Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines



পরবাসে
সৌম্যেন ভট্টাচার্য্যর

লেখা


ISSN 1563-8685




হিমশৈল

ডাক্তার জবাব দিয়েছিল দুলুর মাকে। কথা বলার জোরটুকুও চলে যাচ্ছিল তাঁর আস্তে আস্তে। শুয়েই কাটাতেন দিনরাত। একেবারে মিশে গিয়েছিলেন বিছানাটার সাথে।

মা’র কষ্ট দেখে চোখ ফেটে জল আসত দুলুর। পাশে বসে মা’র মাথায় হাত বোলাত সে। কথা হত কম, শুধু জল গড়াত মা, বেটা দুজনের চোখ থেকে।

একদিন দুলুকে তার মা বললেন চিঁচিঁ করে - আমায় ইলেকটিরি চুল্লিতে দিস কিন্তু।

দুলু মোটেই তৈরি ছিলনা এটার জন্য। আচমকা এসব শুনে চমকে গেল সে। বলল - বাদ দাও তো আবোলতাবোল কথা। মনটা অস্থির হয়ে ওঠে তার নিশ্চিত পরিণতির কথা ভেবে।

মরা হাসি মা’র মুখে। খানিক থেমেই আবার তিনি ফিরে গেলেন ‘ইলেকটিরি চুল্লিতে’। বলেকয়েও দুলু মা’কে ফেরাতে পারেনা সেখান থেকে। অন্য কথা পাড়ে সে।

কিন্তু মা নাছোড়বান্দা। বাধ্য হয়ে সঙ্গত করে দুলু। তার ভালো লাগেনা এসব বলতে, তবু বলে। অন্তত গলা তো পাওয়া যাচ্ছে মা’র।

- তুমি তো বলেছিলে বাবার মতোই কাঠের চুল্লিতে ...

মা বলেন – না না, ইলেকটিরিতেই দিস।

দুলু বলে - খরচা বাঁচাচ্ছ?

মা বলেন - ও ভাবতে হবে নি তোকে। বাস্কে ঘাট খরচ রাখা আছে।

দুলু তাকায় বাক্সের দিকে। দুটো বাক্স ঘরে।

– তাহলে?

– তোর বাবাকে যখন কাঠে দেয়, তখন তোর বাবা নাকি উঠে বসেছিল মাঝপথে। বাঁশ দিয়ে বাড়ি মেরে ওরা শুইয়ে দিয়েছিল আবার।

- কারা?

- ওই যারা থাকে - ডোমগুলো।

- তোমায় কে বলল?

- আমি শুনেছি।

- ওরকম হয় কাঠের চিতায়।

- না না, দরকার নেই ওসব। ডোম চাঁড়ালগুলো বাঁশ পেটা করবে মরার পর, দরকার নেই আমার। ওরা নাকি পা দিয়েও ঠেলে মরা মানুষকে।

- কে বলল এসব?

- আমি শুনেছি।

- বাদ দাও তো আবোলতাবোল কথা। একটু ঘুমোবে?

- আমি জানি।

- কী জানো?

- ওরা ওরকম করে কাঠের চিতায়।

- তাতে কী? মানুষটাই চলে গেল, তো বাঁশ আর লাথি।

- না বাবা, ইলেকটিরিতেই দিস আমায়। সারা জীবন ঠাকুর-দেব্‌তার নাম করে মরার পর ডোম চাঁড়ালের লাথি খাওয়া? পাঁচটা লোকের সামনে ওভাবে লাঠির বাড়ি দেবে। কেন রে ব্যাটা, চোর নাকি? একদম করবি নি ওসব। মরেও শান্তি পাব না তাহলে।

একদমে শেষ কথাগুলো বলেন দুলুর মা। হাঁপাতে থাকেন কথা শেষ করে।

দুলু অবাক। মা এত জোর পেল কোথায় এই শরীরে? এসব কথা ভাল লাগে না তার।

বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ে সে। বলে – ঠিক আছে, তাই হবে। এখন বাদ দাও, যখন হবে দেখা যাবে।

খানিক দম নিয়েই ইলেকটিরি চুল্লি-তে ফিরে যেতে চান দুলুর মা। দুলু জোর করে চুপ করায় তাঁকে। মরা হাসিখানা লেগে থাকে মায়ের মুখে। পরদিন, না শুধু পরদিন কেন, সেদিন বিকেলে আরও একবার আর পরদিন থেকে রোজ বার তিন-চার ‘ইলেকটিরি’ চুল্লির কথা পাড়েন তার মা, ততদিন অবধি যতদিন না কথাটথা একেবার বন্ধ হচ্ছে। প্রতিবারই কায়দা করে অন্য কথায় ঢুকে পড়ে দুলু, নয়তো সরে যায় মা’র সামনে থেকে।

তারপর এক সোমবার চলে গেলেন দুলুর মা।

ক্লাবের সেক্রেটারি পাইন বাবু পাড়ার পাঁচটা ভালমন্দে থাকেন নিজে থেকেই (এবং এটা জেনেই যে পেছনে সবাই তাঁকে ফোঁপরদালাল বলে, ঘট আর কাঁঠালি কলার কথা তোলে)। রজনীগন্ধার মালা হাতে দুলুকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি – মা’কে কাঠেই দিবি তো বাবার মতো?

দুলু বলল - মা ইলেকট্রিক চুল্লির কথা বলে গেছে।

- কেন রে, তোর মা নাকি বলে রেখেছিল কাঠেই দিতে। তোর বাবাকে যেমন ...

- মা বলছিল কাঠে হুজ্জতি বেশি। অনেক খরচ, গন্ধটন্ধ হয়। তাছাড়া ওইসব ...

মুচকি হাসলেন পাইন বাবু। বললেন - তোর মা স্কুল না পেরোলে কী হবে, অনেক অ্যাডভান্সড ছিল তোর বাবার থেকে।


(এই সংখ্যায় সৌম্যেন ভট্টাচার্য্যর আরো একটি গল্পঃ 'উদ্‌যাপন')




(পরবাস-৭০, ৩১ মার্চ ২০১৮)