রিলিফ ক্যাম্পে ভলান্টিয়ারের কাজ করছি। শরণার্থীদের দল সকাল থেকে এসেই চলেছে একটানা। এই এতক্ষণে তাদের সংখ্যা একটু কমতে শুরু করেছে। ভরসা হয় এবার আমরাও একটু কিছু খাবার, একটু জিরোবার সুযোগ পাবো।
কদিন আগের ভুমিকম্পে মারাত্মক কাণ্ড হয়ে গেছে এসব দিকে। মূল ধাক্কা গেছে নেপালের ওপর দিয়ে, কিন্তু উত্তর বিহারেও তার আঁচ পড়েছে। আমরা কজন “সেবা” নামক একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে ত্রাণকার্যে নেমে পড়েছি। কো-অরডিনেট করছে দিল্লির এন-ডি-এম-এ।
বেলা হয়ে গেছে বেশ। প্রায় তিনটে বাজে। রোদের তেজ বেশ কড়া। শরণার্থীদের খাবার দেওয়া চলছে। খিচুড়ি। তার মধ্যেই আলু দেওয়া আছে। প্রমোদদার কড়া নির্দেশ, কাউকে আড়াই হাতার বেশী দিবি না। অনেক দিনের না খেয়ে থাকা লোকগুলো হাউমাউ করে খাবে আর তারপর ভেদবমি বা পায়খানা। প্রমোদদা অনেক রিলিফ ক্যাম্পে কাজ করেছে, লিডও করেছে – ভালো জানে সব। আমার এই প্রথম।
লোকগুলোর শোবার জন্যে চট আর ক্যানভাস দিয়ে বিশাল সাইজের তাঁবু খাটানো আছে। খেয়ে ওখানেই শুয়ে পড়বে ওরা। একপাশে ওষুধের ব্যবস্থা আছে, ডাক্তারেরও। তারই পাশে খাবার জল রয়েছে বড়ো বড়ো ক্যানে। তাছাড়া প্লাস্টিকের ড্রামে ট্যাবলেট দিয়ে জল পিউরিফাই করা হচ্ছে।
বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম। খেতে খেতে দেখলাম একটা লোক আমাদের ক্যাম্পের দিকে আসছে। বয়স্ক লোক, কোলকুঁজো, হাতে লাঠি। আমাদের এই ক্যাম্পটা যে ছোটো টিলাটার ওপর, সেটাতে উঠতেই কাহিল হয়ে গেলো। উঠে এসে হুস হুস করে হাঁপাতে লাগলো বুড়োটা।
আমাদের তালিম দেওয়া আছে। একটা বোতল থেকে একটু জল ঢেলে দিলাম তার হাতে। অঞ্জলি করে সেটা খেলো। তারপর গলার গামছাটা দিয়ে মুখে লাগা জলটা মুছে নিলো। ঘামটাও। তারপর হাতজোড় করে নমস্কার করলো।
লোকটার হাসিটা বেশ সরল। একটু নিষ্পাপ গোছের।
বললাম “ওই সামনের তাঁবুতে চলে যান। নিজের নাম, গাঁয়ের নাম সব লেখান। একাই এসেছেন তো দেখছি। বউ ছেলে মেয়ে ভাই বোন কেউ আছে নাকি?”
“নেহি বাবু। আউর কোই য়াহা তক পহুছ নেহি পায়া। বিবি তো রাস্তে মেহি চল বসি। ভাইয়ো ভি।” বললো লোকটা।
“ঠিক আছে। ওই তাঁবুতে চলে যান।”
প্রমোদদাও বেরিয়ে এসেছিলো সিগারেট খেতে। এগিয়ে এসে বললো “তাড়াতাড়ি যান। এখনো খিচুড়ি আছে। খেয়ে নেবেন’খন।”
লোকটা ঢোক গিললো। কদিন খায় নি বোধহয়। তাঁবুর দিকে হাঁটা লাগালো লাঠিতে ভর করে।
একটু বাদে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলো নির্মল। “ও প্রমোদদা – এ আরেক পাগল এসেছে।”
“কেন, কি বলে?”
“ওর সঙ্গে নাকি একটা কুকুর আছে, তাকেও থাকতে দিতে হবে। মানুষের থাকার জায়গা নেই, এনার কুকুর রাখতে হবে। কি আহ্লাদের কথা রে!!”
বুড়োটাও এই সব গোলমালে বেরিয়ে এসেছে। এবার খেয়াল করলাম একটা ঘেয়ো নেড়ি কুত্তা ওর সঙ্গে সঙ্গে এসেছে বটে।
প্রমোদদা এগিয়ে গেলো। অসম্ভব মাথা ঠাণ্ডা লোক প্রমোদদা। বুড়োটার পিঠে হাত বুলিয়ে বললো “বুঝতেই তো পারছেন, এখানে থাকার জায়গা নেই, খাবার কম। তাছাড়া রাস্তার কুকুর থেকে নানান ইনফেকশান হয়, এতো লোক তাঁবুতে একসঙ্গে আছে...”
“বাবু – উহ তো হামরা সাথহি রেহ সাকতি হেয়। থোড়িসি জাগাহ নেহি হোগা ক্যা? ছোটিসি তো হ্যায়...”
“কি করে দি বলুন। এটা কি সম্ভব?”
বুড়োটা চুপ করে রইলো। তারপর গামছা দিয়ে মুখ মুছলো। বেজায় রোদ।
তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বললো “ফির ম্যায় কৈসে রহু? ইতনি দূর মেরা সাথ দিয়া, উসে কেইসি ছড়ু? ইয়েহ ত অধরম হোগা।“
আরেকবার গামছা দিয়ে মুখটা মুছে বুড়ো বললো “বাবু, উসে থোড়া পানি পিলায়েঙ্গে?”
দেবার ইচ্ছে বিশেষ ছিলো না; মানুষের জন্যে জল নেই, তার মাঝখানে কুকুরকে আবার আদিখ্যেতা করে জল খাওয়ানো। কিন্তু প্রমোদদা চোখের ইশারা করলো বলে একটা গর্তে একটু ঢেলে দিলাম। কুত্তাটা বেশ চেটেপুটে খেলো দেখলাম।
তারপর লাঠিতে ভর দিয়ে বুড়োটা টিলা বেয়ে নেমে গেলো। সঙ্গে ওই হাড়-হতভাগা ঘেয়ো কুত্তাটা। ওপর থেকে দেখতে থাকলাম ওদেরকে – যদ্দুর দেখা যায়। একসময় আর দেখা গেলো না।
“মাথা খারাপ।” আবার বললো নির্মল।
“কি নাম রে লোকটার?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“ধরম। ধরম রাজ পাণ্ডে।”
(এই সংখ্যায় অতনু দে-র অন্য গল্পঃ 'ভোরের আগের গান')
(পরবাস-৬৭, জুন ২০১৭)