সুতরাং যেদিন মাসাইমারা যাওয়া ঠিক হল মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমি শুধু কি খেয়েছি কি দেখেছি বলব, কেনিয়ার বাকিটা কালু বলবে।
আমার সঙ্গীরা সব জাঁদরেল ফোটোগ্রাফার। ফলে আমাদের সঙ্গের ঝোলা বিবিধ সন্দেহজনক জিনিসে ভরতি। নানা অগ্নিপরীক্ষা পার হয়ে বিমানের গর্ভজাত হলাম। বিমানকর্মীরা ভেড়ার পালের মতো তাড়িয়ে এনে খোদায় মালুম কত শ' না কত হাজার লোক ঐ একটা প্লেন-এর এদিকে ওদিকে নানা কায়দায় ঠেসেঠুসে, দুরুস্ত করে দিয়ে হাসি হাসি মুখে ছোটাছুটি করতে লাগল। বসতে না বসতেই দশ বারোজন যাত্রী আমাদের অংশটায় যে দুটি বাথরুম আছে তা ব্যবহার করার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে লাগল, গোটা চারেক বাচ্চা কীসের জন্যে কে জানে হাহাকার করতে লাগল, বিমানসেবিকারা বিভিন্ন তৃষ্ণার্ত যাত্রীদের জল দিতে দিতে, বাচ্চাদের মায়েদের সাহায্য করতে করতে বাথরুমের কেল্লার ফটক আগলে দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে মোহিত করে দিল। মনে পড়ে গেল আমাদের পাড়ার গৌতমের বড়দি ছিলেন বিমানসেবিকা—সে সময়ে বেশ ব্যতিক্রমী পেশা। ছুটির দিনে ইনুদি যখন বের হত গড়িয়া থেকে যাদবপুর পর্যন্ত তরুণেরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকত। ইনুদি অম্লান হাসিমুখে তাদের পাত্তা না দিয়ে চলে যেত।
দুবাই বিমানবন্দর—পাড়ায় সবাই বলে দিয়েছিল—দেখার জিনিস। মূল অংশটা হয়ত আমি দেখতে পাইনি কেননা আমরা যারা ছ ঘন্টা বাদে আরেকটা প্লেন-এ উঠে নাইরোবি যাব তাদের যে অঞ্চলটায় এনে গস্ত করা হল সেটা একটা বড় মল-এর মতো জায়গা। একমাত্র তফাত প্রচুর বসা এবং আধশোয়া হওয়ার জায়গা আছে। যাই হোক রাত্তির আটটা নাগাদ আমরা নাইরোবি নেমে পড়লাম। ভারি আরাম হল। ঠিক আমাদের ছেলেবেলায় দেখা দমদমের মতো খানিকটা। একটু গরিব, একটু মলিন। বাইরে বেরোতে একটু রাত-ই হল। রাস্তায় তখন বেশ ভিড় কম। ফলে মিনিট কুড়ির মধ্যেই হোটেলে পৌঁছে খাওয়াদাওয়ার উপায় করা গেল। আরেকটু হলেই কিচেন বন্ধ হয়ে যেত। দীর্ঘ অপেক্ষা সহ বিমান যাত্রায় সবাই ক্লান্ত। কিন্তু সবাই দেখলাম নবলব্ধ সিম কার্ড ব্যবহার করে অগাস্ট মাসের কলকাতার লোকজনদের জানিয়ে দিচ্ছে যে এখানে চমৎকার ঠান্ডা। আফটার অল বন্ধু পরিজনদের ঈর্ষা উৎপাদন না করলে বিদেশ ভ্রমণের আর সুখ কি।
সকালে ছোট হাজরি সেরেই গেম পার্ক ভ্রমণ। ছাদ খুলে যাওয়া গাড়ি দরজায় প্রস্তুত। ফোটোগ্রাফারদের বায়নাক্কা মেনে গাড়ি প্রতি দুজন। জংলা টুপি, জংলা পোষাক পরে একদম হাটারি-তে দেখা জন ওয়েনের স্টাইলে গাড়িতে গিয়ে বসে বেশ একটা শ্লাঘা বোধ হল। ইস, পাড়ার মেয়েগুলো জানতেও পারলনা।
দুপুরে আমার যে বাল্যবন্ধু গত আট বছর নাইরোবিতে আছে তার বাড়িতে চর্ব্যচোষ্য খাওয়া ছিল। তারা যখন শুনল আমরা রাতে ‘কার্নিভোর’-এ টেবল বুক করেছি নানা ছোটখাটো শলাপরামর্শ দিল। ওদের কাছ থেকেই জানতে পারলাম গলায় পানের ট্রে-র মত ঝুলিয়ে একটা লোক যে ভদকা আর মধু মিশ্রিত অমৃতটি পরিবেশন করে তার নাম দাওয়া। আর দাওয়াই যেহেতু ওষুধ, পরিবেশককে তাই ডক্টর বলা হয়।
আমার খুব মনের মত জায়গা কার্নিভোর। কেউ কোন মাংস না খেয়ে মাছ-এর পদ দিয়ে খাওয়া সারলে ওরা পরম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সেটাকে নিরামিষ ধরে দাম নেয়। এরকম কমনন্সেন্সিক্যাল এপ্রোচ এখন কম-ই চোখে পড়ে। ঢোকার মুখেই একটা বড় গোল জায়গায় লালচে আভার আগুনে টন টন মাংস শূল্যপক্ক হচ্ছে, তার খোশবাইয়ে ভুবন মাতোয়ারা। গোটা রেস্তোরাঁটিতে মৃদু আলো। খালি দেয়ালে কয়েকটা ম্যামথ শিকারের ছবি টাঙিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। গরু, শুয়োর, খরগোস, উটপাখি, টার্কি গোগ্রাসে খেয়ে নিতে নিতে আপনার যে অদম্য ইচ্ছে হবে একখানা মুগুর নিয়ে বেরিয়ে পড়ার তার থেকে আপনাকে বাঁচাবার জন্যে আছে ডাক্তার। এক কামড় মাংস খেয়ে গেলাসে একটা আলতো চুমুক দিলে সবাইকে ভাই বেরাদর মনে হবে, কলিজার মধ্যে বেহস্ত-এর সঙ্গীতমূর্চ্ছনা শুনতে পাবেন, আপনার জখমি দিল-এ হুরি-পরীরা মলম লাগিয়ে দেবে, আপনি--যাক গে ব্যাপারটা তো বুঝতে পেরেছেন।
মাসাই যাওয়ার রাস্তা তিন-চতুর্থাংশ চমৎকার। তারপর না-বাঁধানো, কখনও কখনও এবড়ো-খেবড়ো, বন-এর পথ। তার কতক কতক জায়গায় মাসাই বসতের মধ্যে দিয়ে গেছে রাস্তা। সেখানে একটা করে সরু ডাল দিয়ে পথ আটকানো। আমাদের যেমন কালীপুজোর চাঁদা তেমনি কিছু কিছু চাঁদা দিলে সেই ডাল তুলে পথ খুলে দেওয়া হয়। বিকেল নাগাদ পৌঁছে গেলাম আমাদের আস্তানা মান্নাটা ক্যাম্প-এ। পৌঁছে চমক সেখানে সুদীপ্ত হাজির। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-ও তার ছবি নেয়। তার ড্রেডলক, সতেজ চেহারা এবং গমগমে গলা মান্নাটা ক্যাম্প-এ পূর্ব পরিচিত। কাছেই যে মাসাই গ্রাম সেখানেও তার ইয়ার-বক্সি অঢেল। সুতরাং আমাদেরও খাতিরদারি হল ভালই। সেই সাঁঝবেলাতেই আমরা মাসাই গ্রাম ঘুরে এলাম। সুদীপ্তর দোস্তেরা নেচে গেয়ে দেখালে। কাঠে কাঠে ঘষে আগুন জ্বালিয়ে দেখালে। নামমাত্র বিনিময় মূল্যে। তারপর দুজন দুজন করে একেকটা বাড়ির ভিতর নিয়ে গিয়ে গল্পগাছা করলে। এঁদের অনেকেই এইট অবধি পড়েছেন এবং ট্যুরিস্টদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথাবার্তা চালানো শিখেছেন। জীবিকার প্রয়োজনেই। এঁদের বড় আয় এই গ্রাম দেখিয়ে এবং ট্যুরিস্টদের কাছে হাতের বোনা মাসাই কম্বল, বা হাতে তৈরি গয়না ইত্যাদি বিক্রি করা। সবাই যাতে এর সুযোগ পায় সেইজন্যে এক বাড়িতে দুজনের বেশি নিয়ে যাওয়া হয়না। জিনিস কেনা বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু হলে ভাল। দরাদরি করাই রীতি। এবং এঁরা যে কোনও দোকানের থেকে অনেক কম দাম চেয়ে থাকেন। সিংহের লেজ ধরে রেখে তাকে বল্লম দিয়ে শিকার করা যে মাসাইদের গল্প আমরা শুনেছি এঁরা তার থেকে অন্য কোন গল্পে জায়গা পাবেন। খালি দেখতে পাবেন এমনকি শীর্ণকায় মাসাই কিশোরটিও বিনা নোটিশে মাটি ছেড়ে অনেকটা ওপরে উঠে যেতে পারে মাধ্যাকর্ষণের তোয়াক্কা না করেই।
কিন্তু সুখের ব্যাপার হচ্ছে আপনাকে—না না আপনাকে নয়, আমাকে—ফিরে আসতে হবে। আর জল কিনে খেতে হবে না, নাগাড়ে চিন্তাগুলোকে ইংরেজিতে ট্র্যানস্লেশন করতে হবে না, কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ বলতে হবে না, প্রতিমুহূর্তে ডলারের দাম মাথায় রাখতে হবে না, সুবলকে বলা যাবে চায়ের সঙ্গে কিন্তু প্রজাপতি বিস্কুট খাবো একটা। আপনাদের বিদেশ যাত্রার ক্ষুরে নমস্কার।
(পরবাস-৭২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)