“...প্রত্যেকটা দিনকে আমি বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখি, উপভোগ করি। সূর্য ওঠা ত্থেকে অন্ধকার নামা অব্দি সবটকু সময়। প্রত্যেক মুহূর্তের রঙ, উষ্ণতার তারতম্য আমার মধ্যে ভিন্ন রসায়ন তৈরি করে। আর এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই আমার চারপাশের মানুষগুলোকে আমি যাচাই করি। সকালবেলায় যাকে উদাসীন দেখি, দুপুর গড়াতেই তার মুখটাকে মনে হয় প্রবল ছকবাজ। দুপুরের প্রখর রোদ্দুরের আভা যার অন্তর্নিহিত বিষাদকে মুখের রেখায় ফুটিয়ে তোলে, সূর্য ঢলে পড়ার মুহূর্তে তাকে ঝলমল করে উঠতে দেখি। এর সঙ্গে আমার চোখের অপটিকাল পাওয়ারের কোন সম্পর্ক নেই। আমার চোখের পাওয়ার স্বাভাবিক। এটা অবলোকন। আমার প্রিয় অবসর যাপন।
আজকের দিনটা ব্যতিক্রম হলো। মেঘের আড়ালে থেকে সূর্য ডুবলো। মেঘ যখন সরলো, জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাদাম গাছের ফাঁকে সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করছে। সারাদিন আমার কাছাকাছি যারা এসেছে, তাদের কাউকে পড়তে পারলাম না। কিন্তু একটা নতুন উপলব্ধি দিয়ে আক্রান্ত হয়ে ছিলাম সারাদিন। সারাক্ষণ আমার চোখ ছাপিয়ে একটা অন্য অবলোকন, যা আগে কখনও হয়নি। যেন একটা তৃতীয় নয়ন সংযোজিত হয়েছিল আমার মধ্যে।
যেমন, সকাল সাড়ে সাতটার সময় বেলা যখন চা দিতে এলো, আমি খুব খুশি হয়ে চায়ের কাপ নিলামও ওর হাত থেকে, কিন্তু বেলাকে দেখতে পেলাম না। শুধু চায়ের ফ্লেভারটা নাকে এলো। আমার চোখের সামনে তখন দিগন্ত ছাপিয়ে যাওয়া চা-বাগান। শেড-ট্রি চুঁয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া রোদ নামছে। মদেশীয় মেয়েরা পিঠে কাপড়ের ঝোলা, কেউবা বাঁশের টুকরি নিয়ে চা পাতা তুলছে। প্রথমে ঝাপসা, তারপর স্পষ্ট দেখলাম তাদের প্রত্যেকের মুখে বেলার মুখোশ পরা। সেই যেমন কোন একটা পানীয়ের বিজ্ঞাপনে দেখি শচিনের মুখোশ পরা বাচ্চা ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে, অবিকল তেমনি। তাকিয়ে আছি, কাপ তখনও আমার হাতে ধরা, চুমুক দিইনি। মুখোশ সরিয়ে একটি মেয়ে বলে উঠলো, ছোড়দা আর কিছু বলবেন?
--না তো। বলে চায়ে চুমুক দিতেই দেখলাম বেলা দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
চা-টা শেষ করে ভাবছিলাম একটু ছাদে যাবো, অনেকদিন যাইনি। ঝিলিক বলছিল, ছাদের টবে স্বর্ণচাঁপা গাছে প্রচুর ফুল এসেছে। গাছটা আমি শিলিগুড়ি থেকে এনেছিলাম, বৌদি যত্ন করে ফুল ফুটিয়েছে। যাবো বলে উঠে দাঁড়িয়েছি, অনি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে কতকগুলো আলগা কাগজ আর একটা পেন্সিল টেবিলে রেখে বললো,
--ছোটকা আমাকে চটপট ইন্ডিয়ার ম্যাপ আঁকাটা শিখিয়ে দাও তো। কাল আমার ভূগোল পরীক্ষা।
--সে কি রে! কাল পরীক্ষা, আর আজ ম্যাপ প্রাকটিস?
--আমার প্রিপারেশন তো হয়ে গেছে। শুধু ম্যাপটা নিয়ে একটু প্রবলেম........
অগত্যা প্রথমে চোখ বন্ধ করে মাথার মধ্যে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর একটা ইম্প্রেশান আনতে চেষ্টা করলাম, তারপর একটা কাগজ টেনে নিলাম। উত্তর থেকেই শুরু করলাম। আমার পেন্সিল আরব সাগরের ধার বরাবর আসতেই অনি বাধা দিল--একটু থামো, আমি রঙ-পেনসিলগুলো নিয়ে আসি।
--রঙ-পেনসিল কী হবে?
--তুমি স্টেটগুলো আলাদা আলাদা রঙ করে দেবে, না হলে মাথায় থাকবে না। সব গুলিয়ে ফেলব। রঙ করে দিলে ব্যাপারটায় বেশ একটা থ্রি-ডাইমেনশানাল লুক আসবে। তার ওপর যদি নদী, বন, পাহাড়গুলো একটু...
কাগজের ওপর পেন্সিলের টান দিতে দিতেই আমি বললাম--এরপর বলবি, নদীতে একটু কুলুকুলু শব্দ, বনের ভিতর একটু ঝিরঝির হাওয়া, পর্ণমোচী গাছগুলিতে খানিকটা হাহাকার জুড়ে দাও। হাহাকারটা কী জানিস--যখন প্রবল কষ্টে বুকের ভেতর শুকিয়ে যায়--চৈত্রের মাঠের মতো--কান্নাও পায় না--আর কষ্টটা ঘন কালো ধোঁয়ার মতো পাকিয়ে পাকিয়ে উঠে সমস্ত ভাবনাকে দুমড়ে মুচড়ে--টর্নেডোর মতো--টর্নেডোর দেখেছিস কখনও--কুণ্ডলী পাকানো খিদে যেন--বাড়ি ঘর গাছপালা, মানুষ সমেত গাড়ি…।
পেন্সিল চলছে, পাশাপাশি বুঝতে পারছিলাম কথারা আমার নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, আয়ত্তে আনতে পারছি না। অনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। আমার কথারা আরও ডালপালার দিকে এগোচ্ছিল তখনই অনি বললো, ছোটকা তোমার কথাগুলো সবার থেকে আলাদা, সবটা বুঝতে পারি না, তবু শুনতে বেশ লাগে।
ওর কথার মধ্যেই আমার আউটলাইন কমপ্লিট।
--ছোটকা পাহাড়, নদী, বন, কোথায় কী আছে সেটা এঁকে দাও।
--সবটা তো মনে করতে পারবো না, শুধু পশ্চিমবঙ্গটা… দেখি চেষ্টা করে।
এবারও উত্তরদিক থেকে শুরু করলাম। এবার অনির রঙ-পেন্সিল হাতে নিলাম। কিন্তু পাহাড় থেকে নামতেই আটকে গেলাম ডুয়ার্সের বনাঞ্চলে। হাতে ধরা সবুজ রঙ-পেনসিল ঝাপসা হতে হতে আচমকা দীর্ঘ সবুজ গাছের সারিতে রূপ নিলো। বুনো শ্যাওলার সঙ্গে মিলে মিশে নানারকম মুকুলের গন্ধ নাকে এসে লাগলো। বাতাসে মাঝে মাঝে পাতা ঝরছে। চিরহরিৎ অরণ্যের মাঝে দু’একটা পর্ণমোচী সত্যি সত্যি নিজের হাহাকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎই মনে হলো, ঘন বনের মাঝ দিয়ে পায়ে-চলা পথ ধরে নীল ওড়না পরা একটা মেয়ে একা হেঁটে চলেছে। ওর পাশে পাশে একটা সরু নদী বইছে। কখনও মনে হচ্ছে--না, ও কোনো মানুষ নয়, গাছের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ছিটকে আসা এক টুকরো আকাশ। পরমুহূর্তে মনে হচ্ছে সত্যিই কোনো মেয়ে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, কিন্তু মেয়েটা ভিজছে না। কিছুদূর যাওয়ার পর সে ওড়নাটা নিজের মাথায় তুলে নিয়ে পিছন ফিরে বলল,
--জানলাটা বন্ধ করে দেইন, আপনার পিঠ ভিজে যাচ্ছে।
চমকে দেখি আধখানা খোলা দরজায় হৈমন্তী দাঁড়িয়ে। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আর জলের কুচি হাওয়ায় উড়ে এসে আমার পিঠে লাগছে। কথাটা বলেই দরজা ভেজিয়ে চলে গেল হৈমন্তী। ও চোখের আড়াল হতেই মনে হলো হৈমন্তী একটা নীলরঙের ফুলছাপ দেওয়া লংস্কার্ট পরে আছে।
যতক্ষণ আমি ঘরে থাকি, আমার দরজাটা সবসময় ভেজানো থাকে, এটা এ-বাড়ির সবাই জানে। হাট করে খোলা দরজায় আমার অসুবিধে হয়। মনে হয় কেউ আমাকে তীব্রভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। অস্বস্তি লাগে। আমি নির্দিষ্ট কোনো একটা বিষয়ে কনসেনট্রেট করতে পারি না। অনেক লোকের মাঝে কিছু বলতে গেলে এই সমস্যাটা আরও বেশি হয়। কথাগুলো কোলাজের মতো হয়ে যায়, আমি সেটা বুঝতে পারি। কেউ হেল্প না করলে কন্ট্রোল করতে পারি না। ঝিলিক এটা খুব ভালো বোঝে। সেই জন্যেই ওর ওপর আমার খানিকটা নির্ভরতা আছে।
এই যেমন দুপুর বারোটার দিকে দাদার একজন ক্লায়েন্ট এসেছিল। দাদা স্নান করছিলেন বলে আমি তাকে বসিয়ে সামান্য সৌজন্য-আলাপ করতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলাম। ভদ্রলোক ক’দিন আগে কোনো নিউজ ম্যাগাজিনে একটা আর্টিকেল পড়েছেন যে জলের নাকি মেমারি আছে। ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না ওঁর। ব্যাপারটা ওঁকে বোঝাতে গিয়ে একটা সময় খেয়াল করলাম আমি তাকে বানভাসি বাংলার দিকে নিয়ে যাচ্ছি, ভদ্রলোক বিস্মিত অসহায় মুখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু নিজেকে আয়ত্তে আনতে পারছিলাম না। অসহায় লাগছিল, তখনই ঝিলিক এসে কৌশলে আমাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, আর একটু হলেই ভদ্রলোক আমাকে পাগল ভেবে বসতেন। ভাগ্যিস ঝিলিক ছিল। একটু পরে মনে হলো এসময় ঝিলিক বাড়িতে কেন? ওর তো কলেজে থাকার কথা, ও তো কলেজ কামাই করার মেয়ে না। জিজ্ঞেস করলাম, কী রে, কলেজ যাসনি কেন?
--মা যেতে নিষেধ করলো। দুটো ইম্পর্টান্ট ক্লাস ছিল, মিস করলাম। এত করে বললাম তিনটের মধ্যে ফিরে আসবো। মা কিছুতেই শুনলো না। বলে কি না কলেজে গেলে বিকেলবেলায় একঝস্টেড লাগবে। কলেজে গিয়ে আমি যেন কুস্তি লড়ি। মায়ের সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।
--কিন্তু কলেজ যাতে না দেওয়ার কারণটা কী?
--তুমি জানো না?
--কী?
--আমাকে দেখতে আসবে বিকেলবেলায়।
--কি হয়েছে তোর?
--বয়েস হয়েছে। যে বয়েসে মেয়েকে আর বাড়িতে রাখা যায় না, বুঝলে মি: অপার্থিব।
--কে দেখতে আসবে?
--বারাসাত, মানে হায়দ্রাবাদ।
--বারাসাত, মানে হায়দ্রাবাদ!
--ওহ্, ছোটকা, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না। কিচ্ছু মনে থাকে না তোমার। ছোটপিসির ননদের ছেলে, সেই যে উইপ্রো-তে চাকরি করে। এখন হায়দ্রাবাদে থাকে। তুমিই তো না কি ওর কথা বলেছিলে ছোটপিসিকে। ছোটপিসি সেটা অ্যারেঞ্জ করেছে।
--অ্যারেঞ্জ করেছে মানে! বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছে?
--তবেই হয়েছিলো আর কি। তারা এসে আমার চোখ দেখবে, চুল দেখবে, দাঁত দেখবে নখ দেখবে। আমাকে হাঁটাবে, হাসাবে, বাজাবে, তবেই না বিয়ের কথা ভাববে।
--ধ্যাৎ এরা ওরকম নয় মোটেই।
--তুমি কী করে জানলে ওরা এরকম নয়?
--ওরা মানে ঐ ছেলেটা, আই মিন ঋত্বিক।
--ওর নাম বুঝি ঋত্বিক? নামটা পছন্দ হলো। এবার বলো তুমি জানলে কী করে ও ওরকম নয়?
--তাইতো, কী করে জানলাম, দাঁড়া একটু ভেবে দেখি। হ্যাঁ মনে পড়েছে। ছেলেটার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল বারাসাতে ছোড়দির বাড়িতে গিয়ে। খুব ভালো লেগেছিল, ইউনিক লেগেছিল ওর কথাবার্তা। একটা অন্যরকম ভাবনাচিন্তা আছে ছেলেটার মধ্যে।
অন্যরকম মানে?
--মানে গড়পড়তা মানুষ কোনো একটা বিষয় বা ঘটনাকে যেভাবে দেখে, ও সেই একই বিষয় বা ঘটনাকে দেখে জারা হ্টকে। ইমাজেনেটিভ। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, ও কথা বলার সময় এত রকম রেফারেন্স দেয়, বোঝা যায় প্রচুর পড়াশুনো করে।
--সর্বনাশ, ওর কথাবার্তার ধারা আমার তোমার মতো নয় তো? কাঁচকলা নিয়ে বলতে গিয়ে চিত্রকলায় পৌঁছে যাওয়া।
আমি মনে করতে পারছি না ছোড়দিকে কবে ঝিলিকের বিয়ের কথা বলেছি, আর কেনই বা বলতে যাবো। ঝিলিকের তো এখনও গ্রাজুয়েশান কমপ্লিট হয়নি। এ-বছর ওর ফাইনাল পরীক্ষা। সাইকোলজি নিয়ে পড়ছে। এবং বেশ ইন্টারেস্ট নিয়েই পড়ছে সাবজেক্টটা। ঝিলিককে কনভিন্স করার জন্যে এটা ছোড়দির একটা চালাকিও হতে পারে...”
বিয়ে ব্যাপারটায় নিজে বরাবর খুব ভয় পায় মৈনাক। একজন মানুষ সারাক্ষণ এত কাছে, ওর প্রত্যেকটা নিশ্বাস, প্রতিটা দৃষ্টিপাতের ওপর তার নজর থাকবে, ভাবতেও শিউরে ওঠে। তার ওপর সে যদি একেবারে অচেনা হয়। কলেজে চাকরি পাওয়ার পর বাড়ির লোকেরা যখন বিয়ের জন্যে তোড়জোড় শুরু করলো, তখন মোহনার কথা মনে হয়েছিল। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে পড়াশুনো করেছে ও আর মোহনা। কিন্তু সুজাতার কাছে যখন বললো, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। মোহনার ততদিনে অন্যত্র প্রেম এবং বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তারপর বিয়েতে আর মৈনাককে কিছুতেই রাজি করানো যায়নি। সবাই মেনে নিয়েছিল। মৈনাক নিজেও অভ্যস্ত ও স্বচ্ছন্দ ছিল নিজের বন্ধ দরজার মধ্যে এলোমেলো হয়ে যাওয়া ভাবনার মুক্ত আনন্দে। দীর্ঘ বারো বছর কেটে যাওয়ার পর ওর বন্ধ দরজায় আর একজনের ছায়া পড়েছিল, যাকে দেখে মনে হয়েছিল ওর ভাবনাকে জাস্টিফাই করতে পারবে। কিন্তু তাকে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভেতর টেনে আনা সম্ভব হয়নি।
সন্ধেবেলায় মেয়ে-দেখার ফর্মালিটি হয়ে যাওয়ার পর মৈনাক জিজ্ঞেস করলো ঝিলিককে, কি রে ঋত্বিককে ভালো লেগেছে?
ঋত্বিককে সত্যিই খুব ভালো লেগেছে ঝিলিকের। কলেজে দু’একটা খুচরো প্রেম এনজয় করে বটে, তবে কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়নি এখনও। কলেজ ফুরিয়ে গেলে তারাও মিলিয়ে যান মন থেকে। আজ মনে হচ্ছে, নিভৃতে ঋত্বিকের কথা ভাবতে ওর ভালো লাগবে। একটা নতুন ধরনের অনুভূতি হচ্ছে ঝিলিকের। ও সরাসরি মৈনাকের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
--তা লেগেছে, তবে বিয়ে করার আগে আমি এম-এ টা কমপ্লিট করতে চাই।
--কিন্তু দাদা-বৌদিকে কনভিন্স করবি কী ভাবে? ওরা তো মনে হলো শিগগিরিই তোড়জোড় শুরু করে দেবে।
--আমি তো কিছু বলতে পারবো না। কনভিন্স করার জন্যে কারো হেল্প দরকার। একজন পারে আমাকে হেল্প করতে। সে মায়ের খুব ফেভারিট।
--কে?
--মৌ, মানে বৌদি।
মৌ হৈমন্তীর ডাকনাম। মৈনাকও জানে হৈমন্তী সুজাতার খুব প্রিয়।
মৈনাক এমন স্বাভাবিকভাবে কোনো প্রসঙ্গ নিয়ে সুন্দর গুছিয়ে কথা বলছে, এটা ঝিলিকের কাছে নতুন ব্যাপার। ছোটকাকে নিয়ে ওর খুব গর্ব। এই বিশ্ব-সংসারে এমন কোনো বিষয় নেই যা ছোটকার অজানা। সমস্যা ঐ একটাই, কথার খেই হারিয়ে ফেলা। কেবলই প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে সরে যায়, এবং এটা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয়, যে বিষয়টার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত তার আর সম্পর্ক থাকে না। কলেজের চাকরিটা এই কারণেই ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু ওর ভাবনাচিন্তায় কোনো অসংগতি নেই, লিখতে গেলেও অসুবিধে হয় না। সমস্যাটা হয় মুখে বলতে গেলে। সেই কারণেই ছাত্রজীবনে মৈনাকের ক্লাস পারফরমেন্স ভালো না হলেও পরীক্ষার রেজাল্ট আগাগোড়া খুব ভালো ছিল। ঝিলিকের উদ্যোগে মাস ছয়েক হলো একজন বিহেভিয়ার থেরাপিস্ট-এর অবজারভেশানে আছে মৈনাক। মাসে দুবার ড: গুপ্তর চেম্বারে ঝিলিকই মৈনাকের সঙ্গে যায়। ড: গুপ্ত মৈনাককে ডাইরি লেখার পরামর্শ দিয়েছেন। ঝিলিক লক্ষ্য করেছে ইদানীং রেগুলার ডাইরি লেখে মৈনাক। যখন এটা করে, তখন কথাবার্তায় স্বাভাবিক প্রাসঙ্গিকতা বজায় থাকে। মৈনাক নিজেও তা বুঝতে পারে।
“...ঝিলিক খুব যে উচ্ছল হাসিখুশি তা নয়। তবু ওকে দেখলে মনে হয় সকালে উঠেই দু’হাতের পাতায় কয়েক ফোঁটা হাসি নিয়ে ও ক্রিমের মতো করে মুখে মেখে নেয়। সারাদিন মুখটা একই রকম প্রসন্ন থাকে। আজ ঋত্বিকেরা যখন এলো, খুব সুন্দর লাগছিল ওকে। আমি লক্ষ্য করছিলাম ঋত্বিকের মা চোখ সরাননি ওর মুখ থেকে। ঝিলিকের মুখের প্রসন্নতা ওদের মুখেও জড়িয়ে গেছিলো...”
হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে যাওয়াতে ডাইরিটা বন্ধ করে খুব সাবধানে দরজা ঠেলে ঘরের লাগোয়া ছোট্ট ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়াতেই মৈনাকের চোখে পড়লো নিজের ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে হৈমন্তী সেলফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছে। একবার ওর টুকরো হাসি কানে এলো। তাতেই ওর মনে হলো ফোনের ওপাশে যেই থাকুক, সে অভী নয়। অভী অফিসের কাজে একসপ্তাহের জন্যে পুনে গেছে। অভীর সঙ্গে কখনও হেসে কথা বলতে দেখেনি ওকে মৈনাক। ফোন দূরে থাক, সামনাসামনি দুজনে যখন কথা বলে, মনে হয় সারাক্ষণ কোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলছে। অথচ হৈমন্তী যে গোমড়ামুখো, তা নয়। বাড়ির সবার সঙ্গেই বেশ খোলামেলা, হৈ হৈ করে। মৈনাকের সঙ্গে অবশ্য ততটা নয়। এর কারণ হতে পারে হৈমন্তী দু’বছর মৈনাকের ছাত্রী ছিল শিলিগুড়ি কলেজে। অঙ্ক নিয়ে পড়তো। মৈনাকের ফিজিক্স-এর ক্লাস করতো, পড়াশুনার প্রয়োজনে মাঝে মাঝে বাড়িতেও আসতো। মৈনাক তখন হাকিমপাড়ায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতো। হৈমন্তী যে খুব ভালো ছাত্রী ছিল তা নয়, মৈনাক ওকে পছন্দ করতো অন্য কারণে। ক্লাসে পড়াতে গিয়ে মৈনাক যখন বিষয় থেকে সরতে সরতে অনেক দূরে চলে যেত, অন্য ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করত, কেউ কেউ ক্লাস ছেড়ে চলে যেত, তখন হৈমন্তীই কেবল মনোযোগ দিয়ে ওর লেকচার শুনতো। ইন্টারেস্ট নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করতো। সাউন্ড পড়াতে গিয়ে একবার মৈনাক যখন চৌরাশিয়ার বাঁশিতে পৌঁছে গেল, তখন ক্লাস ফাঁকা। মৈনাক লক্ষ্য করলো তখনও একমাত্র হৈমন্তী গভীর উৎসাহে শুনছে ওর কথা।
একবার শুকনার জঙ্গলে কলেজের সঙ্গে পিকনকে গিয়েছিল মৈনাক। সবাই যখন হৈ-হুল্লোড়, খেলা, কুইজ নিয়ে মেতে আছে, তাদের মধ্যে হৈমন্তীকে দেখতে পেলো না। দূর থেকে ভেসে আসা গানের সুর লক্ষ্য করে এগিয়ে গিয়ে দেখলো যেখানে বনের ভেতর দিয়ে মহানন্দা বয়ে চলেছে তিরতির করে, তারই পাশে একটা মরা গাছের গুঁড়ির ওপর একা বসে গান গাইছে হৈমন্তী ‘আজ হাওয়া যেমন পাতায় পাতায়, মর্মরিয়া বনকে কাঁদায় তেমনি আমার বুকের মাঝে কাঁদিয়া কাঁদাও গো”----। ওকে দেখতে পেয়েও লজ্জা পায়নি, গান থামায়নি। ভারি অদ্ভুত লেগেছিল মৈনাকের। আরও একটা ব্যাপার তখন মৈনাক খেয়াল করেছিল, হৈমন্তী খুব বেশি নীল রঙ পরে।
শিলিগুড়িতে মৈনাকের কাছে বেড়াতে গিয়ে হৈমন্তীর মা-বাবার সঙ্গে সুজাতার পরিচয় ও অন্তরঙ্গতা হলো। তার ছ’মাসের মাথায় অভীকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল হৈমন্তীর। এই পরিবারে যুক্ত হয়ে গেল হৈমন্তী। এবার ঝিলিক ওদের ছেড়ে অন্য পরিবারে চলে যাবে। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
পুরোনো কথা ভাবছিল, চোখে হঠাৎ আলোর মৃদু রশ্মি লাগতে মৈনাক ডানদিকে ফিরলো। হাত দিয়ে মোমবাতি আড়াল করে নিয়ে ওপরে আসছে ঝিলিক।
মোমবাতির মৃদু আলোয় চোখ রেখে অন্য দু’বছর আগের একটা দৃশ্য মনে পড়লো মৈনাকের...
দরজায় দু’তিনবার নক করতেই কেউ একজন ওকে দরজা খুলে ‘বসুন’ বলে ভেতরে চলে গেল। একটু পরে হাতে মোমবাতি নিয়ে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে দেখলো হৈমন্তীকে। মৈনাককে দেখে অবাক চোখে জিজ্ঞেস করলো--আপনি!
--তোমার বাবার সঙ্গে দরকার। মানে একটা অত্যন্ত জরুরি কথা ছিল।
--বাবা তো গতকাল কলকাতায় গেছেন।
--কবে ফিরবেন?
--আমি ঠিক বলতে পারবো না। খুব জরুরি কিছু হলে আপনি আমাকে বলুন, আমি ফোনে জানিয়ে দেবো।
--না। আমাকেই বলতে হতো...মানে আজই, এখনই... নাহলে পরে ভুলে যাবো, হয়তো তখন বলার আর কোনো মানে থাকবে না....। কিছুটা স্বগতোক্তির মতো কথাগুলো বলতে বলতে বেরিয়ে এলো মৈনাক। বুঝতে পারছিল পিছনে মোমের আলোয় স্থির হয়ে আছে হৈমন্তীর বিস্মিত মুখ। সেই জরুরি কথাটা আর বলা হয়নি।
সেদিনই রাতে বৌদি ফোনে জানালো, হৈমন্তীর বাবা এসেছিলেন। অভীর বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে, তুই ছুটি নিয়ে চলে আয়...।
--ছোটকা। মোমটা ঘরে রাখবো?
--হ্যাঁ।
মৈনাক দূর থেকে লক্ষ্য করলো লেখার টেবিলে মোমটাকে রেখে ঝিলিক চারপাশে ছড়ানো বই পত্রিকাগুলো গুছিয়ে একপাশে রাখলো, বিছানাটা ঝেড়ে ঝুড়ে একটু টানটান করে দিয়ে হৈমন্তীর ঘরের দিকে গেল। ঠিক তক্ষুনি কারেন্ট চলে এলেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো মৈনাক। ভালো লাগছিল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের লক্ষ্য করতে।
ঝিলিককে ঘরে ঢুকতে দেখে হাত ইশারায় ওকে বসতে বললো হৈমন্তী। তারপর ‘বেশ, কাল তোমাকে ফোন করে জানাবো’ বলে ফোন রেখে ঝিলিকের দিকে ফিরলো।
--তোকে ওদের দারুণ পছন্দ হয়েছে। ঋত্বিকের মা পারলে কালই বিয়েটা দিতে চায়। তবে মায়ের ইচ্ছে আসছে অঘ্রাণেই...।
--আমার তো তা ইচ্ছে নয়।
--কেন রে?
--একদম চেনাজানা নেই, কিছুদিন এমনি একটু মেলামেশা করলে কেমন হয় বলো তো?
--ন্যাকামি করিস না। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ওরকমই হয়। চেনাজানাটা বিয়ের পরেই হয়।
--হয় কি?
--নিশ্চয়।
--তোমার হয়েছে?
--হয়েছে বৈ কি। আমি অভীককে খুব ভালোভাবে জানি।
--জানাটা তোমার এক্সপেক্টেশান ফুলফিল করেছে?
--দেখ ঝিলিক, যখন বুঝলাম বিয়ের ব্যাপারে আমার মতামতের খুব একটা গুরুত্ব নেই, তখন কোনোরকম এক্সপেক্টেশান রাখিনি আমি। একসঙ্গে থাকতে থাকতে একটা টান তৈরি হয়ে যায়, যা সম্পর্কটাকে বহন করে। অসুবিধা একটাই, অভীকের মধ্যে কোনও ইমাজিনেশান নেই।
“হৈমন্তী একটু অন্যরকম। অভীর থেকে একেবারেই আলাদা। আমার চেয়ে প্রায় ন’বছরের ছোট অভীকে আমি জন্ম থেকে জানি। প্রচণ্ড কেরিয়ারিস্ট ছেলে। সাধারণ মেরিটের ছেলে, তবু শুধু লেগে থাকার অধ্যবসায়ে চাকরির জায়গায় বেশ গ্ল্যামারাস একটা পজিশান হোল্ড করছে। ইমোশানের কোনও জায়গা নেই ওর কাছে। ও খানিকটা খর রোদ্দুরের মতো। একটুও ছায়া নেই ওর মধ্যে। ছিঁটেফোটা মেঘও নয়। আর হৈমন্তী একটা আলোছায়ার খেলা। অভীর পাশাপাশি এটা আরও স্পষ্ট করে চোখে পড়ে। কথাগুলো মনে হচ্ছে এই জন্যে যে আজ কদিন হৈমন্তীকে মুক্তপক্ষ পাখির মতো লাগছে। ওর গলায় গান আসছে। গত এক বছরে নিজে থেকে হৈমন্তীকে কখনও গাইতে শুনিনি। এক কলিও না। আগে কলেজে থাকতে যেমন গাইতো, যখন তখন--কমনরুমে, টিচার না আসা ক্লাসে, বা পিকনিকে গিয়ে আপনমনে, শুধু নিজের জন্যে। দেড় বছর আগে বৌদি যখন ফোনে অভীর সঙ্গে হৈমন্তীর বিয়ের খবরটা জানিয়েছিল, আমার কেবলই মনে হচ্ছিল এটা ঠিক হলো না...”
দরজায় টকটক শব্দ হতেই ডাইরির পাতা বন্ধ করলো মৈনাক। কলম বন্ধ করতে গিয়ে ঢাকনাটা নিচে পড়ে গেল। নিচু হয়ে তোলার আগেই ঝিলিক এসে ঢাকনাটা তুলে নিয়ে কলমটা বন্ধ করে ডাইরির ভাঁজে গুঁজে দিল। তারপর টেবিলে একটা কার্ড রেখে হাত পাতলো--টাকা দাও।
--কিসের টাকা?
--কার্ডটা দেখো। যেও কিন্তু।
মৈনাক কার্ডটা নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে আবার রেখে দিল। ঝিলিকের কলেজের ফাংশান।
--তুই তো জানিস এই ধরনের ফাংশানে যেতে আমার ভালো লাগে না।
--কার্ডটা ভালো করে পড়োনি তুমি।
--চিত্রাঙ্গদা কে করবে?
হাত দিয়ে মৈনাকের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে গম্ভীর মুখে বললো--গিয়ে দেখতে হবে সেটা। কিন্তু টাকা বার করো।
--কত দক্ষিণা দিতে হবে?
--পাঁচ, অ্যাটলিস্ট তিন তো দাও।
মৈনাক একটা পাঁচশো টাকার নোট বার করে ঝিলিকের হাতে দিতে দিতে বললো--যা, পাঁচশোই দিলাম তোকে চান্স দেওয়ার জন্যে।
--হোয়াট চান্স ছোটকা। আমি ছাড়া মণিপুর রাজকন্যার চরিত্র আমাদের কলেজে আর কে করবে বলো তো? বলতে ভুলে গেছি, মা তোমাকে ডাকছে ব্রেকফাস্ট করার জন্যে।
ব্রেকফাস্টের টেবিলে বাড়ির সবাই উপস্থিত, সেটা রবিবার বলেই। অন্যদিন ঝিলিক একাই কোনরকমে নাকেমুখে গুঁজে কলেজে বেরিয়ে যায়। তারও আগে অনি টিউশনিতে। তারপর হৈমন্তীর স্কুলে যাওয়ার পালা। একটা নার্সারি স্কুলে পড়ায় হৈমন্তী। ব্রেকফাস্টটাও ও সার্ভ করে। পাউরুটিতে যখন মাখন লাগাচ্ছে হৈমন্তী, এটা ওর। লুচি পরটা সচরাচর খায় না ও। সব অল্পবয়সী মেয়দের মতো ওরও তেল বাতিক আছে। কিন্তু এ ব্যাপারে ঝিলিক একবারে দরাজ দিল। হৈমন্তী মাঝে মাঝে ওকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে, আজও বললো--ব্রন বোলো না বৌদি, ওটা চাঁদের কলঙ্ক।
--মণিপুরের রাজকন্যার মুখে ব্রন ছিল কি?
--ছিল, ছিল। রবীন্দ্রনাথ চেপে গেছেন।
মৈনাক মুখ নিচু করে খাচ্ছে, সেদিকে চোখ পড়তে ঝিলিক বললো--জানো তো, ছোটকা পাঁচশো টাকা দিয়ে কার্ড কিনেছে। দাদার কাছ থেকে আর পাঁচশো আদায় করতে পারলে আমার কোটা কমপ্লিট।
--মৈনাক মুখ তুললো--অভী ফিরেছে?
--আজ ফিরবে।
হৈমন্তীর দিকে একঝলক তাকালো মৈনাক। ওর মুখের সেই ঝলমলে রোদ্দুরটার ওপর এক চিলতে ছায়া পড়েছে কি? ভাবতে ভাবতে বেসিনের দিকে গেল মৈনাক। শুনলো ঝিলিক বলছে
--ছোটকা, আজ পাঁচটায় ড: গুপ্তর কাছে যাওয়ার কথা কিন্তু।
হৈমন্তী নিজের কাজ করতে করতে বললো, তুই ভুলে গেছিস, ড: গুপ্তর কাছে যাওয়ার ডেট ছিল গতকাল, যখন ঋত্বিকেরা এসেছিল। মৈনাক অবাক হয়ে ভাবলো, হৈমন্তী ঠিকঠাক ডেটটা মনে রেখেছে। নিজের উত্তেজনায় ঝিলিকই ভুলে গিয়েছিল। হৈমন্তীর মনোযোগের মৃদু আলো আড়াল থেকে মৈনাককে অনুসরণ করে, এটা ওকে কিছুটা বিব্রত করলেও কেন যেন আজ খুব মানসিক আরাম পেলো।
(পরবাস-৬৭, জুন ২০১৭)