কোন বাঙালির বাড়ি গেলে কিছুক্ষণ বাদেই গৃহকর্ত্রী বা কর্তা থেকে অনুরোধ আসবেই--‘একটু চা খাবেন তো?’ সেই অনুরোধ ফেলা মুশকিল--‘না, না, একটু চা না-খেলে কি করে চলবে।’ আসলে চা খাওয়ানো আতিথেয়তার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সুতরাং ইচ্ছে না থাকলেও চা খাওয়ার অনুরোধ নাকচ করে দেওয়াটা প্রায় গৃহস্থকে অপমান করার মত। অন্যভাবে বললে বলতে হয় যে চা খাওয়ার নেশাটা বাঙালির সামাজিকতার সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ শ-তিনেক বছর আগেও অবিভক্ত বাংলা অর্থাৎ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সমগ্র অঞ্চলে বা ভারতবর্ষে চা-র কোন নামগন্ধ খুঁজে পাওয়া যায় না। অতিথি আপ্যায়ন সে-কালেও ছিল। আর সেই আপ্যায়নের অন্যতম অঙ্গ ছিল অতিথিকে জল ও গুড় বা বাতাসা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করা। তাহলে জল ও গুড় বা বাতাসা চা-তে পরিবর্তিত হল কি করে? অবিশ্বাস্য মনে হলেও সে কথা জানতে আমাদের পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাতে হবে।
ব্রিটিশ রাজতন্ত্র বা মনার্কির সবচেয়ে বড় উপনিবেশ বা কলোনী ছিল ভারতবর্ষ--দ্য জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন। কিন্তু ১৮৫৮ সালের আগে সেখানে বকলমে রাজত্ব চালাতো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী--এই শাসনকে বলে হত “কোম্পানীর শাসন”। ভারতের পর ব্রিটিশ মনার্কির সবচেয়ে বড়ো কলোনী ছিল উত্তর অ্যামেরিকা। যদিও অ্যামেরিকান কলোনীতে যারা বসবাস করতো তারা ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে ভাষা, ধর্ম, চেহারা--এসব ব্যাপারে ছিল একেবারে এক, তাদের মধ্যে সম্পর্কটা কিন্তু ছিল শাসক আর শাসিতের। ভারতবর্ষের মতো অ্যামেরিকান কলোনীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ছিল রমরমে ব্যবসা, যদিও ‘কোম্পানী’ কোনোদিন সেখানে রাজত্ব চালায় নি।
কিন্তু রাজত্ব না চালালে কি হয় লন্ডনের রাজা বা রানি আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে ছিল গভীর গলাগলি। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শেয়ার-হোলডার বা অংশিদারদের সবাই ছিল লর্ড, ব্যারন বা ব্রিটিশ নীল রক্তের অন্তর্গত লোক ও কিছু বড় ব্যবসায়ী। তাই অ্যামেরিকান কলোনীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ছিল একেবারে একচেটিয়া ব্যবসা। আর সেই ব্যবসার অন্যতম পণ্য ছিল ‘চা’।
অ্যামেরিকায় গিয়ে যারা প্রথম বাসা বেঁধেছিল তারা নতুন জায়গায় বসবাস শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে আসে তাদের নানান আমোদ-প্রমোদ ও অভ্যেসের উপকরণ। তার মধ্যে অন্যতম ছিল চা খাওয়া। আর কলোনীর সেই চায়ের যোগান দিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। সেই চায়ের ওপরে একসাইজ ডিউটি বা শুল্ক ছিল অত্যন্ত কড়া। তাই অ্যামেরিকান কলোনীর লোকজন তাদের চায়ের নেশা মেটাতে চা কিনতে আরম্ভ করে চোরা-পথে, চড়া শুল্ক এড়াতে। অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর গুদামে চা জমতে থাকে পাহাড়-প্রমাণ।
কলোনীর লোকজনের এই ব্যবহার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আর তার পৃষ্ঠপোষক ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের একেবারে পছন্দ হয় নি। তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে ১৭৭৩ সালের মে মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চালু হয় ‘টী অ্যাক্ট’। এই আইন অনুসারে অ্যামেরিকান কলোনীর চা-পায়ী লোকজনদের বাধ্য করা হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চা কিনতে।
টি অ্যাক্ট চালু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে তিন জাহাজ-ভর্তি চা ইংল্যান্ড থেকে অ্যামেরিকার উত্তর-পুর্বে ম্যাসাচুসেটস প্রদেশের বস্টন শহরের বন্দরে নোঙ্গর করে। তাদের উদ্দেশ্য সেই জাহাজ-ভর্তি চা বস্টনে নামিয়ে তার দাম-সহ খালি জাহাজ ইংল্যান্ডে ফেরত যাওয়া। তার বদলে ১৭৭৩ সালের ১৬-ই ডিসেম্বর বেশ কিছু লোকজন রেড ইন্ডিয়ান বা নেটিভ অ্যামেরিকানদের ছদ্মবেশ নিয়ে সেই বাক্স-বাক্স চা সমদ্রের জলে ভাসিয়ে দেয়।
ব্রিটিশ শাসকবর্গ তাদের তাঁবে থাকা, তাদেরই কর দেওয়া লোকজনের এই আচরণ মোটেই ভালো চোখে দেখে নি। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই ‘চা বিদ্রোহে'র বিরুদ্ধে নানা দমন-মুলক আইন জারি করা হয়। কিন্তু শাসক ও শাসিতের এই আপাত: মামুলি সংঘর্ষ দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে সারা কলোনীতে। এই ঘটনাই অ্যামেরিকান স্বায়ত্বশাসনের দাবী ও স্বাধীনতার আন্দোলনে স্ফুলিঙ্গের কাজ করে।
এদিকে বস্টনের ‘চা বিপ্লব’-এর ফলে ব্রিটিশ শাসক ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বিরাট ফাঁপরে পড়ে। বস্টনে যা চা নষ্ট হয়েছে তার অনেক বেশি কোম্পানীর গুদামে পচছে--তার কি ব্যবস্থা হবে! একটা কাল্পনিক কথোপকথন দিয়ে পরিস্থিতিটা বোঝানো যায়।
ক: এই বিপুল পরিমাণ চা ইঁদুর আর পোকায় শেষ করেছে। এগুলো নষ্ট হলে বিশাল লোকসান। অ্যামেরিকান কলোনীতে তো আর পাঠানো যায় না। তাহলে এগুলো কোথায় বেচা যায়?
খ: কেন ইন্ডিয়াতে?
ক: ইন্ডিয়াতে? সেখানে নেটিভদের তো চা খাওয়ার মতো রীফাইন্ড টেইস্ট নেই!
খ: নেই তো কি, সেই টেইস্ট তৈরি করাতে হবে।
ক: টেইস্ট তৈরি করানো যায় নাকি?
উ: আরে, তাহলে আমরা ব্যবসা করছি কিসের জন্য!
ক: তাছাড়া জল গরম করতে হবে, তাতে চা দিতে হবে, দুধ চাই--এসব আসবে কোথা থেকে?
খ: আরে সব আসবে। এর জন্য চাই একটা বিরাট অ্যাডভারটাইসিং ক্যাম্পেন।
ক: হুঁ, আর সেই ক্যাম্পেনে আমাদের কে সাহায্য করবে?
ক: কে আবার। খুঁজে বার করো ইন্ডিয়ার এখন গভর্নর কে। তাকে হাতে আনতে পারলে আমাদের আটকায় কে।
ক: মি: ওয়ারেন হেস্টিংস।
খ: আরে সে তো আমাদেরই লোক। তাহলে চলো ক্যালকাটা।
ক: আরে ক্যালকাটা তো যাবো, কিন্তু আমাদের টী-লঞ্চিং এর জন্য তো একটা বড় ইভেন্ট দরকার।
খ: আরে সে আমরা ওখানে গিয়ে ঠিক খুঁজে পাবো। আই হার্ড সাম মাহারাজ ন্যান্ডোকুমার ইস গোয়িং ট্যু বী হ্যাংড স্যুন ফর গোয়িং এগেনষ্ট দ্য কম্পানী। আই হিয়ার দ্য এন্টায়ার সিটি উইল বী দেয়ার ট্যু উইটনেস ইট। এর চেয়ে ভালো সময় আর কি হতে পারে।
ক: ট্রু। ক্যালকাটা, হিয়ার উই কাম।
সতেরশো পঁচাত্তর সালে পৃথিবীর দুই গোলার্ধের আপাত: সম্পর্কহীন দুটি ঘটনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সতেরোশো তিয়াত্তরের ‘চা বিদ্রোহ’-এর ফলশ্রুতি হিসাবে ১৭৭৫-এর এপ্রিল মাসে বস্টনের উত্তরে লেক্সিংটন-কনকর্ড শহরে অ্যামেরিকান বিপ্লবের শুরু হয় ও উত্তর অ্যামেরিকায় ব্রিটিশ শাসনের অবসানের ঘন্টা বাজতে আরম্ভ করে।
পৃথিবীর অন্য প্রান্তে, ভারতবর্ষের বুকে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মারফত ব্রিটিশ শাসনের থাবা ক্রমশ: শক্ত হয়ে চেপে বসেছে। কোম্পানীর শাসকদের স্পর্ধা ও দৌরাত্ম্যের ঘটনা উর্ধ্বমুখী। তাদের আশা একদিন তারা নিষ্কন্টকে ভারতের বুকে শাসন চালাতে পারবে। এর মধ্যে পলাশির যুদ্ধে মোগল ও মুসলমান রাজন্যদের দাঁত-নখ সব ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আর হিন্দু রাজাদের তো মুসলমান শাসকরাই শেষ করেছে অনেক আগে। সুতরাং কোম্পানীর শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারোর নেই।
সতেরশো চৌষট্টি সালে তখনকার বেঙ্গল প্রেসিডেনসির গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে গভর্নর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর সেই একই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মহারাজ নন্দকুমারকে বর্ধমান, নদীয়া ও হুগলী জেলার জন্য ট্যাক্স কালেক্টর বা দেওয়ান হিসাবে নিযুক্ত করে। এই দেওয়ানরাই ছিল সাধারণ লোকদের মেরে-কেটে, ঘরে আগুন লাগিয়ে, বাড়ির বৌকে তুলে নিয়ে খাজনা আদায় করার ব্যাপারে কোম্পানীর মুখপাত্র। সুতরাং মহারাজ নন্দকুমারের যে দেশের লোকের জন্য প্রাণ কাঁদত তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তিনি দেওয়ান হওয়ার পর জানতে পারেন যে আদায়ী রাজস্বের সিংহভাগ চলে যায় ইংল্যান্ডে, বাকিটা যায় ইন্ডিয়াতে কোম্পানীর লোকেদের পকেটে আর দেশের লোকেদের জন্য ছিটে-ফোঁটাও পড়ে থাকে না। তাই ১৭৭৩ সালে এই নিয়ে তিনি বাংলার সুপ্রিম কাউনসিলের কাছে আবেদন করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তখন হেস্টিংসদের বিচার চলছে, তাই কলকাতায় মহারাজা তাঁর আবেদন সমর্থন করার লোক পেয়ে যান সুপ্রিম কাউনসিলে। ঘটনার পাকে-চক্রে মহারাজ নন্দকুমার হয়ে দাঁড়ান এক সম্পূর্ণ অভাবনীয় দেশপ্রেমী বা মোস্ট আনলাইকলী পেট্রিয়ট।
ইতিমধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ওয়ারেন হেস্টিংস বেকসুর খালাস পেয়ে বাংলা প্রেসিডেন্সির গভর্নর জেনারেল হিসাবে আবার নিযুক্ত হয়েছেন। মহারাজার সুপ্রিম কাউনসিলের কাছে আবেদন হেস্টিংসের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়--যার জন্য খাই, যার জন্য পরি--তারই উপড়োতে চাই দাড়ি! মি: হেস্টিংস কাউন্টার-চার্জ আনেন যে মহারাজা আবেদনের স্বপক্ষে যে-সব কাগজপত্র পেশ করেছেন তা সব জাল। মহারাজের বিরুদ্ধে এই মামলা লড়তে গিয়ে তিনি পেয়ে যান এক বিশেষ বন্ধুকে--তিনি বেঙ্গল সুপ্রিম কোর্টের প্রথম চীফ জাস্টিস, মি: ইলাইজা ইম্পে। প্রধানত: মিঃ ইম্পের সাহায্যেই মহারাজার বিরুদ্ধে জালিয়াতির স্বপক্ষে রায় বেরোয় ও শাস্তি হিসাবে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির হুকুম হয়। ভারতবর্ষে কোম্পানীর ইতিহাসে এই ঘটনা একেবারে প্রথম।
সতেরশো পঁচাত্তর সালের পাঁচই অগাস্ট সারা কলকাতা ভেঙে পড়েছে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি দেখতে। বধ্যভূমির চার দিক গোরা পলটন ঘিরে রেখেছে যাতে সেখানে কোনো মাছিও ঢুকতে না পারে। তার পরেই শ্রেণির পর শ্রেণি চেয়ার পাতা। সেখানে বসে আছেন গভর্নর জেনারেল মি: হেস্টিংস, চীফ জাস্টিস মি: ইম্পে ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর স্যুট-বুট পরা নানান লোক। সেখানে রয়েছে তাদের স্ত্রীরা। তারাও সেজে-গুজে ছুটির মেজাজে এসেছে। অগাস্টের সূর্যের রোদ এড়াতে তাদের হাতে সুদৃশ্য ছাতা। ইংরেজি কথার গুঞ্জন উঠছে। এদের ঠিক পিছনের শ্রেণিতেই রয়েছেন বাঙালি রায়-বাহাদুর, রাজা সম্প্রদায়ের লোক। তারা মহারাজা নন্দকুমারের ব্যবহারে অত্যন্ত লজ্জিত। তাই তাঁর চরম সাজা উপভোগ করতে এসেছেন, যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোনো নেটিভ এই কাজ করার সাহস না পায়। তাঁদের সঙ্গে আছে আবার কিছু মোসাহেব। তারা তাদের মনিবদের সুখ-আরামের ব্যবস্থা করতে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। আর সবায়ের পিছনে খোলা মাঠ। সেখানে কাতারে-কাতারে সাধারণ লোক এসেছে তাদেরই একজনের ফাঁসি দেখতে।
দিনটা ভারি সুন্দর। রোদে ভেসে যাচ্ছে। চারদিকে একেবারে মেলার আবহাওয়া। এই সুযোগে নানান ব্যবসায়ী এসেছে দু-পয়সা রোজগারের আশায়। তারা মাঠের ঘাসের ওপর চাদর বিছিয়ে তাদের জিনিসপত্র বিছিয়ে রেখেছে। কোথাও বিক্রি হচ্ছে পুঁতির মালা, কোথাও হার-দুল, কোথাও আবার মাটির পুতুল। কোথাও আবার টং-টঙ্গা-টং ঘণ্টা আর কাঁসি বাজিয়ে সং-এর নাচ হচ্ছে। কোথাও হচ্ছে কথকতা।
ফাঁসি-কাঠটা বেশ একটু উঁচুতে--যাতে সবাই ঝুলন্ত অপরাধীকে দেখতে পায়। জানতে পারে কোম্পানীর শাসনের বিরুদ্ধে যাওয়ার ফল। তা ছাড়া আর একটা জায়গা কারোর চোখ এড়ানো মুশকিল। সেটা হল একটা মস্ত তাঁবু--মাঠের অন্য পাশে। সেখানে বড়-বড় করে বাংলায় লেখা বিজ্ঞাপন--এখানে বিনা মূল্যে চা পাওয়া যায়। এটা পড়ে কিছু লোক হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে--তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে--‘চা আবার কি। একজন অন্যজনের গা ঠেলাঠেলি করছে--চল না, দেখি চা-টা আবার কি বস্তু।
তাঁবুর একপাশে উঁচু করে দাঁড় করানো বড় বড় কাঠের বাক্স। তাদের গায়ে ইংরেজিতে বড় অক্ষরে লেখা - টী। অন্যদিকে একটা মস্ত উনুনে গনগনে আগুন আর তার ওপরে একটা মস্ত গামলায় জল ফুটছে। একটা ঢেঙা-পানা লোক তারস্বরে চেঁচাচ্ছে— 'চা লিয়ে যান, চা লিয়ে যান' আর জলটা ফুটে উঠলেই পাশে রাখা একটা গামলায় ঢেলে কালচে বাদামী রঙের গুঁড়ো-গুঁড়ো কি একটা তাতে ঢেলে দিচ্ছে। আর একটা লোক একটা ছাঁকনিতে সেটা ঢেলে একটা বাদামী রঙের তরল সার-সার সাজানো মাটির ভাঁড়ে ঢেলে দিচ্ছে, আর তার মধ্যে দিচ্ছে একটু দুধ, আর কয়েক চামচ চিনি। ভাঁড়ে তরলটা নেড়ে দিয়েই তারস্বরে চেঁচাচ্ছে — 'চলে আসুন, চলে আসুন--চা খান সাহেবদের মতো। এক্কেবারে মাগনায়।' কোম্পানীর এক সাহেব এইসবের রক্ষণাবেক্ষণ করছে।
সেই তাঁবুর সামনে কতোগুলো লোক হুস-হুস করে ভাঁড়ে চুমুক দিচ্ছে আর উত্তেজিতভাবে পাশে দাঁড়ানো লোকদের বলছে — 'খেয়ে দেখ, মাইরী, কি ভালো। সাধে কি সায়েবরা এটা রোজ খায়। আরে এই জন্যেই তো ওরা এতো ফর্সা। আমাদের মত কালো-কুচ্ছিত নয়।' আর এক লোক আর একজনকে বলছে — 'আরে, আমাদের পঞ্চা এক সায়েবের বাড়ি কাজ করে। ও বলে সায়েব-মেমের সক্কালে উটেই চা চাই। একদিন এট্টু দেরি হয়েছিল বলে চাবুক খেতে হয়েছিল কয়েক ঘা।'
আর একজন বলছে — 'কি মজারে রে। সাধে কি একানে এয়েছি। ফাঁসি দেখা হবে, আবার মাগনায়- মাগনায় চাও খাওয়া হবে।'
এই ফাঁসির মেলায় শিবের সং-ও এসেছে। মুখে রং মেখে শিব আর নন্দী-ভৃঙ্গি সাগরেদরা নেচে নেচে শিবের গাজন গাইছে। তাদের সামনে কিছু লোক হাঁ করে দাঁড়িয়ে তাই দেখছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভিড় আর একদল সং-এর সামনে। তাদের গায়ে বিচিত্র জমকালো সাজ, মাথায় লম্বা টুপি। তারা মুখের কাছে চোঙ্গা লাগিয়ে তারস্বরে নানারকম ছড়া কাটছে। একজন বলছে—
এসো, এসো ভাইসবনাচতে নাচতে একপাক ঘুরে নিয়ে সে আবার ধরছে—
চলে এসো এইখানে
এয়েছে কোম্পানীর রাজ
মজা করো প্রাণপণে।
দয়ার শরীল তাদেরআর একজন গান ধরেছে ঢপ কীর্তনের ঢঙ্গে —
পেন্নাম হই খুরে খুরে
এয়েছে কোম্পানীর রাজ
নাচি-গাই ঘুরে-ঘুরে
সখিগো-আর একজন ধরেছে দেহতত্ত্বের খেউড়—
থেকোনা, থেকোনা, দূরে সরে
চা পাবে মাগনায়
কোম্পানীর পয়সায়
খেয়ে নাও, খেয়ে নাও প্রাণভরে।
সখিগো---
চা খাও ঢুকু-ঢুকুএদের সামনে বেশ কিছু লোক হাঁ করে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে আর হাততালি দিচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সাহস করে এগিয়ে গিয়ে চায়ের ভাঁড় তুলে নিয়ে সুড়ুৎ-সুড়ুৎ করে চুমুক দিচ্ছে, আর আহা: আহা: করছে। অন্যদিকে যে মহারাজের ফাঁসির যোগাড়-যন্তর সব শেষ, সে ব্যাপারে কারোর কোন হুঁস নেই।
নেশা হবে একটুকু।
যেমন মাগের বদন ধরে--
মধু খাওয়া মন ভরে--
খেয়ে লাও, খেয়ে লাও
চায়ে আছে সবটুকু।
হঠাৎ বিকট শব্দে তিন বার তোপ পড়লো। এইবার ফাঁসি হবে। কিন্তু চা-পায়ী আর মজা দেখতে জড় হওয়া লোকজনের তাতে কোন হেলদোল হল বলে মনে হল না। সং-গুলোর নাচে-গানের হট্টগোলে অন্যদিক থেকে ভেসে আসা মার্চিং ব্যান্ডের বাজনায় ‘গড সেভ দ্য্য কুইন’ প্রায় শোনাই গেল না।
ইতিমধ্যে দুপুর কাটিয়ে বিকেল এসে সন্ধে আসবো-আসবো করছে। মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি হয়ে গেছে। সাহেবরা যে যার বাড়ি চলে গেছে। আর পলটনের দল ফিরে গেছে তাদের ব্যারাকে। মাঠের এইদিকে কেউ নেই। কিন্তু মস্ত মাঠের অন্য দিকে চায়ের তাঁবুর আশেপাশে লোকে একেবারে লোকারণ্য। খালি শোনা যাচ্ছে চা খাওয়ার সুড়ুৎ-সুরুৎ আওয়াজ। বিড়ির গন্ধে সারা জায়গাটা ভারি হয়ে রয়েছে।
কলকাতার সাহেবদের ঘনিষ্ঠ লোকজন মহারাজার ফাঁসি শেষ হওয়া অবদি সাহেবদের গায়ে লেপ্টে ছিল। এখন তাদের কেউ-কেউ, তাদের মোসাহেব সহ মাঠের এ-দিকে মজা দেখতে হাজির। কোম্পানীর লোক এই ব্যাপারটাই আশা করছিলো। তাই বাবুদের জন্য আলাদা করে চায়ের কাপ প্লেটের ব্যবস্থা ছিল, আর ছিল বিড়ির বদলে অম্বুরী তামাকের বোলবোলার ব্যবস্থা। এখন দেখা গেল প্রথম দিকের মজা দেখতে আসা গরীব-গুর্বো লোকেরা পিছু হটেছে। তার বদলে কিছু বাবু আর তাদের মোসাহেবরা চারিয়ে-চারিয়ে চা খাচ্ছে দুধ সাদা কাপ-প্লেটে। দেখা গেল তাকিয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। বিড়ির বদলে অম্বুরী তামাকের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ রব উঠলো-- জয় কোম্পানী বাহাদুরের জয়।
আস্তে-আস্তে মাঠে অন্ধকার নামলো। সেই প্রায়ান্ধকারে দেখা গেল মহারাজার নিষ্প্রাণ দেহ অল্প-অল্প হাওয়ায় দুলছে।*
*এটা ঐতিহাসিক দলিল নয়। তবে দিন-ক্ষণ-তারিখ ইতিহাস-সম্মত।
(পরবাস-৬৭, জুন ২০১৭)