Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines






পরবাসে
শ্রেয়সী চক্রবর্তীর

লেখা


ISSN 1563-8685




ফিরে পড়া বইঃ পূর্ণেন্দু পত্রীর “নায়িকা বিলাস”


নায়িকা বিলাস;--পূর্ণেন্দু পত্রী; অলংকরণ ও প্রচ্ছদশিল্পীঃ পূর্ণেন্দু পত্রী; প্রথম প্রকাশ: আশ্বিন ১৩৮২; প্রকাশকঃ বিশ্ববাণী প্রকাশনী, কলকাতা; ISBN: নেই

পূর্ণেন্দু পত্রীর পরিচয় বাংলা সাহিত্যপাঠকের কাছে নতুন করে ২০১৭ সালে দেওয়ার দরকার পড়লে বাঙালিকে আত্মবিস্মৃত জাতি বলা ছাড়া উপায় থাকেই না। এহেন অদ্ভুতকর্মা অস্তিত্বের এক অদ্ভুত সৃষ্টি “নায়িকা বিলাস”। যদিও তাঁর বিভিন্ন আঙ্গিকের কাজের ধারা লক্ষ্য করলে বোঝা সম্ভব তাতে নায়িকার অবস্থান বিশিষ্ট এবং প্রকট। ছবি পরিচালনা, কবিতা, উপন্যাস, চিত্রকলা, অলংকরণ সবেতেই ‘নায়িকা’র আভাস উদ্ভাস এবং সত্তার জয়ধ্বনি। “নায়িকা বিলাস” বইতে হয়তো লেখক সযত্নে সেই হিয়ামথিত নায়িকার আবরণ উন্মোচন করতে চেয়েছেন যিনি এই পৃথিবীর বুকে অপার্থিবা; যিনি জীবনের হিরকচূর্ণ মিশিয়ে কবিমানসের ছন্দোবন্ধ গ্রন্থগীতে ছেয়ে থাকা কল্পনালতা। যুগন্ধর কবির দল আকাশ ধ্বনিত করেছেন কালাতীত নায়িকার বিবিধ বর্ণনার কলোচ্ছ্বাসে। আর “নায়িকা বিলাস” বই যেন সেই সমস্ত নায়িকার নবনী মিশ্রিত কোমল পক্ষসম্পূট। প্রাচীন সংস্কৃত কাব্য সুপ্রাচীন পুরাণ কথা এবং প্রাচীনতর ভারতবর্ষীয় ধর্মজীবনের কেন্দ্রস্থল থেকে উঠে আসা বিভিন্ন নায়িকা এবং তাঁদের চারিত্র্যের চিত্রশালা এই বই, “নায়িকা বিলাস”। পৃথিবীর আদি নায়িকা “উর্বশী” থেকে শুরু করে বৈষ্ণব ধর্ম আন্দোলনের কেন্দ্রোত্থিতা কৃষ্ণের হ্লাদিনীশক্তিরূপা মহাভাবাধিষ্ঠাত্রী নায়িকা শ্রীরাধিকা হয়ে সুন্দ-উপসুন্দ কাহিনী খ্যাত তিলোত্তমা বা ব্রহ্মা-মানসজাতা কন্যা শতরূপা-সন্ধ্যা, স্বর্গাধিপতি ইন্দ্রজায়া শচী, দৈত্যকুলকন্যকা দেবযানী ও শর্মিষ্ঠার কাহিনী স্পর্শ করে বৌদ্ধযুগের জনপদবধূ আম্রপালী, কালিদাস রচিত রঘুবংশস্থিত ইন্দুমতী এবং শুদ্রক সৃষ্ট মৃচ্ছকটিকমের বসন্তসেনায় উপনীত হয়েছেন লেখক। সঙ্গে আছেন ভারতবর্ষীয় অন্ত্য-মধ্যযুগীয় কবি কেশব দাসের মধ্যদেশীয় কাব্য ‘রসিকপ্রিয়া’র নায়িকা রায় পারবিন বা রায় পরভিন! স্বাভাবিক এবং লক্ষ্যণীয় ভাবে এঁদের সকলেরই “রূপ লাগি আঁখি ঝুরে/ গুণে মন ভোর”।

“নায়িকা বিলাস” বইয়ের নাম যেন ফেলে আসা কালের ‘হরিভক্তিবিলাস’ ‘চিত্তবিলাসিনী’ ইত্যাদি এবং তদ্বিষয়ক নামের অনুসারী। অথচ আধুনিক বিজ্ঞানরহস্যভেদী মানুষের কাছে প্রমিথিয়াসের মতো আধুনিক দৃষ্টিতে পরিবেশিত হয়েছেন চিরন্তনী নায়িকারা। এবং তাঁরা দিব্য স্বমহিমায় বিরাজিতা। সেখানে যন্ত্রযুগের যন্ত্রমনের সামান্য ছোঁওয়া লাগতে দেননি লেখক। আসলে আধুনিক মানবের বিলাস সুপ্রাচীন নায়িকার লীলাতরঙ্গে। তাই কলমের তালে তালে নায়িকা কারা, কেন, কবে থেকে, কী হেতু ইত্যাদি কূট তত্ত্ব মীমাংসার সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ণেন্দু পত্রীর অনর্গল কলম থেকে উৎসারিত হয়েছে মধুসূদন দত্ত, প্রমথ চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নায়িকা বিষয়ক সারাৎসার। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের উজ্জ্বলমধুর আলোচনায় নায়িকাদের শ্রেণিবিভাজন কিম্বা ভাবলোকের বিশ্লেষণে লেখকের কলম অনবরত আকর্ষণীয় দ্যূতি বিস্তারে মগ্ন করে রাখে পাঠককে।

রমণীর মন সহস্রবর্ষের সখা-সাধনার ধন সত্যদ্রষ্টা কবির এই বাণীই নায়িকা-বিলাসের পাতায় পাতায় সত্যতর হয়ে উঠেছে। নারীমনের অন্তর্গূঢ় চলন, মনস্বিনী নারীর জীবনসৌকর্য এবং তৎসঞ্জাত প্রভাবে বিপরীত লিঙ্গের জীবন ঘূর্ণচক্রপথে কিভাবে প্রভাবিত হয়, হয়ে এসেছে, যুগে যুগে কালে কালে আর শুধু তাইই নয়, সমস্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাজনীতি কিভাবে নারীকে কামনা করেছে, কী ভূমিকায় ব্যবহার করেছে এবং কতখানি সীমারেখা তার আচরিত জীবন ও চর্যার প্রতি নির্দেশ করেছে তার এক সম্যক ঝলক ‘নায়িকা বিলাস’। ঘোরতর পিতৃতন্ত্রের অঙ্গনে দাঁড়িয়ে একুশ শতকে নিয়তই নির্মিত হচ্ছে দ্রোহকালের ভাঁজ। নারীর সে প্রতিরোধে খুব কম হলেও কিছু পুরুষ সহায় হচ্ছেন নিত্য। বাড়িয়ে দিচ্ছেন সহযোদ্ধার হাত। এই অবস্থান থেকে স্বভাবতই বৈদিক এবং তৎপরবর্তী সার সার নারীপ্রতিমার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে ঘিরে এই যে আয়োজনের ঘনঘটা, সেই রসাতুর বিবরণে পাঠকচিত্ত এবং মস্তিষ্ক ক্ষুরধার লব্ধানন্দভবতী। আর এই বইয়ের অসামান্য রূপবতী অলংকরণ পাঠ-রঞ্জিত হৃদয়ে রক্তরাগ বুলিয়ে দিয়ে যায়, যার অলোকসামান্যতা এ বই যাঁরা পাঠমাত্র করেছেন তাঁরাই একবাক্যে স্বীকার করবেন।

সমকালের অমেয় ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত নারীর সঙ্গে একই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে বিস্ময় জাগে লেখকের এই অদ্বিতীয় আইডিয়াকে রূপ দেওয়ার প্রয়াস-প্রণোদনা সম্পর্কে ভাবলে। একে তো স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা ন জানন্তি কুতঃ মনুষ্যাঃ! তারপর নারীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সৃষ্টিরহস্যের গভীর জটিল যাত্রাপথের আনন্দগান। অথচ আধুনিকতম কাল সভ্যতার বিস্তারে নারীসত্তার থেকে মুছে নিতে চাইছে সমস্ত আভিজাত্যের মহিমা অনিঃশেষ ফুৎকারে। মুছে যাচ্ছে নারীর ললিতমনের আবরণ, আভরণ জীবনের অনিশ্চয়তার সঙ্গে প্রতিপদে সংগ্রামে বিক্ষুব্ধ অর্থহীনতায়। নারীত্বের বিশেষত্ব যে কোন অসীম আকাশচর আনন্দের নাদ বহন করে আধুনিক সভ্যতা তাকে অস্বীকার করে চলেছে নাগাড়ে। আর পাশ্চাত্যের অনুকরণে প্রমত্ত প্রাচ্য কবেই ভুলেছে সম্মান। সুলভা রমণীর তকমা জুটে যায় নারীর তাই যে কোন পদক্ষেপে। প্রধর্ষিতা নারী আজ সমস্ত পৃথিবীর ভুলুন্ঠিতা অথচ শুদ্ধ হৃদয়াবেগের প্রতীক। অথচ এককালে এই ভারতবর্ষেই ছিল নারী বিষয়ে জ্ঞানলাভের গাঢ় আকাঙ্ক্ষানুভূতি। নিরবধিকালের ইতিহাস জুড়ে থাকা নারীকে জানার তাই শেষ ছিল না চিন্তাশীল, দার্শনিক ও শাস্ত্রজ্ঞ পুরুষের; মনের ফুল্লকুসুমিত বনপথে কোমলাঙ্গী নারীকে অসংকোচ আহ্বান জানাতেন প্রেমিক, কবি, নর্তক ও অভিনেতা। নক্ষত্রের মতো দীপ্ত শাশ্বতী নারীর প্রতি ধ্যানবিন্দুর পর্যালোচনা করা হয়েছে ভারতীয় রস এবং অলংকারশাস্ত্রে। আর সেই গভীর আলোচনার স্পন্দন স্পর্শে ধরে দিয়েছেন পূর্ণেন্দু পত্রী একালের পাঠকের হৃৎকমলে।

সাহিত্যদর্পণ, নাট্যশাস্ত্র, কামসূত্র, অভিনয়দর্পণ, বৈষ্ণব রসশাস্ত্র ইত্যাদি সুপ্রাচীন জীবনবেদ অনুসারে নারী (যে নারী স্বভাবতঃই নায়িকা) পদ্মিনী, চিত্রিণী, শঙ্খিনী, হস্তিনী, স্বকীয়া, পরকীয়া, সামান্যা, মৃগী, বাড়ব বা অশ্বা, হস্তিনী (পূর্ববর্তী হস্তিনীর থেকে ভিন্ন অর্থে প্রযুক্ত), বালা, তরুণী, প্রৌঢ়া, বৃদ্ধা, সমস্ত-রস-কোবিদা, বিচিত্র-বিভ্রমা, আক্রামিতা, লব্ধাপতি, বাসকসজ্জিতা, বিরহখণ্ডিতা, স্বাধীনাপতিকা, কলহান্তরিতা, খণ্ডিতা, বিপ্রলব্ধা, প্রোষিতভর্তৃকা, অভিসারিকা, মুগ্ধা, মধ্যা এবং প্রগল্‌ভা এমত বিভিন্ন ধরনের ও পর্যায়ের হতে পারেন। তার বিশদ বিবরণে সুস্নিগ্ধ ‘নায়িকা বিলাস’। সাহিত্যের কুঞ্জে মধ্যা নায়িকার আবাহন সর্বত্র। নায়কের সঙ্গে কথোপকথনের ধারানুসারে আবার ‘মধ্যা’ নায়িকা তিন রকম হয়ে ওঠেন — ধীরা, অধীরা, ধীরাধীরা।

“নদীর আবেগ যেমন উচ্ছ্বসিত তার তরঙ্গমালায়, অরণ্যের আবেগ যেমন আন্দোলিত তার শাখা প্রশাখায়, মেঘের আবেগ যেমন বিদ্যুৎচ্ছটায় ও বর্ষণে” ... তেমনি প্রসিদ্ধ, সুপ্রসিদ্ধ বা অপ্রসিদ্ধ নারী নায়িকার মনোজগতের প্রত্নকেতকী রূপের হাব ও ভাব অপরিহারযোগ্য নায়িকার বিভিন্ন আচরণে। বিভাব, অনুভাব, স্থায়ী, সদ্‌ভিকা, ব্যভিচারী ভাবের খেলা নায়িকার নিত্যজীবনে। আর লীলা, বিলাস, ললিতা, বিচ্ছিতি, বিভ্রম, কিলকিঞ্চিতা, মুচ্ছয়িতা, বিবোকা, হেলা, বোধক, কুচ্ছমিতা, মদ, বিকৃত আদি পরিস্থিতি নায়িকার রূপনির্মাণে একান্ত ক্রিয়াশীল। এক্ষেত্রে রূপ কেবল সৌন্দর্যসুসার নয়। সমগ্র নারী চরিত্রের কলানির্মাণ। এমনকি এই পুরুষ-প্রকৃতির আন্তর্বিনিময়ে হয়ে উঠতে পারে অদ্বিতীয়া। যেমন রাজা ভঙ্গাস্বনের কাহিনীটি সাক্ষ্য দেয় নায়িকাবিলাসের পাতায়। নারীর এই লীলায়িত প্রস্ফুটনের সঙ্গে সঙ্গেই লেখকের কলম বলে ওঠে পুরুষের কূটনীতি আর ছলনার কথা। এমনকি দেবপুরুষও রেহাই পান না আত্মবিধ্বংসী হিংসার লেলিহান শিখা থেকে। বার বার ফিরে ফিরে আসে তাই অহল্যা আর দময়ন্তীর কাহিনী। কানে কানে উদ্ধৃত হয় রাজা নহুষ আর লোমপাদের পৌরাণিক কথন। আর এই সব কথা ও কাহিনীর হাত ধরে আসে নারী-পুরুষ সম্পর্কের অচ্ছেদ্য অঙ্গ ‘সংকেত’-এর প্রকারভেদ এবং উপস্থাপনরীতি বিষয়ক মনোগ্রাহী আলোচনা। এই বই পড়তে পড়তে বাস্তববোধ প্রায় রহিত হতে বসে যখন, ঠিক তখনি ক্ষীণতনু বইটি ফুরিয়ে যায় পাতা উল্টানোর অছিলায়!

মনে জাগে রবীন্দ্রনাথের কলমে চারুলতার বয়ানে বঙ্কিমী নায়িকার রূপের আধিক্য সম্পর্কে বিরূপ ভাবনা। আরো এক রবীন্দ্র-নায়িকা ছিন্নপত্রের মৃণালের অপরূপ রূপ ছাড়িয়ে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ বড় হয়ে ধরা পড়া শ্বশ্রূকুলের কারান্তরালের নেপথ্যচারীদের কাছে, (যেন অপরাধ!) আর এই মৃণালই জেগে ওঠে পূর্ণেন্দু পত্রী নির্দেশিত চলচ্চিত্রের মূলস্তম্ভ হয়ে, তার সবটুকু আশা বিশ্বাস বিদ্রোহ মৃত্যুর অধিকারের অভিজ্ঞান তার নিজের হাতে নিয়ে। কবিমানসীর সেই নিজস্বতার সূত্রেই হয়তো স্রষ্টার অজ্ঞাতে যুক্ত হয়ে যায় আবহমান ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার পথচারিণী নারীর বিভিন্ন মেয়েবেলা। নারীর সহাস্য বিকচ-কিরণ সত্তার সামান্যতম উত্তাপ পাওয়ার জন্য মুগ্ধহৃদয় পুরুষ যখন বেদনায় অস্থির তখন গান ধরেন বড়ে গোলাম আর রচিত হয় “নায়িকা বিলাস”।।



(পরবাস-৬৬, মার্চ ২০১৭)