Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines



পরবাসে রঞ্জন ভট্টাচার্যের
আরো লেখা




ISSN 1563-8685




অমৃতসমান

"চলো পুণ্যবান — চলো"

— কথাগুলি যেন পরম মমতায় কম্পিত হতে লাগলো।

— সেই ঊষালগ্নে।

— অজস্র বৃক্ষের পত্রতলে।

* * *

ভূমাপৃথিবীর এই গূঢ়স্থানে সে নিজেই প্রবেশ করেছিলো বিগতদিনের সূচনায়। তারপর একের পর এক আশ্চর্য ঘটনাক্রমে কত দ্রুত অতিক্রান্ত হলো সেই দিনটি। এখন পরবর্তী দিনটি অজ্ঞাত ভবিষ্যের ইঙ্গিতে যেন স্থির হয়ে আছে এই প্রশান্ত প্রত্যূষে। আর এই ক্রান্তিকালেই যেন সে আক্রান্ত হলো বিগতদিনের স্মৃতিতে।

* * *

তার মনে পড়লো সেই বিচ্ছিন্ন বিরল স্থানটির কথা .... সেই স্বল্পালোকিত আবদ্ধ পরিবেশটির কথা ....আর সেই দুর্লক্ষ্য কোণ থেকে বিন্দু বিন্দু ক্ষরিত হওয়া তরলটির কথা....

....প্রথমে সে এই ব্যাপারটিকে যথাযথ উপলব্ধিই করতে পারে নি। কিন্তু এরপর যখন একটির পর একটি তরলবিন্দু ঝরে পড়তে লাগলো তার মুখের উপর তখন সে প্রবল বিস্ময়ে তাকালো উপরের দিকে...

আসন্ন দিনের আলোকাভাসে সে বুঝতে পারলো একটি স্তূপাকৃতি বস্তু তার সম্মুখস্থিত বিশালবৃক্ষের শাখাসংলগ্ন হয়ে আছে। আর সেই স্তূপের থেকেই ক্ষরিত হচ্ছে বিন্দু বিন্দু গাঢ় তরল।

'কি এটি?' — সেই প্রগাঢ় নির্জনতায় নিজেকেই প্রশ্ন করেছিলো সে।

'মধু। জীবনের মধু।' — এক আশ্চর্য ললিত কন্ঠে উত্তর এলো ওই স্তূপের দিক থেকে।

'আমি শতকোটি মধুলিটের অক্লান্ত পরিশ্রমের সৃষ্টি — এবার আমার স্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ এলো তোমার কাছে — আমায় লেহন করো — এবং তৃপ্ত হও।' — অতি রমণীয় কন্ঠের এই মৃদুভাষ যেন ধ্বনিত হলো ওই স্তূপের প্রান্ত থেকে। এবং আশ্চর্য ভাবে অনুরণিত হতে লাগলো ওই গূঢ় আবহে।

এতক্ষণে বৃক্ষসংলগ্ন স্তূপটিকে নিরীক্ষণ করে সে বুঝলো যে সেটি একটি মধুচক্র। তারই এক প্রান্ত থেকে ক্ষরিত হচ্ছে তার অন্তঃস্থ রস।

এই অবকাশে তার মুখের উপর এসে পড়া তরলবিন্দুটি গড়িয়ে নেমে এলো তার ওষ্ঠের প্রান্তে। তখনই সে উপলব্ধি করলো যে ওই তরলবিন্দুটি অপূর্ব স্বাদু।

* * *

সেই বিস্ময়ের আবেশের মাঝেই তার সম্মুখের আলো স্পষ্টতর হয়ে উঠছিলো। সেই অমল আলোয় সে দেখতে পেলো আরেক বিচিত্র ঘটনা।

একটি শুভ্র বর্ণের মূষিক চক্রাকারে আবর্তিত হয়ে তার সম্মুখের প্রকাণ্ড বৃক্ষটির কাণ্ডটিকে ক্রমাগত দংশন করে চলছে।

'এরা কারা?' — প্রবল কৌতূহলের উদ্রেক হলো তার মনে। আর তখনই কর্কশ কন্ঠে উত্তর এলো —

— 'আমি দিবা। আর ও রাত্রি। যাবতীয় অস্তিত্বের নিঃশব্দে ক্ষয় করাই আমাদের ধর্ম।'

মূষিকের কথা তার সহজবোধ্য বলে মনে হলো না। তাই ওদের উদ্দেশ্যে সে বলে উঠলো —

— 'রহস্য কোরো না। স্পষ্ট করে বলো তোমরা কে? আর কেনই বা এভাবে নষ্ট করছো এই বৃক্ষটিকে?'

মূষিকদুটি তার কথায় কর্ণপাতও করলো না। পূর্ববৎ নিবিষ্ট মনে দংশন করে যেতে লাগলো বৃক্ষটির নিম্নভাগ।

* * *

সদ্য সকালের নম্র আলো স্ফটিকের মতো প্রখর হয়ে উঠলো স্বল্পক্ষণ বাদেই। আর সেই ব্যাপ্ত আলোয় যা তার দৃষ্টিপথে এলো তাতে নিমেষেই আতঙ্কে হিম হয়ে গেলো সে।

ওই বদ্ধস্থান থেকে সামান্য দূরত্বে এক বিপুল ফণা উদ্যত করে স্থির হয়ে আছে একটি বিরাট কৃষ্ণসর্প। বাকরুদ্ধ হয়ে সে তাকিয়ে রইলো ওই মহাসর্পটির দিকে।

— 'আমি সংহার — জীবনের অন্তিম সংহার। দংশনের দ্বারা মৃত্যুকে অমোঘ ভাবে নিবেদন করাই আমার ধর্ম।' — অতি শুষ্ককন্ঠে উত্তর এলো ওই মহাভুজঙ্গের কাছ থেকে।

— 'কিন্তু কেন? কি কারণে তুমি কোনো নিরপরাধের প্রাণ হরণ করবে? কে দিয়েছে তোমায় এই অধিকার?'

কৃষ্ণসর্পটি এ কথার কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। পূর্বের মতোই স্থির হয়ে রইলো তার উদ্যত ফণা ধারণ করে।

* * *

এইসময় তার দৃষ্টিগোচর হলো একটি সোপানস্তম্ভ। অতি সন্তর্পণে ওই অপ্রশস্ত সোপানটির সাহায্যে সে ওই বদ্ধ পরিসরের বাইরে এলো।

বাইরের বিশাল আকাশের নীচে এসে দিনের প্রথম আলোয় সে অবাক হয়ে দেখলো যে কোন্ অন্ধকার গর্ভের অভ্যন্তরে সে প্রবিষ্ট ছিলো এতক্ষণ। তারপর নিজের মনেই বলে উঠলো — 'কি বিশাল এই গহ্বর! যেখানে ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ ... রহস্যময় দুই মূষিক... আর প্রকাণ্ড বৃক্ষের শাখায় সংযুক্ত এক আশ্চর্য মধুচক্র — সবাই কি অদ্ভুতভাবে সহাবস্থান করে! ধরিত্রীর এ কোনস্থান কি জানে!'

— 'আমার নাম মহাকূপ। আমিই মানুষের অন্তিম স্থান।' — এক গম্ভীর নাদ যেন উত্থিত হলো সেই কূপের অভ্যন্তর থেকে।

সে বলে উঠলো — 'তোমার গহন আকর্ষণীয় কিন্তু ভয়াবহ। বিশদ করে বলো তোমার পরিচয়।'

একথার কোনো উত্তর এলো না। চারিপার্শ্বের নিস্তব্ধতায় তার এই মৌনরূপ মিশে গেলো সহজেই।

* * *

এইবার সে উপরের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। উপরে বিস্তীর্ণ নীলাকাশ আর মেঘাশ্রিত সূর্যালোক। সম্মুখে একপ্রান্তে বিশাল হরিৎক্ষেত্র। অন্যপাশে নিবিড় অরণ্য।

সে দক্ষিণপার্শ্বের বিজন বনপথেই প্রবেশ করলো।

সেখানে অসংখ্য পত্রপুষ্পের বিপুল সম্ভার, অজস্র পশুপক্ষীর বিচিত্র সমারোহ, তাকে মোহিত করে বনের দূরতম নিভৃতে নিয়ে গেলো। স্বগতভাষণে সে বলে উঠলো — 'এ কোন্ পথে এলাম?'

— 'যাত্রাপথ। আমি জীবনের যাত্রাপথ।' — যেন পরিপার্শ্বের অজস্র পত্রমোচনের নিস্বনে উত্তর এলো তার কাছে। সে বললো — 'এতো মনোরম তুমি কিন্তু এতো সংগোপনে কথা বলো কেন? সরবে বলো তোমার এই বিপুল ভাণ্ডারের কথা।'

তার কথার উত্তরে এলো এক দীর্ঘায়িত মর্মর শব্দ — যেন কতকিছুই না বলা হলো এক ধূসর সাংকেতিক ভাষায়।

* * *

এইভাবে শতসহস্র শুষ্কপত্র নিঃশব্দে ঝরে পড়তে লাগলো তার সামনে। সে তন্ময় হয়ে দেখছিলো সেই নির্ভার পতনের অসংখ্যরূপ। হঠাৎই তার সমস্ত দেহ কম্পিত হয়ে উঠলো এক তীব্র বৃংহণে।

স্তম্ভিত হয়ে সে দেখলো তার অনতিদূরে একটি কৃষ্ণবর্ণের হস্তী প্রস্তরের স্তূপের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ছায়াচ্ছন্ন বৃক্ষের নীচে যা এতক্ষণ তার গোচরেই আসেনি। প্রবল উৎকন্ঠায় সে নিজের মনেই বলে উঠলো — 'এ কখন কীভাবে এলো?'

— 'আমি আতঙ্ক। অতর্কিত আতঙ্ক।' — অত্যন্ত গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলো ওই বিপুল হস্তীটি।

প্রবল শঙ্কায় আক্রান্ত হয়েও সে কোনো ক্রমে বলতে পারলে — 'সেকি? কেন? কেন তুমি এই ভয়ানক নিমিত্ত হয়ে আছো?'

তার এই ভয়ার্ত কন্ঠস্বর যেন নিমেষেই লুপ্ত হলো অরণ্যের প্রগাঢ় নিস্তব্ধতায়।

* * *

এইভাবে একাদিক্রমে ঘটে যাওয়া ইত্যাকার ঘটনায় সে একেবারেই হতবুদ্ধি হয়ে বসে পড়লো সম্মুখের বিস্তীর্ণ তৃণভূমির উপরে। দূরান্তের দিকে দৃষ্টি দিয়ে সে ভাবতে লাগলো এইসব ঘটনাবলী সত্য না বিভ্রম!

এই কথা ভাবার সাথেসাথেই সে দেখতে পেলো কোথা থেকে একজন যেন মহানন্দে আপনমনে গীত গাইতে গাইতে চলছে সম্মুখ দিয়ে। তার পরিধান অত্যুজ্জ্বল বর্ণময়। একটি সুদৃশ্য পেটিকা স্কন্ধে নিয়ে চলেছে সে দারুণ স্ফূর্তিতে।

'কোথায় চলেছো বন্ধু?' — হয়তো কিছুটা আবেগের আতিশয্যেই কথাটা বলে ফেললো সে। লোকটি যেন শুনতেই পেলো না এই কথাগুলি। এবং পূর্বের মতোই চলতে লাগলো বিপুল উৎসাহে।

এইবার সে তার কন্ঠস্বর উচ্চকিত করে বলে উঠলো — 'ও বন্ধু! তোমার পরিচয়টা দিলে না যে?' এইবারেও লোকটি তার দিকে দৃকপাত করলো না। বরং তার ওই আপনমনের গীতের সুর মুখর হলো অতি স্ফূর্তিতে।

আর তারপরেই ঘটলো সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি।

চারিদিকের বনাঞ্চলকে বিধ্বস্ত করে প্রবল ঝঞ্ঝার মতো লোকটির সামনে এসে উপস্থিত হলো সেই বিশালাকৃতি হস্তীটি। পলকের মধ্যেই লোকটি যেন দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রাণপণে দৌড়তে লাগলো সেই নির্জন প্রান্তরে। হস্তীটিও তার শুঁড় উত্তোলিত করে ধাবমান হলো লোকটির পিছুপিছু।

* * *

তখন সে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেই তৃণক্ষেত্রের উপর। সামনে বিধ্বস্ত বনভূমি। সেই ভীমগতি জীবটির নিষ্ক্রমণের ভয়াল চিহ্নগুলি যেন আতঙ্কের মুদ্রার মতো স্থির হয়ে রইলো তার সামনে।

এইবার সে ওই হস্তীটির পরিচয়ের মর্ম উপলব্ধি করতে পারলো যথাযথভাবে ।

কিছুটা সন্ত্রস্ত কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে সে হাঁটতে শুরু করলো সেই বিনষ্টের চিহ্ন অনুসরণ করে। যেতে যেতে তার মনে হলো এই তো সেই পথ যা কিছুক্ষণ আগেই সে অতিক্রম করে এসেছে।

কিন্তু এ পথের সেই মোহনরূপ এখন সম্পূর্ণ ভাবেই বিলুপ্ত। বরং এক ছায়াময় বিপন্নতা যেন স্থির হয়ে রয়েছে সর্বত্র।

এইবার তার কাছে এই পথের নামটির গূঢ়ার্থ স্পষ্ট হলো।

কিছুটা অন্যমনস্ক ভাবে চলতে চলতে সে কিছুক্ষণ বাদে থমকে এসে দাঁড়ালো একটি জায়গায় — 'এই তো সেই কূপ যেখানে আমি প্রবেশ করেছিলাম কিছুক্ষণ আগেই।' — সেই স্থানটিকে দেখে অতি বিস্মিত হয়ে বললো সে। কিন্তু তার বিস্ময়ের মাত্রা চূড়ান্তে পৌঁছোলো যখন সে ওই কূপটির অভ্যন্তরে দৃষ্টিপাত করলো। সে দেখতে পেল ওই লোকটিকেই — ওই কূপের গহ্বরে — একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষের শাখা ধরে কোনোক্রমে ঝুলছে।

সে ওই কূপটির প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারলো তখনই।

এরপর আরো গভীর ভাবে ওই কূপের অভ্যন্তরটি লক্ষ্য করতে গিয়ে শিহরিত হলো সে। কারণ এইবার সে দেখতে পেলো সেই প্রকাণ্ড বিষধর সর্পটিকে। ওই কূপের গহ্বরে সর্পটি তার হিংস্র উদ্যত ফণা নিয়ে অপেক্ষা করছে সেই পতিত বিপন্ন মানুষটিকে লক্ষ্য করে।

সেই মুহূর্তেই সে ওই মহাসর্পটির প্রকৃত পরিচয় স্পষ্ট বুঝতে পারলো।

এমনকি সে দেখতে পেলো সেই শ্বেত ও কৃষ্ণবর্ণের মূষিক দুটিকেও। পূর্বের মতোই নিবিষ্ট ভাবে বৃক্ষের কাণ্ডটিকে দংশন করে চলেছে ওরা। তৎক্ষণাৎ তাদের সম্যক রূপ প্রতিভাত হলো তার কাছে।

এরপর সে দেখতে পেলো ওই বৃক্ষসংলগ্ন স্তূপটিকে। যার একটি প্রান্ত থেকে যথাপূর্ব ক্ষরিত হচ্ছে বিন্দু বিন্দু তরলরস। আর এই ভয়ঙ্কর আবহে ওই বৃক্ষের শাখাটিকে আশ্রয়ের শেষ প্রান্ত মনে করে লোকটি সেই শাখাটির সঙ্গে কি আশ্চর্য ভাবে দোলায়মান — এই বুঝি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যায় অতল সর্বনাশে! কিন্তু কি বিচিত্র — এই অন্তিম দশাতেও — ওই ঝুলন্ত অবস্থায় থেকেও লোকটি যখনই স্তূপটির নিকটবর্তী হচ্ছে তখনই লেহন করছে সেই আশ্চর্য রস।

এইবার রসটির পরমার্থ উপলব্ধ হলো তার কাছে।

এবং সেই একই মুহূর্তে সে চিনতে পারলো এই লোকটিকে — এই তো সেই মানুষটি যে মহাস্ফূর্তিতে অতিক্রম করেছে জীবনের যাত্রাপথ — তারপর অতর্কিত বিপদের তাড়নায় এই গোপনপথের গহ্বরে নিয়েছে তার শেষ আশ্রয় — আর আশ্রিত হয়েই দেখতে পেয়েছে তার জন্যে সেখানেই অপেক্ষা করে আছে তার অন্তিম সর্বনাশ। সর্বোপরি সে জানেই না যে এইসব বিপদের খড়্গাঘাতে সে ধ্বংস না হলেও যে স্থান-কাল-পাত্রের আধারে সে অবস্থান করছে সেখানে তার বিনাশ শুধু সামান্য কালক্ষয়ের অপেক্ষামাত্র। আর এই বিপন্নতার চূড়ায় এসেও সেই লোকটির কি অসীম রসস্পৃহা। যখনই সুযোগ পাচ্ছে, তখনই আপ্রাণ চেষ্টায় লেহন করছে সেই রসধারা।

অতএব এই মূঢ় মানুষটির পরিচয় এখন তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেলো।

* * *

কিন্তু কি মর্মান্তিক এই অস্তিত্ব! এই বীভৎস দৃশ্য সে আর সহ্য করতে পারলো না। তাই ওই কূপের অভ্যন্তর থেকে সে তার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বাইরের দিকে তাকালো।

আর সেই মুহূর্তেই সে দেখতে পেলো তার অতি পরিচিত প্রাচীন মানুষটিকে। বিশালদেহী বিরাট জটাজুটধারী অবিন্যস্ত বেশভূষা — এবং সেই আশ্চর্য সুগভীর দৃষ্টি — যার সঙ্গে সে দীর্ঘকাল ধরে পরিচিত।

তখনই সে সকাতরে বলে উঠলো — 'আপনি? আপনি এসেছেন এখানে? এই মহাসঙ্কটে আপনিই তো একমাত্র ত্রাতা।' বৃদ্ধটি কোনো উত্তর দিলেন না। বরং স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।

তাকে ওইভাবে নিরুত্তর থাকতে দেখে সে অনুনয় করে বললো — 'হ্যাঁ আপনি — আপনিই পারবেন — কারণ আপনিই তো এই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন — আপনিই তো যাবতীয় ঘটনার রচয়িতা —'

প্রাচীন ব্যক্তিটি পূর্বের মতো নির্বাক হয়েই দাঁড়িয়ে রইলেন। এইবার সে আর্তকন্ঠে বলে উঠলো — 'একটি মৃত্যুমুখীন মানুষের সামনে আপনি এইভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন — যেখানে আপনি সবকিছুর স্রষ্টা। এই আপনার ধর্মপথ?'

বৃদ্ধ মানুষটি চক্ষুদুটি মুদ্রিত করলেন — তাঁর মুখের সুপ্রাচীন বলিরেখাগুলি বারংবার কম্পিত হতে থাকলো — তাঁর মুদ্রিত নয়ন থেকে ঝরে পড়লো একটি অশ্রু বিন্দু।

সেও নিরুপায় হয়ে তার চক্ষু দুটি বুজিয়ে শুধু একমনে প্রার্থনা করতে লাগলো — 'উদ্ধার করো — উদ্ধার করো — এই অজ্ঞ পতিত বিনাশমুখী মানুষটিকে।'

* * *

এর কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ চোখ খুলে সামনের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেলো এক আশ্চর্য দৃশ্য — শ্বেত মূষিকটি হঠাৎ দংশন বন্ধ করলো। এর পরক্ষণেই কৃষ্ণ মূষিকটিও তার দংশন বন্ধ করলো। এরপর শ্বেত মূষিকটি কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। তাকে অনুসরণ করে কৃষ্ণ মূষিকটিও অন্তর্হিত হলো।

এরপরই দেখা গেলো সেই ভয়ঙ্কর ফণিধর সর্পটিও হঠাৎ তার উদ্যত শিরটি নত করে নিলো। তারপর শিথিল গতিতে চলে গেলো অন্যত্র। সবশেষে দেখা গেলো সেই ঝুলন্ত মানুষটিও ধীরে ধীরে নেমে এলো সেই বৃক্ষের শাখাটিকে ধরে — ওই কূপটির তলদেশে — যেখানে তার জন্য আর কোনো বিপদ অপেক্ষা করে নেই।

তখন তার মনে হলো — 'এগুলি কি সত্য না মায়া?' সে আবার তাকালো সামনের দিকে। যেখানে শান্ত সমাহিত মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেই বৃদ্ধটি। তার চক্ষু দুটি মুদ্রিত করে। এবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সে বলে উঠলো — 'জানতাম — আমি জানতাম — সবই আপনার ইচ্ছার অধীন — আপনি অনায়াসেই পারবেন এই অসহায় মূঢ় মানুষটিকে উদ্ধার করতে — তার এই সমূহ সংকট থেকে।'

বৃদ্ধটি এইবার তার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। তার চোখে যেন দূরাগত কালের ছায়া।

সে আবার বলে উঠলো — 'আপনাকে শতকোটি প্রণাম। আপনার দয়ায় লোকটি অকল্পনীয় ভাবে মুক্তি পেলো।'

বৃদ্ধটি কোনো উত্তর করলেন না। যেন ম্লান হাসির রেখা ফুটে উঠলো তার বহুযুগক্রান্ত মুখটিতে।

* * *

ইতিমধ্যে সেই কূপস্থ লোকটি উঠে এসেছে বাইরের বনভূমিতে। তাকে এইভাবে উঠে আসতে দেখে সে উল্লসিত হয়ে বলে উঠলো — 'এসো! এসো বন্ধু! তোমার এই উদ্ধার আমার কাছে পরমপ্রাপ্তি।' লোকটি যেন তার কোনো কথাই শুনতে পেলো না। এমনকি তার অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ওই তৃণভূমির উপর দিয়ে চলতে লাগলো আপনমনে।

সে চীৎকার করে বলে উঠলো — 'কোথায় চলেছো? কোথায় চলেছো বন্ধু আমার? আবার সেই ভ্রান্তপথে? না না! ওদিকে আর নয়। এবার চলো ওর বিপরীত দিক দিয়ে যাই।'

লোকটি অতি নিস্পৃহভাবে তার গতিপথের পরিবর্তন করে বিপরীত দিক দিয়ে চলতে শুরু করলো। এই দেখে সে দৌড়ে গিয়ে তার পার্শ্ববর্তী হলো। এবং তার সাথেই হাঁটতে হাঁটতে বলতে লাগলো — 'এই তো — এই ভিন্নপথেই চলো।' লোকটি এবারও তার কথার কোনো উত্তর করলো না। যেন সে এক অবয়বহীন অলীক অস্তিত্ব।

সে কিন্তু সোৎসাহে বলেই যেতে লাগলো — 'দ্যাখো বন্ধু — দ্যাখো — আকাশের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো! তোমার মুক্তির আনন্দে মেঘেরা কী বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে স্থির হয়ে রয়েছে — সুউচ্চ বৃক্ষের শীর্ষগুলি কী প্রবল উচ্ছ্বাসে হিল্লোলিত হচ্ছে — কী আনন্দে আহ্লাদে —'

এই পর্যন্ত বলেই অকস্মাৎ থেমে যেতে হলো তাকে — সভয়ে ও সবিস্ময়ে।

— 'স্তব্ধ হও নির্বোধ! ওই দিকে তাকিয়ে দ্যাখো — কীভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার মুক্তি!' এতক্ষণ এক নির্বাক নির্বিকার অবয়বমাত্র হয়ে যে লোকটি তার সামনে বিচরণ করছিলো — সেই লোকটিই হঠাৎ এমন প্রবলভাবে মুখর ও সক্রিয় হয়ে উঠলো দেখে সে হতচকিত হয়ে গেলো। মুহূর্তকাল পরেই যেন সে সম্বিৎ ফিরে তার দক্ষিণ দিকে তাকালো। আর তখনই দেখতে পেলো সেই মহাকায় হস্তীটিকে — যে তখন তার বিশাল শুণ্ডটি উদ্যত করে মূর্তিমান সংহাররূপে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের পিছনে।

তীব্র আতঙ্কে হিম হয়ে গেলো সে। লোকটি কিন্তু সেই ভয়ানক হস্তীটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে অট্টহাস্য করে বলে উঠলো — 'না না — তুমি আতঙ্কিত হয়ো না — ওরা আমার জন্যই অপেক্ষা করে আছে — কী চমৎকার ভাবে — আমার মুক্তির নির্ধারিত দূত!' এরপর কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে সে আবার উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলো —' দেখে নাও — চারিপাশে ভালো ভাবে দেখে নাও — এই মুহূর্তে পৃথিবী কতো রমণীয় — কতো রসিকভোগ্যা —'

সে স্তম্ভিত হয়ে গেলো ঘটনার আকস্মিকতায়। লোকটি আবার বলে উঠলো — 'এবার বলো — কোন্ পথে — কোন্ প্রান্তরের দিকে আমায় যেতে হবে? — আমার মুক্তির জন্য — ওই বামদিকের বিস্তৃত বনাঞ্চলের ভিতর দিয়ে — নাকি দক্ষিণ দিকের বিশাল তৃণভূমি অতিক্রম করে — যা তোমার অভিপ্রায় — দ্রুত বলো — কারণ সময় অতি অল্প — আমার মুক্তির জন্য' — বলেই আবার হো হো করে হেসে উঠলো লোকটি।

সে ব্যাপারটি সত্য না দৃষ্টিবিভ্রম দেখার জন্য আরেকবার তার দক্ষিণ দিকে তাকালো — আবার দেখতে পেলো সেই অতিকায় হস্তীটিকে -- এবার ধীর গতিতে কিন্তু নির্দিষ্ট ভাবে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।

তখনই সে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে শুরু করলো ওই তৃণভূমির উপর দিয়ে — লোকটিও দৌড়তে লাগলো তার সাথেই। এইভাবে দৌড়তে দৌড়তে একসময় চরম পরিশ্রান্ত হয়ে সে বসে পড়লো সেই তৃণভূমিতেই — যেন তার হৃৎপিণ্ড বিস্ফোরিত হয়ে যাবে এবার—

লোকটিও তার সাথেই দৌড়তে দৌড়তে এসে বসে পড়লো তার পাশটিতে। তারপর উপরের বিস্তীর্ণ নীলনিশ্চল আকাশের দিকে তাকিয়ে লোকটি বললো — 'এইবার মুক্তি! তাই না?'

সেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো — 'তাই তো মনে হয়।'

লোকটি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো — 'তাহলে দ্যাখো — পিছনে তাকিয়ে দ্যাখো —'

সঙ্গে সঙ্গে পিছনে তাকিয়ে সে যা দেখলো তাতে সে শিহরিত হয়ে উঠলো। সেই ভয়ঙ্কর অতিকায় হস্তীটি তাদের পশ্চাদ্‌ধাবন করে এখানে উপস্থিত হয়েছে — তার সেই উদ্যত শুণ্ডটি নিয়ে — অতি ভয়ানক রূপে!

— 'তাহলে? তাহলে কোথায় গেলে আমি পরিত্রাণ পাবো বলো তো?'— লোকটির এই প্রশ্নে সে হতবুদ্ধি হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো।

মৃদু হেসে অতি শান্তস্বরে বললো লোকটি — 'সামনের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো — আমার পরিত্রাণের স্থান — আমার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে — যথাযথ ভাবে — যথাসময়ে।'

সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলো — সামনে একটি বিশাল কূপ! 'এসো — আমার সঙ্গে এসো — দ্যাখো — ভালো করে দ্যাখো — কারা অপেক্ষা করে রয়েছে ওই স্তূপের ভিতরে — আমার মুক্তির জন্য —'

সে বিহ্বল হয়ে লোকটির পিছু পিছু ওই কূপটির অগ্রবর্তী হলো এবং স্তম্ভিত হয়ে দেখতে পেলো ওই কূপের গভীরে রয়েছে একটি বিশাল সর্প — তার উত্তোলিত ফণা সহ।

লোকটি আবার সহাস্যে বলে উঠলো — 'আতঙ্কিত হয়ো না — দ্যাখো ওই কূপটির মধ্যস্থ বৃক্ষের প্রান্তটিকে।'

সে স্তম্ভিত হয়ে দেখলো সেই শ্বেত ও কৃষ্ণ বর্ণের মূষিক দুটিকে — নিবিষ্ট মনে বৃক্ষের প্রান্তটিকে দংশন করে চলেছে।

— 'দ্যাখো দ্যাখো কী নিষ্ঠার সঙ্গে আমার মুক্তির জন্য কাজ করে চলেছে এরা —' সামান্য নীরবতার পর অতি নম্রভাষে বললো লোকটি। তারপর আরো শীতল কন্ঠে বললো — তাহলে তো বিধাতা পুরুষের সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ — এবার শুধু আমায় উপস্থিত হতে হবে — যথাস্থানে আর যথাসময়ে — অতএব আর বিলম্বের প্রয়োজন কী?'

এই বলে স্মিত হাস্যে লোকটি তাকালো তার মুখের দিকে। আর তার পরমুহূর্তেই তাকে সম্পূর্ণ হতবাক করে দিয়ে লাফ দিলো ওই কূপের গভীরে। লতাগুল্মপত্রের খসে পড়ার কর্কশ শব্দ এলো কূপের অভ্যন্তর থেকে। আর তারপরেই যেন এক আশ্চর্য কঠিন নীরবতায় ঢেকে গেলো চারিদিক।

সমস্ত ঘটনার অভিঘাতে সে যেন জড়বৎ স্থির হয়ে রইলো বহুক্ষণ।

এইসময় একটি প্রশ্ন তার মনে ক্রমশ বৃহত্তর হতে থাকলো —

'নিয়তির লীলাই জীবনের শেষ কথা' — এই শিক্ষা দিতেই কি এমন আশ্চর্য আবির্ভাব আর বিনাশ হলো লোকটির?

* * *

ঠিক তখনই শোনা গেলো সেই লোকটির কন্ঠস্বর — ওই অতল অন্ধকার কূপটির ভিতর থেকে —

— 'আমি আছি।'

— 'এখানেই।'

— 'এইভাবে।'

— 'দেখতে পাচ্ছো আমায়?'

লোকটির কথায় সে চেষ্টা করলো ওই কূপের অভ্যন্তরে নিরীক্ষণ করতে। কিন্তু এক ভয়াবহ খনিজ অন্ধকার ব্যতীত আর কিছুই তার দৃষ্টিগোচর হলো না।

এইবার সে শুনতে পেলো আরো স্পষ্টভাবে —

— 'দেখতে পাচ্ছো আমায়? দেখতে পাচ্ছো বৃক্ষসংলগ্ন সেই বিশাল স্তূপটিকে? আর সেই মধুচক্রটিকে? চিনতে পারছো তো?'

লোকটির কথায় বাকরহিত হয়ে সে আবার চেষ্টা করলো আরো গভীর দৃষ্টিপাতে — কিন্তু সেই নিশ্চল দুর্ভেদ্য অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই তার দৃষ্টিগোচর হলো না।

— ‘দ্যাখো — ভালো করে দ্যাখো — আমার মুখের কাছে — কীভাবে ঝরে পড়ছে তার নির্যাস।'

লোকটির কথাগুলিতে তার আরেকবারের ব্যর্থ চেষ্টা নিক্ষিপ্ত হলো ওই অন্ধকারে।

আবার শোনা গেলো লোকটির কন্ঠস্বর — যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে —

— 'যেমন ওই অতিকায় হস্তী — বিশাল কূপ — বিষধর সর্প আর নির্বিকার মূষিক দুটি — অপেক্ষা করে থাকে আমায় সংহার করার জন্য — তেমন এই মধুচক্রটিও প্রতীক্ষা করে থাকে আমার জন্য — এই অন্ধকারে — কিছু কিছু রস ক্ষরণ করে এই নির্জনে — শুধু আমাকে তৃপ্তি দেওয়ার জন্য — আমার এতো বড়ো দুর্দৈবেও —'

ক্রমশ প্রগাঢ় হয়ে ওঠা সেই দূরাগত কন্ঠস্বর —

— ‘বড়ো মধুময় ....মধুময় ....এই রস...ঝরা পড়েছে অবিরত.... অঘোরে ...এরই নাম আনন্দধারা.... নিখিলের —'

* * *

যেমন অতর্কিতে কথাগুলি শুরু হয়েছিলো তেমন সহসাই স্তব্ধ হয়ে গেলো সেই কন্ঠস্বর। কারণ ঠিক সেই মুহূর্তেই সে শুনতে পেলো হঠাৎ কিছুর ভূতলে পতিত হওয়ার বিকট শব্দ। অর্থাৎ —

— অমোঘপতন?

— সেই লোকটির?

মুহূর্তের মধ্যে সেই শব্দটিও লুপ্ত হয়ে গেলো চারিদিকের স্থির অন্ধকারে।

* * *

এরপর এক অখণ্ড নীরবতায় মগ্ন হয়ে গেলো চারিদিক।

এই শব্দহীন অন্ধকারে যেন পার হলো তার এক অমেয় সময়।

আর ওই সময় মন্থন করে তখন একটি কথাই তার সামনে স্থির হয়ে দাঁড়ালো —

— 'নিবিড় অন্ধকার আর নিখিলের আনন্দধারা কত সহজেই একাকার হয়ে গেলো এই রহস্যময় স্থানটিতে।'

এই ভাবতে ভাবতে সে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো ওই কূপের গভীরে — সেই রহস্যের আধারে।

সময় বাহিত হলো যেন নিষ্পলকে।

আরেক অরুণোদয়ের সূচনা হলো যথাসময়ে।

আর তখনই সে শুনতে পেলো — 'চলো পুণ্যবান — চলো।'

অর্থাৎ সেই অতিপরিচিত প্রাচীনপুরুষের কন্ঠস্বর।

সে তার সামনের দিকে তাকালো। ঊষার আলোকাভাসে দেখতে পেলো ধর্ম-অর্থ-কাম-মোহের সেই জীর্ণ রচয়িতাকে।

সে অস্ফুটে সেই বৃদ্ধের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো — 'আপনি? এখনো এখানে আছেন?'

তারপর একটু থেমে যেন অতি কষ্টে ওই বৃদ্ধকে বলতে পারলো সে — 'যে কঠোর সত্যকে আপনি আমার চোখের সামনে উপস্থিত করলেন, তাকে আমি ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমার অলীক কল্পনায় —'

তারপর যেন নিজেই নিজেকে বলতে লাগলো —

— 'ওই মোহাচ্ছন্ন মানুষটি নিশ্চয়ই সত্য — ওই মধুর বিন্দুগুলিও সত্য — আর এতো বড়ো সত্য যে এর সামনে সবকিছুই যেন অতিতুচ্ছ হয়ে গেলো — এরপর জীবনের আর কোন্ কাহিনী শোনার ইচ্ছা হবে?'

আর তখনই যেন বহুকালের ওপার থেকে সেই বৃদ্ধটি বলে উঠলেন —

'আমায় অনুসরণ করবে না?'

সে বলতে যাচ্ছিলো — 'আমি তো সামান্য শ্রোতামাত্র — অতি নগণ্য দর্শক — তাই এই বৃত্তান্তের পর স্থির থাকাই শ্রেয়।'

কিন্তু সেই সময়েই স্পষ্ট দেখা গেলো — সেই বৃদ্ধের ক্লিন্ন চক্ষু দুটি থেকে নেমে আসছে দুটি শুভ্র অশ্রু কণা — তার যাবতীয় কাহিনীর দ্যুতি নিয়ে —

এই দৃশ্যে সে যেন সম্বিৎ ফিরে পেলো। তার মনে হলো —

— 'এই কথকঠাকুরের বেদনার মনিকণাগুলিকে তো আমাকেই তুলে নিতে হবে —'

তাই সে আবার প্রস্তুত হয় ..... যাত্রার জন্য ....মহাভারতের পথে....

কারণ —

— সে যে পুণ্যবান —

....একমাত্র সেই পারবে এই পথে যেতে যেতে ....

.....ব্যাসের অশ্রুমানিক্যগুলির ভার গ্রহণ করতে।



(পরবাস-৭২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)