Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines






পরবাসে
সায়ন্তন সেন-এর

আরো লেখা


ISSN 1563-8685




বাঙালির দেশভাগ: স্মৃতি, সত্তা, ইতিহাস ও কিছু বিতর্কিত প্রশ্ন

১.

০০৮ সালে বই হিসেবে প্রকাশিত হয় সুনন্দা সিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’। ১৯৫১ সালে জন্ম লেখিকার, পুববাংলার দিঘপাইত গ্রামে। ১৯৬১ সালে, বাংলাদেশ নামক একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার দশ বছর আগে, জন্মভিটে ছেড়ে তিনি চলে এসেছিলেন পশ্চিমবাংলায় বাবা-মা’র কাছে। মধ্যবর্তী এক দশকের যে শৈশব-স্মৃতি— তা-ই ‘দয়াময়ীর কথা’। কী সেই কথা, কেমন সেই কথা? তা জানতে-বুঝতে হলে কথারম্ভেই একটি দগদগে উচ্চারণে আমাদের নজর দিতে হবে। সুনন্দা তাঁর স্মৃতিকথার গোড়াতেই বলছেন, কতকটা স্বীকারোক্তির ঢঙে,

“যখন খবরের কাগজে বের হত পুববাংলার কোনও খবর, কোনও লোকের মুখে উঠত পুববাংলার প্রসঙ্গ, যখন পুববাংলা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই করছে, তখন সেই সব কথা আমি শুনতে চাইতাম না।”
এমনকী, শৈশবের যে দশটি বছর তিনি কাটিয়েছেন নিজের দেশে, তাদেরও নাকি সচেতন ভাবে মুছে দিতে চেয়েছেন মন থেকে। অর্থাৎ, ছেঁটে ফেলতে চেয়েছেন স্মৃতিভার। প্রশ্ন জাগে, কেন নিজের গ্রাম, শৈশব, ঘরদুয়ার আর আত্মীয়পরিজনে ঘেরা দিনের স্মৃতি ভুলে যাওয়ার এই প্রকল্প নিচ্ছে দেশ-ভিখিরি একটি মেয়ে, নিতান্ত বালিকা-বয়সে? আসলে, এই ভুলে থাকার চেষ্টার মূলে আছে খুব সূক্ষ্ম কোনো গ্লানি, খুব গভীর কোনো অপরাধবোধ। তার ইঙ্গিতও আছে রচনার শুরুতেই—
“১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হল। অপ্রত্যাশিত ভাবে বাংলাদেশ থেকে আমার দাদার এক চিঠি এল। দাদা লিখেছেন, ‘আমরা বাঁচিয়া আছি। পথের খরচ জুটাইতে পারিলে একবার তোমার মুখখানি দেখিয়া আসিব।’ দাদার পথের খরচ জোটাতে চার বছর লাগল। ...পথেই খবর পেলাম, ‘তোকে যে মানুষ করেছিল, তোদের মুসলমান চাকর, সে তোদের বাড়ি এসেছে। বলছে তোকে দেখতে এসেছে। আসলে অবশ্য কোনও ধান্ধা আছে মনে হয়।’ ...আমার ভিখিরি অন্নহীন দাদা গোরু বেচে আমাকে একবার দেখতে এসেছে। তার মধ্যে আমার আত্মীয়দের কেউ কেউ ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়েছিলেন!”
ইঙ্গিত স্পষ্ট এবং ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। অতঃপর, আখ্যান যত এগোতে থাকে, তত আমরা বুঝতে পারি, আসলে লেখিকা যেন বহুদিনের কোনো ঋণ শোধ করছেন কলমের আঁচড়ে। যেন স্বীকারোক্তি পাঠাতে চাইছেন এমন কারও উদ্দেশে, যার কাছে আর স্বীকারোক্তি পৌঁছোয় না। যেন ছেড়ে আসা প্রিয়জনদের বলতে চাইছেন, আমি সেদিন খুব ভালো করে বুঝিনি কোন গোপন ষড়যন্ত্র আমাকে ছিঁড়ে এনেছে তোমাদের থেকে, আমায় ক্ষমা করো। অশোক মিত্র এ বই সম্পর্কে লিখেছিলেন, “চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিন্দু বিন্দু রক্ত ক্ষরিত হওয়ার মতো” একের-পর-এক কথার আত্ম-উন্মোচন। আমার বিনীত প্রশ্ন, এই রক্তক্ষরণ যতখানি বিচ্ছেদের যন্ত্রণা থেকে, ততখানিই কি অপরাধবোধ থেকেও নয়? এইখানেই প্রাথমিক খটকা-টা। সাফারারের বয়ানে এমন গ্লানি মিশে থাকবে কেন? তাঁর বয়ান তো ঠাসাঠাসি ভরে থাকার কথা মুখ্যত ভয়ে, আতঙ্কে, কতকটা ক্ষোভে, আর অনেকখানি শিরা-ছেঁড়ার-যন্ত্রণায়! তেমনই তো দস্তুর!

২.

হ্যাঁ, দস্তুর তেমনই, এবং সেই কারণেই সুনন্দা সিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’ কিংবা মিহির সেনগুপ্ত’র ‘জালালি’ অভিবাসনের একটা বিকল্প আখ্যান প্রস্তাব করে। ‘জালালি’-র ক্ষেত্রে এই প্রথা ভাঙার কৌশলটা আরও চমকপ্রদ—এই আখ্যানে কথক ‘সাফারার’-এর পোশাক পরবেন না, বরং নিজে আখ্যানের পাত্র হয়েও ইতিহাসকে দেখতে চাইবেন সমালোচকের দৃষ্টিতে। স্মৃতির আলেখ্য নির্মাণ সংক্রান্ত একটা জরুরি সমস্যার কথা দিয়ে শুরু হয় ‘জালালি’। লেখক জানান—

“স্মৃতিচর্চাকারীরা খেয়াল করে থাকবেন, স্মৃতির অলিগলির আনাচে-কানাচেও অনেক কথা, অনেক ঘটনা ঘাপটি মেরে থাকে। রোমন্থনের বেলায় তারা সাধারণত মনের উপরিতলে উঠে আসে না... আমার এই বিস্মৃতি-কথার আলেখ্য শুরু করবো জালালিকে নিয়েই।”
‘বিস্মৃতি-কথা’? সেটা কি স্মৃতিকথার চেয়ে ভিন্নতর কিছু? না, তা ঠিক নয়। এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করে লেখক আসলে আমাদের সচেতন করে দিচ্ছেন, মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, স্মৃতিকথা মাত্রেই কতকটা ‘বিস্মৃতি’-রও কথা। যে স্মৃতি লিখিত হয়, ‘লিপিবদ্ধ’ হয়, তার পরিধি আদত স্মৃতির অনেকখানি ভুলে যেতে-যেতে, ছেঁটে ফেলতে-ফেলতে তৈরি হয়। ফলে, ‘জালালি’ উপন্যাসে মিহির সেনগুপ্ত একটা আশ্চর্য বাচনভঙ্গির আশ্রয় নেবেন। বারবার তিনি স্মরণ করিয়ে দেবেন, যা তিনি লিখছেন, তা খুব মনে রাখবার মতো ঘটনা নয় আসলে। তার অনেকটাই এখন বিস্মৃতির অতলে। নানান সূত্র থেকে, নানান ছেঁড়া-ছেঁড়া আপাত অসংলগ্ন ঘটনা জুড়তে-জুড়তে তিনি বানিয়ে তুলছেন এক পাগলির আখ্যান— যাকে মনে রাখবার খুব প্রয়োজন কখনোই ছিল না। ছিল না বলেই এ স্মৃতিকথা মুখ্যত নির্ভর করে অনুমান আর শোনা কথায়। কী উদ্দেশ্যে এই স্বীকারোক্তি? এমন আভাস দিয়ে, ‘জালালি’ কার্যত আর সাধারণ স্মৃতিকথা হয়ে থাকে না, বরং এই উপন্যাস পাঠকের মুখোমুখি হয় স্মৃতি সংক্রান্ত একটা সন্দর্ভ হিসেবে, যার উপজীব্য— ‘স্মৃতিকথা’-য় স্মৃতি আর বিস্মৃতির চলাচল।

৩.

এই দুটো লেখার সুত্র ধরে যে-কথা আসলে বলতে চাইছি, তা অনেকটা এরকম— অন্ধকার হাঁ-মুখে দাঁড়ায়নি এপার বাংলার ছেদের ‘লিপিবদ্ধ’ ইতিহাসে, রক্ত ছিটকে পড়েনি, বরং রক্ত পড়েছে চুঁইয়ে, অন্ধকার এসেছে অতর্কিতে, অনুভূতি-দেশ থেকে।

আপাত ভাবে এই বক্তব্য কতকটা অসংবেদনশীল মনে হবে হয়তো। কিন্তু ভেবে দেখা যাক, যদি ধরে নেওয়া হয় ‘পার্টিশন লিটরেচার’ নামে সাহিত্যে একটি জঁর আছে, তার যতটুকু এপার বাংলায় লেখা হয়েছে, ততটুকুর মধ্যে কোনো ‘শিয়া হাসিয়ে’ নেই কেন, কেন নেই ‘খোল দো’ বা ‘ঠান্ডা গোস্ত’ বা ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’! এমনকী, ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’-এর মতো বিপজ্জনক লেখাও বাংলাদেশেই জন্ম নিয়েছে। কেন? ‘দয়াময়ীর কথা’-য় তার একটা প্রত্যক্ষ কারণ নির্দেশ করা আছে। পুববাংলায় থেকে-যাওয়া যাদের কথা প্রাক-ষাটের থেকে সূচিত সত্তর দশকের মধ্যে উঠে আসছিলো খবরের কাগজে, যাদের প্রতিদিনের লড়াই তৈরি করছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস, আর সেই ইতিহাসে যাদের রক্ত ও অশ্রুর সাক্ষর— তাদের সাথে লেখিকার চির বিচ্ছেদ। মুখ্যত, এই বিচ্ছেদের সূত্রেই কথক লগ্ন হন তাঁর যাপিত শৈশবের সাথে, স্মৃতির সাথে। ফলে, স্মৃতির ভিতর এক মেদুর, আলতো, ছায়াঘেরা, সবুজ কল্প-দেশ তৈরি হয়। সেই দেশ ও দেশের যারা বাসিন্দা— তাদের অসময়ে ছেড়ে আসার গ্লানি স্তরে স্তরে জমতে থাকে সুখস্মৃতির নিচে। রণবীর সমাদ্দার তাঁর স্মৃতি ও ইতিহাস সংক্রান্ত একটি গবেষণা-সন্দর্ভে বলেছিলেন, দেশভাগের স্মৃতি অর্ধশতক পার করে এসে ছেড়ে আসা জন্মস্থান সম্পর্কে একরকম ‘রূপকথা’-রও জন্ম দিতে পারে। সম্ভবত, যে রূপকথার বিপরীতে থাকে ‘থেকে যাওয়া’-দের ইতিহাস। কেমন সে ইতিহাস? তার অনেকখানি পরিচয় আমরা পাই বাংলাদেশের ছোটগল্পে, উপন্যাসে। কিন্তু আপাতত আমরা অন্য একটি উপন্যাসের দিকে চোখ ফেরাতে চাইছি।

‘সুপুরি বনের সারি’ তার নাম, শঙ্খ ঘোষের লেখা। এ আখ্যানও একটি পরিবারের জন্মভিটে ছেড়ে আসার। কিন্তু এখানে সকলেই দেশ ছেড়ে আসেন না শেষ পর্যন্ত। ছোট্ট নীলু দেখে, সেই কবে নিজে হাতে লাগানো কিছু সুপুরি গাছের মায়ায় তার দাদু থেকে যান দেশেই, কিছুতেই ছেড়ে আসতে পারেন না একখণ্ড সেই সুপুরিবন। সুপুরিবন থেকে যায়, দাদু-দিদা থেকে যান, নীলু চলে আসে সুপুরিবনের স্নিগ্ধ, মেদুর স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে। আসার পথে সে প্রণাম জানায় দেশের মাটিকে, প্রণাম জানায় দৃষ্টির অন্তরালে চলে যেতে থাকা কাছারি ঘর, মণ্ডপ, দালানঘরকে। নৌকো থেকে দেখতে পায় বন্ধু হারুন রুমাল নাড়ছে। জানতে চাইছে, “কী রে, কথা কইস না ক্যান, আসবি তো?” লক্ষণীয় যে, সম্মতিসূচক কোনো উত্তর কিন্তু এখানে নীলুর মুখে জোগান না শঙ্খ ঘোষ। চেপে-রাখা যে একরাশ কান্না আর গ্লানি নিয়ে নীলুদের দেশ ছেড়ে আসা, তা হারুনের করুণ জিজ্ঞাসার কোনো ইতিবাচক উত্তর আদৌ তৈরি করে না। কেবল জলের কাছে একা-একা, ঘুরে-ঘুরে প্রতিধ্বনি তোলে পুকুরের পাশে স্থলপদ্ম, কাছারিঘর, মণ্ডপ, দাদু-দিদা, সুপুরিবন একসাথে— “কী রে, কথা কইস না ক্যান, আবার আসবি তো?” এই উপন্যাসের শেষাংশ এত বিস্তারে উল্লেখ করবার জরুরি কারণ আছে। খুব গভীর, দীর্ঘমেয়াদী, দগদগে কোনো ট্রমা বা আতঙ্কের স্মৃতি এপার বাংলার দেশভাগ এবং অভিবাসনের সাহিত্যে কখনোই উঠে আসেনি। মান্টোর মতো, খুশবন্ত সিং-এর মতো ইমেজের বীভৎসতা দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে দেওয়ার প্রকল্পও নেওয়া হয়নি সাহিত্যে। বরং বহু নিরুচ্চার কান্না আর বিষণ্ণতা নিয়ে, ঠিক নীলুর মতো-ই সে ফিরে তাকিয়েছে হারানো দেশের দিকে।

তাহলে কি পুববাংলা থেকে কাঁটাতার পেরোতে-পেরোতেই, পথে-পথে ছড়িয়ে রইল, গুম হয়ে গেল উৎপীড়িতের প্রকৃত বয়ান ও ভাষ্য, আর বাকিটা পড়ে রইল কাঁটাতারের ওপারেই? যে ভাষ্য উঠে আসবে কায়েস আহমেদের ছোটগল্পে, হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস ও প্রবন্ধে? আর এপার বাংলার জন্য বরাদ্দ থাকবে মুখ্যত মধ্যবিত্ত আত্মধিক্কারের করুণ, বিষণ্ণ অনুরণন? তার কোনো সঙ্গত কারণ কি লুকিয়ে আছে অভিবাসনের ইতিহাসের মধ্যেই?

৪.

সংক্ষেপে আরেকটি স্মৃতিকথার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আমরা কিছুক্ষণের জন্য চোখ ফেরাব ইতিহাসের দিকে। রাজা সরকার তাঁর স্মৃতিকথা ‘আঁতুড়ঘর’-এর শেষে, বইতে পরিশিষ্ট/উপসংহার জুড়ে দিয়ে খুব চমকপ্রদ একটা ব্যাপার ঘটিয়েছেন। স্মৃতিলগ্নতা থেকে কতকটা সরে এসে সেই পরিশিষ্টে দেখতে চাওয়া হয়েছে ইতিহাস-কে, বুঝতে চাওয়া হয়েছে সেই সময়ের বিক্ষুব্ধ ঘটনাস্রোতের কার্যকারণ সূত্রগুলো। সেই চার পৃষ্ঠার লেখাটি শুরু হয়েছে, সম্পূর্ণ ভাবে বাঙালির দেশভাগকেই বিষয় করে কোনো বড়ো মাপের উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আছে কিনা— এই জিজ্ঞাসা থেকে। মনে রাখতে হবে এই প্রশ্ন করছেন যিনি, দেশ ছেড়ে এসে তিনি অতিকষ্টে দিনযাপন করেছেন উদ্বাস্তু শিবিরে। এই প্রশ্ন থেকে আলোচনা শুরু করে আরও অনেক কথার ভিড়ে তিনি লিখবেন—

“বঙ্গভঙ্গের শতবর্ষে বাঙালি কিছুটা পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করেছে বটে, তবে তা বেদনার সমুদ্রে এক ঘটি সান্ত্বনার মতো। ঠিক এখান থেকেই আমার কিছু ধারণা তৈরি হতে লাগলো। যেমন— ১) বঙ্গভঙ্গ বা দেশভাগ মনে করা হয় বাঙালি বোধহয় মেনে নিয়েছিলো। যদি হয় তবে প্রশ্ন— এই বাঙালি কোন বাঙালি? এই বাঙালি কি মূলত সমাজপতি বাঙালি? এরাই কি রাজনীতির কর্ণধার ছিলেন? ভাগাভাগির সময়ে এঁরা কেউ কেউ সম্মতিসূচক মত দিয়েছেন। লক্ষ্য ছিলো নিজস্বার্থ। দেশভাগে এঁদের শুধু সম্পত্তি স্থানান্তরের জন্য সাময়িক আরামের ঘাটতি হয়েছে। আর কিছু নয়। এঁরা ধর্মে হিন্দু ও মুসলমান দুই-ই ছিলেন। তবে হিন্দুরা অনেকটাই বেশি ছিলেন সংখ্যায়। ২) বাংলাদেশ এক গ্রামমাতৃক অঞ্চলের ভূখণ্ড ছিলো অন্তত সেই সময়। ছিলো এক স্বয়ংসম্পূর্ণ সামন্ততান্ত্রিক গ্রামব্যবস্থা। বলাবাহুল্য, সমাজপতি সামন্তপ্রভুরাই ছিলেন গ্রামজীবনের সর্বেসর্বা, অভিভাবক। এখানে আর একটি লক্ষ্যণীয় ব্যাপার এই যে এইসব প্রভুরা ধর্মে ছিলেন হিন্দু। অর্থাৎ অবিভক্ত বাঙালি জাতির মধ্যে সংখ্যালঘু। যদিও এসব বিষয় তখনকার দিনে এত সংজ্ঞায়িত হয়ে ওঠেনি। এঁরা কিছু শিক্ষিত ছিলেন, রাজনীতির খবরাখবর রাখতেন, রাখতেন কলকাতা কানেকশন এবং একসময় অর্থাৎ তিরিশের দশকেই বুঝে যান যে আর এখানে নয়, সরে পড়তে হবে। আর সরেও পড়লেন। ধারাবাহিক ভাবে এই শ্রেণিটা সরে পড়ে তিরিশের দশক থেকে চল্লিশের দশকের শেষপর্যন্ত। ফলে ভেঙে পড়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামজীবন থেকে একটু একটু করে। তৈরি হতে থাকে দেশভাগের প্রেক্ষাপট। এর কারণ কি? প্রথমত মুসলিম লীগের উত্থান এবং ব্রিটিশ ভারতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের সুযোগে বাংলায় মুসলিম লীগের টানা প্রায় দশ বছরের বাংলা শাসন? হবেও বা। ৩) এই অভিভাবকহীনতা যেমন একদিকে, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে বর্ণবিভক্ত হিন্দুসমাজের নিজস্ব ক্ষত। সেই ক্ষত তার মধ্যে বিভেদ তৈরি করেছিলো তার গোড়াপত্তনের সময় থেকেই। যা তার আন্তঃসামাজিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিলো৷ এর সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় দৃষ্টান্ত হচ্ছে নিম্নবর্গের হিন্দুদের নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পাকিস্তান প্রস্তাবকে সমর্থন করে বসা।”

উদ্ধৃতি হয়তো-বা কিছু দীর্ঘ হলো, কিন্তু কথাগুলোও তো জরুরি! যে গ্লানির কথা বলে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম, দেশভাগ-পূর্ব পুববাংলার সমাজ-বাস্তবতা থেকে তারও কিছু পূর্বসূত্র কি নির্দেশ করে না এই উপসংহার? কিছু পরে আবার বলা হয়েছে ঐ লেখাতেই, কতকটা আলগোছে, দেশভাগের পর যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল পূর্ব বাংলার গ্রামীণ জীবনে— প্রাথমিক ভাবে তার কারণ সে সময় ‘শিক্ষিত’, ‘মধ্যবিত্ত’ (মুখ্যত উচ্চবর্ণ) হিন্দুদের দেশ ছেড়ে আসা। এবং এপার বাংলায় শিকড়-ছেঁড়ার স্মৃতিচর্চা বা রোমন্থনে খুব স্বাভাবিক ভাবেই মুখ্য তাঁদেরই ভাষ্য, তাঁদেরই বয়ান, এবং/অতএব তাঁদেরই অভিজ্ঞতা। সে অভিজ্ঞতায় নিশ্চিত আতঙ্ক আছে, ভয় আছে, নিরাপত্তাহীনতা ও অসহায়ত্ব আছে। আছে ছেচল্লিশে ভয়াবহ নোয়াখালি দাঙ্গার স্মৃতি ও কাহিনির অবিরাম ভার। কিন্তু, পাশাপাশি এ প্রশ্নও তোলা যায়, তারপরও প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো প্রত্যক্ষ দগদগে রক্তপাতের ট্রমা আছে কি এপার বাংলার দেশভাগের সাহিত্যে (এ কথা বলতে চাইছি না একেবারেই যে, বাংলাভাগের সাথে এ-ধরনের ট্রমার সম্বন্ধ বাকি ভারতবর্ষের তুলনায় লঘু, ন্যূন, খাটো। আমার আলোচনা, আগেই বলেছি, কেবল ‘লিপিবদ্ধ’ স্মৃতি নিয়ে)? প্রশ্ন যে আছে, থাকা সঙ্গত, তারই সমর্থন মিলবে কথকের ঐ গ্লানির ভিতর— যার কথা বারবার ফিরে আসছে, এবং আসবেও, এই লেখায়। যার সূত্রে উদ্ধৃত উপসংহারটি শেষ হয় একজন থেকে-যাওয়া-মানুষের প্রত্যয়ী উচ্চারণে, যে উচ্চারণে মিশে যায় সুপুরিবন আঁকড়ে থাকা অন্য এক বৃদ্ধেরও কন্ঠস্বর— “আরে যাইতাইন কই— মরলে এইহানেই মরবাইন— বাঁচলে এইহানেই— সময় অইলে আফনে যাইবাইন শ্মশানে, আমি যাইয়াম কবরে।”

৫.

স্মৃতিকথা থেকে এবার একটু চোখ ফেরানো যাক ইতিহাসের দিকে। যদিও স্মৃতিকথার আলোচনায় অকস্মাৎ নথিপত্রের হিসেব-নিকেশ নিয়ে তরজা বেমানান ঠেকে অনেক সময়, তবু ‘স্মৃতি’ আর ‘ইতিহাস’ একুশ শতকের ভারতবর্ষে যখন পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়ায় ক্ষোভে, অসন্তোষে, যেন বহুদিনের বৈরিতা তাদের— তখন এটুকু ধৈর্য আমাদের রাখতে হবে। নইলে অনেক বড়ো প্রতারণার স্বীকার হয়েও আমাদের আর্তরব প্রতিবিধানের কোনো স্থায়ী গন্তব্য পাবে না।

কথা হলো, দেশভাগ এবং ক্ষমতা হস্তান্তর যখন ঘটমান বর্তমান, দেশের সরকার বাহাদুরের তরফে ভাবা হয়েছিল, বড়ো আকারের অভিবাসনের সম্ভাবনা রয়েছে কেবল পাঞ্জাব প্রভিন্সের ক্ষেত্রে। পুনর্বাসনের ব্যবস্থাপত্র যতটুকু গৃহীত হয়েছিল, তা তাই সমগ্র দেশের কথা প্রথম থেকেই বিবেচনা করেনি। ধরা যাক দিল্লীর কথা, সেখানে অসংখ্য মুসলিম পরিবারকে নিরাপত্তার খাতিরে নিজেদের ঘর থেকে সরিয়ে এনে উদ্বাস্তু শিবিরে রাখা হয়। নিজের পরিবার থেকে বাধ্যত অনেক মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে এ সময় পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হন। আর যাঁরা চাকরিজীবী তাঁদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি অস্থায়ী চুক্তিপত্র— যার সাহায্যে তাঁরা কাঁটাতার পারাপার করে যোগাযোগ রাখতে পারবেন দূরে চলে যাওয়া পরিবার-পরিজনের সাথে। কিন্তু পরিহাস, এই পরিবারগুলিকে সুরক্ষা দিতে প্রতিশ্রুত হয়ে এবং সাময়িক নিরাপত্তার জন্য উদ্বাস্তু শিবিরে পাঠিয়ে ‘দ্য ইভাক্যুই প্রপার্টি অ্যাক্ট’ (১৯৫০)-এর আওতায় নিয়ে আসা হয় তাঁদের শূন্য ঘরদুয়ার। পুনর্বাসন তাতে কদ্দূর কী হয়েছে খোদাই জানেন, কিন্তু নিজের দেশে চিরতরে ভিটেছাড়া হয়ে যান অসংখ্য মানুষ। অতএব, মনে রাখা দরকার, দেশভাগকে উপলক্ষ করে যে বিপুল হিংসার আয়োজন, তাতে ধুনো দিতে রাষ্ট্রযন্ত্র আদৌ কার্পণ্য করেনি। ‘সি আই ডি পারমিট ইনভেস্টিগেশন্স’-এর নথিতে চাইলেই খুঁজে পাওয়া যাবে এই চালচিত্র— কীভাবে পাকিস্তানে অভিবাসী পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখতেন ভারতে থেকে যাওয়া সেই পরিবারের বাকি সদস্যেরা। অথবা, আমাদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে শ্যাম বেনেগালের ‘মাম্মো’ ছবির কথা— যেখানে পাকিস্তান থেকে ভারতে নিজের পরিবারের কাছে এসে থাকার জন্য মেহমুদা বেগমকে রাষ্ট্রের চোখে ‘মৃত’ হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। ভারি চমৎকার শ্যাম বেনেগালের চাবুক, রাষ্ট্র আর যাই পারুক— মৃতব্যক্তিকে ‘ইললিগ্যাল ইমিগ্র্যান্ট’ (রাষ্ট্রের ঠিক এই অভিযোগ ছিল মেহমুদা বেগম সম্পর্কে) বলে দেশছাড়া করতে তো পারে না সে!

বাংলার ক্ষেত্রে দেখা যাবে, দেশভাগের পর পূর্ব থেকে পশ্চিমে এসে যাঁদের থাকতে হয়েছে রিফিউজি ক্যাম্পে, স্থায়ী ঠিকানার খোঁজে যাঁরা বিনিদ্র রাত্রিযাপন করেছেন ক্রনিক দুঃস্বপ্নের ভিতর, তাঁদের বৃহত্তর অংশটা দরিদ্র, ভূমিহীন কৃষি-শ্রমিক। পুনর্বাসনের সুস্থ ব্যবস্থা বা উদ্যোগের নামগন্ধ ছিল না বাংলার ক্ষেত্রেও, এ তো জানা কথা-ই। তাঁদের নিভৃত রক্তপাত আর গোপন শুশ্রূষার কোনো দীর্ঘ, অনুপুঙ্খ স্মৃতি-বিবরণ কিন্তু উঠে আসেনি এপার বাংলার দেশভাগের সাহিত্যে (ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে)। যদি উঠে আসতো তা, হয়তো আরও চিৎকৃত কোনো স্বরে, আরও বিপন্ন কোনো ভাষায় লেখা হতো সেই সমস্ত স্মৃতি-বিবরণ, কে বলতে পারে! এ কথাই হয়তো বলতে চেয়েছিলেন রাজা সরকার তাঁর বই-এর শেষে। এ ছাড়া, পঞ্চাশে ‘ইউনাইটেড সেন্ট্রাল রিফিউজি কাউন্সিল’-এর জন্মের ইতিহাস, এপার বাংলার কোথাও-কোথাও জমি ধরে-ধরে হিন্দু-বিজয়ের ইতিহাস, নিজেদের আবাসস্থল থেকে উৎখাত হয়ে দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর ‘ঘেটোয়াইজেশন’ এবং প্রান্তে সরে যেতে থাকার ইতিহাস এবং রাষ্ট্রের ‘অপর’ নির্মাণের রাজনীতি এ লেখায় অনালোচিত থাক।

৬.

কেবল একটি আক্ষেপ এ লেখার শেষে আলগোছে ছুঁয়ে যাই, পশ্চিম থেকে যাঁরা বাধ্যত চলে গেলেন পূর্বে— আমাদের অবসন্ন অনুভূতি-দেশে তাঁদের যন্ত্রণা খুব গভীর কোনো ছাপ ফেলে যায়নি। রুগ্ন, ক্লিষ্ট সুপুরিবনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে তাঁদের অলিখিত চিৎকারের ভাষা। সে ভাষার বর্ণমালা কিছুটা অবশ্য সাজিয়েছেন রাহুল রায় ‘পশ্চিম থেকে পূর্ববঙ্গ দেশবদলের স্মৃতি’ বইতে। স্বস্তির কথা এই যে, মিহির সেনগুপ্ত, সুনন্দা সিকদার কিংবা রাজা সরকারের মতো অনেকের স্মৃতির আলেখ্যেই সেকালের ইতিহাসের গোপন ক্ষত ও চোরাস্রোতগুলো নির্দেশিত হয়, ভাবী সময়কে আস্কারা দেয় চোখ মেলতে, নতুন করে ভাবতে।


ঋণস্বীকার :


১. সুপুরিবনের সারি— শঙ্খ ঘোষ

২. দয়াময়ীর কথা— সুনন্দা সিকদার

৩. জালালি— মিহির সেনগুপ্ত

৪. আঁতুড়ঘর— রাজা সরকার

৫. The Long Partition and the Making of Modern South Asia— Vazira Fazila-Yacoobali Zamindar

৬. The Great Partition: The making of India and Pakistan— Yasmin Khan

৭. The Spoils of Partition: Bengal and India, 1947-1967— Joya Chatterji



(পরবাস-৭২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)