Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines






পরবাসে নিবেদিতা দত্তর লেখা



ISSN 1563-8685




আমি ইনা

রিও অলিম্পিক তখন সবে শেষ হয়েছে। সেই সময় ওখানকারই এক তরুণ বাঙালি হঠাৎ অদ্ভুত (আবার গভীরে ভাবলে অতি স্বাভাবিক) একটি মেল পান। পড়ে মনে হল গ্রহান্তর থেকে পাঠানো। এমন চিঠি তো সাংবাদিকদের হাতে তুলে দেওয়াই যায়, একেবারে হৈ হৈ ফেলে দেওয়ার মতই ব্যাপার। কিন্তু অবিশ্বাস, বিশ্বা্স, পাল্টা অবিশ্বাসের ছুরিকাঘাতে এমন একটি অভিজ্ঞতাকে ছিন্নভিন্ন করতে মন চাইল না সেই তরুণের। আর সে ভাবে দেখলে অন্য গ্রহ থেকে বাংলায় মেল কেনই বা কেউ বিশ্বাস করবে? কিন্তু আবার মনে পড়ে গেল কলেজ লাইফে সেই বিখ্যাত কথাগুলির সাথে প্রথম সাড়া জাগানো পরিচয় ‘there are more things in heaven and earth---’ তাই কোনো আলোচনা ছাড়াই নিজের রোজকার ডায়ারীতে নিচে দেওয়া চিঠিটি লিপিবদ্ধ করে রাখল সে।

সুধী,

আমার এই মেল পেয়ে অবাক হওয়ারই কথা তোমার। কারণ তোমাদের কাছে আকাশ শুধু তোমাদেরই। সূর্য তারা তোমাদের জন্যই ওঠে, জাগে। সারা বিশ্বে তোমরাই একক — একমাত্র উন্নত চিন্তাধারাসম্পন্ন প্রাণী। এমন ভাবাটাকে আমি দোষ দিই না। কিন্ত মজার কথাটা কি জানো তোমাদের অজান্তে তোমাদেরই গতিবিধির ওপর আমরা চোখ রেখে চলেছি যুগ যুগান্ত ধরে।

এতদিন তো একাই ছিলাম, নিজের কথা কাউকে বলার প্রয়োজন জাগেনি। আজ কেন জানি না কিছু বলতে চাইছি, তাই এই চিঠি। হয়তো আমারও বিবর্তনের সময় শুরু হ’ল বলে।

কখনো কখনো আমাদের খানিক আভাস তোমরা পেয়ে থাকো, কিন্তু তা নেহাতই সামান্য। তোমাদের মাঝে কেউ কেউ আছেন যাঁরা আমাদের নিয়ে মাথা ঘামান কিন্তু সেসব চিন্তা প্রায়শই অসম্পূর্ণ। আর যেহেতু আমাদের সম্বন্ধে তোমাদের কোনো পুরো তথ্য নেই তাই খানিক সত্য আর বেশিরভাগই কল্পনা দিয়ে তোমরা আমাদের গড়ে তুলেছ। কখনো অদ্ভুত শরীর দিয়েছ, কখনও তোমাদের নিজেদের দৈহিক গঠন, কখনো ওড়ার শক্তি। আবার মাঝে মাঝে নানান অস্ত্রশস্ত্র দিয়েও আমাদের সাজিয়ে তুলেছ। আমরা কিন্তু এসবের কোনোটাই নই। সহজ করে যদি বলা যায় তো বলি আমরা শুধু রশ্মি শক্তি। যে প্রচণ্ড শক্তি গ্রহ গ্রহান্তরে ছড়িয়ে আছে আমরা তারই পুঞ্জীভূত প্রকাশ মাত্র। আমাদের গ্রহ তোমাদের পৃথিবীর মত এত রং রসে ভরপুর নয়। এক বিরাট শূন্যতায় আছি আমরা, আর দূ্রদূরান্ত থেকে চেয়ে আছি তোমাদের দিকে। তোমাদের হাসিকান্না, শক্তি এমনকি অক্ষমতাও আমাদের অধরা, তাই তা ঈর্ষা করারই মত, যদিও বলে রাখি আমাদের ঈর্ষা করার ক্ষমতাও নেই ভালবাসারও না। শুধু এক ধরনের টান অনুভব করি তোমাদের জন্য।

হয়তো ভাবছ ভাষাটা কি আমাদের। কিছুই না--শুধুই রশ্মি সংকেত। এই যে তোমাদেরই একটি ভাষায় এত কথা বলছি, সে তো আমি প্রচণ্ড ইচ্ছাবলে তোমাদের ওই ধরিত্রীতে এসে শিখেছি।

আমাদের যে মাধ্যমে তোমাদের গতিবিধি ধরা পড়ে, আনমনে সেটার কাছাকাছিই ছিলাম। দেখলাম তোমাদের পৃথিবীর এক কোনায় রিও নামে একটি শহরে যাকে তোমরা খেলাধূলা বলো তার বিরাট ব্যবস্থা হয়েছে। তাকে তোমরা অলিম্পিক বলছ। এসব তো আমাদের ধ্যানধারণার বাইরে। যাইহোক মাধ্যমটি ঠিকমতো কাজে লাগাতেই সবকিছু আরো ফুটে উঠল। আমি এক অদম্য ইচ্ছার পাকে পড়ে ঠিকই করে ফেললাম তোমাদের কাছে রিও শহরে একবার ঘুরে আসি।

আমি যেহেতু এক আলোকরশ্মি, তাই গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ভেসে যাওয়াটা আমার পক্ষে কিছুই না। যাদের পাশাপাশি পৌঁছালাম, শুনে শুনে তাদের ভাষাটাই শিখলাম। পরে অবশ্য আরও কৌতূহলী হয়ে জেনেছিলাম ভারতবর্ষ নামে এক বৃহৎ ভূখণ্ডের এক রাজ্যের ভাষা এটা। অবাক হচ্ছ তো! আবারও বলি আমাদের উন্নত শক্তির পক্ষে এটা একেবারেই অসম্ভব নয়। কিন্তু দেহধারণের পালায় এসে পড়লাম ফাঁপরে,—নারী না পুরুষ কোনটা? (তোমরা যেমন ভাগ করে থাকো সেইমতোই লিখছি)। নারীই পছন্দ হল,— কেমন সুন্দর দেহসৌষ্ঠব, কি কমনীয়তা, মনে হল আমায় এটাই মানাবে।

আমায় দেখে কেউ বিস্মিত হয়নি দেখলাম। যদিও আমার রশ্মি আমি পুরোপুরি ঢেকে রাখতে পারিনি। কি করে বুঝলাম জানো? তোমরা যাদের শিশু বলো তাদের আমারও ভারি ভালো লেগেছে। লোভ জেগেছিল ওদের একটু ছুঁয়ে দেখি — পথের ধারে, সমুদ্রসৈকতে ওরা আপনমনে খেলছিল — আমি এগিয়ে ওদের একজনকে স্পর্শ করতেই সে যেন ছিটকে সরে গেল — তাই মনে হয়েছে আমার রশ্মিশক্তির ক্ষমতা ওদের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল বোধহয়! যাইহোক অবাধে ঘুরেফিরে সবকিছু দেখছিলাম, তোমাদের থেকেই ধার করা দৃষ্টিশক্তি দিয়ে। যখন সবকিছু নিঝুম হয়ে গভীর রাত নেমেছে আমি তখন তারা হয়ে তোমাদের আকাশে কাছেপিঠেই থেকেছি। এখানে ভারি বলতে ইচ্ছা জাগছে আমাদের সকাল বিকাল এত মনোলোভা নয়। আমাদের কেবলই আলো, কেবলই আঁধার। এত পাখির কলতান, এমন ঝিরঝিরে বাতাস আমাদের আকাশে বয় না। তোমাদের মত দেহসৌষ্ঠবও তো আমাদের নেই, দেহই নেই, তাই দেহধারণ করে ভারি ভাল লেগেছে, মনে হয়েছে এই দেহতে যদি আমি চিরতরে থাকতে পারতাম! —নাহ্‌--এমন চিন্তা তো আমার স্বাভাবিক নয়, বোধহয় তোমাদের মাটির গুণেই এ সম্ভব হয়েছে।

একদিন এক সকালে দেখি একজন পুরুষদেহধারী আমায় যেন লক্ষ্য করছে, কি ভাবে তা হ’ল জানি না। সে কিন্ত আমার সাথে সাথেই ছিল সারাক্ষণ। পরে জেনেছিলাম ওর একটা নামও আছে — ম্যাক্স। সেই ম্যাক্স কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সাথে আলাপ জমিয়ে ফেলেছিল— কোথায় থাকি, কেমন লাগছে রিও, এবং সবশেষে, আমার নাম কি? কি করে বলি আমি নামহীন! আর গ্রহান্তর থেকে এসেছি বললে কি বিশ্বাস করত? তাই রিওতে হওয়া বিভিন্ন ক্রীড়ার নাম, খেলোয়াড়দের নিয়ে আলোচনা করে কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলাম। (এখানেই বলি যে-খেলাটিকে তোমরা সাঁতার বলো তা-ই আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে। এক তরল পদার্থ, যাকে জল বলো তাতে সুন্দরভাবে হাত পা নেড়ে এগিয়ে যাওয়া — দেখে আমি সত্যিই বিস্মিত। এমনটা যে করা যায় আমি কোনোদিনই ভাবিনি।) যাইহোক এত এ-কথা সে-কথা সত্ত্বেও ম্যাক্সকে স্পষ্টতই হতাশ দেখাল একটু। আবার দেখা হবে বলাতে আমিও সায় দিয়ে ভিড়ে মিলিয়ে গেলাম।

সযত্নে এড়িয়ে গেলেও ম্যাক্স আবার জুটে গেল। যেন ওকে আমাতে পেয়েছে। বলতে লাগল ‘চলো তোমাকে রিও দেখিয়ে আনি।’ রাজি হব কিনা ভাবছিলাম। তবে ওকে একটা কথা না বলে পারলাম না। এই খেলাধূলাই বোধহয় ওর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তোমাদের পরস্পরের হানাহানি, বিদ্বেষের কথা সাংকেতিক মাধ্যমে আমাদের কাছে যে পৌঁছায় না তা নয়, আমরা তো ধারণা করেই নিয়েছিলাম পৃথিবী বলতে শুধু এই। এলাম বলেই তো তা পাল্টে গেল। যা দেখলাম সত্যিই তুলনাহীন। তোমাদের এত মনোবল, এত ভ্রাতৃত্ববোধ, — এ যেন তোমাদের খেলাধূলার আঙ্গিনাতেই ফুটে ওঠে। কি পেশীবহুল দেহ খেলয়াড়দের। জানি না কত যুগের প্রতীক্ষার পর আমরা এর কাছাকাছি আসতে পারব!

যা বলছিলাম, ম্যাক্সের এই আমার দিকে ঝোঁকাটা আমার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াচ্ছিল (ওর পক্ষেও হয়তো)। হৃদয় বলতে তোমরা যা বোঝ তা তো আমার নেই। তাই খামোকা হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর আখ্যাই বা পাই কেন? কিন্তু তা বোধহয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়াল। আরও কাছাকাছি এসে যাব এই ভেবে রিও দেখার প্রস্তাবে সায় দিলাম না। কিন্তু এক সময়ে ম্যাক্স আমাকে বলেই বসল আমি সুন্দরী কিন্তু হৃদয়হীনা। কি করে বোঝাতাম ওকে আমার সবই ক্ষণিকের। আমি নারী পুরুষ কোনোটাই নই, তাই সুন্দর অসুন্দর, হৃদয়বান, হৃদয়হীন — কিছুই আমায় প্রযোজ্য নয়।

রিওর খেলাধূলার পর্বও শেষের দিকে চলে এল, আমি ফিরে যাবার কথা ভাবতে শুরু করে দিলাম। এক সন্ধ্যায় তোমাদের এত সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে রিওর আলোকসজ্জা, আকাশে ছোঁড়া আতসবাজির মাঝে মিশে ফিরে চললাম আমার গ্রহে। জানি না কি হ’ল আমার — কোনো এক অজানা ভাবাবেগের অধিকারিনী হয়ে ম্যাক্সের জন্য রেখে গেলাম অনেক শুভেচ্ছা।

তুমি কোনোদিনও হয়তো আমার এ-চিঠির উত্তর দিতে পারবে না। তবু একটা প্রশ্ন তোমার কাছে রেখে গেলাম। সব দেখেশুনে মনে হ’ল তোমরা নিজেদের যতটা প্রাধান্য দাও বৃক্ষাদিকে ততটা নয়, আর দেখো আমরা কি কঠিন প্রতীক্ষায় আছি আমাদের গ্রহ কবে এত শ্যামলিমায় ভরে উঠবে। বোধহয় এর উত্তর তোমার কাছেও নেই।

নামটা আবার জানতে চাইছ? তোমাদের দেখাদেখি আমার নিজেরও একটা নাম নিতে ইচ্ছে হচ্ছে---ধরে নাও আমি ইনা। তাই সবশেষে লিখি--

শুভেচ্ছা জেনো,
ইতি ইনা




(পরবাস-৬৭, জুন ২০১৭)



অলংকরণঃ আন্তর্জাল থেকে