এখন শিমূল ছাড়া আর কোন বন্ধু নেই –
নিষ্পত্র ডালের ভাঁজে লাল ফুল জ্বেলে
কথা বলে মনে মনে, আমি শুনি
আমি বলি সেও – তার মত করে শুনে চলে।
মানুষের কাছে গিয়ে মন খুলে কথা বলে
এবং সে পরিণামে ব্যথা পেয়ে পেয়ে –
এখন বিরতি ঋতু, এখন ক্লান্তি লাগে।
নদীর নরম জলে মুখ ধুয়ে,
পাড়ে থাকা নুড়িদের সাথে কথা বলি,
হাত রাখি জল মাখা মসৃণ গায়ে তার,
কি দরদে ভালবাসে, কথা বোঝে, ব্যথা বোঝে তারা –
শান্তির সুতো দিয়ে কাঁথা বোনে
আমাকে আড়াল দেয়।
এখন সপ্তর্ষির যূথ ছাড়া আর কোন বন্ধু নেই।
ঘোলাটে ধূসর রঙ আকাশের নীচে বেপথু শয়ানকালে
ঝুঁকে পড়ে খোঁজ নেয় সাত ঋষি,
পৃথিবী কেমন ছিল সারাদিন! বলে যায়
কাল ভোরে সূর্য ওঠার কথা আছে,
সবকিছু ঠিকঠাক চলে যদি।
সেইটুকু সান্ত্বনা নিয়ে আরামে ঘুমাতে যাই।
ভারতবর্ষ
এই প্রায়াব্ধ সন্ধ্যায় আমি ভারতবর্ষের ম্যাপ খুলে বসেছি,
পড়ন্ত সূর্যের মৃদু আলোয় আমার দেশকে চিনবো বলে।
একদিন দেশকে মা ডেকে কত গান লেখা হয়েছে বুকের তলায় ঝাঁকি দিতে
পুরোনো কত কবিতা পড়ে চোখে জল এসেছে -
আমার আঙুল নাগাল্যান্ড, মণিপুর স্পর্শ করে
তিস্তা তোর্সার স্রোত ধরে, কাশ্মীর থেকে গুজরাট হয়ে কন্যাকুমারী ছুঁয়ে যাচ্ছে,
একি আমার দেশ? আমি একে চিনি?
যখন বন্দেমাতরম গান গাই, আমি কি এই মায়ের কথাই বলি?
আমি এদের সকলের ভাষা বুঝি? ওরা সবাই আমার ভাষা বোঝে?
আমি কি এদের সঙ্গে স্কুলে পড়েছি? প্রেয়ার হলে গান গেয়েছি একসঙ্গে?
টিফিন ভাগ করে খেয়েছি কখনও?
আমার জন্মদিনে এসেছিল এরা? ওদের বিয়েতে আমায় নিমন্ত্রণ করেছে?
আমার মনে পড়ে না।
আমি মহীরুহ বৃক্ষের মত আভূমি প্রোথিত হয়ে অনুভব করতে চাইছি
ভুলে যাওয়া গর্ভজল,
বৈশাখের তাপে শুকিয়ে যাওয়া আত্রেয়ীর বালিতে মুখ গুঁজে
স্বাদ নিতে চাই শৈশব মাতৃদুগ্ধের
গঙ্গা অববাহিকায় সমস্ত শরীর বিছিয়ে ছুঁয়ে নিতে চাই
খাওয়ার পরে মুখ মুছিয়ে দেওয়া মায়ের আঁচল,
রান্নাঘরের গন্ধমাখা।
কোথাও কোন ভুল হচ্ছে, আমার কিছুই স্মরণে আসছে না।
এ যদি আমার নিজস্ব সাড়ে তিন হাত ভূমি হবে
কেন আমার বাড়ানো হাতে এখনও একটি আঙুলও এসে স্পর্শ করে নি,
আমার কথা বোঝে না কেউ,
আমি মা বলে ডাকলে কেউ সাড়া দিচ্ছে না।
দিনের আলো অনেকক্ষণ নিভে গেছে,
এই অন্ধকারে কেন তবে আমার ফেরার কোন ঘর নেই,
কেউ অপেক্ষায় বসে নেই উৎকন্ঠ প্রহর গুণে।
তাই আজ সন্ধ্যার আবছা আলোতে, নিতান্ত আতুর আমি
অন্ধের মত ম্যাপ ছুঁয়ে ছুঁয়ে বুঝে নিচ্ছি আমার দেশ, আমার ভারতবর্ষ।
(পরবাস-৬৭, জুন ২০১৭)