“মুন্নি বদনাম হুই ডার্লিং তেরে লিয়ে” গানটার গগনবিদারী আস্ফালনে চিন্তার রেশটা কেটে যায় অনিকেতের। এই প্রৌঢ় বয়সে তার কাছে পুজো ঐ টিভিতে পুজো পরিক্রমা পর্যন্তই কিন্তু তাও দশমীর বিষণ্ণতাটা কেমন ছোঁয়াচে রোগের মত তার আটান্ন বছরের মনটাকেও ছুঁয়ে গেছে। অবিশ্যি আজকের মনখারাপের কারণটা কিছুটা বিজয়া আর কিছুটা এক আর্থিক উদ্বেগের জন্যে। কি করে টাকার জোগাড় হবে সেই চিন্তাটা খুবই ভাবিয়ে তুলেছে তাকে। মিস্টুর বিয়ের আর দু-মাসও বাকি নেই। একটু সাজিয়ে গুছিয়ে না দিলে শ্বশুরবাড়িতে মান থাকবে কেন? সম্বল যা ছিল মেয়েটাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে আর এই মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু কিনতেই বেরিয়ে গেছে। ব্যাঙ্কে হাঁড়ির হাল। চিন্তা সরিয়ে রেখে ওঠে অনিকেত। দু একটা বিজয়া জানাতে হবে।
তার স্ত্রী অরুণিমার মা এখনও বর্তমান। তাঁকেই প্রথম ফোনটা করে। “মিস্টুকে কতদিন দেখিনি, তোমরা বাবা কবে আসবে” ইত্যাদি জিগেস করতে থাকেন বৃদ্ধা। কিছু স্তোকবাক্য দিয়ে ফোনটা নামিয়ে রাখে। মনে মনে ভাবে “মায়া বড় প্রবঞ্চক। চলে যাওয়ার সময় যত ঘনিয়ে আসে, তত মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে।” এমন সময় ফোনটা আসে আদিত্যর। সেই গমগমে খুশি খুশি গলা, যেন এইমাত্র ইন্ডিয়া ওয়ার্ল্ড কাপ জিতেছে--
“কি রে কি খবর? তুই কি পাকাপাকি ভাবে ডুমুরের ফুল হয়ে যাবি সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?”
আদিত্য তার সেই কলেজ জীবনের বন্ধু। আমুদে, হুল্লোড়বাজ। যেকোন গম্ভীর পরিস্থিতিকে হাল্কা করে দিতে পারে। এখন ওর বড় ইম্পোর্ট এক্সপোর্ট-এর ব্যবসা। নিন্দুকে বলে ওর সব রোজগার সৎপথে নয় কিন্তু তাতে কি আসে গেল। সততা আর মূর্খামি এখন সমার্থক। ওর একটা ভাল গুণ তো বলতেই হবে পুরোন অসফল বন্ধুকে ভুলে যায়নি। নমাসে ছমাসে একবার খোঁজ তো নেয়। তার একটা কারণ অনিকেত জানে যে সে কখনো বড়লোক বন্ধুর কাছে কোন সাংসারিক দুর্যোগে বদান্যতা ভিক্ষা করেনি। আর একটা কারণ আছে। না, সেটা সে মনে রাখতে চায় না।
কোন কোন ঘোড়া লম্বা রেসের হয়, আর কোনটা পড়ি-কি-মরি করে একশ মিটার। অনিকেত দ্বিতীয় দলের মানুষ। সাফল্যের মাপকাঠিতে কলেজে অনেকের থেকে ওপরেই ছিল সে। পরীক্ষাতে প্রথম হত। লাজুক স্বভাবের হলেও কলেজে সাহিত্যমহলে নাম ছিল। উপরন্তু ভাল আঁকে বলে মেয়েদের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি অনুসরণ করত তাকে। একদিন যখন আদির সাথে ক্যান্টিনে চা খাচ্ছিল হঠাৎই চন্দ্রিমা এসে বলে “আমার একটা ছবি এঁকে দিতে পারবেন।” সেই ষাটের দশকের তুলনায় চন্দ্রিমা নামটা যথেষ্ট চটকদার, এমনকি তার বেশভূষাও যথেষ্ট আধুনিক, সবাই যখন শাড়ি সালোয়ার তখন থেকেই সে পালাজো। ইংরেজি বিভাগের সকলেই থেকে থেকে তাকে প্রেম নিবেদন করে বলে শোনা যায়। অনিকেতের ফাইন আর্টসেও দু একজন অসফল প্রেমিক আছে তার। অনিকেত দশ সেকেন্ড তার বড়বড় চোখের দিকে তাকিয়ে জড়তা কাটিয়ে বলেছিল “চন্দ্রের আভা কি আলোছায়ায় বন্দী হয়? তবু আপনি অনুমতি দিলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।” করিডোরে দৃষ্টি বিনিময়, নোট বিনিময় করতে করতে কবে একটা হৃদয় বিনিময় হয়ে গেছিল। কলেজ পাশ করার পর নেশাকে পেশা বানানোর ভুল সবাই করে না, অনিকেত করেছিল। কিন্তু একজন চিত্রকর যে বাংলার বাজারে বিশাল কল্কে পাবে না সেটা বলাই বাহুল্য। বিভিন্ন পত্র, পত্রিকা, আর্ট এক্সিবিশানে দীর্ঘ দু বছর যাবত প্রত্যাখ্যানের পর যখন বুঝল এ-লাইনে উন্নতি অসম্ভব তদ্দিনে তার অন্য চাকরি পাওয়ার আশা বন্ধ হয়েছে। আরও পুরো এক বছর অপেক্ষা করেছিল চন্দ্রিমা। আদির সাথে চন্দ্রিমার বিয়ের খবরটা যখন এল রাগ করেনি অনিকেত। সত্যিই তো ওর বাড়ির লোকেরা তো চাইতেই পারে যে মেয়ে একটু দুধে ভাতে থাকুক। আর তার অভাবের সংসারে পড়ে স্টাইলিশ চন্দ্রিমা কলুর বলদ নাই বা হল। সস্তা একটা উপহার নিয়ে গিয়ে নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করে এসেছিল অনিকেত। মন থেকে।
আদিত্যর সাথে ফোনটা রেখে সে স্ত্রী অরুণিমাকে বলে, “শুনছ, আদি তোমায় শুভ-বিজয়া জানাল।”
“আচ্ছা, ওর কাছে কিছু টাকা ধার চাওয়া যায় না?” অরুণিমা বলে ওঠে হঠাৎ। মাথাতে তারও মিস্টুর বিয়ের টাকার জোগাড় কি করে হবে সেই কথাটাই ঘুরছে সারাক্ষণ।
না না কিছুতেই নয়, মরে গেলেও চাইতে পারবে না অনিকেত। আরও দুদিন হন্যে হয়ে ঘোরে সে ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে। কাকস্য পরিবেদনা। যেসব ব্যাঙ্কের থেকে বাড়ি বয়ে ক্রেডিট কার্ড দিতে আসে সেখানেই লোন চাইতে গেলে একটা মিষ্টি মাপা হাসি ঝুলিয়ে বলে “স্যার, উই উইল রিভিউ ইয়োর কেস।” শেষমেশ অরুণিমার চাপে আর মিষ্টুর এগিয়ে আসা বিয়ের দিনের তাড়ায় লজ্জার মাথা খেয়ে ফোনটা করেই ফেলল অনিকেত।
“বেশি না, এই হাজার পঁচিশেক। আমি, আমি এক বছরের মধ্যেই শোধ করে দেবো।”
“হুম। দিতে পারি কিন্তু একটা শর্ত আছে।” গম্ভীর মুখে বলে আদিত্য।
এবার বুঝি বড়লোক বন্ধু টাকা ফেরত দেবার সময়সুচি বেঁধে দেবে বা পরিবর্তে কিছু বন্ধক চাইবে। আসন্ন অপমানের আশঙ্কায় কান লাল হয়ে ওঠে অনিকেতের।
“তোকে আর অরুণিমাকে একদিন আমাদের বাড়ি আসতে হবে। আতিথ্যঋণ গ্রহণ না করলে অর্থঋণ দিচ্ছি না। কোন জারিজুরি খাটবে না।” বলেই জোরে হেসে ওঠে আদিত্য।
সেই একইরকম রয়ে গেছে আদি। বদলায়নি একটুও। গত তিরিশ বছরে একবারও যাওয়া হয়নি আদির বাড়ি। অরুণিমারও একটু হাওয়াবদল হয়ে যাবে। খুশি মনেই সম্মতি জানায় অনিকেত।
“তাহলে আসছে শনিবার। সক্কাল সক্কাল চলে আসিস। রাতে থেকে যাবি। আমাদের কেষ্ট যা সুন্দর মাটনের কালিয়া রাঁধে না! খেলে তোর মুখে লেগে থাকবে। আর হ্যাঁ, সুন্দরী বউটিকে বাড়িতে লুকিয়ে রেখে এসো না। অরুণিমাকে না নিয়ে আসলে বাড়ির দরজা থেকেই বিদেয় দেবো, এটা মনে থাকে যেন।”
“আচ্ছা বাবা, নিয়েই আসব ওকে।” ফোন নামিয়ে রেখে অরুণিমাকে ডাকে সে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে তার।
“শুনছ। আদি নেমন্তন্ন করল ওর বাড়িতে। বলল বাড়ি বয়ে গিয়ে ঋণ গ্রহণ করতে হবে।”
“সে তো উনি মাঝে মাঝেই করে থাকেন নেমন্তন্ন। আজ তিরিশ বছর সংসার করছি। কখনো তো তোমায় যেতে দেখিনি।”
“এবার ভাবছি, যাব। তোমায় নিয়েই যাব। তোমায় নিয়ে না গেলে ঘরে ঢুকতে দেবে না বলেছে।”
মুচকি হাসে অরুণিমা।
***
শনিবার সকালে অনিকেতকে মিষ্টি কিনতে পাঠিয়ে একটু প্রসাধন করে অরুণিমা। সাংসারিক অনটন যতটা ঢাকা-চাপা দিয়ে রাখা যায় স্বামীর বড়লোক বন্ধুর কাছে। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের মেয়ে ছিল সে। বাপের বাড়িতে থাকতে কখনো খুন্তি ধরেনি। কিন্তু সংসারের পাকচক্রে এখন চোখের কোণে কালি। তাও সাজলে এখনো খারাপ দেখতে লাগে না। বেশ চোখ কাড়ার মতো রূপ তার। আগের বছরের পুজোয় যে ময়ূরকণ্ঠী রঙের শাড়িটা কিনেছিল সেটা প্রাণে ধরে এখনো ভাঙেনি সে। সেটাই বের করে পরে। বহুদিন পরে ঠোঁটে একটু লিপস্টিক লাগাল। যতই হোক, অনিকেতের একটা সম্মান আছে।
বেহালার চৌরাস্তার মোড়ের ওপর বিশাল বাড়ি আদিত্যর। আগেই ফোন করে বলে দিয়েছিল বাসরাস্তার মোড়ে ওর দারোয়ান রামবিলাস দাঁড়িয়ে থাকবে। বিশাল বড় ড্রয়িংরুমে আরামদায়ক রিক্লাইনিং সোফা। সেন্টার টেবিলে সুন্দর ফুলদানিতে তাজা রজনীগন্ধার গুচ্ছ। অপরদিকের দেওয়ালে একটা পঞ্চাশ ইঞ্চি এলইডি টিভি। অন্য ধারের দুটো দেওয়ালে দুটো বড় বড় পেন্টিং। সারা ঘর জুড়ে সুপ্রসন্না লক্ষীর ইঙ্গিত। “জিন্দেগি, ক্যাইসি হ্যায় পেহলি হায়” গুনগুন করতে করতে আদি ঢুকল ঘরে। মনে পড়ে গেল অনিকেতের। কলেজে থাকতে ভালো গান গাইতো আদিত্য।
“এসে গেছিস। বাহ। চা, কফি, সোডা, ভদকা, হুইস্কি কি খাবি বল।”
“আপাতত চা-ই খাওয়া যাক। তাহলে পৃথক পৃথক নয় আমরা সমষ্টি রস উপভোগ করতে পারব।” বলে ওঠে অরুণিমা। স্পষ্টতই সকাল সকাল তার উপস্থিতিতেই এই কোহলিক ড্রিঙ্কের প্রস্তাব রুচিসম্মত মনে হয়নি।
“তাই হবে ম্যাডাম। হাউ ক্যান আই ডিসওবে ইওর হাইনেস? কেষ্ট, তিন কাপ চা নিয়ে আয়।”
বন্ধুর পিঠে একটা চাপড় মেরে স্বভাবসিদ্ধ চাপল্যের সাথে বলে ওঠে আদিত্য, “এতদিনে বুঝলাম এতো দিন কেন লুকিয়ে রেখেছিলি তোর বেটার হাফ কে। সুন্দরী বউ সেলফে লুকিয়ে টুকিয়ে রাখতে হয় বৈকি।” বন্ধুপত্নীর সাথে রসিকতাটুকু করে আড়চোখে দেখে সে অরুণিমাকে।
“আজ্ঞে, না। ধনলক্ষ্মী সুপ্রসন্ন না হলে গৃহলক্ষ্মীকে সেলফে সাজিয়ে রাখা যায় না।” হালকা খোঁচা দিয়ে উত্তর দেয় অরুণিমা। আদিত্যর আমুদে মেজাজটা অরুণিমাকে সহজ করে দিয়েছে। বেশ সহজেই ইয়ার্কি ঠাট্টা করা যায় মানুষটার সঙ্গে।
“আপনার তাঁকে একটু ডাকুন এবার যাতে এই মিষ্টির প্যাকেটটা দিতে পারি। হুইস্কিপ্রেমী আপনি খুব একটা মিষ্টিপ্রেমী বলে তো মনে হচ্ছে না।”
“আমার বীর রস আর মিষ্টির রসে সমান আগ্রহ।” বলেই টপ করে একটা রসগোল্লা তুলে মুখের মধ্যে চালান করে দেয় আদিত্য। চিবোতে চিবোতেই হাঁক পাড়ে, “কেষ্ট, চন্দ্রিমাকে নিয়ে আয়।”
প্রমাদ গোনে অনিকেত। প্রথমবার অরুণিমার সাথে চন্দ্রিমার দেখা। সে যদি অবজ্ঞা করে, অরুণিমা আবার নিজের খোলসের মধ্যে ঢুকে যাবে।
“ওই যে চন্দ্রিমা। চন্দ্রিমা, অনিকেতকে চিনতে পারছ? আমাদের কলেজের বন্ধু। চিনতে পারছ চন্দ্রিমা?”
চোখ তুলে এতক্ষণে দেখে অনিকেত। হুইল চেয়ারে বসে আছে চন্দ্রিমা। গায়ের কাপড় আলুথালু। চোখের দৃষ্টি দূরে কোথায়। আদিত্যর কথাগুলো কানে গেছে বলে মনে হয় না।
“আসলে বছর দুয়েক আগে একটা স্ট্রোক হওয়ার পর থেকে ওর বাঁ দিকটা পড়ে গেছে। তারপর গত বছর থেকে ওর মেমোরিটা… ডাক্তার বলছে আলজাইমার। আজকাল বেশিরভাগ সময় আমায় চিনতে পারে না। দেখ তোকে চিনতে পারে কিনা। যতই হোক, তোর সাথে...” মুখের হাসি একটু ম্লান আদিত্যর। “নিউরোর বেস্ট ডক্টর অফ ইন্ডিয়াকে দেখিয়েছি। বলছেন সেকেন্ড স্টেজ। বিশ্রাম, যত্ন আর সহানুভূতি ছাড়া আর কিছু করার নেই।”
সোফা থেকে উঠে হুইল চেয়ারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অনিকেত।
“চন্দ্রিমা চিনতে পারছ? আমি অনিকেত।” ক্ষণেকের জন্য চোখটা একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে চন্দ্রিমার। তারপরেই কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
“ওকে এবার নিয়ে যা কেষ্ট। লীলাকে বল ওকে স্নান করিয়ে খাইয়ে দিতে।”
আবার হাসিখুশি মুডে ফিরে আসে আদিত্য। “ছবি আঁকাটা একেবারে ছেড়ে দিলি? তোর আঁকার হাতটা এতো ভালো ছিল। আবার শুরু কর না। এখন আমার অনেক চেনাজানা আছে। কেনবার লোকের অভাব হবে না।”
“ধুর। এই বুড়ো বয়সে। এতদিনের অনভ্যাস। তবে তোর গানের গলাটা একই রকম আছে। অরুণিমাও ভালো গান করে। সন্ধেবেলা একটা গানের আসর বসানো যাবে।”
“তবে তো আর কথাই নেই। ইওর হাইনেস-এর মধুকন্ঠ শোনার জন্য আসর বসাতেই হচ্ছে। এখন স্নান-টান করে নে। তারপর জমিয়ে মাংস ভাত খাওয়া যাবে।”
স্নানে যেতে যেতে আদিত্যর কি একটা অস্বস্তি হয়। কোনো একটা চেনা সুরের কলিটা মনে না পড়লে যেমন অস্বস্তি হয় অনেকটা তেমন ।
***
সন্ধেবেলা চা, সিঙ্গাড়া আর চিকেন কাবাব সহযোগে গানের আড্ডা বসে। আদিত্য অবশ্য চায়ের বদলে একটু হুইস্কি নিয়েছে। পর পর বেশ কয়েকটা তার জামানার হিন্দি গান শোনায় সে। গলাটা ভালই তার। আসর জমে ওঠে। এরপর অরুণিমার গান গাওয়ার পালা।
“আমি কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতই গাইব। হিন্দি না। পুরোন ধাঁচের মানুষ আমি।” আর একটা খোঁচা দেয় অরুণিমা আদিত্যকে।
“প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ”
আবার সেই অস্বস্তিটা ছুঁয়ে যায় আদিত্যকে। এবার যেন চেনা কলি, অচেনা সুর। রাত্রিতে বিছানায় স্বপ্ন আর জাগরণের মাঝের অস্বস্তিটা ঘুরে ফিরে আসতে থাকে।
পরের দিন খাওয়াদাওয়ার পরে বিদায় জানাতে চন্দ্রিমার কাছে যায় অনিকেত আর অরুণিমা। আর একবার নিজেকে চেনাতে চেষ্টা করে অনিকেত। চন্দ্রিমার চোখটা আবার যেন একটু জ্বলজ্বল করে ওঠে। কিন্তু চিনতে পারে না। এক গভীর কুয়াশার আড়ালে অধরা থেকে যায় সে। বেরনোর আগে আলাদা করে ডেকে অনিকেতকে একটা দু-লাখ টাকার চেক দেয় আদিত্য।
“এটা কিন্তু ঋণ নয়। মিষ্টুর বিয়েতে এটা আদিত্যকাকুর গিফট। না না। কোন কিন্তু শুনব না। ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করলে খুব কষ্ট পাব।” তারপর হঠাৎ বলে ওঠে--
“তোর অরুণিমাকে তুই ভালই রেখেছিস। আমার চন্দ্রিমাকে রাখতে পারলাম কই?” স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে আদিত্যর চোখের কোণটা চিকচিক করে। বোঝা যায় প্রৌঢ় মানুষটার আপাত আমুদে মুখোশটার নিচে গভীর ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তা।
“অবশেষে অরুণের সাথে দেখাটা তোর হয়েই গেল?” পরিবেশ হালকা করতে বলে অনিকেত।
অরুণ, অরুণ... বিদ্যুতের মত মনে পড়ে যায় আদির। অস্বস্তির কারণটাও পরিষ্কার হয়ে যায়।
তখন সে ব্যারাকপুরে বাবা মার সাথে থাকত। ক্লাস টেন। পাশের বাড়িতে কিছুদিনের জন্য ভাড়া এসেছিল ওরা। লম্বা চুল। বিনুনি করে স্কুলে যেত। ক্লাস নাইন বোধ হয়। অনেকবার লুকিয়ে শুনেছে অরুণিমাকে ওই “প্রাণ ভরিয়ে” গানটা করতে। সদ্য ওঠা গোঁফের রেখা বলেছিল একেই বিয়ে করতে হবে। একটা চিঠিও লিখেছিল ষাটের দশকের রোমান্টিক ভাষায়। সে চিঠি পৌঁছেছিল কিনা জানে না, কিন্তু পাখি ফুরুত হয়ে গেছিল ছ মাসের মাথায়। অরুণিমার বাবার ট্রান্সফার হয়ে যায় কোথায় একটা।
সেই কলেজ জীবন থেকে বয়ে বেড়ান অপরাধবোধটা এক লহমায় অনেকটা ফিকে হয়ে যায় তার। অনিকেতের প্রথম প্রেমকে সে চুরি করেছিল। বার বার সেই ঋণবোধ থেকে অনিকেতকে সাহায্য করতে চেয়েছে। কিন্তু বার বার অনিকেতের আত্মসম্মানের কাছে হার মেনেছে। সেই অনিকেত অজান্তে তার প্রথম প্রেমকেই… জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এক প্রগাঢ় ঋণভার থেকে মুক্ত হয়ে গিয়ে ভীষণ হালকা লাগছে তার। যাক ভাগ্য ভালো অরুণিমা তাকে চিনতে পারেনি। নতুবা তার তরুণ বয়সের সেই অবোধ আবেগের সেই সব কাণ্ড। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে সে।
অনিকেত আর অরুণিমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ক্লাস নাইনের অরুণিমার সুন্দর ঢলঢল মুখটা মনে পড়ে যায় তার। আজকের সপ্রতিভ অরুণিমার সাথে সেদিনের ভীরু অরুণিমাকে মেলাতে চেষ্টা করে মনে মনে। একটাই নিশ্চিন্তি--অরুণিমা তাকে চিনতে পারেনি। কি লজ্জার ব্যাপার হত তাহলে।
সোফায় গা এলিয়ে বসতেই চোখে পড়ে সেন্টার টেবিলে তার কলেজ ক্রিকেট টীমের ছবির নিচে চাপা কাগজের টুকরোটা। চশমাটা চোখে লাগিয়ে খুলে ধরে সে কাগজটা।
এই ছবিটা দেখে প্রথমেই চিনেছি আপনাকে। “তোমার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করে থাকব, অরুণ” -- এরকমই বলেছিলেন না সেদিন রাস্তার ধারে। :-) মাথা নামিয়ে ছুট্টে পালিয়ে গেছিলাম। সাইকেলে করে চলে যাবার সময় ওই গানটাই গেয়েছিলেন -- “জিন্দেগি, ক্যাইসি হ্যায় পেহলি হায়। কভি তো হাসায়ে, কভি ইয়ে রুলায়ে।” আর চিঠিটাতে যা যা লিখেছিলেন সেগুলো পড়লে কবি কালিদাসও লজ্জা পাবেন। :-) :-) --ইতি অরুণ।
পুনশ্চ -- কথাটা খুব সত্যি আদিত্যবাবু। জীবনটা একটা পেহলি, মানে কিনা প্রহেলিকা, একটা গোলকধাঁধা। এই গোলকধাঁধায় কাকে যে কোন গলিতে হাঁটতে হয় তা বোধ করি সৃষ্টিকর্তাও জানেন না।”
হুম, চিঠিটা পৌঁছেছিল তাহলে। ফিক করে হেসে ফেলে আদিত্য। চিঠিটা আর একবার পড়ে সে। অরুণিমা না লিখে যে “ইতি অরুণ” লিখেছে, সেই ব্যাপারটা আদিত্যর শিরায় শিরায় একটা ভাললাগার অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়। “তবে কি কিশোরী অরুণ তাকে মন দিয়েছিল?” ঈষদোষ্ণ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অনুভূতিটাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে আদিত্য। অনুভূতিটা প্রেমের নয়, যে হরমোন প্রেমে পড়ায়, তার নিঃসরণ বন্ধ হয়েছে বহুকাল আগে, অনুভূতিটা বোধ হয় নস্টালজিয়ার।
(পরবাস-৬৬, মার্চ ২০১৭)