ঢাকায় পদার্পণের সাতাশ দিনের মাথায় মালিহার ফোন পেল আকাশ। মালিহা ওকে নেমন্তন্ন করেছে ওর কৃষিবাড়িতে। আকাশ ব্যস্ততার দোহাই দিলেও শুনল না; সুতরাং অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হলো। অনেক বছর বাইরে থাকার কারণে সহপাঠীদের সাথে কোনো যোগাযোগ ছিলনা আকাশের। ফোন রাখার পর ভাবল, তাই তো, মালিহা ওর ফোন নাম্বার পেল কোত্থেকে!
এতদূর যেতে হবে? আর কি হবে সেখানে? কে কে আসবে? এমন অনেক বন্ধু আছে যাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় পার হবার পর একটিবারও দেখা হয়নি। ঢাকায় অবস্থানকালে দুয়েকজন সহপাঠী বা পাঠিনীর সাথে দেখা হতো বৈকি। কিন্তু দেখা হবার পর আলাপচারিতা পানসে লাগত। বরং, সে যে মধুর ক্যান্টিন বা ক্যাফেটোরিয়ায় কিংবা বৃটিশ কাউন্সিলে যে স্মৃতিগুলো সঞ্চিত ছিল সেগুলোই আকাশ মনেপ্রাণে ধারণ করত।
চুলোয় যাক, উচ্ছন্নে যাক সবকিছু--এমন একটা ভাব নিয়ে টরোন্টো ছেড়েছিল আকাশ। অতএব, চুলোয় যেতে দিল সে শুক্রবার বড় ভায়রাভাইয়ের সাথে বিশেষ মোলাকাতের পর্ব। তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করে দিল সে সেই পর্ব। পরিবর্তে সে যাবে কৃষিবাড়িতে। ভায়রাভাইয়ের সাথে আলোচনায় বসতে হবে, আর আলোচনা মানে একপ্রকার জবাবদিহি। জবাবদিহি করার জন্য সে টরোন্টো থেকে ঢাকায় উড়ে আসেনি। বিগত একুশ দিনে অন্তত চোদ্দবার ফোন করে কামরুন্নাহার ইতি গত এক সপ্তাহ আর ফোন করেনি।
নিজের ফিরে আসার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেও আকাশের ভেতরে জমাটবাঁধা মেঘের মতো উদ্বেগ জমে আছে। ফলে সে ফিরে এসে আকাশের মতো মুক্ত হলেও বুকের ভেতরে চাপা উৎকণ্ঠায় ভুগে ঘুমের বড়ির আশ্রয় নিয়েছে। দিনগুলো তার ভালোই কাটে, রাতটা অন্যরকম। তাড়িত হয় সে...
মালিহার সাথে ফোনে কথা শেষ করার পরই গুলশান থেকে মুনিরা ফোন করল। মুনিরা জানাল, আকাশ চাইলে সে ওদের গাড়িতে যেতে পারে। মুনিরা আরো জানাল, বারিধারা থেকে যূথি এসে তার গাড়িতে ওকে তুলবে। ওরা মাত্র দু’জন, সুতরাং আকাশ এই দু’জনের সঙ্গী হতে পারে। আকাশ সায় দিল এবং জানাল সে এয়ারপোর্টের ব্রিজের কাছে অপেক্ষা করবে।
ফোন রেখে বুঝতে পারল মালিহা ওর ফোন নাম্বার পেয়েছে মুনিরার কাছ থেকে। আগে থেকেই মুনিরার সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ ছিল আকাশের। ঢাকায় এসে মুনিরার সাথে ফেসবুকে চ্যাট করেছিল, তখনই দু’জনের ফোন নাম্বার বিনিময় হয়।
মন হঠাৎ ফুরফুরে হয়ে উঠল। আকাশ কর্তব্যকর্ম ঠিক করে ফেলল, সিদ্ধান্ত নিল--আংশিক পাকা চুল ও গোঁফ কালো করতে হবে। মিশমিশে কালো করা যাবে না, আর সবটা কালো করা বোকামি হবে, একটু রূপালি আভা চুলে-গোঁফে রেখে দেবে। টরোন্টো থেকে কেনা কেলভিন ক্লাইনের কালো প্যান্ট, ঢাকায় বানানো হালকা নীল শার্ট পরবে। আর গিফ্ট? এখানে একটু সমস্যা দেখা দিল। আকাশের মুখে মেঘের আনাগোনা চলল, কিন্তু পরমুহূর্তেই মেঘ কেটে গিয়ে রোদ দেখা দিল। সমস্যা যেমন হামলে পড়ে তেমনি সমস্যাও হাতের কাছে থাকে।
বিগত সাতাশ দিনে আশঙ্কাজনক হারে ক্যানেডিয় ডলারের শ্রাদ্ধ হয়েছে চিকিৎসায়, গিফট প্রদানে, ঘোরাঘুরি ও প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটায়। এখন যে-কটা ডলার আছে সেগুলোকে প্রথমা, দ্বিতীয়া ও তৃতীয়া বউয়ের মতো সমান খাতিরযত্নে রাখতে হবে। ফিরতি টিকিটের ডলার প্রথমা বউ, আরও যে-কটা দিন থাকবে তার খরচ হলো দ্বিতীয়া বউ, এবং যদি বাউন্সড ব্যাক হয়ে টরোন্টো থেকে ফিরে আসতে হয় তখন পুশ্ড ব্যাক টিকিট বাবদ খরচা।
এসব হিসেব অংকের মতো করতে হয়না, আপনা আপনি মনের ভেতর তৈরি হয়ে থাকে। আকাশের হিসেব আগে আসত না, ধাক্কা খেয়ে, জাঁতাকলে পড়ে হিসেব কষতে শিখেছে। সারাজীবন অংকে কাঁচা আকাশকে ঢাকায় পদে পদে অংক কষতে হয়েছিল, আর সেই অংক টরোন্টোতে গিয়ে ক্যালকুলাস-এ পরিণত হয়।
যূথির গাড়ি থামল সাড়ে দশটায় ব্রিজ সামান্য পেরিয়ে। আকাশ উঠল গাড়িতে। যাত্রা শুরু হলো। যাত্রা মানে জ্যামে আটকে থাকা। উত্তরা থেকে টঙ্গি পর্যন্ত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগুলো গাড়ি। আকাশ বলল, এবার মনে হয় জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত দ্রুত যেতে পারব। ড্রাইভার রউফ আকাশকে হতাশ দিয়ে জানাল--চৌরাস্তা পর্যন্ত এমনই জ্যাম থাকবে।
তেমনই জ্যাম ছিল। তবে বাঁচিয়ে দিল যূথি। তার কথার তোড়ে দুইঘন্টার জ্যাম-টাইম কোথা থেকে কেটে গেল টের পেলনা আকাশ, টের পেল যূথির তীক্ষ্ণ রসবোধ। ঠাহর হলো, আড়াই দশক আগে এরকমই বোধহয় ছিল যূথি।
সেই যূথি--আহ্লাদি, মুখর। শ্যামলা, মিষ্টি চেহারা। সেই যূথি, যার সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ ছাড়ার পর আর দেখা হয়নি! অথচ মেয়েটাকে দেখে বুঝবার উপায় নেই। সে আগের মতোই প্রাণবন্ত, স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে তার অনেক আগেই। জীবনটাই বুঝি বিচ্ছেদের।
আরও একটা বিচ্ছেদ কি অত্যাসন্ন?
এক পর্যায়ে জানা গেল, আরেক ক্লাসমেট রাশিদা ও তার হাজব্যান্ড তাদের গাড়িতে আকাশদের পেছনেই। তখন থেকে যূথি একবার রাশিদা, একবার তার হাজব্যান্ড ব্যারিস্টার শরাফত ভাই’র সাথে ঠাট্টা-চাতুরিসহ নানা রসাত্মক আলাপ জুড়ল। গাড়ি চলছিল দ্রুত গতিতে।
ক্যানেডার গল্প হলো। আরও আলোচনা হলো ঢাকা লিট-ফেস্ট বিষয়ে। আলোচনা হলো ইংরেজি বিভাগ থেকে আকাশ ও আরো কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবীর নেপাল সফর সম্পর্কে। সেই সফরে মালিহা ও তার হাজব্যান্ড মালেকভাই ছিলেন। আকাশ প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন পিকনিকে যাবার কথা উল্লেখ করল, সেখানে রাশিদা ছিল আকাশদের সঙ্গী। পিকনিকের সেই ফটোগুলো যে এখনও আকাশের সংগ্রহে আছে, সেকথা সে জানাল। যূথি ফোন তুলে রাশিদার হাজব্যান্ড শরাফতভাইকে জানিয়ে দিল তার বিপদের কথা। তার বউয়ের কথা একজন (আকাশ) সারাক্ষণ বলে যাচ্ছ, অতীতে কি সব কাণ্ড ঘটিয়েছে, আর এদিকে বার-অ্যাট-ল সাহেব দিব্যি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে!
আকাশ প্রমাদ গুনল। সামনের সিটে বসা ছিল সে, ঘাড় ঘুরিয়ে মুনিরাকে জিজ্ঞেস করল--যূথি কি সত্যিই এসব বলছে আইনবিদকে! মুনিরা বলল, হ্যাঁ বলছে। আকাশ নিশ্চিন্ত মনে বলল, মনে হয়না। যূথি ফোন উঠিয়ে কথার তুবড়ি ছুটিয়ে চলল। আকাশ এবার একবার মুনিরা, আরেকবার যূথির দিকে তাকিয়ে বলল, ও ফল্স ফোন করেছে। প্রিটেন্ড করছে। মুনিরা আবার বলল, করছে না।
যূথি এবার ফোন ছেড়ে আবার ফোন করল রাশিদাকে। একই কথা বলল সে শরাফত গিন্নিকে। রসিয়ে রসিয়ে। জানাল, ব্যারিস্টার সাহেব মক্কেলদের প্যাঁচ খসান আর এদিকে গিন্নির ফয়সালা মামলা তিনি ঝুলিয়ে রেখে তামাদি বানিয়ে ফেলেছেন। আর আকাশের কপালে যে খারাপি আছে, সেটাও দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। যা হবার মালিহার বাড়িতে পৌঁছে যাহোক একটা কিছু সালিশ বসাতে হবে। সভাপতিত্ব করবে মালিহার জামাই ঠ্যাটা মালেক ভাই।
আকাশ হাসবে না কাঁদবে? সে হাসবার সিদ্ধান্ত নিল, এবং হেসেই চলল। যূথি অনবরত যা মনে আসছে, বলে যাচ্ছিল। একসময় একটা স্থানে এসে বিপাকে পড়ল সবাই। কোনদিকে যাবে? ওরা তখন গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে শ্রীপুর পেরিয়ে ভালুকা সীমান্তে ঢুকে পড়েছে। মালিহার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল যূথি। মালিহার কাঁচা নির্দেশনায় বারবার ওরা ভুল পথে চলে যাচ্ছিল। ইতোমধ্যে ওরা একস্থানে গাড়ি থামাল। পেছনে রাশিদাদের গাড়ি। আকাশ নেমে সেই গাড়ির সামনে যেতেই রাশিদা উষ্ণকন্ঠে স্বাগত জানাল। বার-অ্যাট-ল কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, আকাশ বলল, ফয়সালা মালিহাদের বাড়িতে গিয়ে হবে।
এদিকে আরেকটি গাড়ি দেখা দিল। পুলিস সদস্যসহ পুলিসের বড় কর্মকর্তা গোপাল এসে হাজির। সবাই আলোচনা করে কীভাবে এগুবে, সেই সিদ্ধান্ত নিল। রাশিদাদের গাড়িটাকে যেখানে তারা ছিল, সেখানেই থাকতে বলা হলো। আকাশ ও তার দলবল সঠিক নিশানা পেলে তবে সেই গাড়িটাকে অগ্রসর হতে বলবে। একটা সূত্র পেল ওরা--আকাশদেরকে একটু এগিয়ে গিয়ে থামতে হবে ছিট যুগি বাংলাবাজারে।
যূথি বলল, মালিহার মাথায় ছিট আছে। ছিট যোগীতে এসে আস্তানা গেড়েছে!
রাশিদার গাড়ি বিপথে চলে গেছে। আরেকটু এগিয়ে মালিহাদের বাড়ির রাস্তাটা পেল সবাই। ওর সেই রাস্তায় ঢুকে কিছুটা এগিয়ে ফের রাশিদারের খোঁজে উল্টো চলল। আকাশ মোড়ে গিয়ে নেমে পড়ল; রাশিদাদের গাড়ি দেখা গেলে সেটাকে গাইড করতে। ইতোমধ্যে হোন্ডায় চড়ে ‘ছিটগ্রস্ত’ মালিহা-প্রেরিত গাইড চলে এলো। আকাশ একসময় দেখতে পেল রাশিদার সাদা গাড়িটাকে। দিক নির্দেশ করল সে গাড়িটাকে। রাশিদার গাড়ির অপেক্ষায় নিচে নেমে একটা সিগারেট ধরিয়েছিল কেবল, তখন নতুন আপদ দেখা দিল। শরাফত আলি শিকদারের নাম জ্বলজ্বল করছে তার মোবাইলের স্ক্রিনে। কো-ইন্সিডেন্স, ইনি আইনজ্ঞ শরাফত নন। তার কুখ্যাত বড় ভায়রাভাই শরাফত। আকাশ ফোন ধরল, এবং ভাবল, ভাগ্যিস ফোনটা এসেছে গাড়ি থেকে নামার পর। নইলে যূথি আরেকটা প্যাঁচ মেরে দিত।
কি ছোটো ভায়রাভাই, তোমার না আমার এখানে আসবার কথা?
আমি আসছি না।
কেন, কেন ভায়রাভাই?
আমি আসব না।
কিন্তু কেন?
আসব না, ব্যস।
তোমার সাথে আলোচনা ছিল। তুমি রাজি হয়েছিলে আসতে।
এখন গররাজি হলাম।
তা বললে চলবে কেন। তোমাকে আসতে হবে। আজ না আসো, কাল তো আসতে পারো।
আমি আজ বা কাল, শুক্রবার কিংবা শনিবার, কোনো বারই আসব না।
এটা রাগ বা জেদ দেখাবার জায়গা না। আলোচনা তোমাকে করতেই হবে। তুমি টরোন্টো থেকে চলে এসেছ বিনা নোটিসে। কেন, তার আলোচনা হবে।
আলোচনা আপনি আপনার শ্যালিকার সাথে করেন। ক্যানেডায় ফোন কল বাবদ বিল আমি আপনাকে দিয়ে দেব।
আইন কিন্তু এই দেশে এখনও উঠে যায়নি, আর ওই দেশের আইন কতটা নিয়মতান্ত্রিক তা তো তুমি জানো।
তা ঠিক। কিন্তু পাখা গজিয়ে গেলে কোনো আইন কাজ করেনা। আপনার শ্যালিকার পাখা গজিয়েছে, তার বিচার আমি আমার আদালতে করব। সেখানে ঢাকা বা টরোন্টোর কোনো আইন কাজে আসবে না।
তোমার শেষ কথা?
শেষ বলতে কিছু নেই। আপনি আইন দেখাচ্ছেন, আমি দেখব আপনার আইনের পাল্লা কত ভারী।
কিন্তু...
আকাশ লাইন কেটে দিল। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে যূথি ও মুনিরা উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে। সে প্রায় দৌড়ে গেল গাড়ির দিকে।
কোনো সমস্যা? যূথি জিজ্ঞেস করল।
সমস্যা বলতে ভায়রাভাইয়ের বাসায় নেমন্তন্ন ছিল। কেন গেলাম না। তার জবাবদিহি করলাম এতক্ষণ।
অবশেষে সবাই পৌঁছল স্পটে। বিশাল জায়গা, ছত্রিশ বিঘা। সবই আছে সেখানে, নবান্নের ধান তোলা হয়েছে বলে মালিহা জানাল। গোরু আছে। আছে বাগান, গাছপালা ও পদ্মফুলের টাব। টাবে পানি দেখে সেখানে ব্যাঙ আস্তানা গাড়ে, আর ব্যাঙের লোভে আসে সাপ। সুতরাং টাবগুলোতে মালিহা নেট দিয়ে দিয়েছে। রাতে শেয়াল ডাকে সেখানে। আকাশ আবারিত প্রকৃতির ছবি তুলে চলল, শুনল ঘুঘুর ডাক।
আকাশ মালিহাকে একটা পার্ল উপহার দিল। ওর সংগ্রহে থাকা জেমস্টোন ও হিরা-মুক্তার মধ্যে সেরা মুক্তা সেটা। কিছু জেমস্টোন সে জাপান থেকে এনেছিল। সেগুলো এখনও তার শখের কালেকশন আছে। গতবছর সামারে সে টরোন্টোর জেরার্ডে ইন্ডিয়ান মেলায় গিয়েছিল, সাথে ছিল ইতি। ইতি ইন্ডিয়ান চটি ও একসেট পোশাক কিনল শিখ স্টল থেকে। আকাশ ইতিকে একটা স্টল থেকে মুক্তা কিনে দেয়। ক্যানেডিয় তিরিশ ডলার দাম পড়েছিল। ইতি এই মুহূর্তে ভারতীয় স্টলে তো পর মুহূর্তে বাংলাদেশি চুড়ির স্টলে ছুটছে। আকাশ পূব দিক দেখালে ইতি যায় পশ্চিমে। বাংলাদেশি স্টলে এসে তার শিল-পাটা কেনার শখ হলো। দাম-দর প্রায় স্থির, এইসময় ইতি বলল সে কিনবে না। ইতি নিজের ইচ্ছেমতো ছুটতে ছুটতে একসময় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সেই অবসরে আকাশ রত্নের দোকানে ফিরে এসে আরেকটা মুক্তা কিনে ফেলল।
ভাগ্যিস সেদিন দ্বিতীয় মুক্তাটা কিনেছিল। চরম বিপদের মুহূর্তে সেটা কাজে দিয়েছে। মালিহাকে অন্তত একটা পারফিউম উপহার দিতে হতো, আর ভালো একরা পারফিউম কিনতে হলে নিদেন হাজার চারেক টাকা তার চলে যেত। মুক্তাটা তার কঠিন সময়ে পরম বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়াল।
বারান্দায় বসে ছিল আমলা দম্পতি--আশিক ও তার অতীব সুন্দরী বউ। আকাশকে চিনতে পেরে লাফ দিয়ে উঠল আশিক। কুশল বিনিময় হলো। মিট মাই ওয়াইফ, বলে আশিক বলল, সূচনা, ওর নাম আকাশ। আকাশ বলেই চিনতাম, ভালো নাম ভুলে গেছি। আকাশ বলল, ভালো নাম তো আমি নিজেও ভুলে গেছি। যাক, শুনেছিলাম ভাবি অনেক সুন্দরী। আজ চোখে দেখলাম। সূচনা ভাবি লজ্জিত হাসল, তারপর বলল, থ্যাঙ্কিউ। আপনিও তো খুব হ্যান্ডসাম। যুগ্মসচিব আশিকুর রহমানকে সামান্য অপ্রতিভ দেখাল। আকাশ কারণটা আন্দাজ করল। আশিক আগে থেকে আনস্মার্ট গোছের ছিল। মফঃস্বল থেকে পড়তে এসেছিল। থাকত মুহসিন হলে। হলের খাবার খেত। দিনরাত পড়াশোনায় মজে থাকত। সে যে জীবনে একটা লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছে, তার সেই হলে থাকার চালচিত্র আকাশকে এই মুহূর্তের কথাই মনে করিয়ে দিল।
বহুবছর পর নেপাল-ইন্ডিয়া ভ্রমণের আরেক সাথী গোর্কির সাথে দেখা হলো।
মালিহা রীতিমতো রাজকীয় আয়োজন করেছিল। সবাই পেটপুরে খেল পোলাও, রোস্ট, গোরুর ঝাল মাংস, গলদা চিংড়ি ও বেগুন ভাজা। আকাশ মাঝেমধ্যেই আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। কানে বাজছিল ভায়রাভাই শরাফতের কথাগুলো। সে তেমন খাচ্ছিল না। লক্ষ করল হোস্ট মালিহা, সে কিছু না বলে ওর পাতে দু’টো গলদা চিংড়ি উপুড় করে দিল। যূথি একটু দূরে বসে খাচ্ছিল আর রাশিদার কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিল।
এদিকে পুলিস গোপাল ছবি তুলে যাচ্ছে। সে নাকি ঘন জঙ্গলে থাকতে থাকতে আজকাল কবি বনে যাচ্ছে। আকাশ তারপর যোগ দিল ফটোশেসনে। ব্যারিস্টার ভাই মালিহার জমিদারি আদলের খাটগুলোর একটায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল! সম্ভবত আকাশ নামের এক ক্যানেডিয়র সঙ্গে তার বউয়ের এককালে দহরম-মহরম ছিল সেটা মনের পটে ফুটিয়ে তুলে চরম হতাশায় ম্রিয়মাণ হয়ে ঘুমের রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। আকাশ তার মোবাইল ফোনে ঘুমন্ত মানুষটার ছবি তুলে ফেলল। লক্ষ করল আশিকের সুন্দরী বউ। বলল, আমিও এই দৃশ্যটা তুলতে চাইছিলাম।
কিন্তু কেন সে তুলল না--সেটা ব্যাখ্যা করেনি।
দল ভাগ হয়ে এস্টেট ঘুরে দেখে একসময় বারান্দায় সবাই বসল চা চক্রে। এমন সময় পেছনের জঙ্গল থেকে বারান্দায় আসতে দেখা গেল অতীব সুন্দরী আশিক গিন্নিকে। মুনিবার পাশে বসে থাকা যূথি বলে উঠল--বোধহয় ইয়াং কাউকে খুঁজতে গিয়েছিল। মুনিরা তিরস্কারের ভঙ্গিতে তাকাল যূথির দিকে। আকাশ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ভাবি প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে যেতে ওদিকে গিয়েছিল। সুন্দরী ভাবি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল--মনের কথাটা বলেছেন।
আশিকের হস্তক্ষেপে আর চায়ের মিঠে গন্ধে ভাবিকে উদ্দেশ্য করা বলা যূথির কথাটা হারিয়ে গেল।
ফেরার পথে এক পর্যায়ে কেউ কথা বলছিল না। এমনকি যূথিও না। আকাশ বলল, যূথির এনার্জি শেষ। সম্ভবত চার্জড হচ্ছে। পেছন থেকে মুনিরা বলল, নামাজ পড়ছে যূথি।
নামাজ! হ্যাঁ, যাওয়া আসা ও ভালুকায় মালিহার বাংলোতে পৌঁছে সব ওয়াক্তের নামাজ আদায় করেছে সে। যাইহোক, নামাজ শেষ করে যূথি ফের শুরু করল তার বকবক। তার পাল্লায় পড়ে আকাশ আর মুনিরা নেহাত চুপচাপ থাকেনি, তবে তা যূথির তুলনায় সিন্ধুর অশেষ জলে বিন্দু কণা মাত্র।
সন্ধেয় ফিরে আসার পথে মুনিরা একটা ঘটনা বলল--যূথির ভয় পাওয়া নিয়ে। কক্সবাজারের এক মোটেলে যূথি একবার মুনিরার কক্ষে আসছিল, আবার ফিরে যাচ্ছিল নিজ কক্ষে। মুনিরা ভেবেছিল যূথিকে নিশিতে পেয়েছে। কিন্তু যূথি জানাল সে ভূতের ভয় পাচ্ছে।
মুনিরা বলল, ভূত! কোথায়?
ওরা কি নির্দিষ্ট স্থানে থাকে? ওরা নিঃশব্দে, মানে কখনও কোনো আকারে, কখনও বা নিরাকারে বিচরণ করে।
তুই ভূত দেখলি কিনা তাই বল।
এখনও দেখিনি, তবে নি:শ্বাসের শব্দ শুনেছি।
নে হয়েছে, এবার শুয়ে পড়।
তুমি ভূতে ভয় পাও? মানুষকে ভয় পাও না? আকাশ জিজ্ঞেস করল।
না। মানুষকে আমি মোটেও ভয় পাইনা। অনেকটা চ্যালেঞ্জের সুরে বলল যূথি।
আবার নিঃশব্দতা। তবে নীরবতা বেশিক্ষণ বজায় থাকেনা যূথির জন্য। সে বলল, মনে হচ্ছে তুমি মানুষকে খুব ভয় পাও আকাশ।
তা একটু পাই বৈকি।
কাকে ভয় পাও, বউকে? ভাবি বুঝি ফোন করেছিল?
চমকে উঠল আকাশ কথাটায়। আর ওর চমকানো যূথির দৃষ্টি এড়াল না। আবার বলল, ভাবি বুঝি ফোন করেছিল?
ফোন! ভাবি? কখন?
ওই যে তুমি গাড়ি থেকে নেমে ফোনে চাপা উত্তেজনায় কথা বলেছিলে?
আকাশের চোখে স্পষ্ট হতাশা নামল--যূথির চোখ এড়ায় না কোনো কিছুতেই। আকাশ জবাব দিল, ফোনে যখন কথা বলছিলাম ক্যানেডায় তখন রাত গভীর, তাই না? তুমি তো টরোন্টোতে ছিলে। রাত গভীরে জেগে, পরদিন সকালে ডিউটির কথা বিস্মৃত হয়ে বউ বুঝি ফোন করবে আমাকে?
শেয়ালের মতো হাসল যূথি। বলল, মাথা গরম থাকলে রাত গভীর আর ভোর সকাল অল দ্যা সেম।
আমার ভায়রাভাই ফোন করেছিল। তুমি আমার সেলফোনে নাম্বারটা দেখতে পারো, এটা লোকাল নাম্বার।
তোমার বউয়ের নাম কি?
ইতি।
ইতি, বিড়বিড় করল যূথি, বউ কি ইতিবাচক নাকি তোমাকে ইতি মানে বাই বলতে চায়?
মুনিরা যে এমন বেঢপ হাসি দিতে পারে, আকাশ ভাবতে পারেনি। মুনিরা গাড়ি কাঁপিয়ে হাসছে। অথচ আকাশ আশা করেছিল মুনিরা যূথিকে থামিয়ে দেবে।
আকাশ বোকার মতো হাসছিল। যূথি আক্রমণ শানাল আবার--তা একা কেন? ইতিকে নিয়ে এলে না?
আমি প্রয়োজনে এসেছি। ওর আসার দরকার ছিল না। একটু সম্পত্তিগত ব্যাপার। তাছাড়া ওর ছুটি ছিল না।
আকাশ, লেম এক্সকিউজ দেখিও না। আমার মনে হচ্ছে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
সেটা হলে তুমি খুব খুশি হবে?
আমার খুশি অখুশির ব্যাপার না। বিষয়টা জানতে পারলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারতাম।
ড্রাইভার রউফ আকাশকে বাঁচিয়ে দিল। বলল স্যার তো মিরপুর যাবেন। এখানে নামবেন? এখানটা কোন্ স্থান আকাশের জানা ছিলনা। দিনের বেলাতেও এই শহরকে চেনা যায়না, আর এই রাত ন’টায় সে চিনবে কী করে? আকাশ বলল, এখানেই নামব।
একটা আসন্ন উত্তেজনাকর পরিস্থিতি থেকে বঞ্চিত হয়ে যূথি ও মুনিরার মুখ আমসির মতো হয়ে গেলেও আকাশকে উষ্ণ বিদায়বার্তা জ্ঞাপন করতে ভুলল না।
সিএনজি নিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে আকাশর মনে হলো সে যেন এক পোড়ো মানব। ভাবল--স্ত্রী কর্তৃক পরিত্যক্ত মানবের জন্য পৃথিবীর কোনো স্থানই বিচরণযোগ্য নয়।
(পরবাস-৬৬, মার্চ ২০১৭)