অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার পূর্বাংশের তাম্রলিপ্ত, কাঁথি, হলদিয়া, এগরা সহ চারটি মহকুমা ন্নিয়ে ২০০২-সালে গড়ে ওঠে পৃথক জেলা পূর্ব মেদিনীপুর। তবে একটি নবগঠিত(??) জেলার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও লোকজীবনের ঐতিহ্যকে ধরতে গেলে প্রয়োজন সেই অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাসকে ফিরে দেখা। তাই পূর্ব মেদিনীপুরে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার আলোচনা এই জেলার অন্তর্ভুক্ত জনপদগুলির অতীতকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। কারণ ইতিহাসের পথ ধরেই আসে বর্তমানের বাস্তবতা, আর ভবিষ্যতের হাতছানি। (Maybe a line or two about the pros and cons abt choosing an administrative unit as a reference frame to view lit. and culture of a region would be in order... they may be somewhat useful to catalog sources of literary journals etc., but over all, does Medinipur represent any self-contained cultural unit?)
বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুরের অন্তর্গত প্রাচীন, সমৃদ্ধ জনপদগুলির মধ্যে প্রথমেই মনে হয় তাম্রলিপ্ত বা তমলুকের নাম। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, এই জনপদের বয়স চার হাজার বছরেরও বেশি। প্রাচীন ভারতের প্রসিদ্ধ বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত তাম্রলিপ্তে ধর্ম, শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্যও বেশ পুরোনো। গ্রিক পর্যটনকাহিনি ‘Periplus of the Erythrean Sea’, হিউ-এন-সাঙ-এর ‘Si-yu-ki’ (চৈনিক) প্রভৃতি গ্রন্থে তাম্রলিপ্তের কথা পাওয়া যায়। মহাভারত, দশকুমার চরিত ও বিভিন্ন বৌদ্ধগ্রন্থেও তাম্রলিপ্তের উল্লেখ রয়েছে। তাম্রলিপ্তে বাংলা সাহিত্যের সূচনা ঘটে মধ্যযুগে, বৈষ্ণব ভাব-আন্দোলনের পথ ধরে। পূর্ব মেদিনীপুরের প্রথম বৈষ্ণব পদাবলীকার বাসুদেব ঘোষ ছিলেন শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক। ১৪৫৫-শকাব্দে তিনি তমলুকে এসে বসতি স্থাপন করেন। পদাবলী ছাড়াও ‘গৌরাঙ্গ চরিত’ ও ‘নিমাই সন্ন্যাস’ নামে সেকালের দুটি জনপ্রিয় নাটকের রচয়িতা তিনি।
মধ্যযুগে তমলুকের আর এক বিশিষ্ট কবি ছিলেন জগন্নাথ। তাম্রলিপ্তের রাজা কমল নারায়ণের সভাকবি ছিলেন তিনি। রাজার অনুরোধে তিনি ‘শীতলামঙ্গল পালা’ রচনা করেন। মধ্যযুগের পরবর্তীকালে বলরাম চক্রবর্তী (রচনা: ‘কালিকামঙ্গল’) এবং মুরলীধর দাশ (রচনা: ‘সুবচনীর পাঁচালি’)--এই দুজন কবি তমলুকের আশেপাশে বসবাস করতেন বলে জানা যায়।
পুঁথি-পাঁচালি আর মঙ্গলকাব্যের যুগ পেরিয়ে তমলুক আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের সময়ে প্রবেশ করে ঊনিশ শতকের শেষ দিকে। তমলুক থেকে প্রকাশিত প্রথম মুদ্রিত প্রবন্ধটির নাম ‘বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ’ (?? Remark that it is about Science!!)--কিন্তু এতে লেখকের বা মুদ্রকের নাম বা প্রকাশনা সংক্রান্ত কোন তথ্যই দেওয়া ছিল না। শুধু জানা যায় প্রকাশকাল--১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে। তবে এরপর যে-গ্রন্থটির নাম পাওয়া যায়--১৮৭২-৭৩-খ্রিস্টাব্দে--তমলুকের ইতিহাসে তার অবদান অপরিসীম। ইতিহাসবিদ উমাচরণ অধিকারীর লেখা এই বইটি হল ‘তমলুকের প্রাচীন ও আধুনিক বিবরণ'। অবশ্য বইটি প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে।
অখণ্ড মেদিনীপুরের প্রথম সাহিত্য-বিষয়ক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ পায় তমলুক থেকেই, ১২৮০ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে (সেপ্টেম্বর ১৮৭৩ খ্রি: )। এই ‘তমোলুক পত্রিকা’র প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ রক্ষিত--তিনি পরে ‘তমোলুক ইতিহাস’ নামেও একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ‘তমোলুক পত্রিকা’র দুটি সংখ্যা হাতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন তাঁর ‘বঙ্গদর্শন’-এর পাতায়--
‘আনন্দের প্রথম কারণ এই যে তমোলুক হইতে একখানি সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা প্রচারম্ভ হইয়াছে। দ্বিতীয় আনন্দের বিষয় এই যে, এই পত্রখানি উৎকৃষ্ট। লেখকদিগের লিপিশক্তি ও পাণ্ডিত্য বিষয়ে ইহা বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, যদিও তমলুক সামান্য নগর, তথাপি তথা যে মাসিক পত্র প্রকাশিত হইয়াছে তাহা রাজধানীর অধিকাংশ সাহিত্য বিষয়ক পত্রাপেক্ষ উৎকৃষ্ট।' (উদ্ধৃতি--তাম্রলিপ্তের কথা, পৃ. ৩৯৩)‘সামান্য নগর’ তমলুক আর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠস্থান রাজধানী-শহর কলকাতার তুলনা করতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র যা বলেছেন, তার মধ্যে একালের গবেষকরা ‘centre’ আর ‘margin’-এর দ্বন্দ্ববিষয়ক আলোচনার কিছু রসদ পেতেই পারেন।
‘তমোলুক পত্রিকা’র মান যথেষ্ট উচুঁদরের হওয়া সত্ত্বেও ‘গ্রাহকগণের অসদব্যবহারে তাহা ১৯ মাস চালিয়া বন্ধ হইয়া’ যায়, লিখেছেন ত্রৈলোক্যনাথ রক্ষিত নিজেই (তমলুকের ইতিহাস)। এরপর তমলুকের রাধাশ্যাম প্রেস থেকে ‘তমালিকা’ নামে আরও একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতে থাকে; প্রকাশকাল ১৮৭৩-৭৪। এই পত্রিকায় তমলুক ও পারিপার্শ্বিক অঞ্চলের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জীবনের এক চমৎকার চিত্র ফুটিয়ে তোলার দিকে নজর দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও ১৮৭২-এ ‘সঙ্গীত সমালোচনী’ নামে আরও একটি পত্রিকা প্রকাশ পায়। সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন সেকালের বিশিষ্ট সঙ্গীতগুরু ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী। ড: কমলকুমার কুণ্ডু এটিকে “বাংলা ভাষায় প্রথম সঙ্গীত বিষয়ক পত্রিকা” বলে অভিহিত করেছেন।
তমলুক শহর বা মহকুমা-কেন্দ্রিক সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশনার পুরোনো ঐতিহ্যকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে ‘প্রদীপ’ পত্রিকা (প্রথম প্রকাশ: ১৪ই এপ্রিল ১৯৪১)। এটি মূলত: সংবাদ-পত্রিকা হলেও খবর পরিবেশনে বৈচিত্র্য রয়েছে। বর্তমানে চিত্তরঞ্জন কুণ্ডুর সম্পাদনায় ‘নিজস্ব বীণা’ প্রেস থেকে এটি প্রকাশিত হয়। ১৯৪২-৪৪--এই দুই বছর চালু ছিল তমলুকের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দ্বারা পরিচালিত ‘বিপ্লবী’ পত্রিকা। সাহিত্য-বিষয়ক পত্রিকার মধ্যে অগ্রগণ্য ছিল ‘শীষ’ (সম্পা: পুলক বেরা), ‘চিত্রলেখা’ (সম্পা: বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য্য)। তমলুকের সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাহিত্য সংগঠক ও সম্পাদক ইন্দুভূষণ অধিকারী (সম্প্রতি প্রয়াত) ‘আলপনা’ এবং ‘পূর্বাদ্রি’ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন, ‘পূর্বাদ্রি’ তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্তও নিয়মিত ছিল; বুদ্ধিজীবী মহলে এটির বিশেষ কদর ছিল তখন। শ্রীঅধিকারী বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক ড: প্রদ্যোত কুমার মাইতির সহায়তায় ‘চতুরঙ্গ’ নামে একটি সাহিত্য-সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৯৫ সালে। প্রায় প্রতি মাসেই এই গোষ্ঠীর আলোচনা সভা বসত, এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তবে ‘তাম্রলিপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মিলনী’ (পূর্বে নাম ছিল 'তাম্রলিপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ') এখনও সক্রিয়। এই সম্মিলনীর বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক জ্ঞানেন্দ্রনাথ জানা, সম্পাদক অশোক কুমার পট্টনায়ক। মাঝেমধ্যেই এই সাহিত্যগোষ্ঠীর উদ্যোগে আলোচনাচক্র, সাংস্কৃতিক আড্ডা ইত্যাদির আয়োজন করা হয়।
সারস্বত-সাধনায় তমলুক এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে যাঁরা প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন বা এখনও রেখে চলেছেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য সুশীলকুমার ধাড়া, কালোবরণ পাড়ই, প্রণব বাহুবলীন্দ্র, যুধিষ্টির জানা, সত্যেন্দ্রনাথ জানা, মদনমোহন বৈতালিক, প্রদীপ্ত খাটুয়া, সুস্নাত জানা, আর্জুমান্দ লায়লা প্রমুখ। সুশীলকুমার ধাড়া তমলুকের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র, কিন্তু এই প্রাক্তন বিপ্লবী নেতা যে সুসাহিত্যিক হিসেবেও আলোচিত হবার দাবি রাখেন তা যেন আমরা ভুলে না যাই। সাহিত্যসাধক এই মানুষটি কারাগার-অন্তরালে বসেও সাহিত্যপাঠ চালিয়ে গেছেন, সেই সঙ্গে নিজের লেখালেখির চর্চাও। তাঁর আত্মজীবনী ‘প্রবাহ’ একটি সুখপাঠ্য রচনা--এতে ১৯৩০ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত মেদিনীপুরে মুক্তিসংগ্রামের কর্মকাণ্ড ধরা পড়েছে তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার আলোয়। সাহিত্যপাঠের জন্য নতুন ভাষা শিখতেও তাঁর আগ্রহ ছিল অসামান্য। ‘ওমর-খৈয়াম’ ও ‘কোরান শরিফ’ মূলভাষায় পড়বেন বলে শিখেছিলেন উর্দু ও আরবি, এক সহবন্দীর কাছে। জেলখানায় বসে ‘মালাকার’ ছদ্মনামে তিনি লিখেছেন বহু কবিতা, যা পরবর্তীকালে ‘মালা’ শিরোনামে একটি কাব্যগ্রন্থের আকারে প্রকাশ পায়। শ্রীধাড়ার অশীতিতম জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত একটি স্মারকগ্রন্থে (‘চিরতরুণ বিপ্লবী সুশীলকুমার: সঙ্কলন গ্রন্থ') ড: দিলীপকুমার মিত্র বলেছেন--
“অনেক কবিতাই লিরিক্যাল--যাদের স্বতোৎসারণ, আবেগের উচ্ছ্বল প্রবাহ, অনুভূতির নিবিড়তা সহজ রূপের বন্ধনে ধরা পড়েছে, যেমন ‘মালাকার’, ‘প্রিয়’, ‘মনে পড়া’, ‘মালা’ প্রভৃতি কবিতা। ...ঐশী চেতনায় নিবেদিত কবিচিত্তের ব্যাকুলতা রূপবদ্ধ হয়েছে ‘প্রার্থনা’, ‘গতি’ প্রভৃতি কবিতাতে।” (পৃ: ৫৮)সুশীলবাবুর প্রকৃতি ও ঐশী অনুভূতি-বিষয়ক কবিতাগুলিতে রবীন্দ্রপ্রভাব চোখে পড়ে। তবে সবচেয়ে বেশি করে তাঁর বিপ্লবী দেশপ্রেমিক সত্তা ধরা দিয়েছে ‘জনতার কল্লোল’-এর মত কবিতায়, যার মধ্যে নজরুল-সুলভ প্রচণ্ড আবেগের স্মরণ লক্ষ্য করার মত।
কবিতা ছাড়াও সুশীল কুমার ধাড়া বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন গ্রামীণ অর্থনীতি, তমলুকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ইত্যাদি বিষয়ে। পরে এগুলি ‘প্রবন্ধগুচ্ছ’ নামে পুস্তকাকারে সঙ্কলিত হয়েছে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন ২০১১ সালে, শতবর্ষে পা রেখে। সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন আরো নতুন নতুন গবেষণার আলোকে সামনে আসুক, এই আশা।
কালোবরণ পাড়ই সত্তর, আশি ও নব্বই-এর দশকে কবিখ্যাতি অর্জন করেন। তমলুকে আবাসবাড়ি তাঁর জন্মস্থান। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ১৯৭১ সালে, শিরোনাম ‘দুর্বোধ্য কবিতা’, ‘বিকেলে কবিতা নিয়ে মিছিলে’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। তারপর আরো অনেকগুলি কবিতা সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে--দুই খণ্ডে সম্পূর্ণ কবিতা-সমগ্র সহ। ‘নেশায় আছি জেগে’, ‘কালিঢল’, ‘সুপ্রভাত পৃথিবী’ ‘A Father's SMS’, ‘আমি এবং রূপনারায়ণ’, ‘বাক্য ফেস্টনী’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কবিরুল ইসলাম তাঁর কয়েকটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে হিন্দিতেও--অনুবাদক সঞ্জীব পন্থী। কালোবরণের কবিতার গুণগ্রাহী ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো স্বনামধন্য সাহিত্যিকও। তাঁর ভাষায়, “বাংলা সাহিত্যের ধারায় কালোবরণের একটি স্থান নির্দিষ্ট হয়ে গেছে।” ভাষার সহজ ভঙ্গিতে, উপমা ব্যবহারের কৌশলে, গদ্য ও পদ্যের মিশেলে গড়া নতুন আঙ্গিকের ছন্দে তাঁর কবিতা বিশিষ্টতা পেয়েছে। ‘দেশ’, ‘কৃত্তিবাস’-এর মত প্রসিদ্ধ সাহিত্যপত্রিকায় তাঁর বহু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।
তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক প্রণব বাহুবলীন্দ্র ময়নার রাজপরিবারে জন্ম নিয়েছেন। কিন্তু তমলুক-ই তাঁর কর্মক্ষেত্র। অনুবাদক হিসেবে তাঁর খ্যাতি সুবিস্তৃত। অনুবাদ করেছেন ওমর খৈয়াম, মেঘদূত, গীতগোবিন্দ (১৯৮৪)। বিদ্যাসুন্দর কাহিনী, বিশ্ব ক্লাসিক্স সম্ভার (১৯৮৬)। ‘শাক্ত পদাবলী সমীক্ষা’ (১৯৮৮) তাঁর একটি গবেষণাগ্রন্থ। এছাড়াও তাঁর লেখা কয়েকটি বহুপাঠিত বই--‘পুরোনো দিনের গল্প', ‘শিশু’ (১৯৯৯) ‘গল্পের মণিমুক্তো’ ইত্যাদি। তাম্রলিপ্ত হেরিটেজ কমিটির বিশিষ্ট পরিচালন মণ্ডলীর মধ্যে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রণী। পাঁশকুড়ার ইতিহাস রচনা কমিটিতেও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন।
যুধিষ্ঠির জানার জন্ম ও বসবাস তমলুক শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। কিন্তু তাঁর সাহিত্যকর্ম ও প্রকাশনা-সংক্রান্ত কাজ অনেকটাই তমলুককেন্দ্রিক। লিখতেন ‘মালীবুড়ো’ ছদ্মনামে। ‘বৃহত্তর তাম্রলিপ্তের ইতিহাস’ তাঁর রচনা। ‘সূর্যদেশ' পত্রিকা তাঁর সম্পাদনায় পূর্ব মেদিনীপুরের একটি বিশিষ্ট সাহিত্যপত্রিকা রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর পত্রিকাটিকে চালু রেখেছেন তাঁর পুত্র ড: সুস্নাত জানা, মেদিনীপুর কলেজের অধ্যাপক এবং প্রাবন্ধিক-সাহিত্যিক। ‘মালীবুড়ো’ শিশুদের জন্য ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ছোটদের উপযোগী অনেক বই লিখেছেন, যেমন ‘ছড়ায় আলাদীন’ (১৩৬৩ বঙ্গাব্দ), গল্প মালঞ্চ (১৩৬৫ ব: ), ‘ছোটদের লালবাহাদুর’ (১৩৭৩ ব: ), ‘গল্পে বিদ্যাসাগর’ প্রভৃতি। তাঁর লেখা উপন্যাস ‘লগ্ন’ (১৩৭৬ ব: ), ‘কচ্যা বউ’ (১৩৮৭ ব: ), 'নিমকি মালের দিনরাত' (১৪০৪ ব: ) এখনও পাঠকপ্রিয়, ‘অন্তর্গত সত্ত্বার’ তাঁর একমাত্র কবিতার বই।
‘মালীবুড়ো’র পুত্র সুস্নাত জানা মূলত: কবি, উপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষ করে বলা যেতে পারে ‘আর এক বিভঙ্গের নৈ:শব্দ’ (১৯৯৭ খ্রি: ) ‘বৃষ্টির নূপুর’ (২০০৭), ‘প্রেম কিংবা হননবৃত্তান্ত’ (২০১৩)--এগুলির কথা। আরও লিখেছেন ‘দুপুরের রোদ’ (১৯৯৩), ‘পরভিন ইলিয়াসের আত্মজীবনী’ (২০০৯), ‘অগ্নিগর্ভ’ অর্বাক(??) (২০০৪) প্রভৃতি উপন্যাস। প্রবন্ধে ও গবেষণাগ্রন্থে তাঁর অধ্যাপক-মননই বড় হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে ‘গীতাঞ্জলী: সৃজনের অন্তর্গত সত্তায়’ (২০১১), ‘আধুনিক সাহিত্যপাঠ’ (২০১২), ‘পোস্ট মডার্নিজম ও বাংলা কবিতার উত্তর-আধুনিক চেতনা’ (২০১৪) প্রভৃতি প্রবন্ধ গ্রন্থ। ‘সূর্যদেশ’ পত্রিকার পাশাপাশি আরও দুটি পত্রিকা তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে--‘চতুর্থ দুনিয়া’ (১৯৯৪-) এবং ‘শ্বাশত ছিন্নপত্র’ (২০০৪)। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিও পেয়েছেন জেলা ও রাজ্য স্তরে--‘উপত্যকা স্মারক সম্মান’, ‘রবীন্দ্র সম্মান’ (পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদ), ‘সাহিত্য প্রগতি সম্মান’ ইত্যাদি।
আর্জুমান্দ লায়লা তমলুকের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলা কবিদের মধ্যে অগ্রণী। ‘ফসলের মৌ’ তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ (১৯৯৭)। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘অন্তহীন ভালবাসা’ (২০০২) এবং ‘প্রণম্য শব্দের কাছে’ (২০০৪)। ব্যক্তিগত অনুভূতির পাশাপাশি তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছে নৈর্ব্যক্তিক আধুনিকতার স্বরও।
মদনমোহন বৈতালিক এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত পূর্ব মেদিনীপুরের সাহিত্য-আকাশে নিজের স্থান করে নিতে পারতেন। যদিও অল্পবয়সে দুরারোগ্য ব্যধির আক্রমণ তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনকে ব্যহত করেছে। কবি শ্যামল দাসের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি সম্পাদনা করতেন ‘বররুচি পত্রিকা’। ‘সারারাত শব্দের বৃষ্টিপাত’ তাঁর একটি সম্ভাবনাময় সৃষ্টিপ্রয়াস।
বর্তমান প্রজন্মের কবিদের মধ্যে গৌতম ভট্টাচার্য্য, কুন্তল দাশ, কৃতিসুন্দর পাল, প্রদীপ্ত খাটুয়া প্রমুখ সক্রিয়ভাবে নতুন নতুন সৃষ্টিসম্ভার রচনায় ব্যস্ত রয়েছেন। ভবিষ্যতেও এঁরা জেলার সাহিত্য-সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন--এমন আশা করা যেতেই পারে। এছাড়া তরুণ ছাত্রছাত্রীদের সাহিত্যপত্রিকা বিকাশের মাধ্যম হিসেবে তমলুক হ্যামিলটন হাইস্কুলের পত্রিকা ‘তমালিকা’ এবং তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয়ের ‘রুচিরা’ যথেষ্ট উচ্চমানের কাজ করে চলেছে।
নাটক, আবৃত্তি ও সঙ্গীতের চর্চায় তমলুক কোনদিনই পিছিয়ে ছিল না। আনন্দলোক নাট্যসংস্থার প্রতিষ্ঠাতা রক্তকমল দাশগুপ্ত তমলুকের নাট্যচর্চায় সমৃদ্ধি এনেছিলেন। তিনি একাধারে নাট্যকার, পরিচালক ও অভিনেতা। ‘সংলাপ’ নামে একটি পত্রিকাও তিনি সম্পাদনা করেন। এপর্যন্ত তিনি চারটি পূর্ণাঙ্গ নাটক, ১৭টি একাঙ্ক, ২৬টি শ্রুতিনাটক এবং শিশুদের জন্য ৫টি নাটক লিখেছেন, যদিও নাটকগুলি পাণ্ডুলিপি হিসেবেই রয়ে গেছে। নাট্যকার ও শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে তিনি বেশ কয়েকবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য-সংস্কৃতি দপ্তর-প্রদত্ত সম্মান, এবং রাজ্যদপ্তরের বিভিন্ন নাট্য প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করেছেন। তাঁর সুযোগ্য সন্তান অনুপম দাশগুপ্তও একজন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব। যদিও এখন তাঁর কর্মক্ষেত্র কলকাতা-কেন্দ্রিক।
সরিতকুমার জানা সঙ্গীতশিল্পী এবং সুরকার হিসেবে তমলুকবাসীর গর্ব। ১৯৭৫ থেকে তিনি আকাশবাণী কলকাতার জন্য সঙ্গীতরচনা করেছেন। সুরও দিয়েছেন পাঁচ-ছয় শতাধিক গানে। তাঁর পিতা সত্যেন্দ্রনাথ জানাও ছিলেন সাহিত্যসেবী। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে প্রায়ই তাঁর স্বরচিত কবিতাপাঠ শোনা যেত। এছাড়াও বাচিক শিল্পী হিসেবে দেবব্রত দত্ত প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন। দূরদর্শন, বেতার ও মঞ্চানুষ্ঠানে তিনি এক জনপ্রিয় আবৃত্তিকার। HMV সহ কলকাতার বেশ কয়েকটি বিখ্যাত ক্যাসেট কোম্পানি তাঁর আবৃত্তির ক্যাসেট প্রকাশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলা আকাদেমি, বাংলাদেশের ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর আমন্ত্রণে তিনি আবৃত্তি পরিবেশন করে এসেছেন। পেয়েছেন বহু সম্মান ও পুরস্কার -- কাজী সব্যসাচী স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৮), 'জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার' (২০০৬), ‘কবি নিত্যানন্দ পুরস্কার' (২০১২)। দেবব্রত দত্ত কবি হিসেবেও খ্যাতনামা। তাঁর কয়েকটি ছড়া ও কবিতার বই--‘ছড়ার মজা মজার ছড়া’ (১৯৯৬), 'অদলবাবু বদলবাবু' (২০০২), 'এস্রাজ বাজছে একা একা' (২০০১), ‘আর একটু অপেক্ষা করো’ (২০০৭), ‘পাতার আড়াল থেকে’ (২০১৩) প্রভৃতি।
সুচরিতা দাস, দেবপ্রিয়া ভট্টাচার্য প্রমুখ বাচিকশিল্পীও আবৃত্তির জগতে সুনাম অর্জন করেছেন। সুচরিতা দাসের পরিচালনায় ‘চরৈবতি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ আবৃত্তিচর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সঞ্চিতা দাশের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে ‘উৎস’-- যেখানে প্রশিক্ষক হিসেবে ব্রততী বন্দোপাধ্যায় আমন্ত্রিত হয়ে আসেন প্রায়ই।
১৯৯০-তে অনিল পট্টনায়ক এবং সনাতন দাসের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘অবন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’, ঐ বছরই ডা: উত্তম পট্টনায়কের উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করে ‘বহুব্রীহি নাট্য সংস্থা’। এইসব সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রযোজনার মাধ্যমে সংস্কৃতির বহমানতা বজায় রেখেছেন।
সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা এবং পত্রপত্রিকা প্রকাশে তমলুক মহকুমা অখণ্ড মেদিনীপুরের ইতিহাসে নি:সন্দেহে অগ্রণী। জেলা ভাগের পরও তমলুকের সাহিত্যিক-সম্পাদক-প্রকাশকরা সেই ধারাকে ব্যাহত হতে দেননি। তবে পিছিয়ে ছিল না কাঁথি মহকুমাও। ১৯০১ সালে কাঁথি থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘নীহার’--সংবাদ সাপ্তাহিক, মধুসূদন জানার সম্পাদনায়। এখন পত্রিকাটি বিলুপ্ত। বর্তমানে কাঁথি থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির মধ্যে পঞ্চানন জানা-সম্পাদিত ‘কালের নাগরিক’, সুদর্শন পাণ্ডার সম্পাদনায় ‘অঙ্কুশ’, পবনকৃষ্ণ বেরার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘দেশপ্রাণ’ প্রভৃতি উল্লেখের দাবি রাখে। এছাড়াও রয়েছে প্রণব মাইতি-সম্পাদিত ‘সাহিত্য সম্প্রতি’, ননীগোপাল বেরার ‘অমৃতরেখা’, সোফিয়র রহমানের সম্পাদনায় ‘পঞ্চমা’, অমিতাভ ত্রিপাঠীর ষান্মাসিক পত্রিকা ‘অভীক’, রামনগর থেকে প্রকাশিত মাধব দিন্দার মাসিক পত্রিকা ‘উষসী’ প্রভৃতি সাহিত্য-বিষয়ক পত্রিকা। এগুলি এখন প্রায় অনিয়মিত হয়ে গেছে, তবু কাঁথির সাহিত্যসাধনায় এদের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য ত্রৈমাসিক ‘দীঘলপত্র’ এখনও প্রকাশ পেয়ে চলেছে সুদর্শন খাটুয়ার সম্পাদনায়। সুদর্শন খাটুয়া নিজেও সুসাহিত্যিক। কাঁথির বাসিন্দা তৃণাঞ্জন দত্ত পেশায় ব্যাঙ্ককর্মী। কিন্তু মনেপ্রাণে সাহিত্যের অনুরাগী। নিজেও সাহিত্যচর্চা করেন। কাঁথির উদীয়মান সাহিত্যকদের মধ্যে কানাই বেরা, দেবাশিস মাঝি ও সোমনাথ প্রধানের নাম করা যেতে পারে। সম্প্রতি ‘দেশ’ পত্রিকায় সোমনাথবাবুর দুটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এ অঞ্চলের প্রবীণ কবি দেবাশিস প্রধান সত্তরের দশক থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা লিখে চলেছেন। বহু কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা এই কবির ধ্যানজ্ঞান হল ‘কবিতার কাগজ’-এর শ্রীবৃদ্ধি-সাধন। দীর্ঘদিন ধরে এই পত্রিকা সাহিত্য প্রকাশনার উন্নত মান বজায় রেখেছে।
পূর্ব মেদিনীপুরের অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রকাশিত বেশ কিছু সাহিত্যপত্রিকা কোন না কোন সময় জেলার সারস্বত সাধনাকে সমৃদ্ধ করেছিল। ১৯৪৮-এ কল্যাণচক থেকে প্রকাশিত হয় সংবাদ ও সাহিত্যের পত্রিকা ‘পল্লীজীবন’ নলিনীরঞ্জন হোতার সম্পাদনায়; পাঁশকুড়া অঞ্চলের প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ছিল ‘প্রলাপ’ (১৯৫৩)--সম্পাদক হরেকৃষ্ণ পট্টনায়ক। সংবাদ ছাড়াও সাহিত্য, সমাজ বিষয়ক বিভিন্ন লেখা এই পত্রিকায় প্রকাশিত হত। নব্বই-এর দশকের পত্রিকাগুলির মধ্যে পাঁশকুড়া থেকে প্রকাশিত ‘মেদিনীকন্ঠ’, ময়না থেকে প্রকাশিত দ্বিমাসিক ‘তকমিনা’ (সম্পা: নরেশচন্দ্র দাস), মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘বঙ্গোপসাগর’, সুনীল জানার ‘সূর্যনেশা’, মহিষাদল থেকে হরপ্রসাদ সাহুর সম্পাদনায় প্রকাশিত ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র ‘সুরঞ্জনা’, অস্মিতা রায়ের সম্পাদনায় ‘শ্যামাশ্রিতা’ প্রভৃতি মাঝে মধ্যে অনিয়মিত হয়ে পড়লেও, এইসব পত্রিকায় প্রকাশিত উচ্চমানের লেখা একসময় পাঠকমহলে যথেষ্ট সমাদর পেয়েছিল। কোলাঘাট থেকে প্রকাশিত ‘জনমানস’ (সম্পা: ফণিভূষণ চক্রবর্তী), ‘অহল্যা’ (সম্পা: শ্রীহরি মাইতি) হলদিয়া থেকে প্রকাশিত ‘আপনজন’ (সম্পা: তমালিকা পণ্ডাশেঠ, এখন প্রয়াত), ‘কবিতাযুগ’ (সম্পা: তুষারকান্তি দাস), ‘হঠাৎ’ (সম্পা: উষা ভৌমিক)--প্রভৃতি পত্রিকা আধুনিকতা, অভিনবত্ব ও বৈচিত্র্যের বিচারে বিশিষ্টতার স্বাক্ষর রেখেছে।
‘পথ’ পত্রিকার সম্পাদক সৌরভকুমার ভূঞ্যাঁ জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন চলার পর নানা বাধা-বিপত্তির কারণে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে গত চার বছর ধরে তিনি ‘মেঘপালক’ নামে তার একটি ত্রৈমাসিক পত্র সম্পাদনা করছেন। মূলত: আঞ্চলিক সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে তুলে ধরা এই পত্রিকার লক্ষ্য। পত্রিকাটি বেরোয় মহিষাদলের তেরপেখিয়া থেকে ১৯৮০ থেকে এগরার সাহিত্যসেবী শান্তিপদ নন্দ প্রকাশ করছেন ‘এষণা’--পত্রিকাটির ২৫টি সংখ্যা এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত। মোটামুটি নিয়মিতভাবে বেরোয়। সুতাহাটা থেকে শিশিরকুমার বাগ প্রকাশ করেন ‘অর্ঘ্য’ পত্রিকা। নন্দীগ্রামের রাজকুমার আচার্য সমাদনা করেন ‘স্রোত’ পত্রিকা--মান যথেষ্ট উঁচুদরের। বিশ্বজিৎ মাইতি নন্দীগ্রামের আর এক বিশিষ্ট লেখক সম্প্রতি তাঁর লেখা ‘বারো হাত কাঁকুড়ের দেশে’ উচ্চপ্রশংসিত হয়েছে। কোলাঘাট থেকে বৈরাগ্য চক্রবর্তী প্রকাশ করেন ‘পূর্বাচল’ ও ‘প্রতিপক্ষ’ নামে দুটি পত্রিকা। ‘লোককৃতি’ পত্রিকাটি বেরোয় মহিষাদল থেকে। শ্রী সাহু ‘মহিষাদলের ইতিবৃত্ত’ নামে একটি স্থানীয় ইতিহাসও রচনা করেছেন।
লিট্ল ম্যাগাজিন এক উর্বর শস্যক্ষেতের মত, উঠতি লেখকদের বহুমাত্রিক প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে দেবার, এবং ভবিষ্যতে তাঁদের সাহিত্যযাপনের পথ সুগম করে দেওয়ার কাজ এই ছোট পত্রিকাগুলি করে যায় নি:শব্দে। একথা শুধু জেলার লিট্ল ম্যাগাজিন নয়, রাজধানী কেন্দ্রিক লিট্ল ম্যাগাজিনগুলোর ক্ষেত্রেও কমবেশি একইরকম সত্যি। তবে এখানে আমরা পূর্ব মেদিনীপুরের সাহিত্যচর্চা নিয়ে আলোচনা করছি। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র কয়েকজন সাহিত্যিক আর কিছু লিট্ল ম্যাগাজিনের তালিকা তুলে ধরলেই আলোচকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কি ধরনের লেখা এঁরা পাঠকের কাছে পরিবেশন করেন, কতখানি তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও সমকালীন আবেদন, তার একটা সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা অন্তত: করাই যায়।
কবি-সম্পাদক তপনকুমার মাইতি (হলদিয়া টাউনশিপ) তাঁর কবিতা-অন্বেষী পত্রিকা ‘প্রমিতাক্ষর’-এর ‘সম্পাদকীয়’-তে উদ্ধৃত করেছেন গটফ্রিড বেন-এর মন্তব্য--“শ্রেষ্ঠ কবির কাছে সবশুদ্ধ পাঁচটি কবিতা আশা করতে পারি”। এই ‘পাঁচটি কবিতা’ যেন সাহিত্যজনতার জন্য নিবেদিত পাঞ্চজন্য। তাই বুঝে নিতে কষ্ট হয় না এই পত্রিকার ভাবগত চরিত্রটিকে। কবিতার নতুন পথরেখা কখনো বা সৃষ্টি-দেওয়ালের ফাঁকফোকর দিয়ে। এই ফাঁক থেকেই নতুন রাস্তার খোঁজ ‘প্রমিতাক্ষর’-এর অন্যতম উদ্দেশ্য।
‘পূর্বাচল’ (তমলুক, নিমতৌড়ি) পত্রিকার মূল সুর প্রতিবাদী। সাহিত্যে বেনোজলের অনুপ্রবেশ রুখতে এই পত্রিকাগোষ্ঠী বদ্ধপরিকর, সেই সঙ্গে সোচ্চার হয়েছে তাঁদের সমাজ ও শ্রেণিচেতনা--“অধিপতি শ্রেণি তার মতাদর্শ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি-চিন্তা মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়, নিজের আধিপত্য মগজ ধোলাই-এর মধ্যে বজায় রাখার জন্যে।” এই প্রবণতার বিরুদ্ধে পূর্বাচল গোষ্ঠী তুলে ধরতে চায় সাধারণ জীবনের গল্প-কবিতা-অনুভব এবং মাটির কাছাকাছি থাকা লোকসংস্কৃতির ধারা। যথার্থ সাহিত্যজীবী ও অকারণ কলরবকারী ভেকের দলের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে।
তাই এ পত্রিকায় এক কবি বলে ওঠেন--
“এবার নতুন এক খোঁজপূর্ব মেদিনীপুরের প্রবীণ অথচ চিরতরুণ কবি মধূসুদন ঘাটীর ‘দেশকাল সাহিত্য’ প্রায় ত্রিশ বছর গুণমান বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে। সাহিত্যের মাধ্যমে এক আশ্চর্য অনুভূতির দেশ নির্মাণ করতে চেয়ে কবি সম্পাদক বলেছেন--
সাহিত্যের মহাভোজখানায়
খানাখন্দে লুকিয়ে থাকা ভেকেরা বাইরে এসে তাকায়”।
“এর বেশি চাইবে কি, পূর্ব, সেই অনুভূতির দেশমেচেদা থেকে রবীন্দ্র সিংহরায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘ঋতুপাঠ’ একটি অভিনন্দনযোগ্য কাজ করে চলেছে আঞ্চলিক ভাষার কবিতা, বাংলাদেশের কবিতা এবং নতুন ধরনের ভাবনাচিন্তাকে পাতায় পাতায় সাজিয়ে। এ পত্রিকায় এক সাঁওতালি ভাষার কবি লিখেছেন ঘোলা জলে রঙ বদলানোর কথা- যা এক সমকালীন সত্যের সন্ধান দেয়--
শান্তময় অপেক্ষার একখানি রজনী বিশেষ।”
“উলে: তেতাং নিয়ে বডে দা:কবি আশোককুমার বাগের সম্পাদনায় মেচেদা থেকে প্রকাশিত ‘ভাষামৃগ’ পত্রিকা একেবারে প্রথম সংখ্যা থেকেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। চৈতন্যপুর থেকে প্রকাশিত ‘ল্যাকেটু’ পত্রিকা প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প ও গ্রন্থ-আলোচনার এক উজ্জ্বল আয়না। লেখক ও পাঠকের সম্পর্কে একটা আলাদা মাত্রা যোগ করেছে জহরলাল বেরা-সম্পাদিত এই পত্রিকা।
বাননে কত দবাং
নিনে: দা:, দা: হং রঙ এ বদলে আ!”(অনুবাদ: এতই পিপাসা ঘোলা এই জলে/ সবকিছুই কী স্রোতে/ এত জল, রঙ বদলায় জলও।)
কবি দেবাশিস প্রধানের ‘কবিতার কাগজ’-এর কথা আগেই বলা হয়েছে। শ্রীপ্রধান নিজেও যেমন বয়সকে হারিয়ে নতুন নতুন গ্রন্থ রচনায় অক্লান্ত (তাঁর সাম্প্রতিক কয়েকটি কবিতার বই--‘প্রেমগান শুদ্ধ বিচরণ’- ২০১৬, ‘বৃষ্টির ভাষা’- ২০১৭), তেমনই পুরস্কার ও সম্মানপ্রদানের মাধ্যমে অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের উৎসাহ দেবার কাজটিও তিনি করে চলেছেন প্রতিবছর। তাঁর অনুপ্রেরণায় বহু নবীন লেখক সমৃদ্ধ হয়েছেন।
পূর্ব মেদিনীপুরের সাহিত্য-আলোচনা প্রসঙ্গে কয়েকজন বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক-সম্পাদকের কথা একটু বিশদে বলা প্রয়োজন। এই জেলারই এক প্রত্যন্ত অঞ্চল-রুক্মিণীপুরের (এগরা থানার অন্তর্গত) ভূমিপুত্র অনিল ঘড়াই একালের বাংলা সাহিত্যে একটি উজ্জ্বল নাম। পরবর্তীকালে কর্মসূত্রে নদীয়া জেলার বাসিন্দা হয়ে পড়লেও তাঁর সাহিত্যমননের শিকড় ছিল পূর্বমেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। তাঁর লেখায় ধরা পড়েছে জেলার প্রান্তিক, অন্ত্যজ, দরিদ্র মানুষদের জীবনসংগ্রাম, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের নানা জলছবি। পূর্ব মেদিনীপুরের লোকজীবনের সংস্কৃতি, লোকাচার, আঞ্চলিক ভাষা-সবই তাঁর গল্প-উপন্যাসের শরীর-নির্মাণে অঙ্গীভূত হয়েছে। অনিল ঘড়াই-এর প্রথম উপন্যাসে ‘নুনবাড়ি’--এতে পূর্ব মেদিনীপুরের নোনাখাল, গঞ্জের হাট-সংলগ্ন এলাকার নুনমারা সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকার যুদ্ধ ফুটে উঠেছে দরদী কলমের আঁচড়ে। তাঁর ‘নীল দু:খের ছবি' (২০০১) উপন্যাসের পটভূমি হল এগরা-২ থানার বালিঘাই ও মাঠপুকুর গ্রাম। অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে কেলেঘাই নদী, তাজপুর বস্তি, ভবানীচক প্রভৃতি অঞ্চলের কথা-ও। 'সামনে সাগর’ (২০০৩) উপন্যাসটি সম্বন্ধে লেখক নিজেই বলেছেন--
“দীঘাকে নিয়ে উপন্যাস লেখার ইচ্ছে আমার বহুদিনের। সেই ইচ্ছের কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে, এটা ভেবে স্বস্তি পাই। শ্রমজীবি ভূমিহীন সহায় সম্বলহীন কিছু মানুষ দীঘার সমুদ্রকে অবলম্বন করে আজও বেঁচে আছে। তারাই এই উপন্যাসের কুশীলব”। (উদ্ধৃতি: অরূপ পলমল, ‘সৃজন’ অনিল ঘড়াই বিশেষ সংখ্যা, পৃ: ১১৬)এই উপন্যাসে বাংলা সাহিত্যের ভৌগোলিক পরিধিকে বিস্তৃত করার কাজটি সম্পন্ন করেছেন সচেতনভাবে। তার সঙ্গে মিশে গেছে তাঁর সহজাত মানবিকতার বোধ, সমাজের পিছিয়ে থাকা জনসমষ্টির প্রতি অকৃত্রিম সমবেদনা। জেলার সাহিত্যজীবীদের একই মঞ্চে নিয়ে এসে সঙ্কলন গ্রন্থ প্রকাশের দিকেও তাঁর উৎসাহ ছিল প্রশংসনীয়। সম্পাদনা করেছেন ‘মেদিনীপুর জেলার গল্প সঙ্কলন’ (২০০২)। 'দগ্ধদিনের কৃষ্ণচূড়া’ (দুই মেদিনীপুরের বিশিষ্ট কবিদের কবিতা-সঙ্কলন) প্রভৃতি গ্রন্থ। পত্রিকা সম্পাদনার জগতে তিনি পা রাখেন ১৯৭৯ সালে, ‘কোয়েল’ পত্রিকা-প্রকাশনার মাধ্যমে। তারপরেও সম্পাদনা করেছেন ‘শব্দযুগ’ (১৯৮৪) ‘তূর্য’ (২০০৯)-এর মত পত্রিকা--সক্রিয় থেকেছেন অসুস্থ শরীরেও। ২০১৪-র ২৩শে নভেম্বর মাত্র ৫৭ বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণ একালের বাংলা সাহিত্যজগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি।
একালের আর প্রসিদ্ধ কবি বিপ্লব মাজীর জন্ম পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক শহরে; যদিও বর্তমানে তিনি মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা। ১৯৬৭-সালে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়- সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম কবিতা। তারপর প্রায় পাঁচ দশক ধরে তাঁর লেখনী সৃষ্টিকাজে অক্লান্ত রয়েছে। এ-পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে প্রায় শতাধিক কাব্যগ্রন্থ, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে-- ‘Early Poems’, ‘Love Poems and Others’, ‘Global Village’, ‘Buddha’ প্রভৃতি। বিপ্লব মাজী বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের কবিসম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন, তার মধ্যে ২০১২-তে ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত প্রথম এশিয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কবিতা উৎসব এবং তিব্বতের কিংহাই লেক রাউন্ড টেবিল বৈঠকের কথা না বললে কবির আন্তর্জাতিক পরিচয় অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ১৯৮১ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত তাঁর সম্পাদনায় ‘সময়সারণি’ নামে একটি সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা বের হত--পত্রিকাটি গুণীমহলে বেশ সমাদর পেয়েছিল। এখন সম্পাদনার সঙ্গে সেভাবে যুক্ত না থাকলেও তিনি ‘দৈনিক উপত্যকা’ পত্রিকায় কলাম লেখেন। কলকাতার কয়েকটি বিখ্যাত প্রকাশনাসংস্থার উপদেষ্টা তিনি, এছাড়াও বিশ্ববাংলা কবিতা উৎসবে সভাপতিত্ব করেছেন। মেদিনীপুর কবিতা উৎসবের স্থায়ী সভাপতি হিসেবে তিনি আজও সক্রিয়। কবিতার পাশাপাশি সাম্প্রতিক বৌদ্ধিক চর্চার নতুন দিকগুলি সম্পর্কেও তিনি আগ্রহী। বিশ্বায়ন, উত্তর-আধুনিকতা (Post-modernism), পরিবেশ নারীবাদ (Eco-feminism) নিয়ে তাঁর বেশ কিছু গবেষণামূলক লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
পূর্ব মেদিনীপুরের সাহিত্যসমাজে আরো কয়েকটি বিশিষ্ট নাম হল মধুসূদন ঘাটী, চিত্তরঞ্জন রণসিংহ, রণজিৎ কুমার নায়েক, নিতাই জানা প্রমুখ। এঁরা সকলেই শিক্ষকতা বা অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। কেউ বা অবসরপ্রাপ্ত, তার পাশাপাশি কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক হিসেবেও তাঁদের অবদান স্মরণে রাখার মত। জেলার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বা গবেষণাগ্রন্থে এঁদের লেখা অনেকক্ষেত্রেই উৎকর্ষের মাপকাঠি হিসাবে ধরা হত। এখনও হয়। তবে এই প্রজ্জন্মের কবি ও গল্পকারদের মধ্যে অনেকেই জেলার পত্রিকায় লিখতে উৎসাহ পান না, কলকাতার পত্র-পত্রিকায় বা আন্তর্জাল মাধ্যমে লিখে পরিচিতি পেতেই তাঁদের আগ্রহ বেশি। তা হলেও জেলার মাটির টানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করার কথা হয়তো কেউই ভাবেন না।
(পরবাস-৬৬, মার্চ ২০১৭)
ম্যাপ এখান থেকে নেয়া হয়েছে