গ্রামের নাম “লাল জল”। পাকা রাস্তা থেকে সাত-আট কিলোমিটার পায়ে হাঁটা পথ। চারদিক পাহাড় আর ঘন শাল জঙ্গলে ঘেরা, ঝাড়খন্ড লাগোয়া এই গ্রাম। সর্বসাকুল্যে তিরিশ-পয়ঁত্রিশটি মাটির বাড়ী। গ্রামে আসার রাস্তা বলে কিছু নাই। দীর্ঘ দিন হাঁটা চলায় যেমন রাস্তা হয় তেমনটি। এক ফসলী কিছু ধানের জমি, গ্রামের ভেতরে কিছু আম, জাম, কাঁঠাল, কেঁদ, মহুয়া, কুসুম, বেলগাছ। প্রত্যেক বাড়িতে গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া, মুরগীর চাষ। আপাতদৃষ্টিতে নিরিবিলি শান্ত গ্রাম। রাস্তা নাই, পাঠশালা নাই, বিজলির লাইন নাই, তবু মনে হয় এরা ভালো আছে।
নিজের মাটির বাড়ীর দাওয়ায় বসে থাকা এক বৃদ্ধের সাথে আলাপ হলো। জিজ্ঞাসা করলেন বাবু, কোথা থেকে আসছেন? বললাম ঝাড়গ্রাম থেকে। হাতে সময় পেলে এদিক ওদিক বেড়িয়ে পড়ি, আজ আপনাদের গ্রামে ঘুরতে এলাম। বিকেল বিকেল ফিরে যাবো, না হলে তো ফেরার উপায় নেই।
কাকা সম্বোধন করে বৃদ্ধকে বললাম, হ্যাঁ গো কাকা আপনাদের গ্রামটা সবুজ শান্ত নিরিবিলি গ্রাম। গ্রামের নামটাও বেশ ভালো। বৃদ্ধ উত্তর করলো “লালজল”। আমাদের গ্রামের লোকেদের শরীরের লালজল- ই আমাদের শক্তি জুগিয়েছে আর অধিকারের লড়াই শিখিয়েছে। বৃদ্ধ হেসে বললেন, দিনের বেলায় দেখছেন নিরিবিলি শান্ত গ্রাম। সন্ধ্যা হলেই যত ডর। নিজের মনকেই জিজ্ঞাসা করলাম? কিসের ডররে বাবা? (ডর মানে ভয়)
ঐ দেখো বাবু মহুল গাছের উপর মাঁচা। সন্ধ্যা হলে আমাদের গাঁয়ের ছেলেরা দল বেঁধে গাছে উঠে ওই মাচা থেকে গ্রামে পাহারা দেয়। দলের নাম হাতি খেঁদা দল। (খেঁদা মানে তাড়ানো) প্রত্যেক মাচায় তিনজন-চারজন করে পাহারা দেয়, সঙ্গে থাকে মশাল। আওয়াজ করার জন্য টিনের ড্রাম, এক-দুই লিটার কেরোসিন আর লাঠির মাথায় বাঁধা লোহার ধারালো শিক্। তা বাবু বসো, ঘর-লে চাটাই আনি। বৃদ্ধ মানুষটি হাতে লাঠি নিয়ে কুঁজো হয়ে ধীর গতিতে চাটাই আনতে ঘরের ভিতরে গেলো। এতক্ষণ ভালোভাবে লক্ষ্য করিনি গ্রামের দশ- বারোটি গাছে হাতি নাগালের বাইরে হাতি খেঁদা মাচা। কৌতুহলে শরীরে শিহরণ জাগে, মনে বাসনা জাগে যেমন করে হোক আজ রাত্রি বাস করবো এই গ্রামে।
এর মধ্যে কাকা একটি খেজুর পাতার চাটাই নিয়ে দাওয়ায় পেতে দিলেন বসার জন্য। বললেন, বসো বাবু এই খানে। গিয়ে বসলাম। কাকা সম্বোধনে মনে হলো বড়ো প্রসন্ন মানুষটি। বহুদিন বাদে এই গ্রামে শহরের একজন আপনি এলেন, গ্রামের লোকের মুখ ছাড়া বাইরের লোকের মুখ একটা বিশেষ দেখা যায় না। বাইরের কেউ এলে ভালো লাগে কথা বলতে। মনের মধ্যে কত কথাই তো আনাগোণা করে। মনে মনে ভাবলাম বলুন না, আমার লেখার খাতা ভরে উঠুক। কাকা বললেন তা বাবু আপনার তো কোন তাড়া নাই? বললাম না- না আমার আবার কিসের তাড়া। অবসর দিনগুলো ঘুরে বেড়াই, কত কিছুর অভিজ্ঞতা হয়, আমার মুখ কিন্তু গ্রামমুখো। গ্রামে, জঙ্গলে, পাহাড়েই বেশী ঘুরি। কাকা বললেন বাবু, আমাদের গ্রামে এসেছেন দিনটা দেখলেন, রাতটা দেখবেন না? রাতটা দেখে যান। আমার ঘরে থাকবেন, কুকড়া মারবো (কুকড়া মানে মুরগী) খাবেন। সকাল হলে না হয় চলে যাবেন। মনের উৎফুল্লকে দমিয়ে না- না করলাম। কাকা বললেন ঠিক আছে আমার ঘরে নাই বা থাকলেন, হাতি খেঁদার মাচায় থাকবেন। কুকড়ার ঝোল কিন্তু আমার ঘরে খাবেন। মনে মনে ভাবলাম, জানা-শোনা নেই সামান্য আলাপে কত আপন করে নেয় গ্রামের এই মানুষজনেরা। মনের সরলতা, ও বিশ্বাসের পাঁচিলে এখনও আঘাত দেয়নি সভ্যজগৎ। বললাম তাই হবে কাকা। তা কাকা আপনি কুঁজো হয়ে হাঁটছেন, পিঠের হাড়টা উঁচু হয়ে আছে, কোন কি আঘাত পেয়েছিলেন? এর মধ্যে এক গৃহবধূ ঘটিতে সরবত নিয়ে এলো। কাকা পরিচয় করিয়ে দিলো, বললো আমার বড়বৌমা। এক গ্লাস পাতিলেবুর সরবত খেয়ে প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। কাছেই এক ঝাঁক টিয়া ট্যা ট্যা চিৎকারে ভুট্টা ক্ষেতে বসলো, কাকা হ্যাট্ হ্যাট্ করে হাতের কাছে একটা দড়ি ধরে টান মারতে লাগলো কাকা, দড়ির শেষ প্রান্তের ঘুটিতে টিন বাঁধা আছে ঠন্ ঠন্ করে বাজতে লাগলো টিয়ার দল ভুট্টার ক্ষেত ছেড়ে ট্যা ট্যা করে মহুল গাছে গিয়ে বসলো। কাকা বললেন দু-বিঘা মতো ভুট্টা লাগিয়েছে আমার বড় ব্যাটা। এখন পাকার সময়, দিনে টিয়া পাখির উৎপাত, রাত্রিতে হাতী ঠাকুরের তান্ডব। হাতের দড়ি টানতে টানতে কাকা বলতে লাগলেন, আজ থেকে বছর কুড়ি আগে আমার বড় ছেলে তখন বছর বারো। কোন একদিন, চাঁদ ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, পূর্ণিমা তখন দুই-তিন দিন বাকি। ধান পাকার সময় একটা বিরাট হাতির দল গ্রামে ঢুকলো, রাত বেশী নয়, জ্যোৎস্নার আলোয় সবকিছু দেখা যাচ্ছে। আমার পিছনের ঘরের মাটির দেওয়াল ভেঙে দিয়ে ধানের বস্তা টেনে এক হুঙ্কার দিয়ে তান্ডব শুরু করলো এক দাঁতাল। হুংকার শুনে হই-হই করে গাঁয়ের ছেলে ছোকরার টিন পিটিয়ে টায়ার জ্বালিয়ে হাতিগুলোর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমি দাঁতালটার সামনে পড়ে গেলাম। নিমেষের মধ্যে শুড়ে পেঁচিয়ে দাঁতালটা আছাড় মারতে গিয়ে উঠানের কাঁঠাল গাছের ডালে শুঁড়ে বাধা পেয়ে শুন্যে ছুঁড়ে দিতে আমি কাঁঠাল গাছের চ্যাঙ্গে আটকে গেলাম। (চ্যাঙ্গ মানে দু’টি মোটা ডালের মধ্যখানের অবস্থান) অসহ্য ব্যথায় আমি জ্ঞান হারালাম। পরে শুনেছিলাম গায়ের ছেলেরা হাতি খেদিয়ে এসে আমাকে উদ্ধার করে ঘরের মেঝেতে শুইয়ে রাখে। যখন জ্ঞান ফেরে তখন বুঝি আমার কোমরের হাড় ভেঙেছে। সকাল হতে আমাকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে ঝাড়গ্রাম সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। তিনমাস হাসপাতালে কাটিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরি। তারপর গ্রামের সকলকে নিয়ে হাতী খেদা দল করি। গ্রামের গাছে গাছে রাত পাহারা দেবার জন্য মাচা করলাম। যা বাঁচার লড়াই আজও চলছে। আমার মতো আরো তিনজন হাতী ঠাকুরের দ্বারা আহত। আর দু’জন বৃদ্ধা জঙ্গলে পাত (পাত মানে শালপাতা যার দ্বারা থালা, বাটি হয়) তুলতে গেছিল হাতী ঠাকুরের সামনে পড়ে যেতে প্রাণ গেছে। দুই জনের প্রাণ যেতে আমাদের ছেলে ছোকরা ছেড়ে কথা বলেনি, বুঝলেন বাবু। একদিন বৃষ্টি ভেজা রাতে গ্রামের হাতির দল ঢুকলো। গাঁয়ের ছেলেরা সতর্ক হয়ে টিন পিটিয়ে সাইকেলের টায়ার জ্বালিয়ে তাদের পিছন তাড়া করলো। একটা কমজোর হাতীকে দল থেকে আলাদা করে হাতিটির লেজে জ্বলন্ত টায়ার বেঁধে দিলো। হাতিটার চিৎকারে সেই যে জঙ্গলে ঢুকলো তারপর থেকে তাদের দেখা বহু দিন বন্ধ ছিল। গ্রামে দু বৃদ্ধার মৃত্যুর এইভাবে প্রতিশোধ নিলো। গল্প চলছে, আমি প্রশ্ন করি, আচ্ছা কাকা আপনি হাতীকে মাঝে মধ্যে হাতী ঠাকুর বলছেন, এরা তো আপনাদের কত ক্ষতি করে, চাষের পাকা ধান খায়, গাছ গাছালির ক্ষতি করে, এমন কি মানুষ মারে তবুও আপনি-। মুখের কথা টেনে নিয়ে কাকা বললেন। দেখুন বাবু এই জল- জঙ্গলে বনভূমি তো ওদের ছিল আমরা কেড়ে নিয়ে বসবাস করছি। তাই মাঝে মধ্যে ওরা ওদের অধিকার জানান দিতে আসে। এছাড়া এদের মাথা জুড়েই তো সিদ্ধিদাতা গণেশের পুন:জন্ম। তাই আমরা হাতী ঠাকুর বলি।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, বিকেল চারটে বাজে। এর মধ্যে আকাশ কালো করে দুই এক পশলা বৃষ্টি এলো। আমরা ঘরে গিয়ে বসলাম। ধীরে ধীরে বৃষ্টি থামলো। বললাম কাকা বিকেল তো হলো, আরে তো ফেরার উপায় নেই। আমি বরং একটু আপনাদের গ্রামটা ঘুরে আসি। কাকা সাবধানের সুরে বললেন ঠিক আছে যান ঘুরে আসুন, দেরী করবেন না এখানে অন্ধকার চটজলদি নামে।
ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, আকাশ পরিস্কার, গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে উত্তর দিকে গেলাম। কিছু ঝোপঝাপ তারপর কিছু ধানের জমি, তারপরে ঘন শালের জঙ্গল আরও পরে পাহাড়। বড়ই ভালো লাগছিল। ধীরে ধীরে হেঁটে কিছুটা দূরে চোখে পড়ল একটা খেজুর গাছের দিকে। গোড়াটা ঝোপঝাপ। দু’টি বাচ্চা ছেলে বয়স তেরো-চোদ্দ হবে, খেজুর গাছের তলা থেকে কি কুড়াচ্ছে আর খাচ্ছে। মনে হলো পাকা খেজুর খাচ্ছে। সম্বিৎ ফিরল। না-তো এখন তো খেজুরের সময় নয়। কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম, দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এক পশলা বৃষ্টির উঁই ঢিপি থেকে হাজার হাজার বাদলা পোকা (উইপোকা বা ডানাওয়ালা উইপিঁপড়ে) বের হচ্ছে। কোন কিছু না বলে অতি সন্তর্পনে কাছে গিয়ে বসলাম।
উঁই ঢিপ ঘিরে বাদলা পোকা খেতে ব্যস্ত দশ-বারোটি মোটা মোটা ব্যাঙ, সাত-আটটি ক্যাকলাস (গিরগিটি প্রজাতি) ও অনেকগুলি কাঁকড়া বিছের দল। যে যার মতো করে খাচ্ছে। বাচ্চা দুটি পাখনা ছাড়িয়ে পাকা খেজুরের মতো মুখে পুরছে। সকলেই খেতে ব্যস্ত। ব্যাঙের দল একদিকে, ক্যাকলাসের দল আরেক দিকে, কাঁকড়া বিছে তাদের সীমানায়। এত খাদ্য সকলেই খেতে ব্যস্ত। বাদলা পোকা উঁই ঢিপি থেকে একনাগাড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যে এরা মারা যাবে, এই পোকার ডানা হওয়া মানেই মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়া। এদেরকে দেখেই কবি সম্ভবত: লিখে ছিলেন— ‘পিপিলিকার ডানা বাঁধে মরিবার তরে’। হঠাৎ একটা ক্যাকলাস খেতে খেতে অন্যমনস্ক কাঁকড়া বিছেদের সীমার দিকে যেতেই, এক বড় সাইজের কাঁকড়া বিছে দৌড়ে গিয়ে ক্যাকলাসটার শরীরে বিষাক্ত হুল ঢুকিয়ে বিষ ঢেলে দিল। ক্যাকলাসটা চিঁচিঁ শব্দ করে এক পাক ঘুরে, ধীরে ধীরে লেজ তুলে একটা ছোট জংলি গাছে গা ঘষতে লাগলো। তারপর ঐ গাছের পাতা চিবিয়ে অতি সন্তর্পণে আবার এসে খাবারে যোগ দিল। আমি হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। ভাবলাম এটা একটা ঔষধি গাছ নিশ্চিত। ‘প্রকৃতি’ এদের এইসব ঔষধি গাছ চেনার শক্তি দিয়েছে। ক্যাকলাসটি তার অধিকারের মাত্রা ছাড়ায়নি। বাচ্চা দুটি মুখ ভর্তি করে খেয়ে যাচ্ছে। আমি কাছে বসে এসব দেখছি। একবার ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি কি রে কেমন খেতে পোকাগুলো? তারপর ভাবলাম কথা বললে এরা যদি সকলে সরে পড়ে। তাহলে এ দৃশ্য আর দেখা যাবে না। এই চিন্তা করতে করতে দেখি একটি বাচ্চা অন্য মনস্কভাবে কাঁকড়া বিছের দিকে যেতেই বাচ্চাটি পায়ের পাতায় একটা কাঁকড়া বিছে হুল ঢুকিয়ে দিলো। চিৎকার করে এক পা তুলে লাফাতে লাফাতে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি পায়ের পাতায় হাত দিয়ে দেখি জায়গা গরম হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে জায়গাটা ফুলে উঠলো। বাচ্চাটা বললো ওর খাবারে ভাগ বসাতে ওদের জায়গায় চলে গেছিলাম তাই হুল ঢুকিয়ে দিলো। ততক্ষণে আরেকটি বাচ্চা ওই ঔষধি গাছের ডাল ভেঙে এনে হুল ফোটানোর জায়গায় ঘসতে লাগলো, আর একটা পাতা ধরিয়ে দিলো চিবিয়ে খাবার জন্য। বাচ্চাটি পা চেপে বসে আছে। আর একটি বাচ্চা ওর পাশে এসে বসলো বৃষ্টি ভেজা ঘাসের ওপর। বসে বসে ভাবছি এ লড়াই সর্বত্র, কোথাও নি:শব্দে, কোথাও প্রকাশ্যে। সন্ধ্যা নেমে এলো। বাচ্চা দুটিকে নিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরলাম। অধিকারের গন্ডি অতিক্রম করতে দুইজনকেই কামড় খেতে হলো। বাচ্চা দুটোকে জিজ্ঞাসা করলাম হ্যাঁ-রে তোরা যে পোকাগুলো খাচ্ছি-লি কেমন খেতে? গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। একটা বাচ্চা বললো টক্ টক্, মিষ্টি মিষ্টি, বলে দু’জন দুই ঘরের দিকে দৌড়ে লাগালো।
ধীরে ধীরে হাঁটে চলেছিলাম আর ভাবছিলাম একরত্তি বাচ্চাটাও অধিকারের লড়াই বোঝে। কাকার মুখে শুনলাম অধিকারের লড়াই। সন্ধ্যা হলেই নেমে আসে এদের জীবনে ভয়ঙ্কর অধিকারের লড়াই। সন্ধ্যার আগে যে যার ঘরে ফিরে আসে দলবদ্ধভাবে যে যার লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে। গ্রামে মেয়ে-বৌ-রা সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে ব্যস্ত। নিস্তব্ধ গ্রামে সন্ধ্যায় শাঁখের ধ্বনি। মানুষজনের ঘরে ফেরার তাড়া। কেউ কেউ গোয়ালে গরু মহিষ বাঁধতে ব্যস্ত। কৌতুহল বশত: অনেকে তাকিয়ে ভাবছে হয়ত, এই সাঁঝবেলায় শহুরে মানুষটা যাবে কোথায়? একজন অল্পবয়েসী ছেলে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো— আপনি বুঝি আর রাত্রিতে আমাদের গ্রামে থাকবেন? হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিলাম— হ্যাঁ বাবা এখন আর কোথায় যাবো। ছেলেটি বললো— আমার নাম বীরু। যার ঘরে এসেছেন উনি আমার “বড়বাপ” (বড় বাপ মানে জ্যাঠা) হাতী দেখবেন বলে এসেছেন? আমতা আমতা করে বললাম— না, যদি দেখা যায়। কপাল ভালো থাকলে দেখতেও পারেন বললো বীরু। আরো বললো দৌড়াতে পারেন? মৃদু স্বরে বললাম কোথায় দৌড়াবো অন্ধকার রাত্রিতে চারদিকে জঙ্গল ঘেরা গ্রামের অজানা পথে। ঠিক আছে, হাতী যদি আসে আপনি আজ আমাদের মাচায় থাকবেন ওখান থেকে না হয় হাতী দেখবেন। আপনি খেয়ে দেয়ে অপেক্ষা করবেন আমি ডেকে নিয়ে যাবো। কথা বলতে বলতে আমরা কাকার ঘরের কাছে সে পৌঁছলাম।
কাকা ঘরের দাওয়ায় বসে অপেক্ষা করছিলেন। বীরু চলে গেলো, কিছুদূর যেতে বীরুকে আর দেখা গেলো না। অন্ধকার নেমে এলো। আমরা কাকার ভিতরের বারান্দায় গিয়ে বসলাম। ভেতরে ঢোকার একটি দরজা চারিপাশে বারান্দা, বারান্দা লাগোয়া চারিপাশে ঘর। মাঝখানে বেশ বড় উঠান এবং তুলসি মঞ্চ। এ ঘরের বড়বৌ শাঁখ বাজিয়ে ধূপ-ধুনো প্রদীপ তুলসীমঞ্চে দিয়ে, গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো সঙ্গে আমাকেও। না-না করলাম, শুনলো না। সকলকে প্রণাম করে বৌ-টি রান্নার উদ্দেশ্যে ভিতরে চলে গেল।
কাকা বললেন বাবু আমাদের এই সব না করতে নাই। এসব আমাদের রীতি। বুঝলেন সংসারে যদি কোন অশান্তি বনিবনা না হয়, ঐ এক প্রণামে সবকিছু সরল হয়ে যায়। মনে মনে ভাবলাম সত্যিই তো।
এর মধ্যে বৌমা চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো, মনে মনে এইটাই চাইছিলাম। চায়ের কাপে মুখ দিয়ে কাকা বললেন— এ গাঁয়ের কথা। আমাদের কত পুরুষের বাস জানি না তবে ছয় পুরুষের নাম জানা আছে। বাপ ঠাকুরদার আমলে কখনও হাতী ঠাকুরের উপদ্রব ছিল না। জঙ্গলে তখন খাবারের কোন অভাব ছিল না। কখনো তারা লোকালয়ে আসতো না। প্রকৃতি অফুরন্ত খাবার দিয়েছিল। কিন্তু আমরা জ্ঞানবৃক্ষ ফল ভক্ষণকারী মানুষরূপী জন্তুটি যেদিন থেকে প্রকৃতির উপর আস্ফালন শুরু করলাম সেই দিন থেকে অধিকারের লড়াই শুরু হলো। কাকা বলেই চলেছে, আমাদের এই সব জঙ্গলে অতি দুর্লভ প্রাচীন গাছ ছিল, সেই সব গাছ কেটে বন-বিভাগ ইউক্যালিপটাস লাগালো, এই সব গাছে না বসে পাখী, ডালপালা না কোন পশুখাদ্য, না গোড়ায় জন্মায় ঘাস। পশুদের খাদ্য ভূমি ধ্বংস হলো কয়েকশত ভেষজও পশুখাদ্য হারিয়ে গেলো পাখীরা নিরুদ্দেশ হলো।
খাদান খাদকেরা আমাদের পশ্চিমদিকের পাহাড় ফাটিয়ে আরও চাই-চাই করতে লাগলো। ওখানকার বন্য প্রাণীরা নিচে নেমে এলো খাবারের খোঁজে। সেচবাবুরা নদীর পথ রুদ্ধ করে বাঁধ দিলো, নদীর ধারা বন্ধ করে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ করলো। কাকার কথা মন দিয়ে শুনছিলাম, ভালই লাগছিলো। তবে বাবু, জেনে রাখুন প্রকৃতি কিন্তু সবসময় আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চায় এবং ফিরে যাবেই শুধু সময়ের অপেক্ষায়।
মাটির মেঝেতে আসন পাতা হয়েছে। কাকা বললেন— চলুন রাতের খাবারটা খেয়ে নিন্। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ৭-৪০ মিনিট। খুব তৃপ্তি সহকারে খেলাম ঢেঁকি ছাটা চালের ভাত আর দেশি মুরগির ঝোল (কুকড়ার ঝোল)। বৌমা আর শাশুড়ী মা খুব যত্ন করলেন। বৌমাকে বললাম খুব ভালো খেলাম, বৌমা হেসে বলল আবার আসবেন।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বীরু ডাক পড়লো। কাকা দুয়ার পর্যন্ত এগিয়ে এসে বীরুকে বললেন তোরা কোন গাছে থাকবি? বীরু বলল পশ্চিম দিকের মহুল গাছে। কাকা বললেন সাবধানে থাকবেন, আমরা কিছুটা এগিয়ে যেতে কাকা ঘরে দরজায় খিল দিলো। বীরুর টর্চের আলোয় আমরা এগিয়ে চললাম, একটা মোটা গাছের কাছে এসে বীরু বললো উঠতে পারবেন? গাছের গোড়া এবড়ো খেবড়ো থাকাতে উঠতে কষ্ট হলো না। বেশ উঁচুতে এই মাচা। বেশ শক্ত তক্তা দিয়ে তৈরী। উপরে খড় দিয়ে ছাওয়া, বৃষ্টি এলেও ভেজার কোন ভয় নাই। তক্তার উপর চাটাই পাতা। আমাদের আগে তিন জন এসে শুয়ে পড়েছে, মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে। বীরু বেশি কথা না বলে শুয়ে পড়লো বললো, হাতী গ্রামে এলে আমরা জানতে পারি। হয় ওরা আওয়াজ দেবে, নচেৎ কোন গাছের ডাল ভেঙে জানান দেবে।
অন্ধকারে গোটা গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে। কাজল কালো অন্ধকার গোটা গ্রামটাকে গ্রাস করেছে। নি:শব্দ গ্রামের এই রাতটা উপভোগ করবো ভেবে শুয়ে পড়লাম উদ্ভূত এক উৎকন্ঠা মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে। চোখ বুজে ভাবছি এই গ্রামের মানুষজনের জীবনযাত্রার কথা। বেশী রাত নয়, ঝিঁঝির ডাক, কালো অন্ধকার আর নি:শব্দ প্রকৃতি। ধীরে ধীরে অবসন্ন ক্লান্ত শরীরে নিদ্রা ধেয়ে এলো।
তিনজনের গুঞ্জনে ঘুম ভেঙে গেলো। টর্চ জ্বালিয়ে ঘড়ি দেখলাম রাত দেড়টা। মাচা থেকে দেখলাম দূরে একটি ঘরের উঠানে কয়েকটা টর্চ আর হেরিকেনের আলো। ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম অস্পষ্ট কয়েকজনের ব্যস্ততা। বীরুর নাম নিয়ে একজন বললো নেমে আসতে। বীরু বললো আপনি এখানে থাকুন আমরা নেমে যাচ্ছি। আমি বললাম না না আমি এখানে একা থাকবো না, তোমরা যেখানে যাবে সেখানে আমিও যাবো। বীরু আর আপত্তি করলো না। আমরা সকলে ধীরে ধীরে গাছ থেকে নেমে এলাম। টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে যেতে এক মহিলা কন্ঠের আর্তনাদ। ধীরে ধীরে হাতী খেদা দলের সদস্যরা গাছ থেকে নেমে এক জায়গায় জড়ো হলো। বীরুর কথার ব্যাখ্যা করলে যা বোঝায় এই গৃহের গৃহবধূটি প্রথম গর্ভবতী। অনেক চেষ্টা করে প্রসব করানো যায়নি, সত্বর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটা ড্রাইভারের বাড়ীতে মালিকের গাড়ী থাকে, সেখানে নিয়ে যেতে হবে, সেখান থেকে গাড়ী করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।
দূরে দাঁড়িয়ে মধ্যরাতে এই ঘুমিয়ে পড়া গ্রাম, গর্ভ-যন্ত্রণায় আর্তনাদ অদ্ভূত শোনাচ্ছে, আর্তনাদের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। দড়ির খাটিয়ায় বাঁশ লাগিয়ে তার উপরে কাপড়ের আচ্ছাদনে ঢেকে পালকির মতো করা দুইজন কাঁধ দিলো। দু’জন বৃদ্ধা সাথে সাথে এগিয়ে চললো। গ্রাম ছেড়ে আমরা জঙ্গলের রাস্তা ধরলাম। গ্রাম অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রইল। বীরু আমার সাথে পেছনে হাঁটছিল। বীরু বললো ভয় পাবেন না, ওরা আমাদের সামনে আসবে না। ওরা আমাদের ভয় করে। আত্মবিশ্বাস এদের শক্তি জুগিয়ে এসেছে। মশালের ক্ষীণ আলোয় দেখলাম দুই বৃদ্ধা খাটিয়ার আচ্ছাদনের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে বধূটিকে আশ্বস্ত করে সকলকে বললো, একটু জোরে পা চালাতে। আমরা সকলে হন্ হন্ করে হাঁটতে লাগলাম। গর্ভবতীর যন্ত্রণার আওয়াজ কানে আসতে লাগলো। সামনের দল মাঝে মাঝে টিন পিটিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। আমি বার বার পেছনে থেকে যাচ্ছিলাম, পিছনে ঘন কালো অন্ধকার ফেলে আমরা এসেছি, আবার সামনের এই ঘন কালো অন্ধকার ভেদ করে যেতে হবে। সরু পায়ে হাঁটা রাস্তা দুই পাশে ঘন কালো অন্ধকার ভেদ করে যেতে হবে। গাছগুলি কোলাকুলি করে আছে। প্রায় মাঝ রাস্তা এসে পড়েছি। হঠাৎ খাটিয়ার আচ্ছাদন থেকে মুখ বের করে এক বৃদ্ধা দাঁড়াতে বললো। খাটিয়া কাঁধ থেকে নামিয়ে, সবাই দূরে সরে গেল। ড্রামের আওয়াজ নেই, মশাল দুটি জ্বলছে। আমি পেছনে কিছু দূরে মাটিতে বসে আছি। আচ্ছাদনের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে দুই বৃদ্ধা। হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে, অরণ্যের এই নিস্তব্ধতা ও সকলের উদ্বেগ কাটিয়ে সদ্যজাত শিশুটির কান্নার আওয়াজ। বৃদ্ধা দুইজন হাঁপিয়ে কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে খোকার উদ্দেশ্যে বললো— তোর বেটা ছানা হয়েছে। (ছানা মানে ছেলে) ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ৩.৪০ মিনিট। খোকা যে কে আধো অন্ধকার আধো আলোয় বুঝতে পারলাম না। মনে হলো যে দুই জন খাটিয়া বইছিল তাদের একজন হবে। সকলে মাটিতে এসে পড়েছে আকাশ পরিস্কার হয়ে এলো দূর থেকে মোরগের ডাক কানে ভেসে এলো। আকাশে বাদুরের দল আর রাত জাগা পাখির দল ঘর মুখো। ক্লান্তি ভেঙে সবাই উঠে পড়লো। এবার ফেরার পালা। বীরু বললো আপনি যদি গ্রামে না গিয়ে ফিরে যান তবে একটা সাইকেল আসছে, আপনাকে পাকা রাস্তায় ছেড়ে দেবে। ফেরার জন্য মনস্থির করে সাইকেল দাঁড় করাতে বললাম। সবার উদ্দেশ্যে বললাম, তোমরা ভাই ভালো থেকো। আর কাকাকে বোল আমি চলে যাচ্ছি আবার আসবো। শিশুটির জন্ম হয় ৩.৪০ মিনিট। প্রাপ্তি তো অনেক পেলাম, কম কি। এই গভীর জঙ্গলে শেষ রাতে একটি শিশুর জনম সাক্ষী হয়ে রইলাম। গৃহবধূটি সদ্য “মা” প্রাপ্তি শব্দটি সারা জীবনের সঙ্গী করে, বাচ্চাটিকে বুকে নিয়ে খাটিয়ার দোলায় দুলতে দুলতে ঘর মুখো হলো।
আমিও সবার কাছে বিদায় নিয়ে, ফেলে আসা লালজল গ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়ে সাইকেলের কেরিয়ারে বসে আমার গন্তব্যর দিকে রওনা দিলাম।
(পরবাস-৬৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭)