ফার্স্ট এসির ক্যুপে ঢুকে অনি দেখলো ওর ওপরের বার্থ। ভালোই হয়েছে। সুটকেসটা সীটের তলায় গুঁজে দিয়ে এক ঝটকায় ওপরের বাঙ্কে উঠে পড়লো অনি। হাতের পাতলা ব্রিফকেসটা মাথার কাছে খাড়া করে রেখে, হাতটা চোখের ওপর ভাঁজ করে শুয়ে পড়লো। অপরিচিত সহযাত্রীর সঙ্গে “কদ্দুর যাচ্ছেন” গোছের খেজুর করার মতো মনের অবস্থা এখন অনির নেই।
এভাবে ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে শুয়ে পড়া ঈষৎ বিপদজনক। বিশেষত ট্রেন ছাড়তে যখন আরও কুড়ি মিনিট বাকি আছে। কোথায় যেন অনি পড়েছিলো যে ট্রেনে যতো চুরি হয় তার সত্তর শতাংশ এই সময় হয়ে থাকে। হলে হবে – ওই নিচের সুটকেসে তেমন দামী কিছু নেই। যা দামী, তা ব্রিফকেসেই আছে।
আজ অনির মনটা একদম ভালো নেই। বড্ডো পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ছেলেবেলার কথা। স্কুলের কথা। বাবার কথা।
ছোট্ট একটি মফঃস্বলী শহরে অনির ছেলেবেলা কেটেছে। সেখানে একটি মাত্র স্কুল। সেই একমাত্র স্কুলের হেডমাষ্টারমশাই ছিলেন ওর বাবা। দীঘল ঋজু চেহারা ছিলো তাঁর - ব্যাকব্রাশ করা চুল, চওড়া কপাল, কপালের মাঝখানে একটা সামান্য দাগ - যেটা আলো পড়লে চকচক করতো। মনে হতো তিলক কেটেছেন। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী আর ধুতি বা পায়জামা পরতেন, কাঁধে থাকতো একটা শান্তিনিকেতনী ঝোলা। চশমার হালকা কাচের আড়ালে দেখা যেতো ওনার অমলিন চোখদুটো। হাসিটি ছিলো ভারী সুন্দর – স্নিগ্ধতা আর শুদ্ধতা মিলে মিশে থাকতো তাতে।
অসম্ভব মার্জিত রুচির মানুষ ছিলেন অনির্বাণবাবু – অনির বাবা। আন্তরিক এবং প্রবলভাবে আদর্শবাদী। ব্যক্তিগত জীবনে এবং জীবিকাতেও। শিক্ষকতা ওনার কাছে পেশা নয়, সাধনা ছিল। স্কুল এবং ছাত্রছাত্রীদের প্রতি একেবারে নিবেদিত প্রাণ । সেই জন্যেই উনি সন্দেহাতীতভাবে শহরের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবও গাড়ি করে যাবার সময় পথে অনির্বাণবাবুকে দেখলে গাড়ি থেকে নেমে প্রণাম করতেন – যদিও বয়েসের তফাৎ বিশেষ ছিলো না।
অনির্বাণবাবু ওনার বয়ঃকনিষ্ঠ অন্যান্য শিক্ষকদের কাছে এক উজ্জ্বল উদাহরণ ছিলেন। অধিকাংশই ওঁনার দ্বারা অনুপ্রাণিত – এক অর্থে ওঁনার শিষ্যই ছিলেন। কেউ কেউ অনির্বাণবাবুর বাড়িতে আসতেন সন্ধ্যায় – সাহিত্য আলোচনা বা স্কুলের উন্নতির কোন আলোচনা করতে। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায়ই লোডশেডিং হতো – হ্যারিকেনের আলোয় আলোচনা চালু থাকতো। অনির কাজ ছিলো রান্নাঘর থেকে চা আর কাঁসার একটা মস্ত বাটিতে নারকোল মেশানো মুড়ি এনে দেওয়া । বারান্দার এক পাশে মোড়ায় বসে এঁদের কথা শুনতে শুনতে অনির মনের জানলা খুলে যেতো। সেই জানলা দিয়েই প্রথম ভেসে এসেছিলো চাকরি না করে সায়েন্টিস্ট হবার ইচ্ছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো অনি। ভালো রেজাল্ট করলো, বিজ্ঞান পড়লো, সায়েন্টিস্টও তো হলো। কিন্তু কি যেন একটা হলো না।
কেন হলো না কে জানে। আই আই টি থেকে পাশ করে বিদেশে পড়াশোনা করে দেশে ফিরলো অনি। কলকাতার থেকে অনতিদূরে একটি নামী সরকারী রিসার্চ ইন্সটিট্যুটে যোগ দিলো। কিছুদিনের মধ্যেই অনি নাম করে ফেললো ওই ইন্সটিট্যুটে। তরতর করে উন্নতি হতে লাগলো। সরকারী পুরস্কারও জুটে গেলো দু-একটা। এদিক ওদিক কিছু পেপার প্রকাশিত হলো। তারপর...
তারপর কি হলো সেটা অনি ঠিক বুঝতে পারলো না। শুধু অনুভব করলো একটা অদৃশ্য দেয়াল এসে গেছে ওর সামনে। বা একটা কাচের সিলিং, যেটা টপকে ও আর এগোতে পারছে না। সেটা পলিটিক্স, প্রতিদ্বন্দ্বিতা নাকি প্রতিভার অভাব, অনি জানে না। শুধু বুঝলো ওর কেরিয়ারে এবার ভাঁটার টান এসে গেছে। এবং এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ ওর জানা নেই।
কামরার দরজা খোলার আওয়াজ হলো। সহযাত্রীটি ঢুকলেন মনে হচ্ছে। সুটকেস ঢোকানোর আওয়াজ, কুলির “নমস্তে সাব”, দরজা বন্ধের আওয়াজ – তারপর ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেন ছাড়লো। অনি চোখ বুজেই রইলো। যতক্ষণ থাকা যায় এভাবে।
বেশিক্ষণ সে সুখ সইল না অবশ্য। একটু বাদেই বেয়ারা এলো চা আর একরাশ খাবার নিয়ে। রাজধানীর ফার্স্ট এসিতে এই এক ঝামেলা – খাইয়ে খাইয়েই মেরে ফেলবে এর! “নিচে রাখিয়ে, হাম উতার রাহা হ্যাঁয়” বলে রেলিং ধরে ছোট্ট ওই সিঁড়ির ধাপে ব্যালেন্স করে নেমে পড়লো অনি। তারপর সহযাত্রীটির দিকে তাকিয়ে একেবারে থ!
কারণ ওর সহযাত্রীটি আর কেউ নন, ওঁর বাবার বয়ঃকনিষ্ঠ সতীর্থ - ওর স্কুলের প্রাক্তন সায়েন্স টিচার - সমীরণবাবু। ওঁর বাবার প্রকৃত মন্ত্রশিষ্য এবং সন্ধ্যার আড্ডার নিয়মিত সদস্য। অনির বাড়িতে কোনার ডান-হাতা-ভাঙ্গা চেয়ারটা একরকম ওনার জন্যেই বাঁধা ছিলো।
সমীরণবাবু অনির ছেলেবেলার অনেকটা জুড়ে আছেন। অনির বাবার মতাদর্শে দিক্ষিত হলেও সমীরণবাবু পোশাক আশাক বা ব্যবহারে অনেকটাই একেলে ছিলেন। কর্ডুরয়-এর প্যান্ট আর রঙিন সার্ট পরে স্কুলে আসতেন, চোখে সানগ্লাস। বেশ হ্যান্ডসাম চেহারা ছিল ওনার, তার সঙ্গে ঝকঝকে স্মার্টনেস। দারুণ কথা বলতেন, ভালো গান গাইতেন, বহু বিষয়ে অগাধ জ্ঞান ছিলো ওনার। অঙ্কে ও সায়েন্সে দুর্বল ছাত্রদের বাড়িতে ডেকে পড়াতেন বিনাপয়সায়, অনেক সময় রেফারেন্স বইও ধার দিতেন। ছাত্রদের ছোটোখাটো দোষত্রুটি নিয়ে বেশি জল ঘোলা করতেন না, তবে সেটা যে অন্যায়, তা বুঝিয়ে দিতেন। ক্লাসের পরে সিনেমা বা খেলা নিয়ে আলোচনায় অবলীলায় যোগ দিতেন ছাত্রদের সঙ্গে। পেলে বড় না মারাদোনা, সত্যজিৎ না ঋত্বিক – এই সব তর্কে সমীরণবাবু সক্রিয়ভাবে ছাত্রদের সঙ্গে মিশে যেতেন বড় দাদার মতো। সেই অর্থেই সমীরণবাবু অনেক ছাত্রের দাদাই ছিলেন, অনিরও। তাই সমীরণবাবু স্কুল ছেড়ে দিচ্ছেন শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলো অনি।
অনির বাবা আটকাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যখন শুনলেন যে সমীরণবাবু উচ্চশিক্ষার জন্যে বিদেশ যেতে চান, বাধা দেন নি। শুধু যাবার আগের দিন বাড়িতে ডেকে এনে খাইয়েছিলেন ভালো করে। অনির মা অনেকগুলো পদ করেছিলেন, সামনে থেকে পরিবেশন করেছিলেন। খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন সমীরণবাবু - তারপর এঁটো হাতেই অনেকক্ষণ গল্প হয়েছিলো সেই রাত্রে। বাড়ি যাবার আগে অনির বাবাকে প্রণাম করেছিলেন সমীরণবাবু। অনির বাবা ওঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। চলে যাবার পর অনির্বাণবাবু অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন অন্ধকার বারান্দায়।
অনির বৈজ্ঞানিক হবার স্বপ্নের পালে সেদিন আবার হাওয়া লেগেছিলো। বাবা মা কে কাঁদিয়ে এই মফঃস্বল ছেড়ে সুদূর বিদেশে চলে যাবে, পড়াশোনা করে দেশে এসে বিজ্ঞানের সেবা করবে, দেশের সেবা করবে – অনেক নাম, খ্যাতি - এরকম অনেক তালগোল পাকানো স্বপ্ন দেখেছিলো অনি সেই রাত্রে।
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো অনি। “চিনতে পারছেন স্যার? আমি অনি।”
“আরে অনি!! হ্যাঁ, বলে দেবার পর চিনতে পারছি বটে।” বললেন সমীরণবাবু। “কেমন আছো? বাড়ির সবাই কেমন?”
চা খেতে খেতে গল্পে মসগুল হয়ে উঠলো অনি। অনেকদিন পরে দেখা, বলবার অনেক কিছুই জমে গেছিলো। সমীরণবাবুও নিজের কথা অনেকটাই বললেন। আমেরিকায় পড়াশোনা করে ওখানকার একটি রিসার্চ ইন্সটিটিউটে যোগ দেন। পরে চলে যান ক্যানাডা, সেখান থেকে বেলজিয়াম, তারপর জার্মানি, অবশেষে সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরে প্রাইভেট একটি কোম্পানির রিসার্চ কেন্দ্রে যোগ দেন। এখন রিটায়ার করেছেন, কনসালটেন্সি করেন দু তিনটে প্রাইভেট কোম্পানির হয়ে। সিঙ্গাপুরে থাকেন, একা। বিয়ে করেননি। দেশে এসেছেন ধানবাদে ওঁর এক আত্মীয়ের বিয়েতে যোগ দিতে।
চেহারাটা এখনো ধরে রেখেছেন সমীরণবাবু, মনে মনে ভাবলো অনি। ছিপছিপে চেহারা, চুল বিশেষ পাকেনি – শুধু জুলফির কাছে একটু সাদা ভাব। কথাবার্তায় সেই পুরনো ধার, চোখের দৃষ্টিতে সেইরকম বুদ্ধির ছাপ। আর্থিক অবস্থাও নিশ্চয়ই ভালো – পোশাক আশাক দামী, হাতের ল্যাপটপটা ম্যাকবুক, ফোনটাও আইফোন-এর নতুন মডেল। রিসার্চ করলেই যে মধ্যবিত্ত হয়ে থাকতে হবে, সেটা বিদেশে থাকলে প্রযোজ্য নয়, তা আরেকবার অনুভব করলো অনি। একটা দীর্ঘশ্বাসও ফেললো। মনটা আবার এলোমেলো হয়ে যেতে লাগলো।
কথাবার্তায় একটু ভাঁটার টান এলো যখন বেয়ারা খাবারের অর্ডার নিতে এলো। অর্ডারটা দিয়ে “একটু আসছি” বলে বাথরুমে গেলো অনি। বাথরুম সেরে বাইরের প্যাসেজে দাঁড়িয়ে ট্রেনের দরজাটা খুলে দিলো। তারপর প্রবল হাওয়ার মধ্যেও হাত চাপা দিয়ে কায়দা করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললো। তাতে লম্বা টান দিয়ে চোখ বুজে আবার ভাবনায় ডুব দিলো অনি। ভাবনার সমুদ্রে বড্ড ঢেউ উঠছে গত কদিন ধরে।
এই প্রফেশনাল জগতে আটকে যাওয়া, এই হতাশা যে ভেতরে ভেতরে ওকে এতোটা ফাঁপা করে দিয়েছে অনি বুঝতে পারেনি। টাকাপয়সার অভাবটা তো কিছুটা আছেই। এই সব মিলিয়ে যখন হতাশা তার নিত্যসঙ্গী, তখনই এক সতীর্থর সুত্রে খবর পায় ইনোভেশন্স অ্যান্ড লাইফ কোম্পানিটার। সংক্ষেপে আই-এ-এল। যারা বিভিন্ন দেশ বিদেশের বৈজ্ঞানিকদের কাছ থেকে তাদের রিসার্চ ভালো টাকায় কিনে নেয়। শুধু তাদের রিসার্চ নয়, তারা যে ইন্সটিটিউটে কাজ করে তার কাজও। বিশেষত ডিফেন্সের রিসার্চ সংক্রান্ত কাজ। সোজা বাংলায় যাকে বলে দালাল।
কিছুটা বাধো বাধো ভাবে আই-এ-এল এর উদ্দেশ্যে অনি একটা আলগা ই-মেল করেছিলো। আই-এ-এল উত্তর দেয় প্রায় সঙ্গে সঙ্গে – এবং প্রবল উৎসাহ নিয়ে। সম্ভবত ওর রিসার্চটা ডিফেন্স-জনিত বলেই। মিঃ স্পেন্সার নামে আই-এ-এল-এর একজনকে অনির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয় – ওদের ভাষায় তিনি হলেন অনির “হ্যান্ডলার”। স্পেন্সার নামটা নিঃসন্দেহে ছদ্মনাম – তবে সে নিয়ে ভাবার দায়িত্ব অনির নয়। সে স্পেন্সারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করে।
ইন্সটিটিউটের কাজের বাইরে অনি কিছু নিজস্ব রিসার্চ করেছিলো – সেগুলো কিছু কিছু স্পেন্সারকে পাঠাতে শুরু করে অনি। স্পেন্সার বেশ উৎসাহের সঙ্গে সেগুলো গ্রহণ করে। কিন্তু এভাবে মাসতিনেক চলার পর স্পেন্সার কাজের কথায় আসে। অনির নিজস্ব রিসার্চ নয়, আই-এ-এলএর আসল আগ্রহ ইন্সটিটিউটএর কাজের ব্যাপারে। অর্থাৎ একটু প্রফেশনাল এথিক্সে মোচড় মেরে দুটো বাড়তি পয়সা উপার্জন নয়, সরাসরি তস্করবৃত্তি। দোনামোনা করতে করতে একসময় রাজি হয়ে যায় অনি।
টাকার অঙ্কটা কম নয়। প্রথম কিস্তিতেই ৫০,০০০ ডলার। সেটাকে কিভাবে দেশী টাকায় বদলাবে, সেসব ব্যবস্থা স্পেন্সারই করে দিয়েছে। কোন ভুয়ো কোম্পানির সাহায্য নিতে হবে, সে সব বলে দিয়েছেন। সেই ভুয়ো কোম্পানির মালিক – মিঃ সমাদ্দার-এর সঙ্গে অনির কথাও হয়েছে। ধরা পড়ার সম্ভবনা প্রায় নেই বললেই চলে। বরং এই দিয়ে শুরু হবে অনির সমৃদ্ধ “অন্য” জীবন। এরকম আরও কয়েকটা দাঁও মারতে হবে অনিকে। তারপর বিস্তর টাকা নিয়ে মানে মানে সরকারী চাকরী থেকে স্বেচ্ছা-অবসর। সেই বাবদ আরও বেশ কিছু টাকা। তারপর স্পেন্সার বলে রেখেছে – ওনার সাহায্যে বেসরকারী কোন সংস্থায় কনসালটেন্সির ব্যবস্থা করে দেবেন । বিদেশে গিয়ে বসবাস করতে চাইলে তাও সম্ভব। অর্থাৎ অনির জীবনটা একেবারে পালটে যাবে। যদি শেষ অব্দি এটা অনি পেরে ওঠে, তবে।
রিসার্চের কাজগুলো আছে একটা পেন ড্রাইভে। ওদের সারভার-এর থেকে কপি করা অত্যন্ত কঠিন – বহু স্তরের সিকিউরিটি রয়েছে। ও অনেকটা অ্যাকসেস পেয়েছে এই দিল্লির সেমিনারটায় পেপার প্রেজেন্ট করবে বলে। এই বাবদ অনেক ডাটা নিয়ে ওকে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়। তারই ফাঁকে এই পেন ড্রাইভে কপি করেছে অনি। সেই পেন ড্রাইভ এখন ওঁর ব্রিফকেসে। চামড়ার পাউচের জীপ দেওয়া পকেটে।
কিন্তু স্মৃতি বড্ড জ্বালাচ্ছে অনিকে। বাবা চলে গেছেন প্রায় দশ বছর হলো, কিন্তু তার ওই শান্ত নিষ্পাপ চোখদুটো বারবার সামনে এসে পড়ছে। মা চলে গেলেন দু বছর আগে, তাঁর কথাও মনে পড়ছে। আর আজ আবার সমীরণবাবু কথা থেকে উদয় হয়ে ওকে আরও টলিয়ে দিলো।
“দুত্তোর” – বলে হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘাড় ঘোরাতেই অনি দেখলো সমীরণবাবু ঠিক ওর পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। মুখে একটা মৃদু হাসি, কিন্তু সেই স্কুলের দিনের মতন অন্তর্ভেদী চোখ। মনে হয় মনের ভেতর অবদি দেখে ফেলছেন।
“চলুন স্যার” বলে ফেরত যাবার জন্যে পা বাড়ালো অনি। কিন্তু এগোবার আগেই ওর পিঠে একটা হাত এসে পড়লো। অসীম মমতা আর অনুভূতি মেশানো একটা হাত। অনি একটু থমকে গেলো।
“অনি – তুমি কেমন আছো বলো তো। সত্যি করে?” স্যারের গলাটা খুব নরম শোনালো অনির কানে।
উত্তর না দিয়ে কামরায় ফিরে এলো অনি। মাথা নিচু করে।
সমীরণবাবু একটু বাদে এলেন কামরায়। অনির পাশে বসে ওর কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন “অনি – তোমার ক্লাস এইটে অঙ্ক পরীক্ষার কথা মনে পড়ে?” বলতেই বিদ্যুৎ চমকের মতো সেই দিনের স্মৃতি ফিরে এলো অনির।
অঙ্কে অনি বরাবর ভালো। চিরকাল একশো বা তার কাছেই ঘোরাফেরা করেছে ওঁর নম্বর। সেবারের ফাইনাল পরীক্ষায় দু দুটো অঙ্কে একেবারে দাঁত ফোটাতে পারলো না অনি। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে হতাশ হয়ে শেষে সেই কাজটাই করে বসলো ও - যা জীবনে কখনো আর করে নি। ওর পাশের ছেলের খাতা থেকে অঙ্কদুটি টুকে নিয়েছিলো অনি। সম্পূর্ণ নয়, প্রথম দুটো স্টেপ – কিন্তু অনির মতো তুখোড় ছাত্রের কাছে তাই যথেষ্ঠ । ওই দুটো স্টেপ টুকে নিয়ে বাকি অঙ্ক নিখুঁতভাবে কষে ফেলেছিলো অনি। দুটো অঙ্কই। পরীক্ষা শেষে খাতা জমা করে দিয়েছিলো। ইনভিজিলেটার ছিলেন সমীরণবাবু। খাতা জমা দেবার সময় কিছু বলেননি - শুধু চশমার মধ্যে দিয়ে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ছিলেন। আর একটু দাঁড়িয়ে যেতে বলেছিলেন।
সবাই চলে যাবার পর সমীরণবাবু অনির সঙ্গে কথা বলেছিলেন। একটুও গলা তোলেন নি, রাগও করেন নি। শুধু খুব ঠাণ্ডা গলায় অনিকে বলেছিলেন যে উনি সব দেখেছেন। এবং এর শাস্তিস্বরূপ অনিকে নিজের দোষ স্বীকার করে ওনাকে একটি চিঠি দিতে হবে । বাংলা লেটাররাইটিং-এ অতি দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও এই চিঠি লিখতে অনির ঘাম বেরিয়ে গিয়েছিলো। বিশেষত এই জন্যে - যে সমীরণবাবু বলেননি এই চিঠি নিয়ে উনি কী করবেন। বাবাকে দেবেন কি? দুর্ভাবনায় সারা রাত ঘুমতে পারেনি অনি। পরদিন সকালে এসে চিঠিটা দিয়েছিলো সমীরণবাবুর হাতে। মাথা নিচু করে দিয়েছিলো, কারণ সমীরণবাবুর সঙ্গে চোখ মেলাবার সাহস হয় নি সেদিনও।
সমীরণবাবু চিঠিটা নিয়েছিলেন। খোলেননি। বন্ধ চিঠিটা অনির সামনেই ছিড়ে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন “এই চিঠি লিখতে গিয়ে তোমাকে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে অনি। আমি ওইটুকুই চেয়েছিলাম। তোমার অন্তরের অন্য তুমিই তোমাকে তোমার দ্বিধায়, দ্বন্দে, শঙ্কায় তোমায় পথ দেখাবে। আমি তোমায় আর কি শাসন করবো।"
“সেদিনকার মতো তোমার হয়তো আবার অন্য তুমির মুখোমুখি দাঁড়াবার দরকার অনি।" সমীরণবাবুর গলা ভেসে এলো। “আমাকে নিজের আয়না বলে মনে করো অনি। মনে করো আমাকে নয়, নিজেকেই বলছো, নিজেকেই প্রশ্ন করছো।"
দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো অনি। তারপর আস্তে আস্তে বলতে থাকলো তার নিজের কথা।
বেয়ারা এক সময় খাবার দিয়ে গেছে। দুজনের কেউই তাতে হাত দেয় নি। একসময় অনির কথা ফুরিয়ে গেলো। সমীরণবাবু কিছু বললেন না। স্তব্ধতা ভেসে রইলো বাতাসে।
“আমি কি করবো স্যার”, জিজ্ঞেস করলো অনি। ক্লাস সেভেন বা এইটে যেমন জিজ্ঞেস করতো সমীরণবাবুকে। কিংবা নিজের বাবাকে।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সমীরণবাবু। “অনি – আমি আজ তোমার মাষ্টারমশাই নই। আর তুমিও স্কুলের অপরিণত বালক নও। আমরা দুজনেই জানি যে আদর্শর পাশাপাশি অনেক বাস্তব প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপারও থাকে। আদর্শের জন্যে কতটা শক্ত থাকবে তুমি, সেটা বলা সহজ নয়।”
“বাবা হলে কখনই এই পথে যেতেন না – তাই না স্যার?”
“সম্ভবত নয়। কিন্তু উনি অন্য যুগের মানুষ ছিলেন। অন্য মানসিকতার। ওইরকম চারিত্রিক দৃঢ়তা সকলের থাকে না, আশা করাটাও বোধহয় উচিৎ নয়। এই প্রবল কনজিউমারিজম-এর যুগে, তীব্র প্রতিযোগিতার যুগে তো আরোই নয়। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যেমন সকলে হতে পারে না, অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তেমনি কম লোকই হতে পারে, অনি। আর হতে পারলেও নিজের আদর্শর কাছে নিজের পরিবারকে বলি দেওয়াও উচিৎ কিনা তাও ভাবতে হবে। প্রশ্নটা সহজ নয়, অনি – এর উত্তর তোমাকে একাই খুঁজতে হবে।”
রাত হয়ে এলো। ট্রেন চলেছে রাতের অন্ধকার চিরে। জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে অনি। ঘোর অন্ধকারের মধ্যে দু চারটে বিলীয়মান আলো। একসময় বেয়ারা এসে তুলে নিয়ে গেলো ওদের অভুক্ত খাবার প্লেট। অ্যাটেনডেন্ট এসে জিজ্ঞেস করলো বিছানা করে দেবে কিনা। ততক্ষণে কানপুর পেরিয়ে গেছে।
“শুয়ে পড়া যাক, অনি। আমার তো কাল ধানবাদে নামা, কাজেই সকাল সকাল উঠতে হবে।”
চটকা ভেঙ্গে গেলো অনির। “হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই স্যার।” তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লো অনি। ওপরের বাঙ্কে উঠে পড়লো বিছানা হয়ে যাবার পর।
“এই নাও অনি।” সমীরণবাবু একটা প্যাকেটের জুস দিলেন অনিকে। সঙ্গে একটা ওষুধ। “এটা খেয়ে শুয়ে পড়ো। খুব মাইল্ড ঘুমের ওষুধ। তোমার একটু রিলাক্স করা দরকার। কাল সকালে উঠে ভেবো কি করবে।”
***
অনির ঘুম ভাঙলো কামরার অ্যাটেনডেন্ট এসে ডেকে তোলার পর। হাওড়ায় ট্রেন ঢুকছে তখন। মালপত্র বেশি নেই, তাই অনি আর কুলি করলো না। নেমে পড়লো নিজেই। ওর কর্মস্থানে যেতে ট্রেন বদল করতে হবে। তার আগে রেলের রিফ্রেশমেন্ট রুমে গিয়ে একটু হাত পা ছড়িয়ে নেবে ও।
রিফ্রেশমেন্ট রুমে গিয়ে হাতের ব্রিফকেসটা খুললো অনি। চামড়ার পাউচে মেমারি স্টিক ছাড়া একটা চিরকুটে ফোন নামবার আছে সমাদ্দারের। তাকে ফোন করবে ও। বলবে যে এই পথে অনি নামবে না। দ্য ডীল ইজ অফ। মন স্থির করে ফেলেছে অনি।
পাউচ খুলে অনি দেখলো ভেতরের জিপ দেওয়া পকেটটা খালি। তার ভিতর একটা ভাঁজ করা কাগজ রয়েছে। একটা চিঠি। অনি পড়তে শুরু করলো
“স্নেহের অনি,আজ তোমাকে আমার চিঠি লেখার পালা।
অনেক ভেবে দেখলাম, এই পথ তোমার নয়। তোমার ভিতর তোমার বাবার সত্তার দু-চার কণা আজো মিশে আছে। সেটাকে হারিয়ে ফেলো না। অনেক টাকা, গাড়ি, বাড়ি নিয়ে বেশিরভাগ লোক শান্তি পায়, সকলে নয়। তুমি পাবে না। বরং এই পদস্খলনের স্মৃতি তোমাকে অবিরত জ্বালাতে থাকবে বাকি জীবনটা। যেমন ওই আমাকে চিঠি লেখার স্মৃতি তোমাকে আজো জ্বালায়। আমি জানি।
তাই তোমাকে প্রলোভনের হাত থেকে উদ্ধার করলাম। ওই মেমারি স্টিকটা আমিই নিলাম। এখন তুমি মুক্ত। চুরির পাপটা আমার একারই থাক।
আবার নতুন করে জীবন শুরু করো। সাদা কাগজ নিয়ে।
ভালো থেকো।
-- তোমার সমীরণস্যার।
পুঃ – সমীরণ নয়, আমাকে এখন বেশিরভাগ লোক স্পেন্সার নামেই চেনে।”
(পরবাস-৬৬, মার্চ ২০১৭)