Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines



পরবাসে
ভাস্কর বসুর

লেখা


ISSN 1563-8685




সত্যজিতের ‘ফেলু’চিত্র

যখন কোন জনপ্রিয় সাহিত্য অবলম্বনে কোন চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, তার প্রতি দর্শকদের অসীম আগ্রহ থাকে। আবার আশঙ্কাও থাকে – পাঠকালীন যে অনুভূতি, যে ভালোলাগা ছিল, তা কি আরো বেড়ে যাবে, না একেবারে ধূলিসাৎ হবে? এই নিয়ে বাংলা সিনেমাতে বহু বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আসলে দুটি মাধ্যম, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র, একেবারেই আলাদা। সুতরাং একটি ‘রূপান্তর’ প্রয়োজন। কিন্তু সেই রূপান্তর কতখানি শিল্পোত্তীর্ণ হল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত।

কোন বিখ্যাত পরিচালক তাঁর নিজের রচিত কাহিনীকে যখন চলচ্চিত্রে রূপ দেন, তখন ব্যাপারটি বেশ চিত্তাকর্ষক। স্বাভাবিকভাবেই তিনি অনেক স্বাধীনতা নিতে পারেন। আর চরিত্রটি যদি ‘ফেলুদা’ হয় আর পরিচালক বিশ্ববরেণ্য সত্যজিৎ রায়, প্রত্যাশার পারদ থাকে তুঙ্গে।

তাঁর কৃত দুটি চলচ্চিত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা – সোনার কেল্লা আর ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’। কী কী পরিবর্তন এবং তার প্রভাব কীভাবে দর্শকদের মনোহরণ করেছে তা নিয়ে এই অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা এই প্রবন্ধে। এই প্রসঙ্গে, বিষয়টিকে পরিস্ফুট করার তাগিদে, সত্যজিতের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়েও প্রাসঙ্গিক কিছু আলোচনা রাখা হয়েছে।

|| ১ ||
গোড়ার কথা

বীন্দ্রনাথের মত সত্যজিৎ রায়ও জন্মগ্রহণ করেছিলেন এমন এক বাড়িতে যেখানে নিয়মিত শিল্প সাহিত্যের চর্চা ছিল। উপরন্তু ছিল বিজ্ঞানের চর্চাও। উপেন্দ্রকিশোর বাড়িতে ছাপাখানা বসিয়ে ‘সন্দেশ’-এর মত একটি উঁচুমানের কিশোর পত্রিকার সূচনা করেন। পরবর্তী কালে তাঁর ভাই সুবিনয় ও কুলদা এবং পুত্র সুকুমার, কন্যা লীলা প্রভৃতির হাত ধরে সেই পত্রিকা আরো উন্নতি করে। উপেন্দ্রকিশোরকে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের অন্যতম অগ্রপথিক বলা চলে। একেবারে বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে এক পরাধীন দেশে, একটি আঞ্চলিক ভাষাতে উঁচু মানের সাহিত্য রচনা করে তিনি এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটালেন।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে ত্রিশের দশকে সুকুমারের অকাল মৃত্যুর ধাক্কা সামলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে যায় সন্দেশ। আবার ছয়ের দশকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গী করে সত্যজিৎ পুনরায় চালু করেন এই পত্রিকাটি। সেইসময় সত্যজিৎ চিত্র-পরিচালক রূপে জগদ্বিখ্যাত, তা সত্ত্বেও যে তিনি এই কাজের জন্য সময় বার করতে পেরেছিলেন তার মূল কারণ নিঃসন্দেহে কিশোর সাহিত্যের প্রতি তাঁর আজীবনের অগাধ অনুরাগ। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "ছেলেবেলার আমার একটা মস্ত সুযোগ এই যে, বাড়িতে দিনরাত্রি সাহিত্যের হাওয়া বহিত।" একই কথা সত্যজিতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাঁর ক্ষেত্রে হয়তো কথাটি মূলতঃ কিশোর সাহিত্যই হবে।

এরপরে যখন তিনি সিগনেট প্রেসে যোগদান করেন, দিলীপকুমার গুপ্তের সহযোগিতায় বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীর কিশোর সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’ পড়ে তিনি মুগ্ধ হন। বইটি অলংকরণ করাকালীনই তাঁর মনে এটিকে চলচ্চিত্রায়িত করার কথে মনে আসে।

ষাটের দশকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে সন্দেশ পত্রিকার পুনরাবির্ভাব করাতে গিয়েই কিশোর সাহিত্যে তাঁর নিজের হাতেখড়ি। শুরু হল গল্প লেখা। সন্দেশে ফেলুদার আত্মপ্রকাশ হয়েছিল খুবই সাধারণ ভাবে। দার্জিলিং-এ — ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ নামক একটি গল্প দিয়ে। সম্ভবত তখনো তিনি ভাবেননি যে এই চরিত্রটি এতটা জনপ্রিয় হবে। ১৯৬১-তে সন্দেশ শুরু হওয়ার পরও ১৯৬৫ অবধি ফেলুদা আবির্ভূত হননি। সন্দীপ রায় আমাদের জানিয়েছেন যে সত্যজিৎ এই গল্পটি অন্য গল্পের মতই শুরু করেছেন, সেভাবে চরিত্র নিয়ে ভাবেননি। কথাটা খুবই ঠিক।

প্রথম গল্পে ফেলুদা ছিল তোপসের মাসতুতো দাদা। প্রথম গল্পে তপেশের পদবীর উল্লেখ নেই। এমনকি বাদশাহী আংটি-তেও তাই। কিন্তু কৈলাস চৌধুরীর পাথর গল্পে দেখছি, ফেলুদা তোপসের পরিচয় দিচ্ছে নিজের খুড়তুতো ভাই বলে। এই গল্পের শুরুতেই দেখেছি, ফেলুদা নিজের একটা ভিজিটিং কার্ডও বানিয়েছে। অর্থাৎ সত্যজিৎ এইবার সত্যিই সিরিয়াস হয়ে সিরিজের কথা ভাবছেন। তখন তাঁর চোখেই নিজের এই ত্রুটি ধরা পড়লো। একবাড়িতে যারা থাকবে, মাসতুতোর বদলে জাঠতুতো খুড়তুতো ভাই হলে দুজনের পদবীও এক হবে। এটি পাঠকের চোখে অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্য হবে।

তাঁর ‘ডিটেল সম্পর্কে দু চার কথা’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ বলেছিলেন বঙ্কিমের কথা। বিষবৃক্ষ উপন্যাসে নগেন্দ্রের বাড়ীর উঠোনের বিবরণের কথা। “--বঙ্কিম জানতেন যে কাহিনী কাল্পনিক হলেও পাঠকের মনে সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে ডিটেলের সাহায্যে তার একটি বাস্তব পটভূমিকা রচনা করে নিতে হয়।”

ডিটেলে ত্রুটি থাকলে তা পাঠকের মনে খুঁতখুঁতুনি তৈরি করে আর তাতেই কাহিনীর চরিত্র পাঠকের কাছে রক্তমাংসের চরিত্র হতে পারেনা।

এই ‘বিশ্বাসযোগ্য’ আর ‘বাস্তব পটভূমি’ শব্দ দুটি সত্যজিতের জীবনে আর কাজে খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি গল্প থেকে সিরিজে যাওয়ার পথে দেখলাম কি করে তিনি বাস্তব পটভূমি তৈরি করতে ত্রুটি শুধরে নিলেন। আরো দেখবো পরবর্তীকালে নিজের গল্প থেকে চলচ্চিত্র করতে গিয়েও এই ঘটনা তিনি ঘটালেন।

|| ২ ||

টেনিদা – ঘনাদা – ফটিকদা – ফেলুদা

১৯৬৫ সালে ফেলুদার আগমনের পূর্বেই কিন্তু বাঙালি কিশোরদের মন জয় করে ফেলেছে টেনিদা ও ঘনাদা। সত্যজিৎও কিশোর সাহিত্যের আগ্রহী পাঠক। তাঁর সম্পাদনাতে টেনিদার ঝাউবাংলোর রহস্য নিয়মিত প্রকাশিত হতে লাগলো সন্দেশ পত্রিকাতে। এঁরাই কি ফেলুদার পূর্বসূরি? তবে সত্যজিতের হাতে কিন্তু একটি ফেলুদার পূর্বসূরির জন্ম হয়ে গিয়েছিল, হয়তো তাঁর অজান্তেই।

বলছি ‘শিবু আর রাক্ষসের কথা’-র ফটিকদার কথা। শুনতে আজগুবি লাগলেও একটু ভেবে দেখা যেতে পারে। শিবু একটু ভীতু প্রকৃতির ছেলে, বাবা-মার আদরের। অন্যদিকে ফটিককে সবাই পাগল বললেও শিবু তাকে ভাবে খুব বুদ্ধিমান। ফটিকের অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, বুদ্ধি আর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, সে শিবুকে রাক্ষসের হাত থেকে বাঁচাতে চায়। পিতৃমাতৃহারা ফেলুদাও তাই, ফেলুদাকেও লোকে একটু পাগলাটে বলতো।

শিবুও যেন তোপসের পূর্বসূরি। তাকে ফটিক শেখায়, “দেখা আর লক্ষ করা এক জিনিষ নয়। বুঝেছিস? বলতো তুই যে বেল্টটা পরেছিস, তাতে কটা ফুটো? শার্টটার কটা বোতাম? না দেখে বলতো?”

শিবু পারে না। যেভাবে তোপসেও প্রথমদিকে পারতো না। বাদশাহী আংটি-তে ফেলুদা সম্পর্কে তোপসে প্রথম বিস্তারিত পরিচয় দিতে গিয়ে কি বলছে দেখা যাক— “এখানে বলে রাখি, ফেলুদা হল আমার মাসতুতো দাদা। আমার বয়স চোদ্দো, ওর সাতাশ। ওকে কেউ কেউ বলে খামখেয়ালী, কেউ কেউ বলে আধপাগলা, কেউ কেউ বলে কুঁড়ে। আমি কিন্তু জানি ওই বয়সে ফেলুদার মত বুদ্ধি খুব কম লোকেরই হয়। আর ওর মনের মত কাজ পেলে ওর মত খাটতে খুব কম লোকেই পারে। ---ওর মেমারি এত ভাল ছিল যে ‘দেবতার গ্রাস’ মাত্র দুবার পড়েই মুখস্থ করে ফেলেছিল।”

শিবু ঠিক যেমন বলেছে ফটিকদা সম্পর্কে, “শিবু শুধু জানে ফটিকদা খুব গরীব আর লোকে বলে এককালে খুব পড়াশোনা করেই ফটিক পাগল হয়ে গেছে। শিবুর কিন্তু তার এক-একটা কথা শুনে মনে হয় তার মতো বুদ্ধিমান লোক খুব কমই আছে।”

কি আশ্চর্য মিল, না? তাই একথা মনে হতেই পারে ঘনাদা ও টেনিদা অনুপ্রাণিত সত্যজিৎও এরকম একটি চরিত্রের সন্ধানে ছিলেন। একটা তফাৎ — টেনিদার সাঙ্গোপাঙ্গরা প্রায় তার সমবয়সী। ঘনাদা আবার একটু বয়স্ক — মেসের অধিবাসীরা তাঁকে ‘আপনি’ বলেই সম্বোধন করেন। তিনি কিন্তু তাদের খুব কাছের মানুষ নন। এখানে ফেলুদা আলাদা — তোপসের চেয়ে তার বয়সের ব্যবধান এক দশকের বেশী। ফলে সে কার্যত তোপসের অভিভাবকও বটে। সোনার কেল্লা ছবিতে তো সত্যজিৎ একেবারে পরিষ্কার করে দিয়েছেন এই সম্পর্কের ভিত্তি — যখন তোপসের বাবা তাঁর স্ত্রীকে বলছেন, “ফেলুর মত মাস্টার আছে সেই স্কুলে?”

আমরা দেশে-বিদেশে যে সব রহস্যকাহিনী পড়েছি, তাতেও গোয়েন্দাদের সঙ্গী থাকে, কিন্তু তারা গোয়েন্দার সমবয়সী। ওয়াটসন, হেস্টিংস বা আমাদের অজিত, সুব্রত ইত্যাদিরা তাদের প্রায় বন্ধুর মত। কিন্তু এই রহস্য গল্পের পাঠক যেহেতু কিশোর-কিশোরী, তাই তোপসেকে থাকতে হয়েছে তাদের প্রতিনিধি হয়ে। বেশ অভিনব প্রয়োগ!

সুতরাং, একটু আকস্মিক ভাবে শুরু হলেও ফেলুদার পথচলা ধীরে ধীরে মসৃণ হয়ে গেছে। এরপরে যখন জটায়ু দলে যোগ দিলেন, — ব্যস! সব মিলিয়ে তাদের কীর্তিকলাপ শুধু কিশোর নয়, সব বয়েসের পাঠকদেরই আকর্ষণ করতে লাগলো।

|| ৩ ||

দুজনার দুটি পথ, দুটি দিক

‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে’— জনপ্রিয় গানটি ব্যবহার করে ফেললাম ফেলুদা ও ব্যোমকেশের গতিপথের তফাৎ বোঝাতে। মাঝে মাঝেই এই নিয়ে বিতর্ক হয়, তাই এই ফাঁকে নিজের মতামতটাও জানাতে দ্বিধা করলাম না।

শরদিন্দুর রহস্যকাহিনীতে ভ্রমণের স্বাদ নেই বললেই চলে। তার কারণও আছে। বাংলার প্রাপ্তবয়স্ক ভ্রমণসাহিত্য যথেষ্ট পুষ্ট। কাজেই তাঁর উপন্যাসে সে কথা বলে বিশেষ লাভ নেই। তিনি অসাধারণ বর্ণনা দিতে পারতেন, তাঁর রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি যাঁরা পড়েছেন তাঁরাই মানবেন একথা। কিন্তু গোয়েন্দা কাহিনীতে শরদিন্দু তার ধার মাড়ালেন না। তিনি স্থির করেছিলেন, তাঁর উপন্যাস হবে ‘আধুনিক’, তা প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের জন্য। লেখক শেখর বসু ‘চোখের বালি’ নিয়ে আলোচনা করা কালীন লিখেছেন,

“নতুন উপন্যাসের স্বভাব হবে আধুনিক। ছবিকে সাজসজ্জায় আচ্ছন্ন করার প্রয়োজন নেই। আজকের ছবি স্পষ্টই হওয়া দরকার। নামতে হবে ‘মনের সংসারের কারখানাঘরে।’ সেখানে ‘আগুনের জ্বলুনি হাতুড়ির পিটুনি’ থেকে দৃঢ় ধাতুর মূর্তি জেগে ওঠে। ‘মানববিধাতার নির্মম সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার বিবরণ’ চাই। এমন কোনও বিষয় নিয়ে আগে উপন্যাস লেখা হয়নি।”

তাই আমরা শরদিন্দুর রহস্যে সেই আধুনিকতার ছোঁয়া পাই। পরকীয়া প্রেম, (বহ্নি-পতঙ্গ), সম্পত্তি — উত্তরাধিকার (আদিম-রিপু, খুঁজি খুঁজি নারি, দুর্গ রহস্য), লাম্পট্য (বেণী সংহার, রক্তের দাগ, বিশুপাল বধ), মাদকাসক্তি (মাকড়শার রস), বঞ্চিতের প্রতিশোধ স্পৃহা (শজারুর কাঁটা, অদৃশ্য ত্রিকোণ), দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা (মগ্নমৈনাক), অবৈধ সন্তান (আদিম রিপু, অচিনপাখি, রক্তের দাগ) ইত্যাদি। ‘মানববিধাতার নির্মম সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার বিবরণ’ — একদম পুরোমাত্রায়। এছাড়া রয়েছে ব্যোমকেশ, অজিত ও সত্যবতীর আলোচনার মধ্যে ধর্মাধর্ম, পাপ-পুণ্য, প্রেম-বিরহ ইত্যাদির মনোরম সংমিশ্রণ যার আবেদন সংবেদনশীল পাঠকের কাছে চিরকালীন।

আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল ব্যোমকেশ-সহযোগী অজিতের। তার সাহিত্যগুণের সম্পর্কে এসে ব্যোমকেশের মধ্যেও সাহিত্য ও দার্শনিকতার রসসঞ্চার হয়। কাহিনীগুলিতে সেটিও এক আলাদা মাত্রা দান করেছে। এই প্রসঙ্গে স্বলিখিত একটি প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা আছে।

একটু আলোচনা করা যেতেই পারে। অগ্নিবাণ গল্পে এর শেষ পর্বে এসে আমরা দেখেছি যে ব্যোমকেশ তার কাহিনী শেষ করে অজিতকে বলছে — “‘অজিত, তুমি তো লেখক, দেবকুমারবাবুর এই ব্যাপারের মধ্যে একটা প্রকান্ড রূপক দেখতে পাচ্ছ না? মানুষ যেদিন প্রথম অন্যকে হত্যা করবার অস্ত্র আবিষ্কার করেছিল, সেদিন সে নিজেরই মৃত্যুবাণ নির্মাণ করেছিল; আর আজ সারা পৃথিবী জুড়ে গোপনে গোপনে যে হিংসার কুটিল বিষ তৈরী হচ্ছে, এও মানুষ জাতটাকে একদিন নিঃশেষে ধ্বংস করে ফেলবে - -ব্রহ্মার ধ্যান-উদ্ভুত দৈত্যের মত সে স্রষ্টাকেও রেয়াৎ করবে না। মনে হয় না কি?’

ঘর অন্ধকার হইয়া গিয়াছিল, ব্যোমকেশকে ভাল দেখা যাইতে ছিল না। আমার মনে হইল, তাহার শেষ কথাগুলো কেবল কল্পনা নয় – ভবিষ্যদ্বাণী।”

বলা বাহুল্য, এই অংশ কোন কিশোর উপন্যাসে থাকা সম্ভব নয়। তা আদৌ মনোগ্রাহী হবে না।

অপরদিকে কিশোরপাঠ্য হতে হবে ফেলুদাকে। কারণ তার আবির্ভাব ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায়। বাংলার কিশোর সাহিত্যের ঐতিহ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। ফলে উপরিলিখিত উপাদানগুলিও নেই। শুধু রহস্যকাহিনী একটু খটোমটো হয়ে যাবে, তাতে রসোত্তীর্ণ করে তুলতে আরো একটি উপাদানের খুব প্রয়োজন।

সম্ভবত সত্যজিৎ জানতেন যে কিশোর উপযোগী ভ্রমণ কাহিনী বাংলাতে নেই বললেই চলে। এ ব্যাপারে তাঁর কলম চলে প্রায় তুলির মতই, আদতে তিনি তো চিত্রশিল্পীই। সন্দীপ রায় জানিয়েছেন যে ছবির শুটিং করতে যে যে জায়গায় যেতেন, সেগুলিই চলে আসতো কাহিনীর পটভূমিতে। এভাবেই এসেছে দার্জিলিং, গ্যাংটক, রাজস্থান, বারাণসী। সে জায়গাগুলি তাঁর বিবরণে একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে আমাদের চোখের সামনে। কতটা প্রাণবন্ত, তা আমরা দেখবো কিছু উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করে।

|| ৪ ||

‘আশ্চর্য ভ্রমণ’

“—‘আর সাতাত্তর পা।’
—‘আর যদি না হয়?’
— ‘হবেই ফেলুদা। সেবার আমি গুনেছিলাম।’
— ‘না হলে গাঁট্টা তো?’
— ‘হ্যাঁ- কিন্তু বেশী জোরে না। জোরে মারলে মাথার ঘিলু এদিক-ওদিক হয়ে যা।’
কি আশ্চর্য সাতাত্তরে রাজেনবাবুর বাড়ি পৌঁছলাম না। আরো তেইশ পা গিয়ে তবে ওর বাড়ির গেটের সামনে পড়লাম। ফেলুদা ছোট্ট করে একটা গাঁট্টা মেরে বলল — আগের বার ফেরার সময় গুনেছিলি না আসার সময়?
— ফেরার সময়।
— ইডিয়ট। ফেরার সময় তো ঢালে নামতে হয়। তুই নিশ্চয়ই ধাঁই ধাঁই করে ইয়া বড়া বড়া স্টেপ ফেলেছিলি।”

প্রথম গল্পের এই ছোট্ট বিবরণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ফেলুদার ভবিষ্যতের পথচলা। এমন জীবন্ত বর্ণনাতে যেন সকল কিশোর কিশোরী ফেলুদার সঙ্গে তোপসে হয়ে যাই। সেই পাহাড়ী পথের চড়াই-উৎরাই, নিজেকে ফেলুদার কাছে বুদ্ধিমান প্রতিপন্ন করা, কিছুটা সাফল্য কিন্তু শেষমেশ হার স্বীকার আর ফেলুদার প্রচ্ছন্ন তিরস্কার — সব কিছু একেবারে চোখের সামনেই দেখতে পাই।

পরবর্তী কালেও আমরা এরকম ছবি পাই। ধরা যাক — বাদশাহী আংটি। ডুন এক্সপ্রেসে চেপে সবাই মিলে হরিদ্বার যাচ্ছে। অস্টিওপ্যাথ শ্রীবাস্তব আর বনবিহারীবাবুর সঙ্গে আলোচনাতে রহস্য আরো ঘনীভূত হচ্ছে। তখনকার বিবরণে পাই— "সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কামরার বাতিগুলো এইমাত্র জ্বলেছে। ট্রেন ছুটে চলেছে বেরিলির দিকে। কামরায় সবশুদ্ধ সাতজন লোক।”

এত সহজে ভ্রমণের একটা সজীব ছবি! তারপর ট্রেনের দোলানিতেও তোপসের ঘুম আসছে কিন্তু চিন্তা এত ঝাঁকুনির মধ্যে ঘুম আসে কি করে? তোপসেকে তখন ফেলুদা বোঝাচ্ছে,

"এরকম শব্দ যদি অনেকক্ষণ ধরে হয় মানুষের কান অভ্যস্ত হয়ে যায়; তখন আর শব্দটা ডিস্টার্ব করেনা। আর ঝাঁকুনিটা তো ঘুমকে হেল্পই করে। খোকাদের দোল দিয়ে ঘুম পাড়ায় দেখিসনি।"!!

মনে হয়না কি আমরাও ঐ ভ্রমণের সঙ্গী? বা গ্যাংটকে গণ্ডগোল — প্লেনে যেতে যেতে —

“কিছুক্ষণ আগে অবধি বাইরে জানলা দিয়ে নীচের দিকে তাকালে শুকনো হলদে মাটি আর সরু সরু সিল্কের সুতোর মত এঁকে বেঁকে যাওয়া নদী আর মাঝে মাঝে খুদে খুদে গ্রামের খুদে খুদে ঘরবাড়ি গাছপালা দেখতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ কোত্থেকে জানি মেঘ এসে পড়াতে সেসব কিছুই আর দেখা যাচ্ছেনা।”

কিংবা বাক্স-রহস্য--

“অবিশ্যি বরফের দেশ বলতে কেউ যেন নর্থ পোল সাউথ পোল ভেবে না বসে। -- আমরা যেখানে গিয়েছিলাম সেটা আমাদেরই দেশের ভিতর; কিন্তু যে সময়টাতে গিয়েছিলাম তখন সেখানে বরফ। আর সে বরফ আকাশ থেকে মিহি তুলোর মত ভাসতে ভাসতে নীচে নেমে এসে মাটিতে পুরু বরফ হয়ে জমে, আর রোদ্দুরে সে বরফের দিকে চাইলে চোখ ঝলসে যায়, আর সে বরফ মাটি থেকে তুলে নিয়ে মুঠো করে ছোঁড়া যায়।” ১০

এক্ষেত্রে সত্যজিতের ওপর সম্ভবত অবনীন্দ্রনাথের প্রভাব দেখা যায়। তিনিও ছবি আঁকতেন, আবার ছবি লিখতেনও। বুড়ো আংলা তার সর্বোত্তম উদাহরণ।

আমরা একটু বিস্তারিত ভাবেই আলোচনা করলাম সত্যজিতের ফেলুদা সৃষ্টির নেপথ্য কাহিনী নিয়ে। আমাদের মনে হয়, যখন সত্যজিৎ ফিল্ম বানাতে চাইলেন, তিনি ফেলুদার এই মূল ব্যাপারগুলিকে মাথায় রাখলেন। কাহিনী থেকে কাহিনীচিত্রের যে পরিবর্তনগুলি তিনি করেছিলেন, তা এই উদ্দেশ্য থেকেই। এটা ভাবলেই তফাৎগুলি বুঝতে আমাদের বিশেষ সুবিধে হবে।

|| ৫ ||

সোনার কেল্লায় স্বর্ণরেণুর সন্ধান

সোনার কেল্লা চলচ্চিত্রায়িত হওয়ার পরিকল্পনা হয় ১৯৭৩ সাল নাগাদ। তখনো অবধি সত্যজিতের যে পূর্ণাঙ্গ কাহিনীগুলি প্রকাশিত হয়েছে তা হল, গ্যাংটকে গণ্ডগোল, বাদশাহী আংটি, সোনার কেল্লা, বাক্সরহস্য, কৈলাসে কেলেঙ্কারিরয়াল বেঙ্গল রহস্য। এদের মধ্যে সোনার কেল্লাকে বাছার প্রধান কারণ সম্ভবত ঐ গল্পেই জটায়ুর আগমন এবং রঙিন চলচ্চিত্রে সোনার কেল্লার অমোঘ আকর্ষণ। তাঁর আগের ছবিটি, অশনি সঙ্কেতও ছিল রঙিন ছবি।

সোনার কেল্লা উপন্যাস শুরু হয়েছিল মুকুলের বাবা সুধীর ধরের ফেলুদার বাড়িতে আসা দিয়ে। গল্পের শেষ কিন্তু সোনার কেল্লাতে নয়। জয়সলমীরে বাংলোতে এসে ফেলুদা সবাইকে তার ভবানন্দ ও মন্দার বোসের মুখোস খোলার গল্প শোনায়। আসল ডঃ হাজরার সঙ্গে আলাপ হয়, সেখানে নাহারগড়ে দুর্ঘটনার কথা জানা যায়। এর আগের পরিচ্ছেদেই অবশ্য সোনার কেল্লাতে ভবানন্দ ধরা পড়েছেন।

সত্যজিৎ নিজেই বলেছেন তো—

“আগেও বলেছি, আবার বলছি, ভাষার গুণে পড়ার সময় এসব খটকা মনে লাগেনা। কিন্তু চিত্রনাট্য রচনার প্রয়োজনে যখন মূল কাহিনীর নির্মম বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়, যখন চরিত্রগুলিকে রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে কল্পনা করতে হয়, গল্পের পরিবেশ চোখের সামনে মূর্ত করে তুলতে হয়, সময়ের পরিষ্কার সূত্র ধরে ঘটনাবলীর একটা ধারাবাহিকতা তৈরী করতে হয় — তখনই এ জাতীয় ত্রুটি চোখে পড়ে। কাহিনীর অদলবদল যে হয় তা এ কারণেই — খামখেয়ালবশত নয় বা পরের কাহিনীর ভিত্তিতে ছবি তৈরী করে মৌলিক রচনার বাহবা নেওয়ার জন্য নয়”। ১১

সিনেমা করতে গিয়ে সম্ভবত সত্যজিতের মাথায় একটা কথাই প্রথমে এসেছিল, তা হল কাহিনীর ক্লাইম্যাক্স হবে সোনার কেল্লাতেই। শুরু এবং শেষ দুইই হবে কেল্লাতে। প্রথমটি হবে আঁকা কেল্লা — দ্বিতীয়টি হবে একেবারে আসল কেল্লা। এই ভাবে ছবিটিকে সাজালে তার একটি অনন্য অভিঘাত থাকবে। আগেই বলেছি কিশোর পাঠ্য কাহিনীর পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে তিনি ভেবেছেন ভ্রমণকে — কাজেই কিশোরোপযোগী রহস্য কাহিনীতেও একটি ভ্রমণ থাকবে কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে। সোনার কেল্লা — সত্যিই তো! এই কেল্লাতেই তো ফেলুদা ‘কেল্লাফতে’ করবে! তারপরে আবার বাংলোতে ফিরে ফেলুদা গড়গড় করে গল্প বলবে নাকি! সব অভিঘাতই নষ্ট হয়ে যাবে। এছাড়া যে মুকুল ধরকে নিয়ে এত কাণ্ড, তাকে তো ক্লাইম্যাক্সে গুরুত্ব দিতে হবে। কাহিনীর শেষে কিন্তু মুকুলের সেরকম গুরুত্ব নেই। দেখা যায় গেস্ট হাউসে মুকুল আনমনা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

‘আপনি আচরি ধর্মের’ উদাহরণ দিলেন সত্যজিৎ। নিজের কাহিনীর ‘নির্মম বিশ্লেষণ’ করতে গিয়ে তিনি দেখলেন অনেক পরিবর্তন প্রয়োজন। ছবিটা দেখলে এটা পরিষ্কার, তাঁর কাছে কাহিনীর নায়ক ছিলেন দুজন — মুকুল ধর ও তার সোনার কেল্লা। কাজেই তিনি স্থির করে ফেললেন শুরুতে যেমন, শেষেও তেমন — কেন্দ্রবিন্দুতে — মুকুল ও সোনার কেল্লা।

        
“এটা কেল্লা – সোনার কেল্লা”    মুকুল হাসে - প্রথমবার               বাড়ী ফেরার পালা

এই ভাবনাটা মাথায় রাখলেই কিন্তু আমরা চিত্রনাট্যের বদল গুলি খুব সহজেই ধরতে পারি। যে হেতু ছবির শেষে ফেলুদার ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকছে না, তাই আগে থেকে গল্প বলে দিতে হবে। আগে থেকে বলে দিলেও শেষের দিকে যাতে দর্শকের আগ্রহ থাকে তার জন্য থাকতে হবে দ্রুত গতির কাহিনী আর পট পরিবর্তন। উঁচুমানের কমিক অভিনয় করার জন্য তিনি রাখলেন তাঁর অতিপ্রিয় দুই অভিনেতাকে জটায়ু — সন্তোষ দত্ত আর মন্দার বসু — কামু মুখোপাধ্যায়। আর ফেলুদার ভূমিকায় তিনি পেশ করলেন, তাঁর আবিষ্কৃত তুরুপের তাস — সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। যেহেতু ভ্রমণের এক বিশেষ ভূমিকা, অনেক ঘটনাই ঘটছে ট্রেনে। গল্পে ট্রেনের কিন্তু এতবড় ভূমিকা ছিল না। চাক্ষুষ দেখলে ট্রেনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গল্পের গতিও বেড়ে যাবে।

খুব ছোট্ট একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে দুটি দৃশ্যের তফাৎ — কাহিনীতে আর ফিল্মে। মরুভূমিতে ফেলুদার ট্রেন থামানোর ঘটনা। বইতে ছিল ফেলুদা ট্রেনটাকে দাঁড় করানোর জন্য দৌড়ে গিয়ে ট্রেনটিকে থামানোর চেষ্টা করছে। সঙ্গে ছিল ছবিও — তাঁর নিজেরই আঁকা। কিন্তু সিনেমাতে দেখা যাবে ফেলুর দল আগেই উটে চড়ে বসেছে — উটের মাথা থেকে ফেলুদা জীবনপণ করে রুমাল নাড়ছে। ট্রেন থামে না — আমরা সেই সময় ফেলুদার হতাশা দেখতে পাই।

     
গল্পে – ট্রেন ধরা                                আর – ছবিতে

দুটি দৃশ্যকে পাশাপাশি রাখলেই বোঝা যায়, কোনটি বেশী সজীব আর বর্ণময় আর কিশোরমনে কার অভিঘাত বেশী। উটের ওপর থাকার দরুন উচ্চতা পেয়ে দৃশ্যটি আরো মনোগ্রাহী হয়েছে। আর উটের দল যাচ্ছে, আর বিস্তীর্ণ মরুভূমি জুড়ে ট্রেন যাচ্ছে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে। অপূর্ব দৃশ্য। সেজন্য কাহিনী অনুযায়ী ট্রেন মিস করার পর নয়, তার আগেই উটে চড়তে হয়েছে ফেলুদাকে। আরো একটা সুন্দর কন্ট্রাস্ট ধরা পড়ে — উট হল মরুভূমির চিরকালীন ধ্রুপদী বাহন আর ট্রেন হল আধুনিক সভ্যতার। পাশাপাশি এই দুই বাহনকে দেখে দর্শকের চোখেও এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। নিজের কাহিনীর এরকম বহু অসামান্য অদলবদল করে তিনি বুঝিয়েছিলেন, তাঁর উপরিল্লিখিত যুক্তি শুধু অন্য লেখকের জন্য নয়, স্বয়ং লেখক সত্যজিতের জন্যও প্রযোজ্য।

এছাড়া ‘অপরাধী কে’ ধরনের ডিটেকটিভ কাহিনীর চিত্রায়নেও তাঁর বেশী আগ্রহ ছিল না। ‘চিড়িয়াখানা’ ছবি প্রসঙ্গে এন্ড্রু রবিনসনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন যে একেবারে ক্লাইম্যাক্সে এসে ডিটেকটিভ যে তাঁর পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেন, এটি তাঁর মতে সিনেমা সুলভ নয়। ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিটি তিনি করেছিলেন নিমরাজি হয়েই “‘I accepted willy-nilly,’ he said. Whodunits don’t make very good films, because of the very long explanation at the end where the film becomes very static।” ১২

সেই কারণেই তিনি আঙ্গিক বদল করেছিলেন। আর এই পরিবর্তিত আঙ্গিকের ছবি দেখেই বাঙালি দর্শক আত্মহারা হয়েছিল। ভ্রমণপিপাসু বাঙালির জীবনে আরো এক চিরন্তন তীর্থ যোগ হল — সোনার কেল্লা আর তার অন্তর্ভুক্ত ‘মুকুলবাড়ি’, সেই বাড়ী যেখানে মুকুল প্রথম হাসে। এখানেই ছবিটির চরম সার্থকতা আর পরিচালকের পরম প্রাপ্তি।

|| ৬ ||

ঐতিহ্যে ঝলমল কাশীর গলিতে — বিশ্বনাথ ও ফেলুনাথ

জয় বাবা ফেলুনাথ-এর রচনা কাল ১৯৭৭ সাল। তার আগে সোনার কেল্লা অভূতপূর্ব সাফল্যের মুখ দেখেছে। জটায়ুর মুখে পাঠক পাঠিকারা দেখতে পাচ্ছেন সন্তোষ দত্তর ছায়া। এটা জানা যাবে না যে যখন সত্যজিৎ জয় বাবা ফেলুনাথ লিখছেন তখন তিনি কিছুটা সিনেমার আদল কাহিনীতে দেখতে পেয়েছিলেন কিনা। তবে এই কাহিনীতেও বেশ কিছু বড়রকম পরিবর্তন থাকার ফলে সে সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়। ‘কাশী’ তাঁর একটি ভীষণ প্রিয় জায়গা। ‘তীর্থস্থান মানেই নোংরা শহর’ — হরিদ্বার সম্পর্কে ফেলুদার বক্তব্য সত্যজিতেরই মনের কথা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ‘কাশী’ সম্পর্কে তিনি ও ফেলুদা উচ্ছ্বসিত। এবং সম্ভবত এটাই কারণ যে ‘কৈলাস’ বা ‘দার্জিলিং’ বা ‘গোরস্থান’ নয়, তাঁর পরের কাহিনীর অকুস্থল হল বারাণসী।

তার কারণটা তো আমরা জানি। ফেলুদাই জানিয়েছে,

“‘তার কারণটা কি জানিস’ ফেলুদা বলল, ‘তুই যে নীচের দিকে তাকিয়ে একটা রাস্তা দেখছিস তা তো নয়; তুই দেখছিস বেনারসের রাস্তা। বেনারস! কাশী! বানারসী! চারটি খানি কথা নয়। পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর! পুণ্যস্থান, পীঠস্থান! রামায়ণ মহাভারত মুনিঋষি যোগী সাধক হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ জৈন সব মিলে এই বেনারসের একটা ভেলকি আছে যার ফলে শহরটা নোংরা হয়েও ঐতিহ্যে ঝলমল করতে থাকে’ ”!!১৩

সুতরাং ফেলুস্রষ্টা একদম পরিষ্কার — তাঁর পরবর্তী রহস্য কাহিনী চিত্রায়িত হবে সেখানেই যে শহরের ‘ভেলকি’ আছে আর যা নাকি ‘ঐতিহ্যে ঝলমল’। উপরি হিসেবে এই কাহিনীতেও সোনার কেল্লার মত এক শিশু চরিত্র আছে — রুকু ওরফে রুক্ষিনীকুমার ওরফে ক্যাপটেন স্পার্ক।

এই কাহিনীকে চিত্রায়িত করতে গিয়ে কিন্তু সত্যজিৎ সোনার কেল্লার চেয়েও অনেক বেশী পরিবর্তন করলেন। এমনকি পালটে দিলেন অপরাধীকেও।

১৯৭৭ সালে শারদীয়াতে প্রকাশিত এই কাহিনীর শুরু কিন্তু কলকাতায় ফেলুদার বৈঠকখানায়। জটায়ু ফেলুদাকে লোভ দেখাচ্ছিলেন দশাশ্বমেধ ঘাটে ঠাকুরের ভাসান দেখানোর জন্য। কাগজের কাটিংও দেখাচ্ছেন বেনারসের মছলি বাবার। কিন্তু ছবি শুরু করতে গিয়ে এসব অনর্থক সময় নষ্ট করেননি তিনি, সটান ফেলুর দলকে নিয়ে ফেলেছেন একেবারে বেনারসে। কারণ, সেই যে — প্রথমেই সেই শহরে গিয়ে পড়তে হবে, ক্যামেরার সাথে দর্শকরা ঘুরবে কাশী শহরের সর্বত্র। আবিষ্কার করবে শরের ভেলকি আর ঝলমলে ঐতিহ্য। অতএব, ‘আর বিলম্ব নয়’!

যখন উপন্যাস লিখেছিলেন, তখন কিন্তু রুকু আর তার বন্ধু সূরযের বন্ধুত্ব ও পরে সূরযের বিশ্বাসঘাতকতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চিত্রনাট্য রচনার সময় কিন্তু সত্যজিৎ চোখ রাখলেন ক্যামেরাতে। পরক্ষণেই তাঁর মনে উদয় হল একটি ভাবনা — রুকুর বন্ধু সূরয, যে একটি বাচ্চা ছেলে, তাকে যদি একজন হীন অপরাধী করে দেখানো হয়, তাঁর যাঁরা উদ্দিষ্ট দর্শক, তাঁরা কিভাবে নেবেন? বইয়ে পড়া আর চোখে দেখা — দুয়ের মধ্যে তফাৎ অনেক! যে ছেলেটি প্রথমে রুকুর প্রাণের বন্ধু ও খেলার সাথী, পরে সেই কিনা এতটা বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করবে? এটা তাঁর নিজের কাছেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। আরো কটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার — সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধী হল মগনলাল মেঘরাজ — তাহলে খুনের মত সাংঘাতিক কাজটির জন্য কি করে অন্য কেউ দায়ী হবেন? এছাড়া রুকুর পক্ষে একা গণেশের মূর্তি চুরি করে চিকলেট দিয়ে সিংহের মুখে আটকানো কি সম্ভব? আরো কথা, অত দামী মূর্তি এরকম হেলায় থাকবে? মগনলাল যে জটায়ুকে এত বড় অপমান করলেন, ফেলুদাকে সাক্ষী রেখে, সে কোন শাস্তি পাবে না? কাহিনীতে দেখি এরকম অপমানের পর ফেলুদা অনেকটা হতাশ, তার প্রতিশোধস্পৃহা নেই। বিকাশ সিংহ লোভী নিঃসন্দেহে, কিন্তু তার মত ছাপোষা লোক একেবারে সাহস করে খুন করে ফেলবেন, বিশেষত যখন সেখানে মগনলালের মত দুর্ধর্ষ অপরাধী রয়েছেন? ফেলুদার জীবনে যিনি ‘সবচেয়ে ধুরন্ধর প্রতিদ্বন্দ্বী’’?

তিনি নিজের কথাই আবার ভাবলেন।

“চিত্রনাট্য রচনার প্রয়োজনে যখন মূল কাহিনীর নির্মম বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়, যখন চরিত্রগুলিকে রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে কল্পনা করতে হয়, গল্পের পরিবেশ চোখের সামনে মূর্ত করে তুলতে হয়, সময়ের পরিষ্কার সূত্র ধরে ঘটনাবলীর একটা ধারাবাহিকতা তৈরী করতে হয় — তখনই এ জাতীয় ত্রুটি চোখে পড়ে!”১৪

সম্ভবত এখানেও তাই হল। নিজের কাহিনীর চিত্রনাট্য রচনার সময় তিনি নৈর্ব্যক্তিকভাবে নিজের কাহিনীর ‘নির্মম বিশ্লেষণ’ করতে গিয়ে ওপরে যেগুলি আলোচনা করলাম, সেই গণ্ডগোলগুলি লক্ষ করলেন। আর তাই কাহিনীতে এল বড়োসড়ো পরিবর্তন।

কাহিনীর শুরুতেই আমরা দেখেছি অপরাধের অংশবিশেষ। দেখেছি সম্ভাব্য অপরাধীদের আর ঘটনাস্থল। এরপরেই দেখা গেল, ফেলুদা ও তোপসে লালমোহনবাবু সহ রিক্সায় চড়ে রওয়ানা হচ্ছে লজের দিকে। তাদের উদ্দেশ্য নির্ভেজাল ছুটি কাটানো। অর্থাৎ ঠিক সোনার কেল্লার আঙ্গিককেই যেন কিছুটা অনুসরণ করলেন। প্রথমে সেই লালমোহনবাবুর সঙ্গে কলকাতার বৈঠকখানায় গল্প গুজব একেবারেই হাওয়া। একেবারে Straight to the point. কারণ কাহিনীচিত্রের দাবি।

এরপরও তিনি এমনভাবে চিত্রনাট্য তৈরী করলেন যাতে উপরোক্ত সব কটি ফাঁক ঠিকঠাক ভরে গেল। এমনকি একটু আত্মসমীক্ষা বা আত্মসমালোচনাও করে ফেললেন। সেটা আমরা আলোচনা করব।

সিনেমাতে দেখা গেল, সূরযের কোন অস্তিত্বই নেই। মূল অপরাধের চক্রী স্বাভাবিক ভাবেই ধুরন্ধর প্রতিদ্বন্দ্বী মগনলাল। বিকাশ সিংহ লোভী হলেও তিনি খুনী নন। রুকু একা সিন্দুক থেকে গণেশ চুরি করেনি আর যে মূর্তি নিয়ে এত কাণ্ড তা আদৌ দামী নয়। সর্বোপরি, ফেলুদা মগনলালকে চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত করে লালমোহনবাবুকে অপমানের প্রতিশোধ নেয়।

সুতরাং সিনেমাতে আর ঐ ফাঁক চোখে না পড়ায় তা অনেক বেশী উপভোগ্য হয়। বিশেষতঃ ভাবা যাক ঐ ছুরি খেলার দৃশ্য আর তারপরে গঙ্গার ঘাটে অনুতপ্ত ফেলুদার প্রতিজ্ঞা — ‘লালমোহনবাবু, হয় এই ঘটনার প্রতিশোধ নেব, নয়তো গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব।’ আর ক্লাইম্যাক্সে এসে বেশ বদল করে ফেলুদার গণেশ উদ্ধার আর

     
মগজাস্ত্রর ব্যাখ্যা                           জটায়ুর পরীক্ষা

মগনলালের ওপর সাংঘাতিক প্রতিশোধ! দুটি ঘটনাই কাহিনীর ধারাবাহিকতা আর চরিত্রগুলির সঙ্গে পুরোমাত্রায় মানানসই হয়েছে।

তবে এই জায়গাতে রুকু না থাকার জন্য, আরো একটি ক্লাইম্যাক্স এসেছে ঘোষালবাড়ীতে, রুকুর উপস্থিতিতে। সেখানে আমরা রহস্যের আরো গভীরে ঢুকতে পারি। সেখানেই জানি নকল গণেশ আর রুকু ও তার ঠাকুর্দার যোগসাজশের কথা। আর শেষে রুকুর সংলাপ — “মগজাস্ত্র”!

দুটি কাহিনীচিত্রের মধ্যে তুলনা করলে হয়তো সোনার কেল্লা একটু এগিয়েই থাকবে, কিন্তু ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। কাশীর গলি, দশাশ্বমেধ ঘাট, রুকুদের বাড়ির অন্দরমহল, মগনলালের বৈঠকখানার আলো-আঁধারি, গঙ্গাবক্ষে মগনলালের বজরা — ক্যামেরা তার আপন ছন্দে ঘুরেছে। আমরাও প্রত্যক্ষ করেছি এই প্রাচীন শহরের বুকে যাওয়া অপরাধ ও তার তদন্তকে। এই উপভোগ্যতার অন্যতম কারণ নিঃসন্দেহে গল্পের চরিত্র ও ঘটনাকে চোখের সামনে মূর্ত করে তুলে ধরার জন্য কাহিনীর অতি আবশ্যিক পরিবর্তন ও পরিমার্জন।

আরো এক বিশেষ কারণ থাকবে। কাহিনী পরিমার্জনের জন্য নির্মম বিশ্লেষণের জন্য পরিচালক সত্যজিতের হাত থেকে পরিত্রাণ পাননি লেখক সত্যজিৎও। দুটি বিরাট পরিবর্তনের কথা বিশেষভাবে আলোচনা।

প্রথমত, কাহিনীতে শশীবাবুর হত্যাকারী রূপে বিকাশ সিংহ চিহ্নিত হয়েছিলেন। কাহিনীতে কিন্তু তা আদপেই নয়, তিনি শুধুমাত্র চিনিয়ে দেন। ফেলুদাও বলে যে বিকাশবাবুর দ্বারা খুন সম্ভব নয়। এটি কি একটি বড়মাপের আত্মসমালোচনা নয়? যে কাহিনীকার তাঁকে কাহিনী রচনার সময় খুনী বলে ভাবলেন, সেই মানুষই যখন ছবি পরিচালনা করছেন, তখন তাঁর গোয়েন্দা নির্দ্বিধায় বলে দিচ্ছেন — ‘সেটা না বললেও চলতো। ও কাজ আপনার দ্বারা সম্ভব নয়’!

দ্বিতীয় ব্যাপারটি আরো বড় মাপের। নকল গণেশের উদ্ভাবন। এখানেও ফেলুদার মুখ দিয়ে সমালোচিত কাহিনীকার — “এই গণেশটি যদি সত্যিকারের গণেশ হত, তাহলে কিছুতেই আপনি সেটিকে রুকুর সঙ্গে ফন্দী করে সিংহের মুখে আটকে রাখতেন না!” খুব সত্যি কথা। আসল কাহিনীতে সত্যজিৎ কিন্তু তাই রেখেছিলেন। রুকু সেটিকে চুরি করে সিংহের মুখে লাগিয়ে রেখেছিল। সত্যজিৎ চিত্রনাট্য লিখতে গিয়েই বুঝেছিলেন, পড়তে গিয়ে এই খটকা উপেক্ষা করা গেলেও চাক্ষুষ দেখার সময় কিন্তু এটি খুব বড় দুর্বলতা হিসেবে রয়ে যাবে। কিন্তু তিনি ফেলুদাকে কাশী দর্শন করাবেন ঠিক করে ফেলেছেন। সুতরাং এবারেও তিনি স্বচ্ছন্দে কাহিনীর বড়ো সড়ো একেবারে মূলগত পরিবর্তন করতে দ্বিধা করলেন না।

|| ৭ ||

খোদার হাতেই খোদকারি

বিস্তারিত আলোচনাতে আমরা দেখেছি নিজের কাহিনীকে সত্যজিৎ চিত্রপোযোগী করতে প্রায় গড়ে পিঠে নিয়েছেন। তিনি নিশ্চিন্তে করেছেন, কারণ এখানে তিনিই ‘খোদা’, ‘খোদকারি’ ও তাঁর নিজের হাতেই। কোন সমালোচনার প্রশ্ন নেই, হলেও গ্রাহ্য হবেনা। বিশেষতঃ সোনার কেল্লার অভাবনীয় সাফল্য তাঁকে অনেক বেশী আত্মপ্রত্যয়ী করে ছিল জয় বাবা ফেলুনাথ রূপান্তরের প্রক্রিয়াতে। আশানুরূপ সাড়াও এল দর্শকের কাছ থেকে, সাথে বাণিজ্যিক সাফল্যও।


উচ্ছ্বসিত সিধুজ্যাঠা
উত্তীর্ণ ফেলুদা
একটি প্রশ্ন এখানে উঠতেই পারে। খুব গাম্ভীর্য না রেখে হাল্কা চালেই আমরা কথাটি আলোচনা করতে পারি। ধরা যাক, অন্য কেউ সত্যজিতের জীবিতকালে জয় বাবা ফেলুনাথ চিত্রায়িত করবেন আর ঐ পরিবর্তনগুলি সেই পরিচালক করলেন? আমরা তাঁর গুণগ্রাহীরা ভাবতেই পারি, সেই ছবি দেখতে দেখতে সত্যজিৎ হয়তো সিধু জেঠার মত সেই পরিচালককে পিঠ চাপড়ে হয়তো বলে উঠতেন, — ‘বাহ, বাহ! দেখি তোমার আঙুলগুলো, জিতে রহো বাচ্চে’!



তথ্যসূচীঃ


১) বিষয় চলচ্চিত্র, সত্যজিৎ রায়; অষ্টম মুদ্রণ; আনন্দ; সেপ্টেম্বর ২০০৯; পৃ: ৫৯

২) গল্প ১০১, সত্যজিৎ রায়; তৃতীয় মুদ্রণ, আনন্দ, নভেম্বর – ২০০২ – পৃ: ৬৬

৩) ফেলুদা সমগ্র, সত্যজিৎ রায়; প্রথম খণ্ড, আনন্দ, ষষ্ঠ মুদ্রণ, নভেম্বর ২০০৯, পৃ: ২১

৪) গল্প ১০১, সত্যজিৎ রায়; তৃতীয় মুদ্রণ, আনন্দ, নভেম্বর – ২০০২ – পৃ =৬৫

৫) http://www.abasar.net/unibibidh_lit_chokherbali.htm

৬) http://www.abasar.net/sharadindu_bhaskar.html

৭) ফেলুদা সমগ্র, সত্যজিৎ রায়;, প্রথম খণ্ড, আনন্দ, ষষ্ঠ মুদ্রণ, নভেম্বর ২০০৯, পৃ: ৩

৮) ফেলুদা সমগ্র, সত্যজিৎ রায়; প্রথম খণ্ড, আনন্দ, ষষ্ঠ মুদ্রণ, নভেম্বর ২০০৯, পৃ: ৬২

৯) ফেলুদা সমগ্র, সত্যজিৎ রায়; প্রথম খণ্ড, আনন্দ, ষষ্ঠ মুদ্রণ, নভেম্বর ২০০৯, পৃ: ৬৫-৬৬

১০) ফেলুদা সমগ্র, সত্যজিৎ রায়; প্রথম খণ্ড, আনন্দ, ষষ্ঠ মুদ্রণ, নভেম্বর ২০০৯, পৃ: ১১৯

১১) ফেলুদা সমগ্র, সত্যজিৎ রায়; প্রথম খণ্ড, আনন্দ, ষষ্ঠ মুদ্রণ, নভেম্বর ২০০৯, পৃ: ২৪৪

১২) বিষয় চলচ্চিত্র, সত্যজিৎ রায়; অষ্টম মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর – ২০০৯, পৃ: ৯৮

১৩) Satyajit Ray The Inner Eye, Andrew Robinson; New edition published in 2004 by I.B. Tauris & Co Ltd, Pp. 233

১৪) ফেলুদা সমগ্র, সত্যজিৎ রায়, প্রথম খণ্ড, আনন্দ, ষষ্ঠ মুদ্রণ, নভেম্বর ২০০৯, পৃ: ৪৩৪

১৫)বিষয় চলচ্চিত্র – অষ্টম মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর – ২০০৯ – পৃ = ৯৮



(পরবাস-৭২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)



ছবি-ঋণ - সব ছবিগুলিই ইন্টারনেট থেকে গৃহীত