Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines






পরবাসে
শ্রেয়সী চক্রবর্তীর

লেখা


ISSN 1563-8685




ফিরে পড়া বইঃ বিধুশেখর ভট্টাচার্যের 'বিবাহ মঙ্গল'


বিবাহ মঙ্গল--বিধুশেখর ভট্টাচার্য; প্রথম প্রকাশ: ১৯৩৮ (১৩৪৪ বঙ্গাব্দ); লেখায় ব্যবহৃত সংস্করণঃ ২০১৬ ‘লালমাটি’ সংস্করণ, কলকাতা

চার্য বিধুশেখর শাস্ত্রী মশাইকে শান্তিনিকেতনে আনানো হয়েছিল রবীন্দ্র-পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় সংস্কৃতে প্রস্তুত করাবার লক্ষ্যে। ১৩৪৮-এর ‘প্রবাসী’র পাতায় শাস্ত্রী মশাই লিখছেন ১৩১১ অর্থাৎ ১৯০৪ নাগাদ শান্তিনিকেতনে মাসিক ৩০টাকা সম্মানদক্ষিণায় তাঁর আগমন-কথা। আচার্য বিধুশেখর শাস্ত্রী তাঁর সংস্কৃতজ্ঞানের জন্য এবং ন্যায় দর্শন প্রভৃতি শাস্ত্রে চরম ব্যুৎপত্তির জন্য ভারতসরকার কর্তৃক “মহামহোপাধ্যায়” উপাধিতে ভূষিত হন ১৯৩৬-এ, আরো অনেক পরে ১৯৫৭-তে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে তাঁকে দেশিকোত্তম সম্মানে বরণ করে নেওয়া হয়। পালি তিব্বতি প্রভৃতি ভাষা এবং শাস্ত্রেও তাঁর দক্ষতা ছিল অসীম। এহেন বিধুশেখর ভট্টাচার্য শাস্ত্রী রচিত ‘বিবাহমঙ্গল’ বইটি পাঠ শুরু করা মাত্র ঋতু-সময়-পল-অনুপল নির্বিশেষে উলুধ্বনি-শঙ্খধ্বনি প্রকম্পিত কলগুঞ্জনময় আনন্দিত উৎসব-সন্ধ্যার ছবি মনে জেগে ওঠে। এক একটি বৈদিক মন্ত্রোচ্চারে হৃদয়ের এক একটি দরোজা খুলে ধরে আরক্তিম সন্ধ্যার মধুর কল্পলোক, একটি শুদ্ধাচারী জীবন-ছবি, এক সুপ্রাচীন এবং সুমহান আদর্শের ধারার সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য আমাদের মেধা বুদ্ধিকে গ্রন্থিবদ্ধ করে রাখে।

এই বইটির মন্ত্রসংকলন এবং অনুবাদ প্রথম ১৯০৯ সালে পুস্তিকাকারে রচিত হয় বিধুশেখরের কন্যাচতুষ্টয় শ্রীমতী নীরজাসুন্দরী, বিরাজমোহিনী, শৈলবালা এবং শ্রীমতী গঙ্গামণির শুভপরিণয় উপলক্ষ্যে। পরে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহেই মূলতঃ আরো কয়েকটি অধ্যায় সহযোগে বইটির কলেবর বৃদ্ধি এবং প্রচার-প্রসার ঘটে [১৯১৫]। এখন বইটি ঠিক যেরকম তার প্রকাশ আগেই বলা হয়েছে ইংরেজি ১৯৩৮ সালে। বইটিতে যে যে অধ্যায় আছে ক্রমানুসারে--‘পতি ও পত্নীর মূল ভাব’, ‘আশীর্বাদ’, ‘মন্ত্র’, ‘উপদেশ’, ‘গৃহস্থাশ্রম’, ‘গৃহিণীধর্ম’, এবং ‘প্রার্থনা’ ও ‘উপদেশ’ সূচক দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। এই মূল অংশের সঙ্গে বর্তমানে সংযোজিত হয়েছে শাস্ত্রী মশাই সম্পর্কিত কিছু তথ্য ও পঞ্জী এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর-অঙ্কিত অনুষ্ঠান-উপযোগী বহুসংখ্যক আলপনা।

 

উনবিংশ শতকে জাত, একজন শাস্ত্রজ্ঞ এবং শাস্ত্রানুসরণকারী পিতা বিংশ শতকের আদিপাদে তাঁর কন্যাদের বিবাহিত জীবনের জন্য যা প্রার্থনা করতে চান বা পারেন তদনুসারী মন্ত্রে গ্রথিত এই বইটি। এতে যেমন সুললিত বৈদিক মন্ত্রের শুদ্ধরূপ জানা সম্ভব তেমনি বোঝা সম্ভব এ বই কোনো এক পিতার চাওয়া, সামাজিক পুরুষের চাহিদার ভূমিকাকেই যা আরো দৃঢ় করে তুলেছে। কিছু মন্ত্রের উদাহরণ দেবো। এবং অনেকানেক বক্তব্যই আজকের দুনিয়ায় অনেকাংশে কিম্বা পুরোপুরিই গ্রহণযোগ্য হবে না। তবু নারীপুরুষ নির্বিশেষে উদার পাঠকমনের অনেক রসদ এই বইতে খুঁজে নেওয়া সম্ভব। পুরুষশাসিত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীর আসলেই কিছুমাত্র বদল না ঘটে তা বরং আরো নিম্নাভিমুখী হয়েছে এবং সেই অধোগমনে হেজিমনির ভূমিকা কি জটিল শৃঙ্খলের মতো কাজ করছে প্রাচীন যুগের প্রচলিত মন্ত্রগুলি আমাদের তা অহরহ মনে পড়িয়ে দিতে বাধ্য করছে।

এবারে মন্ত্রের স্বরূপঃ

ক। আশীর্বাদে কন্যাকে বলা হচ্ছে, “স্যোনা ভব শ্বশুরেভ্যঃ/ স্যোনা পত্যে গৃহেভ্যঃ। স্যোনাস্যৈ সর্বৈস্যে বিশে/ স্যোনা পুষ্টায়ৈষাং ভব।” [অথর্ববেদসংহিতা ১৪.২.২৭।] অনুবাদঃ “তুমি শ্বশুরগণের সুখবিধায়িনী হও, পতির সুখবিধায়িনী হও, পতিগৃহের সুখবিধায়িনী হও, এই সমস্ত লোকের সুখবিধায়িনী হও, এবং ইহাদের পোষণের জন্য তুমি সুখবিধায়িনী হও।”

খ। বরকন্যার শুভদৃষ্টিতে বলা হচ্ছে, “অঘোরচক্ষুরপতিঘ্ন্যেধি/ শিবা পশুভ্যঃ সুমনাঃ সুবর্চাঃ।/ বীরসূর্দেবকামা স্যোনা/ শন্নো ভব দ্বিপদে শং চতুষ্পদে।।” [ঋগ্বেদসংহিতা, ১০.৮৫.৪৪।] অর্থাৎ- তুমি সৌম্যদৃষ্টি হও, অপতিঘাতিনী হও। তুমি পশুসমূহের হিতৈষিণী হও, প্রসন্নচিত্তা হও, এবং তেজস্বিনী হও। তুমি পুত্র-প্রসবিনী হও, ঈশ্বরাভিলাষিণী হও, এবং সুখভাগিনী হও। তুমি আমাদের কল্যাণকারিণী হও, আমাদের মনুষ্যবর্গের ও আমাদের চতুষ্পদবর্গের কল্যাণকারিণী হও।” এখানে মনে পড়ে যাচ্ছে সংস্কৃতবিশারদ শ্রীমতী গৌরী ধর্মপাল সংকলিত “পুরোনতুন বৈদিক বিবাহ” বইটির কথা। সেখানে শ্রীমতী ধর্মপাল কিন্তু সুমঙ্গলী বধূর পতিঘাতিনী সত্তার কল্পনার বিয়োজন ঘটিয়েছেন শুভমন্ত্রোচ্চারণ থেকে। কেননা সদ্য বিবাহসম্পর্ক লাভ করতে যাওয়া মেয়েটির জন্য তা কোনোক্রমেই সম্মানজনক নয়। তাঁর কন্যার বিবাহ বৈদিক মতে হয়েছিল ফলে আত্মসম্মানজ্ঞানী মা হিসেবে এবং একজন পূর্ণ নারী হিসেবে তিনি এই মন্ত্র উচ্চারণের অসার্থকতা সর্বাংশে অনুভব করেছিলেন। এবং মনে জাগে আরো একটি কথা... বারে বারেই আসে পুত্রের জননী হওয়ার আশীর্বাণী। কন্যা তো দূর, সন্ততি শব্দও ব্যবহৃত হয় না। তাই এই মন একজন শিক্ষিত সামাজিক পিতার হতে পারে (কেননা তিনি শেষপর্যন্ত বিঘ্নহীন ভারসাম্য রক্ষায় আগ্রহী, যিনি পুরুষের অন্যায় বা পুরুষের চাহিদার জন্য পুরুষকে নয় দায়ী করেন নারীকে), সর্বৈব মেধাবিনী সামাজিক মাতার হয়ে ওঠে না; সেখানে বিধুশেখর শাস্ত্রী এবং গৌরী ধর্মপালের ভাবনায় ও ভাষ্যে তফাৎ তৈরি হয়। অবশ্য পিতৃতন্ত্র যে মায়েদের মগজ-ধোলাই করেছে তাঁরা কন্যা এবং বধূদের প্রতি কতখানি খড়গহস্ত তার নিদর্শন প্রতিদিনের সংবাদপত্রে মেলে ভুরি ভুরি। গার্হস্থ্যের নিয়ত হিংসা আমাদের যাপিত জীবনের একাকী সময়ের যে তুলোট কাগজে তার ছাপ নিয়তই রেখে চলেছে, সেই গৃহস্থাশ্রম সম্পর্কে বিবাহমঙ্গলে তুলনামূলক ভাবে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে।

শাস্ত্রানুসারে এবং গ্রন্থকারের মতে, গৃহস্থের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য ত্যাগ ও সংযম। ফলে অজিতেন্দ্রিয় এবং দুর্বলচিত্তের পক্ষে আদৌ গৃহস্থ সম্পাদন করা সম্ভব নয়। যজ্ঞ গৃহস্থের একটি নিত্যকৃত্য, তার মধ্য দিয়ে যে অপার্থিব ধ্যানরূপের ভাব কল্পিত হয় সেই শুচিবোধই গৃহীর জীবনে আরাধ্য। তাই অন্যান্য সমস্ত আশ্রমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং কঠিন অধ্যায় গৃহস্থাশ্রম। কেননা পতি এবং পত্নীর সুসংযোগে গড়ে ওঠে গৃহ। আর হিন্দুবিবাহে পতি-পত্নীর মূল ভাবের উদ্বোধন ঘটানো হয়েছে অর্ধনারীশ্বরের অস্তিত্ব কল্পনায়। ফলে কেবল পুরুষ বা নারী একা সম্পূর্ণ নন, উভয়ের সমমেলবন্ধনে পত্রপুষ্পশোভিত গৃহধর্মের সূচনা। এই ভাব ছেড়ে হিংসাকে প্রশ্রয় দিলে কিম্বা নিজেকে অকৃত্যে ডুবিয়ে দিলে গৃহস্থ হওয়া যায় না। লেখক বলছেন, “বাড়ি-ঘর-দুয়ার করিয়া ছেলে-মেয়ে-পরিবারের সঙ্গে বসবাস করিলেই কেহ গৃহস্থ হয় না। হিন্দুদের নিকট গৃহস্থ হওয়া একটি অতি-উচ্চ অতি-পবিত্র ভাব। বিবাহের পর ধর্মসাধনার দ্বারা ইহা লাভ করিতে পারা যায়।” [দ্রঃ ‘ভূমিকা’] বেদপাঠ এবং স্বাধ্যায় গৃহস্থের অবশ্যকৃত্য। “যথা বায়ুং সমাশ্রিত্যে বর্তন্তে সর্বজন্তবঃ।/ তথা গৃহস্থমাশ্রিত্য বর্তন্তে সর্ব আশ্রমাঃ।।” [মনু ৩.৭৭।] অনুবাদ--“যেমন বায়ুকে আশ্রয় করিয়া সমস্ত জীব থাকে, সেইরূপ গৃহস্থকে আশ্রয় করিয়া সমস্ত আশ্রম থাকে।” এছাড়াও আরো নানা পালনীয় নীতির মধ্যে বলা হচ্ছে, গৃহস্থ অতিথিকে যা ভোজন করাতে পারেন না, তাঁর নিজের কল্যাণে তা তিনি কখনো গ্রহণ করবেন না। কিম্বা “সুবাসিনীঃ কুমারাংশ্চ রোগিণো গর্ভিণীস্তথা।/ অতিথিভ্যোগ্র এবৈতান্‌ ভোজয়েদবিচারায়ন্‌।।” [মনু, ৩.১১৪] অর্থাৎ গৃহস্থ, নবোঢ়া বধূ ও কন্যাকে, বালকগণকে, রোগিসমূহকে ও গর্ভিণীদের অতিথিদেরও আগে ভোজন করাবেন, এতে কোনো বিচার চলবে না। অথচ এই ত্রিশ বসন্ত পার হওয়া চোখে এই অধম গ্রন্থসমালোচক এ নিয়মের ব্যত্যয় যতবার দেখেছেন তার যৎসামান্যও যদি নিয়ম পালিত হতে দেখতেন, তবে এই চারপাশের স্রোতবাহী জনতার মিতালি হয়তো ততটাও অসহ্য ঠেকত না।

পরবর্তী অধ্যায় ‘গৃহিণীধর্ম’, যার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই আজকের কন্যা বা গৃহিণীদের কোনো মিলই আর অবশিষ্ট নেই। ফলে স্বামীর শয়ন করার পর তাঁকে শয়ন করতে হবে বা এবং স্বামী ওঠার আগেই উঠে পড়তে হবে কিম্বা ভোজনের পর অবশিষ্ট দুধের সার তিনি গ্রহণ করবেন, পাশ ও শিকা বুনবেন, সংসারের প্রয়োজনীয় ফলন ফলাবার ব্যবস্থা করবেন কিম্বা ধান কোটা, চাল বাছা ইত্যাদি কাজ করবেন; স্বামীর অনুমতিক্রমে কোথাও যাবেন, উচ্চহাস্য করবেন না, স্বামীর অন্যায় দেখলে তাঁকে মৃদু তিরস্কার করবেন কিন্তু কখনোই তারস্বরে মাত্রা ছাড়াবেন না, শ্বশ্রূকুলের যাবতীয় সেবা করবেন এবং স্বামীকে সর্বপ্রকারে সন্তুষ্ট রাখবেন, স্বামীর আদিষ্ট কর্ম দাসীর মতো করবেন কিন্তু প্রয়োজনে স্বামীর সঙ্গে সঙ্গিনীরূপে বিহার করবেন -- এই কৃত্যগুলির বেশ কিছু সমাজের বিভিন্ন অংশে আংশিক পালিত হলেও যেহেতু উপার্জনকারিণীর সংখ্যা নিত্যদিন বেড়ে চলেছে তাই আর এই বাৎস্যায়ন কৃত দাসীরূপা নিগড়ের অস্যার্থও দিনে দিনে বাতিল জঞ্জালে পরিণত হচ্ছে। কন্যার বিবাহের একটি শ্লোকে বলা হচ্ছে “তুমি সম্রাজ্ঞী হও। বরের, শ্বশুরের, শাশুড়ির, ননদের কাছে এবং সংসারে তুমি সম্রাজ্ঞী হয়ে ওঠো” কিন্তু এই কি সম্রাজ্ঞী-জীবন? এ প্রশ্ন বিধুশেখর ভেবেছিলেন বলে মনে হয়না... তবে সমাজে মেয়েদের ভূমিকা বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন কোটির বিভিন্ন মেয়েরা ভেবেছেন সেখানেই বিবাহিত কিম্বা অবিবাহিত মেয়েদের নিজস্বতার পরিচয়।

তাই ফিরে পড়া বই হিসেবে বিবাহমঙ্গলে প্রকাশিত গৃহিণীর ভূমিকা কিম্বা নারীর প্রতি প্রকাশিত কিছু অনুজ্ঞা যেমন মনকে প্রশ্নক্ষুব্ধ করে, ভাবতে বাধ্য করে; তেমনি আবার বিবাহিত জীবনের আচরণীয় কিছু মূল্যবোধ আমাদের মুগ্ধ করে রাখে পদ্মগন্ধী জীবনচর্যার আলোয়।।




(পরবাস-৬৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭)