Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines






পরবাসে
শ্রেয়সী চক্রবর্তীর

লেখা


ISSN 1563-8685




ফিরে পড়া বইঃ গিরীন্দ্রশেখর বসুর “স্বপ্ন”


স্বপ্ন;--গিরীন্দ্রশেখর বসু; প্রথম প্রকাশ: ১৯২৮; লেখায় ব্যবহৃত সংস্করণঃ দ্বিতীয় সংস্করণ, পঞ্চম মুদ্রণ ২০০৬; বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা

চোখ বুজে যা দেখি তা স্বপ্ন; আর চোখ খুলে সমস্ত পৃথিবী উনিশ শতকের দোরগোড়ায় যে বই পড়ে আলোড়িত হল তার নাম “ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস্‌” (১৮৯৯; পরবর্তীতে “অন ড্রিমস্‌”, ১৯০১) লেখক- সিগমুণ্ড ফ্রয়েড। এই অস্ট্রিয়ান মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে স্বপ্নরাজ্যে সফর বিষয়ক পত্রালাপ ঘটেছিল ভারতবর্ষীয় বাঙালি মনোবিজ্ঞানী এবং চিকিৎসক গিরীন্দ্রশেখর বসুর (১৮৮৭-১৯৫৩)। মনঃসমীক্ষণের জগতে ভারতবর্ষে গিরীন্দ্রশেখর নির্দ্বিধ পথপ্রদর্শক। তাঁর হাতেই গড়ে উঠবে ইন্ডিয়ান সাইকো অ্যানালিটিক সোসাইটি, ১৯৪৭-এ। আর তার অন্তত দু দশক আগে গিরিন্দ্রশেখর প্রকাশ করেছেন ফ্রয়েডের স্বপ্নবিশ্লেষক বইটির একটি ভারতীয় ডিসকোর্স, “স্বপ্ন”- ১৯২৮ সালে। এই বই প্রকাশের বহু আগে থেকেই তিনি সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের সঙ্গে চিঠিপত্র আদান প্রদান শুরু করেন; শুরু হয় মতবিনিময় এবং কিছুক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ। গিরীন্দ্রশেখরের চিঠি নিয়ে তাঁর কন্যা দুর্গাবতী ঘোষ য়ুরোপ যাত্রা করেছিলেন এবং ডক্টর ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তার বিবরণ পাই বাঙালি মেয়েদের প্রথম দিকে লেখা ভ্রমণ কথার মধ্যে দুর্গাবতীর লেখা “পশ্চিমযাত্রিকী” (১৯৩৬) বইয়ে।

“স্বপ্ন” বইটি খুব সরাসরি ঢুকে পড়ে মানুষের স্বপ্ন এবং ফ্রয়েডীয় ভাবনার জগতে। দুইয়ের মধ্যে আদান-প্রদানের পথগুলিকে চিহ্নিত করে দৃশ্যমান করে তোলে ঔপনিবেশিক ভারতীয় তথা বাঙালি পাঠকের কাছে। যদিও সাধারণ পাঠকের পক্ষে তা যে খুব প্রচল পথ একথা ভাবার কারণ নেই। দেরিদা, ফুকো কিম্বা লাঁকার মনঃসমীক্ষণের চেয়ে ঢের ঢের যোজন দূর পথ দিয়ে হেঁটেছেন ফ্রয়েড। এবং তাঁর পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল পশ্চিমী সমাজভাবনা এবং আর্থসামাজিক পরিস্থিতির প্রভাব। এহেন আলোচনা সেসময় তাই সাধারণ্যে খুব গ্রহণযোগ্য না হলেও পরবর্তীতে গিরীন্দ্রশেখরকেই এ বিষয়ে ভারতবর্ষে পথিকৃৎ মনে করা হয়। অবশ্য দেকার্তের যুক্তি > প্রতিযুক্তি > অযুক্তির মতকে চ্যালেঞ্জ করা দেরিদা কিম্বা লাঁকানিয় মনোবিকলন পদ্ধতি কোনটাই পাঠকসাধারণের খুব ধারপাশ দিয়ে যায় না। আবার সিগমুন্ড ফ্রয়েড কিম্বা সমসময়ের সমধ্যায়ী আলফ্রেড অ্যাডলার কিম্বা কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং এই নামগুলোও তখন বাঙালি জীবনে ততটা পরিচিতি লাভ করেনি। সেই সদর-অন্দরের ঘোচানোর কথা ভেবেছিলেন গিরীন্দ্রশেখর।

“স্বপ্ন” বইটি মোট একশ’ পঁয়তাল্লিশ টি ‘অনুচ্ছেদ’-এ বিভক্ত। একদম প্রাথমিক অধ্যায় ‘মুখবন্ধ’ থেকেই প্রথম অনুচ্ছের সুচনা। ‘মুখবন্ধ’ এবং ‘ভূমিকা’ পর্বে গিরীন্দ্রশেখর মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড-এর এবং তাঁর কাজের কিছু পরিচয় দিয়েছেন। এই প্রথম বাংলা ভাষায় বিস্তারিত আলোচনা হল ‘ইডিপাস কমপ্লেক্স’ কিম্বা ‘ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন’ অর্থাৎ ‘অবাধ ভাবানুষঙ্গ’ পদ্ধতির। আর তার হাত ধরেই ক্রমশ উঠে এল স্বপ্নের উপাদান, স্বপ্নে প্রতী্ক, স্মৃতিমূলক স্বপ্ন, কিম্বা ভূতে পাওয়া স্বপ্নের মনোজ্ঞ এবং নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা। উঠে এলো মানুষের জীবন এবং জন্মসূত্রে এবং পরবর্তী সময়ে প্রাপ্ত সম্পর্কগুলির প্রতি মানুষের সম্মান শ্রদ্ধা কিম্বা কামশীলতার তীক্ষ্ণধী অভিমুখ মানব জীবনের বিভিন্ন ইচ্ছার নিরিখে কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় বা হয় না তার রূপরেখা। মানুষের মনের মতো আশ্চর্য অনুভূতি আর কিছুই নেই। এবং সুধাবিষে মিশে গহীন মনের জটিলতা মানুষকে কোন নিয়তির কিনারায় নিয়ে ফেলে তার কোনো সীমারেখা অদ্যাবধি টানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি মানব সভ্যতার পক্ষে। তাছাড়া আসলেই কোনটা সভ্য, কোনটা অসভ্য, কোনটা বাচ্য কিম্বা কোনটা গোপ্য তার নির্ধারক ও মন, যার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে মস্তিষ্ক, হৃদয়, মেধা, বুদ্ধি আর অনুভূতির নিগূঢ় রসায়ন। আর এই মনের সমস্ত ইচ্ছাগুলি কখনোই একাভিমুখী সরলরৈখিক নয়। তারা পরস্পর ছেদ করছে সর্বদা বিরুদ্ধ মতাদর্শে। ফলে একাধিক ইচ্ছার সংঘাত অনবরত চলছে মনের আনাচে কানাচে। সুমতি-কুমতির দ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন হয়েছে বঙ্কিমের উপন্যাসের চরিত্রাবলি থেকে অ্যার্জের মিলোউ। একই দ্বন্দ্ব শেক্সপীয়র থেকে শ’ কিম্বা রবীন্দ্রনাথে। আর আধুনিক সময়ে তো দ্বন্দ্ব এবং দ্বান্দ্বিকতার নতুনতর এবং প্রগাঢ়তর বহুমাত্রিকতা উন্মোচিত হয়েছে সমাজ–সাহিত্য-অর্থনীতি-রাজনীতি-- বলা ভালো জীবনের সর্বস্তরে। অর্থাৎ এই আদিম দ্বন্দ্ব অহর্নিশ মানবসভ্যতার অন্তঃস্তলে জাগরূক। আর এই সুমতি-কুমতির ‘সু’ এবং’কু’ অংশ বাদ দিয়ে কেবল মতি নিয়ে কাজ করেছেন প্রোফেসর ফ্রয়েড কিম্বা গিরীন্দ্রশেখর বসু। সামাজিক ঔচিত্যের ধারণা তাঁরা সরিয়ে রাখছেন প্রাথমিকভাবে। তাঁরা বলছেন মনের জ্ঞাত এবং অজ্ঞাত ইচ্ছের কথা, মনের রুদ্ধ ইচ্ছের কথা, মনের প্রহরী এবং তাঁকে ফাঁকি দিয়ে স্বপ্নে হানা দেওয়া রুদ্ধ ইচ্ছের রূপ এবং প্রতীক হয়ে ওঠার কথা কিম্বা ইচ্ছের অবদম্ন বা অবদমিত ইচ্ছের কথা। আর এই সবই সূচনা করছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ভারতবর্ষে আধুনিকতর ভাবনা এবং জীবনের ইঙ্গিত। অথচ এখানেই ঘটে যাচ্ছে বিপ্লব। গিরীন্দ্রশেখরের লেখনীতে উঠে আসছে ভারতবর্ষীয় অধ্যাত্মভাবনায় নিহিত জীবনচর্যার বীজ এবং তৎসংক্রান্ত ভারতবর্ষীয় ভাবনা পরিবার এবং সমাজের প্রতি। পিতা মাতা বা পুত্র কন্যার প্রতি মনোবিকলনজাত যে কামভাবের পশ্চিমী ভাষ্য উপস্থাপন করেছিলেন ফ্রয়েড, গিরীন্দ্রশেখর বসু মূল তত্ত্বভূমি একই রেখে সেখানে সংযুক্ত করে দিলেন শাশ্বত ভারতীয় চিন্তাধারার প্রভাব। স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হল দুই বিপরীত গোলার্ধের তাবৎ পার্থক্যময় জীবনবেদ। যদিও “স্বপ্ন” বইতে এতখানি তফাতে সরে যাননি গিরীন্দ্রশেখর। ফ্রয়েডের এবং তাঁর প্রাথমিক মতাদর্শগুলির পরিচয় দিয়ে তিনি এই বই থেকেই তৈরি করেছেন মনোবিজ্ঞানের প্রামাণ্য পরিভাষা। গিরীন্দ্রশেখরের কাজের পরিধি জানতে গেলে দেখা যাবে ডাক্তারি থেকে সাইকোল্যজিকাল পাঠ এবং ক্রমশ সাইকো অ্যানালিসিস এবং বৃহত্তর সাইকোল্যজির জগতে তিনি নিবিষ্ট ছিলেন জীবৎকাল। এবং এই সাইকো অ্যানালিসিসের ক্ষেত্রে তিনি প্রথম থেকেই প্রাচীন ভারতীয় নীতি আদর্শের বোধকে পোষণ করেছিলেন অত্যাজ্য আত্যন্তিকতায়। তাই পরের দশক গুলিতে মনঃসমীক্ষণের পত্রিকা ‘সমীক্ষা’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি পুরাণ-প্রবেশ লিখছেন বা অনুবাদ করছেন গীতার।

ফ্রয়েডের মতে লজ্জা ঘৃণা বা ভয়ের কারণে আমাদের [মানুষের] ইচ্ছের অবদমন ঘটে এবং অচেতন অনুভূতি ভালবাসা ঈর্ষা বা হিংসা আমাদের জ্ঞানের বিন্দুমাত্র সংস্রব ছাড়াই আমাদের প্রভাবিত করে। কেননা সামাজিক যৌথ নির্জ্ঞানে [সোশ্যাল আনকনশাস] তাদের চিহ্ন কোন বিশেষ আয়জন ছাড়াই বিদ্যমান। গিরীন্দ্রশেখর ঠিক বললেন উলটো কথা। তাঁর মতে লজ্জা ও ভয় অবদমিত ‘ইচ্ছার’ ফল, তারা অবদমনের কারণ নয়। ঠিক এই কারণেই ফ্রয়েডীয় লিঙ্গচ্ছেদের ধারণা প্রাচ্য সংস্কৃতিতে আপেক্ষিক হয়ে দাঁড়ায় মাত্র এবং ইডিপাস কমপ্লেক্সের রূপ একেবারে বদলে গিয়ে গিরীন্দ্রশেখরে হয়ে যায় ‘গণেশ কমপ্লেক্স’ পুং সন্তানকে পিতার হত্যা করার অনুষঙ্গে [শিব কর্তৃক গণেশের মুণ্ডচ্ছেদ]।

পাঠক বিগত অনুচ্ছেদে ‘ইচ্ছে’ শব্দবন্ধে মনোযোগ দিন। কেননা গিরীন্দ্রশেখরের তত্ত্বে মূলত বিভিন্ন ইচ্ছের অন্তর্গত টানাপোড়েনের রেখাচিত্র। তাই অজ্ঞাত বিবিধ ইচ্ছের ব্লুপ্রিন্ট হয়ে ওঠে “স্বপ্ন”। লেখকের মতে, যে ইচ্ছে সম্পুর্ণ অজ্ঞাতে থেকে স্বপ্নে প্রকাশ পায় তাকে বলা যায় অবদমিত ইচ্ছে বা গূঢ়ৈষা বা আনকনশাস উইশ বা কমপ্লেক্স। এই রুদ্ধ বা অবদমিত ইচ্ছার আত্মপ্রকাশের যে অন্তরায় তাকে বলা হয় বাধা বা প্রতিবন্ধ (রেজিস্টান্স)। প্রতি মানুষের মনে থাকে রুদ্ধ ইচ্ছে গুলির বিপরীত কিছু ইচ্ছে তারা হল সমষ্টিগতভাবে আমাদের মনের প্রহরী বা সেন্সর। আর রুদ্ধ ইচ্ছা ছদ্মবেশে যে ক্রিয়ার দ্বারা চরিতার্থতা লাভের চেষ্টা করে তাকে গিরীন্দ্রশেখর প্রতীক-ক্রিয়া (সিম্বলিক অ্যাকশন) এবং প্রতীক রূপ (সিম্বলিক ম্যানিফেস্টেশন) বলে চিহ্নিত করছেন। আর সমস্তরকম স্বপ্নই হল এই সব ইচ্ছে অনিচ্ছে বিপ্রতীপ ইচ্ছের যুগলবন্দী। অনেকক্ষেত্রে গিরীন্দ্রশেখর বসু বাংলা ভাষার প্রচলিত বাগ-ব্যবহারের সহায়তা নিয়েছেন। যেমন দোল খাওয়া বা আকাশে কিম্বা উঁচুতে ওড়ার স্বপ্ন দেখা আসলে মনের রুদ্ধ এবং সামাজিক ভাবে অসদ-ইচ্ছার কাল্পনিক চরিতার্থতা এ কথা বোঝাতে গিয়ে গিরীন্দ্রশেখর বলছেন, যখন কেউ হঠাৎ করে কোনো অসামাজিক কাজ করেন বা অন্যায় পথে চলতে থাকেন, তখন সেই ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয় “অমুকে উড়ছে”।

এই বইতে বিভিন্ন ধরণের স্বপ্নের বিশ্লেষণ আছে। এবং সমস্ত বিশ্লেষণই পাঠককে চমকে দিয়ে ধরাশায়ী করতে অব্যর্থ। আর বিশ শতকের প্রারম্ভের বাঙালি পাঠকও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। যেমন, পরিক্ষা দিতে হবে কিন্তু পড়া তৈরি হয়নি এমন স্বপ্নে বা ট্রেন ফেল হওয়ার স্বপ্নে ফ্রয়েড বলছেন কোন কঠিন কাজ হাতে থাকলে এমন স্বপ্ন দেখা স্বাভাবিক, বিশেষতঃ যেখানে কার্য সম্পাদনবিষয়ক একটা ভীতি মনের মধ্যে অনবরত ক্রিয়াশীল। কিন্তু গিরীন্দ্রশেখর বসু বলছেন রাতের বেলা প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে উঠবো কি উঠবো না এমন একটা শারীরিক বৃত্তিগত দ্বন্দ্ব এবং কামজ প্রবণতা থেকেই এই স্বপ্নের উদ্ভাবনা। ঠিক এমনভাবেই দাঁত তোলার স্বপ্ন, জলে ডোবা বা জল থেকে তোলার স্বপ্ন, চোর ডাকাত কিম্বা হিংস্র জন্তুর স্বপ্ন সবই গূঢ় কামৈষা নির্দেশ করে। ফলে সমসময়ে গিরীন্দ্রশেখর বসুকে বহুতর সামাজিক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল তা তিনি এই বইয়ের মুখবন্ধে উল্লেখ করছেন। আর ভারতীয় যৌনতার পর্দানশীন মনোভাবের ক্ষেত্রে তা অনুমান করতে এইসময়ে দাঁড়িয়েও খুব অসুবিধা একালীন পাঠকের হবার কথা নয়। এবং গিরীন্দ্রশেখর নিজেই বলছেন সবসময়েই সব স্বপ্নের সঠিক অর্থভেদ হবেই ভাবানুষঙ্গ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, তা কিন্তু প্রশ্নাতীত বা তর্কাতীত সিদ্ধান্ত নয় একেবারেই। তবে গিরীন্দ্রশেখর বসুকে ভারতবর্ষীয় মনঃসমীক্ষণের অবিসম্বাদী জনক বলা যায় তর্ক বা প্রশ্নের পরিসর না রেখেই; সে বিষয়ে পাঠক-সমালোচকের আর কোনো দ্বিধার অবকাশ নেই।




(পরবাস-৬৭, জুন ২০১৭)