ISSN 1563-8685




একটি মেয়েলি প্রেমের গল্প

ঘু মটা কেন যে ভেঙে গিয়েছিল সেটা ইজাজ বুঝতে পারেনি। ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই প্রবল হ্যাংওভারের সমস্ত রকম উপসর্গের মধ্যেও চক্ষু-কর্ণ দুই প্রধান ইন্দ্রিয়ের উপর অত্যাচারের যে প্রমাণ হাতেনাতে পাওয়া যাচ্ছিল, যত্নসহকারে তার বিশ্লেষণ যদিও করতে লেগেছিল ও—কাছাকাছির মধ্যেই কোথাও, যাকে বলে, ‘অত্যন্ত উচ্চস্বরে’, নাগিন ডান্স চলছে, ঘুমন্ত অবস্থাতেও কানের ভেতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করার ক্ষমতা সে গানের আছে, আর অন্যদিকে জানলার কাচ দিয়ে সূর্যের আলো অন্ধকার ঘরে ঢুকে বন্ধ চোখের পাতার উপরে পড়ে চোখের মধ্যে যেন সুঁচ বিঁধিয়ে দিচ্ছে। ইজাজ যদিও জানে, যে, চোখে সুঁচ বিঁধিয়ে দেওয়ার, বা, কানের মধ্যে দামামা পেটানোর এই যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির অনেকটাই ওর নিজের দোষ, কর্মফল, পবিত্র কুরানের সুস্পষ্ট নির্দেশ অমান্য করবার পরিণতি...

...বালের—আগের রাতে ইলিয়ানার পার্টিতে বাড়াবাড়ি রকম নেশা করার পরিণাম। কিন্তু—কাতর গোঙানির একটা শব্দ করে ডানহাতের কনুই ভাঁজ করে চোখের উপর হাতটাকে চাপিয়ে দিয়ে চোখদুটোকে রোদের দাপট থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে করতে, ভেবেছিল ও, চোখ কানের উপর এই যুগল অত্যাচারের কোনওটাই তো প্রতিদিনকার ঘটনা নয়, ঘুমের দফা শেষ করে দেওয়ার জন্য দুটোর মধ্যে যে কোন একটাই যে যথেষ্ট!

গানের শব্দটা সম্ভবত আসছে দু'তিন বাড়ি পরের আজহারের তুতো বোন নাজমিনের নিকাহ্ উপলক্ষে। ছোট একচালা ঘর একটা, সামনে একফালি বারান্দা আর একটা বাসন মাজার জায়গা, রাস্তার ঠিক উপরে যেখানে সদর সেখানটায় দরজার অভাবে ছেঁড়া নোংরা বস্তা টাঙিয়ে ইজ্জত রক্ষা করার একটা করুণ চেষ্টা করা হয়েছে। ওদের বাড়ির হাল ইজাজদের দু’কামরা এই পলস্তারা খসানো বাড়ির চেয়েও আরো বোধ হয় খারাপ। সেই শ্রীহীন বাড়ি আর পাশের আজহারদের বাড়ি জুড়ে আজ উৎসব। উপায়ের অভাব থাকলেও উৎসাহের অভাব নেই। উপায়ের অভাবটাকেই তাই মহোৎসাহে বিশ্রীরকম শব্দ করে ঢেকে রাখতে চায় মনে হয় ওরা। এ তো গেল শব্দ। আলোটা অন্যদিকে—ঘষা কাচটা ইজাজের মা বহু সাধ করে লাগিয়েছিল ইজাজের ঘরের জানলায়। বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধনের দিকে নজর ছিল সম্ভবত মায়ের। সরু গলির পাশে ওর ঘরটা, গলি থেকে ওদের বাড়ির ওই ঘরটাই দেখা যায় একমাত্র, আর ওই জানলাটাই। সাধারণত, ওই জানলায় মোটা খাকি রঙের কাপড়ের পর্দা ঝোলানো থাকে একটা। আলো আটকায়। আজকেই ছিল না। বোন পর্দাটা খুলে নিয়ে গেছে কাল ধোবে বলে, পাশের বাড়িতে বিয়ে বলেই সম্ভবত। তবু—আর দিন পায়নি পর্দা ধোবার! গোঙানির মত কাতর একটা শব্দ করে কোনওমতে ভার হয়ে থাকা শরীরটাকে উলটে উপুড় হয়ে শুয়ে তেলচিটে কালো হয়ে যাওয়া বালিশে মুখ গুঁজে দিয়ে নিজের এইমুহূর্তের দুঃখজনক অস্তিত্বটাকেই প্রাণপণে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল ইজাজ। আর খাবে না হুইস্কি, যতই ফ্রি জুটুক না কেন—প্রতিমাসে অন্তত দুবার করে ইজাজ এই শপথ করে—আজও মনেপ্রাণে সেই শপথের পুনরাবৃত্তি করতে করতে—সেই প্রবল হ্যাংওভারের মধ্যে আগের রাতের অস্পষ্ট ছেঁড়াছেঁড়া টুকরো স্মৃতিগুলোকে নিজের নেশাগ্রস্ত মস্তিস্কের বিভ্রম বলেই প্রায়, প্রা-আ-য় ধরে নিয়েছিল ও।

***

ছেঁড়াছেঁড়া টুকরো স্মৃতিগুলোর অর্থ স্পষ্ট। কিন্তু সে অর্থটা অবিশ্বাস্য। অসম্ভব।

জলপাই রঙের নরম মসৃণ চামড়ার ফালি। আঙুল আর নখ আর দাঁত দিয়ে ছুঁয়ে-আঁচড়ে-কামড়ে অনুভবে সেই প্রলোভনকে স্পর্শ করা।

নেশার্ত খিলখিলে হাসি। নিজের জিভ আর ঠোঁট দিয়ে সে হাসির স্বাদ আস্বাদন করা।

নেশাগ্রস্ত মস্তিস্কের উদ্ভট বিকার ছাড়া অন্য কোন যুক্তিপূর্ণ উপায়ে ও স্মৃতির ব্যাখ্যা করা যায় না।

ওদের কলেজের অহনা চক্রবর্তী বড়লোকের মেয়ে। চোখে মোটা গোল ফ্রেমের আপাত অ-স্টাইলিশ, কিন্তু আসলে স্টাইলিশ দামী চশমা। চশমার ফাঁকে ধীর কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। মোটা মোটা করে শেপ করা ঘন ভুরু। ঠোঁটে শান্ত আধাফোটা আধা না-ফোটা হাসি। গায়ের রং শ্যামলা।

ইজাজ অহনাকে অপছন্দ করে।

কলেজ ক্যান্টিনে যখন অহনার ‘আঁতেল’ বন্ধুরা সোশ্যালিজম্ আর ক্যাপিটালিজম্ নিয়ে জোরালো তর্ক করে, তখন জিভের উপর 'চুক্' করে অধৈর্য একটা শব্দ ক'রে, উদ্ধত মাথা সতেজে নাড়িয়ে অহনা বলে, “দূর! তোরা কোনও খবর রাখিস না! অতই সহজ নাকি সব কিছু? চায়ের কাপে তুফান তুলেই তোরা—” কথাটা শেষ না করেই ও থেমে যায়। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে মনে হয়। বন্ধুদের খেপিয়ে তোলাই যে ওর উদ্দেশ্য ছিল না সেটা মনে করে নেয় একবার, তারপর গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলে, “—ভেনেজুয়েলার অর্থনীতির কি হাল জানিস? ওদের দেশের—” ওকে দেখে ইজাজের হাসিও পায় আর প্রবল চিড়বিড়ে বিরক্তিও জাগে একসাথে। অহনার চিন্তাভাবনা সব চলে ওর সমশ্রেণীর আর পাঁচটা ‘ভাল’মানুষের মতই বইপড়া ভালমানুষীর বাঁধা পথে, যেসব বিষয়ে কোনওদিন কোনওকালে সামান্যতম অভিজ্ঞতাটুকুও ওর নেই সেসব বিষয়েই ওর সুস্পষ্ট ও জোরালো মতামত আছে এক একটা। অন্য বেশিরভাগ মানুষকেই যে ও একটা আঁতেল অবজ্ঞার চোখে দেখে সেটা পরিষ্কার ইজাজের কাছে; আবার, অন্যেরা ওর উপরে বিরক্ত না হয়ে ওঠে সেটা নিয়েও ওর যথেষ্ট মাথাব্যথা।

অহনাদের আঁতেল আড্ডা থেকে নিরাপদ দূরত্বে ইজাজ বসে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে। প্লাস্টিকের ছোট্ট কাপে ধোঁয়াওঠা গরম লেবু চা ধরা থাকে একহাতে, অন্যহাতে থাকে সিগারেট। ও অহনাকে লক্ষ করে। আর সব বড়লোকের বাচ্চার মতই গরীবদের নিয়ে, দুঃখী মানুষদের দুঃখের রসালো বর্ণনা নিয়ে সমবেদনায় মজে থাকতে ভালবাসে অহনা। ওর মধ্যে নূতনত্ব নেই কোন। তবু যে ওকে ইজাজ একটু বিশেষভাবে লক্ষ করে, তার কারণ সমস্তকিছুর মধ্যেও অহনার মধ্যে জোরালো একটা ঐকান্তিকতা আছে যেন। যেন, যে কথাগুলোকে মুখে ও বলে সে কথাগুলোতে ও সত্যিই বিশ্বাসও করে! যেটা কৌতূহলোদ্দীপক আর বিরক্তিকর একসাথে।

ওর এই লক্ষ করাটাকে অহনাও লক্ষ করে বোধহয়। টেরিয়ে টেরিয়ে ওও তাকায় মাঝে মাঝে ইজাজের দিকে, অর্ধদৃষ্টিতে। একটু যেন ঘাবড়ে যাওয়া অর্ধদৃষ্টিতে।

মাঝে মাঝে ইজাজের মনে হয়, অহনা ছেলে হলে ওর নাকে সজোরে একটা ঘুষি বসাত ও। একটু হয়তো তৃপ্তি পেত তাতে।

এইরকম সময়গুলোতে ইজাজের পাশের চেয়ারে সাধারণত বসে থাকে ইলিয়ানা। ইজাজের সিগারেটটায় মাঝে মাঝে টান লাগায়। বড়লোকের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও, এবং এই আঁতেলমার্কা কলেজে পড়তে আসা সত্ত্বেও ইলিয়ানার মধ্যে শখের আঁতলামো নেই। ওর পয়সা আছে, সে পয়সা ও উড়ায় দু'হাতে। বাপের একমাত্র আদুরে মেয়ে। মাঝে মাঝেই পার্টি দেয় বাড়িতে, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সব সহপাঠীদের নেমন্তন্ন করে। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলকেও করে। ইজাজ নিমন্ত্রণ পায় আর গিয়ে এন্তার হুইস্কি গেলে ওর পার্টিতেই। ইলিয়ানা, ইজাজ ভাবে মনে মনে, এই কলকাতা শহরটার মত, ভিতরে দারিদ্র্য আর ফাঁকাভাব লুকোনোর মত লজ্জা ওর অনেক আছে, কিন্তু সেসব অতি নির্ভাবনায় নিশ্চিন্তে অবহেলা করে বসে আছে, এই অন্য বড়লোকের সন্তানদের মত অর্থহীন জীবনে অর্থ আনার জন্য অন্যের জীবনসংগ্রামকে মাস্টারবেট করার উপাদান হিসেবে অন্ততপক্ষে ব্যবহার করছে না। ওর ব্লিচ করা কৃত্রিম রকমের সাদা দাঁতের ঝলকের মতই ইলিয়ানার সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বটাই যেন কৃত্রিম, অথচ ধারও আছে ওর। সেই ইলিয়ানাকে ইজাজ বলে অহনার জোরালো মতামত শুনতে শুনতে অলসগলায় আলগা স্বরে একগাল সাদা ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে, “অহনা...অ্যাঁ? বহুত বকে, অ্যাঁ? ছেলে হলে অ্যাদ্দিনে একটা ঘুষি-টুষি খেয়ে যেত।”

ইলিয়ানা তাকায় ওর দিকে, উত্তর করে না কয়েক মুহূর্ত, তারপর বলে, ভুরু নাচিয়ে, “হুউম্?”

ইজাজ 'হাফ্' করে একটা নিশ্বাস ফেলে মুখের উপর ডানহাতের তালু ঘষে নেয় জোরে জোরে, ‘হুউম্’ই বটে, চুক্ করে শব্দ করে জিভের উপরে একটা। গরমে ওর ফর্সা চামড়া জ্বালা জ্বালা করে। বলে, “একনাগাড়ে এত বকে যায়... শুনতে শুনতে মাথা গরম হয়ে যায়—প্রিটি শ্যিওর ও ছেলে হলে ওর এই...” একটু থেমে থেকে আরো বিড়বিড় করে বলে, “আমিই হয়তো ঘুষি কষাতাম একটা নাকে।”

“প্রিটি শ্যিওর--” মধুর হাসি হেসে বলে ইলিয়ানা, অহনাকে ঘুষি মারার ইজাজের ভায়োলেন্ট ইচ্ছার কথা শুনে একটুও ও চমকেছে মনে হয় না, বরঞ্চ কৌতুকে চকচক করে ওঠে ওর চোখ, “--দ্যাটস্ ইয়োর সেক্সুয়াল ফ্রাস্ট্রেশন টকিং।” চোখের ইঙ্গিত করে অহনার দিকে, “শি ইজ্ প্রিটি ইয়াহ্? ইন এ নার্ডি কাইন্ড অফ ওয়ে?” তারপর চোখ মিটমিট করে বলে, “মনে করিস না আমি দেখিনি তুই ওর দিকে তাকিয়ে থাকিস হাঁ করে।”

ইজাজ হাফ্ করে আবার নিশ্বাস ফেলে একটা। হাতে ধরে থাকা সিগারেটে টান দেয়। ইলিয়ানার কথাটা নিয়ে হাসাহাসি করা যেতে পারত, সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু, অহনার প্রতি ইজাজের সেক্সুয়াল অ্যাট্রাকশন আছে এই ইঙ্গিতটা কেন যেন ইজাজের কাছে অপমানজনক মনে হয়। ওই আঁতেল এনটাইটেলড্ ব্র্যাটের উপর...? এজন্মে নয়। গম্ভীরমুখে ধোঁয়া উড়িয়ে ভাবে ইজাজ।

তো সেই অহনার দগদগে ক্ষতের মত লাল টুকটুকে লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটে সজোরে কামড় বসানোর এলোমেলো ভাসাভাসা নেশার্ত স্মৃতিকে স্মৃতি বলে স্বীকার না করে কল্পনা বলেই মেনে নিয়েছিল তাই ইজাজ। আজ এই প্রবল হ্যাংওভারের মধ্যে নাজমিনদের বাড়ি থেকে ভেসে আসা জোরালো শব্দরাশিকে অগ্রাহ্য করে আবার অবলিভিয়নের মধ্যে তলিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল ওই টুকরো ধাঁধার মত ছবিগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে।

***

পরের দিন ইজাজের মেজাজটা সপ্তমে চড়ে ছিল। থাকার কথা। আগের দিন সারাদিন আর অর্ধরাত ধরে সপ্তমগ্রামে হানি সিংয়ের মধুমাখা কন্ঠস্বর শুনতে হলে, তাও আবার হ্যাংওভার অবস্থায়, কার না মেজাজ সপ্তমে চড়বে? তার ওপরে কলেজে আসার পথে যে মামার দোকানে দাঁড়িয়ে ইজাজ ওর বরাদ্দ সিগারেটদুটো কেনে প্রতিদিন সে দোকানেও আজ রেডিওতে পিনপিনে স্বরে হানি বিতরণ করছিল হানি সিং। ইজাজের মাথার মধ্যেও সেই গান ঘোরাফেরা করছিল। বহু চেষ্টাতেও সরিয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না মাথার মধ্যে তার গুনগু্নুনি। পানের পিকের দাগে সজ্জিত, ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম...’ ইত্যাদি ইত্যাদি লেখা ইউনির পাঁচিলটার সামনে দাঁড়িয়ে, মনে মনে ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে উঠে যখন পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা সিগারেটের ফাঁকা বাক্সে জোরালো লাথি কষিয়ে সেকেন্ড পিরিয়ডের লেকচারের পরে টানার জন্য বরাদ্দ সিগারেটটা এখনই ধরিয়ে নেবে কিনা ভাবছে, ফুটপাথের অন্যদিক থেকে আসা অহনার মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল ইজাজ।

‘বিদ্যুচ্চমকের মত মনে পড়ে যাওয়া’ কথাটা ইজাজ আগে শুনেছিল। মানে, কোনও অখাদ্য রদ্দি মার্কা উপন্যাসে পড়ে টড়েছিল সম্ভবত, যখন একসময় বইয়ের অভাবে হাতের কাছে ঠোঙা টোঙা যা পেত তাই খুলে পড়ত ও। বা, ওর মা ঠোঙা বানানোর জন্য যে খবরের কাগজের গাদা কিনে আনত ওদের বস্তির পাশের ফ্ল্যাটবাড়িগুলো থেকে সেগুলোর মধ্যে অভিযান চালাত গল্পের খোঁজে।

কথাটা আগে শুনেছিল, তার মানেটা অ্যাদ্দিনে বুঝল। ইয়ার্কি নয়, আগের রাতের ভাসাভাসা স্মৃতির টুকরোগুলো খাপে খাপে জুড়ে গিয়েছিল একেবারে এক লহমায়।

ওদিকে অহনার মসৃণ জলপাই ত্বক বেগুণীটে হয়ে উঠতে চাইছিল। চশমার ফাঁকে সচকিত হরিণীর মত গোল গোল চোখ চঞ্চল হয়ে উঠেছিল।

এদিকে, একটা আদিঅন্তহীন অনিমেষ মুহূর্তের পরে ইজাজের মনের কোনও কোণে আর কোনও সন্দেহ বাকি ছিল না যে, এক) না, দু’রাত আগের ঘটনাটা নেহাৎই নেশার ঝোঁকের কল্পনা নয়—কল্পনায় ওই দগদগে ভাব থাকে না, বা কল্পনা বুকে ধাক্কা মেরে যায় না অত জোরের সাথে। আর, দুই) অহনার অন্ততপক্ষে স্পষ্ট মনে আছে সবকিছু।

‘বালের’ একটা ঢোঁক গিলে চোখ বুজে ভেবেছিল ইজাজ।

***

ব্যাপারটাকে শিগগীর্‌ই ভুলে যেতে হবে, মনস্থির করেছিল ইজাজ।

দুজনেই ওরা মাল খেয়ে চুর হয়েছিল। না হলে কোনোভাবেই ও ঘটনা ঘটত না, এটা তো বোঝাই যাচ্ছে।

না হলে—অহনার প্রিভিলেজড্ আঁতেল মতামতের সঙ্গে পরিচয় ইজাজের আজকের নয়! তা সত্ত্বেও যে সেদিন পার্টিতে ইজাজ মুখ খুলেছিল অহনার ‘ইসরো’র লেটেস্ট অভিযান সম্পর্কে বক্তিমে চলার সময়; অহনা নিজের রং করা ঠোঁটদুটো খুলে যখন বলেছিল, “আরো পয়সা খরচ করা উচিত এই সব বৈজ্ঞানিক গবেষণার পিছনে। বাজেট বাড়ানো উচিত!” কারণ? “কারণ, দেশের গর্বের বিষয় এটা! বিজ্ঞানের উন্নতিতে আখেরে দেশেরই উন্নতি হবে...” ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন যে ইজাজও মুখ খুলেছিল, “যেন--” ও যে বলেছিল তখন, “যেন--ভারত মহাশূন্য জয় করলে কিছু আসবে যাবে দুবেলা দুমুঠো ভাত না জোটা দেশের সত্তর শতাংশ মানুষদের! যেন ‘দেশের গর্ব’ কথাটার কোনও অর্থ আছে তাদের কাছে! যেন বৈজ্ঞানিক গবেষণার সুফল আপনা থেকে ঝরে পড়বে ক্ষুধার্ত মানুষের কোলে--” যেন- যেন- যেন— প্রবল যে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল আচমকাই ওর স্বভাববিরূদ্ধ ভাবে, অহনাকে ধরে আচ্ছা করে ঝাঁকুনি দেওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল, সেটা তো প্রবল নেশারই পরিণতি!

অহনাও—ওও যে সেই উত্তেজনার জবাবে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, মার্জিত কৌশলে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করেনি যেমনটা ওর অভ্যেস, সেটাও নেশারই কৃপায়।

তারপরে সেই অ্যাড্রিনালিনের প্রভাবে যা ঘটেছে সেটাও—

—কাজেই, এসম্পর্কে আলোচনার প্রয়োজন নেই। ওটাকে নেশার্ত ফ্যান্টাসি বলেই ধরে নিয়ে ভুলে যেতে হবে।

***

—কিন্তু, সবকিছু ভুলে যাওয়া বা এড়িয়ে যাওয়া অত সহজ নয়।

“আঃ!” ইলিয়ানা বলেছিল একটু পরেই; ক্লাসে ঢোকার মুখে, “—তারপর”

“তার আর পর নেই।” বলেছিল ইজাজ।

“সিরিয়াসলি?” ইলিয়ানা বলেছিল গলায় ঢেউ খেলিয়ে। ‘রি’ আর ‘লি’ এর উপর অন্যাবশ্যক জোর দিয়ে।

“আমার কোনও ধারণা নেই তুই কী বলছিস।” ইজাজ বলেছিল দরজার পাশের দেওয়ালে হেলান দিয়ে।

“তেমন কিছু না।” বলেছিল ইলিয়ানা, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখেছিল করিডরের কে কোথায় আছে, তারপর যেন তাদের শোনানোর জন্যই বেশ উচ্চস্বরে, “এই পরশুদিনের পার্টিতে তুই আর অহনা মাঝরাস্তায় হঠাৎ কোথায় হাওয়া—”

“বাজে বকিস না।” বলেছিল ইজাজ তাচ্ছিল্যের সুরে।

ইলিয়ানা ওর কথাটাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়ে বলে চলেছিল, “তা-ছাড়া— আমার নিচের তলার গেস্ট বেডরুমটার চাদরের হাল—”

ইলিয়ানার গেস্ট বেডরুম আছে। একটা নয়। অনেকগুলো। বিভিন্ন তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তারই মধ্যে একটা গেস্ট বেডরুমের চাদর যে দামী মসৃণ সিল্কের, আর তার রঙ যে কালো—কালোর উপর লাল অ্যাবস্ট্রাক্ট ডিজাইনের—আর...সেই কালো লালের উপরে অহনার জলপাই রঙ যে গর্জাস দেখায়—এইসবই ইজাজ জানে।

নোংরা সরু গলিতে পায়রার খোপের মত দু’কামরা টিনের চালের বাড়িতে বসে ইজাজের মা-বোন এতটা কল্পনাও করতে পারে না। ওর জীবন নিয়ে অনেক বিদ্ঘুটে বিদ্ঘুটে কল্পনা ওরা করে তা যদিও ইজাজ জানে। ওদের ছোট রঙিন টিভিতে খবরের চ্যানেলে ইজাজেরই ইউনির মেয়েদের 'কিস অব লাভ' বা 'স্যানিটারি ন্যাপকিন বিদ্রোহ' করতে দেখে লজ্জায় আর অন্য কোন এক শিরশিরিনি অনুভূতিতে ওদের যে গা কেমন করে ওঠে তা ইজাজ বুঝতে পারে। কিন্তু ইজাজ এটাও জানে যে ওদের কল্পনার একটা সীমা আছে। ওই জিন্স টপ পরিহিতা লজ্জাহীনা 'স্মার্ট' মেয়েগুলো, যারা ওদের নিজেদের থেকে এতটাই দূর জগতের মানুষ বলে মনে হয় যে তাদের চরিত্রের বিচার করতেও ওরা ঠিক যেন সাহস পায় না, ইজাজ যে তাদের একজনের সাথে এতটা অন্তরঙ্গ হতে পারে, এতটা বাড়াবাড়ি কল্পনা করার কথা ওরা কল্পনাও করতে পারে না।

ইজাজ হেসে উঠেছিল হঠাৎ। মাথা নাড়িয়েছিল হালকা হালকা, নিজেরই প্রতি অবিশ্বাসে যেন। ইলিয়ানা কী বুঝেছিল কে জানে? আচমকা গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল ও।

ইজাজ দেখেনি সেটা। লম্বা করিডরের একপাশে সার দিয়ে ক্লাসরুম। অন্যদিকে একটানা খোলা জানালা, মধ্যিখানে একটা করে চৌকো থাম দিয়ে দিয়ে ভাগ করা। জানলা দিয়ে হঠাৎ ফুরফুরে হাওয়ার সাথে সুগন্ধী সাদা কামিনীফুলের পাপড়ি ভেসে এসেছিল দু'একটা। অনেক দিন চুলে শ্যাম্পু করা হয় না। ধূলো পড়ে জড়িয়ে যাওয়া চুলের মধ্যে দিয়ে আঙুল চালিয়ে দিয়ে ইজাজ একটু হেসে বলেছিল, “কী জানিস? হঠাৎ খবর পাই মনে, আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।”

ইলিয়ানা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশুনো করেছে ছোটবেলা থেকে। আনন্দ পাওয়ার জন্য সাহিত্য ওরা পড়ে না কখনো। ওরা সাহিত্য পড়ে সিলেবাসে থাকলে, নয় আঁতেল সভায় যোগদান করার জন্য। ইলিয়ানা আঁতেল নয়। রবীন্দ্রনাথ ও যে কখনো পড়েনি তাতে ইজাজের কোনও সন্দেহ নেই।

হেসে ইজাজ ক্লাসে ঢুকে পড়েছিল সন্দিগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকা ইলিয়ানাকে ওখানেই রেখে। মনটা দিব্যি ঠান্ডা হয়ে ফুরফুরে হয়ে এসেছে দুদিনের চাপা উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে।

***

অহনা এসেছিল দুদিন পরে, অপ্রত্যাশিতভাবে। ইজাজ তখন এক ফাঁকা ক্লাসরুমের পিছনের দিকের জানলার পাশের একটা ডেস্কে বসে ডানহাতের কনুই পিছনের ডেস্কে রেখে এলিয়ে পড়েছে। ক্লাসরুমের ঠিক বাইরের ঝাঁকড়া কাগজফুল গাছের পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে ক্লাসে ঢুকে পড়া প্রায় অপরাহ্নের তির্যক রোদে ধুলোময়লার নাচানাচি দেখছে মন দিয়ে।

ফাঁকা ক্লাসরুম ইজাজের বুদ্ধির ডিমে তা দেওয়ার জায়গা। জ্ঞান জাবর কাটবার জায়গাও বলা যায়। ওর বড়লোক সহপাঠী-পাঠিনীরা ওর এই সুযোগ পেলেই বিভিন্ন ধরনের আড্ডাস্থল, আঁতেল থেকে বাচাল—সমস্ত ধরনের আড্ডাস্থল থেকে পালিয়ে এই ফাঁকা ক্লাসরুমে গিয়ে বসে থাকার কোনও মানে বুঝতে পারে না। তার কারণ বোধহয়, ইজাজ ভাবে মনে, ওদের বুদ্ধিতে তা দেওয়ার জায়গার অভাব পড়ে না ওদের নিজেদের বাড়িঘরে। এসিরুমে কম্পিউটারের সামনে বসে ওরা কী-বোর্ডে বিশ্বের সাথে লড়াই করতে ব্যস্ত থাকে, বুদ্ধিতে তা দেওয়ার ওদের সময়ও হয় না বোধহয়। এমনিতে তা দেওয়ার মত বুদ্ধি ওদের আছে কিনা ইজাজের সন্দেহ আছে তাতেও, কিন্তু সেটা অন্য প্রসঙ্গ। ইজাজের অবস্থা, অন্যদিকে, যাকে বলে ‘তথৈবচ’। ওর এই ফাঁকা ক্লাসরুমের নির্জনতাটুকুর দরকার পড়ে বড়ই বেশি।

এখানে অহনার আসাটুকু অপ্রত্যাশিত তার কারণ, প্রথমত, ইজাজ যে এই মুহূর্তে এখানে থাকবে সেটা ওর জানার কথা নয়, আর দ্বিতীয়ত, এবং প্রধানত, এটা ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডের রীতিনীতির মধ্যে পড়ে না। যতদিন না এক রাতের বন্যতার স্মৃতিটুকু একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় ততদিন পরস্পরকে এড়িয়ে চলাই নিয়ম। অন্ততপক্ষে ইজাজ যেটুকু জানে তাতে।

এখন, অহনার চরিত্রের খুব সুনাম নেই। যে অর্থে চরিত্র বলতে আমাদের দেশে আমরা শুধু যৌনচরিত্র বুঝি, ভালমানুষী, সততা, পরোপকার প্রবৃত্তি ইত্যাদিকে আমরা চরিত্রের সংজ্ঞার মধ্যে ফেলি না, সেই অর্থে অহনার চরিত্রের সুনাম নেই।

ওর সম্পর্কে বহু ধরনের গুজব শোনা যায়। ও অস্কার ওয়াইল্ডের সারকাজম্ থেকে শুরু করে পাবলো নেরুদার প্রেমের কবিতা পর্যন্ত কোট করে স্ট্যাটাস শেয়ার করে ফেসবুকে, আর ওর যে সব ভক্তের দল তাতে হৃদয় প্রতিক্রিয়া দেয় তাদেরই কারো কারো সাথে প্রতিবাদী ধরনায় বসে হেঁড়ে গলা ছেড়ে গান ধরে আর নন্দনে ‘ব্লু লাস্ট’ বা ওরকম কোনও নামের যৌনগন্ধী আঁতেল সিনেমা দেখতে যায়। অন্ততপক্ষে, ইজাজ হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছে যে, নেশা করে অর্ধ পরিচিত মুখচেনা পুরুষের সাথে বিছানায় যেতে ওর আপত্তি নেই। ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডের রীতিনীতিগুলো ওর না জানার কথা নয়।

এইমুহূর্তে, কিন্তু, ওকে দেখে—ফাঁকা ক্লাসরুমে ইজাজের ডেস্কের সামনে ডানপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে প্লাটফর্ম হিলওলা জুতোপরা বাঁ পাটা ক্লাসরুমের ধুলোভরা মেঝেতে ঘষতে দেখে—কিন্তু, সে কথা মনে হচ্ছিল না।

“উম্—” বলেছিল অহনা, গলা খাঁকারি দিয়ে কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিয়েছিল, তারপর চুপ করে ছিল।

ওর আচমকা আগমনের চমকটা কাটিয়ে নিয়ে ইজাজ তাকিয়েছিল ওর—মুখের দিকে নয়, ওর গলার দিকে। অস্পষ্ট ওর মনে পড়ছিল, ওখানে এলোমেলো কুঁচকোনো চুলগুলোর নিচে একটা লালচে রঙের তিল আছে। পরিষ্কার শ্যামলা চামড়ার উপর সেটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

“—কোনরকম ভুলবোঝাবুঝি হয়ে থাকলে সেটা—মানে...তুমি—তু-ই সম্ভবত আমাকে পছন্দ করিস না, মানে—আইডিওলজির পার্থক্য তো—”

সেদিনকার সেই পার্টির আগে সরাসরি অহনার সঙ্গে ইজাজের সেরকমভাবে কথা হয়নি প্রায় কখনোই। নেশাগ্রস্ত সেই ওদের প্রথম আলাপ। সম্বোধনে তুমি বা তুই সম্পর্কেও অহনা অনিশ্চিত। অথচ এতই ওর অ্যাপ্রুভালের প্রয়োজন, এতই ওর গুরুতর প্রয়োজন সকলের সামনে ‘ভাল’ থাকবার যে এমনকি অত্যন্ত অপ্রয়োজনীয় ইজাজের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি না মিটিয়েও ও থাকতে পারে না। ইজাজের চামড়ার নিচের চিড়বিড়ানি অনুভূতিটা বাড়তে শুরু করেছিল আবার।

আজ অহনার ঠোঁটে লিপস্টিক নেই, কিন্তু ঠোঁটদুটো চকচক করছে ঠিকই। ইজাজের চামড়াটা যেন আঁট হয়ে বসেছে ওর শরীরে, নাভির নিচে শিরশিরে অনুভূতি।

কোন এককালে ইজাজের কোন এক সহপাঠী, তাকে ও বন্ধুই বলত, সে ওর পিঠে এক বন্ধুত্বপূর্ণ জোরালো চাপড় মেরে বলেছিল, “শালা তোদের—হিন্দুদের মেয়েদের দিকে এত ছোঁকছোঁকানি কিসের? শালা—” হেসেছিল তারপর নিজের ঠাট্টায় নিজেই, “—তোদের অত ফর্সা ফর্সা মেয়েগুলোর দিকে তো আমরা নজর দিতে যাই না!—” কথাটা এখনই হঠাৎ ইজাজের মনে পড়েছিল কেন কে জানে?

অহনার ঠোঁট শুকিয়ে এসেছিল বোধহয় বাজে বকবক করে করে। জিভ দিয়ে ঠোঁটের পাশটা চেটে ভিজিয়ে নিয়েছিল ও, কোন কথার প্রসঙ্গ টেনে যেন বলে চলেছিল, কানে এসেছিল ইজাজের, “—ভালমন্দ দুই তরফেই থাকতে পারে—আছেই, কিন্—” মোটা ভুরু দুটো কুঁচকে এদিক ওদিক তাকিয়েছিল, তারপর ইজাজের দিকে একপলক তাকিয়ে বলেছিল, “উম্...চুলে চকের গুঁড়ো লেগে—” কথা শেষ না করেই ইজাজের চুলের চকের গুঁড়োর দিকেই বোধ হয় হাত বাড়িয়েছিল কিছু না ভেবেই।

ইজাজ যে ওর সেই বাড়িয়ে দেওয়া হাতের কবজি ধরে হ্যাঁচকা টানে ওকে টেনে এনেছিল কাছে, সেটাও তেমন কিছু না ভেবেই। আজ অহনার ঠোঁটে লিপস্টিক লাগানো ছিল না ঠিকই, কিন্তু কোন রাসায়নিক যে লাগানো ছিল তাতে সন্দেহ নেই। কৃত্রিম ফলের চ্যাটচ্যাটে গন্ধ তাতে। ঠোঁট আর জিভ দিয়ে সেই গন্ধকে তাড়া করতে করতে ইজাজ ভেবেছিল, ‘বিশ্রী ব্যাপার, বাজে, বাজে, বাজে।’

বিশ্রী ব্যাপার আরো এই কারণে যে, আদপেই বিশ্রী লাগছিল না অনুভূতিটা। বরং প্রথম কয়েক মুহূর্তের হকচকানি কাটিয়ে ওঠার পর ক্ষুদ্র একটা নিশ্বাস ফেলে যখন অহনা আলতো একটা হাত রেখেছিল ওর পিঠে, যেন কোন প্রার্থনা পূরণ করার মত করে, জয়ের নেশার মত কোনও একটা অনুভূতি জেগে উঠেছিল ইজাজের মাথায়। অহনার ঠোঁটে জোরালো একটা কামড় বসিয়ে ইজাজ ভেবেছিল, ইজাজ একা কিংবা নতুন নয়, সম্ভবত সবারই প্রার্থনা পূরণ করে থাকে ও।

বিকেলের লালচে রোদ তেরচা কোণে পরিত্যক্ত ক্লাসরুমের জানলা গলে এসে পড়েছিল ওদের উপর। সেই আলোয় বিন্দু বিন্দু ঘামে সজ্জিত অহনার শ্যামলা সাধারণ মুখটাকেই অপার্থিব দেখাচ্ছিল।

ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গিয়েই ইজাজের পায়ের কাছে পড়েছিল সাদা কালো বিড়ালের বাচ্চা একটা। সেটাকে লাথি কষানোর ইচ্ছাটাকে কষে দমন করেছিল ইজাজ।

বেচারা বিড়ালের বাচ্চা, কোনও দোষ করেনি।

***

“অসম্ভব!” ঋজু বলেছিল ওর নিজের হাতে ধরে থাকা কাগজের তৈরি চেনগুলোর দিকে তাকিয়ে, প্রবল মনোযোগের সাথে ও তাকিয়েছিল চেনগুলোর দিকে, চোখদুটো ট্যারা দেখাচ্ছিল প্রায়।

“কিচ্ছু অসম্ভব নয়।” বলেছিল সরণ্যা, “দে দেখি আমার হাতে।...একটা মই হলেই—” এদিক ওদিক ও তাকিয়েছিল মিটমিট করে।

ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিংএ একটা মই নাকি আছে, একটু আগেই খবর দিয়ে গিয়েছিল ওই ডিপার্টমেন্টের শুচিস্মিতা। কিন্তু সেটা আনার লোকের অভাব। অথচ এই চেনগুলোকে সরণ্যা-অহনার ইচ্ছা অনুসারে সিলিং থেকে ঝোলাতে হলে মই লাগবে একটা। ওরা ইতি উতি চাইছিল ব্যস্তভাবে। ইজাজ কোণে বসে লক্ষ করছিল ওদের।

কলেজ রিইউনিয়ন কমিটিতে ডিপার্টমেন্ট সাজানোর কাজে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছা যে ইজাজের ছিল না সেটা বলাই বাহুল্য। এমনিতেই মনুষ্য সংসর্গ ভালবাসে এমন অপবাদ ওকে ওর শত্রুও দেবে না, তার ওপরে এই কমিটির সবচেয়ে উৎসাহী সদস্য সম্ভবত অহনাই। সপ্তাখানেক আগের ফাঁকা ক্লাসরুমের সেই তপ্ত চুম্বনের পর থেকে ইজাজ অহনাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিল। তবু যে এই কমিটিতে ও জড়িয়ে পড়েছিল তার পিছনে কোন ষড়যন্ত্র আছে সম্ভবত, সন্দেহ করেছিল ইজাজ। সন্দেহের প্রথম তীরটা ছিল অহনারই দিকে। কিন্তু সম্ভবত ভুল সন্দেহই ছিল সেটা। অহনা যেমন ভীরু দৃষ্টিতে ওর দিকে কটাক্ষপাত করছিল তাতে এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে ইজাজের আশেপাশের মধ্যে পড়ার ইচ্ছা ওরও ছিল না।

তা সত্ত্বেও, প্রথমেই একটা তর্কবিতর্ক হয়ে গিয়েছিল ওদের মধ্যে—ওর আর অহনার। ইজাজ তর্কে জড়াতে চায় নি। কিন্তু—

মাঝে মাঝে ওর নাকের উপরে চশমাটাকে ঠিক করে বসাতে বসাতে অহনা ওর স্বভাবানুযায়ী বকবক করে চলেছিল সরণ্যা আর নীলার সাথে, ঋজুও মাঝে মাঝে ফুট কাটছিল এদিক ওদিক। আলোচনা চলছিল বর্তমান পৃথিবীর রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর মেরুকরণের রাজনীতি আর এরকম সব বেকার বিষয় নিয়ে। এতই সে সব অপ্রয়োজনীয় বকবক যে ইজাজ মোটেই সচেতনভাবে কান দিচ্ছিল না সে দিকে। কিন্তু...তারই মাঝে অহনা বলে বসেছিল, "লোক পাল্টায়, সমাজ পাল্টায়। সবই পরিবর্তনশীল—এবং ভালর দিকেই।" কথাটা কানে এসেছিল বটে, কিন্তু ইজাজ তখনও কান দেয়নি ওর কথার দিকে, অহনা বলছিল, "না যদি পাল্টাত, তবে আজও আমরা মধ্যযুগে পড়ে থাকতাম।"

তারপর বলেছিল, "মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।"

বালের- রবীন্দ্রনাথ আউড়েছিল, চোখ বড় বড় করে- যেন বেদবাক্য! যুক্তি নয়, হিসাব নয়, ফ্যা্ক্ট নয়, শুধু বিশ্বাস! অন্যদিন হলে, প্রথমত, হয়তো কথাটা ইজাজের কানেই ঢুকত না, দ্বিতীয়ত, কানে ঢুকলেও ও গায়ে মাখত না, আজ কিন্তু,--নাকের মধ্যে তাচ্ছিল্যের হাসি একটা না হেসে পারেনি ইজাজ।

অহনা চকিত চোখে তাকিয়েছিল ওর দিকে। তর্ক বেধে গিয়েছিল তারপর।

ইজাজ বলেছিল, “মানুষ জাতিটার স্বভাবই হিংস্রতা, বিগট্রি। যা নিজেরা বুঝতে পারে না তাকে বোঝার চেষ্টা করে না--ভয় করে, আর ঘৃণা করে।”

ইজাজের কথার ভঙ্গিতে অহনার ভুরু কুঁচকেছিল, লাল ঠোঁটকে কামড়ে ধরে আরো লাল করে তুলেছিল, বলেছিল, “তাই যদি হত, তবে সভ্যতার এত উন্নতি হত কি? আমরা এখনও এগোচ্ছি, এখনও শিখছি। এখনও অনেক কিছুই শেখা বাকি আছে হয়তো, কিন্তু কিছুই কি শিখিনি?”

না কিছুই শিখিনি আমরা। বুদ্ধির উন্নতি আর বিবেকের উন্নতি এক নয়। বড়সড় একটা ক্যাটাস্ট্রোফির পরে সবাই কিছুদিন একটু সামলে চলে, তারপর আবার ফিরে যায় রক্তপিপাসুতায়-- ভেবেছিল ইজাজ। সাধারণভাবে এসব আদর্শবাদী ফাঁকা কথাবার্তা ইজাজ এড়িয়েই চলে। কী করে যে মানুষ এত নির্বোধ হয়, ইচ্ছাকৃত চোখ বুজে থাকা ছাড়া আর কিছুই যে নয় এই ‘মনুষ্যত্বের উপর আস্থা রাখা’ ইত্যাদি গালভারি কথাবার্তা সব।

আজ এড়িয়ে থাকতে পারেনি। অহনার ভালমানুষের মত আপাত নিরীহ মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল ওর।

"এত স্ট্রাগল্ করেও আমরা ঠিকই বেঁচে আছি। মনুষ্যত্বের মৃত্যু হয়নি। সব মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু ভাল আছেই--আমি বিশ্বাস করি--” অহনা বলেছিল। উত্তেজনায় চকচক করছিল ওর মুখ।

আর ইজাজ ভেবেছিল, "এই অহনার মত 'ভাল' মানুষেরাই যুদ্ধ বাধায়, সবাইকে ‘বিশ্বাস’ করে, সবাইকে 'সমান' অধিকার দিতে গিয়ে। বোঝে না যে, সব মানুষ বিশ্বাসযোগ্য নয়, 'সমান' নয়। আর শেষকালে সমস্ত ভাঙচুর শোধরাবার দায়িত্বও কাঁধে চাপে আর দোষও হয় ইজাজের মত বাস্তববাদীদেরই।

ইজাজ অনেক বেছে বেছে, ভেবে ভেবে শব্দ নির্বাচন করেছিল, তাই অহনাকে, ‘নাইভ ফুল’এর চেয়ে বেশি কিছু বলেনি ও। অহনা ওকে বলেছিল ‘সিনিক’।

তর্কের কোন মীমাংসা হয়নি। এতর্কের মীমাংসা হয় না। মানুষকে বিশ্বাস করার ক্ষমতা সবার সমান নয়। কিন্তু, যে মানুষ যত বেশি মানুষের মাঝে পড়েছে, যত বেশি মানুষের সাথে মিশেছে, মানুষের উপর বিশ্বাস তার তত কমেছে--ইজাজের কাছে সেটাই যথেষ্ট নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার জন্য। বিষম অবজ্ঞার সাথে ভেবেছিল--বড়লোকের আতুপুতু আদরে লালিতা মেয়ে--কী বোঝে ওরা পৃথিবীর! ভিতরে ভিতরে রাগে ফুলে চলছিল। গরম হয়ে উঠেছিল রক্ত।

অহনা চোরা চাহনিতে আড়ে আড়ে তাকাচ্ছিল ওর দিকে। ইজাজের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে এতই ব্যস্ত ছিল ও যে ঋজু যে নানাভাবে ওর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে চলেছে সেটা লক্ষই করেনি। ঋজুর অহনার উপর মারাত্মক রকম ক্রাশ আছে, সবাই জানে সেটা। সেই ঋজুকে গ্রাহ্যই করছিল না অহনা।

নাঃ! এটা একেবারেই, বিন্দুমাত্রও সন্তোষজনক মনে হয়নি ইজাজের কাছে।

সে যাক, এই তর্কাতর্কির পরই ইজাজকে সবাই, এই নীলা, সরণ্যা বা ঋজুর দল এড়িয়ে এড়িয়ে চলছিল একটু। ওরা অহনারই বন্ধু মূলত, কেউই সম্ভবত ইজাজকে পছন্দ করে না খুব একটা। যেটা—ইজাজ খুশিই তাতে। কিন্তু, বাকি সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত, এক ইজাজই বসে আছে কোণের দিকে, মই আনতে হলে ওরই যাওয়া উচিত, অথচ কেউ মুখ ফুটে সেই দাবীটা জানাচ্ছে না ওকে, এতে খুশি হবে না একটু অফেন্ডেড হবে সেটাই ভেবে পাচ্ছিল না ও; এমন সময়ে নীলা উঠে দাঁড়িয়েছিল হাতের কাজ ফেলে, ইজাজের দিকে কটাক্ষপাত করতে করতে গ্লিটারের প্যাকেট আর থার্মোকলের টুকরো সরিয়ে রেখেছিল, বলেছিল, “—দেখি, আমিই যাই—”

নীলার দৃষ্টি অনুসরণ করে অহনা ধীর চোখে তাকিয়েছিল ইজাজের দিকে। ইজাজ উঠে দাঁড়িয়েছিল। “নাঃ! আমার স্মোক করতে লাগবে একটু। আসার সময় নিয়ে আসব মই। তুই থাক।” নীলাকে বলেছিল ও, তাকিয়ে ছিল অহনার দিকে। অহনা সামান্য একটা হাসি হেসেছিল যেন।

বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা আড়মোড়া ভেঙে চোখ পিটপিট করে ইজাজ ভেবেছিল, “যত্তসব পাগলামি!”

*

ওদের ডিপার্টমেন্ট সাজানোর কাজ শেষ হতে হতে রাত হয়েছিল। সরণ্যার বাড়ি যেদিকে সেদিকে আর কেউ থাকে না, ও একাই যাবে সেদিকে। তাই একটু আগেই বিদায় নিয়েছিল সরণ্যা। বাকি ওরা চারজন—ঋজু, নীলা, অহনা আর ইজাজ ইউনি ছেড়ে বেরিয়েছিল বেশ রাত করে। খিদে পেয়ে গিয়েছিল। ফুটপাথের পাশের স্টল থেকে এগরোল কিনে এনেছিল ইজাজ। অহনা অপরূপ মুখভঙ্গি করেছিল সেই এগরোল হাতে নিয়ে—যেন আগে কখনো এগরোল খায়নি ও। তারপর অতি যেন যত্ন করে আলতো এক কামড় বসিয়েছিল রোলে। হয়তো খায়নি, ভেবেছিল ইজাজ ওর মুখের ভাবে ফুটে ওঠা বিস্ময়ের দিকে তাকিয়ে, ফুটপাথের স্টলের এগরোল হয়তো সত্যিই আগে খায়নি ও। এতই যত্নসহকারে ধীরে ধীরে অহনা খাচ্ছিল রোলটা যে ওর গালদুটো ফুলে উঠেছিল যেন চিপমাংক-এর মত। চশমার নীচে চোখদুটো চকচক করছিল। ইজাজ চোখ সরিয়ে নিয়েছিল ওর থেকে।

“সকাল সকাল আসিস কাল!” নীলা বলেছিল ওর বাড়ির রুটের বাসে উঠতে উঠতে। একটু পরে নিজের বাড়ির গলির মুখে দাঁড়িয়ে একই কথা বলেছিল ঋজুও।

“হ্যাঁ হ্যাঁ! তোরাও।” বলতে বলতে এগিয়ে গিয়েছিল অহনা আর ইজাজ।

মেট্রো স্টেশনের কাছাকাছি প্রায় ফাঁকা শুনশান বড় রাস্তায় আচমকা একঝলক হাওয়া ঝাপটা দিয়ে গিয়েছিল। একটা কাগজের টুকরো, দু-তিনটে শালপাতার ঠোঙা ধুলোর সঙ্গে উড়ে এসেছিল সামনে। অহনা সম্ভবত হাওয়ার দাপট থেকে বাঁচতেই গা ঘেঁষে এসেছিল ইজাজের। শরীরের বাঁদিক ঘেঁষে ওর উষ্ণতাটুকু অনুভব করতে করতেই অহনার নিচু গলার স্বর কানে এসেছিল ইজাজের, “উঃ! কী নোংরা এই রাস্তাটা!”

রাস্তার উপর বেওয়ারিশ ন্যাকড়া পড়েছিল একটা, আর তেমন কোনও ময়লা চোখে পড়ছিল না ইজাজের, তাতেই ভীষণ নোংরা লাগছে অহনার কাছে এ রাস্তা! কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে পার্ক সার্কাস স্টেশনে নেমে যে গলিটা ইজাজকে ধরতে হয় প্রতিদিন, সেই গলির আশেপাশের মধ্যে এলেও অহনার...অহনার মত মেয়েদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠবে।

ট্যুশুনির পয়সা জমিয়ে কেনা মোটামুটি দামী পারফ্যুমটায় প্রায় ভিজিয়ে নেওয়া রুমাল নাকে চেপে ধরেও সে গলির উৎকট গন্ধ এড়িয়ে যাওয়া যায় না; আর ইজাজ তো সেই গলিতেই জন্মেছে, ওই গলির ধুলোয় খেলে বড় হয়েছে; তাতেই আজকাল ইউনির আবহাওয়া থেকে ফিরে এই গলিতে ঢোকার মুখে প্রতিদিনই মনটা যেন বেদম মার খেয়ে বিগড়ে যায়। সরু গলির একপাশে সরুতর বাঁধানো ড্রেন, তাতে জমে রয়েছে যতধরনের আবর্জনা, মাছের পেটের নাড়িভুঁড়ি থেকে শুরু করে শিশুর পায়খানায় মাখামাখি ছেঁড়া ন্যাকড়ার টুকরো, রাস্তার ঠিক মাঝামাঝি ধুলোতে সন্দেহজনক সরু জলের ধারা পড়ে ভিজে রয়েছে ধুলো। ওটা কোন উলঙ্গ অতি অল্প বয়সীর রাস্তার মাঝখানে করে ফেলা বদকর্মের সাক্ষী।

গলির ভিতরে সূর্যের আলো ঢোকে না। স্যাঁতসেঁতে বিষাক্ত আবহাওয়া সে গলির। বাইরের ঝাঁ চকচকে পরিবেশ থেকে এখানে ফিরে এসে মেজাজ সামলানো কঠিন হয়। আর তার মেজাজটা ইজাজ দেখায় ওর মাকে, ছোটবোনকে। ইজাজ গর্বিত নয় নিজের ব্যবহারে, কিন্তু--

...অহনার অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসবে সে গলির চেহারা দেখলে।

আধো অন্ধকার রাস্তায়, মেট্রোর স্টেশনের মুখেই এক দেওয়ালের আড়ালে, আর এক নোংরা দেওয়ালে অহনাকে চেপে ধরে এক কঠোর চুম্বন করেছিল ইজাজ। অহনা এটা একেবারেই আশা করেনি। কিন্তু বাধাও দেয়নি।

পরে, তীক্ষ্ণ কিন্তু স্নিগ্ধ, সাবধানী চোখে ও তাকিয়েছিল ইজাজের মুখের দিকে। ইজাজ ওর দিকে না তাকিয়েও অনুভব করতে পারছিল ওর দৃষ্টি নিজের মুখের উপর।

***

কলেজ এক্সকার্সন ছিল চাররাত তিনদিনের।

তৃতীয় রাতে অহনা এসেছিল ইজাজের ঘরে। সে খবরটা কলেজে ছড়িয়ে পড়েছিল দাবানলের মত। ইজাজ দাবানলের দাহটা অনুভব করছিল ভালই। অন্ততপক্ষে, এটা সত্যযুগ হলে ঋজু যে একাই দৃষ্টি দিয়েই ওকে দগ্ধ করে ফেলত সেব্যাপারে সন্দেহ ছিল না ইজাজের।

একবার ভেবেছিল, সান্ত্বনা দেয় ঋজুকে।

কিন্তু, “আমরা রিলেশনশিপে নেই, জাস্ট মাঝে মাঝে চুমুটুমু খাই, দু’একবার শুয়েছি একসাথে।” এই কথাটাকে কিভাবে বললে সান্ত্বনার মত শোনাবে ঋজুর কাছে সেটা ধরতে না পেরে শেষপর্যন্ত চুপ করে থাকাই সাব্যস্ত করেছিল ইজাজ।

সত্যি কথা বলতে? ইজাজ নিজেই জানে না অহনার সাথে ওর বর্তমান সম্পর্কের সংজ্ঞা। অহনাও জানে বলে মনে হয় না।

এটাই বাঁচোয়া যে তা নিয়ে চিন্তিতও মনে হয় না ওকে। ইজাজও ও নিয়ে চিন্তা করে না তাই।

***

অহনা ওর বাহুবন্ধনে ধরা দিতে ইতস্তত করে না। এতই সহজে আত্মসমর্পণ করে যে ইজাজের মনে সন্দেহমাত্র থাকে না যে এটা, এই ধরা দেওয়াটা কিছুই নয় অহনার কাছে। ওর মনে দাগ পড়ে না। সম্ভবত—ইজাজ সাতানব্বই শতাংশ নিশ্চিত যে—অহনার কাছে ইজাজের মূল আকর্ষণটা হচ্ছে ওদের ধর্মগত পার্থক্য। মুসলমান ছেলের সঙ্গে এত মাখামাখিটা নিশ্চয়ই ওর প্রগতিশীল নারীবাদি ‘আদর্শ’-এর গায়ে সুড়সুড়ি লাগায়।

ইজাজ ব্যবহৃত হতে চায় না। কিন্তু, পুরুষরা কি ব্যবহৃত হয় যৌন সম্পর্কে? ওটার দখল, যাকে বলে সেক্সুয়াল এক্সপ্লয়টেশনের দখল তো একচেটিয়া মেয়েদেরই। মেয়েরা ব্যবহৃত হয়, ছেলেরা ব্যবহৃত হয় না। মেয়েরা চ্যাটচ্যাটে প্রেমের অনুভূতিতে মাখোমাখো হয়ে গিয়ে পুরুষের নিষ্ঠুর জালে জড়িয়ে পড়ে, পুরুষ পড়ে না। শরীরের জালে পুরুষ ধরা পড়তে পারে; দেহগন্ধী যৌনতার জালে ধরা পড়তে পারে। যৌন হেনস্থার জালে নয়। রসসিক্ত প্রেমের জালে নয়। ওগুলো পুরুষালী নয়।

তাই ইজাজও অহনাকে ব্যবহার করে উলটে। ও পিছিয়ে আসবে কেন? ও না পুরুষমানুষ?

সেই চলতে থাকে তাই। ইজাজ অহনাকে নাকি অহনা ইজাজকে ব্যবহার করে ফাঁকা ল্যাবরেটরি রুমে ক্লোরিনের গন্ধের মধ্যে, এত ঘন আর লম্বা চুম্বনই ইজাজ করে অহনাকে যে ক্লোরিনের গন্ধটুকুর কথা যেন মনে হয় ভুলেই যায় অহনা; কলেজের সকলের সাথে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কোন এক মফস্বল এলাকায় গঙ্গার ধারে ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে থাকা সেই নাকি ইংরেজদের আমলে তৈরি পরিত্যক্ত কোয়ার্টারের ইট বের করা দেওয়ালে অহনাকে চেপে ধরে ইজাজ। ভেঙে পড়া ছাদটা প্রায় ঢেকে থাকে দেওয়ালের আর মেঝের ফাঁক ফোকর থেকে বেড়ে ওঠা বট অশ্বত্থ গাছের ঝাঁকড়া ডালপালায়। তার মধ্যে থেকেই তবু একটু ফাঁকের সুযোগ বুঝে ঢুকে আসে সরু রেখায় সূর্যের আলো, জমে ওঠা মাকড়সার জালগুলো চকচক করে। অহনা কি এক তীব্রতায় আঁকড়ে থাকে ইজাজকে।

অহনার সঙ্গে তর্কাতর্কি এখন ইজাজ করে অনেক বেশি। কারণ আগে যেখানে ইজাজ চুপ করেই থাকত, এখন সেখানে ও কথা বলে। কেন আজকাল ও এত বেশি কথা বলে তার কারণ ভাবতে গিয়ে একরাতে নিজের ঘরের তক্তপোষে শুয়ে ভয়ানক চমকে উঠেছিল ইজাজ। সেরাতে আর ঘুম হয়নি ওর।

ব্যাপারটা ভাববার।

অহনা আজকাল যথেষ্ট রয়ে সয়ে কথা বলবারই চেষ্টা করে ইজাজের সামনে, এমনকি আগের চেয়েও বেশি। ইজাজের মতামতটুকুকে ও গুরুত্ব দিয়ে শুনতে চায়...। ওর এই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাটুকুকে পাত্তা দিতে চায় না ইজাজই। কারণ, ইজাজ ওর এই ‘ইজাজের ফিলিংসকে রেয়াৎ করার চেষ্টা’টুকুকে রেয়াৎ না করলে অহনার শ্যামলা মুখটা হয়ে ওঠে থমথমে, ঠোঁট ফুলে ওঠে। সবসময় সর্ব বিষয়েই গুরুত্ব পেয়ে অভ্যস্ত অহনা। ইজাজ ওকে গুরুত্ব না দিলে ও যে মনে মনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে এটুকু ইজাজ বুঝতে পারে। এই ব্যস্ততাটুকু ভাল লাগে ইজাজের।

তা-ই, আঁতকে উঠে ভেবেছিল ইজাজ, তাই, নিজের এতটা এনার্জী আজকাল খরচ করে ও বেকার তর্ক করতে!

বোঝো ব্যাপার!

***

অহনা এতই বেশি পরিকল্পনাহীন উপস্থিতি ইজাজের জীবনে—যাকে বলা যেতে পারে একেবারেই ‘সিলেবাসের বাইরে’, যে—ওর নেশা আছে একটা।

‘নিষিদ্ধ ফল’ নিষিদ্ধ না হলে তার আকর্ষণ অত বেশি হত না।

ইজাজ অহনার কাছে যতটা ‘নিষিদ্ধ’ অহনা ইজাজের কাছে তার চেয়ে কম নিষিদ্ধ নয়। তাই বোধ হয় পরস্পরকে নেশা ধরে যায় ওদের।

অহনাকে যে ও স্পষ্ট বোঝে না সেকথা ইজাজ স্বীকার করবে। আমাদের দেশের সমাজের যে মূল্যবোধ আর নীতিবোধের মানদণ্ড তাতে অহনাকে বোঝা কঠিন। মানে, —ও সরল কিন্তু সহজবোধ্য নয়। যেখানে কিনা—ইলিয়ানার মত মেয়েরা সরল না হতে পারে, কিন্তু সহজবোধ্য।

কিন্তু, অন্যদিক দিয়ে দেখতে গেলে অহনাও ইজাজকে বোঝে না।

কোন এককালে কোন এক বড়লোকের বাড়ি থেকে বিক্রী হয়ে আসা এক মলাটহীন বইয়ে ইজাজ একটা অনুবাদিত গল্প পড়েছিল। ঠোঙা বানানোর জন্য মলাট খুলে ছিঁড়ে বই বিক্রী করতে হয়, তাই ছেঁড়াখোড়া ছিল বইটা, না হলে ওই বইয়ের সাবেক মালিক কোনদিন বইটা খুলে দেখেছিল বলে মনে হয়নি। কোনও এক মামার উপহার দেওয়া বইটা সম্পূর্ণ অক্ষতই ছিল অন্য সবদিক দিয়ে।

সেই বইয়ে এক গল্পের নাম ছিল ‘সত্য দু’রকম’। গল্পটা ভাল ছিল। কিন্তু, কিশোর ইজাজের মনে যেটা বেশি আঁচড় কেটেছিল সেটা হচ্ছে গল্পটার নামটা।

—‘সত্য দু’রকম’!

বড় হতে হতে ইজাজ বুঝেছে, সত্য বহু রকম হতে পারে। প্রতিটা মানুষের আপেক্ষিক সত্য থাকে এক একটা।

আবার সমাজের প্রতিটা শ্রেণীর মানুষের সত্যের আর বাস্তবের মানদণ্ড হয় আলাদা আলাদা।

ইজাজ আর অহনার মধ্যের আর্থসামাজিক দূরত্ব এতই বেশি যে অহনার পক্ষে সম্ভবই নয় ইজাজের সত্যকে বোঝা। ইজাজকে বোঝা।

কোন একদিন তর্ক করতে করতে হাঁফিয়ে গিয়ে অহনা চুপ করে যায়। খানিক পরে বলে, “তোকে—তোকে বুঝতে পারি না। আমার তো...” একটা নিশ্বাস টেনে নেয় ও, বলে, “আমার তো বোঝার মত নির্দিষ্ট একটা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক আদর্শ আছে। তোর—” ইজাজের দিকে ও তাকায় সন্দিগ্ধভাবে, “—তুই কি অ্যানারকিস্ট নিহিলিস্ট?”

ইজাজ মিটিমিটি চায় ওর দিকে। দাঁত বের করে গা জ্বালানো হাসির ভঙ্গিমা করে তারপরে, বলে, “না, আমি ডিকটেটরশিপে বিশ্বাসী। প্রোভাইডেড যে ডিকটেটরটা আমিই হব।”

অহনা হাসে না। গম্ভীর বিরক্তমুখে বসে থাকে ও। একটু পরে অতি ধীর স্বরে আস্তে আস্তে বলে, যেন ইজাজের কানে আসুক আর না আসুক কথাটা তাতে ওর কিছু এসে যায় না, “তুই কোনওদিন সত্যিকারের হাসি হাসিস না। জানিস কি সেটা? সব নকল দ্যাখানে দাঁত বের করা হাসি।”

ইজাজ কথাটা না শোনার ভান করে চুপ করে থাকে।

আসল কথাটা হচ্ছে, ইজাজের প্রচুর হাসি পায় আজকাল।

ঋজু যখন প্রবল বিদ্বেষের সাথে তাকায় ওর দিকে। বা ইলিয়ানা যখন তাকায় সন্দেহের সাথে।

বা অহনা যখন ‘দ্য আদার প্যারিস’ বা ‘কলকাতার কাছেই’ পড়ে ডিপ্রেসড্ হয়ে পড়ে আর সমানে বকবক করে যায় ওর কানের কাছে। ফেমিনিস্ট র‍্যান্ট যাকে বলে!

ইজাজের হাসি পায়। রাগ হয়, কিন্তু হাসিও পায়। কিন্তু, তার মানে এই নয় যে সেকথা ও স্বীকার করবে অহনার কাছে।

***

তারপরে একদিন, ইজাজের হাসি পায় না।

সেদিন, আগের রাতে হঠাৎ তেড়ে অকালবর্ষণ হয়ে গিয়েছিল এক পশলা। সকালে উঠেও, আকাশের থমথমে ভার মুখ চোখে দেখার আগেই, ঘরের জং ধরে যাওয়া সিলিং ফ্যানের ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজের মধ্যে গায়ে জড়ানো পাতলা চাদরটাকে আরো ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বাঁ হাতটা হাতড়ে অন্য একটা চাদর খুঁজতে খুঁজতে ইজাজ অনুভব করতে পারছিল বাতাসের উপাদেয় ভিজে ভাব। যদিও এখনও লোকেরা বলে থাকে ‘অকালবর্ষণ’, কিন্তু যে হাল আজকাল করে এনেছি আমরা আবহাওয়ার তাতে কাল-অকাল কথাগুলোর কোন সত্যিকারের অর্থ নেই। কখন যে বৃষ্টি হবে, কখন যে হবে না, কখন যে শীত পড়বে আর কখন গরম—এইসব প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো এখন প্রায় কোন নিয়ম মেনে ঘটে না আর। সবই যোগাযোগ। কাজেই, ফাল্গুনমাসের বৃষ্টিতে একটুও অবাক হয়নি ইজাজ। বরঞ্চ খুশিই হয়ে উঠেছিল, শীতের শেষ রেশটুকুকে এই বৃষ্টি টেনেটুনে আর কয়েকদিন দীর্ঘায়িত করতে পারে যদি সেই আশায়।

সেই খুশি খুশি ভিজে ভিজে মন নিয়ে ‘বৃষ্টি নেই কিন্তু বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে’ আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে কলেজের দিকে রওয়ানা হয়েছিল যখন, তখন ও কল্পনা করেনি ইলিয়ানার সঙ্গে ঝামেলা বাঁধবে ওর।

ইলিয়ানার সাথে ইজাজের সম্পর্কটাকে বলা যেতে পারে মিথষ্ক্রিয়ার সম্পর্ক।

ইলিয়ানা ওর জন্য দামী সিগারেট-ফিগারেটের জোগাড় করে দেয় মাঝে মাঝে। ইজাজের পক্ষে যেসব লাক্সারি কল্পনা করা হয়তো সম্ভব হত না এমনিতে, ইলিয়ানার জন্যই সেসব সম্ভব হয়ছে কিছু কিছু এটা স্বীকার করতে ইজাজের লজ্জা নেই। বড়লোকের সন্তানদের প্রতি ওর স্বাভাবিক বিতৃষ্ণাটুকুকে সরিয়ে রেখে তাই ইলিয়ানার সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব। ব্যাপারটা হিপোক্রিটিকাল সন্দেহ নেই। কিন্তু ইজাজ কেয়ার করে না। ইলিয়ানার মধ্যে কাঁচা একটা সততা আছে, পলিশ করা অন্য সব ধনীর দুলালীদের মধ্যে যেটা পাওয়া যায় না সাধারণত, সেটাও একটা কারণ হতে পারে ইজাজের ইলিয়ানার সাথে বন্ধুত্বের।

বদলে, ইজাজও কাজে লাগে ইলিয়ানার। সেটা—

বিরাট ঝাঁকড়া গাছটার পাতা থেকে টপ টপ করে জলের ফোঁটা পড়ছিল বড় বড়। বৃষ্টির পরের ফলাফল ওটুকু।

সেদিকে তাকিয়ে জিভের উপর বিরক্তির একটা শব্দ করে ইলিয়ানা বলেছিল, “দূর! ভাল লাগে না। ভাবলাম কোয়েষ্টে যাব একটু!”

যার উত্তরে ইজাজ বলেছিল স্বাভাবিক ভাবেই, “পৃথ্বীশ—স্যার—এর সাথে?” পৃথ্বীশ আর ‘স্যারে’র মাঝে দূরত্বটা ও ইচ্ছে করেই রেখেছিল, মুখে ফুটিয়েছিল মজা পাওয়া হাসি।

পৃথ্বীশ চন্দ ওদের ইউনিতে লেকচারার ছিলেন। এখন অন্য একটা অনামা কলেজে প্রফেসরি করছেন। ওদের থেকে বয়সে অন্তত বছর পঁচিশেকের বড়। ইজাজ শুনেছে ওঁর নাকি এক মেয়েও আছে, কুড়ির কোঠায় যার বয়স। সেই ভদ্রলোক ইলিয়ানার—বয়ফ্রেন্ড বা প্রেমিক বলাটা বেমানান শোনায়, ‘লভার’, ভাবে তাই ইজাজ। ও সন্দেহ করে যে ও ছাড়া আর কেউ জানে না ইলিয়ানা আর পৃথ্বীশ স্যারের এই অ্যাফেয়ারের ব্যাপারটা।

ওকে জানানোটা ইলিয়ানার স্ট্র্যাটেজি, সেটুকু বোঝার মত বুদ্ধি ইজাজের আছে। ইলিয়ানা ইজাজের সাথে বাড়াবাড়ি রকমের মাখামাখি করে থাকে, পৃথ্বীশ স্যারের দিক থেকে সকলের দৃষ্টি ঘোরানোর জন্যই। ওর বাবা যেমন বড় বিজনেসম্যান তেমনই বড় ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি। ছোটবেলা থেকে মেয়েকে সময় না দিতে পেরে অঢেল স্বাধীনতা আর পয়সা দিয়েছেন হাতে। কিন্তু, সে নিয়ে সর্বদাই অসোয়াস্তিতেও থাকেন। ইজাজের সঙ্গে ইলিয়ানার মেলামেশাটা আদপেই ভাল চোখে দেখেন না। মুসলমান ছেলের সাথে মেয়ে লটরপটর না করে বসে সেদিকে নজর রাখতে গিয়ে মাঝবয়সী ডিভোর্সী অধ্যাপকের দিকে নজর রাখতে ভুলে যান।

ইজাজ মনে মনে জানে যে ওর আর ইলিয়ানার যে লেনদেনের সম্পর্ক তাতে ওর নিজের দিক থেকে দেওয়ার পরিমাণ কিছুমাত্রায় অল্প নয়। তাই ইলিয়ানার সঙ্গে ওর বন্ধুত্বের সম্পর্কে অসাম্য নেই।

পৃথ্বীশ ‘স্যার’কে নিয়ে ফাজলামোও চলতে পারে তাতে।

আজ কিন্তু, বৃষ্টির জন্যই হোক বা অন্য কারণে, ইলিয়ানার মেজাজ সত্যিই খারাপ ছিল মনে হয়।

ইজাজের নির্দোষ ঠাট্টার জবাবে ফোঁস করে উঠেছিল ও।

“ডোন্ট ইয়ু ডেয়ার জাজ মি!”

ইলিয়ানাকে জাজ করার কোনও ইচ্ছা ইজাজের কোনকালে ছিল না।

কিন্তু অভিযোগটা এতটাই আকস্মিক আর অবাক করা যে সেই কৈফিয়ৎ দেওয়ার কথাও ওর মনে আসেনি।

ইলিয়ানার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল, ওর চোখে সত্যিকারের বিতৃষ্ণা। ওর আনা অভিযোগটাতে ও সত্যিই বিশ্বাস করে। রাগের মাথায় হঠাৎ ঝগড়া করার জন্যই ঝগড়া করা নয় এটা।

দুর্বল একটা বাঁকা কৌতুকের হাসি হেসে ইজাজ বলার চেষ্টা করেছিল, “মাথাটা কি সত্যিই গেছে? কী বলছিস বাজে কথা? আমি--? জাজিং?”

ইলিয়ানা তার উত্তরে নাকের মধ্যে তিক্ত হাসির মত আওয়াজ করেছিল একটা।

ও ঝগড়া করার চেষ্টা করলে ইজাজ সহ্য করতে পারত। ওর স্পষ্টতই ইজাজকে অবজ্ঞা করার হাসি দেখে মাথায় রক্ত চড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল ওর।

“কী বলতে চাইছিস?” থমথমে ভারি গলায় জিজ্ঞেস করেছিল ইজাজ।

ইলিয়ানা কাঁধ আর হাত নাড়িয়েছিল অনির্দেশ্য ভাবে। যেন ইজাজের কথার উত্তর দেওয়ার কোন প্রয়োজনই বোধ করে না ও।

তারপরে, দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিল ওরা কয়েকটা অপলক মুহূর্ত।

শেষটায় ইলিয়ানা মুখ খুলেছিল। “আমি জানি তুই জাজ করিস আমায়। বড়লোকের আদুরে মেয়ে। পার্টি দেয় আর পয়সা ওড়ায়। মাল গেলে। বিবাহিত মাঝবয়সী টিচারের সাথে প্রেম করে!”

বড় করে একটা নিশ্বাস টেনে নিয়েছিল ইলিয়ানা। তারপর অপেক্ষাকৃত শান্তস্বরে বলেছিল, “আই জাস্ট হোপ ইউ নো হাউ মাচ অফ এ হিপোক্রিট ইউ আর! অহনার সাথে যা করছিস—ওর দুর্বলতার সুযোগে—”

ইজাজ উঠে চলে গিয়েছিল সেখান থেকে। অহনার সাথে ওর সম্পর্কটা কী, সেটা ও নিজেও বোঝে না হয়তো। কিন্তু ইলিয়ানার গলায় সেসম্পর্কে কোন আলোচনা শোনার জন্যও প্রস্তুত নয় ইজাজ। আত্মসংযম অভ্যেস করে সেখান থেকে উঠে যাওয়াই মঙ্গল বিবেচনা করেছিল ইজাজ। ফিরে তাকায়নি ইলিয়ানার দিকে আর।

সেই সংযম বেশিক্ষণ টেঁকেনি। ইলিয়ানারই দোষ সেটা, পরে ভেবেছিল ইজাজ, ও, যাকে বলে বেকার বাজে বকবক করে ব্লাইন্ডসাইডেড করে দিয়েছিল ইজাজকে। মাথাটা আগে থেকেই গরম হয়েই ছিল।

ইজাজ ভাল মুসলমান নয়। মদ খায়, নামাজ পড়ে না--কিন্তু নিজের শিকড়কে অস্বীকার করার নির্লজ্জ প্রবণতা ওর নেই।

আবার, ও বাস্তববাদীও, জানে, বর্তমান পৃথিবীর যে অবস্থা, তাতে জাত তুলে কেউ ঠেস দিলে গায়ে মাখলে চলে না সেটা। গায়ের চামড়া মোটা করে নিয়েছে ও বহুদিন হল।

সেদিনও ছেলেদুটোর কথাগুলোকে গভীর অনুশীলনের সাথে অগ্রাহ্য করে চলেছিল ও। এসব গা সওয়া হয়ে এসেছে, অন্তত যতক্ষণ ঠেস দেওয়ার মূল লক্ষ্যটা থাকে ও নিজে। অন্য কোন নিরীহ চ্যাংড়া কমলা জালি কাজের গেঞ্জি পরা কালোকোলো ছেলের পিছনে যখন লাগে ভদ্র পোষাক পরিহিত বেশ কয়েকজন একসাথে তখন মাঝে মাঝে মনটা বিদ্রোহ করে উঠতে চায় বটে, কিন্তু নামী ইউনিতে বড়লোকের বাচ্চাদের সাথে এতদিন ওঠাবসা করে এইসব বিদ্রোহ-টিদ্রোহ জেগে ওঠার প্রবণতাকে দাবিয়ে দিয়ে ভদ্র হয়ে ওঠার কায়দাও আয়ত্ত করেছে ইজাজ বহুদিন হল। ‘কাম্যু’ থেকে ‘মুরাকামি’ পর্যন্ত পড়ে ফেলেছে ‘প্লেবিয়ান’ থেকে ‘মানুষ’এ উত্তীর্ণ হতে, সে তো আর বৃথাই নয়।

তবু শেষ পর্যন্ত সেদিন যে ও খেপে উঠেছিল তার একটা কারণ ওই ছেলেদুটো বাড়াবাড়ি রকমের অসভ্যতা করে ফেলছিল বটে, কিন্তু ইলিয়ানার সঙ্গে কথোপকথনটাই বেশি দায়ী ছিল ওর পিছনে তাতে সন্দেহ নেই। আর খেপে ওঠাটাই বা কিরকম!-–শেষ এরকম খেপে উঠেছিল ইজাজ তিন চারবছর আগে ওদের পাড়ারই কোন একজনকে এক কুকুরের লেজে পটকাবাজি বাঁধতে দেখে। একটা ছেলের নাক বোধহয় ফেটেই গিয়েছিল, অন্যজনও খুব সুস্থ ছিল না। ইজাজের নিজের ঠোঁটের কোণে জিলজিলে ব্যথা করছিল ভালই। ইজাজ জানে এই ইউনি ক্যাম্পাসেই এমন এক ইউনিয়ন আছে যাদের কাছে ও গেলে লাফিয়ে উঠে তারা লুফে নেবে ‘ওর বিরূদ্ধে এই অপরাধ’এর বিরূদ্ধে লড়াইয়ের ভার। দুঃখের মধ্যে তাদের বিপরীত দলের মতই এরাও ইজাজকে মানুষ বলে স্বীকার করার চেয়ে একটা ধর্মের প্রতিনিধি বলে দেখাটাই বেশি লাভজনক মনে করে। ইজাজ ওদের ঘৃণা করে অন্য দলের চেয়ে কম নয়।

অহনা আজ আসেনি ইউনিতে। বৃষ্টির জন্যই বোধহয়। ইজাজ নিজেই গিয়েছিল ওর কাছে। কেন গিয়েছিল সে প্রশ্ন কেউ করলে তার উত্তর দিতে পারত না। সেকথা সুস্থ মনে বিচার করার মত অবস্থা ওর ছিল না। অহনার বাড়িতে গিয়েছিল ও চাপা রাগে কাঁপতে কাঁপতে। দু’এক ফোঁটা বৃষ্টির সাথে হালকা ঠান্ডা হাওয়াও দিয়ে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু ওর কাঁপুনিটা সেকারণে নয়।

অহনা দরজা খুলে দিয়েছিল একবার বেল বাজাতেই। ইজাজের ঠোঁটের কোণের তাজা ক্ষত বা সব মিলিয়ে এলোমেলো চেহারা দেখে ওর ভুরু কোঁচকায়নি। হাত ধরে ইজাজকে নিয়ে গিয়েছিল ওর বেডরুমে।

এই হাত ধরাটুকুই নতুন। মুখের ভাবে ভাবান্তর না হলেও ওটাই যথেষ্ট এটুকু বোঝানোর জন্য যে অহনা অল্প হলেও ঘাবড়েছে।

অহনার বেডরুমে আগে দু’একবার ঢুকেছে ইজাজ। কিন্তু আজ এই বেডরুমে ঢোকাটাও নতুন লেগেছিল হঠাৎ ওর কাছে। এই যে সাজানো গোছানো হলুদ-সবুজ জঙ্গুলে ওয়ালপেপারে সজ্জিত বেডরুম। দামী আসবাব, দামী পর্দা, সুন্দর গন্ধ। যেখানে ইজাজের প্রবেশের কোন অধিকার থাকার কথা ছিল না—যেকথা আজকেই একবার রূঢ়ভাবে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে ওকে—কিন্তু তবু যেখান থেকে ইজাজ নড়বে না। একবার ঢুকতে পেরেছে যখন, অনধিকার প্রবেশই সই, বিনাযুদ্ধে নড়বে না ইজাজ। থরথরে কাঁপুনিটা বেড়ে গিয়েছিল হঠাৎ।

ওর মুখের দিকে একবার তাকিয়েই অহনা বেডরুম সংলগ্ন বাথরুমে ঢুকেছিল গিয়ে, বাথরুমের ক্যাবিনেট খুলে আঁতিপাতি খুঁজছিল কি সব। ফার্স্ট এডের সরঞ্জাম সম্ভবত।

নিজেকে সামলে নিচ্ছে অহনা, ভেবেছিল ইজাজ, মন তৈরি করে নেওয়ার জন্যও ওর প্রয়োজন এই কাজের ভান করা।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইজাজ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছিল ওর দিকে। অপেক্ষা করছিল—কিছু একটা নিশ্চয়ই বলবে অহনা। নিশ্চয়ই ওর মতামত জানাবে, কারণ সব বিষয়েই ওর মতামত আছে একটা।

ইজাজের হাত মুঠো হয়ে ছিল। নখ চেপে বসেছিল হাতের তালুতে।

যদি অহনা দয়া দেখানোর চেষ্টা করে, বা জ্ঞান দেওয়ার—

কিছুই বলেনি অহনা। আবার ওর হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছিল নিজের খাটের ধারে। তুলোয় অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে আস্তে আস্তে পরিষ্কার করছিল ওর ঠোঁটের ক্ষত। বাঁহাতে ধরেছিল ইজাজের চিবুকটা। ইজাজের পছন্দ হয়নি এটা। যেন ও ছেলেমানুষ, এমন ব্যবহারের মানে কী? ঝাঁকি দিয়ে নিজের মুখটাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল একবার।

অহনা ভুরু কুঁচকে ক্লান্তস্বরে বলেছিল, “ওরকম করিস না।”

যেন, ইজাজের জীবনের আর কোন উদ্দেশ্য নেই অহনার জন্য মুশকিলের সৃষ্টি করা ছাড়া।

ইজাজদের পাড়ার ঘেয়ো কুকুরটা, যেটা এক-আধ টুকরো বিস্কুটের আশায় পাড়ার চায়ের দোকানের সামনে লেজ নাড়িয়ে লেই লেই করে বেড়ায়। কেউ কিছু ছুঁড়ে দিলে কৃতার্থ হয়ে তার পায়ের সামনে বসে থাকে চুপটি করে, কেনা গোলামের মত, তার সাথে আসলে ইজাজের কোন পার্থক্যই নেই। ও ঘেউ ঘেউ করতে পারে, দাঁত খিঁচিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু শেষপর্যন্ত—হঠাৎ অসহিষ্ণু হয়ে উঠে বিদ্রোহ করতে চাইছিল ইজাজের মন, কিসের জন্য আজ অহনার কাছে এসেছে ও? কিসের আশায়?

ইজাজের মুখটা বিকৃত হয়ে উঠেছিল সম্ভবত। অহনা তাকিয়েছিল ইজাজের মুখের দিকে একবার। ইজাজ চোখ সরিয়ে নেয়নি। অহনা ঠোঁট চিপে ভেবে নিয়েছিল কিছু। তারপরে যেন মনস্থির করে নিয়েছিল কোন ব্যাপারে। নিজের মনেই মাথা নাড়িয়ে নিজের কোন সিদ্ধান্তে সমর্থন জানিয়েছিল। তারপর বলেছিল, “সেদিন...প্রথম নেশা করেছিলাম আমি।”

এতক্ষণ প্রায় নিস্তব্ধ থাকার পর হঠাৎ এইরকম একটা কনফেশন! ইজাজ হকচকিয়ে গিয়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর ওর কথার মানেটা মাথায় ঢুকেছিল ওর। বেঁকে থাকা ঠোঁটের কোণ আরো বেঁকে গিয়েছিল মুহূর্তের জন্য, তারপর, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটব ফুটব করে উঠেছিল।

“আহ্!” অনেকক্ষণের অব্যবহারে ঘরঘরে বসে যাওয়া গলায় বলেছিল ও, “—সেদিন—”

অহনা চোখ নিচু করে ওর আঙুলের ফাঁকের কাটাটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলেছিল, “সেদিন।”

“অর্থাৎ কিনা যেদিন—” বলেছিল ইজাজ।

অহনা চোখ তুলে তাকিয়েছিল, “ইলিয়ানার লাস্ট পার্টিতে।”

ইজাজ কিছু বলেনি আর, ভাবছিল কী বলবে। ‘অ্যাদ্দিন পরে হঠাৎ সেদিনের কথা কেন?’ জিজ্ঞেস করবে?

মিথ্যে বলে লাভ নেই। আজ ইজাজ অহনার কাছে এসেছিল কড়া কিছু আঘাত করার আশায়, কিছু প্রত্যাঘাত লাভ করার আশায়। তাতে কোন এক পাশবিক শান্তি পাবে আশা করেছিল বোধ হয়। কিন্তু সেই পরিকল্পনা ইতোমধ্যেই ভেস্তে যাওয়ার জো হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। অহনার আশেপাশে ইজাজের সব পরিকল্পনাই যেমন ভেস্তে যায়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতে চাইছিল ইজাজের।

অহনা তাকিয়েছিল ওর দিকে। “জিজ্ঞাসা করবি না হঠাৎ সেদিনই নেশা করলাম কেন?...মানে প্রথম দিন ড্রিংক করেই অত বাড়াবাড়ি...”

“কী লাভ হবে আমার জেনে?” বলেছিল ইজাজ, “আমার কী?”

“—ঠিক!” অহনা ঠোঁট চিপে বলেছিল। তারপর গম্ভীরমুখে বলেছিল, “শোন তবে।”

ক্লান্ত লাগছিল এতক্ষণ পরে নিজেকে, ইজাজ কোনরকম আপত্তি করেনি আর অহনার গল্প শুনতে।

“আমার মা...বুঝলি? ক্যান্সার হয়েছিল মায়ের। ধরা পড়েছিল লাস্ট স্টেজে। কিছু আর করার ছিল না তখন।

ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল ইজাজ। অহনার চোখের দৃষ্টি সহজ, গলা স্বাভাবিক।

অহনা বলে চলেছিল, “চোখের সামনে একটা মানুষকে...বিশেষ করে এমন একজনকে যাকে তুই ভালবাসিস, অ্যাঁ? এমন একজনকে তিলে তিলে মরতে দেখা কঠিন। কত কঠিন সেটা যারা ভোগ করেনি ওই অবস্থা তারা বুঝবে না। কিছু না করতে পারার অসহায়তা—সেটা—” মাথা নাড়িয়ে মাথা পরিষ্কার করে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। বড়সড় নিশ্বাস টেনে নিয়েছিল একটা। “আমার বাবা খুব ভেঙে পড়েছিল। আমার চেয়েও বেশি। আমি শক্ত থাকার চেষ্টা করছিলাম—তা—”

“একবছর পরে মা মারা গেল। কিছু করা গেল না, কষ্টটা দীর্ঘায়িত করা ছাড়া। তার মাস দুয়েক পরে বাবার ল্যাপিতে কী একটা কাজ করবার সময় আমি জানতে পারলাম—মায়ের অসুখ চলার সময়—হি ওয়াজ হ্যাভিং অ্যান অ্যাফেয়ার। মানে, মায়ের অসুখ ধরা পড়ার পরে...ইট স্টার্টেড।

“মোস্টলি অনলাইন চ্যাট ইত্যাদিই করত ওরা। বাট হি মেট হার ওয়ান্স অর টোয়াইস টু। জানি না কেন।” দুচোখের এপর হালকা হাত বুলিয়ে নিয়েছিল একবার অহনা, “—জানি না—প্রব্যাবলি, ওই স্ট্রেসের কোপিং মেকানিজম্ হিসেবেই? কে জানে? সস্তাদরের কল গার্ল ছিল মেয়েটা—সে যাক! নট দ্যাট ইট ম্যাটারস্! তা ব্যাপারটা জানার পর আমি গুম মেরে গিয়েছিলাম কদিন। মোস্টলি বিকজ অফ দ্য শক্। মানে, মায়ের মৃত্যুটা তাজা ছিল তখনও, সো--যে একটা লোকের সাথে সবচেয়ে বেশি সেই শোকটাকে শেয়ার করা যেত...বিশ্বাসভঙ্গ হওয়াটা হজম করা কঠিন।

“তারপর একদিন--তারও মাস ছয়েক পরে--ইমোশন দাবিয়ে রাখলে যা হয়--বিশাল ঝগড়া হয়ে গেল বাবার সাথে। বাবা জানত না আমি জেনে গিয়েছি। অবাক হয়ে গিয়েছিল। ...তারই সপ্তাখানেক পরে ছিল ইলিয়ানার পার্টি। আগে নেমন্তন্ন পেতাম। যাইনি কখনো। সেদিনই গিয়ে--”

চোখ তুলে তাকিয়েছিল অহনা ইজাজের দিকে। গোপন একটা ক্লান্ত মধুর হাসি হেসেছিল। ইজাজ এতদিন জানত না অহনা হাসতে পারে অমন করে।

“আমার মা খুব স্ট্রিক্ট ছিল, বুঝলি?--এক একসময় মনে হত--আমি স্ট্রীটফুডও খাইনি আগে কখনো, সেদিন যে এগ-রোল টা খেলাম...তুই দিলি?... তার আগে--শি ডিডন্ট--আই মিস হার, অ্যান্ড--ওয়েল”

ইজাজের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ফ্যাকাশে একটা হাসি মেখে মুখে, “কী বুঝলি?”

ইজাজ তাকিয়েছিল ওর মুখের দিকে। মুখ উপর দিকে তুলে। ও জানে না অহনা ওকে ঠিক কী বলল এক্ষুনি, ঠিক কী বুঝল ও, ঠিক কী বোঝা উচিত ওর?

যে, অহনার মায়ের মৃত্যুটা, ঠিক মৃত্যুটাই হয়তো নয় কিন্তু মৃত্যুর অলঙ্ঘনীয় কঠোর রূপটা গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে ওকে? নাকি, যে বাবার প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা সেই অবস্থাতেও ওকে খাড়া রাখতে পারত সেটা ভেঙে পড়েছে অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত এবং সেই কারণেই রূঢ় আঘাতে? ওর বেদনা না ওর লজ্জা? নাকি ওর নিঃসঙ্গতা? কোনটাকে যে অহনা ঠিক প্রকাশ করল বোঝার চেষ্টা করছিল ইজাজ।

এটুকুই শুধু ও স্থির বুঝেছিল যে, আগে কখনোই নিজেকে এত নগ্ন অহনা করেনি ওর কাছে।

ঘরের এসিটাতে কোন সমস্যা আছে বোধহয়। ঘড়ঘড় করে একটানা একঘেয়ে শব্দ হচ্ছিল একটা। হাড়ের মধ্যে পর্যন্ত কাঁপন লাগিয়ে দিয়ে ইজাজকে যেন জানিয়ে গিয়েছিল, ও নিজেও কোনদিন এত নগ্ন বোধ করেনি আগে অহনার সামনে...কারোরই সামনে।

অহনার শরীরের উষ্ণতা এসে লাগছিল ইজাজের গায়ে। মুখের সামনেই অহনার হালকা সবুজ রঙের প্রিন্সেস লেখা টপে ঢাকা নরম পেট। ওই পেটে মুখ গুঁজেছিল ইজাজ। শারীরিক দিয়ে কত ওরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে তারই প্রমাণস্বরূপ যেন অহনা চমকে যায়নি বিন্দুমাত্রও। ওর আঙুলগুলো খেলা করছিল ইজাজের বৃষ্টিতে কাকভেজা উস্কোখুস্কো চুলের মধ্যে। “—ঠান্ডা লাগাবি—” যে মুহূর্তে অহনা বলতে শুরু করেছিল ঠিক সেই মুহূর্তেই ইজাজ বলেছিল, “কী শুনেছিস নাকি আজ ইউনিতে কী—” ও নিশ্চিত জানে যে অহনার কাছে খবর পৌঁছেছে আগেই। নইলে এই অযাচিতভাবে অহনার জীবনের সবচেয়ে বড় গোপনখবর জানার ঘটনা ঘটত না ইজাজের জীবনে।

“ইলু ফোন করেছিল একটু আগে।” বলেছিল অহনা। কোনও প্রশ্ন করেনি।

“কেন ছোটলোকদের মত মারামারি করলাম জানার চেষ্টা করবি না?” বলেছিল ইজাজ।

“প্রব্যাবলি কিছু ঘটেছিল। কিন্তু সে জেনে আমার লাভ কী?” অহনা বলেছিল পরম নিশ্চিতসুরে।

ইজাজ মুখটাকে আরো গুঁজে দিয়েছিল অহনার পেটে। ওর ধৈর্যচ্যুতির আসল কারণটা যে অহনা নিজেই সেটা জানলে অহনার মুখের ভাব কেমন হবে ভাববার চেষ্টা করেছিল চোখ বুজে। বোধ হয় ও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করবে না। “আমার মা লোকের বাড়িতে কাজ করে আমায় মানুষ করেছে। আমি ক্লাস ফোরে পড়ার সময় ডেনড্রাইটের নেশা ধরেছিলাম, চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলাম ওই বয়সেই। ছোটলোকোমি আমার—”

“আচ্ছা!” ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল অহনা, “আগে এই নোংরা জামা প্যান্ট ছেড়ে হাত পা ধুয়ে নে। মাথাটাও মুছে নে একটু। তারপর শুয়ে শুয়ে শুনব।”

“অলরেডি ঘাবড়ে গেলি?” ওর হাতের কবজি ধরে একটু হেসে বলেছিল ইজাজ।

“ঘাবড়াইনি।” হেসেছিল অহনাও।

পরে, বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলেছিল, “আমি প্রথমবারে তোর সাথে হুক আপটা করেছিলাম কারণ তুই মুসলমান। বাবাকে বেশি জোরে আঘাত করা যাবে ভেবেছিলাম। আমাকে চমক দেওয়া অত সহজ নয়।”

ইজাজ এতক্ষণ বাদে প্রাণখোলা হাসি হেসেছিল, “ফিগারড্! ওটা আমি বহুবছর আগে থেকেই জানি। তোর বাবার ব্যাপারটা নয় ও এফ সি, জাস্ট ভেবেছিলাম তোর প্রগতিবাদী ফেমিনিস্ট অ্যাজেন্ডায় আমি কনভিনিয়েন্ট। আর আমি ইজিও, তাতে সন্দেহ নেই।”

অহনা চোখ ঘুরিয়ে হেসেছিল, “—ওয়েল! সেটাও।” তারপরে, “—উম্ আমার বাবার পায়জামাটা তোর হবে মনে হয়। কিন্তু শার্ট—”

পরে সত্যিই অহনার বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে ওরা গল্প করেছিল অনেক। যে গল্প এতদিন ওরা পরস্পরের সাথে করেনি। অন্য কারো কাছেও নয়।

গল্প করতে করতে ইজাজ আবিষ্কার করেছিল যে ইলিয়ানা আর পৃথ্বীশের ব্যাপারটা অহনা জানে। কারণ অহনা বলে বসেছিল, “আমার মনে হয় কিছু ঝামেলা হয়েছে ওর স্যারের সাথে, সেই ঝালটা তোর উপরে ঝেড়েছে, শি সিমড্...” চুপ করে ঠোঁট কামড়েছিল খানিকক্ষণ, শব্দ হাতড়েছিল বোধ হয়, তারপর বলেছিল, “...আপসেট? কিন্তু তোকে নিয়ে চিন্তাও করছিল।”

“হু-উ-ম্” ইজাজ বলেছিল, তারপর বলেছিল, “আমি ভাবতাম আমি একাই জানি ওর আর স্যারের অ্যাফেয়ারের ব্যাপারটা।” অহনাও জানে শুনে ওর যে অনুভূতিটা হয়েছিল সেটাকে ঠিক ঈর্ষা বলা হয়তো চলে না, কিন্তু খিঁচখিঁচিনি লেগেছিল যেন একটা মনে। গোপনকথা হাতছাড়া হয়ে যাওয়াটা মনে হয় মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতিগুলোর মধ্যে একটা। গোপনকথা মানুষ ভালবাসে, যতক্ষণ না সে নিজে সেটা ফাঁস করে দেয়, প্রকাশ করে সকলের মাঝে।

“হিংসা হচ্ছে নাকি তোর?” কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে একটু উঁচু হয়ে বলেছিল অহনা।

“কে জানে?” ইজাজ সৎ জবাবই দিয়েছিল।

অহনা হেসেছিল তখন, মধুর প্রাণখোলা হাসি, বলেছিল, “হিংসা করিস না। শি প্রব্যাবলি টোল্ড মি বিকজ অফ ইউ। কয়েকদিন আগেই বলেছে।” একটু ইতস্তত করে বলেছিল তারপর, “শি প্রব্যাবলি থট যে তুই-ই বলে দিবি আমাকে...বা—” কথাটা অসমাপ্ত থেকে গিয়েছিল।

ইজাজ ভাবছিল, ইলিয়ানা যে রেগে ছিল আজ তাতে সন্দেহ নেই। ওর কি হিংসা হচ্ছিল অহনাকে? ইজাজের কাছাকাছি এসে গেছে বলে ও? ওদের শেয়ারড্ গোপনকথাগুলো অন্য একজনের কাছে ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায়? নাকি ওর হিংসা হচ্ছিল ইজাজ আর অহনার অস্বাভাবিক সম্পর্কটাকে? অবশ্য ওর আর পৃথ্বীশ-স্যারের সম্পর্কটাও স্বাভাবিক নয় কোনওভাবেই।

ইজাজ ভেবেছিল, ইলিয়ানার কথা, পৃথ্বীশ-স্যারের কথা, ভেবেছিল ওর নিজের আর অহনার কথা, ভেবেছিল অহনার বাবার কথা।

“মানুষের মন জিনিষটা,” ইজাজ বলেছিল আচমকাই, “মনে হয় কখনো আমরা তার রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে পারব?”

“আর যার মনেরই পারি না কেন, তোর মনের নয়।” কিছু না ভেবেই যেন উত্তর দিয়েছিল অহনা।

উত্তরটা এত ভাল লেগেছিল কেন কে জানে ইজাজের, বোধ হয় এত বেশিরকম মিথ্যা বলেই।

ঘুমে প্রায় জড়িয়ে এসেছিল চোখ। তার মধ্যেই কোনওরকমে ইজাজ জিজ্ঞাসা করেছিল, “—তারপরে? তোর বাবার সাথে রিলেশনশিপটা...ক্ষমা করেছিস?”

অহনা আলগা হাতে ইজাজের চুলগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল অল্প। ইজাজের প্রশ্নের উত্তরে হাতটা থেমে গিয়েছিল মুহূর্তের জন্য, অনির্দিষ্টরকম একটা শব্দ করেছিল গলার আর নাকের মধ্যে, একটা দীর্ঘনিশ্বাসও মিশে ছিল যেন তার সাথে। কয়েকমুহূর্ত পরে বলেছিল, “ক্ষমা করা জিনিষটা...ওটা লোকেরা নিজের জন্যই করে থাকে। সে অর্থে ক্ষমা বোধ হয় করেছি, যদি আমার ক্ষমার কোনও মূল্য থেকে থাকে তো, অপরাধটা তো আর সরাসরি আমার বিরূদ্ধে হয়নি?...” খানিকক্ষণ চুপ করে ছিল আবার, ইজাজ ঘুমিয়েই পড়েছিল প্রায়, ঘুমের চৌকাঠ পেরিয়ে প্রায় ঢুকেই পড়েছে এমন সময় আবার কানে এসেছিল অহনার গলা, “—কিন্তু, সব সম্পর্কই এক এক ধরনের চুক্তি তো? বাবার সাথে ছোটবেলা থেকে যে অকথিত চুক্তিটা ছিল সেটা ভেঙে গেছে। এখন, বাবা যা, রক্তমাংসের সাধারণ ভুলত্রুটিভরা একজন মানুষ, তাই বলেই বাবাকে স্বীকার করে নিয়েছি, ‘মাই ড্যাডি স্ট্রংগেস্টে’র দিন শেষ! বাবার আদুরী মেয়ে বনে থাকারও দিন শেষ। বদলে, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার দায় নিতে পেরেছি... অন্ধের মত সব নির্দেশ না মেনে। যাকে বলে ‘ভুল করার অধিকার’।”

ঘুমের অতন্দ্রে তলিয়ে যেতে যেতেও ইজাজের হাসি পেয়ে গিয়েছিল যেন, ‘ভুল করার অধিকার’, অ্যাঁ। জড়িয়ে জড়িয়ে বলেওছিল মনে হয়, “আমি সেই রকম একটা 'ভুল', অ্যাঁ?”

জবাবে অহনা কী বলেছিল তা আর শুনতে পায়নি ও।

***

অহনার সাথে ইজাজের সম্পর্কের কোন নামকরণ ওরা এখনও করেনি। করে লাভ কী? ওই সম্পর্কের কোনও ভবিষ্যৎ যে নেই তা ওদের থেকে ভাল আর কে জানে? ইজাজের বাস্তব অহনার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়, ইজাজের পক্ষে সম্ভব নয় অহনার পারিপার্শ্বিককে বোঝা, ওদের পরিবার পরিবেশের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল।

কাজেই ওরা সেই আগের মতই নামহীন সম্পর্কে রয়ে গেছে। শুধু, ইলিয়ানা যখন ওদের ট্রিট দেয় (আসলে ইজাজের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য, কিন্তু সেটা স্বীকার করে না ও, বলে পৃথ্বীশ-স্যারের সাথে ওর ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাওয়ার কারণে), আর সেখানে ওর পরিচিত দু'একজনের সাথে দেখা হয়ে গেলে ইজাজের পরিচয় দেয় অহনার বয়ফ্রেন্ড বলে, তখন ইজাজ আপত্তিও জানায় না বিন্দুমাত্র। একেবারেই নয়। অহনাও আপত্তি জানায় না। বরঞ্চ মিটিমিটি হাসে ঠোঁট চেপে ইজাজের দিকে তাকিয়ে, আর ইজাজ ইচ্ছে করেই অহনার কোমর জড়িয়ে ধরে একহাতের বেড়ে, আর ইলিয়ানা সেদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে যদিও বলে, “ডিসগাস্টিং!” কিন্তু ওর ঠোঁটেও চাপা হাসি খেলে যায়, বলে, “উল্টে তোদেরই আমায় ট্রিট দেওয়া উচিত। আমার পার্টিতেই তো...” ইঙ্গিতপূর্ণ ভুরু নাচায় ও।

আর ইজাজ বলে, “কিশোর ও যুব সম্প্রদায়ের গুপ্তঘাতক এইসব পার্টিগুলো, ঠিকই বলেছিল সেই ফেসবুক পেজটা! ওই পাপের জন্য ট্রিট চাস? ছি ছি!”

আর অহনা হাসে আর হাসে, আর পেটের কাছে উষ্ণ তুলো জমে ওঠার মত একটা অনুভূতি হয় ইজাজের ওর হাসির দিকে তাকিয়ে।

ইলিয়ানা সে কথা শুনে মুখবিকৃত করে বলে, “ওই ডিসগাস্টিং অনুভূতিটার নাম প্রেম! কিন্তু, অবাক করলি, তোকে তো কখনো এমন মেয়েলি...”




(পরবাস-৬৬, মার্চ ২০১৭)