Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines








পরবাসে শান্তনু চক্রবর্তীর লেখা



ISSN 1563-8685




পুস্তক-সমালোচনা - অষ্ট চরণ ষোল হাঁটু


অষ্ট চরণ ষোল হাঁটু স্বপ্নময় চক্রবর্তী; প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৮; অনুষ্টুপ - কলকাতা; পৃষ্ঠাঃ ??

টটা পায়ে ষোলটা হাঁটু হয় কি করে? হবার তো কথা আটটার! স্বপ্নময়ের এই গল্প-সঙ্কলনটি পড়তে গিয়ে প্রথম ধাক্কাটা লাগে সেখানেই। সঙ্কলনটির প্রথম প্রকাশ ১৯৮৮ সালে। অনুষ্টুপের এই সংস্করণটিও নেই-নেই করে প্রায় তিনবছরের পুরোন। তাহলে এই কাসুন্দি ঘাঁটা কেন? উদ্দেশ্য একটাই: পরবাসের যে পাঠক-পাঠিকারা এই সম্ভারের সন্ধান পাননি এখনও পর্যন্ত, তাদের কাছে এই খোঁজ পৌঁছে দেওয়া। আর জন্মের প্রায় তিনদশক পরেও যে কাহিনীগুলোর প্রাসঙ্গিকতা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি, তারই এক প্রামাণ্য দলিল তৈরি করা।

স্বপ্নময় চক্রবর্তীর সাহিত্যপথের যাত্রা সার্থকতার দীপালোকে উজ্জ্বল। ‘হলদে গোলাপ’ তাঁকে ২০১৫ সালের পয়লা বৈশাখ “আনন্দিত” করেছে; তার সঙ্গে তাঁর অনুরাগী পাঠকদেরও। সমাজের বহু-দৃষ্ট কিন্তু মোটামুটি অচর্চিত বিষয়কে ভিত্তি করে রচিত তাঁর ঐ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল পথ-নির্দেশক। সেই আলো সরিয়ে রেখে এই সঙ্কলনের গল্পগুলিকে নিয়ে নাড়াচাড়া করলে যে কটি অবিসংবাদিত সত্য উঠে আসে, তাদের ‘বুলেট-বিদ্ধ’ করলে মনে হয় এরকম দাঁড়ায়ঃ

সমসাময়িক সমাজ সম্পর্কে স্বপ্নময় সম্যক্‌ সমৃদ্ধ (অনুপ্রাস-অনিচ্ছাকৃত!)।
অধিকাংশ আখ্যানেই বৈষম্য বা Contrast-এর ব্যবহার তাদের বিশিষ্ট করেছে।
ক্যানভাসে চড়া-পর্দার রঙ ব্যবহার হলেও তাদের ফাঁক-ফোকর দিয়ে সূক্ষ্ম আলোছায়ার খেলাও প্রায়শ:ই চোখে পড়ে’।
ভাষার স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীলতা যদি লেখকের এক অনন্য পরিচয় হয়, তবে তার সঙ্গে আঞ্চলিক বাগ্‌ধারার সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভার আর একটি কৌণিক সৌন্দর্য; যা গল্পের বুনটকে বিশ্বাসযোগ্যতার পাড়-এ নিখুঁত করে তোলে।
গল্পে যাবার আগে নামকরণের রহস্য-সন্ধানে ব্রতী হলে বুঝি মাকড়শার আটটি পায়ে ষোলটি পর্ব-মধ্য বা হাঁটু থাকে। কিন্তু জমিদারবংশে মহানন্দের তরবারি নিয়ে “ব্লাডশেডিং সিরেমণি”র যে মর্মান্তিক উপাখ্যান (প্রথম গল্প), তার সঙ্গে গল্পটির তথা গ্রন্থটির নামকরণের তাৎপর্য আমার যথাযথ হৃদয়ঙ্গম হল না। এমনকি হতে পারে যে রূপকটি একসঙ্গে ধরতে চেয়েছে কুসংস্কারের জালে আবদ্ধ সমাজ একদিকে মুনিষের বুকের রক্তদানকে মহিমান্বিত করে চলেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, আর অন্যদিকে পণ্ডিত-গবেষক-অধ্যাপক অনাথ পবনকে নিজের লোভের ও লাভের হাঁড়িকাঠে বলিদান দিয়েও নির্বিকার? তার সঙ্গে মনীষাও, যে কিছুটা চেষ্টা করেছিল এই নিগড় ভেঙ্গে ছেলেটিকে শিক্ষা-পুষ্টি-শহরের আলো দেখাবার, সে ও তো আবদ্ধ অন্য এক স্বার্থের তন্তুজালে! এই ঊর্ণনাভের মৃত্যুগন্ধী ফাঁদ কাটে, কার সাধ্য?

গ্রন্থটিতে দু-পৃষ্ঠার একটি প্রাসঙ্গিকী (বা preamble?) আছে শুরুতেই। সম্ভবত: প্রকাশকের টেবিল থেকে। কিন্তু মোটামুটি পাঁচ-অনুচ্ছেদের ভূমিকার দুটি নিবেদিত প্রচ্ছদশিল্পীর উদ্দেশ্যে, যিনি আপন কৃতিত্বেই শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র জগতে সমুজ্জ্বল; আলাদা করে তাঁর খ্যাতি-খ্যাপন আমার কাছে খাপছাড়া মনে না হলেও বাহুল্য মনে হয়েছে। এই প্রচ্ছদের পরিপ্রেক্ষিত পূর্ণেন্দু পত্রীকে প্রকীর্তিত হতে হবে কেন? অলমিতি বিস্তারেণ।।

গল্প আছে মোট তেরোটি:

নামের তালিকা দিয়ে ভারাক্রান্ত করা অর্থহীন। বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য বরং উল্লেখযোগ্য: জ্যোতিষী, অঙ্গ-বিক্রয়, প্রোমোটারি, রক্ত নিয়ে ব্যবসা, দুর্নীতি, শিশু-শ্রম, জাতিবৈচিত্র্য, বেকারি — এই সবই আমাদের কম বেশি পরিচিত। কিন্তু আপাত-সম্পর্কবিহীন sub-themes যে কি অবলীলাক্রমে মিশে যায় তাঁর লেখনীতে, তার আভাসমাত্র দেওয়া যায় এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে; পাঁচ-ছয়টির উদাহরণে তুলে আনা যাক:

শনিপুজোর সিন্নি আর নিউক্লিয়ার রেডিয়েশন
ধর্মান্ধতা আর শিশু শ্রম?
মাতৃভক্ত বিদ্যাসাগর ও চরিত্রহীন সরকারি অফিসার
বহুতল সভ্যতা ও গণ আন্দোলন
রিক্‌শাওয়ালার দুনিয়া আর গণকঠাকুরের জগৎ
স্বপ্নময় কি এই গল্পগুলিতে সমাজ-সংস্কারের বার্তা দিয়েছেন বা দিতে চেয়েছেন? সুনিশ্চিতভাবে না! কিন্তু হিতচেতনায় উদ্বুদ্ধ যে কোনও উচ্চকোটির সাহিত্যকের মত জ্ঞানাঞ্জন-শলাকা দিয়ে বিদ্ধ করতে চেয়েছেন আমাদের মনের চোখ। সে শলাকা প্রথমে অস্বস্তির সৃষ্টি করে, বেদনা দেয় এবং পরে, ভাবায়।

তেরোটি আখ্যানের মধ্যে শেষ গল্পটি (‘শনি’) আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছে। পিতৃত্বের তৃষ্ণায় আকুল উৎকন্ঠিত তাজুদ্দিন যেমন ধর্মীয় আচার সংস্কারের বেড়া ডিঙিয়ে শনিপুজোয় যোগদান করে, হিন্দু জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হয়, তেমন উদ্বেগেই অশান্ত হয়ে ওঠে আণবিক বিকিরণে দুষ্ট গুঁড়ো-দুধের কথা ভেবে। বিজ্ঞান-অবিজ্ঞান, শয়তান-শনিঠাকুর-শকুন, সংস্কার-কুসংস্কার — এই সব ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে তার আর্তি “সমস্ত চেন্নোবিল, সমস্ত শনি সাতঙা-দেওদের কেরদানিকে নাথি মারতি মারতি, নাথি মারতি আয়রে আমার আহ্লাদ। তুই কেমন জানিনা”।। হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় শীর্ষেন্দুর কালজয়ী উপন্যাস ‘পারাপার’-এর শেষ স্তবকটি, যেখানে অনাগত সন্তানের কথা ভেবে তুলসীর, অথবা লেখকেরই অভিব্যক্তি: “এ পৃথিবীতে মানুষের জন্ম কত পুরনো হয়ে গেল, তবু এখনও তা কী রোমাঞ্চকর”!

ঠিক এমনই ভাবে ‘পূর্বজন্মের ভাই’ কাহিনীটির শেষ দৃশ্যে যখন কর্তামশাই (জ্যোতিষ/গণক) আকুল হয়ে ভেঙে পড়েন তাঁর রিক্‌সাওয়ালা নকুলের কাছে, তখন মনে পড়ে আরেক অমর কথাশিল্পী সুবোধ ঘোষের সেই গল্পের কথা, যেখানে এক অনৈতিক সন্তান প্রসবের এক নির্জন সাক্ষীর মন্তব্য “শালা বুড়ো এখন নাতির মুখ দেখছে”......!

উপমান, উপমেয় আর সাধারণধর্ম দিয়ে বিশ্লেষ্য অলঙ্কারের জটিলতায় না ঢুকেও নির্বাধে উপভোগ করা যায় স্বপ্নময়ের ব্যবহৃত অলঙ্কারগুলি।

ক) গামছা ঝোলে — সংসারটা ঝোলে
খ) জবার বিনুনিতে রক্ত-বেচা সিলিকের ফুল
গ) গরদপরা এয়োরমণীর মতো রোদ
ঘ) প্রাণটা শামুকমাংসের মতো ছোটো হয়ে যায়
ঙ) অম্বলের টকবমির মতো চাঁদের আলো
চ)অবিনাশের মরা বউ-এর লুটানো আঁচলের মতো বিষণ্ণতা
প্রত্যাশিতভাবেই সব গল্প সমানভাবে ধাক্কা দেয় না, মনে ধরে না। ‘মেরুদণ্ড’, যা মূলত: একটি অভাবী চাকরীসন্ধানী হতাশ যুবকের কাহিনী, বা ‘জাতীয় সংহতি’, যা একটি কবি-পর্যটকের বেড়ানোর বিচিত্র কোলাজ — আমার মতে তেমন দানা বাঁধেনি, যেমন বেঁধেছে অধিকাংশ অন্য গল্পগুলি — ‘শনি’ ছাড়াও ‘স্পেয়ার পার্টস’ বা ‘অষ্টচরণ ষোল হাঁটু’ বা ‘আরওয়ালের হাত’ বা ‘রক্ত’। Contrast তাঁর উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য হলেও মধ্যে মধ্যে যে সূক্ষ্ম আলোছায়ার কথা আগে উল্লেখ করেছি, তার ছোঁয়া গল্পগুলিকে আরও আকর্ষণীয় করেছে সন্দেহ নেই।

‘বিদ্যাসাগর! বিদ্যাসাগরে'র শেষ অংশে একটি হাতে বোনা উলের সোয়েটার, ‘দুলালচাঁদ’ গল্পে মায়ের মৃত্যুর পরে মিষ্টির দোকানে তার ফিরে যাওয়া, ‘কাননেকুসুমকলি’তে শিশুশ্রমের রক্তাক্ত ছবির পরে একটা আইসক্রিমের লোভ, ‘রক্ত’ গল্পে মাছের মুড়ো দিয়ে মানকচু খাবার বাসনা — এই ছোটো ছোটো কোমল পর্দার স্পর্শ পাঠকদের স্বপ্নময়ের গানের আরো নিকট সান্নিধ্যে নিয়ে যায়। তাঁকে চিনতে সাহায্য করে। তাঁর লেখনীর দীর্ঘায়ু কামনা করে। আমাদের প্রতীক্ষাকে দীর্ঘতর করে, সুন্দর করে।



(পরবাস-৬৭, জুন ২০১৭)