ঘটনাটা ১৯৫২ সালের। মানুষের মুখে-মুখে চাউর হয়ে গেছে পরদিন থেকে নাকি দুই বাংলার মধ্যে চালু হয়ে যাবে পাসপোর্ট। তাই বহু মানুষ চান সেদিন রাতেই ভারত-(পূর্ব) পাকিস্তানের বর্ডার পেরিয়ে পাকাপাকিভাবে চলে আসতে পশ্চিমবঙ্গে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বারবার ঘর পুড়েছে যাদের, তারা আর ভরসা রাখতে পারছিলেন না চালু হতে যাওয়া কাগজপত্রের সাদা-কালোয়। সন্ধে ছটায় পূর্ব পাকিস্তানের গোয়ালন্দ স্টেশন থেকে ছাড়ার কথা ঢাকা মেলের। এই গোয়ালন্দের সঙ্গে পুববাংলার মানুষের স্মৃতিমথিত করা সেই গোয়ালন্দ আর তার ইলিশ মাছ-ভাতের হোটেলের চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটে গেছে ততদিনে। সেদিন সন্ধ্যায় চারদিকে ধু ধু বালুচর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোয়ালন্দ স্টেশন। ইতিউতি ভাঙাচোরা হোটেলের কাঠামো। হাজার হাজার উদ্বাস্তু মানুষের জন্য বরাদ্দ মাত্র একটি দশ বগির ট্রেন, তার মধ্যে আবার দুটো রিজার্ভড কামরা আর আনসার বাহিনীর দখলে দুটো। বাদবাকি ছটা কামরায় গাদাগাদি আর ঠেসাঠেসি করে ‘যমালয়ের পাশের বাড়ি’, ভারতীয় ভূখণ্ডের বানপুরে আসতে চায় কয়েক হাজার অমৃতের পুত্র-কন্যা। সেই ট্রেনে বছর আঠারোর সত্যেন্দ্রপ্রসাদ বিশ্বাসকে তুলে দিয়ে তাঁর এক পিতৃব্য জরুরি উপদেশ দিয়ে যান— ‘বাঁচতে হলে পালিয়ে যা, রাত ভোর হলেই আমরা মরব।’ ঘণ্টাখানেক চলার পর স্টিম ইঞ্জিন এসে থামে রাজবাড়ি স্টেশনে। সেখানে কামরার দরজা খোলার কোনো প্রশ্নই নেই। ওই পরিস্থিতিতে কে আর ভাবতে চায় রাজবাড়ি স্টেশনে সমান উৎকণ্ঠায় অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলোর কথা! তবু শিকভাঙা জানলা দিয়ে একটি মেয়েকে কারা যেন ছুঁড়ে দেয়। বুকের কাছে পুঁটলি নিয়ে মেয়েটি বসল সত্যেন্দ্রপ্রসাদের পাশেই। পরের স্টেশন কুষ্ঠিয়া কোর্টে আনসার বাহিনীর মাতব্বররা গলায় সবুজ রুমাল বেঁধে সাদা কাগজে যাত্রীদের নামধাম লিখতে শুরু করলে সত্যেন্দ্রপ্রসাদ জানতে পারলেন পুঁটলি-হাতে মেয়েটির নাম নমি, নমিতা দাস, বাড়ি কোটালি পাড়ায়। ট্রেন আবার চলতে শুরু করলে নমি সত্যেন্দ্রকে অনুরোধ জানিয়ে রাখে তাকে যদি তিনি পৌঁছে দেন রানাঘাটের ক্যাম্পে। সেখানে তার গ্রামের লোক আছে এমনই শুনে ঘর ছেড়েছে সে। এরপর চুয়াডাঙা স্টেশনে কামরায় এল বুকে সবুজ চাঁদ-তারা আঁকা নতুন একদল আনসার। তাদের আঙুলের ফাঁকের পাসিং শো থেকে উড়ছে জ্বলন্ত ছাই, চোখে তাদের উদগ্র বাসনার আগুন। তাদের ধূর্ত নজর যে নমিতার শরীরে তা বুঝতে কষ্ট হয় না সত্যেন্দ্রের। গভীর রাতে ট্রেন এসে দাঁড়ায় পাকিস্তানের শেষ স্টেশন দর্শনায়। সত্যেন্দ্রপ্রসাদ লিখছেন:
"কামরায় চূড়ান্ত হল্লা। কাস্টমস ঢুকেছে। তাকিয়ে দেখি নমি নেই। যাত্রীদের চোখেমুখে আতঙ্ক। কাছের লোককে জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটি কোথায় গেল? যাত্রীটি বললেন ‘বডি সার্চ হবে, আনসাররা নিয়ে গেছে।’ গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকালাম। কোথাও নমি নেই। যথাসময় কাস্টমস নেমে গেল। হাতে তাদের মুঠো মুঠো টাকা, গয়না। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। শত্রু সম্পত্তি।বাঙালির সামূহিক স্মৃতিভাণ্ডারে এমন ভাবেই সঞ্চিত আছে সীমান্ত তথা বর্ডারের কথা। দেশভাগ ও র্যাডক্লিফের অবিবেচক রেখা যখন ছিন্নভিন্ন করে দেয় একটি জাতির অন্তত হাজার বছরের ঐতিহ্যের শিকড় তখন তার অভিঘাত সুদূরপ্রসারী হবেই। বিশেষ করে হিন্দু বাঙালি তখন প্রায় নতুন ইহুদির ভূমিকায়। ভিটেমাটি ছেড়ে সবাই পালিয়ে আসতে চায়। সত্যেন্দ্রপ্রসাদ এই ঘটনার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে (‘মুক্ত সীমান্তের শেষ রাত’) যাকে বলেছেন ‘যমালয়ের পাশের বাড়ি’ চলে আসা। সদ্য বিভাজিত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাদের ছিন্নমূল করেছে, যাদের বলা যেতে পারে দেশভাগের প্রত্যক্ষ বলি, তাঁদের মানসিক স্থানাঙ্ক সত্যেন্দ্রপ্রসাদের সঙ্গে হুবহু মেলে। সম্পত্তি বাঁচানো আর নারীর ইজ্জত রক্ষা এই দুই চিন্তাই তখন ভারাক্রান্ত করেছে সেসময়ের হিন্দু বাঙালিকে।গাড়ি ছাড়ল দু ঘণ্টা পর।
খুব আস্তে আস্তে। নমি এল না। জানালা দিয়ে তখনও তাকিয়ে আছি। নমি আসবে। গাড়ি তখনও প্ল্যাটফর্ম ছাড়েনি। হঠাৎ দেখি, সবুজ রুমালের কয়েকটি যুবক একটি মেয়েকে বাইরে এনে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে রাখল। ছিন্নভিন্ন পোশাক, জায়গায় জায়গায় রক্তের দাগ। চিনতে দেরি হল না। এতো নমি। কাঁপা কাঁপা হাত তুলে কী যেন বলতে চাইছে। নামতে চেষ্টা করিনি। মরতে বড়ো ভয় হল। নির্মম আত্মপ্রেম।
বন্দে মাতরম্। হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ।
বানপুর স্টেশনে গাড়ি এল। ...
ভোর হল।
হিন্দুস্থানের আকাশে মেঘভাঙা আলো উঁকি দিল। আধো-অন্ধকারে দর্শনার প্ল্যাটফর্মে শুয়ে রইল ঠিকানাহীন নমি। কোটালিপাড়ার নমিতা দাস। আমি তখন সীমান্তের এপারে।"
জয়ন্তী বসু তাঁর ‘রিকনস্ট্রাক্টিং দ্য বেঙ্গল পার্টিশন’ বইয়ে দেশভাগের বলি মানুষজনের সাক্ষাৎকারের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে হিন্দু বাঙালির এই ট্রমাকে চিহ্নিত করতে গিয়ে যে কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন তার মধ্যে গুরুত্ব পেয়েছে ‘দ্য ফেসলেস এনিমি’ বিষয়টি। ছেচল্লিশ ও পঞ্চাশের দাঙ্গা ছাড়াও স্থানীয় স্তরে চোরাগোপ্তা সাম্প্রদায়িক হিংসা এক অভূতপূর্ব সঙ্কটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের। অবিশ্বাস ক্রমশ ভীতিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। তাই মানুষ চেয়েছে যেনতেন প্রকারে চার হাজার ছিয়ানব্বই কিলোমিটার দীর্ঘ, পৃথিবীর এই পঞ্চম বৃহত্তম স্থল-সীমান্তের যে-কোনো একটা ছিদ্র গলে এপারে চলে আসতে । স্বাধীনতার পর প্রথম বছরে আসেন ১০ লক্ষ মানুষ, ১৯৫১ পর্যন্ত সরকারি হিসেবে সংখ্যাটা ৩৫ লক্ষ। ‘দেশভাগ দেশত্যাগ’ বইতে সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন ১৯৫১ সালের ৯-১০ এপ্রিলের কথা। একদিকে নেহরু চুক্তি করছেন লিয়াকত আলির সঙ্গে, অন্যদিকে মানুষ একইরকম প্রাণভয়ে পালিয়ে আসছে ভারতে। যদিও বর্ডার পেরিয়ে এপারে আসা তখনও এক ভয়াবহ ব্যাপার। আনন্দবাজার পত্রিকায় রাজলক্ষ্মী-মালতীরা সীমান্তে আনসার বাহিনীর হাতে নিজেদের লাঞ্ছনার বিবরণ দিয়েছেন—
"আমরা সীমান্ত পার হইব এমন সময় চারিজন লোক আসিয়া আমাদিগকে নানারূপ প্রশ্ন করে এবং তাহাদের সহিত যাইতে বাধ্য করে। আমাদের নিকট যাহা কিছু ছিল তাহাদিগকে দিয়া দিতে বলে। তাহাদিগকে আমরা দশ টাকা দিই। কিন্তু তাহারা আমাদের জামাকাপড় খুলিয়া ফেলিতে বলে। জোর করিয়াই তাহারা আমাদের পরিধেয় খসাইয়া ফেলে। তারপর তাহারা আমাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করে।"
ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার বাংলার এক বড়ো অংশের মানুষের কাছে তীব্র আবেগবাহী বিচ্ছেদরেখা। জয়ন্তী বসু যে অবয়বহীন ভয়ের কথা বলেছিলেন তার মূর্ত প্রতীক এই সীমান্ত। দুই বাংলার চিরায়ত আদানপ্রদানের বধ্যভূমি। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সুদূর ইউরোপের মানুষ সিরিল র্যাডক্লিফ আর এই ভূখণ্ডের কিছু রাজনীতিকের অবিবেচনায় তৈরি হওয়া এক আরূঢ় উৎপাত। অবশ্য গঙ্গা-পদ্মায় যত জল গড়িয়েছে ক্রমেই বদলাতে থেকেছে এই আবেগ। স্বাধীনতার পরে-পরেই সীমান্তে যে ভয়াবহতা তা ক্রমশ দালাল-ফড়েদের একচেটিয়া কারবারের জায়গা হয়ে ওঠে। বিড়ম্বিত মানুষ সর্বস্ব বিক্রি করে সামান্য যেটুকু পুঁজি সম্বল তার বড়ো অংশ এদের হাতে তুলে দিয়েই চলে আসতে চায় ভারতে।
১৯৬৪ সালের এক সকালে যেমন জন্মের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতের দিকে রওনা হন রাজা সরকার। রাজার বয়স তখন মাত্র এগারো বছর। তাঁর অনবদ্য আত্মকথা ‘আঁতুড়ঘর’-এ তিনি শুনিয়েছেন সেদিনের কথা। গ্রামের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নেত্রকোণা স্টেশন হয়ে এক আত্মীয়ের বাড়ি দিন তিনেক থেকে সুসংগ দুর্গাপুরের দিক দিয়ে মেজদা আর ঠাকুমার সঙ্গে তাঁদের বর্ডার পেরোনোর কথা। কাজটা খুব সহজ ছিল না। রাস্তার দুর্গমতার কথা বাদ দিলেও ওই থানার আনসাররা ছিল কুখ্যাত। সুতরাং যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সেই যাত্রা। তবে দালালরা টাকা পেলে কথাও রাখে। রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে এক অদ্ভুত নৈতিকতা তো দুনিয়া জুড়েই অপরাধপ্রবণ জায়গায় সুলভে মেলে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় না। অন্ধকারের মধ্যে দুই ভাই তাদের পিতামহীকে নিয়ে হেঁটে চলেছে অজানা রাস্তায়। সামনে কী অপেক্ষা করে আছে জানা নেই কারো। তবে টাকা কথা রাখে। এখানেও মাটি ফুঁড়ে বর্ডার পার করিয়ে দেবার দালাল ঠিকই উপস্থিত হয়। তারপর তিনজনকে পথের পাশেই এক অন্ধকার ঘরে রেখে শিকল তুলে দিয়ে সে চলে যায়। জানিয়ে দেয় ঠিক রাত বারোটায় সে আবার এসে হাজির হবে। সত্যিই রাত বারোটার পর পুনরায় শুরু হল হাঁটা। সঙ্গী হল দালালচক্রের তিন যুবক। শুনশান গ্রাম, ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, ঘুমন্ত মানুষের কাশির শব্দ, শিশুর হঠাৎ কেঁদে ওঠা শুনতে শুনতে চলা। মাঝে মাঝে ফসলের খেত, মাঝে মাঝে গ্রাম। মনে একটাই আশা দিনেরবেলায় দেখা গারো পাহাড় নিশ্চয় খুব বেশি দূর হবে না। তাই পুলিশ আর পুলিশ-কুকুরের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ক্রমে এগিয়ে যাওয়া বর্ডারের দিকে:
"খুব ফিকে হয়ে আসছিলো চাঁদের আলো। তার মধ্যেই আমরা আল বেয়ে একটা শস্যপ্রান্তর অতিক্রম করছি। সামনে দিকে তাকানোর ফুরসৎ হয়নি এতক্ষণ। এখন হঠাৎই মনে হলো সামনে আকাশ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার পাহাড়। এটাই গারো পাহাড়। তার পাদদেশে এতক্ষণ পর আমরা এসে দাঁড়িয়েছি। সবাই একটা জায়গায় এসে থেমেছি। সঙ্গের তিনজন যুবক এতক্ষণ পর কথা বলল। একজন বলল— ‘আফনেরা আইয়া পরছেন— এই যে পিলারটা দেখতাছেন এইডার ঐ পাড়ডা পাকিস্তান আর এই পাড়ডা হিন্দুস্তান। আমরা অহন হিন্দুস্তানে দাড়ায়াছি। আমরার কাম শ্যাষ।’ একটু তফাতে মেজদা অন্য দুইজনের সংগে কথাবার্তা বলছিল। একসময় ঠিক হলো যে ওরা আমাদের আরো কিছুটা এগিয়ে দেবে। কারণ এখান থেকে পাহাড়ের পথ শুরু হবে। তারা আমাদের সেই পথটা ধরিয়ে দেবে। ...হয়তো কথকের বয়সের কারণে সীমান্ত পার হওয়ার সময়টা নিয়ে সেই অর্থে কোনো আবেগ এই বিবরণে নেই। তাঁর পিতামহীকেও খুব আবেগপ্রবণ হতে দেখি না। মূল কারণ মনে হয় সেই ভীতি, যা তাদের ছিন্নমূল করেছে।... ইতিমধ্যে সীমানা পার হয়ে যাওয়াতে পুলিশ আনসারের ভয়টাও আর নেই। একসময় আবার আমরা থামলাম। তিন যুবক আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিল।
বলল যে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তারা আর এগোতে পারছে না। কারণ তাদের আবার পাকিস্তান অংশে ফিরতে হবে। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাদের নির্দিষ্ট আশ্রয়ে পৌঁছুতে হবে না হলে তাদেরও বিপদ।"
সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মূলত ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ ও তার পরবর্তী সময়ে এই উপমহাদেশে যে কুৎসিত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা চলেছে তার উদাহরণ সমগ্র দুনিয়াতেই মেলা ভার। আর সাধারণ মানুষ সেই রাজনীতির দাপটে ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে। যেমন রাজা সরকারের পরিবার। ছিন্নভিন্ন স্বদেশ আর বিছিন্ন পরিবার এক প্রজন্মের বাঙালির কাছে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল।
রাজা সরকার তাঁর ‘আঁতুড়ঘর’-এই প্রথমবার সীমান্ত পেরোনোর দুদশক বাদে আবার সীমান্ত পেরোনোর কথা লিখেছেন। ততদিনে লেখকও যথেষ্ট মধ্যবিত্ত প্রতিবেশ গড়ে ফেলেছেন নিজের চারপাশে। ছিন্নমূলের সীমান্ত পেরিয়ে এসে নতুন জায়গায় থিতু হতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় নয়, নস্ট্যালজিয়া নামক মধ্যবিত্ততোষ আবেগে ভরপুর লেখক দেখতে যান বাংলাদেশ ও তাঁর ফেলে আসা জনপদ। শিয়ালদহ থেকে বনগাঁ লোকাল ধরে বনগাঁ স্টেশন, সেখান থেকে অটো রিক্সায় পেট্রাপোল বর্ডার। এবার কিন্তু সঙ্গে আছে বৈধ পাসপোর্ট আর দশ দিনের ভিসা। রাজা লিখছেন—
"বর্ডার অফিস খোলার পর আমরাই প্রথম। নির্বিঘ্নেই অফিসের সব কাজ হয়ে গেল। ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে প্রথমে পড়ে নো ম্যানস ল্যান্ড। ওখানে আমরা কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে কমিনিট দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর দুজন দুজনকে সেই আবেগে প্রায় জড়িয়ে ধরলাম। তারপর ধীরে ধীরে বাংলাদেশে প্রবেশ।"এরপরের ঘটনা সেই চিরাচরিত বিএসএফ-বিডিআরের টানা হেঁচড়া। বিএসএফ ব্যাগপত্তর ঘাঁটাঘাঁটি করে ছেড়ে দিলেও বিডিআর-এর হাত থেকে দশ-দশ কুড়ি টাকার বিনিময়েই বৈধ পাসপোর্ট ফিরে পেতে হল। কিন্তু অবাক করে দেবার মতো ঘটনাটা ঘটে বাংলাদেশের দিকে ঢুকে। প্রতিষেধক টিকাকরণ কেন্দ্রে। সেখানে বসে থাকা যশুরে টানে কথা বলা কর্মী জানালেন—
"... নিয়ম অনুযায়ী আমাদেরকে দুটো করে ইনজেকশান নিতে হবে। কিন্তু যেহেতু আমাদের দেখে ওনার ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে তাই উনি সেটা দিতে চান না। কারণ পাশের টেবিলে রাখা একটা অপরিচ্ছন্ন ট্রেতে দু-খানা সিরিঞ্জ খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। আর ওতে ইনজেকশান নিলে নাকি ধনুষ্টঙ্কার অনিবার্য। তা অবশ্য আমরাও বুঝতে পারছিলাম।... তখনই তিনি মোক্ষম চালটা দিলেন। বললেন যে সাধারণত জনপ্রতি পঞ্চাশ করেই নিই, তবে আপনারা যেহেতু আমাদের মেহমান, জীবনে একবার আধবারই আসবেন, তাই কুড়ি কুড়ি চল্লিশ টাকা বা দুইখান ডলার দিলেও হবে। কথাটা শুনে আমরা অবাক। প্রায় চোখে জল আসার উপক্রম। কিন্তু উপায় নেই। কোনোমতে অনুনয়বিনয় করে আবার দশ দশ কুড়ি টাকা দিয়ে আমরা মুক্তি পেলাম। ঘুষের টাকাটা সবসময় ভারতীয় টাকাতেই দিতে হলো।"লেখক এর পর মন্তব্য করেছেন-- ‘পরে শুনেছি পৃথিবীর অনেক দেশেই নাকি স্থলপথের সীমানা অতিক্রমের কাহিনী প্রায় এক।’ সহজেই লক্ষ করা যায় বর্ডার নিয়ে লেখকের আবেগ ক্রমশ কেমন বদলে যাচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার দেশভাগের অর্ধশতাব্দী পেরোনোর আগেই হয়ে উঠেছে নেহাতই এক আন্তর্জাতিক সীমান্ত, চোরাচালান আর হরেক বেআইনি কাজকর্মের গর্ভগৃহ, যার দুপারের দুই রক্ষীদল সমানতালে দুর্নীতিরও পাহারাদার। বাঙালির চোখের কোণের অশ্রুরেখা যত শুকিয়ে এসেছে, ততই সীমান্ত নিয়ে আবেগ অন্তর্হিত হয়েছে।
বর্ডার এলাকার বাস্তব প্রতিচিত্রণ, অর্থাৎ এর দিনরাত্রির ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ দেখা যায় আবুল বাশারের ‘ভোরের প্রসূতি’ উপন্যাসে। সেখানে সীমান্তের যে টোপোগ্রাফিক বিবরণ দিয়েছেন লেখক তাও বেশ অভিনব:
"ভি-পয়েন্ট। ইংরাজীর ভি। ভিয়ের বাহু দু’খানি মৃত্যুর মতো প্রসারিত। সীমান্ত রেখা ভিয়ের মত কাল্পনিক ঢেউ খেলানো। সরল রেখা নয়। কতক গুলি স্তম্ভ খাড়া করা আছে। দেখতে সেগুলিও ভি-এর মত সরলরেখায় দাঁড়িয়ে নেই। এমন ভাবে পোঁতা হয়েছে যে মনে মনে রেখা টানলে রেখার আকৃতি হয় ভি-এর মত। দুই বাহু যেখানে মিলিত হয়, সেটির মূলটুকুকে পয়েন্ট ধরা হয় নাম ভি-পয়েন্ট ক্ষেত্রটির নাম ভি-পকেট। সেই পয়েন্টে দাঁড়ালে এক পা ভারতে, অন্য পা বাংলাদেশে ফেলে দাঁড়ানো যায়। শুয়ে পড়লে ধরের অর্ধেক বাংলাদেশে অর্ধেক ভারতে ফেলা যায়।"সেখানকার অর্থনীতির প্রায় সবটাই চোরাচালানকেন্দ্রিক। উপন্যাসে সিতারা আর জীবন ব্যাপারীর কথা আছে। জীবন আপাদমস্তক ব্যাপারী। সব কিছুই বেচতে পারে সে। সিতারাকে সেই নিয়ে এসেছিল, বলা ভালো নামিয়েছিল ফরিয়াদির চরে। মাল টানার জন্য, ভদ্রজনোচিত ভাষায় যাকে বলে চোরা চালান। সিতারা এখানে এসে নিজের জীবনটাকে তিলে তিলে শেষ হতে দেখে, আর শেখে নানান ইঙ্গিতময় ভাষা—
"বুঁদি। বুঁদির আলো উঠছে নামছে। ওপারের দু-নম্বরীরা এপারের দু-নম্বরীদের সংকেত পাঠাচ্ছে। ঘাট বন্ধ নাকি ঘাট খোলা। পার্টি পারাপারে নৌকা ভাসাবে নাকি ভাসাবে না। রাজনীতির পার্টি নয়। এ হচ্ছে এল পি জি পি। লেডিজ প্যান্ট জেন্টস প্যান্ট। অর্থাৎ বাংলাদেশ হয়ে আসা কাপড়। চোরা কাপড়।"সেই চরে যারা আসে সবাই কমবেশি ফেরারি, তাড়া খাওয়া। হয়তো আইয়ুবশাহী জমানায় খুন করে এপারে এসেছে, মুজিবের সময় ফিরে গেল। নয়তো মুজিবের সময়কার ফেরারি এরশাদের আমলে ফিরে গেল। চোরা চালানের এই জগৎ জুড়ে নানা চোরা স্রোত আর বেইমানির গল্প। পরিবেশের কারণেই মানবিক মূল্যবোধগুলিও বুঝি পরিবর্তিত। কী নেই সেখানে, সাইকেল চুরির জন্য পিটিয়ে খুন থেকে শুরু করে প্রকাশ্য দিবালোকে সপ্তাহে দুবারের এল পি হাট। সেখানে পুলিশ আছে, টোল গেট আছে, পুলিশের ‘মিট’ খাওয়াও আছে। সেটা থানায় বা ফাঁড়িতে। পথের পুলিশের আছে ডেলি পেমেন্ট। মান্থলি বা উইকলি নয় রাস্তায় নগদ টাকারই চল। আবার এল পি বাজার শুধু একপেশে নয়। তাতে গঞ্জের তামাম বৈশিষ্ট্যই অটুট। ইসকুল-স্বাস্থ্যকেন্দ্র-গ্রামীণব্যাঙ্ক-কাঠ চেরাই কল-মুদিখানা-মাড়োয়ারির গদি থেকে শুরু করে সিফিলিস-গনোরিয়া-নারীর অবৈধ গর্ভপাতের জন্য বিশেষ হাতুড়ে ডাক্তারও আছে। সেইসঙ্গে লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন চোরাচালানের জগতের অদ্ভুত ধর্মীয় সাম্যবাদের কথা। মহাজন মুসলমান হলেও সেখানে অর্ধেক খদ্দেরই হিন্দু। আবার কৃষ্ণনগরের হিন্দু এল পি-রা জুতোপরা, হাতে ঘড়ি, পরিষ্কার শাড়িপরা। কিন্তু বেলডাঙার মুসলমান এল পি-দের অবস্থা একেবারেই করুণ। রাষ্ট্রযন্ত্র আর তার হতদরিদ্র নাগরিকের এই নিদারুণ বেঁচে থাকার খেলার গল্পে আবুল বাশার তাঁর আখ্যান নিয়ে ক্রমেই মানব চরিত্রের গহন সন্ধানী হয়েছেন কিন্তু তার কাহিনির বহিরঙ্গ নির্মিত হয়েছে ব্যাপারী-মহাজন-মাল টানা মানুষদের নিয়ে। আর বর্ডার যেন তার চালচিত্র। অন্য কোনো জায়গার প্রেক্ষাপটে যেন এই চরিত্রগুলোকেই অবাস্তব মনে হত।
‘লোকসকল’-এর মতো অসামান্য গল্পগ্রন্থের প্রণেতা বাংলাদেশের মোস্তাফা পান্নার ‘ওপার’ গল্পের বিষয় সীমান্ত দিয়ে বেআইনি ভাবে মানুষ পারাপার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে বসবাসকারী হিন্দু মানুষজনের পারাপারই গল্পের বিষয়। গল্পে অবিনাশ আর শামসের মোল্লা বাংলাদেশে পিসির বাড়ি বেড়াতে যায়। আসলে আত্মীয়তা, সামাজিকতার মোড়কে অবিনাশ বেআইনি ভাবে মানুষ পাচার করে। এই ‘ধুর’ এনে ভারতে পাঠানোর খেলায় জড়িয়ে আছে এক বিশাল নেটওয়ার্ক। নিরীহ মানুষ সেই জালে বাঁধা পড়ে ছটফট করে মরে। ‘ওপার’ গল্পের শুরুতে অবিনাশ আর শামসের কেবল মানুষের আস্থা অর্জন করে গেছে। সেসময় আবিনাশ দেশত্যাগ করে ভারতে আসা পরিবারের মধ্যে যারা পুনর্বার জীবনযুদ্ধে জয়ী তাদের ভূমিকায় অভিনয় করে চলে। জানায় আংড়াইল বাজারে তাদের বিরাট মুদি ব্যবসা আর কৃষিজমির কথা। শামসের না কি সিপিএম নেতা, বনগাঁ জেলা কমিটির সহ-সভাপতি (তথ্যের খাতিরে বলে রাখা ভালো সিপিআইএম নামক রাজনৈতিক দলটিতে বনগাঁ জেলা কমিটির অস্তিত্ব থাকার কথা নয়, কারণ বনগাঁ পশ্চিমবঙ্গের কোনো জেলা নয়, এমনকী ওই পার্টিতে সহ সভাপতিও থাকে না কারণ এটি একটি সম্পাদক ভিত্তিক সংগঠন।)। ক্রমশ ওরা ওখানকার হিন্দুদের বলতে শুরু করে— ‘এত ভয় ভীতির মধ্যে আপনারা কেন এই দেশে থাকেন? জায়গাজমি বেচে ইন্ডিয়া চলে যান না কেন?’ ভেকধারী কমিউনিস্ট শামসের জানায়— ‘ইন্ডিয়ায় যাওয়ার সাথে সাথে রিলিফ পাবেন, রেশনকার্ড পাবেন, নাগরিকত্ব পাবেন। যারা লেখাপড়া জানেন, সাথে সাথে চাকরি পাবেন।’ এরপর জাল গুটোনোর পালা। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে সব দিক থেকেই পর্যুদস্ত বেশ কিছু মানুষ জমিজমা ঘরবাড়ি বিক্রি করে আইনের শাসন আর স্বস্তির জীবন পেতে ধরা দেয় ‘ধুর’ টানার ব্যবসায়ীদের জালে। মোট আঠাশ জনকে নিয়ে তারা সীমান্তের কাছে একটি বাড়িতে ওঠে। পরিবার প্রতি প্রাথমিক চুক্তি ছিল তিন হাজার টাকার যেটা সীমান্তের ওই বাড়িতে এসে পুলিশকে দেবার নাম করে সাড়ে চার হাজারে দাঁড়ায়। আর তারপর মধ্যরাতে চলে ঘণ্টাখানেকের নারকীয় তাণ্ডব। সবার সোনাদানা, টাকাকড়ি সব লুটে নিয়ে চলে যায় দুর্বৃত্তের দল। অবিনাশ-শামসের বা বিএসএফ-বিডিআর কেউ আসে না বাঁচাতে। কপর্দকশূন্য মানুষগুলো শেষ রাতে অবিনাশ-শামসেরকে অনুসরণ করে অল্প জলের নদী হেঁটে পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় ঢুকল। মোস্তাফা পান্না লিখছেন—
"ওপারে উঠে অনিল ব্যাপারী পেছনে ফিরে তাকাল। পিতৃপুরুষের জমি--জন্মভূমি শেষবারের মতো দেখতে চাইল। অন্ধকারে নদীর ওপারে কিছুই দেখা গেল না।তুখোড় বাস্তববাদী লেখক মোস্তাফা পান্না নিশ্চয়ই বোঝাতে চেয়েছেন সীমান্তের দুই পারের কোথাও মানুষ স্বস্তিতে নেই। বস্তুত ধর্মের ভিত্তিতে যে কোনো হোমল্যান্ড হতে পারে না লেখকের এমন নৈতিক অবস্থান সহজেই চেনা যায় এই গল্পে।অবিনাশ বলল, ‘সামনের দিকে হাঁটেন।’
অনিল ব্যাপারী সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না।"
পশ্চিমবঙ্গের লেখক অভিজিৎ সেনের বেশ কিছু গল্পে বর্ডার ও সন্নিহিত এলাকা এসেছে গল্পের পটভূমি হিসেবে। সম্ভবত তিনিই বাংলার একমাত্র লেখক যাঁর গল্পে বর্ডার ও বর্ডারের জীবনযাত্রা এত নিপুণভাবে বারংবার ফুটে উঠেছে। যেমন ‘পাথরে জলের বিন্দু’ গল্পে দুই পাঠানের কথা আছে, আনোপা আর তার ভাইপো দানী। গল্পের বিষয় তাদের সমাজ-সংস্কার-কৌমবোধ-যৌনতা হলেও আবহে আছে বর্ডার। শুরুতেই লেখক জানিয়েছেন: ‘যদি কেউ সতর্ক করে না দেয়, তাহলে এ রাস্তা দিয়ে চলার সময় মানুষ, বিশেষ করে নতুন মানুষ, ওপারে, অর্থাৎ বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে। ঢুকে পড়েও।’ গল্পে আনোপা আর দানী কৈলাসকে খুন করে। কৈলাস যে ডাইন বা ফোকসিন হয়েছিল তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও কৈলাসের সঙ্গিনী পুষ্পা যে ডাইন এ নিয়ে ওদের সমাজে কোনো সন্দেহ ছিল না। সুতরাং আইন আদালত পুলিশ পঞ্চায়েত-এর ঊর্ধে উঠে সামাজিক সুরক্ষার কৌম-রক্ষাকবচ ওদের কৈলাসকে খুন করার তাৎক্ষণিক শক্তি জোগায়। সে শক্তি অবশ্য আক্ষরিক অর্থেই তাৎক্ষণিক। কেননা সামান্য কারণেই তাদের সেই শক্তির বর্ম যায় টুটে। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র:
"আনোপার জমির যে অংশের রঙ আলাদা, কৈলাসের মুণ্ডুহীন ধড় সেখানেই আছে। তুলে দেখার প্রয়োজন হয়নি, কেননা স্বীকারোক্তি মতো মুণ্ডুটি এর প্রায় আধামাইল তফাতে সীমান্তের ওপারেই আরেকটি গর্তে পাওয়া গেছে। সে মুণ্ডুও সেখানেই আছে। যেহেতু মুণ্ডু ও ধড় উভয়ই সীমানার ওপারে, সুতরাং ওদুটির হেফাজত বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষীদের। কাজেই পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। আর মধ্যবর্তী ব্যবস্থা হিসাবে, কে না জানে সীমান্তরক্ষীর জীবন কী একঘেয়ে এবং উত্তেজনাহীন। আপাতত কৈলাসের কবরের দুই পাশে আনোপা ও দানী বাঁধা। ব্যবস্থা যা হয়েছে তাতে সারারাত এভাবেই তাদের থাকতে হবে।"দুজনকে অবশ্য সারারাত ওভাবে থাকতে হয় না। কারণ ওই রাতেই দানী নিজেকে শেষ করে দেয়।
‘বদলি জোয়ানের বিবি’ গল্পে সরাসরি বর্ডারের কথা না বললেও বর্ডারের রক্ষীদের ক্যাম্পই গল্পের পটভূমি। ‘সাইদার এখন-তখন’ গল্পটির মৌল বিষয় সীমান্ত দিয়ে বলদ পাচার। হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার থেকে আসা বলদগুলো জোড়ায় জোড়ায় বাংলাদেশে পাচার করা। বিএসএফ লাইন ক্লিয়ার দিলে ওরা স্বচ্ছন্দে কাজটা করে। কিন্তু মাঝে মাঝে লাইন দেয় না, টর্চ দেখায় না। ওরা সে সময়টা খুব সমস্যায় থাকে। অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু সীমান্তরক্ষীদের ডিউটি বদলে যদি ওদের ভাষায় ‘এইট্টি ফোর’ লাগু হয় তখনই সমস্যা হয়। এইট্টি ফোর ওদের সঙ্গে কোনো আপসে আসে না। সোজা গুলি চালায়। তেমনি এইট্টি ফোরের হাতে গুলি খেয়ে দগ্ধে-পচে মরেছিল হানিপের বড়োভাই ইকবাল। ইকবালের স্ত্রী সাইদা আর হানিপ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছে ইকবালের ওই ঘটনার সময় থেকেই, যখন ওর শরীরের পচা গন্ধে সাইদা আর ওর পাশে শুতে পারেনি, হানিপের চটের তলায় এসে শুয়েছে। সাইদা আর হানিপ তখন আল্লার কাছে ইকবালের মৃত্যু কামনা করত। ইকবালের জন্যই। ইকবালের কষ্টের কোনো শেষ ছিল না। সাইদা হানিপের বড়ো দুর্বল জায়গা। কিন্তু হানিপও বড়ো ভাইয়ের মতো রোজগারের তাগিদে বেপরোয়া হতে বাধ্য হয়। টানা এইট্টি ফোর চলায় সে মহাজনের থেকে টাকা ধার নিয়ে মালিকের বলদ কিনে গোহাটায় বেচতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে নিকেশ হয়ে যায়। কথক বলেন— ‘সব শুনে আমি থম মেরে বসে রইলাম। তারপর প্রথমেই আমার চোখে ভেসে উঠল সাইদার এখন-তখন পেটটা। ... সত্যিই তো সাইদা এখন কী করবে?’ যে জিজ্ঞাসা দিয়ে লেখক গল্পটা শেষ করেছেন তার উত্তরও সম্ভবত আমাদের জানা। কিন্তু সাইদারা অহরহ এই চক্রে পড়ছে আর শেষ হয়ে যাচ্ছে। কেননা ওটা আন্তর্জাতিক সীমান্ত। চোরাচালান ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ‘চোরাচালান’ গল্পে অভিজিৎ সেন হিলি সীমান্তের কথা লিখেছেন একেবারে আত্মকথা লেখার ঢঙে। লেখকের ভাই এক অভূতপূর্ব সংকটে পড়েন নিজের শ্যালিকাকে নিয়ে। সে মেয়েটি বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় এপারে চলে আসে। তারপর তার লেখাপড়া বড়ো হওয়া সবই এদেশে। এখন বিবাহযোগ্যা মেয়েটির যখন বাংলাদেশে পরিবারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন তখন নিয়মনীতির বেড়াজালে আটকে বেচারা আর যেতে পারে না। আইন দেওয়ালের মতো সামনে এসে দাঁড়ায়। সেই সময় লেখক অফিসের এক সহকর্মীর মাধ্যমে দয়াল নামক এক পারাপারের ত্রাতা তথা দালালের সহায়তায় কীভাবে সাকুল্যে বত্রিশ টাকায় মেয়েটিকে ওপারে তার ভাইদের জিম্মায় পোঁছে দিতে পেরেছিলেন, তারই অনুপুঙ্খ বিবরণ ‘চোরাচালান’। অনড় আইন শালগ্রাম শিলার মতো মানুষের স্বাভাবিক জীবনে বাধা তৈরি করলে মানুষ কীভাবে আইন ভাঙতে বাধ্য হয়, গল্পটি তার দুর্দান্ত এক নমুনা।
অভিজিৎ সেনের বর্ডার বিষয়ক গল্পগুলির মধ্যে সব থেকে পরিণত গল্প সম্ভবত ‘সীমান্ত’, যেখানে একসময়ের ছিন্নমূল বিভূতি তার ছেলেকে নিয়ে যায় বর্ডার দেখাতে। গল্পটির প্রেক্ষাপট বহুধা বিস্তৃত। পুববাংলা থেকে ওদের পরিবারের ছিন্নমূল হয়ে যাওয়া, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সত্ত্বেও বিভূতি একটা অসাম্প্রদায়িক মন বাঁচিয়ে রাখতে চায়। যদিও সেটা খুব সহজ কথা নয়। সাম্প্রদায়িক ভাবনার হাত থেকে মুক্ত রাখতে চায় সে নিজের সন্তানকেও। তাই চারপাশের কলুষ-বাক্য থেকে সে নিজে যেমন পৃথক থাকতে চায়, ছেলেকেও দেখতে চায় সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভ্যানগার্ড হিসেবে। ওরা যেদিন বর্ডারে যায় সেদিন ছিল ইদ। বিএসএফ-কাস্টমস সেদিন মানুষের মেলামেশায় বাধা হয় না। বিভূতি ছেলেকে জিগ্যেস করে এই মানবের মিলন ক্ষেত্রে সে হিন্দু-মুসলমানকে কোনোভাবে আলাদা করতে পারে কি না। বিভূতির ছোটো ছেলে হিন্দু-মুসলমান জনতার দিকে তাকায়, আর পিতা বিভূতি: ‘মনে মনে প্রার্থনার মতো স্তব করতে থাকে। পারিস না, খোকা— পারিস না।’
চেতনার যে জায়গা থেকে বিভূতি তার ছেলের উদ্দেশে মনে মনে প্রার্থনা করে— ‘পারিস না, খোকা— পারিস না’— দুপারের নতুন প্রজন্মের বাঙালি সেই দার্শনিক অবস্থানেই থাকতে চায়। টানাপোড়েন যে আছে তা অস্বীকার করা যায় না, তবে এখনও বৃহত্তর অংশের বাঙালি মনে মনে বিভূতিই। আর স্বাধীনতার পর ভারত-বাংলাদেশের (আগে পূর্ব পাকিস্তান) অর্থনীতি এবং সীমান্ত এলাকার রাজনীতি যে পথে এগিয়েছে, তাতে বর্ডার নিয়ে বাঙালির আবেগ ক্রমেই মুছে যাচ্ছে একথা বলাই যায়। বর্ডার বললেই দুপারের সীমান্তরক্ষী দল আর চোরাচালানের মুক্তাঞ্চলের কথাই মনে আসে। বাংলা সাহিত্যেও তার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
তথ্যসূত্র :
১. মুক্ত সীমান্তের শেষ রাত : সত্যেন্দ্রপ্রসাদ বিশ্বাস, তিতির সাহিত্য পত্রিকা দেশভাগ সংখ্যা; সম্পাদনা সঞ্জয় সাহা
২. রিকনস্ট্রাক্টিং দ্য বেঙ্গল পার্টিশন : দ্য সাইকি আন্ডার আ ডিফারেন্ট ভায়োলেন্স / জয়ন্তী বসু , সময়
৩. দেশভাগ দেশত্যাগ : সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুষ্টুপ
৪. আঁতুড়ঘর : রাজা সরকার, কোয়ার্ক পাবলিশার্স
৫. ভোরের প্রসূতি : আবুল বাশার, আনন্দ
৬. ওপার : মোস্তাফা পান্না, এখন পর্যাবরণ পত্রিকা দেশভাগ সংখ্যা
৭. পঞ্চাশটি গল্প : অভিজিৎ সেন, সুবর্ণরেখা
৮. দশটি গল্প : অভিজিৎ সেন, পরশপাথর
(পরবাস-৭২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
অলংকরণঃ ঢাকা থেকে কলকাতাগামী শেষ ট্রেন, ১৯৪৭; এখান থেকে