অষ্টম গর্ভ; বাণী বসু; প্রথম প্রকাশ: ২০০০, আনন্দ পাবলিশার্স; কলকাতা; পৃষ্ঠাঃ ৩১৮; ISBN: 81-7756-043-3
কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার বলে স্বীকৃত। যদুবংশে জন্ম। কংসের বোন দেবকীর সঙ্গে বসুদেবের বিয়ে হয়। পৃথিবী ধেনুরূপ ধরে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন দেবাসুরের যুদ্ধে মৃত অসুররা সবাই দুষ্ট রাজা হয়ে পৃথিবীতে জন্মাচ্ছেন, পৃথিবী এদের ভার সহ্য করতে পারছেন না। ব্রহ্মা ও শিবের অনুরোধে বিষ্ণু আশ্বাস দেন তিনি বসুদেবের ছেলে হয়ে জন্মাচ্ছেন। দ্বাপর-শেষে সদ্যনিদ্রাউত্থিত বিষ্ণু দেখেন পৃথিবী ভার-পীড়িত। পার্বতী গুহাতে পুরাতন দেহ রেখে বিষ্ণু বসুদেবের ঘরে জন্মাতে যান। কংসের হাতে দেবকীর প্রথম ছটি সন্তান নিহত হয়। সপ্তম সন্তান অনন্তের অংশ, গর্ভ নষ্টের খবর ছড়ায়। অষ্টম বার গর্ভ হলে কারাগারে কঠোর পাহারার ব্যবস্থা হয়। জন্মের পরই তাকে নন্দ রাজার ঘরে রেখে আসা হয়। মহামায়ার মায়াতে সবাই অচৈতন্য হয়ে পড়লে কৃষ্ণের জন্ম। কারাগারের দরজা খুলে যায়, বসুদেব ছেলেকে নিয়ে বহির্গত হয়, বৃষ্টিতে শেষনাগ ফণা ধরে তাকে রক্ষা করেন। বসুদেব কৃষ্ণকে রেখে যশোদার মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসেন। কৃষ্ণকীর্তির নানান আখ্যান ভাগবত ও অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত আছে। কৃষ্ণ হিন্দুধর্মের প্রধান উপাস্য দেবতা। তাঁর দুটি রূপ--একটি কূটনীতিবিদ পার্থসারথি; ধুরন্ধর রাজনীতিজ্ঞ. আর একটি যশোদা-দুলাল এবং অবৈষ্ণব দৃষ্টিভঙ্গিতে লম্পট। এই কৃষ্ণকে তারপর নারায়ণ বিষ্ণুর সঙ্গে এবং ঋক বেদের বিরাট পুরুষের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হয়েছে। মহাভারতে কৃষ্ণ ক্ষত্রিয়, মথুরার লোক। কংসের অত্যাচারে দ্বারকাতে রাজধানী স্থাপন। খ্রীষ্টপূর্ব ৪-শতকের বিদেশীদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় কৃষ্ণ তখন দেবতা। পতঞ্জলির মতে কৃষ্ণ বাসুদেব ক্ষত্রিয়বিশেষ নন, এক দেবতা। সুতরাং বর্তমান কৃষ্ণের দুটি রূপ — তিনি রণপণ্ডিত, কূটনীতিজ্ঞ, আশ্রিতবৎসল, পরমতত্ত্বজ্ঞ। আর এক রূপে তিনি প্রেমিক, ভক্ত সখা ও গোপীবল্লভ। কৃষ্ণ-প্রচারিত শিক্ষা অন্তর্মুখী ও নিরাসক্ত হয়ে জ্ঞানযজ্ঞের পথে এগিয়ে যাওয়া। বৈষ্ণব মতে এই কৃষ্ণই ঈশ্বর। ইনি পরমাত্মা, রাধা তার হ্লাদিনী শক্তি। ভক্ত হচ্ছেন জীবাত্মা। (পৌরাণিকা - অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়) বিশ্বকে ব্যাপ্ত করে বিরাজমান বলে নাম বিষ্ণু। কিন্তু এই পূজিত বিষ্ণু ও বেদের বিষ্ণু এক নন। বৈদিক বিষ্ণু তীব্র গতিময়, যিনি বিশ্বভুবনকে স্থির করেছেন, নির্মাণ করেছেন বা ধারণ করেছেন যেন। তিনি সর্বগুণাশ্রয়ী, বিপদে দেবতারা এঁর স্মরণ নেন। রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রয়োজন হলেই অবতার হিসেবে জন্মান এবং দুষ্টের দমন করে সৃষ্টি রক্ষা করেন এবং ধর্ম সংস্থাপন করেন। বিষ্ণুর দশ অবতার। (ঐ) 'অষ্টম গর্ভ' উপন্যাসটির আলোচনার জন্য যে সামান্য আখ্যান অংশ দ্যোতক, তাই উল্লেখ করলাম।
বাণী বসু পুরো উপন্যাসটিকে (আনন্দ প্রকাশিত) তিনটি স্কন্ধে ভাগ করেছেন। 'স্কন্ধ' শব্দের একাধিক অর্থের মধ্যে একটি প্রাসঙ্গিক অর্থ হল — 'গ্রন্থাদির অধ্যায় বা সর্গ' (সংসদ বাঙ্গালা অভিধান) সাধারণতঃ যা প্রাচীন কাব্যাদিতে ব্যবহৃত হয়। এরপর অধ্যায়গুলিতে আছে আবির্ভাব, অষ্টোত্তর শতনাম, গোকুলে বাড়িছে সে, দুহুঁ করে দুহুঁ, হরিবংশ-১ এবং লঙ্কাকাণ্ড, হরিবংশ-২ — কালো কুমু, হরিবংশ-৩ এবং হরধনু ভঙ্গ, হরিবংশ-৪-- গোপীজনবল্লভ, আকালাসুর, ছদ্মবেশী অসুর-অসুরিণী, হরিবংশ-৫ — টমদিদি, হরিবংশ-৬ — বুজবুজদিদি, হরিবংশ-৭ — পুটপুটদিদি, প্রলম্বিত ব্যোমাসুর — শেষ আক্রমণ, কালিন্দীর দহে, ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ - ১, নিও - যশোদা, অঘাসুর, শিব-পুরাণ, শ্রীদাম - সুদাম - সুবল সখা, নাচিকেত, বাসুদেব। নষ্ট ভ্রষ্ট দষ্ট ব্রজ, প্রভৃতি। পাঠকদের উপন্যাসটি বুঝতে সাহায্য করার জন্য জানাই —
গোকুল হল যমুনাতীরস্থ গ্রাম যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম নন্দালয়ে পালিত হয়েছিলেন। মহাভারতের পরিশিষ্ট বলে কথিত, দশ হাজার শ্লোক সমন্বিত গ্রন্থ হরিবংশ, যার প্রথম ভাগে জগৎসৃষ্টি ও সূর্যবংশ চন্দ্রবংশ ও যদুবংশের বিবরণ, দ্বিতীয় ভাগ বিষ্ণু পর্ব যাতে কৃষ্ণের জীবনী ও লীলা। তৃতীয় ভাগে ভবিষ্য পর্ব যাতে কলিযুগ, পৃথিবী কথা, বামন, নরসিংহ অবতার এবং শিব ও বিষ্ণু প্রসঙ্গ রয়েছে। আকালাসুর সম্ভবতঃ আকাল অর্থাৎ দুর্ভিক্ষ ও দুঃসময় অসুর রূপে কল্পিত। ব্যোমাসুর ময়াসুরের ছেলে, কৃষ্ণের হাতে নিহত, যে গোপ বালকদের পর্বত গুহাতে নিয়ে গিয়ে বন্দী করেছিল। 'কালিন্দী' ও যমুনা সমনামিক। বসুদেব সদ্যজাত কৃষ্ণকে নিয়ে এই যমুনা হেঁটে পার হয়েছিলেন। কৃষ্ণ ও অর্জুন যমুনার তীরে বেড়াতে গিয়ে কৃষ্ণের জন্য তপস্যারত জনৈক সুন্দরীকে দেখেন। তিনিই কালিন্দী, যাকে কৃষ্ণ দ্বারকাতে বিয়ে করেন। কৃষ্ণজীবনের সঙ্গে যমুনা নদী অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। 'ক্লৈব্য' অর্থাৎ ক্লীবের ভাব। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রারম্ভে স্বজন নিধন যুদ্ধে অর্জুন অনিচ্ছুক হয়ে পড়লে কৃষ্ণ তাকে বোঝান ও বিশ্বরূপ দর্শন করান। ভবিতব্য হল স্বজনের মৃত্যু এই ব্যাপারটি বোঝানো হয়। যশোদা গোকুলে নন্দের স্ত্রী, কৃষ্ণের পালিকা জননী। অঘাসুর বকাসুর ও পুতনার ছোটভাই, কংসের একজন সেনাপতি। বাড়ি ফেরার পথে অজগর রূপী অঘাসুরের মুখের মধ্যে ঢুকে যান কৃষ্ণ ও সঙ্গী গোপালরা। পরে বুঝতে পেরে বিরাট দেহধারণ করে অসুরের পেট ফাটিয়ে হত্যা করেন। 'শিব পুরাণ' একটি উপ-পুরাণ, যাতে শিবতত্ত্ব নারদ কর্তৃক ব্রহ্মাকে ব্যক্ত করা হয়। কৃষ্ণের সাতজন সখা ছিল, যারা হল — শ্রীদাম, সুদাম, বসুদাম, সুবল প্রভৃতি। বাসুদেব কৃষ্ণের অপর নাম। 'ব্রজ' মথুরা ও চারপাশ, কৃষ্ণের লীলাভূমি। ব্রজমণ্ডলের কামবনে কৃষ্ণ অঘাসুরকে নিহত করেন, বকবনে বকাসুর কৃষ্ণ কর্তৃক নিহত, ব্রহ্মাণ্ড ঘাটে কৃষ্ণ নিজ মুখের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ড দেখান। মথুরাতে কংস হত্যা ক'রে বিশ্রান্তি ঘাটে কৃষ্ণ বিশ্রাম করেন। 'নাচিকেত' অর্থাৎ নচিকেতা প্রাসঙ্গিক। রাজা বাজশ্রবার ছেলে নচিকেতা (মহাভারতে সে উদ্দালক ঋষির ছেলে)। নচিকেতার বাবা স্বর্গে যাবার জন্য এক যজ্ঞ করে সমস্ত ধনরত্ন দান করে। বালক নচিকেতা বাবাকে জিজ্ঞাসা করে কোন ঋত্বিকের হাতে তাকে দান করবেন। বারংবার জিজ্ঞাসায় রাজা তাকে যমের হাতে দান করবেন বলেন। যম ব্রহ্মলোক থেকে ফিরে নচিকেতা তিন রাত উপোস করে আছে শুনে তিনটি বর দিতে চান। প্রথম বরে নচিকেতা চান তার বাবা যেন ছেলের জন্য চিন্তা না করেন ও আগের মতো তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। দ্বিতীয় বরে স্বর্গে যাবার পথ জানতে চান এবং যারা স্বর্গগামী তারা যাতে ক্ষুধা তৃষ্ণা জরা মৃত্যু ইত্যাদির অধীন না হন। তৃতীয় বরে জানতে চান মৃত্যুর পর আত্মার কি হয়? জীবাত্মা বলে কিছু আছে কি না। যম প্রথম দুটি বর দিয়ে নানা প্রলোভন দেখিয়ে নচিকেতাকে নিবৃত্ত করতে চান। তৃতীয় প্রশ্নের জবাবে ব্রহ্মবিদ্যা দান করেন। এই তৃতীয় প্রশ্নের জবাবই কঠোপনিষদ। বাণী বসুর উপন্যাসটির দ্বিতীয় স্কন্ধে দশম অধ্যায়ে আছে পুনপুনের ও বুনবুনের মৃত্যুবোধের ভিন্নতার কথা ও নচিকেতার কথা আছে, নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে মিলিয়ে রসিকতাও আছে।
এ ছাড়া আছে অধ্যায় নামে কিছু পাশ্চাত্য প্রসঙ্গ। প্রধানতঃ তৃতীয় স্কন্ধে। যেমন — ডার্ক নাইট অফ দা সোল-১, ডার্ক নাইট অফ দা সোল-২, লেট দেয়ার বি লাইট, জেনেসিস। শেষের দুটি তো বাইবেল থেকে। অধ্যায় নাম থেকেই বোঝা যায় তিনি পুরাণ প্রসঙ্গকে আধুনিক বাঙালি সামাজিক জীবন প্রসঙ্গে ব্যবহার করতে চাইছেন, তুলনার্থে, নব মাত্রা রচনায়। হরিবংশ-২ — কালো কুমু — যেখানে তিনি কালো কুমুর কথাই বলবেন। ২য় স্কন্ধর ৫ম অধ্যায়ের নাম — 'নিও-যশোদা'-- এই তুলনাকরণ অভিপ্রায় স্পষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া অধ্যায়ের নানা অভ্যন্তরে আছে পুরাণ কথা। কিন্তু বাণী বসুর অন্বিষ্ট দীর্ঘ একটা কালের বঙ্গীয় সমাজের আখ্যান রচনা, যেটা তিনি পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে বিন্যস্ত করতে চান, স্ট্রাকচারেও তার ছাপ আছে।
লিজেন্ডকে ব্যবহার করার রীতি অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। আবার জনপ্রিয় লোকনায়ক বা বিপ্লবী, সন্ত বা যোদ্ধা তাদের নিয়েও মৌখিক বা লিখিত লিজেন্ড বিকশিত হয়। Joseph Compbell তাঁর The Masks of God বইটিতে মানব আচরণের কিছু deep chord-কে শনাক্ত করেন, বাস্তবের কিছু ধ্রুপদী সাদৃশ্য দেখান। মিথ তার স্বভাববশতঃ সমষ্টিগত, সম্প্রদায়গত যা একটি ট্রাইব বা একটি নেশনকে বাঁধে তার মনস্তত্ত্বগত ও অধ্যাত্ম সক্রিয়তায়। একটা সর্বব্যাপকতা সময় ও স্থানে হয়ে ওঠে প্রযোজ্য, এই জঙ্গম বৈশিষ্ট্য সমাজে আছে, তার সময় সীমানা অতিক্রম করে যায়, অতীত ও বর্তমানকে বাঁধে, সনাতনী বিশ্বাস ও সাম্প্রতিক মূল্যবোধের সমন্বয়ে অভিমুখ Spiritual and Cultural aspirations. সাধারণতঃ আলোচকরা নির্ভরশীল ইতিহাস ও লেখক জীবন প্রসঙ্গের ওপর। মিথ ক্রিটিক আগ্রহী বেশিমাত্রায় Prehistory এবং দেবতাদের জীবনকথায়। মিথ ক্রিটিকের আগ্রহ inner spirit-এ যা ফর্মকে প্রাণবন্ত ও সহনশীল আবেদনময় ক্করে তোলে। 'অষ্টম গর্ভ' উপন্যাসে কৃষ্ণকথার পৌরাণিকতা ও মিথ আধুনিক জীবন ভাগ্যের উপস্থাপনায় আনা হয়েছে একালের অন্তর্লীন মানসকে প্রাণবন্ত করার লক্ষ্যে। এক্ষেত্রে পাঠককে ঔপন্যাসিক কৃষ্ণকথা ও পুরাণ প্রসঙ্গে কৌতূহলী ক'রে সমকালীনতায় দৃষ্টিসন্নত রাখতে চান।
প্রকাশিত বইয়ের প্রচ্ছদ পরিচয়ে বলা হচ্ছে (ক) আমাদের সর্ববিধ চেতনায় মিশে আছে কৃষ্ণকথা (খ) আমরা কৃষ্ণের অবতরণ প্রত্যাশী (গ) মহামানবের পুনরাবির্ভাবের স্বপ্ন আমাদের বিশেষত্ব। এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই কিন্তু সর্বজনীন আশঙ্কার ধারক হতে পারে না। বাঙালির চেতনার একটি অংশের মধ্যেই মাত্র সর্বাত্মক মিশ্রণ আছে কৃষ্ণকথায়। ইতিহাসনিষ্ঠ কোনো মানুষই মহামানবের লিজেন্ডারি আবির্ভাবের প্রত্যাশা করে না। বরং পরের মন্তব্যগুলো অনেকাংশে গ্রহণীয়। তা হল — (ক) তিনটি শিশুর বেড়ে ওঠার কাহিনী এ উপন্যাস। (খ) শিশু তিনটির বেড়ে ওঠার প্রেক্ষিত এক কালান্তক সময়। (গ) শিশুদের দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা আছে বড়োদের জগৎকে। লেখিকার দৃষ্টিকোণের চালিকাশক্তি — 'বস্তুজগৎ সেখানে অনবরত পুরাণ হয়ে যাচ্ছে আর পুরাণ হয়ে উঠছে বাস্তব।'
উপন্যাসের অন্বিষ্ট বাস্তব, একটা বর্তমানকে এক একজন নানাভাবে তুলে ধরতে, দেখাতে চান। এই বার্তমানিক বাস্তবকে কেন্দ্রে রেখে শিল্পী কখনও ঘুরে আসেন পুরাণ জগতে, একটা দেশের Cultural heritage-এর সঙ্গে বাস্তবের সমস্যা ও সংকটকে যুক্ত করতে চান। মেলভিল যেমন 'মবি ডিক'-এ, জয়েস যেমন 'ইউলিসিস'-এ, লরেন্স যেমন 'দ্য প্লুমড সার্পেন্ট'-এ মিথ মেটেরিয়ালের নানা কিছু ব্যবহার করেন, কালেকটিভ কনসাশনেস থেকে তার নিঃসরণ বাস্তব স্ট্রাকচারে অভিঘাত সৃষ্টি করতে চেষ্টা করে। বাণী বসু যেমন 'রাধানগর' বা 'অষ্টম গর্ভ' উপন্যাসে কৃষ্ণাশ্রয়ী, 'মৈত্রেয় জাতক'-এ বুদ্ধজীবন কথায়। বাণী বসু তাঁর 'জন্মভূমি মাতৃভূমি' থেকেই স্বদেশ ভাবনায় বেদনার্ত, 'উত্তর সাধক'-এ কুশিক্ষা, অশিক্ষায় দুঃখমনা। তিনি প্রধানত কুশল গানের শিল্পী, দেশব্যাপী কুশলতার অভাবেই তিনি উদ্বেল ও সক্রিয় কলমী। আসলে পুরাণ, মিথ মহিমা কীর্তন নয়, বর্তমানকে বুঝে নেওয়াই শিল্পীর কর্তব্য। বাণী বসু তাই উল্লেখ্য শিল্পী।
কথাসাহিত্যিক তাঁর চরিত্রায়ন, ন্যারেটিভ টেকনিক, প্রয়োজনীয় উৎকর্ষযুক্ত গদ্যশৈলী বিবেচনার মাধ্যমে ধরিয়ে দেন উদ্দিষ্ট উপন্যাসটির প্রকৃতি এবং মনে করিয়ে দেন ফর্ম এবং সাবস্ট্যান্স নিবিড়ভাবে যুক্ত। মৌল ন্যারেটিভ ক্রিয়াকর্মে তিনি যতটা সফল হন তার ওপরেই নির্ভরশীল উপন্যাসটি মূল্যবান ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার। 'Structure involves ideas and sensations of some sort of pattern: Completion, reiteration, contrast, repetition, complementarity — all of these and others can be invoked by a work's structure.' (Jeremy Hawthorn) মিরিয়াম অ্যালট বলেন ভার্জিনিয়া উলফের মতো লিরিক্যাল ট্যালেন্ট অভূতপূর্ব ভঙ্গুর কাঠামো নিয়েও সুদৃঢ়ভাবে গড়ে তোলেন এমন কিছু যা উপন্যাস হিসেবে মর্যাদা পেয়ে যায়। তাঁর The Waves উপন্যাস গড়ে তুলতে থাকে ছটি চরিত্রের শৈশব থেকে প্রথম তারুণ্য পার হয়ে বিড়ম্বিত মধ্যবয়স পর্যন্ত জীবন। এই গড়ে ওঠা একই নার্সারি, স্কুল রুম, উদ্যানে। তারা স্কুল যায় একই ধাঁচের ইমোশন, ভয়, আকাঙ্খা নিয়ে যা গড়ে উঠেছে শৈশবাবধি। 'অষ্টম গর্ভ' উপন্যাসের সঙ্গে মনে পড়ার অংশ মাত্র এইটুকুই। পুনপুন, বুজবুজ, বুবু তাদের অনুভূতি ও বোধের প্রায় সমত্ব, শৈশবের স্মৃতি এবং বর্তমানের বোধ, পারিবারিক মানুষজন ও তাদের মন মানসিকতা পর্যবেক্ষণ এ উপন্যাসের অন্যতম উপজীব্য। যদিও স্বাধীনতা, দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা এবং তজ্জনিত পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া একই 'সেটিং'-এ আধারিত। বাণী বসু যে স্টাইলটি নিয়েছেন তা আমাদের মনে পড়ায় প্রবোধ সান্যালের তুচ্ছ, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের পোনুর চিঠি, সতীনাথ ভাদুড়ীর অচিন রাগিনী প্রভৃতি। 'অষ্টম গর্ভ'-এর স্বাতন্ত্র্য একবারও কিন্তু ভুলছি না। বইটির তিনটি 'স্কন্ধ' অর্থাৎ পর্ব। প্রথম স্কন্ধের ষোলটি অধ্যায়ে ডাক্তার বাবা, মা, দাদামশায়, দু একজন বাইরের মানুষ, পিসিমা, ঠাকুমা, পমপম, ঠাকুর্দা প্রভৃতির কথা আছে। আবহ নির্মাণ করে নেন নিপুণভাবে। বর্ণনাভঙ্গিতে একদিকে যেমন আছে শিশুকল্পনার জগৎ, বড়ো হয়ে দেখা সামাজিক প্রসঙ্গের বিশ্লেষণ, পাশ্চাত্য প্রসঙ্গ যোগে উত্থাপন। ভাষার মধ্যে প্রথমাবধি তৎসম শব্দের পাশে মেগালোমেনিয়াক, ইনডিগনেশন, সুপার পাওয়ার, বা ইংরাজি বাক্য আছে যা ন্যারেশনে স্বতন্ত্র স্বাদ আনে। গান্ধার আর্ট, মোঙ্গলীয় ধাঁচের পার্থক্য, পরিণত মনের পরিচায়ক। জাতক, ধম্মপদ, কথামৃত, রাজযোগ, স্বামী শিষ্য সংবাদ উল্লেখ-ও তাই। 'তাত্ত্বিক বাঙালির সঙ্গে ব্যবহারিক বাঙালির এই সহাবস্থানের ব্যাপারটা নীরদ সি. ঠিকই বুঝেছিলেন' বা পুরো উপন্যাসে একাধিকবার সুভাষচন্দ্রের উল্লেখ, রবীন্দ্র শান্তিনিকেতন প্রসঙ্গে রক্ষণশীলদের কটাক্ষ এবং নানা স্বাদের (মধ্যযুগীয়, ছড়াপ্রতিম, সংস্কৃত) স্বরচিত কাব্যাংশ ধাঁধা ব্যবহার পাঠককে প্রাচীন ও নবীন শাস্ত্রাদিতে অভিঘাত বিষয়ে কৌতূহলী করে তোলে। বাক্যান্তর্গত শব্দের মিশ্র ব্যবহারও স্বতন্ত্র-স্বাদী। প্রতি স্কন্ধের প্রথম অধ্যায়টি সাধু ভাষায়, যা ন্যারেশন স্টাইলের পৃথকত্ব বোঝায়। ভাষায় কল্পনামুখ্যতা অপেক্ষা পরিশীলিত মনস্কতার, চকিত মন্তব্য প্রশংসার্হ। পৃ. ৬২-তে পথের পাঁচালির উল্লেখ না ক'রে 'সর্বজয়া দুগ্গাকে বড্ড মেরেছে'; পৃ. ৬৪-তে 'রেমব্রান্টের নাইট ওয়াচ ছবিটা দেখছি', 'শব্দটা নিয়ে কুলকুচি করে পমপম' (পৃ. ৬৭), 'ইনি বিভূতিভূষণের মেঘমল্লার গল্পের সেই আত্মবিস্মৃতা সরস্বতী' (পৃ. ৭৩), 'মুখের ডৌল গ্রিক দেবীদের মতো। হেরা কিংবা এথিনা।' (পৃ. ৭৩) 'শরৎচন্দ্রের যাদব - গিরীশের অরিজিন্যাল মডেল, আমার মামার বাড়িতে অঙ্ক নিয়ে বসে আছেন।' (পৃ. ৭৬) [এখানে দাদাভাই প্রসঙ্গে], 'বাঙালি ট্রেনযাত্রীদের মধ্যে ফাজিল ফক্কড় মিচকে পটাশরা তো সংখ্যায় নেহাত কম নয়।' (পৃ. ৮২) — কয়েকটি বিচিত্র ও চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টান্ত।
দ্বিতীয় স্কন্ধের 'পূর্বকথা' শীর্ষক প্রারম্ভে তিনি পিতা দুর্গাপ্রসাদের কলকাতা আগমন, জীবিত সন্তানদের, উড়নচণ্ডী জামাইয়ের, ভানুর বিবাহের, মৈরাং যুদ্ধের ক্ষণ-সাফল্যের, দুর্গাপ্রসাদের কলকাতাস্থ চিকিৎসক জীবনের কথা বলে নেন। ব্যক্তিগত ও দেশগত প্রসঙ্গের সম্মিলন বাণী বসুর অন্যান্য উপন্যাসের মতই এ উপন্যাসেও লক্ষ্য করা যাবে। পাঠক সম্বোধিত ভঙ্গিটি উপন্যাসটির আপাত প্রাচীন অবয়ব রক্ষার্থে সচেতন ভাবেই আনা হয়েছে এবং সাধুভাষায়। প্রথম অধ্যায় থেকেই তিন ভাই বোনের বাল্যলীলা, হরতাল দিবস পালন, যুদ্ধকালে সকালবেলার বিয়ে বাড়ি, নবকৃষ্ণ স্ট্রীটে প্রথম দফার মুসলিম শিকার, ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে, ছেচল্লিশের দাঙ্গায় মৃতদের সম্পর্কে ঠাকুর্দার মন্তব্য (যারা মরছে তাদের তিনি মেরেই রেখেছেন), দেশের জন্য মায়ের স্যাক্রিফাইস, নেতাজির সংস্পর্শে আসা দুর্গাপ্রসাদের খাঁটিত্ব, মন্বন্তর ও দাঙ্গার মধ্যে মন মানসিকতার সব কিছু গুলিয়ে যাওয়ার কথা আছে। ফাঁকে ফাঁকে হিরণ্যকশিপু নৃসিংহ মিশিয়েছেন। ধীবর ও দৈত্য, ক্রোমিল ক্লোরাইড এর গল্প, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের বই, ফুটবল প্রাণতা, ধুতিঐতিহ্য, স্নো হোয়াইট, সিন্ডারেল্লা, ঘুঁটে কুড়ুনি মেয়ের গল্প, নানা রূপকথা মিলিয়ে ন্যারেশনের এক বিরল কোলাজ গড়ে উঠতে থাকে। বারণাবতের জতুগৃহ, চৌত্রিশ সালের ভয়াবহ ভূকম্প, ময়দানব প্রসঙ্গ মুকেশ মধুবালা লতার গানে মুগ্ধতা, নেতাজীর আবির্ভাব আকাঙ্খা, প্রথম স্বাধীনতা দিবস, বাস্তব ও পুরাণের অতিবাস্তবকে মেলানোর চেষ্টা, বেলেঘাটায় মহাত্মা, মুমূর্ষু আশার এই আকাশ পারিবারিক সেটিং এ দেশকে আনার, এক লহমাও না ভোলবার ভঙ্গিটি স্পষ্ট করে। পঞ্চম অধ্যায়ে নিও-যশোদা ঠাকুমা পাকুমার একাধিক গল্পে বাস্তবে অলৌকিকে মিশে, কখনো অবনীন্দ্র স্টাইলে রাজকন্যে, কালনাগ, পাপীর নরকগমন, শিব ও শিবরাত্রি প্রসঙ্গ, মঙ্গলচণ্ডী ও জার্মান ইহুদী ইয়াওয়ের অনিবার্য ধ্বংসের ভবিষ্যৎবাণী, আব্রাহাম কর্তৃক আইজাককে বলি দিতে যাওয়া, যমদূতের মানুষ ভাজা, বিজয়কৃষ্ণ, বালানন্দ প্রসঙ্গের পাশে বুবুকে নিয়ে ছড়া, বড়ি দেওয়া, নানা রূপকের রাজ্য, পুরাণ ও বাস্তব, ধর্ম ও বাস্তবের মিশ্রণের স্টাইলটি অতি চমৎকার। ধ্রুবপদের মতো ভেসে ওঠে হবিবুর রহমান, লক্ষ্মী স্বামীনাথন, ছবিরাণীর মৃত্যু — সবগুলি অসম প্রসঙ্গকে তিনি সমগুরুত্ব দেন। স্বভাবত:ই 'নাচিকেত' অধ্যায়ে মৃত্যুপ্রসঙ্গ একটু অতিরিক্ত গুরুত্ব পায়, মৃত্যু, আত্মা, দর্শন প্রসঙ্গ ভারতীয় অধ্যাত্ম মানসকে, ফ্যানটাসির পাশে রামকৃষ্ণ, বঙ্কিম, দ্বারকানাথ, বিবেকানন্দ, নিবেদিতা, অ্যালিস রবসন মিশে যায়। বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের জানা ও অজানা উন্মোচন বেঁধে রাখে আখ্যানের ভিতটিকে। গিরিশ, শিশির, ইংরাজী আবৃত্তি, অরবিন্দ, বারীন, অমরেন্দ্র, ভূপেন ওঙ্কারনাথ, ফৈয়জ খাঁ, বদল খাঁ এক গৌরবময় ধ্রুপদী ঐতিহ্যের নানান মাত্রাকে, ক্রমবিকাশমান চেতনাকে শক্ত জমি দেয়। পাকুমার প্রায়োপবেশন, 'সত্যি সত্যি ঠাকুর হয়ে যাওয়া' মিশে যায় সুভাষের গৃহত্যাগের ঘটনায়। দুটোই মহাপ্রস্থান — লেখিকা একটু দূরত্ব রেখে সবকিছুকেই নির্লিপ্ত গুরুত্ব দিতে দিতে চলেন। বাস্তব ও অবাস্তবের মিলিত মিশ্রিত এই চিত্রায়ন একটা সার্থক নিরীক্ষা তো বটেই।
তৃতীয় স্কন্ধ শুরু হয় দুর্গাপ্রসাদের চিকিৎসালয়ে বসা, শ্যামপুকুরের সেটিং বর্ণনায়। সুভাষ অনুপ্রাণিত দুর্গাপ্রসাদের মধ্যে দেশ মাঝে মধ্যে চাগাড় দিয়ে ওঠে, যদুনাথ, রমেশ মজুমদারের বক্তব্য, স্বাধীন দেশের সরকার গঠনের স্বপ্ন, অনেক স্বপ্নের অচরিতার্থতা, দুর্গা ডাক্তারের, মনুষ্য প্রজাতির বিভাজন বিশ্লেষণ, পার হয়ে আখ্যান চলে উদ্বাস্তু সমস্যায় অর্থাৎ চল্লিশ দশকের উপান্তে। বাণী বসু দেখান উদ্বাস্তুদের মধ্যে জমে ওঠা তীব্র তিক্ততা, 'এক অদ্ভুত বেআক্কিলে স্বাধীনতা', 'একটা মাতাল, করাপ্ট, ভায়োলেন্ট সোসাইটি' গড়ে ওঠার বেদনালব্ধ এক গভীর হতাশাবোধ যাতে অনিবার্যভাবে সঞ্চারিত হয়ে আছে লেখকের দৃষ্টিকোণ। দ্বিতীয় অধ্যায়ে পরিবারের disintegration ও উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গীয়দের বিরক্তি এক সামাজিক বাস্তবতা তো বটেই। ম্যাধাবাবুর বীরত্ব, ভূতে বিশ্বাস, বড় মামার ভৌতিক বিশ্বাস। পুনপুনের নানা আজগুবি জিনিসে বিশ্বাস প্রভৃতির পাশে পাশে অনাদিপ্রকাশের মুখ দিয়ে কৃষ্ণের বিভিন্ন যুদ্ধে জীব উদ্ধারের 'লীলা' ব্যক্ত হয়, বুনবুন স্বপ্ন দেখে দূর ভবিষ্যতে আজাদ হিন্দ ফৌজ পাশ্চাত্য ভূখণ্ডের নানা অংশ জয় করে ফেলেছে। শিয়ালদহ স্টেশনে উদ্বাস্তুদের অবস্থান, একস্তনী মা, ইতঃস্তত নোংরা আবহ তার পাশে ধ্রুবপদের মতো বয়ে চলে কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস, লক্ষ্মী স্বামীনাথন, ক্যাপ্টেন সায়গলের গল্প, নজরুলের গান। শিশির ভাদুড়ির অভিনয় কথা, পাশে সাবিত্রী সত্যবানের ছবির সূত্রে জ্যাঠাইমার সঙ্গে সাদৃশ্য নির্ণয়। ষষ্ঠ অধ্যায়ে আসে আত্মার নানাবিধ অন্ধকারত্বের কথা, যদিও রবি ঠাকুরের খোঁজে বুবুর যাত্রা, বুজবুজদিদির অতুলপ্রসাদী আর্তিতে হাত ধরার আহ্বান, আমি কে, আমি কোথা থেকে এসেছি, কেন আছি এ পৃথিবীতে, চারপাশের মানুষরা কারা, বাপের ঘরের নদী ধলেশ্বরীর কথা উচ্ছে গাছে নতুন পাতা উদগমে ছাপিয়ে ওঠা আলোর স্পর্শ। সেজদি আর পুলকদার বিয়ে করে চলে যাওয়া, বাবার গর্জন, বুবুর পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসা, বাস্তুহারাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে বাবার চিকিৎসা অভিযান, আলো অন্ধকারের পৃথিবী, মনোপৃথিবীর নাট্যিকতা রচনা করে। বেঁচে থাকার জন্য আলো চাই, তাই উল্লিখিত হয় 'মাকে ভর করেন বুদ্ধ এবং যিশু এবং গান্ধী'। লেখিকা একবারও ভোলেন নি, পাঠককেও ভুলতে দিতে চান না 'নোংরামি ও চৌর্যবৃত্তিকে'। সারদাবাবু, ডাক্তার বাবুর বেদনাবোধ — 'আমাগ' নাইন্টি পার্সেন্ট ভদ্রঘরের কেউ না কেউ স্বরাজের জন্যে আন্দোলন করছে। .... বাংলার তো যা সর্বনাশ হইল।' একটা রেজিস্টান্স গ্রুপ তৈরির কথা ওঠে। সারদাবাবুর দুটি কথা তাৎপর্যপূর্ণ, যা লেখিকারও উপলব্ধি সঞ্জাত। (ক) 'আমাগ' প্রয়োজন এখন একটি কৃষ্ণ-অবতারের' এবং খ) সুভাষচন্দ্র 'তিনি কৃষ্ণরও বাড়া স্বার্থ দেখেন নাই, ব্যক্তিগত লাভের জইন্য লালায়িত হব না...।' কিন্তু — 'কলি কালে অবতার পুরুষেরও মির্যাকুলাস পাওয়ার থাকে না'। (পৃ. ৩১৩) তা-ই যদি হয়, তাহলে পরিত্রাণের উপায় কি? এই বৈপরীত্যের দ্বিধার ওপর উপন্যাসটি দাঁড়িয়ে আছে। নবম অধ্যায়ে আছে ছিন্নমূল বাঙালির বঙ্গদেশের নানাস্থানে উদ্বাস্তু শিবির থেকে ক্ষুধিত, আশাহত মরিয়া মানুষের বেঁচে থাকার উল্লেখ। আগেকার ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার চেষ্টা কি তবে স্বপ্নেই থেকে যাবে! নিভন্ত জ্যোৎস্না রাতে তিন কিশোরের নিদ্রা ও ঈশ্বরের 'নিশ্চিন্তে নিদ্রা'র মধ্য দিয়ে উপন্যাসটির পরিসমাপ্তি ঘটে। প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাবে।
বাণী বসু এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে (বইয়ের দেশ, জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০১৫) জানিয়েছেন 'অষ্টম গর্ভ' উপন্যাসে 'আমার বেড়ে ওঠার সময়টা লিখেছি। সেটা খুব ঘটনাবহুল। ছোট ছিলাম। তবু দেখেছি তো। মন্বন্তর, দাঙ্গা, স্বাধীনতা, তার কিছুকাল পর নকশাল মুভমেন্ট।' কিন্তু স্বাধীনতার পরই কংগ্রেস রাজত্ব, বামপন্থী রাজত্ব, কেন্দ্র রাজ্য সংঘাত — এসবের কথা নেই, নকশাল মুভমেন্ট তো নেইই। কোনো কোনো আলোচক বলেছেন — এ উপন্যাসে 'একটির পর একটি ছবি এসেছে' যা আমাদের মুগ্ধ করে। একেবারে ঠিক কথা। তাঁর 'ছড়া লেখার দক্ষতা' প্রশংসার্হ। তাঁর গদ্যভঙ্গি, গদ্য বাক্যের বিমিশ্র শব্দ ব্যবহার, চরিত্র চিত্রণের নিপুণতা, বিদগ্ধ সরসতা আমাদের মনে সাড়া যে জাগায় তাতে সন্দেহ নেই। অনেক শিশুজনোচিত কল্পনা ও আচরণ আমাদের সামনে বিলীয়মান এক জগৎকে উন্মোচিত করে। সময়ের প্রহারে যা আমরা হারিয়েছি, হারাচ্ছি ক্রমাগত।
চল্লিশের এই স্তম্ভিত সময়, তার মুহুর্মুহু বিস্ময় ও আতঙ্ক যে আমাদের মন্দপ্রবাহী জীবনকে উদ্বেল করে তুলেছিল তার সাক্ষ্য ইতিহাসে আছে, উপন্যাস গল্পে আছে। বাণী বসুও তাঁর মতো ক'রে এই সন্ধিক্ষণকে ধরতে চেয়েছেন, পাঠক বন্দিত হয়েছেন।
এই দেশপ্রীতিময় বাল্যতা সুরভিত উপন্যাসটি সম্পর্কে দুটি পর্যবেক্ষণ লেখিকার বিবেচনার জন্য উপস্থিত করি। (ক) 'শিশুর চোখে সত্য জগৎ প্রকাশিত'। কৈশোর কল্পনার অতিরেক ও মন্বন্তর দাঙ্গা উদ্বাস্তু জীবনের সঙ্গে কৃষ্ণ বাস্তবতা মেশাতে পারা বড়ো কঠিন কাজ। শিল্পের রসায়ন বড়ো শক্ত। ঠিক আছে 'প্রোপাগান্ডা লিটারেচার' করার দরকার নেই আবার স্বপ্ন কল্পনার অতিরেক কৃষ্ণ বাস্তবতার যাথার্থ্যকে মর্যাদা দেয় না, প্রশ্ন-ক্ষুব্ধ করে না, ভুলে গেলে চলবে না।
(খ) লেখিকা বলেছেন — 'কলি কালে অবতার পুরুষের ও মির্যাকুলাস পাওয়ার থাকে না।' (পৃ. ৩১৩) তাহলে কৃষ্ণ অবতার কি ভাবে বাঁচাবে সমষ্টিগত জীবনকে? স্বদেশী আত্মত্যাগের মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা? এই প্রশ্নমনস্কতা কিন্তু অতৃপ্ত থেকে যায়।
(দীর্ঘ ১৪ বছরের পরে 'অষ্টম গর্ভ' উপন্যাসের ২য় খণ্ড প্রকাশিত হয়। এর সমালোচনা পরে প্রকাশিত হবে।)
(পরবাস-৬৬, মার্চ ২০১৭)