Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines




পরবাসে
শ্রীময়ী চক্রবর্তীর

লেখা


ISSN 1563-8685




পাহাড়ি ফুল

কটা শব্দ ক্রমশঃ স্পষ্ট হচ্ছে। টপটপ করে জলের ফোঁটা পড়ার শব্দ আঘাত করছে মগ্ন চেতনায়। রজতাভ সেনের ভুরুটা বিরক্তিতে একটু কুঁচকে গেলো। চোখের বন্ধ পাতায় সূঁচের মতো আলোর তীর। খুব কষ্ট করে তাকালেন তিনি। মুখের কাছে একটা মুখ, ঝুঁকে পড়ে দেখছে তাকে। দৃষ্টিটা পরিষ্কার হতে মুখটা একটু স্পষ্ট হলো। ফর্সা গোল একটা মেয়ের মুখ। চাপা নাক, সরু চোখ, বাদামী চোখ আর ভিজে ভিজে গোলাপী ঠোঁট। রজতাভ অস্ফূট স্বরে 'জয়মতি' বলে আবার চোখ বুজলেন। তাঁর বিরক্তিতে কুঁচকে যাওয়া মুখের রেখারা এখন অনেক নরম। তিনি তলিয়ে গেলেন তাঁর আধো ঘোরের অজানা জগতে। শাওন ডক্টর শৈবাল দাশগুপ্তকে একটা ফোন করে পেশেন্টের লেটেস্ট ডেভেলপমেন্টের খবরটা জানালো। ডাক্তারের কথামত একটা ইঞ্জেকশন পুশ করলো খাটের পাশে ঝোলানো স্যালাইনের বোতলে। তারপর বিদিশা ম্যাডামকে ও ফোন করে রজতাভ সেনের জ্ঞান ফেরার খবরটা দিয়ে দিলো।

সবুজ মখমলে ঢাকা মাঠটা গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে গেছে সবুজ একটা স্লিপের মতো। বছর ষোলো সতেরোর দুটো ছেলেমেয়ে লালিগুড়ান ঝোপের আড়ালে হাত ধরাধরি করে বসে আছে। আলো কমে আসছে, এরপর ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসবে শৈলশহরটায়। মেয়েটা নিঃশব্দে অঝোর ধারায় কাঁদছে, ছেলেটা মেয়েটার হাত চেপে ধরে রেখেছে যেন কোনদিন তাকে ছাড়বে না। ছেলেটি রজতাভ, দার্জিলিং কনভেন্টে একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। মেধাবী, গিটার বাজিয়ে এলভিস প্রেসলি গাওয়া ছেলেটির চোখে এখন অসহায় বিভ্রান্তি। মেয়েটি তার বাল্য-বান্ধবী জয়মতি। জয়মতি পাহাড়ের মেয়ে, তার বাবা রজতাভদের স্কুলে মালির কাজ করেন। জয়মতি স্থানীয় স্কুলে দশম শ্রেণীর ছাত্রী। সে রজতাভদের স্কুলগ্রাউন্ডের প্রান্তে স্টাফকোয়ার্টারে থাকে। ওদের দুজনের ভাব ছয়সাত বছর বয়স থেকে। বাবা যখন ছোট্ট মাতৃহারা রজতাভ ওরফে রাজাকে দার্জিলিং-এ বোর্ডিং স্কুলটায় ভর্তি করে ফিরে গেলেন, তখন রাজা মাঠের কোণে দাঁড়িয়ে চোখভর্তি জল নিয়ে গলার ব্যথাটা গেলার চেষ্টা করছিল। একটা ছোট মেয়ে হঠাৎ একমুঠো পাহাড়ি ফুল হাসিমুখে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ‘ফ্রেন্ডস' বলে ছুট্টে পালিয়ে যায়। রাজার হঠাৎ মনে হয় ওদের আলিপুরের বিশাল গম্ভীর বাড়িটার থেকে এই রোদে মাখামাখি ঠান্ডা পাহাড়টা অনেক বেশি সুন্দর। তারপর দশ বছর কেটে গেছে ওরা বন্ধু। আড্ডা আর ঝগড়ায় বেশ কাটছিল দিনগুলো, জয়মতির বাবা ওদের সমাজের নিয়মে ষোলো বছরের মেয়ের বিয়ে স্থির করে বসলেন। আসন্ন বিচ্ছেদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জয়মতি আর রজতাভ বুঝতে পারলো তাদের বন্ধুত্বের একটা অন্যমাত্রা আছে। আজ খুব ভোরে ওরা পালিয়ে এসেছে। কোথায় যাবে ওরা জানে না। সারা দুপুর গাছের আড়ালে বসে ওরা ঠিক করেছে একসাথে বাঁচতে না পারুক, একসাথে মরবে। পায়ে পায়ে দুজনে খাদের ধারে এসে দাঁড়ায়। চা বাগানের শ্রমিক মহিলারা তাদের লক্ষ্য করছিলেন অনেকক্ষণ ধরেই। ঝাঁপ দেওয়ার আগেই ধরা পড়ে যায় প্রেমিকযুগল। খবর যায় রজতাভর বাবা ইন্দ্রনাথের কাছে। স্কুল ছাড়িয়ে তিনি ছেলেকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যান। জয়মতির বিয়ের খবর রাজাকে ওর ক্লাসমেট সুবিমল ফোন করে জানিয়েছিলো, শীতের ছুটিতে বাড়িতে এসে। ডিপ্রেশন তো চলছিলোই এবার ভেঙে পড়লো রাজা। কথা বলতে আর একটুও ইচ্ছা করতো না তার। একবছর সাইকিয়াট্রিস্টের চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ব্রিটেনে লেখাপড়ার জন্য। টানা দশ বছর সেখানে উচ্চশিক্ষা নেয় রজতাভ। প্রকৃত অর্থেই লন্ডন তার দ্বিতীয় বাড়ি। দশ বছর পরে দেশে ফেরে চৌকস তীক্ষ্ণ বুদ্ধি রজতাভ সেন। বাবার কাগজের ব্যবসায় যোগ দিতেই ইন্দ্রনাথ তার সাথে বিয়ে দেন বিদেশি ব্যাঙ্কে কর্মরতা বিদিশা রায়চৌধুরীর। বুদ্ধি, শিক্ষা, কর্মদক্ষতা এবং বনেদিয়ানায় দুজনে তুল্য-মূল্য।

চুয়ান্ন বছরের রজতাভ সেন পৈত্রিক কাগজের ব্যবসার সাথে সাথে হোটেলের ব্যবসায় প্রভূত খ্যাতি ও অর্থ লাভ করেছেন। একমাত্র ছেলে চব্বিশ বছরের চিরদীপ একটু বোহেমিয়ান গোছের। সে সারা পৃথিবী ঘুরে লোকগান সংগ্রহ করছে। রজতাভর ছেলেকে নিয়ে একটু মানসিক অশান্তি থাকলেও বিদিশার মতো সুযোগ্য স্ত্রী পেয়ে স্বর্গত বাবার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ। প্রতিটি ভালো এবং খারাপ সময়ে বিদিশা তাঁর পাশে থেকেছে, ভরসা জুগিয়েছে। কিন্তু সফল শিল্পপতি রজতাভ সেন আজো জয়মতিকে ভুলতে পারেননি। হঠাৎ কোন বিষণ্ণ রাত্রে তাঁর বুকে চলকে ওঠে ষোলো বছরের এক কিশোরীর চোখের জলে ভেসে যাওয়া মুখ। এমনকি ফুলসজ্জার রাত্রে তিনি বিদিশার মুখে জয়মতির ছায়া দেখে মাথা ব্যথার অজুহাতে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন, নবপরিণীতা স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে। বিদিশা বুদ্ধিমতী; সে কোন প্রশ্ন না করে ধীরেধীরে রজতাভর মনের অনেকটাই দখল করে নিয়েছে। জয়মতির ঘটনাও মাসতুতো ননদের কাছে সে খানিকটা শুনেছে, এবং লক্ষ করেছে আজ এতো বছর পরেও রজতাভ পাহাড়ে বেড়াতে যেতে রাজি হন না।

নভেম্বর মাসে রজতাভর বিএমডব্লিউ গাড়িটা রাজারহাটে আ্যক্সিডেন্টে পড়লো। উল্টোদিক থেকে আসা একটা এসইউভি ব্রেক ফেল করে সজোরে এসে ধাক্কা মারে গাড়ির সামনে। ড্রাইভার ভবেশদা স্পটডেড, রজতাভর মাথায় অস্ত্রোপচার করতে হয়। ডান হাতে ফ্রাকচার, বাঁ পায়ে গভীর ক্ষত। ভাগ্যিস ড্রাইভারের ঠিক পেছনে বসেননি তাই প্রাণে বেঁচে গেছেন। অপারেশনের সাতদিন বাদে রজতাভর জ্ঞান ফিরলো। চোখ খুলে বহুদিন পর তিনি জয়মতিকে দেখলেন।

ঘন্টা দুই বাদে যখন রজতাভ আবার চোখ মেললেন, তখন তাঁর মাথার পাশে বিদিশা বসে আছে। রজতাভ বুঝতে পারলেন এটি হসপিটালের কেবিন এবং মেয়েটি জয়মতি নয়, তাঁর প্রাইভেট নার্স। রজতাভর নার্সের নাম শাওন। শাওন নেপাল থেকে ভারতে এসেছে কাজের সন্ধানে। স্বল্পবাক মেয়েটির স্বভাব অতি মধুর। নেপালে তার গ্রামের পাশেই ছোট শহরটার হাসপাতালে সে কাজ করতে পারতো কিন্তু সেখানে পয়সা কম। শাওনের খুব টাকার প্রয়োজন। আরো সাতটা দিন হসপিটালে থাকার পরে রজতাভ ছুটি পেলেন। কিন্তু এখনো টানা একমাস তাঁকে বাড়িতে বিশ্রাম নিতে হবে। মাথায় কোন চাপ নেওয়া চলবেনা। হসপিটালের মালিক মিস্টার কনোরিয়া রজতাভর পুরোনো বন্ধু। রজতাভ তাঁর কাছে একটা অদ্ভুত আব্দার করে বসলেন, শাওন তাঁর বাড়িতে ডে শিফ্টে নার্সিং করবে। শাওন প্রথমে একটু অস্বস্তি বোধ করছিল — কারুর বাড়িতে সে কখনো নার্সিং করেনি, কিন্তু টাকার অঙ্ক এবং ভদ্র মানুষটির ওপর ভরসায় সে শেষপর্যন্ত রাজী হয়ে গেল।

সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত শাওন ডিউটি করে। রাতের নার্সের সাথে রজতাভ প্রয়োজনাতিরিক্ত একটা কথাও খরচ করেন না, তাঁর যত কথা সব বাইশ বছরের শাওনের সাথে। শাওন যত্ন করে আঙ্কেলের ব্রেকফাস্ট গুছিয়ে দেয়। ফল দিয়ে নানারকম স্মাইলি বানায়। ডিমের পোচের ওপর গোলমরিচ ছড়িয়ে ধৈর্য ধরে রজতাভকে খাওয়ায়। খাওয়ার ফাঁকে চলে এতাল বেতাল গল্প। বিদিশা অফিস যাওয়ার আগে দেখে যান দুই অসমবয়সী, অসমপর্যায়ী বন্ধুর আড্ডা। রজতাভর মুড এবং রক্তচাপ ভালো আছে দেখে নিশ্চিন্ত হন তিনি। বেশিরভাগ গল্প হয় নেপালে শাওনের গ্রাম নিয়ে। পাহাড়ের কোলে শান্ত, সুন্দর, নিরিবিলি ওদের গ্রাম। বাড়িতে শাওনের মা, বাবা আর ছোট ভাই আছে। শাওনের বাবা চাষী। বছর তিনেক আগে ওর ভাই গৌতমের ক্যান্সার হয়। তার চিকিৎসার জন্য জমি বন্ধক রেখে লোন করেন শাওনের বাবা। ভাই সুস্থ তো হয়ে ওঠে কিন্তু জমির কর্জ সুদে আসলে তিনলাখ ছাড়িয়ে গেছে। সংসার চালিয়ে শাওনের বাবা এতো টাকা জোগাড় করবেন কি করে? শাওন কলকাতায় থেকে দাঁতে দাঁত চেপে দুটো বাড়তি পয়সা আয় করছে বলে সুদটা অন্তত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। জমি হাতছাড়া হয়ে গেলে পুরো পরিবার পথে বসবে।

সেদিন আকাশে মেঘ জমেছে, অকাল বর্ষার ভিজে ঠাণ্ডা এলোমেলো হাওয়া। শাওনের চোখেও সেই মেঘের ছায়া, সে টুকটাক কাজ করতে করতে গুনগুন করে একটা নেপালি গান গাইছিল ....

"ফিকা ফিকাচা
তুমি বিনা ইয়োহো .... মেরো জিন্দেগি
ই আঁখালে হরপল
তিমি লাই খোঁজাছো"
গাইতে গাইতে উদাস হয়ে গেছে মেয়েটা, লক্ষ করেন রজতাভ। চল্লিশ বছর আগে জয়মতির কাছে শেখা ভাষাটা এখনো ভোলেননি তিনি। মেয়েটির চোখ কাউকে খুঁজছে, তাকে ছাড়া শাওনের জীবন বড় ফাঁকা। তিনি শাওনকে জিজ্ঞেস করেন "কিসকো ঢুন্ডতি হো শাওন রাতদিন? উয়ো হ্যায় কৌন?" রজতাভ যে নেপালি বোঝেন ভাবতে পারেনি শাওন। চমকে ওঠে সে প্রথমে না না করলেও একটু পীড়াপিড়ি করতেই ওর প্রণয়ী অর্জুনের কথা বলে ফেলে সে। তাদের গ্রামের ছেলে অর্জুন, ওর ছেলেবেলার সঙ্গী। অর্জুনের পরিবারও চাষবাস করে, ছোট একটা তেলকল চালায়।

নেপালে থাকলে ওরা এতোদিনে বিয়ে করে নিতো। কিন্তু যতদিন না জমিটা ছাড়াতে পারছে শাওনের পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। দিনদিন বিয়েটা ওর মরীচিকা বলে মনে হচ্ছে। আপনমনে কথা বলতে বলতে হঠাৎ সে জানতে চায় আঙ্কেল তাদের ভাষা জানালেন কি করে? রজতাভ এতো বছর যাবৎ যে কথা কাউকে বলেননি আজ নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গের মত শাওনের কাছে তাঁর যন্ত্রণার, ভালোবাসার প্রতিটি মুহূর্ত সারাদুপুর ধরে অনর্গল বলে গেলেন। বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া বিয়োগান্তক প্রেমের গল্পটা শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো শাওন।

কথায় কথায় একটা মাস কোথা দিয়ে যেন কেটে গেল। শৈবাল দাশগুপ্ত রজতাভকে ফিট সার্টিফিকেট দিলেন। রজতাভ আবার নিজের কাজের জগতে ফিরে যাবেন, শাওন ফিরে যাবে হসপিটালে। শাওন শেষদিন রাত আটটায় বিদায় চাইলো তার আঙ্কেলের কাছে। রজতাভ একটা তিন লাখ টাকার চেক এগিয়ে দিলেন শাওনের দিকে। হতভম্ব শাওন কিছুতেই চেক নেবে না। রজতাভ এবার বললেন তিনি চান শাওন দেশে ফিরে যাক। বিয়ে করুক তার প্রিয় মানুষকে, কাজ করুক তাদের ছোট শহরের ছোট হাসপাতালে। জয়মতি আর তাঁর জীবনের ট্র্যাজেডি যেন শাওনের জীবনের গল্প না হয়। অনেক বোঝানোর পর শাওন চেকটা নিতে রাজি হলো। রজতাভর পায়ে হাত দিয়ে বাঙালি মতে প্রণাম করলো সে।

আজকাল ভারী হাল্কা লাগে রজতাভর, শাওন দেশে ফিরে গিয়ে খবর দিয়েছে সামনের মাসে তার আর অর্জুনের বিয়ে। আঙ্কেল আর ম্যাডাম যদি আসেন তাদের খুব ভালো লাগবে। জয়মতির কাছে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়, তবু এই মেয়েটির প্রেমের সুখী পরিসমাপ্তি তাঁকে তৃপ্ত করে। রজতাভ রোগমুক্তি উপলক্ষে বিদিশাকে নিয়ে ইয়োরোপ ভ্রমণে বেরোলেন। ফ্রান্স, জার্মানি ঘুরে লন্ডনে কটা দিন বিশ্রাম। পুরোনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা। ফেরার আগে তাঁরা 'হার ম্যাজেস্টিস থিয়েটারে' রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট অপেরা দেখতে গেলেন। অভিনয় এবং গানে বুঁদ হয়ে অপেরা দেখতে দেখতে হঠাৎ স্টেজটা কেমন আবছা হয়ে গেলো রজতাভর চোখে। জুলিয়েট কোথায়? লালকালো চেক স্কার্ট পরা জয়মতি গান গাইছে, কাঁদছে, একবার দেখতে চাইছে তার রাজাকে। তাঁর দুচোখ জলে ঝাপসা হয়ে গেল। রজতাভর কাছে ভালোবাসার অন্য নাম জয়মতি। তিনি কোনদিন পাহাড়ে বেড়াতে যেতে পারবেন না। বুকের গভীরে জয়মতিকে ফিরে পাওয়ার যন্ত্রণায় বড় সুখী হলেন রজতাভ সেন।



(পরবাস-৬৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭)