Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines




পরবাসে
সৌমেন ভট্টাচার্য-র

আরো লেখা


ISSN 1563-8685




অভ্যাস

মার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সম্প্রতি বাবা হয়েছে। বেশ নামডাকওয়ালা এক নার্সিংহোমে দিন-কয়েক আগে বাচ্চা হয়েছে তার। যে মহিলা দেখভাল করেছিলেন বন্ধুর বাচ্চাকে সেই নার্সিংহোমে, তাঁর নাম আরতি। আরতি কী যেন — পদবিটা মনে পড়ছে না। ছোট, বড় সবাই আরতিমাসি বলেই ডাকে।

আরতিমাসির বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। এটা অন্যের থেকে শুনে আর চোখের আন্দাজে বলা। বোঝাই যাচ্ছে আয়ার কাজ করেন তিনি। মিশুকে আর হাসিখুশি। গল্প করতে ভালোবাসেন। কথা বলার ধরন দেখে তো সেরকমই মনে হয়। নার্সিং হোমের অনেকের ভালোমন্দের খবর তাঁর কাছে থাকে। অনেকের অনেক খবর তাঁর কাছে থাকলেও তাঁর খবর খুব বেশি কিছু নাকি জানে না কেউ। এটা সবাই জানে — অনেক দূর থেকে তিনি আসেন রোজ, ট্রেনে প্রায় দেড় ঘন্টা। নিজের খবর আড়াল করে কীভাবে তিনি মেলামেশা করেন সবার সঙ্গে, জানিনা। কেউ তাঁর ব্যাপারে বেশি কিছু জানতে চেয়েছিল কি না তাঁর কাছে, চাইলে তিনি কী বলেছিলেন, কিংবা যদি কিছু না বলে থাকেন তাহলে যে জানতে চেয়েছিল তার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল — এসব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই আমার। স্বাভাবিক কারণেই আমারও কোনও দরকার ছিলনা বেশি কিছু জানার। আমি মোটে দু’বার দেখেছিলাম তাঁকে ওই নার্সিংহোমে বন্ধুর বাচ্চা হওয়ার সময়, আর তাও অল্প কিছু সময়। তখনই বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম তাঁর বাড়ি কতদূর সেটা ছাড়া খুব বেশি কিছু নাকি জানেনা কেউ তাঁর ব্যাপারে আর দেখেছিলাম তিনি হেসে হেসে কথা কথা বলছেন ওয়ার্ডের সবার সঙ্গে, যা দেখে আমি ধরে নিয়েছিলাম তিনি মিশুকে আর গল্প করতে ভালোবাসেন।

আরতিমাসির চেহারা একটু মোটার দিকে। গোল গোল দু’হাতে বাচ্চাদের বুকে জড়িয়ে যখন আদর করেন, মনে হয় বাচ্চাগুলোকে বালিশ দিয়ে ঘিরে রেখেছেন। গোলগাল মুখটা ভরে থাকে হাসিতে। বাচ্চাগুলোও বেশ থাকে তাঁর কাছে! কী ম্যাজিক হয় কে জানে, তাঁর কোলে গেলেই কান্না থেমে যায় তাদের আর তারা ওঁ, আঁ আওয়াজ করে। যেন একটা দাবি নিয়েই কাঁদছিল তারা — কখন আরতিমাসির কোলে চড়ে আদর খাবে। এটা আমি দেখেছি নিজের চোখে। অন্যেরাও সেটা বলেছে।

অনেকবছর এই নার্সিংহোমে আছেন আরতিমাসি। অন্য দু-তিন জায়গায় নাকি কাজ পেয়েছিলেন। টাকার অঙ্কটাও বেশি ছিল সেসব জায়গায়। কিন্তু তিনি যাননি কারণ সেই কাজগুলো নাকি পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডে ছিল না। পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ড ছেড়ে কিছুতেই যাবেন না তিনি অন্য কোথাও। এসব কথা তাঁর থেকে শোনা নয়। অন্য এক আয়া বলেছিল বন্ধুর বউকে, আমি জেনেছিলাম সেখান থেকে।

আরতিমাসি যে বাচ্চাদের অসম্ভব রকমের যত্ন করেন, বাচ্চার বাড়ির লোক থেকে শুরু করে নার্সিংহোমের স্টাফ — সবাই সেটা বলে। বন্ধুর বউও সেরকমই বলেছিল। যেভাবে দুহাতে বাচ্চাগুলোর পটি আর হিসু পরিস্কার করেন, দেখে মনে হয় ঘেন্নাপিত্তি ব্যাপারটার সঙ্গে পরিচয় নেই তাঁর। আমার বন্ধুর বউ তো বলেই ফেলল, নিজের বাচ্চার ওসবের ব্যাপারে প্রথমবার একেবারে সামান্য হলেও একটু ঘেন্না করেছিল তার। কিন্তু বাচ্চাদের পটি ঘাঁটার সময় আরতিমাসিকে দেখলে মনে হবে যেন তিনি মুখিয়ে বসেছিলেন কতক্ষণে ওরা ওসব করবে আর তিনি দুহাতে সেগুলো পরিষ্কার করবেন। যাকে দেখভাল করছেন শুধু তার নয়, ওয়ার্ডে অন্য বাচ্চাদের ভালোমন্দের দিকেও নজর থাকে তাঁর — এমনটা আমার মনে হয়েছিল দেখে।

এটা তো প্রায় সকলেই জানে যে বাচ্চার আয়াদের খুশি হয়ে কিছু না কিছু বখশিশ্‌ দিয়েই থাকে বাচ্চার বাড়ির লোকজন। এটা বাধ্যতামূলক — এমনটা মনে হয়না, আনন্দ থেকেই সবাই দেয়। আরতিমাসি সে রাস্তায় নেই। কক্ষনো বখশিশ্‌ নেন না তিনি। জোরাজুরি করলে মুখ করে ওঠেন। তখন তাঁর এক্কেবারে আলাদা চেহারা। সেই চেহারার সঙ্গে গোলগাল, হাসিখুশি আর বাচ্চাদের বুকে জড়িয়ে আদর করা চেহারাটার মিলই নেই কোনও। বাচ্চা হওয়ার দু’দিন বাদে আমার বন্ধু মিষ্টি খাইয়েছিল পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডে। অনেক বলা সত্ত্বেও সেই মিষ্টি মুখে তোলেন নি আরতিমাসি।

আরতিমাসির ব্যাপারে এরকম নানা খবর আমার কানে এসেছিল ওই দু’দিনে। আরও একটা কথা শুনেছিলাম তাঁর ব্যাপারে, যেটা অদ্ভুত লেগেছিল। তিনি নাকি নিয়ম করে একটা কাজ করে চলেছেন বছরের পর বছর। যেসব বাচ্চার দেখাশুনা করেছেন তাদের যখন ছুটি হয় নার্সিংহোম থেকে, বাচ্চাগুলোকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে খুব আদর করেন তিনি। তাঁর চোখ জলে ভরে যায়, গলা ধরে আসে। আমি নিজেও দেখেছি একবার আর শুনেওছি অন্যদের কাছে। এটা নিয়ে তাঁর পেছনে লাগে সবাই, হাসাহাসিও কম হয়না; কিন্তু তিনি এমনটা করবেনই। ছলছলে চোখে তিনি আদর করবেন বাচ্চাগুলোকে আর বলবেন, ‘ভালো থাকিস বাবু, যেখানেই থাকিস খুব ভালো থাকিস বাবা।’ কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসবে তাঁর আর বাড়ির লোকের হাতে বাচ্চাকে তুলে দিয়ে তিনি সরে যাবেন সেখান থেকে। পরদিন থেকেই আবার লেগে যাবেন অন্য কোনও বাচ্চার হিসু, পটি নিয়ে। এমনটাই হয়ে চলেছে বছরের পর বছর। স্বাভাবিক কারনেই আমার জানা নেই তিনি কেন এমনটা করে চলেছেন এতদিন ধরে।

ছেলে বাচ্চা হোক বা মেয়ে, সবাইকেই ‘বাবু’ আর ‘বাবা’ বলেই ডাকেন আরতিমাসি।



(পরবাস-৭২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)