Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে সুনন্দন চক্রবর্তীর
আরো লেখা



ISSN 1563-8685




বাঙালের কেনিয়া দর্শন


মার ছেলেবেলা বিজয়গড় কলোনিতে। আমাদের তিনটে বাড়ি পরে থাকত অমলকাকুরা। অমলকাকুর যখন বিলেত যাওয়া ঠিক হল পাড়ায় হুলুস্থুল। শংকর দা-র মা হরির লুট দিলেন। উনি আবার বাতাসা বলতে পারতেন না। বলতেন বাসাতা ল। আমরা বলতাম কি কইলেন মাসিমা। উনি একগাল হেসে বলতেন হ, আমি তো বাসাতা-রে বাসাতা কইতে পারিনা, হে লইগ্যা বাসাতা কই। তারপর তো অনেক জল গড়িয়ে গেল। শংকর দা-র বউ এখন রোজ সকালে শংকর দা-র ছেলের সঙ্গে স্কাইপিতে একঘন্টা তত্ত্বতালাশ নেয়। নাতির জন্যে কি কি বাংলা বই কিন্ডল-এ ভরতে হবে বলে দেয়। আমার বন্ধুরা পুজোয় আইসল্যান্ড যাবে না তিব্বত তাই নিয়ে ভাবে। বাঁধা চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফটাফট থাইল্যান্ড বা উজবেকিস্তান বা ভিয়েতনাম চলে যায় ঠিকা কনসাল্টেন্সি করতে। তবে হ্যাঁ, ঠেক-এ এসে কেউ ভুলেও ফাটাবার চেষ্টা করে না। অরূপ একবার ইন্দোনেশিয়ায় তিনমাস কাজ করে আসার পর যা হেনস্তা হয়েছিল সবার মর্মে বিঁধে আছে। অরূপ বলছিল “ওখানে তো অনেক আগ্নেয়গিরি,” কালু বলল, “একশো সাতাশটা।" “হ্যাঁ, তার-ই একটা, মাউন্ট টোবা,” কালু বলল, “ওরা বলবে গুনুং টোবা, লেক টোবা থেকে একশো মাইল দূরে আজ থেকে প্রায় চুয়াত্তর হাজার বছর আগে সৃষ্ট।” অরূপ শুকনো হেসে বলল, "আজ যাই রে, বাড়িতে মিস্তিরি আসবে।" কাজের সূত্রে অরূপের অর্ধেক পৃথিবী ঘোরা। কালু শুধু পুজোর সময় দুর্গাপুর যায় শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু ছেলেকে নিয়ে রোজ ঘন্টা তিনেক ডিসকভারি বা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক দেখে।

সুতরাং যেদিন মাসাইমারা যাওয়া ঠিক হল মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমি শুধু কি খেয়েছি কি দেখেছি বলব, কেনিয়ার বাকিটা কালু বলবে।

আমার সঙ্গীরা সব জাঁদরেল ফোটোগ্রাফার। ফলে আমাদের সঙ্গের ঝোলা বিবিধ সন্দেহজনক জিনিসে ভরতি। নানা অগ্নিপরীক্ষা পার হয়ে বিমানের গর্ভজাত হলাম। বিমানকর্মীরা ভেড়ার পালের মতো তাড়িয়ে এনে খোদায় মালুম কত শ' না কত হাজার লোক ঐ একটা প্লেন-এর এদিকে ওদিকে নানা কায়দায় ঠেসেঠুসে, দুরুস্ত করে দিয়ে হাসি হাসি মুখে ছোটাছুটি করতে লাগল। বসতে না বসতেই দশ বারোজন যাত্রী আমাদের অংশটায় যে দুটি বাথরুম আছে তা ব্যবহার করার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে লাগল, গোটা চারেক বাচ্চা কীসের জন্যে কে জানে হাহাকার করতে লাগল, বিমানসেবিকারা বিভিন্ন তৃষ্ণার্ত যাত্রীদের জল দিতে দিতে, বাচ্চাদের মায়েদের সাহায্য করতে করতে বাথরুমের কেল্লার ফটক আগলে দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে মোহিত করে দিল। মনে পড়ে গেল আমাদের পাড়ার গৌতমের বড়দি ছিলেন বিমানসেবিকা—সে সময়ে বেশ ব্যতিক্রমী পেশা। ছুটির দিনে ইনুদি যখন বের হত গড়িয়া থেকে যাদবপুর পর্যন্ত তরুণেরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকত। ইনুদি অম্লান হাসিমুখে তাদের পাত্তা না দিয়ে চলে যেত।

দুবাই বিমানবন্দর—পাড়ায় সবাই বলে দিয়েছিল—দেখার জিনিস। মূল অংশটা হয়ত আমি দেখতে পাইনি কেননা আমরা যারা ছ ঘন্টা বাদে আরেকটা প্লেন-এ উঠে নাইরোবি যাব তাদের যে অঞ্চলটায় এনে গস্ত করা হল সেটা একটা বড় মল-এর মতো জায়গা। একমাত্র তফাত প্রচুর বসা এবং আধশোয়া হওয়ার জায়গা আছে। যাই হোক রাত্তির আটটা নাগাদ আমরা নাইরোবি নেমে পড়লাম। ভারি আরাম হল। ঠিক আমাদের ছেলেবেলায় দেখা দমদমের মতো খানিকটা। একটু গরিব, একটু মলিন। বাইরে বেরোতে একটু রাত-ই হল। রাস্তায় তখন বেশ ভিড় কম। ফলে মিনিট কুড়ির মধ্যেই হোটেলে পৌঁছে খাওয়াদাওয়ার উপায় করা গেল। আরেকটু হলেই কিচেন বন্ধ হয়ে যেত। দীর্ঘ অপেক্ষা সহ বিমান যাত্রায় সবাই ক্লান্ত। কিন্তু সবাই দেখলাম নবলব্ধ সিম কার্ড ব্যবহার করে অগাস্ট মাসের কলকাতার লোকজনদের জানিয়ে দিচ্ছে যে এখানে চমৎকার ঠান্ডা। আফটার অল বন্ধু পরিজনদের ঈর্ষা উৎপাদন না করলে বিদেশ ভ্রমণের আর সুখ কি।

সকালে ছোট হাজরি সেরেই গেম পার্ক ভ্রমণ। ছাদ খুলে যাওয়া গাড়ি দরজায় প্রস্তুত। ফোটোগ্রাফারদের বায়নাক্কা মেনে গাড়ি প্রতি দুজন। জংলা টুপি, জংলা পোষাক পরে একদম হাটারি-তে দেখা জন ওয়েনের স্টাইলে গাড়িতে গিয়ে বসে বেশ একটা শ্লাঘা বোধ হল। ইস, পাড়ার মেয়েগুলো জানতেও পারলনা।


ভোর ভোর-ই টিকিট কাউন্টারে বেশ ভিড়। সর্দার ফোটোগ্রাফার যতক্ষণে টিকিট কেটে আনছে চাদ্দিক একটু ঘুরে দেখতে গিয়ে দেখি জনা দশেক মাসাই পুরুষ ও রমণী সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছেন। নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে তাঁদের ছবি তোলা যেতে পারে। ইদানীং আমাদের পাহাড় অঞ্চলে বা নেপালেও এই একটু বিব্রত হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। সভ্যতা যাঁদের প্রথাগত জীবন কেড়ে নিয়েছে তাঁরা সেই আদি বেশভূষা সজ্জিত হয়ে তাঁদের প্রথাগত নাচ গান দেখিয়ে কিছু রোজগারের চেষ্টা করেন। এঁদের বিমুখ করতেও খারাপ লাগে আবার এঁদের এই বিজাতীয় পরিবেশে রঙ চং মেখে নাচতে দেখলে একটু অপরাধবোধও জাগে।


খোলা ছাদ দিয়ে বেশ কনকনে ঠান্ডা হাওয়া আসছিল। আমি আড়নয়নে কফির ফ্লাস্কের দিকে চাইছিলাম। কিন্তু সর্দার ফোটোগ্রাফার জাকে বলে একদম ‘ফোকাসড’। চাপা গলায় নির্দেশ এল ‘স্টপ’। তার আঙুল বরাবর তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই তো, ঝোপড়া গাছটার ডালে নির্বিকার বসে আছে এক বাঁশপাতি। তারপর এক ডোবায় দেখলাম ভরতি সারস। তারপর প্রথম চতুষ্পদ—এক জেব্রা। তারপর-ই এক সিংহি। আমার চারপাশে মেশিনগানের মতো শাটার পড়ার আওয়াজ হচ্ছে। আই এস ও, এপারচার, এক্সপোজার কম্পেন্সেশন, এইসব দুর্বোধ্য হিশহিশানির জবাব দিতে দিতে সর্দার ফোটোগ্রাফার একটা পাতলা বালিশের ওপর ক্যামেরার নল ভর দিয়ে রেখে ছবি তুলছেন। আ রে ছি ছি, আমি তো বালিশটার উদ্দেশ্য একদম ভুল বুঝেছিলাম। এরপর আমারও দিব্যি নেশা লেগে গেল। ল্যাগবেগে জিরাফগুলো যখন হাঁটছে পষ্ট দেখতে পেলাম দুটো ক্ষুদে ক্ষুদে নীল রঙের পাখি ওদের আর জেব্রাগুলোর পায়ে পায়ে হাঁটছে আর থেকে থেকে কি যেন ধরে ধরে খাচ্ছে। উটপাখিটা যখন ছাই রঙা মেয়ে উটপাখিটার দিকে ধেয়ে গেল দেখলাম তার পাখার পিছনের দুটো পালকের গুচ্ছ বলের মত ফুলে উঠল। আমাদের সারথী-কাম-গাইড অসম্ভব ধৈর্য নিয়ে একটা ধারাবিবরণী দিচ্ছিল। ডিসকভারি না দেখলেও জনসন্‌স গেজেল আর এন্টিলোপের তফাৎ বুঝতে আমাদের কোন অসুবিধাই হত না। শেষমেশ যখন একটা দাঁতালো শুয়োর বেরিয়ে এসে বিশ্রীভাবে আমাদের টেরিয়ে টেরিয়ে দেখে আবার জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল তখন আমি মরিয়া হয়ে বললাম কিছু একটু খেলে হয়না?

দুপুরে আমার যে বাল্যবন্ধু গত আট বছর নাইরোবিতে আছে তার বাড়িতে চর্ব্যচোষ্য খাওয়া ছিল। তারা যখন শুনল আমরা রাতে ‘কার্নিভোর’-এ টেবল বুক করেছি নানা ছোটখাটো শলাপরামর্শ দিল। ওদের কাছ থেকেই জানতে পারলাম গলায় পানের ট্রে-র মত ঝুলিয়ে একটা লোক যে ভদকা আর মধু মিশ্রিত অমৃতটি পরিবেশন করে তার নাম দাওয়া। আর দাওয়াই যেহেতু ওষুধ, পরিবেশককে তাই ডক্টর বলা হয়।

আমার খুব মনের মত জায়গা কার্নিভোর। কেউ কোন মাংস না খেয়ে মাছ-এর পদ দিয়ে খাওয়া সারলে ওরা পরম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সেটাকে নিরামিষ ধরে দাম নেয়। এরকম কমনন্সেন্সিক্যাল এপ্রোচ এখন কম-ই চোখে পড়ে। ঢোকার মুখেই একটা বড় গোল জায়গায় লালচে আভার আগুনে টন টন মাংস শূল্যপক্ক হচ্ছে, তার খোশবাইয়ে ভুবন মাতোয়ারা। গোটা রেস্তোরাঁটিতে মৃদু আলো। খালি দেয়ালে কয়েকটা ম্যামথ শিকারের ছবি টাঙিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। গরু, শুয়োর, খরগোস, উটপাখি, টার্কি গোগ্রাসে খেয়ে নিতে নিতে আপনার যে অদম্য ইচ্ছে হবে একখানা মুগুর নিয়ে বেরিয়ে পড়ার তার থেকে আপনাকে বাঁচাবার জন্যে আছে ডাক্তার। এক কামড় মাংস খেয়ে গেলাসে একটা আলতো চুমুক দিলে সবাইকে ভাই বেরাদর মনে হবে, কলিজার মধ্যে বেহস্ত-এর সঙ্গীতমূর্চ্ছনা শুনতে পাবেন, আপনার জখমি দিল-এ হুরি-পরীরা মলম লাগিয়ে দেবে, আপনি--যাক গে ব্যাপারটা তো বুঝতে পেরেছেন।

মাসাই যাওয়ার রাস্তা তিন-চতুর্থাংশ চমৎকার। তারপর না-বাঁধানো, কখনও কখনও এবড়ো-খেবড়ো, বন-এর পথ। তার কতক কতক জায়গায় মাসাই বসতের মধ্যে দিয়ে গেছে রাস্তা। সেখানে একটা করে সরু ডাল দিয়ে পথ আটকানো। আমাদের যেমন কালীপুজোর চাঁদা তেমনি কিছু কিছু চাঁদা দিলে সেই ডাল তুলে পথ খুলে দেওয়া হয়। বিকেল নাগাদ পৌঁছে গেলাম আমাদের আস্তানা মান্নাটা ক্যাম্প-এ। পৌঁছে চমক সেখানে সুদীপ্ত হাজির। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-ও তার ছবি নেয়। তার ড্রেডলক, সতেজ চেহারা এবং গমগমে গলা মান্নাটা ক্যাম্প-এ পূর্ব পরিচিত। কাছেই যে মাসাই গ্রাম সেখানেও তার ইয়ার-বক্সি অঢেল। সুতরাং আমাদেরও খাতিরদারি হল ভালই। সেই সাঁঝবেলাতেই আমরা মাসাই গ্রাম ঘুরে এলাম। সুদীপ্তর দোস্তেরা নেচে গেয়ে দেখালে। কাঠে কাঠে ঘষে আগুন জ্বালিয়ে দেখালে। নামমাত্র বিনিময় মূল্যে। তারপর দুজন দুজন করে একেকটা বাড়ির ভিতর নিয়ে গিয়ে গল্পগাছা করলে। এঁদের অনেকেই এইট অবধি পড়েছেন এবং ট্যুরিস্টদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথাবার্তা চালানো শিখেছেন। জীবিকার প্রয়োজনেই। এঁদের বড় আয় এই গ্রাম দেখিয়ে এবং ট্যুরিস্টদের কাছে হাতের বোনা মাসাই কম্বল, বা হাতে তৈরি গয়না ইত্যাদি বিক্রি করা। সবাই যাতে এর সুযোগ পায় সেইজন্যে এক বাড়িতে দুজনের বেশি নিয়ে যাওয়া হয়না। জিনিস কেনা বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু হলে ভাল। দরাদরি করাই রীতি। এবং এঁরা যে কোনও দোকানের থেকে অনেক কম দাম চেয়ে থাকেন। সিংহের লেজ ধরে রেখে তাকে বল্লম দিয়ে শিকার করা যে মাসাইদের গল্প আমরা শুনেছি এঁরা তার থেকে অন্য কোন গল্পে জায়গা পাবেন। খালি দেখতে পাবেন এমনকি শীর্ণকায় মাসাই কিশোরটিও বিনা নোটিশে মাটি ছেড়ে অনেকটা ওপরে উঠে যেতে পারে মাধ্যাকর্ষণের তোয়াক্কা না করেই।


মাসাইমারা-র জঙ্গল যেহেতু মূলত বড় ঘাসের জঙ্গল এবং সমস্ত কিছুর পরেও প্রাণীকুল এত বিপুল যে গাড়ি নিয়ে সারাদিন দাবড়ে বেড়ালে আপনার সবার সঙ্গেই দেখা হয়ে যাবে। জেব্রা, জিরাফ, ওয়াইল্ড বিস্ট তো অগুনতি, চিতা, সিংহ, জলহস্তী, কুমির দেখা যাবে যথেষ্ট পরিমাণে। কিন্তু ফোটোগ্রাফারের দল তাতে সন্তুষ্ট নয়। তারা চাইবে এরা সব ছবি তোলার সময় দিক, কিন্তু শুধু যেন দাঁড়িয়ে না থাকে, শুয়ে, বসে, আড়মোড়া ভেঙে, হাই তুলে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে দেখাক। আর স্টুপিডটা যে গাছের ছায়ায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে ও কি বুঝতে পারছে না যে ওর গায়ে আলো পড়ছেনা, ব্যাকগ্রাউন্ডটা জ্বলে যাচ্ছে তো। আর ঐ ঢ্যাঙ্গাটা, ওর কি ঐ গাছটার একটু ওপাশে দাঁড়ানো উচিত ছিলনা? ও কি বুঝতে পারছেনা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে ও একেবারে মিশে যাচ্ছে? আর এই বেয়াক্কেলে মেঘ সকালে নরম আলোটার সময় ঘন হয়ে থাকল এই দুপুরে কড়া সময়টা থাকলে তো একটু ডিফিউজড লাইট পাওয়া যেত। কিন্তু এসবের পরও বিস্তীর্ণ ঘাসের প্রান্তরে চকিত কোন গাছের ছায়ায় বসে আকাশের পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘমালার দিকে তাকিয়ে—যে মেঘমালা বুঝি শুধু আফ্রিকাতেই দেখা যায়—আপনি যখন লাঞ্চবক্স খোলার আওয়াজ পাবেন মনে হবে এই জীবনই তো আপনি চেয়েছিলেন।


সেই জীবন কাটিয়ে আমরা চললাম নাইভাসা লেক-এর উদ্দেশ্যে। (অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ কালু-র কাছে জেনে নেবেন।) সুদীপ্ত রয়ে গেল আরও কিছু ছবি তুলবে বলে। লেক নাইভাসা-র ধারে আমাদের থাকবার জায়গাটি ভারি মনোরম। খাবার হলঘর পার হয়ে চমৎকার লন পেরিয়ে রিসর্টের নিজস্ব লঞ্চঘাট। লম্বা গাছে ছাওয়া সেই লন-এ বসেই চোখে পড়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে উড়ে আসছে মেছো ঈগল, ঝপাঝপ জলে পড়ছে সাদা-কালো মাছরাঙা, দুটো ফর্কটেইল সানবার্ড খুনসুটি করছে ইতিউতি। চাট্টি খেয়েই মোটর বোট নিয়ে বেরিয়ে পড়া হল। মিষ্টি জলের লেক ভর্তি পানকৌড়ি, সারস, বক আর পেলিক্যান। সবচেয়ে চমকপ্রদ মাঝির খেল। তীব্র শিস দিয়ে সে জলে ছুঁড়ে দিচ্ছে বালতিতে রাখা ছোট ছোট তেলাপিয়া মাছ। আর উঁচু ডাল থেকে বিদ্যুৎগতিতে নেমে এসে ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছে ঈগলেরা। সেই সুবিশাল হ্রদের এক প্রান্তে ক্রেসেন্ট আইল্যান্ড। সেখানে নেমে একটু হেঁটে চলে বেড়ানো যায়। আপনার খুব কাছ দিয়ে ঘুরে বেড়াবে হরিণেরা আর জেব্রা-রা। একসার পেলিক্যান দুলকি চালে হেঁটে যাবে জল ঘেঁষে। দুটো চারটে ওয়াইল্ড বিস্ট হয়ত একটু উলটোপালটা ছুটবে।

কিন্তু সুখের ব্যাপার হচ্ছে আপনাকে—না না আপনাকে নয়, আমাকে—ফিরে আসতে হবে। আর জল কিনে খেতে হবে না, নাগাড়ে চিন্তাগুলোকে ইংরেজিতে ট্র্যানস্লেশন করতে হবে না, কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ বলতে হবে না, প্রতিমুহূর্তে ডলারের দাম মাথায় রাখতে হবে না, সুবলকে বলা যাবে চায়ের সঙ্গে কিন্তু প্রজাপতি বিস্কুট খাবো একটা। আপনাদের বিদেশ যাত্রার ক্ষুরে নমস্কার।





(পরবাস-৭২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)