেই শিখলুম না ভালো করে---নিজে দুখী হই ভেবে! (এখানে মুখ-পাঁচ-করা স্মাইলি তিনটে দিলে হতো!)
*
না, ‘আমলার মন’ নিয়ে পড়তে বসে গুরুদেবের ‘রক্তকরবী’-র ওপর গোটা একটা অধ্যায় যে পড়তে পাবো, তা-ও তো কৈ ভাবিনি। এই অধ্যায়ে লেখক উত্থাপন করেছেন তাঁর ‘গোস্ট-রাইটিং’-এ লেডি রাণুর জীবনী-প্রসঙ্গ, যে রূপরেখাকে ভিত্তি করে পরে সুনীলের ‘রাণু ও ভানু’ উপন্যাস! যদিও, ‘রক্তকরবী’ পড়ে (এবং, এই অধ্যায়টি পড়েও) আমাদের মনে হয়নি যে সেখানি আসলে ছিল অস্তগামী ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের উপর একটি টিপ্পনী। মতামত অবশ্যি নিছকই ব্যক্তিগত।
*
অসামান্য শিরোনাম অধ্যায়গুলির। মনে হয় উপন্যাসের নতুন নতুন অধ্যায় পড়ছিঃ
. ‘সাম্রাজ্যবাদী রাজপুরুষের মনঃ---ক্ষমতার রতি’ বা,
. ‘সাহেব অমাত্যর আরেক রকম বিষণ্ণ আত্মদর্শন’ বা,
. ‘...ভারতীয় রাজপুরুষঃ রাষ্ট্রকার্যে দেবীদর্শন’
. ‘আজকের রাজকন্যা ও রাজকর্মীদের অগৌরবের মরণ’...
গুরুসদয় দত্ত মশায়কে নিয়ে একখানি পৃথক অধ্যায় থাকা স্বাভাবিকই ছিলো, তা’বলে রথীন সেনগুপ্তকে নিয়ে, যিনি আমলা ছিলেন কম, রাজনীতিক বেশি? নয় কেন? তিনি যে ছিলেন ‘বঙ্গপ্রশাসনের উত্তমকুমার’!! বাক্যগঠনের কথা তুলেছিলুম একটু আগে। এখানে আলাপন লেখেন, “সহস্র ছোট-বড় কৃতির কথা, সীমাবদ্ধতা ও সার্থকতার কথা, যথাসম্ভব স্মরণ করতে পারলে বিবর্ণ অচলায়তনকে রঙিন দৃশ্যপট মনে হবে। আকবর বাদশাকেও পড়ব, হরিপদ কেরানিকেও দেখব, রথীন সেনগুপ্তকেও ছিঁড়েখুঁড়ে বিশ্লেষণ করব---এরকম হলেই তো ভাল”-- কী অনায়াসে খুলে ধরেন ‘আমলার মন’, না?
আর, হ্যাঁ, এখানেই তুলনা আসে শেষ অধ্যায়ের (‘রাষ্ট্রকর্মীর লিঙ্গবোধ’)। মধ্য-পঞ্চাশের আমলা ভোলেননি তাঁর ছেলেবেলার কথাঃ ‘উচ্চ-আমলার নেকনজরে নবীন কি ক্ষমতায়িত বোধ করে, না হীনতাবোধে আক্রান্ত হয়?’ এখানে কমলকুমারের ‘বাবু’ গল্পের উপমায় শিহরিত হই। এর চাইতে তীক্ষ্মধীভাবে ‘আমলার মন’-হেন ‘অবাঙ্মনসগোচর’ বিষয়ের উপস্থাপনা আর কী হতে পারতো?
*
ব্লার্বে (দ্বিতীয় প্রচ্ছদ) প্রকাশক একটা কথা বলেছেন অনেক সাহসের সঙ্গে। এ’ সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসীদেশ নয় যে চতুর্দশ লুই-এর মতো ‘আমিই রাষ্ট্র’ বলে পার পাওয়া যাবে; আইসিএসদের গল্পও নয়, যাঁদের কথাই ছিল আইন। যে আইএএসদের নানাস্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সদাই চলতে হয়, সেই “আমলার মন, রাষ্ট্রেরই মন”? জানি না, লেখক-মহাশয়ও এই মত সমর্থন করেন কিনা, তবে দেড়শত পৃষ্ঠার এই আত্মজীবনীধর্মী কেতাবে যেভাবে এক অগ্রগণ্য আমলার তিনদশকব্যাপী কর্মকাণ্ডের পিছনের ভাবনাচিন্তাগুলি ভেসে উঠেছে তা শুধু যে গ্রন্থ হিসেবে একে এক বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে যায় তা-ই নয়, ভবিষ্যৎ গবেষকদের কাছেও এক উল্লেখযোগ্য আকরগ্রন্থ হিসেবে স্থান করে নেবে নিশ্চয়ই। অধ্যায়শেষের ‘পাদটীকা’গুলি এক এক খনি বিশেষ, গ্রন্থশেষে তাই আর আলাদা করে ‘আরও পাঠ’ দিতে হয়নি।
*
অন্নদাশংকর অনবদ্য স্মৃতিকথা লিখেছিলেন, ‘যুক্তবঙ্গের স্মৃতি’। তাকে পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী বলা সঠিক হয়তো হবে না। তাই অশোক মিত্র-মশায়ের ‘তিন কুড়ি দশ’-এর পরে আর কোনো বাঙালি আই সি/এ এস বাঙলায় আত্মজীবনী লিখেছেন বলে মনে পড়ে না (যদি, অবশ্য, আলাপনের এই বইটিকে ঠিক ঠিক আত্মজীবনী বলে ধরা হয়)। এই গ্রন্থ সে-অর্থে ইউনিক। শেষ-মলাটে ঐ যে বলেছে না, ‘আমলা আসলে কে বা কী? সে কি ঈশ্বরপ্রতিম, বা দেবদূত, প্রায় যেন বিধাতাপুরুষ...’?!
হ্যাঁ, সেই দেবদূত জিব্রাঈলের মনের কথা জানতে আর এদিক ওদিক নয়, এ’ কেতাবই ঘাঁটবো বারবার।
বেচুবাবু —রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল; সৃষ্টিসুখ প্রকাশন; জানুয়ারি ২০১৭; ISBN 978-1-63535-498-0
এতো হাতেগরম বুক-রিভিউ এই কলমে কদাচ পড়া গেছে।
সত্তরোর্ধ লেখকের এ’ বইয়ের প্রকাশ মাসখানিক আগে, জানু ২০১৭, কলকাতা বইমেলায়। সম্ভবতঃ এটি তাঁর তৃতীয় পুস্তক। এর আগে ওনার ‘চাপড়ঘণ্ট’ ই-বইটি পড়ে উৎসাহ জেগেছিল, এ’ জীবনকাহিনিটি পড়ার উৎসাহে তাই ছিলাম বটে। নিরাশ তো করেনইনি রামকৃষ্ণবাবু, বরং উচ্ছলিয়া দিয়েছেন!
*
পূর্ববঙ্গ থেকে মূলোৎপাটিত এক উচ্চশিক্ষিত দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবার ভদ্রভাবে দুটো ভাতকাপড়ের সংস্থান করতে বিভক্ত-ভারতে ঢুকে প’ড়ে কখনো উড়িষ্যার দণ্ডকারণ্যের কাছে, কখনও দক্ষিণ কলি.র শহরতলীর উদ্বাস্তু কলোনিতে অবিরত সংগ্রাম করে চলেছে, হার মানছে না....সে পরিবারেরই এক সন্তান ঢুকে পড়লো এক নব্যপেশায়ঃ মেডিক্যাল রেপ্রেজেন্টেটিভ, ১৯৫০-এর দশক নাগাদ যে পেশা ভারতে সবে এসেছে। বিমানসেবিকা পেশাটির মত এতেও বাইরের সাজগোজ স্মার্টনেস এক বড় আভরণ, আকর্ষণও বটে নতুনদের টেনে আনতে। কিন্তু এই টাই-স্যুট-মশমশে স্যু-র পেছনের লড়াইটার খবর, বেদনার খবর কে রাখে? এ’ও সেই ‘পিঠেতে টাকার বোঝা তবু এ টাকাকে যাবে না ছোঁয়া’!
তাঁর প্রথম চাকুরির ইন্টারভ্যুয়ার রামকৃষ্ণের ঢলঢলে উধারিত স্যুট নিয়ে খোঁচা দিতে হাজির-জবাব পেয়েছিলেন, ‘I know, Sir, I’m a mirror’!!
চাকুরিটা রামকেষ্টোর সেদিনই হয়ে যায়।
*
বাঙলাসাহিত্যে কারাজীবন নিয়ে জরাসন্ধ, ক্রিমিন্যাল ঘাঁটাঘাঁটি নিয়ে পঞ্চানন ঘোষাল, পুলিশজীবন নিয়ে ধীরাজ ভট্টাচার্য মশায় (‘যখন পুলিশ ছিলাম’) অনবদ্য লিখে গেছেন। কেবলমাত্র রাজনীতিবিদ-শিল্পী-অধ্যাপকগণেরই যে আত্মজীবনী লেখার এলেম আছে অন্যদের নেই... ওঁদের কলম ধরায় সেটাই প্রমাণিত, যদিও সংখ্যায় এই দ্বিতীয় দলই ভারি বেশি। বেশ। যদিও তিনি প্রায়-বুদ্ধিজীবীর দলে পড়েন, প্রাক্তন নগরপাল তুষার তালুকদার মশায়ের আত্মজীবনীও নাকি বেশ কাটে, শুনেছি (‘তকমা উর্দির আড়ালে’, আজকাল) তাহলে কি অন্য অন্য পেশাধারীরা আত্মজীবনী লিখবেন না? কী করে তাহলে আমরা জানতে পারবো, ধরুন, এক রাঁধুনি বা দর্জি বা নাপিতের জীবনকথা? (উঁহুঃ, নাক কোঁচকাবেন না, পাঠক। এখানে, যথাক্রমেঃ সঞ্জীব কাপুর, তরুণ তাহিলানি বা জবেদ হাবিবের নাম লিখলে তো জাতে ওঠা যেতো, না?)। কিছুদিন আগে এক জীবনগাথার সমাহার পড়েছিলাম (‘আমার আত্মজন’, গ্র. স. পরবাস-৫৩)। তাতে টাঙ্গাওলা, বেশ্যা, পকেটমার প্রভৃতি নানান পেশার মানুষজনের কথা শুনিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠিত লেখক, কিন্তু কোনো বেচুবাবুর কথা নয়। বাঙলাসাহিত্যে, তাই রামকৃষ্ণের এই গ্রন্থই কোনো মেডিক্যাল রেপ্রেজেন্টেটিভের প্রথম প্রামাণ্য জীবনী হিসেবে মান্যতা পাবে।
*
কোনো রেভেনিউ স্টেটমেন্ট ধরে প্রথমেই তার ডান কলমে মাথার দিকের প্রথম এন্ট্রিটায় চোখ চলে যাওয়া এক পুরনো অভ্যেস। সেলস ফিগার। যে কোনো কোম্পানীর জীয়নকাঠি ঐ সংখ্যার মধ্যেই লুকিয়ে আছে যে হে! তাই এই ফিগার বাড়াতে কোম্পানিগুলি যে নতুন নতুন প্ল্যান-প্রোগ্রাম করবে, স্ট্র্যাটেজি আনবে, সে তো স্বাভাবিক। আর, এ’ থেকেই মেডিক্যাল রেপ্রেজেন্টেটিভ পেশার জন্ম, যাঁরা তাঁদের শিক্ষা দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে, উপস্থাপনা দিয়ে কোম্পানীর প্রোডাক্টের বিক্রয় বাড়ান, চালু থাকে কোম্পানীর লাইফলাইন। এটা করতে গিয়ে, অন্য অন্য যে কোনো পেশার মতই নানা ধান্ধাবাজি, চুকলি, ফিগারে-জল-মেশানো চলে, চলতেই থাকে। আর, এ’সব নিয়েই পেশাটিও চলতে থাকে, বন্ধ হয়ে যায় না। এ’গল্পই শুনিয়েছেন লেখক তাঁর মায়াকলমে, যা একবার পড়া ধরলে আর থামা নেই, গড়গড় করে সওয়া-শ’ পৃষ্ঠার কেতাবপাঠ শেষ। বেশ। যদিও লেখকমশাই যে কেবল তাঁর চুলবুলে বেচু-অভিজ্ঞতা দিয়েই বই ভরিয়েছেন তা নয়, চমৎকার বলেছেন এই পেশার ইতিহাস, ভারতে এঁদের সংগ্রাম-আন্দোলনের কথা, ‘হাথি কমিটি’। লেখক-মশাই নিজেও বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে ঘোরতর যুক্ত ছিলেন যে এককালে। পাশাপাশি এসেছে উদ্বাস্তু আন্দোলনের কথা, নকশাল আন্দোলন। ওড়িশা-বিহার-উত্তরবঙ্গে চুটিয়ে কাজ করে গেছেন লেখক তিনদশকের বেশি সময় ধরে। তাই এ’সব জায়গার মানুষজনের গল্প অবিরল উঠে এসেছে নানা ফর্মে, যার পাঠ অতি সুখকর, ইনক্লুডিং হাতুড়ে ডাক্তার, বিহারী মস্তান থেকে উত্তর-বাঙলাদেশের বৃদ্ধ ইদ্রিশ আলি সায়েব যিনি রামকৃষ্ণের মাথায় তসবিমালা জপে আশীর্বাদ করেছিলেন (তাঁর চিকিৎসক পিতামহ এক কালে ইদ্রিশের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন যে)। সামান্য বেতনে (ভাগ্যিস টিএ ডিএ ছিলো), রোদজলবৃষ্টি মাথায় করে, দিনের-পর-দিন পরিবার ছেড়ে আজ এ’শহর তো কাল ঐ গঞ্জ ঘুরতে হয় এমারদের। চিকিৎসককুল সাধারণতঃ এঁদের একটু ইয়ে চোখে দেখেন, তবু তাঁদের নিয়েই এঁদের চলতে হয় কারণ ডাক্তারবাবুরাই যে এমারদের আরাধ্যদেবতা! এমন অনেক দরদী ডাক্তারবাবুর গল্প লেখক শুনিয়েছেন যাঁরা ভ্রাতৃস্নেহে এই লড়াকু পেশাদারকে রোদজল থেকে বাঁচিয়ে মুখে মধ্যাহ্নের অন্ন তুলে দিয়েছেন। বড় মায়াময় সেসব গল্প। বড় সুখপাঠ্য।
*
বেশ। আচ্ছা, এখানে দু’একটি অপছন্দের কথা বলতে পারি কি? বলি। কিছু কিছু রসিকতা শালীনতার কান ঘেঁষে বেরোতে পারেনি, উদা. Oral contraceptive, পৃ. ২১, Milk container পৃ. ৪৭, মহিলাদের ডেট পৃ. ৮৯।
বাছুরের গপ্পোটা ততটা নয় পৃ. ৪৮ অবিশ্যি।
মতামত ব্যক্তিগত।
*
তিনটি মাত্র মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েছে, পৃ. ৩৬ (অ জ), পৃ. ৪৭ (প্রশ্নত্তোর) ও পৃ. ১০৯ (গিরাধারী)। সুমিত রায়-কৃত প্রচ্ছদ অতি মনকাড়া, অন্দরের অলংকরণও। কেবল, পৃ. ৯৪ এর চিত্রে ওটি তানপুরো হয়ে গেছে, সেতার নয়।
ব্লার্বটি বড্ড দীর্ঘ হয়ে গেছে।
*
এ’সকল আলোচনা, অবশ্য, এহ বাহ্য।
গ্রন্থখানির মূলসুর বেজে উঠেছে প্রথমে উৎসর্গপত্রেই, যা সমগ্র গ্রন্থটিকে এক বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে যায়। স্বীয় পেশাকে অত্যন্ত ভালো না বাসলে কেউ নিজের সন্তানকেও সে পেশায় আনে না। রামকৃষ্ণবাবুর জ্যেষ্ঠ সন্তানও ছিলেন এক মেডিক্যাল রেপ্রেজেন্টেটিভ (এম আর), অকালে, মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে, কর্মরত অবস্থায় এক নৌকাডুবিতে প্রাণ হারান। পুত্রহারা পিতার সেই শোক সেই ব্যথা কোথায় যেন অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত বয়ে চলে এই গ্রন্থের অন্দরে অন্দরে, ভারাক্রান্ত করে তোলে মন। এতদ্সত্ত্বেও মনে হয়, তাঁর এই ভালোবাসার পেশার সুখ-দুঃখ-বেদনা-আনন্দ মাধুরীতে ভরিয়ে তুলেছে তাঁর জীবনপাত্র, শুধু ভরিয়ে নয় করেছে উচ্ছলিতও। নৈলে এতো ঠাট্টা-তামাশা, এতো হাসি-গানের জোরটা আসে কোথা থেকে? তবে, বাগ্দেবী প্রসন্নমুখ তুলেছেন রামকৃষ্ণের প্রতি। তাঁর কলম থেকে প্রত্যাশার পারদ অত্যুচ্চে চড়িয়ে ছেড়েছেন তিনি। লেখক যে প্রণম্য সিতু মিঞার বিশেষ ভক্ত সেটা আর বলে দিতে হয় না তাঁর লিখন স্টাইলে।
এরপর আমরা তাঁর কাছে শুনতে চাই পাঁচের দশকে ওড়িশায় এক বাঙাল বারিন্দির ব্রাম্ভোণের গল্প, সেখানকার রেলভ্রমণের কাহানি।
অপেক্ষায় থাকবো, ঘনাদা!
দিলীপ রায়চৌধুরী রচনাসমগ্র— প্রকাশকঃ হ-য-ব-র-ল; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি, ২০১৭; ISBN: 978-1-63535-615-1
‘এই যে দেখছেন হুজুর এই কেঠো-ঘোড়া... এই হলো তার চাবি। এটা ঘোরালেই...এই যে হুউউউশ করে উড়ে গেলো এই ঘোড়া...’ পারস্যরাজ সাবুরের দরবারে এসে সেই কদাকার বৃদ্ধ যে উড়ন্ত কেঠোঘোড়া দেখিয়েছিলো, দশম শতাব্দীর ‘সহস্রএক আরব্যরজনীর গল্প’-গুলির মধ্যে সেই বোধহয় প্রথম এক কল্পবিজ্ঞানের ছোঁয়া দেখা গেলো (‘আবলুস অশ্ব’, ৩৫৮-৩৭১, রজনী), যদিও আলাদিন-আলিবাবা-সিন্দবাদের গল্পে উড়ন্ত কার্পেট আর জিন আর রকপাখির অভাব নেই। কিন্তু সে-সব তো গপ্পোকথা। ভারতীয় মিথই বা কম কী? পুষ্পক রথ, বিশল্যকরণী, ব্রহ্মাস্ত্র... লম্বা ফর্দ। এ’সব ফ্যান্টাসিতে ভারত থেকে গ্রীস থেকে রোমান মহাকাব্য-উপকথা ভর্তি। কিন্তু তাতে ‘বিজ্ঞান’ কৈ?...সেই ‘কেঠোঘোড়া’-র চাবি? ঐ চাবিটিই বিজ্ঞান, ওটি না থাকলেই গপ্পো (যদিও সেটা উপস্থাপনারও আর্ট আছে। রেফ. রাউলিং)।
*
এ’ উপক্রমণিকা ফাঁদলুম কেন? কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাস তো লিখতে বসিনি। কিন্তু ওয়েলস-ভার্ন-পো-এসিমভ তো আর মহাকাশ থেকে উড়ন্ত-চাকতি বেয়ে নেমে আসেননি। তাই শিকড় খুঁজতে যাওয়া। প্রেম-হাস্য-বিষাদ-বিভীষিকা--নানান রসেরই তো কাহিনী হয়ে থাকে, বলার গুণেই কেউ ব্রণ্টে কেউ জেরোম কেউ ডিকেন্স আর কেউ ব্রাম স্টোকার হন। সেই অর্থে সাই-ফাই (‘Sci-Fi’) অনেক নব্য ধারা, নেট খুঁজে অনেক সামোসাতার লুসিয়েন বা মার্গারেট ক্যাভিন্ডিসের নাম খুঁজে পেলেও সে-সব পড়ি-টড়ি নাই, আমাদের কাছে লিলিপুটের দেশের গল্পই প্রাচীনতম সাই-ফাই (জোনাথন সুইফট, ‘গালিভারস ট্রাভেলস’, ১৭২৬খৃ.)।
আর বঙ্গভাষায়? বাল্যকালে যখন ‘মশা’ পড়েছি, বা ‘টল’ বা ‘ঢিল’... আমাদের কাছে তা ঘনাদার গল্পই ছিল। তার পিছনের বৈজ্ঞানিক দানাগুলো বুঝে নিতে অনেক বচ্ছর কেটে গেছে। ষাটের দশকের গোড়ায় ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য মশায়ের ‘টিটিঙ্গি পাহাড়ের দেবতা’ পড়ে ঘোরগ্রস্ত হয়ে পড়ি, সেখানি ‘বৈজ্ঞানিক গল্প’ বলে দাগা মারা ছিলো অবিশ্যি। এরপর নমস্য অদ্রীশ বর্ধন মশায়ের ‘প্রোফেসর নাটবল্টু চক্র’ আর সত্যজিত রায়ের প্রো. শঙ্কু এসে পড়ে ১৯৬০-৭০এর দশকে আমাদের কৈশোর ভরিয়ে তুললেন সৌরভে! আরও ছিলেন অনীশ দেব, সংকর্ষণ রায়... ভূরিভোজ! ভূরিভোজ!
*
হ্যাঁ, এ’সব কথা চমৎকার লিখেছেন শ্রীসিদ্ধার্থ মজুমদার আলোচ্য গ্রন্থখানির মুখবন্ধে, এবং দিলীপকন্যা কবি যশোধরা তাঁর পরিচিতিতে। আর এই পোড়া-কলমচি তার নিজ গণ্ডে ঠাস্ঠাস্ কষিয়েছে দিলীপ রায়চৌধুরীর কলমের সঙ্গে পূর্বপরিচিতি না থাকার কারণে। নৈলে, ‘অগ্নির দেবতা হেফেস্টাস’-এর মত এক কল্প-উপন্যাস, বা ‘নেরগাল’ বা ‘শুক-সমুদ্র’-এর মতো কল্পবিজ্ঞানকাহিনী যে পড়েনি তার আর যাহাই হৌক গ্রন্থ-সমালোচক হওয়া সাজে না।
*
কিন্তু মুগ্ধ হতে তো বাধা নেই? যে মুন্সীয়ানায় দিলীপ এক কল্পবিজ্ঞানগল্পের ‘মাহোল’ গড়ে তোলেন ধীরে ধীরে, যেমন ‘সৌর-ঝঞ্ঝা’ গল্পে অবজারভেটরি হিল-কেন্দ্রিক জনপদটি বা ‘নেরগাল’ গল্পে বিশ্ববিদ্যালয়শহর বা ‘টিথোনাস’ গল্পে টালাপার্ক ঘেঁষা শুনশান ভাড়াবাড়ির একতলাঘর, ....পাক্কা গানার আলাপের মতো পাঠকের মনটিকে উৎসুক করে তোলে ক্রমে-পাতে-পড়া সুস্বাদু আহার্যের প্রতি। এ’গল্পবলার স্টাইলটি বড় মুন্সীয়ানার, ক্লাসিক ঘরানার। আর তার পরতে পরতে খোলে দিলীপের নাক-কান-চোখঃ তা কখনও ক্যালিফোর্নিয়ার পথের ধারে কল্কে-টগর ফুল দেখতে পায়, বা স্ট্যানফোর্ডে টালির চালের কুঁড়ে বা কখনও জনান্তিকে কালিদাস আউড়ে ওঠে, ‘সশী করম্ভোধর শব্দমর্দল...’! অপূর্ব! আর, অসিরীয়-গ্রীক পুরাণ ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে ‘নেরগাল’, ‘হেফেস্টাস’ দিয়ে শিরোনাম দেওয়ার শিহরণটা? কেন জানি না, ফ্যান্টাসি বা সাই-ফাইতে গ্রীক উপকথা এসে পড়লে এক বিশেষ তার হয় (যেমন, সত্যজিতে ‘পেগাসাস’)। ‘অগ্নির দেবতা হেফেস্টাস’-এর তুলনীয় কল্প-উপন্যাস আমি অন্ততঃ বাঙলাসাহিত্যে আর পড়িনি; অবধারিত সুবাস তার Brighter than a Thousand Suns এর! যদিও ‘নেরগাল’ গল্পে মঙ্গলের উপগ্রহ ফোবোসকে কৃত্রিম ধরে গল্প-গড়ায় একটু ‘কিন্তু’ রাখলাম, তবু ‘বৈজ্ঞানিক’ গল্প বলতে গিয়ে বিজ্ঞানের সেই ধারার সঙ্গে এতো সহজে একাত্ম হয়ে যাওয়াটা (এবং, গোলা লোকও বোঝে এমন ভাষায় বলাটা) দিলীপের বড় ইউনিক স্টাইল, আর্থার ক্লার্ক মনে পড়ায়। বাঙলা সাই-ফাইতে প্রফেসর শঙ্কু বা প্রফেসর নাট-বল্টু-চক্রের এতো রমরমা, দিলীপের প্রফেসর সুশোভন রায় অন্তরালে চলে গিয়েছেন, বা বিস্মৃতিতে। যদিও তেমন কথা তো ছিল না। অসামান্য চরিত্রচিত্রণ করেছেন দিলীপ তাঁর স্যরের। আর, ‘আমি’ সঞ্জয় চৌধুরীই বা কম কিসে, যিনি নিজেই বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র!
*
পড়ন্ত এক জমিদারবংশের সন্তান দিলীপ রায়চৌধুরী (১৯২৮-৬৬)-র বেড়ে ওঠা বহরমপুর শহরে। রসায়নশাস্ত্রে উচ্চগবেষণার্থে মার্কিনদেশে গমন, তাই তাঁর গল্পে শিকাগো বা ক্যালিফোর্নিয়া ফার্স্টহ্যান্ডে এসেছে। বড় সুখপাঠ্য। মাত্র সাঁইত্রিশ বৎসর বয়সে প্রয়াণ দিলীপের, কিন্তু তারই মধ্যে নিজস্ব ছাপ রেখে গেছেন শুধু বাঙলা কল্পবিজ্ঞানসাহিত্যেই নয়, চমৎকার লিখে গেছেন ভ্রমণকাহিনি, নাটক ও ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রাম নিয়ে এক মনকাড়া বড়গল্প। হ্যাঁ, স্থান পেয়েছে এই সংকলনে। বস্তুতঃ, এ’সংকলনখানির বেশিরভাগ লেখাই ‘তরুণ তীর্থ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, অদ্রীশ বর্ধন মশাইয়ের ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকাতেও কিছু, কিছু তাঁর অকালপ্রয়াণের পরেও বেরিয়েছে। সত্যি, সেকালে এ’হেন অধুনালুপ্ত/বিস্মৃত পত্রিকাগুলিতে এ’রকম কত কত মণিমুক্তো ছড়িয়ে ছিলো, ভাবলে বিস্ময় জাগে। ‘তরুণ তীর্থ’ পত্রিকা দিলীপ রায়চৌধুরীর কল্পবিজ্ঞান ছাড়াও ভ্রমণকাহিনি (‘দূরের মাটির ধুলো’, ‘নিউ ইয়র্ক’) বা নাটিকা (‘হিদারামগলির রূপকথা’)-ও প্রকাশ করেছিলো... সেসবও স্থান পেয়েছে এই সংকলনটিতে। দিলীপ রায়চৌধুরীর এই গোত্রের লেখাগুলির সম্বন্ধে আমাদের প্রথম অনুযোগঃ এতো কম সংখ্যায় কেন? আরও কেন লিখলেন না? নাকি আরও কোথায় ঘুমিয়ে আছে সে-সব, ক্রমে বেরোবে? মার্কিনমুলুকে এসে ষোলো আনা ভেতো বাঙালির প্রাণটা যখন দুমুঠো ভাতের জন্যে আনচান করে ওঠে, বা বার্চ-এলম্-পপলারের গা বেয়ে অঝোর বৃষ্টিধারা ঝরে পড়তে দেখে সে যখন গেয়ে ওঠে ‘উতল ধারা বাদল ঝরে...’ মনে হয় এটমিক রিএক্টার বা এলকালয়েড কেমিস্ট্রি র ঊর্ধ্বে দিলীপ আসলে একজন কবি ছিলেন, অকালপ্রয়াণ আরও ফুটে উঠতে দিলো না তাঁকে। সে কোন্ অসীম সুরলোক থেকে দিলীপ নিশ্চয়ই এখন দেখছেন মর্ত্যভূমে তাঁর এই মুগ্ধ পাঠকদের গ্রন্থপাঠ, আর অপেক্ষা রচনাবলীর দ্বিতীয় খণ্ডের জন্যে, যেখানে তাঁর বহু পত্রাচারের ভাণ্ডার পাওয়া যাবে।
(পরবাস-৬৬, মার্চ ২০১৭)