''আঙ্কল্, পাঁচশো-হাজারের নোট কোথায় এক্সচেঞ্জ করছে? কোন কাউন্টারে?'' কল্যাণী সেন্ট্রাল পার্কের পোস্ট অফিসের গেটে ঢুকেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল আর্শিকা।
—"ঐ দিকে ঢুকে বাঁদিকে চলে যান। লাস্ট দুটো কাউন্টারেই করছে।'' লোকটি হাত নেড়ে আর্শিকাকে বুঝিয়ে দিলেন। ছোট্ট একটা 'থ্যাঙ্কস্' ছুঁড়ে গেট দিয়ে ঢুকে গেল আর্শিকা। সানগ্লাসটা খুলে প্রীতমের হাতে দিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগের চেনটা খুলল।
—"তুই এই লাইনেই দাঁড়া, আমি পাশেরটাতে যাচ্ছি। ... আর ফর্মটা তোর কাছে? ... না আমার ব্যাগেই তো ঢোকালাম।'' ব্যাগ ঘাঁটতে থাকে আর্শিকা, ''কী রে? অমন উশখুশ করছিস কেন? কী দেখছিস?'' প্রীতমের গায়ে আলতো টোকা দেয় আর্শিকা, ''গরম লাগছে?''
—"হুঁ...'' পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘামটা মুছতে থাকে প্রীতম।
—"ঐ সামনে ফ্যানের তলায় দাঁড়াবি যা।'' আঙ্গুল নেড়ে দেখিয়ে দেয় আর্শিকা।
—"তোদের জায়গাটা বোগাস। একসঙ্গে এতো লোককে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কী বাজে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন! তার চেয়ে টোকেন সিস্টেম করতে পারতো। গর্ভনমেন্টের ইন্সপেক্টিং টীম পাঠানো উচিত। ... এখন তো সাফোকেশন হবার জোগাড়। একে তো নভেম্বরের ১৪ হয়ে গেল, ঠান্ডা পড়ার একটুও নাম নেই। ২০১৬-টা একটা ইউনিক ইয়ার হয়ে যাবে মনে হচ্ছে -- দ্য ফার্স্ট উইন্টারলেস ইয়ার।''
—"প্লীজ," হাত নেড়ে প্রীতমকে থামায় আর্শিকা, ''চুপ কর একটু। এখানে প্রফেসারি ফলাস না। টাইম ওয়েস্ট করলে আমাদেরই ক্ষতি। ... এই নে ফর্মটা। আর এই ফোর থাউজেন্ড।''
প্রীতমের হাতে ফর্ম আর হাজারের নোটগুলো ধরিয়ে পাশের লাইনে দাঁড়ালো আর্শিকা। বিরাট লম্বা লাইন। তার মানে প্রায় আধ ঘন্টা দাঁড়াতে হবে। ধূর্, এর চাইতে দু'জনে এক লাইনে দাঁড়ালেই ভালো করত। বেকার বোকার মতো না দাঁড়িয়ে গল্প করা যেত। পকেট থেকে স্মার্টফোনটা বের করে, হোয়াটস্ অ্যাপ অন করে আর্শিকা। কিছুটা সময় তো কাটবে। ফোনটা হাতে নিয়ে আশেপাশে তাকায়। কিছুক্ষণ বসবে? একটু ফাঁকা হলে তারপর লাইনে এলেই তো হয়। মাকে এত করে বলল যে একটু দেরি করে যাবে, তা সে শুনলোই না। লাঞ্চ শেষ হতেই হুড়মুড়িয়ে পাঠিয়ে দিল।... ঘনঘন হাই তোলে আর্শিকা। তিন-চার দিন আগে ফ্লাইট থেকে নেমেছে। এখনো কেন যে জেট ল্যাগ কাটেনি! খালি ঘুম পাচ্ছে। এখন টানা দুটো ঘন্টা যদি ঘুমোনো যেত! ... আবার ফোনটা ঘাঁটতে শুরু করে দেয়। অফিসের কোন খবর-টবর আছে কি না দেখে।
ব্যাঙ্গালোরের আই. টি. সি. ইনফোটেকে আর্শিকা আর প্রীতম দু'জনেই কাজ করে। প্রীতম আগে পুনেতে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পার্ট টাইম লেকচারার ছিল। বছর চারেক আগে ইনফোটেকে জয়েন করেছে। ওদের আলাপটা অবশ্য একবছরের। প্রীতম কলকাতার আর আর্শিকার বাড়ি কল্যাণীতে। ব্যাঙ্গালোরে অপরিচিত জায়গায় নিজের জায়গার একজনকে পেয়ে আর্শিকাই যেচে প্রীতমের সাথে আলাপ জমায়। মাস দু'য়েক যেতেই প্রীতমকে প্রোপোজও করে ফেলে। 'স্মার্ট হ্যান্ডসাম' মেয়ে দেখে প্রীতমও রিজেক্ট করতে পারেনি। গত তিন-চার মাস ওরা ওখানে একটা 2BHK ফ্ল্যাট কিনেছে; তাতে দু'জনেরই শেয়ার আছে। কাজের চাপে বিয়েটাই যা করে উঠতে পারছে না। প্রীতম ফ্ল্যাট কেনার সময় থেকেই চাপ দিচ্ছিল। আর্শিকা তখন ক'টা প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তাই রাজি হয়নি। এখন একটু হালকা হতে ক'দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে কল্যাণী। বিয়ের বিষয়েই দু'বাড়িতে আলোচনার জন্য; আর তার সাথে টুকিটাকি মার্কেটিংও সেরে রাখবে বলে। প্রীতম এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ওর বাড়ি চলে গিয়েছিল, মা-বাবা বারবার ফোন করছিলেন বলে। আর্শিকার সাথে কল্যাণী আসতে পারেনি বলে আর্শিকার কী অভিমান!
...Arshi, plz understand... bokar moto rag koro na. Ki korbo bolo? Tomak koto kore bollam cholo amar bari... but u denied. What's wrong wid u darlng?
...It's OK Prit. I hvn't uttrd a single word... Did I? ... Stay wid ur Mom and Dad... I don't say anything and mind anything... Gd ni8.
হোয়াটস অ্যাপে পার্সোনাল মেসেজগুলো আবার স্ক্রল করে দেখছিল আর্শিকা। সত্যি, প্রীতম ওকে খুব ভালোবাসে। অভিমান ভাঙাতে পরদিনই হাজির কল্যাণীতে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে, বিছানায় ওর পাশে প্রীতম শুয়ে আছে।
—"কী বেবি? ... বেলা বারোটাতে ঘুম ভাঙল?'' আর্শিকার গাল টিপে আবার দুষ্টুমি শুরু করে দিয়েছিল প্রীতম।
—"তুই কখন এলি? হঠাৎ?'' বিরক্তি দেখিয়ে আর্শিকাই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল প্রীতমের কাছ থেকে।
—"এই তো আধাঘন্টা হল এসেছি।''
—"মা আমায় ডাকেনি তো?"
—"বারণ করেছিলাম। তোকে সারপ্রাইজ দেব বলে।" চোখ মেরে খাট থেকে এক লাফে নেমে পড়েছিল প্রীতম, আর্শিকার হাতে মার খাবার ভয়ে।
মেসেজগুলো দেখে নিজের মনেই হাসতে থাকে আর্শিকা। নিজেকে এক-এক সময় খুব লাকি মনে হয় ওর। পুরোনো দিনের মানুষ হলেও মা ওদের সম্পর্কটা খুব ভালোভাবে মেনে নিয়েছেন। এই নিয়ে আজ অবধি কোনোদিন রাগারাগিও করেননি। আর প্রীতমকে তো নিজের ছেলের চেয়েও বেশি কিছু ভাবেন। বাবার সাথে ডিভোর্সের পর থেকে মা খুব একা হয়ে পড়েছিলেন। প্রীতম নানাভাবে সঙ্গ দেয়, হাসি-খুশি রাখে বলে মাও ওর সাথে খুব ফ্র্যাঙ্ক। সবচেয়ে বড় কথা কোনোদিন আর্শিকার বাবার কথা সেভাবে জানতে চায়নি। হয়তো আঘাত লাগবে ভেবেই। তাই বোধ হয় এই রিলেশ্যনশিপটা কনটিনিউ করতে পারছে আর্শিকা। ওদের এই ফ্যামিলি প্রবলেমের জন্যই তো আগের দু'টো রিলেশ্যন ব্রেক-আপ হয়ে গেল। ... ওসব অবশ্য এখন আর আর্শিকার ওপর কোনো ইফেক্ট ফেলে না। সেল্ফ-সাফিসিয়েন্সিটাই তো এখন ওর জীবনের সবচেয়ে বড় খুঁটি।
—"ও দিদি, হোয়াটস্ অ্যাপটা বাড়ি গিয়ে করবেন। এগোন না তাড়াতাড়ি।"
পিছনের লোকটার খোঁচায় বেশ বিরক্ত হয় আর্শিকা। এটা-ওটা ভাবতে ভাবতে বেশ সময়টা পেরিয়ে যাচ্ছিল... খামোকা পিছন থেকে খোঁচা দেয়।
—"এগোবো কী করে বলুন? সামনে এতজনকে কি বাঁশ দিয়ে ঠেলব?" আর্শিকা প্রায় ঝেঁজে ওঠে।
—"আঃ, দাদা... চুপ করে যান না। এমনিতেই ক্যালক্যালানি, তার ওপর এখন ঝগড়া বাধাচ্ছেন কেন?" পাশের লাইন থেকে একজন বলে ওঠেন।
আর্শিকা রেগে গিয়ে ফোনটা স্যুইচড্ অফ্ করে পকেটে পুরে নেয়। প্রীতমের লাইনটা অনেকটা এগিয়ে গেছে। ওরটা ঢিকিঢিকি করে এগোচ্ছে।
—"কাউন্টারে ম্যাডাম নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়লেন না কি?" কেউ একজন পিছন থেকে মন্তব্য ছোঁড়েন, "মেয়েদের যে কেন ব্যাঙ্ক-পোস্টাপিসের কাউন্টারে বসায়? ক'টা টাকা গুনতেই বছর পোয়াচ্ছে।"
—"আরে? কী হল? জমা নিচ্ছে না?" একটি মাঝ-বয়সি লোককে ফিরে আসতে দেখে এই লাইন থেকে প্রশ্নটা উড়ে এলো।
—"না না... দেখুন না একই বাড়ির দু'জনাকে দিল না।" কথাটা ছুঁড়ে দিয়ে উবে গেল ঐ লোকটি।
—"শালা, গর্মেন্ট হয়েছে। মোদীকে তো আর সব ফেলে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে না। হলে বুঝতো। সকাল থেকে হল গিয়ে টাকা নেই ... আর এখন টাকা আসতে বলে কি না একই বাড়ির দু'জনাকে দেবে না। এ কি সার্কাসের খেলা হচ্ছে?"
লাইনে অসন্তোষ ক্রমশ বাড়তে থাকে। ডিমানিটাইজেশনের সমর্থন অবশ্য আর্শিকাও করে না, তবু... গভর্নমেন্ট অর্ডার... মানতেই হবে। আর. বি. আই.-এর আরো আগে প্রিপেয়ার্ড থাকা উচিত ছিল। আগে থেকে কোনো পলিসি ফ্রেমই তো হয়নি। কী যে হবে এতগুলো লোকের? আট তারিখ রাতে ডিক্লেয়ার করল। নয় তারিখ সারাদিন ব্যাঙ্ক বন্ধ। তারপর দশ, এগারো, বারো, তেরো ... গেল। অথচ আজও সকালে টাকার সাপ্লাই নেই। এলোমেলো ভাবতে ভাবতে প্রীতমের লাইনটার দিকে তাকাল আর্শিকা। ইশ! প্রীতম অনেক এগিয়ে গেছে। ওর আগে আর মাত্র দু'জন। আর আর্শিকার আগে এখনো ... নাঃ, গুনে লাভ নেই। গোনা যাবে না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে প্রীতমের লাইনটায় ঢুকে যায় আর্শিকা।
—"এক্সকীউজ মী ম্যাডাম, একটু দেখি।"
লম্বা চওড়া এক ভদ্রমহিলার পিছনে দাঁড়ালো আর্শিকা। ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে থমকে গেল সে।
—"তুমি...?" অস্ফুটে বেরিয়ে এল মুখ থেকে।
—"একা এসেছো?" গমগমে গলার স্বরটা খেলে গেল আর্শিকার কানে।
—"না। বয়ফ্রেন্ড এসেছে।" নিজেকে সামলে নিয়ে স্মার্টলি উত্তর দেয় আর্শিকা।
—"কোন ছেলেটি?"
—"ঐ যে সামনের দিকে... থার্ড..." চোখের ইশারায় প্রীতমকে চিনিয়ে দেয় আর্শিকা।
—"এখন কী করছ?"
—"হুঁ? ... ইয়ে, ব্যাঙ্গালোরে..."
—"ও, হ্যাঁ, বলেছিলে তো... গতবছরের আগের বছর আমাদের দেখা হয়েছিল না?"
—"হুঁ।" আলতো করে ঘাড় নাড়ে আর্শিকা।
—"আই. টি. সেক্টরেই আছ? ঐ ইনফোটেক না কি যেন?"
—"হ্যাঁ।" আর্শিকা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ভদ্রমহিলার দিকে।
—"কী হল? ওরকম অবাকভাবে তাকিয়ে আছ?"
—"না, মানে... তুমি এখানে সেটাই ভাবছি..." হাতড়ে হাতড়ে প্রশ্ন খোঁজবার চেষ্টা করে আর্শিকা, "তাই অবাক লাগছে।" অ্যাটিচিউড নিয়ে কাঁধ ঝাঁকায়।
—"সমরেশের এক বন্ধুর মেয়ের বিয়ে আজ, তাই এখানেই ক'দিন আছি।"
—"সমরেশ আঙ্কল্?" ভ্রূ কোঁচকায় আর্শিকা।
—"মনে আছে ওঁর কথা? তোমার ছোটবেলায় প্রায় দিনই ওবাড়ি যেতেন। তোমার সাথে কত খেলা করতেন। মনে পড়ে?"
—"মনে থাকাটাই তো স্বাভাবিক। তাই না?" ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি ছিটিয়ে নেয় আর্শিকা। ভদ্রমহিলার মুখের হাসিটা মিলিয়ে আসে। তবু কথা বলতে থাকেন। লাইন এগোয়, উনিও দু'টো-একটা প্রশ্ন করতে থাকেন।
—"তুমি কবে এলে?" আর্শিকার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করেন।
—"এই তো টেনথ্-এ। একটা সপ্তাহ ছুটি নিয়েছি। তুমি এখন কলকাতার কোথায় আছ?"
—"না না, কলকাতায় এখন আর থাকি না। তোমায় বলা হয়নি। আমরা গতবছরই বম্বে শিফট্ করে গেছি। সমরেশের ট্রান্সফার হল। এখন ও তো বম্বের ব্রাঞ্চের সুপারভাইজার। ওর সার্ভিস তো আর বেশিদিন নেই। এটাই মোস্ট প্রোবাবলি লাস্ট ট্রান্সফার। তাই আমাদের ইচ্ছে আছে ... ওখানেই সেটল্ করার।"
—"আমাদের?... বাঃ! বেশ ভালো!" ভ্রূ নাচায় আর্শিকা।
ওর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ভদ্রমহিলা। কী ভাবছেন? কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করে মেয়েটা বেশ ওভার-স্মার্ট হয়েছে? অবশ্য এই দৃষ্টিটা আর্শিকার বেশ এনজয়িং লাগল।
নোট এক্সচেঞ্জের পর উনি দূ্রের ফাঁকা টেবিলটার দিকে চলে যান। আর্শিকা কাউন্টারের সামনে আসে। ফর্ম আর নোটগুলো গ্লাসের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দেয়।
—"অ্যাকাউন্টে জমা করছেন না কেন?" কাউন্টারের কর্মীটি জিজ্ঞাসা করেন।
—"দেখুন, ইটস্ মাই ফার্স্ট টার্ন। আমি ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করি। এখানে ছুটি নিয়ে এসেছি ক'দিনের জন্য। আবার নেক্সট উইকেই ব্যাক্ করব। ক্যাশ দরকার, তাই...।" স্বভাববশত কাঁধ নাচায় আর্শিকা।
ভদ্রলোক ওকে একবার দেখে নিয়ে টাকা গুনতে থাকেন।
—"কুড়ির নোট দিচ্ছি। এটাই এখন সাপ্লাই আছে। প্যান বা ভোটার আই.ডি. ... কী এনেছেন?"
—"প্যান আছে। চলবে তো?"
—"হ্যাঁ, দিন।"
—"ওরিজিনাল লাগবে?"
—"নাঃ... ফোটো কপিটাই দিন।"
—"দিচ্ছি।"
প্যান কার্ডের জেরক্স কপিটা জমা দিয়ে কুড়ির নোটের বান্ডিল দু'টো হাতে নিয়ে নেয়। লাইন ছেড়ে বেরিয়ে বাঁদিকের টেবিলের কাছে যায়।
—"কী রে? এতো দেরি হল?" টেবিলের কাছেই প্রীতম দাঁড়িয়ে ছিল।
—"আমার লাইনটা এগোচ্ছিলোই না। তোকে দিয়েছে?"
—"হ্যাঁ। ঐ ভদ্রমহিলা কে?"
—"অ্যাঁ? কে?" আর্শিকা একটু থতমত খায়।
—"যাঁর সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলি।"
—"ও, আমার একজন রিলেটিভ।"
—"রিলেটিভ?" প্রীতম নাক সিঁটকায়।
—"কেন?"
—"না," প্রীতম মাথা নাড়ায়, "বাইরে চল্। বলছি।"
নোটগুলো গুনে ব্যাগে ভরে নেয় আর্শিকা। ওরিজিনাল প্যান আর ভোটার কার্ড দু'টো হাতেই ধরা ছিল। ব্যাগের ভেতরের খোপে রাখবে বলে চেনটা খোলে। ওগুলো ঢোকাতে গিয়েও একটিবার থমকায়। একবার চোখ বোলায় কার্ড দু'টোতেই। তারপর আবার রেখে দেয় ব্যাগের মধ্যে। ছোট্ট একটা শ্বাস বেরিয়ে আসে আপনা থেকেই।
—"কী রে? চল্... বাড়ি যাবি না?" প্রীতম তাড়া দেয়।
—"হ্যাঁ।" ব্যাগ-ট্যাগ গুটিয়ে পাটিয়ে গেটের দিকে যায় ওরা দু'জনেই।
—"চলে যাচ্ছ? কাজ হয়ে গেল?" ঐ ভদ্রমহিলা আবার উড়ে এসে জুড়ে বসলেন। আর্শিকা বেশ অসন্তুষ্ট হয়। প্রীতম বাইরের গেটে অপেক্ষা করছে দেখে ছটফট করে সে।
—"হুঁ, তাড়া আছে। আসি।"
—"মা কেমন আছেন?" ভদ্রমহিলার গলার স্বরটা এবার একটু নরম শোনাল।
—"ভালো।"
—"এখানেই থাকেন?"
—"হ্যাঁ, মায়ের সার্ভিস তো এখনও দু'বছর রয়েছে। তারপর ব্যাঙ্গালোরেই শিফট করবে ভাবছে। একদিন—" কথাটা বলতে গিয়েও গিলে নিল আর্শিকা। ভদ্রমহিলা মিটিমিটি হাসছেন; আর্শিকার একসময়ের খুব পরিচিত, ভালোলাগা আর ভালোবাসা মাখানো হাসি। ভাবল একবার বলবে, বাড়িতে আসার জন্য। কিন্তু "একদিন আমাদের বাড়ি এসো" কথাটা আর বলা হল না। আরও একটা কথা বলবে বলবে করেও বলল না; ওর আর প্রীতমের বিয়ের কথাটা। সামনের জানুয়ারিতে বিয়ের ডেট ঠিক করবে ভাবছে। নাঃ, বলে কী হবে?
—"আমার আগের নম্বরটা চেঞ্জ হয়েছে। এখানেরটা রাখবে?"
—"দাও।... আচ্ছা আমার নম্বরটাতে কল্ কর। সেভ করে নিচ্ছি।" আর্শিকা পকেট থেকে ফোনটা বের করে স্যুইচড্ অন্ করে। নিজের মোবাইল নম্বরটা ভদ্রমহিলাকে বলে।
—"কল্ গেছে? ৭০ দিয়ে নম্বরটা। জিও সীম্। এই সেপ্টেম্বরে নিলাম। তোমারও তো জিও, না?"
—"হুঁ। কল্ এসেছে।"
—"কী নাম ওর?" ফোনটা হাতে নিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতেই প্রশ্ন করেন ভদ্রমহিলা।
—"কার?"
—"তোমার বন্ধুর।"
—"প্রীতম।"
—"বাঃ! সুন্দর নাম।" একটু থেমে এদিক-ওদিক তাকান। তারপর আবার বলতে থাকেন, "একটা রিকোয়েস্ট করছি। আজ যে আমাদের দেখা হল এসব তোমার মাকে কিছু বোলো না প্লীজ।"
আর্শিকা ছ'ফুট লম্বা মানুষটার মুখের দিকে চোখ তোলে।
—"এসো। প্রীতম অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে।" ভদ্রমহিলাই তাড়া দেন।
—"হুঁ, আসি।"
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আর্শিকাকে অন্যমনস্ক দেখে প্রীতম।
—"কী রে? অমন থম মেরে গেলি কেন? মিও আমর যাবি? প্যাটিস কিনে নিতাম বিকেলের টিফিনের জন্য।"
—"না। চল্ বাড়ি যাই। ঘুম পাচ্ছে খুব। একটা টোটো নিয়ে নিলে হয়।"
পোস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে ডান দিকে বেঁকে সোজা টোটো-স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা লাগায় দু'জনেই।
—"কাকু যাবেন?" স্ট্যান্ডে এসে এক টোটোওলাকে প্রীতম জিজ্ঞাসা করে।
—"কোথায়?"
—"বি-ওয়ান। পিকনিক গার্ডেনের কাছে। দু'জন যাব। কত লাগবে?"
—"তিরিশ টাকা। দু'জনায় যাবেন তো, কম হবে না।"
খুঁতখুঁত করতে করতেই আর্শিকা টোটোতে উঠল। অন্যদিন হলে তিরিশ টাকাকে টেনে কুড়িতে নামাত। আজ আর ইচ্ছে হল না। প্রীতমও বোধ হয় কিছু বুঝেছে। তাই আপত্তি করল না। যেতে যেতে ও দু'একটা কথা বলবার চেষ্টা করে। আর্শিকা কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে চুপ করে যায়। ভদ্রমহিলার সাথে দেখা হবার পর থেকেই সে কেমন যেন গুটিয়ে গেছে। প্রীতম সেটা খেয়াল করেছে। দু'একবছর ছাড়া ছাড়া হঠাৎ করে দেখা হয়ে যায়। আর আর্শিকার স্বাভাবিক দিনগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়। আবার একটু একটু করে ছেঁড়া দিনগুলো থেকে বেরিয়ে আসে সে। গত দশ বছরে এমনটাই অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল তার। কিন্তু আজকের দেখা হওয়াটা এতদিনের অভ্যেসটাকে অনভ্যাসের দিকে ঠেলে দিল। উনি সমরেশ আঙ্কলকে বিয়ে করেছেন? কতদিন? দু'বছর আগে যখন দেখা হল তখন তো কিছু বলেন নি। তার মানে তারপর? মা জানে?
প্রশ্নগুলো আর্শিকার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে থাকে ঘন ঘন। ... বম্বেতে শিফট করে গেছেন পার্মানেন্টলি! তাহলে তো আর দেখা হবে না। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে সে। এতদিন ওঁর সাথে দেখা করতে চাইত না। অথচ আচমকাই দেখা হয়ে যেত। আজ শিফটিং-এর কথাটা শুনে মনটা যে কেন খারাপ হয়ে গেল? মনের ভিতরে দেখা করবার যে ইচ্ছেটা গেঁথে ছিল সেটা এতদিন বুঝতেই পারল না?
—"তোর কী হয়েছে বল তো?" অনেকক্ষণ চুপ থেকে প্রীতম আবার প্রশ্ন করে।
—"...কই না, কিছু হয়নি।" আর্শিকা কথা হারায় বারে বারে।
—"ঐ ভদ্রমহিলা কে? ওঁর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে তোকে এরম ডিসটার্বড্ লাগছে। কী বলছিলেন উনি?"
—"সেরকম কিছু না। এমনি খবরাখবর নিচ্ছিলেন।"
—"ওঁকে আমার ঠিক... মানে, কেমন যেন আনকালচারড্ লাগল। তোর ফ্যামিলির বা রিলেটিভদের সাথে স্যুট করে না ওঁর চেহারা।"
—"তুই আমার ক'জন রিলেটিভকে দেখেছিস?" শুকনো হাসি হাসে আর্শিকা।
—"না, তা দেখিনি। বাট্ আন্টিকে দেখে মনে হয়, তাই বললাম। আন্টি এত কালচারড্।"
—"কালচার মানুষেরই তৈরি, যার যা ভালো লাগে সে তাই করে, তা নিয়েই বাঁচে... সেটা অন্যরকম হলে কি তাকে আনকালচারড্ আর বাকিদের কালচারড্ বলা যায়?" গোলাপ-রঙা নেলপালিশ লাগানো নিজের নখগুলোয় আঙুল বোলাতে বোলাতে উত্তর দেয় আর্শিকা।
—"ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং... প্লীজ ডোন্ট মাইন্ড। ওঁকে দেখে কেমন যেন থার্ড জেন্ডার, আই মীন ট্রান্সজেন্ডার মনে হল। জাস্ট লুকিং লাইক অ্যান এন্ড্রোজাইন। গলার স্বরটা কেমন পুরুষালি, চেহারাতেও ঠিক নর্ম্যাল ফেমিনাইন গ্রেস নেই। কীরকম ডিফারেন্ট লাগল... সো আই অ্যাম আস্কিং।"
আর্শিকা কিছু বলল না। শুধু চাউনিতে ফুটিয়ে তুলল না-বলা কথাটা। ওর আড়চোখের দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে সরাসরি প্রীতমের চোখের ওপর। লাল-আভামাখা চোখদু'টো উপেক্ষা করেই প্রীতম বলতে থাকে--
—"আমি কোন ডেরোগেটরি কমেন্ট করছি না। রিলেটিভ বলছিস তাই...।"
—"কেন? এরকম চেহারার কেউ বুঝি আমাদের মতো সফিস্টিকেটেড্ কারোর রিলেটিভ হতে পারেন না?" আর্শিকা এবার ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে।
—"আরে? ওভাবে দেখছিস কেন? ওঁর সাথে তোর কনভারসেশন দেখে মনে হল ইউ আর ভেরি ক্লোজ, সেজন্যই—"
—"তোর ইনসিকিউরিটির কোন কারণ নেই—" শুকনো জবাব দেয় আর্শিকা।
—"আমার কথায় রাগ করলি? ... আসলে তোরা যখন কথা বলছিলি তখন আশেপাশের লোকজন কীরকমভাবে যেন তাকাচ্ছিল, আমার কেমন অকওয়ার্ড লাগল। তাই জানতে চাইলাম উনি তোর কে হন—"
প্রীতম আর্শিকার হাতটা চেপে ধরে। ওর হাতের ছোঁয়ায় অন্য কী যেন আঁচ করে আর্শিকা, যা এতদিনের ছোঁয়ায় পায়নি। একটা মিথ্যে সাজাতে গিয়েও পারে না। নিজের হাতটা প্রীতমের হাতের মুঠো থেকে সরিয়ে নেয়। তারপর কেটে কেটে স্পষ্ট করে সেই সত্যিটা বলেই দেয়, যা একবছর ধরে গোপন রেখেছিল প্রীতমের কাছ থেকে।
—"উনি এখন আর আমার কেউ হন না... আগে হতেন," আর্শিকার কথায় প্রীতমের চোখদু'টো সরু হয়ে আসে, ভ্রূর ভাঁজটা ফুটে ওঠে। আর্শিকা ওর চোখে চোখ রাখে, "আগে হতেন... আমার বাবা।"
(পরবাস-৬৬, মার্চ ২০১৭)