দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে রাতের ট্রেন। আসানসোল পেরিয়ে গেছে রাত ন’টায়। এখন ক’টা বাজে? দেখছি,তার আগে একবার ওয়াশরুম যাওয়া জরুরি--ভাবতে ভাবতে দোতলার বাঙ্ক থেকে নেমে এলো সুতপা। কেবিনের দরোজাটা ঠেলে ডানদিকে সরিয়ে বাইরের করিডরে এক-পা ফেলেই মনে হল, বাথরুমে তো এসি থাকে না। জানুয়ারির এই ভয়ঙ্কর ঠান্ডায়.....ফের ঘুরে শালখানা নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে টয়লেটের দিকে।
কোথাও একটা মিউজিক বাজছে। ভায়োলিন। এতোরাতে কোত্থেকে আসছে সুরটা? হবে কোনো সহযাত্রীর মোবাইল থেকে, ধারেপাশে আর কারোকে দেখা যাচ্ছেনা যদিও---বাথরুম থেকে বেরিয়ে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিতে দিতে ভাবলো সে। এসি ফার্ষ্টক্লাস কম্পার্টমেন্ট। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আরেক কাঁচের দরোজা ঠেলে ওয়াকিং প্যাসেজে পড়তে হয়। তারপর একটি ধাতব দরোজা পাশে সরিয়ে কেবিনে ঢোকা। এ’সব বাধা ডিঙিয়ে সুরটা আসতেই থাকছে। মৃদু, কিন্তু অতীব মনোরম।
বেশ সুরটা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়ে শুনতে হয়। মালকোষ। তন্ময় হয়ে গিয়েছিল সুতপা শুনতে শুনতে। খানিক্ষণ পরে থেমে যেতে সম্বিৎ ফিরে পেল। হাঁটা দিলো নিজের ‘সি’ কেবিনটার দিকে।
বার্থে শুয়ে পড়তে পড়তে আলগোছে মোবাইলের স্ক্রিনটা এক ঝলক দেখে নিলো। রাত পৌনে দু’টো। সেকেন্ড রাউন্ড ঘুমের জন্যে তৈরী হওয়া যাক্। ঝুপ করে বালিশে মাথাটা দিতেই, অবাক কাণ্ড, আবার সেই সুর। এখন আরও মৃদু বটে তবে ভুল হয়নিঃ সেই ভায়োলিন, সেই মল্লকৌশিকী ! আশ্চর্য, এই বদ্ধ কামরায় সুর ভেসে আসে কোথা থেকে? কামরার বাকি তিনজন যাত্রী তো অঘোর ঘুমে মগ্ন। সুতপার উল্টো দিকের নিচের বার্থে এক বালিকা শুয়েছিল, আলাপ হয়েছিল কাল সন্ধ্যেয় । সে ও’দিকের দেয়ালের দিকে ফিরে গভীর নিদ্রামগ্ন, গায়ে কম্বলের ওপর সাদা চাদর। কেবিনে একটা মৃদু নীল আলো জ্বলছে বটে, তবে তাতে ধুলোটুলো জমে আলো নামমাত্র। কী মনে হতে এক ঝলক মোবাইলের-টর্চটা জ্বালিয়ে নিচের মেয়েটিকে দেখে নিতে চাইল সুতপা। আরে, বালিকাটি তো নয়, এ’তো এক লম্বা ব্যক্তি শুয়ে আছে এ’দিকে পিঠ করে, গায়ে কম্বল জড়ানো। তাহলে মাঝের কোনো স্টেশনে মেয়েটি কি নেমে গেল তার মায়ের সঙ্গে? ঠিক তাই। বাঙ্ক থেকে ঝুঁকে তার ঠিক নিচে তাকিয়ে দেখল সুতপা, না, কোনো আধপ্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা তো নয়, অতীব শীর্ণ এক বুড়োমানুষ চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন তার নিচের বাঙ্কে। জানলার দিকে মাথা, কেশহীন। তোবড়ানো গাল। পরনে কালো নাইট স্যুট। বুকের ওপর ফ্যাকাশে-শাদা হাতদুটি জড়ো করা।
টর্চটা নিবিয়ে দিলো সুতপা। ছোট্ট একটা খটকা লাগল মনে। ঐ ভদ্রমহিলা কাল সন্ধ্যেবেলা বলছিলেন না যে মেয়েকে চিকিৎসার জন্য দিল্লি নিয়ে যাচ্ছেন? তাহলে হঠাৎ মাঝরাতে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে উটকো কোনো স্টেশনে নেমে যেতে গেলেন কেন? পরক্ষণেই ভাবল সুতপা, সে কি একটু বেশিই ভেবে ফেলছে না? সহযাত্রীরা কে কোথায় উঠল-নামলো তা দেখার দায়িত্ব থোড়াই রেলকোম্পানি দিয়েছে তাকে। আগামীকাল সকাল সাড়ে এগারোটায় অত্যন্ত জরুরি মিটিং আছে ‘রয়,পারিখ এন্ড এসোসিয়েটস’-এর সিনিয়র চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট মিস্ সুতপা পারিখের। অতএব ঘুমে মন দাও।
গায়ের কম্বল ও চাদরখানি বেশ করে মুড়ে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমের উদ্যোগ করছে সুতপা, হঠাৎ নিচের সেই বৃদ্ধের করুণ স্বর শোনা গেল, কাকে যেন ডাকছেন, “নীলমাধব, নীলমাধব!”
কান খাড়া হয়ে উঠলো সুতপার। ‘নীলমাধব’ ওনার সহযাত্রীটির নাম নাকি? তাকেই ডাকছেন নাকি উনি? বৃদ্ধমানুষ। অসুস্থ বোধ করছেন না তো?
না, ওঁর সহযাত্রীর দিক থেকে কোনো হেলদোল দেখা গেল না।
আবার অতি মৃদু ও কাতর স্বরে ডাক, “নীলমাধব, নীলমাধব!”
কী করা উচিত সুতপার? কোনো সাহায্য করা উচিত কি? উল্টোদিকের নিচের বার্থে ওনার সহযাত্রীটির দিকে তাকালো। সে-ব্যক্তি বোধহয় এতক্ষণে চিৎ হয়ে শুয়েছে, ভালো বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ জানালা দিয়ে আসা মৃদু আলোয় দেখলো, আরে এ’তো সেই বৃদ্ধ যিনি একটু আগেই তার ঠিক নিচের বার্থটিতে শুয়ে ছিলেন---জানলার দিকে মাথা, কেশহীন, তোবড়ানো গাল। এইটুকু সময়ের মধ্যে তাঁরা দু’জনে বার্থ অদল-বদল করে নিলেন নাকি? সেটা তো অসম্ভব।
সুতপা আবার তার ঠিক নিচের বার্থের দিকে নজর দিলো মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে নিয়ে। আরে! তার নিচের বার্থেও ঐ বৃদ্ধই তো শুয়ে আছেন।
নিচের দুই বার্থে হুবহু একই দেখতে দুই বুড়োমানুষ নিদ্রামগ্ন!!
এবার বুকটা তার কেমন যেন ঢিপঢিপ করতে শুরু করল। গভীর শীতরাতের দুরন্তগতি ট্রেন। অন্ধকারাচ্ছন্ন কেবিন। নিচের দুই বার্থে শুয়ে আছে দুই ক্লোন বুড়ো!!
আজ বারো বচ্ছর প্রফেশনে আছেন সিএ সুতপা পারিখ, দেশে-বিদেশে দু’শ টুর করেছেন এতাবৎ। কৈ কখনো তো এমন অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হয়নি।
পরক্ষণেই মন থেকে ভয়-অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে সে। দুই যমজ বৃদ্ধ ভাই একসঙ্গে রাতের ট্রেনে ভ্রমণ করতেই পারেন। এ’নিয়ে বেকার মাথা কেন গরম করছে সে? নিজেই নিজেকে তিরস্কার করে সুতপা। নাঃ, এবার ঘুমিয়ে পড়তেই হবে। নৈলে কাল ঐ সাতকোটীর টেন্ডার.....
“নীলমাধব,নীলমাধব!” আবার সেই মৃদু কাতর স্বর।
নাঃ, ইম্পসিব্ল। তড়াক করে উঠে বসলো সুতপা নিজের বার্থে। গলা খাঁকরে শুধোলো, “হ্যালো! ইয়েস স্যর! কাম অন। ওয়ণ্ট সাম ওয়াটার?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। মোবাইলের আলোয় দেখলো নিচের বার্থে সেই দুই ‘ক্লোন-বৃদ্ধ’ গভীর নিদ্রামগ্ন, ঠোঁট নড়ছে না।
মাথাটা গরম হয়ে উঠেছে সুতপার। এর একটা শেষ দেখেই ছাড়বে। হোক্ সহযাত্রীদের ঘুমের ব্যাঘাত, দেওয়ালের দিকে হাত বাড়িয়ে বড় আলোটা জ্বালতে চাইল সুতপা। নাঃ, সুইচবোর্ডের ওপরের হুকে কেউ মোটা কোট-টোট ঝুলিয়ে রেখেছে। সুইচে হাত গেল না। তড়াক করে লাফিয়ে নিচে নেমে পড়ল সুতপা পারিখ। এর শেষ তাকে দেখতেই হবে।
কিন্তু এখন সামনে দাঁড়িয়ে কোটগুলো সরাতে গিয়ে কেমন কুণ্ঠিত হয়ে পড়লো সে। অন্ধকার রাত্রে অপর সহযাত্রীর কোট হাতড়ানো উচিৎ হবে কি? তারা কেউ হঠাৎ জেগে উঠে এক অচেনা রমণীকে কোট হা্তড়াতে দেখলে চোর-টোর ভাবে যদি?
থমকে গেল সুতপা। কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কোনো কারণে পেট গরম হয়েছে নাকি তার? নাকি দুঃস্বপ্ন দেখছে এক? বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখে একটু জল ছিটিয়ে এলে রিলিফ পাওয়া যাবে, কারণ এই শীতেও রীতিমত ঘামছে সুতপা।
দরোজা খুলে বেরোবে বলে ঘুরে ছিটিকিনিতে হাত দিয়েছে সে হঠাৎ তার বার্থে রাখা মোবাইল ফোনখানি বেজে উঠল। না, বেজে নয়, রাতে ভাইব্রেট বা সাইলেন্টে করা থাকে, ...ফর্র্ ফর্র্ করে ভাইব্রেট করতে লাগল ফোনটা। এতো রাতে কে ফোন করবে...ভাবতে ভাবতে ফোনটা ধরতে হাত বাড়ালো সে ।
আর, ফোনের শব্দেই বোধহয়, এতক্ষণ গভীর নিদ্রামগ্ন কেবিনের চতুর্থ যাত্রী দেওয়ালের দিক থেকে ঘুরে এ’পাশে মুখ ফেরালেন। আপার বার্থ-‘এ’। ইনি অন্যদের মত জানলার দিকে নয়, দরোজার দিকে মাথা করে শুয়েছিলেন। সুতপাও বেরোবে বলে গেটের গায়েই প্রায়...হতভম্ব হয়ে দেখলো সুতপা, ...হ্যাঁ ঠিকই দেখেছে হালকা আলোয়...এ’ও সেই বৃদ্ধেরই মুখ...হুবহু....সেই তোবড়ানো গাল, কেশহীন, কালো নাইট-স্যুট পরনে... সুতপার মুখ থেকে বিঘৎ-খানেকের দূরত্বে এই তৃতীয় বৃদ্ধের মুখ। এবার এই বৃদ্ধ সুতপার দিকে তাকিয়ে গাল আরো তুবড়ে মৃদু হাসতে লাগলেন...হলদে দু’টো ফোক্লা দাঁত! চক্ষুগোলক সম্পূর্ণ সাদা, কোনো কালো মণি নেই তাতে!!
প্রবল আতঙ্কে দৌড়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো অসহায় মেয়েটি। মোবাইলটা ফর্র্র্ ফর্র্র্ করেই চলেছে। হাতে তুলে নিলো সেটি। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেখানে এক বৃদ্ধের মুখচ্ছবি, তোবড়ানো গাল, বিরলকেশ, হাস্যমুখ। চক্ষুগোলক সম্পূর্ণ সাদা, কোনো কালো মণি নেই তাতে!!
তলায় ট্রু-কলার নাম দেখাচ্ছে, “Neelmadhav, Neelmadhav”!!!
রাত দেড়টায় যখন ডাঃ ভবেন্দ্রনাথ রায় স্টেশনে নামলেন, চারিভিতের একটা দোকানও খোলা নেই। তাই কে আর দেখবে তাঁকে নামতে? নেই কোনো রিকশ’ অটো ট্যাক্সিও। আশাও যে খুব করেছিলেন তা নয়। ট্রেনটা যখন ঝোলাতে শুরু করেছিল, তখন থেকেই শঙ্কা, নেমে দুটি খেতে পাবো তো? শেষাবধি ট্রেন লেটটা যখন আড়াই ঘন্টাতে এসে ঠেকলো , তখন রাতে দু’গ্রাস গরম ভাত পাবার আশা ত্যাগ করলেন ডাক্তারবাবু। স্টেশনে নেমে সন্নাটা দেখেও ঘাবড়ালেন না।
ভয়ঙ্কর গরম।
আজ রোববার। না,না, ইংরিজি মতে সোমবার তো পড়ে গেলো রাত বারোটার পরেই। ভরা জুনের রাত দেড়টা। নিশুতি রাত, ঘোর অন্ধকার! আজ অমাবস্যা নাকি? পথ যদিও অতি দীর্ঘ কিছু নয়। বাঁধানো শহুরে রাস্তা। জোরকদমে চলা শুরু করলেন ডাক্তারবাবু হাসপাতালের দিকে। গ্রামের ছেলে ছিলেন, বয়েস চল্লিশের কোটায়। এটুকু হাঁটা পরোয়া করেন না।
মিনিট পাঁচেকও বোধহয় হাঁটেননি, একেবারে গায়ের পাশে ক্যাঁচ্ করে এক মারুতি ওমনি গাড়ি এসে থেমে গেল। কোনো ভাবনায় মশগুল ডাক্তারবাবু গাড়ি আসার শব্দ শুনতে পাননি, এবার দেখতে পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন।
‘ডাক্তারবাবু, হাঁ-আসপাতাল যাবেন তো? উঠে পড়ুন’, এক বছর বিশেকের ছোকরা-ড্রাইভার ঘাড় বের করে বললো। মুখটা দেখে চেনা চেনা লাগলো বটে একটু, কিন্তু রাতের আঁধারে ভালো ঠাহর হলো না । মাসখানেক মোটে হয়েছে এ’ হাসপাতালে জয়েন করেছেন ডাঃ রায়। তবে, লোকেজনে ডাক্তারকে শিগগিরই চিনে ফেলে, বিশেষতঃ এ’হেন এক ছোট শহরে। ডাক্তার রায়ের মুখটা অবশ্য সকলের সহজেই মনে থাকে কারণ বিরলকেশের সঙ্গে গোঁফহীন দাড়ি রাখার রেওয়াজ হিন্দুদের মধ্যে এক্কেবারেই দেখা যায় না। ডাক্তারবাবু আবাল্য আব্রাহাম লিঙ্কনের ভক্ত!
‘কত নেবে?’ ডাক্তার রায় হিসেবি মানুষ।
‘দ্-দু’-দু’শোটা টাকা দেবেন...আপনার ঠেঙে বেশি আর কী ন্-নোবো?’
‘দু’শো? ক্ষেপেছিস নাকি? যা ভাগ্। গাড়ি চাইনা, হেঁটেই যাবো এট্টুকু পথ। যা।’
‘পথটা দেখছেন ড্-ডা-ডাক্তারবাবু, রাতটা দেখছেন না? এতো রাতে....’ ওনার পাশাপাশি স্লো চালাতে চালাতে ছেলেটা বলতে লাগলো।
‘বললাম তো যাবো না। তুমি চলে যাও ভাই। আমি হেঁটেই....’
ছেলেটা হতাশ হয়ে গাড়ির স্পিডটা বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল।
আর যেই চলে গেল অমনি ডাক্তারবাবুর মনে হতে লাগল কোথায় যেন দেখেছেন ছেলেটাকে, কোথায় যেন...? কোথায় দেখেছেন...?........
হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে, দেখেননি কোথাও আগে ছেলেটাকে, ওর সঙ্গে মুখের খুব মিল তাঁর ছোটভাই রতনের। সেই ঐ রকম সামনের দাঁত উঁচু, ঐ রকম মাথাভরা ঝাঁকরা চুল, ঐ রকম তুৎলে-তুৎলে কথা বলা। হঠাৎ মনটা তাঁর ছোটভাইটার জন্য বড় ব্যাকুল হয়ে উঠলো। রতন মারা গিয়েছিল টাইফয়েডে, ক্লাস টুয়েল্ভে পড়তো তখন। মেধাবি ছাত্র ছিল, অঙ্কে কী মাথা! বাবা-মা মারা যাবার পর দিদি-জামাইবাবুর কাছে থাকতো রতন। ভবেন তখন ফাইনাল এম বি.র ছাত্র।
আহা, দিলেই হতো ছেলেটাকে দু’শোটা টাকা। এতো রাতে কষ্ট করে গাড়ি চালাচ্ছে...পুরনো চিন্তার খেই ধরে ভাবলেন ডাক্তার রায়।
ভাবতে ভাবতেই দেখেন শ’দুয়েক মিটার দূরে গিয়ে গাড়িটা থেমে গেছে ! সোজা ব্যাকগিয়ারে আসতে লাগলো পিছিয়ে তাঁর দিকেই। অবাক হলেন ডাক্তারবাবু।
বেশ খানিকটা কাছে এসে গলা বাড়িয়ে চেঁচিয়ে বললো ছেলেটা, ‘ড্-ডা-ডাক্তারবাবু, রাস্তা ভরা কুত্তো আছে কিন্তু । গত হফতায়...মনে আছে, ক্-কে-কেমন দৌড়টা লাগিয়েছিলেন...হেঁ..হেঁ....খিঁক্....খিঁক্....’
এই রে ! সত্যিই তো মনে ছিল না। কুকুরের পাল আছে কোয়ার্টার্সের গেটের কাছেই। কিন্তু জানলো কী করে এই ছেলেটা?
দেখেছে হয়তো দূর থেকে সেদিন।
‘খুচরো আছে? আমার কাছে কিন্তু পাঁচশোর নোট’ বলতে বলতে ঝুঁকে গাড়ির গেটটা সরাতে গিয়ে আধো অন্ধকারে দেখেন পিছনের সিটে দুই মোটাসোটা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বসে আছেন। অগত্যা, সামনের দরজাটা খুলে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে পড়লেন ডাক্তার ভবেন রায়।
গাড়িটা স্পিড নিয়ে নিলো।
‘রতন, তোর প্যাসেঞ্জার তোলা শেষ হলো? কখন পৌঁছুবি...হিঁক্...হিঁক্....?’ পেছনের সিট থেকে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের ফ্যাঁস্ফ্যাঁসে বকুনি। কণ্ঠস্বরটা যেন বড্ড চেনা ডাক্তারবাবুর!
নামটা শুনে একটু চমকে উঠেছিলেন বৈকি!
এ’ ছেলেটার নাম রতন?
রতন বিজ্বিজ্ করে কী উত্তর দিলো শোনা গেল না। বৃদ্ধের ঐ ফ্যাঁস্ফ্যাঁসে গলা ও হেঁচকি তোলাটা ইউনিক, বড্ড চেনাচেনা লাগলো! আর একটা গন্ধ! বিশেষ গন্ধ! পিরামল নস্য! ভবেন্দ্রনাথদের বাড়িতে খুব চলতো, তাঁর বাবা-জ্যাঠারা এই ব্যান্ডেরই নস্য নিতেন। তাঁরা অবিশ্যি 'পরিমল নস্যি'ই বলতেন। গন্ধটা তাই তাঁর আবাল্য পরিচিত। আজ এখন এ গাড়িতে উঠে প্রথমেই গন্ধটা নাকে এসেছে ডাক্তার বাবুর।
এবার পিছনের সিট থেকে ভেসে এলো এক বামা কণ্ঠ:
"হ্যাঁগা, এতো রাত্তিরে আমরা হুপোশাস্তর গিয়ে পৌঁছুলে রমা-শিশির আবার আতান্তরে পড়বে না তো?"
শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল ডাক্তারবাবুর।
রমা ও শিশির তাঁর দিদি ও জামাইবাবুর নাম।
হঠাৎ করে বিন্-নোটিশে আসা-যাওয়া....তাদের গ্রামঘরে বলে ‘হুপোশাস্ত্র’ আসা-যাওয়া। মা বলতেন তাঁর। বহুদিন পরে শব্দটা শুনলেন।
‘ঝক্মারি হয়েছে মেজবৌ তোমাকে নে বেরোনো এই রাতবিরেতে....’ বৃদ্ধের সেই ফ্যাঁস্ফ্যাঁসে স্বর পিছনের সিট থেকে, অতি অতি পরিচিত ডাক্তারবাবুর। আর সেই পরিমল নস্যির বাস!
‘খোকোর হাঁসপাতালও তো নিকটেই হবে...’ ফের বামা কণ্ঠ।
রীতিমত ঘামতে শুরু করেছেন ডাক্তারবাবু। বাবা-মা তাঁকে আদর করে ‘খোকা’ না বলে ‘খোকো’ বলে ডাকতেন।
ঝড়ের মতো ছুটেছে মারুতি ওমনি রাতের রাস্তা খালি পেয়ে। প্রবল হাওয়ায় উড়ছে ড্রাইভারের একমাথা চুল। বায়ুবেগে পিছনে ছুটে যাচ্ছে পথের দু’পাশের বৃক্ষসারি। খুব ইচ্ছে করছে ডাক্তারবাবুর একবারটি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের সওয়ারি দু’জনকে দেখে নিতে । কী এক অজানিত ভয় আর সংকোচে ঘাড়টা আর ঘোরাতে পারছেন না।
হঠাৎ।.......
আরে আরে রোকো রোকো বলতে বলতে ক্যাঁ---চ্ করে রুকে গেলো গাড়িটা। একটা হাল্কা বাঁক নিয়ে ডানদিকে ঘুরতেই....কী আশ্চর্য....কী আশ্চর্য.....রাস্তার ঠিক মাঝখানে আড়াআড়ি এক মানুষ শুয়ে আছে আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে ঢাকা! ঘোর অমাবস্যার রাতেও ধবধবে শাদা চাদর সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়।
ডেডবডি নাকি?
গাড়ির চারব্যক্তিই নিথর নির্বাক।
‘দ্ দ্যাখ্ না নেমে ...রতন’, ভয়ার্ত স্বরে কথাটা বেরিয়ে গেলো ডাক্তারবাবুর মুখ থেকে।
রতন কিন্তু নামলো না। কারণ ততক্ষণে পথের সেই ‘ব্যক্তি’ চাদর ছেড়ে উঠে বসেছে। এবার হেঁটে হেঁটে আসতে লাগলো গাড়ির দিকে। ড্রাইভারের পাশে এসে ঝুঁকে শুধলো, ‘গোবিন্দপুর যাবে তো?’
আগন্তুক বিরলকেশ, গুম্ফহীন শ্মশ্রু!
অনায়াসে সামনের বামদিকের দরোজাটি খুলে ড্রাইভারের পাশে বসে পড়লো সেই আগন্তুক!
রতন গাড়ি স্টার্ট করতে করতে বাঁদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো সেখানে একজনই বসে আছে।
বিরলকেশ। মুখভর্তি দাড়ি। গোঁফ নেই।
সোমবার সকালেই খবরটা এসে পৌঁছে গেছে জেলা হাসপাতালে।
গত সন্ধ্যায় দিল্লিগামী এক্সপ্রেস ট্রেনের কামরায় অকস্মাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হয়েছেন তরুণ চিকিৎসক ভবেন্দ্রনাথ রায় মহাশয়!
রাত্রেই জেলাসদরের মর্গে লাশ চালান হয়ে এসে গেছে।
(পরবাস-৬৬, মার্চ ২০১৭)