সম্প্রতি প্রয়াত সির্ক্কা সেলিয়া (Sirkka Selja; ১৯২০-২০১৭) ফিনিশ ভাষার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ্যে একজন। এই মহিলার হাত ধরে ফিনিশ কবিতায় পরবাস্তবতার প্রবেশ ও স্থিতি। ইতিপূর্বে আরবি সমেত মোট ছটি ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত, ১৯৭০ সালে ফিন দেশের অত্যুচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘অর্ডার অফ দ্য লায়ন অফ ফিনল্যান্ড’ এ তিনি ভূষিতা।
সির্ক্কা সেলিয়া কবিতা লিখেছেন সুদীর্ঘ আট দশক ধরে, তাঁর শেষ কবিতা রচনার সময়ে তিনি নবতিপর! সির্ক্কা সেলিয়ার কবিতা বিচরণ করে স্বপ্ন আর জাগরণের অন্তরঙ্গ মিশ্রণে নির্মিত এক নিজস্ব জগতে, সুরম্য পরিহাসে সেখানে তিনি উপস্থিত করেন তাঁর অতিগভীর বীক্ষণগুলি। আর তার সঙ্গে ফিন দেশের প্রকৃতির অনির্বচনীয় রূপ রস গন্ধ বর্ণ স্পর্শ মূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর কবিতায়।
বাংলা ভাষায় সির্ক্কা সেলিয়ার কবিতা এর আগে অনূদিত হয়েছে বলে জানা নেই। আমার ফিনিশ পাঠের অক্ষমতা পুষিয়ে গেছে হান্নেলে পোহিয়ান্মিয়েস ও সারকা হান্তুলার করা কবিতাগুলির বর্ণাঢ্য ইংরিজি অনুবাদের কল্যাণে। হান্নেলে পোহিয়ান্মিয়েস শুধু আমার এই অনুবাদের জন্য বেশ কিছু কবিতা মূল ফিনিশ থেকে ইংরিজিতে রূপান্তরিত করেছেন। তাঁকে বিনম্র কৃতজ্ঞতা।
কবিতাগুলির অনুবাদ ও প্রকাশের অনুমতি দিয়ে আমাকে ঋণী করেছেন সির্ক্কা সেলিয়ার পরিবারের সদস্যেরা, তাঁর প্রকাশক Werner Söderström Osakeyhtiö, এবং হান্নেলে পোহিয়ান্মিয়েস ও সারকা হান্তুলা। সঙ্গের ছবি দুটি, ১৯৭৫ সালে কবির প্রতিকৃতি ও কবির সমাধিস্থল, হান্নেলে পোহিয়ান্মিয়েসের তোলা। তাঁদের অকুণ্ঠ সাহায্যে বাংলা কবিতা পাঠকদের জন্য রইল এই কবিতাগুচ্ছ; কালানুক্রমে।
আমার বাগানে (১৯৭৫)
আমার বাগানে ছড়িয়ে পড়ছে আলো
ড্যান্ডেলিওন ফুলগুলো থেকে
আর সে আলো ভেসে যাচ্ছে তোমার দিকে
সমস্ত রাত্রি জুড়ে।
একটি মহাজাগতিক শিক্ষা (১৯৯৫)
রাতটা ভরে উঠছে কিছু আবছা সম্পর্কে।
কার সঙ্গে কথা বলছ তুমি? কার কণ্ঠস্বর?
আমি বদলে যাচ্ছি, তোমার মতো হয়ে উঠছি,
আর পাহাড়ে ওপর থেকে নীচে, নীচ থেকে ওপরে
আচমকা যেন আলোতে দ্যাখা যাচ্ছে
একটা স্ফটিকের ধারগুলো;
একটা অদৃশ্য উপহার কে যেন তোমার খালি
হাতের ওপরে রেখে গেছে।
প্রাপ্তি (১৯৯৫)
কী আর দিয়েছিলাম তাকে? কিছুই না, শুধু একরাশ মুগ্ধতা।
ইস্কুলের সেই উড়নচণ্ডী দিনগুলোতে কী আর এমন
দিতে পারে বল একটা ছোট্ট মেয়ে। সে কিন্তু
ভেবেছিলো তাকে দেওয়া সেই অল্প একটু ভালোলাগা, সেই
অল্প একটু মনে রাখা, এগুলো আদপেই খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার
জিনিশ নয়।
সেদিন স্বপ্নে তাই সে আমায় উপহার দিয়ে গেল
সেলোফেনে মোড়ানো একটা প্যাকেট, তার ভেতরে
ডিমের গড়নের একটা ছোট্ট পাথর, যেখানে
তুমি দেখতে পাবে মহাসাগর, দ্বীপপুঞ্জ
এমন কী মহাদেশ গুলোও।
চেতনাই স্বপ্ন তৈরি করে (১৯৯৫)
আমার গাড়ি আমি রাস্তাতেই দাঁড় করিয়েছি;
বাকিরা সবাই সরাসরি সেলারের মধ্যে ঢুকে গেল।
আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম হতবুদ্ধি হয়ে
আর অনেকক্ষণ বাদে পড়তে পারলাম এই লিখনটুকু:
তোমার দিনের বেলার চেতনাকে ওইদিকে চালিয়ে নেওয়াই ভালো,
ওইদিকে, যেখানে রাতের শক্তিদের কাছে সাহায্য তোমাকে চাইতেই হবে!
আশ্চর্য পিতৃত্ব (১৯৯৫)
মেঝের ওপর দিয়ে দৌড়ে আসছে বেড়ালগুলো
আর তাদের সংখ্যা বেড়ে হচ্ছে দ্বিগুণ!
দুই থেকে চার, চার থেকে আট; আট দ্যাখো
ষোলতে দাঁড়িয়ে গেল।
আর এখানেই তো শেষ নয়, একটা আশ্চর্য প্রাণী
ঢুকে পড়ছে দরজার পেছন দিক থেকে,
একটা বিশাল শাদা ময়ূর
নীল আর সোনালী রঙের সবটুকু ঝলকানিতে
মাথা উঁচু করে এগিয়ে আসছে।
আমার মনে পড়ছে এরকম ডোরাকাটা রঙ
অনেকদিন আগে দেখেছিলাম তুতেনখামেনের কবরের
ঢাকনায়; আর তখনই দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ছে একটা
ছোট্ট বেড়ালছানা, ওই একদম এক রঙের।
সন্দেহ নেই ওই ময়ূরটার সন্তান ওটা!
ফটোগ্রাফারের বিড়ম্বনা (১৯৯৫)
ওই তো আসছে সে। বারান্দায় ঢুকছে ডান দিকের
দরজা দিয়ে, একটা কুকুর তার সাথে।
সরু সরু পা, ছুঁচলো মুখ, গ্রেহাউন্ড বোধহয়;
ঠিক তারই মতো ছিমছাম।
ক্যামেরা বাগিয়ে আছি, একটা দুর্দান্ত ছবি তুলবো
দুজনেরই। তার জন্য অপেক্ষা করছি।
এখন সে বারান্দার মাঝখানে। না এটা তো
কুকুর নয়, একটা বিরাট বেড়াল নাকি? কে জানে,
চিতা বোধহয়। জন্তুটা কেবলই বাঁ দিকে সরে যাচ্ছে
আর আমি দেখছি ক্যামেরার চোখ দিয়ে।
সর্বনাশ! এ যে দেখি এক বিশাল লালচে রঙের ষাঁড়
ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে, ওর থেকে ঢের বেশি উঁচু সেটা!
ও এদিক ওদিক ঘুরতে থাকে বারান্দায়;
কখনও দেখি তার সংগে একটা গ্রেহাউন্ড, কখনও চিতা,
কখনও ষাঁড়। আমি ক্যামেরা তাক করে থাকি, কখনও না কখনও
ওর সঙ্গী সবকটা অবতারকে ঠিকই একটা ছবির ফ্রেমে ধরে ফেলতে পারবো!
স্মৃতি জাগানিয়া গাছেরা (২০০০)
এই লম্বা গাছগুলো
একদম স্তব্ধ।
এত স্তব্ধ যে তারা শব্দগুলোকে জাগিয়ে তুলছে
আমার মধ্যে।
অন্য কোনো শব্দ, অন্য কোনো স্মৃতি
জেগে উঠছে অতি প্রাচীন এক সময় থেকে।
মানুষের সময়ের অনেক আগের সময়:
যখন বেঁচে থাকা প্রতিটি জীব একই ভাষাতে
কথা বলতো।
পপলার গাছেরা (২০০০)
যখনই বাগানটা পেরিয়ে যাই
অনেকদূর থেকে একরাশ মেঘের মতো
আমাকে সৌরভ পাঠায় পপলার গাছেরা।
আর কোনোভাবে কী ওদের সঙ্গে কথা বলা যায়,
ওই লম্বা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা
গাছগুলোর সঙ্গে?
শরৎকালের একটা ঝড়ের রাতের শেষে
বাগান জুড়ে ছড়িয়ে আছে বড়বড় পাতাগুলো,
কী সম্মান ভাবো:
চিঠি এসেছে ওই অত ওপরের পপলার পৃথিবী থেকে!
আজকে, এখন (২০০০)
ক্ষণস্থায়ী এক আশ্চর্য মুহূর্ত।
দরজাগুলো খুলে যাচ্ছে
অন্ধকার ঝোপঝাড়ের গোলকধাঁধায়
জন্তুদের বাসস্থানের দিকে,
সোনালী তবকে মোড়া ঘোড়ারা ছুটে যাচ্ছে রাতে।
এই তো সময়, জেগে উঠুক ঘুমন্ত দেবতারা,
জেগে উঠুক বাস্তবতা, আর এই সমস্ত দৃশ্যগুলো:
রওনা হওয়ার সময় হল হে ঘোড়সওয়ার!
কাব্যতত্ত্ব (২০০৫)
খুব সংক্ষেপে সেরে নেওয়া যায় বাস্তবের কথা।
কিন্তু স্বপ্নের কথা আলাদা
বিশদ করে না বললে কেন তা কেউ বিশ্বাস করবে?
বইয়ের দোকানের ভেড়া (২০০৫)
কয়েকটা ভেড়া ঢুকে পড়েছে বইয়ের দোকানে।
উত্তেজিত হয়ে ছুটছে খুব, দেওয়ালের কাছে বইয়ের
তাকের সামনে দিয়ে, ছুটে যাচ্ছে দোকানের
অন্ধকার পেছন দিকটাতে।
— এই যে শাদা জামাপরা দাদা, একটু সরুন দিকি,
বেরোবার রাস্তাটা খোলা রাখুন। এই ভেড়াগুলো
আদতে বড্ড ভীতু, আর কোনোদিনও এরা একটা বইও
কিনবেনা!
(পরবাস-৬৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭)