১.
ঠিক সাড়ে ছ’টায় সকালের হাঁটাহাঁটি সেরে বাড়ি ফিরেন ফরিদ সাহেব। রুটিনের খুব একটা হেরফের হয়নি আজ পর্যন্ত। বাড়ি ফিরে, মৃদু উষ্ণ পানিতে একটা গোটা লেবুর রস, আর সামান্য মধু মেশানো পানি পান করেন। এক্ষেত্রে, স্ত্রী আয়েশা বেগমেরও সময়ের খুব একটা এদিক-ওদিক হয়না। ফরিদ সাহেব চেয়ার টেনে টেবিলে বসা মাত্র, লেবু পানি নিয়ে হাজির হন আয়েশা বেগম। সকালের হাঁটাহাঁটিতে বলে বলেও, ফরিদ সাহেব স্ত্রীকে সঙ্গী করতে পারেননি। আয়েশা বেগমের সেই এক কথা; না বাবা, তোমার মতো হনহন করে অতটা পথ হাঁটা আমার পোষাবে না। চেষ্টা যে করেননি তা নয়। উৎসাহ নিয়ে একদিন স্বামীর সঙ্গী হয়ে সুবিধা করতে পারেননি তিনি। সকালের হাঁটা তাই বাদ।
বিকেলের হালকা চা-নাস্তা খেয়ে, দু’জনে টুকটুক করে আশেপাশের এলাকায় খানিক হেঁটে আসেন। ফিরতে ফিরতে মাগরিব হয়ে যায়। নামাজ পড়ে, পড়াশোনা লেখালেখির কাজ থাকলে, সেগুলো নিয়ে বসেন ফরিদ সাহেব। বেশির ভাগ দিনেই আয়েশা বেগম নারীকেন্দ্রের খাতাপত্র নিয়ে বসেন। কখনও টিভি দেখেন, নইলে বই পড়েন পছন্দ মতো। টিভির নেশা তাঁর তেমন একটা নেই। মনিরার জন্য টিভি খুলতেই হয়। বাড়ির যাবতীয় কাজ হাসিমুখে করতে মনিরার জুড়ি নেই। কিন্তু সন্ধ্যার পর টিভি না চললেই তার মুখ ভার। আর কোনো আব্দার নেই, কিন্তু রোজ টিভি দেখা চাই। কোন চ্যানেলে কী অনুষ্ঠান, সব মনিরার মুখস্থ।
ফরিদ সাহেব মাঝমধ্যে টিভিতে খবর দেখেন। আজকাল, খবর শোনার চেয়ে দেখার ব্যাপারই তো বেশি। যে যার মতো দেখনদারিতে ব্যস্ত। দুনিয়া জুড়ে শুধু হানাহানি, ভাংচুর, খুন-জখম আর ধর্ষণের সচিত্র প্রতিবেদন। সেসব দেখেন আর বিরক্তিতে গজগজ করেন। বই-খাতা থেকে চোখ তুলে আয়েশা বেগম কখনও কখনও স্বামীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। স্বামীর মন অন্য দিকে ঘোরানোর জন্য হয়ত জানতে চান, “আচ্ছা অমলেন্দু চক্রবর্তীর বইটা পড়েছো?” ফরিদ সাহেব হয়ত তখন, সিরিয়া বিষয়ে, রাশিয়া আর ইরানের পদক্ষেপের জবাবে ক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার খবরটা নিয়ে রীতিমতো বিরক্ত। এরকম একটা সময়ে, হঠাৎ অমলেন্দু চক্রবর্তীর নাম ওঠায় বেশ ভ্যাবাচ্যাকায় পড়ে যান। ঠাহর করে উঠতে পারেন না, সিরিয়া সম্পর্কিত বিষয়ে অমলেন্দু চক্রবর্তীর ভূমিকা ঠিক কী! বিষয়টা স্পষ্ট করতে স্ত্রীকে পালটা প্রশ্ন করেন, “অমলেন্দু চক্রবর্তী সিরিয়া বিষয়ে কি লিখেছেন? না, পড়িনি তো তেমন কিছু।” হঠাৎ-মেজাজ-হারানো বাচ্চা ছেলেকে শান্ত করার ভঙ্গিতে মুখে হাসি টেনে আয়েশা বেগম জবাব দেন--“না, না, আন্তর্জাতিক রাজনীতির কথা বলছিনা। সেদিন, তোমার ছাত্র বকুল, যে বইটা দিয়ে গেলো, ‘আকালের সন্ধানে’, অমলেন্দু চক্রবর্তীর লেখা। তুমি খুব উৎসাহ দেখালে পড়বে বলে?”
মুহূর্তকাল স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থেকে, ফরিদ সাহেব ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠেন। “তুমি পারোও বটে আশা। কিসের সাথে যে কি মিশিয়ে ফেলো, বুঝে কার সাধ্যি!” স্বামীর অগোচরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন আয়েশা বেগম। এই বয়সে, হুটহাট উত্তেজনা ভালো নয়। গত বছরে ছোটোখাটো একটা এ্যাটাক হয়ে গেছে। তাঁর পক্ষে যতটা সম্ভব হয়, স্বামীকে উত্তেজনা বা হঠাৎ মেজাজ খারাপ হওয়া থেকে আলগোছে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। ভোরে স্বামীর হাঁটাহাঁটিতে সঙ্গ দিতে না পারাটা তাঁর জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাশের ফ্ল্যাটের ডাক্তার-ভাই হন্টনসঙ্গী হওয়াতে এখন স্বস্তিতে থাকেন।
ফরিদ সাহেব সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন বছর খানেক হলো। তাই বলে সুদীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের কর্মজীবনে এখনও পূর্ণচ্ছেদ টেনে দেননি। একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে সপ্তাহে দু’দিন ক্লাস নিয়ে থাকেন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণ প্রজেক্টেও সাধ্যমতো সময় দিতে হয়। যদিও ফরিদ সাহেবকে অনুরোধের ঢেঁকি গেলানো একটু কষ্টসাধ্যই, তবুও এমন কিছু প্রিয়ভাজন আছেন, যাঁদের অনুরোধ অগ্রাহ্য করা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাঁদের অনুরোধে ফরমায়েশি লেখার পাশাপাশি নিজ উৎসাহে পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত কলামও লিখে থাকেন। স্ত্রী আয়েশা বেগমের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত নারীশিক্ষা কেন্দ্রটিতেও মাঝে-মধ্যে গিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে নানান বয়সীদের শিক্ষার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে নারীদের স্বাবলম্বী করতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ফরিদ সাহেব বরাবরই স্ত্রীকে এসব বিষয়ে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। সৌরভ ক্লাস সিক্সে ইংরেজিতে ফেল করায়, ছেলেকে সময় দেয়া গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল আয়েশা বেগমের। পাশাপাশি নিজ উদ্যোগেই কিছু একটা করবেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে কলেজের চাকরিটা হুট করে ছেড়ে দেন। ছেলের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে গিয়ে চাকরি ছেড়ে দেয়া, বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সমমনস্ক কিছু মানুষ নিয়ে নারীকেন্দ্রটি গড়ে তোলার জন্য নিজের শ্রম, সময়, মেধা, এবং অবশ্যই সাধ্যমতো অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেবার সিদ্ধান্তে বাধা দেয়া উচিত ভাবেননি ফরিদ সাহেব। স্ত্রীর কাছে শুধু জানতে চেয়েছিলেন, তিনি যা করছেন স্বপ্রণোদিত হয়েই করছেন কিনা? স্ত্রীর হ্যাঁ বাচক উত্তরে তিনি যেন স্বস্তিই পেয়েছিলেন। ফরিদ সাহেব মনে করেন, একটা সমাজের প্রকৃত ‘হিরোজ’ হলেন নারীশক্তি। অথচ তাঁদের গল্পটাই সমাজ কান পেতে শুনতে মনোযোগী নয়। এসব গল্প তখনই বেরিয়ে আসবার শক্তি পায়, যখন একটা সমাজে তার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব হয়। উইমেন্স ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট, এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন, ইত্যাদি কর্মযজ্ঞে স্ত্রীর উৎসাহে ফরিদ সাহেব নিজেও তাই উৎসাহ পান। আশাবাদী হতে কার না ভালো লাগে। ফরিদ সাহেব ভীষণ আশাবাদী মানুষ। আয়েশা বেগম মাঝে মধ্যে কেন্দ্র নিয়ে হতাশ হয়ে পড়লে ফরিদ সাহেব তাঁকে আশার কথা শোনান। এই দম্পতি একে অন্যের কাজেকর্মে সহৃদয় উৎসাহ জোগান। একটা দীর্ঘ সময় পাশাপাশি থেকে, কেবল নিজেদের নেবার পাল্লা ভারি না করে, সাধ্যমতো সমাজকেও কিছু ফিরিয়ে দেবার আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
২.
আয়েশা বেগম-ফরিদ সাহেব দম্পতির এক মাত্র সন্তান সৌরভ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে গিয়ে ওখানেই পাকাপাকি ভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার ছেলে, এখন নামকরা কোম্পানির চাকুরে। ছেলের সিদ্ধান্তে তাঁরা বাধা হননি। জীবনটা যার, সিদ্ধান্তটা তার নিজের হলে পরবর্তীতে কোনো পক্ষকে দোষী করার থাকে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে আবেগের চেয়ে বিবেক-বাস্তবসম্মত বুদ্ধিকে প্রাধান্য দেয়ার ব্যাপারে ফরিদ সাহেব অধিক পক্ষপাতী। ছেলের সিদ্ধান্ত ছেলের ভবিষ্যতের নিশ্চিত নিরাপত্তা দিতে সমর্থ, সন্দেহ নেই। কাজেই, এ নিয়ে তাঁদের দু’জনের কেউ প্রকাশ্য হাহুতাশ করেননি। আয়েশা বেগমের মায়ের মন, খোলাভাবে সেটা মেনে নিতে না পারলেও চুপচাপ থেকেছেন, উচ্চবাচ্যে যাননি। ছেলের কথা বলতে গিয়ে মাঝে মধ্যে আয়েশা বেগমের বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস জানান দিয়ে যায় ছেলের জন্য একটা হিমবাহ-কষ্ট তাঁর বুকের খাঁজে মাথা লুকিয়ে আছে।
মাস ছয়েক আগেই তাঁরা দু’জনে ছেলের কাছ থেকে ঘুরে এসেছেন। সৌরভ মা-বাবাকে নিয়ে আমেরিকার বেশ কিছু রাজ্য ঘুরে দেখিয়েছে। বিদেশ বিভূঁইয়ের পরিবেশ ফরিদ সাহেব বা আয়েশা বেগমের অপরিচিত নয় মোটেও। স্বামীর পেশাগত কাজের সঙ্গী হিসেবে জীবনের বেশ ক’টা বছর আয়েশা বেগমকে দেশ ছেড়ে বিদেশে কাটাতে হয়েছিল। অক্সফোর্ড অন্তর্ভুক্ত প্রেস্টিজিয়াস কলেজ হার্টফোর্ড থেকে ফরিদ সাহেব তাঁর পিএইচডি ডিগ্রী নিয়েছিলেন। ডিগ্রী লাভের পরপরই দেশে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তারপর বেশ কয়েকবার তাঁকে বিদেশগামী প্লেনে চড়ে বসতে হয়েছে কর্মসূত্রে। স্ত্রী মাঝেমধ্যে সেসব যাত্রার সঙ্গী হয়েছেন বৈকি। তবে ছেলের ছুতোয় এভাবে বিদেশ ভ্রমণের আনন্দ একেবারেই অন্যরকম। যে কয়েকদিন তাঁরা ছেলের কাছে ছিলেন সৌরভ সাধ্যমতো সেবাযত্ন করেছে মা-বাবার। কাজ থেকে ফিরে, বা কাজে গিয়েও ফোনে তাঁদের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিয়েছে।
সৌরভের নতুন কেনা বাড়িতে টুকটাক সাজানোর কাজ করে তৃপ্তির পাশাপাশি ছেলের জন্য একটা বউয়ের খুব অভাববোধ করেছেন আয়েশা বেগম। সেকথা ছেলেকে বলা মাত্রই সৌরভ তার স্বভাবসুলভ হাসিতে মাকে জানিয়েছে,
- আই নিউ দিস ম্যাটার উড কাম আউট ফ্রম ইউ, মা।
- হোয়াটস্ রং উইদ দ্যাট বাবা? মায়ের ফিরতি প্রশ্নে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ত্বরিত উত্তর দিয়েছে, নাথিং রং মা।
- আই উইল লেট ইউ নো হোয়েন দ্য টাইম কামস, ওকে মা?
এরপর আর তো কিছু বলার থাকে না। আয়েশা বেগমের ভেতরের কৌতূহলী মন এটা জেনে নিশ্চিত হতে চায়, ছেলের পছন্দের কেউ আছে কিনা, নইলে তারাই ছেলের জন্য মেয়ে পছন্দ করবেন। মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে হয় না সে কথা। সৌরভ মাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় জানিয়ে দেয়,
--ইয়েস, মা, দেয়ার ইজ সামওয়ান স্পেশাল। আই ওয়ান্ট টু স্পেন্ড দ্য রেস্ট অফ মাই লাইফ উইদ…..’
“এক কাপ চা বা কফি পাওয়া যাবে, নাকি মা-ছেলের গপ্পোবাজিই চলবে…” ফরিদ সাহেবের কথার তোড়ে সৌরভকে থেমে যেতে হয়, তা কিন্তু না। সৌরভ তার মুহূর্তকাল আগে বাক্য শেষ না করে থেমে গিয়েছে। আয়েশা বেগম সেটা আমলে না নিয়ে, ছেলের পছন্দের কেউ আছে, এই তথ্যটা পাওয়ার আনন্দে, ছটফটে পায়ে স্বামীর সামনে গিয়ে দাঁড়ান। সেদিন চায়ের সাথে, ফরিদ সাহেব দু’খানা রসগোল্লা খাওয়ার অনুমতিও পেয়ে যান। তাঁর আতিশয্যের হেতুটিও যথাসময়ে স্বামীর কানে তুলে দিতে ভোলেন না আয়েশা বেগম।
৩.
ছেলের পছন্দের মেয়েটিকে সামনা-সামনি দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কাজের কারণে তাকে অন্য কোথাও যেতে হয় বলে মেয়েটিকে স্বচক্ষে দেখতে না পাওয়ার আফসোস নিয়ে দেশে ফিরতে হয় আয়েশা বেগমকে। ফরিদ সাহেবের অত কৌতূহল নেই। দেশে ফেরার পর যখনই ছেলে ফোন করেছে, কথা শুরু হতে না হতেই, আয়েশা বেগম মেয়েটার সাথে হয় কথা বলার আগ্রহ দেখিয়েছেন, নাহয়, ছবি পাঠানোর জন্য অনবরত তাগাদা দিয়ে গেছেন। খুব কাছের আত্মীয়স্বজনদের ইতিমধ্যেই সৌরভের পছন্দের একজন যে আছে, সে-কথা জানানো হয়ে গেছে। শীঘ্রই হয়ত ছেলের বিয়ে দেবেন। নিজের গহনার বাক্স খুলে প্রায় কোনটা কোনটা ছেলের বউকে দেয়া যায় বাছাই করেন। আয়েশা বেগমের পাশে বসে মনিরাও মহোৎসাহে নিজের রায় দিতে ভুলে না।
- আম্মা আজকালকার মাইয়া, এত ভারি গয়না যদি পছন্দ না হয়? দু একটা হালকা পাতলা গয়না বানায়ে রাখেন। নাইলে বেড়াছেড়া লাগতে পারে। ইঞ্চিনিয়ার ভাবীসাবের পছন্দ কেমন, সেইটা জানা গেলে ভালো হইত, ঠিক কিনা?
মনিরার কথাটা ফেলে দেবার মতো না। কাজেই, আলোচনা খাওয়ার টেবিলে গড়ায়। স্বামীকে জানানো হয়, বউয়ের জন্য একসেট নতুন গহনা বানাতে চান তিনি। ফরিদ সাহেব এসব বিষয়ে কখনই মাথা ঘামান না। আজও সেটার প্রয়োজন নেই ভেবে, খাওয়াতে মনোযোগ দেন। অধৈর্য আয়েশা বেগম, ছেলেমানুষি আগ্রহে, স্বামীর উদ্দেশ্যে দ্বিতীয়বার কথাটা বলেন। ডাইনিং টেবিলের ঠিক মাথার উপরে থাকা আলোটা খুব কম মনে হয় ফরিদ সাহেবের। মাছের কাঁটা বাছতে সমস্যা হচ্ছে তাঁর।
সামান্য বিরক্ত চোখে, মাথার উপর শ্যান্ডেলিয়ারে দিকে তাকিয়ে দেখেন বেশ কয়েকটা বাল্ব জ্বলছে না। একটু গলা তুলে মনিরাকে ডাকেন। টিভিতে চোখ আটকে থাকলেও কান খোলাই রাখে সে। ডাক শোনামাত্র এসে উপস্হিত হয় মনিরা। ইশারায় ফিউজ বাতি দেখাতেই, মনিরা জানিয়ে দেয়, ড্রাইভার ভাইকে বাল্বের কথা সে গতকালই বলেছে। “আজকে তো সারাদিনই আপনেরে নিয়া বাইরে বাইরে, তাই লাগানো হয়নাই। কাল ঠিক লাগানো হবে, আব্বা।” এবার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলেন, “আশা, তোমার এসব ব্যাপার তো আমি বুঝিনা। তোমার মন চাইলে একটা কেন, দুটো সেট বানাতে দাও সমস্যা নেই। কিন্তু ছেলের বিয়ে নিয়ে যে এত মাতামাতি করছো, সে তো সোজাসুজি বলছেই না কবে, কখন, সেই মহার্ঘক্ষণটি আসবে। জানিয়েছে কি ইতিমধ্যে সে কথা?”
আয়েশা বেগম এবার খানিক লজ্জিতই হলেন। মনের ভুলে স্বামীর প্লেটে পেটির মাছ না দিয়ে, কাঁটাময় গাদা দিয়েছেন। তার উপর বাতির এই হাল, আর তিনি গহনা নিয়ে ব্যস্ত। কাজটা ঠিক হয়নি। খানিক অপরাধের সাথে স্নেহের মিশেলে বলেন, থাক, ও টুকরোটা খেও না। পেটির টুকরোটা খাও বরং। রাতের মেন্যুতে মাছ রাখতে মনিরাকে বারণ করি এত, কে শোনে কার কথা!
খাওয়াদাওয়া সেরে ফ্যামিলি স্পেসে এসে গা এলিয়ে খানিক বসেন দু’জনে। ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এ সময় নানা বিষয়ে তাঁদের কথা হয়। কখনও পুরনো এ্যালবাম খুলে ছবি দেখাদেখি চলে। ফরিদ সাহেব সোফায় বসে খাওয়ার টেবিলের প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করেন স্ত্রীর উদ্দেশ্যে,
- সৌরভ কিছু জানিয়েছে, কবে বিয়ের সময় পাবে বা সেরকম কিছু? সত্যিই তো আগেভাগে ব্যবস্থা না নিয়ে রাখলে তো শেষ সময় ছুটোছুটি পড়ে যাবে। তুমি ঠিক লাইনেই এগোচ্ছো আশা। শাড়ি গহনা যা যা লাগে আগেভাগেই ব্যবস্থা নিয়ে রাখো।
স্বামীর কথায় সামান্য হেসেই আয়েশা বেগমের মুখটা কেমন হয়ে যায়। ছেলে তো আজকাল আমার মোবাইলে ফোন করা ছেড়ে দিয়েছে, খেয়াল করেছো তুমি? সে এখন তোমাকে ফোন করে। আরে বাবা, তোর ভালোর জন্যই তো বিয়ের তাড়া দেয়া। একা থাকা তো অনেক হলো। আর পছন্দ যখন করাই আছে, দেশে এসে বিয়েটা করে নিতে সমস্যা কোথায় বলো দেখি!
ফরিদ সাহেব স্ত্রী আয়েশার শিথিল হয়ে আসা চামড়ায় মোড়া হাতখানা নিজের হাতে টেনে নেন পরম স্নেহে। ইদানিং ছেলে তাঁর মোবাইলেই ফোন করে, বিষয়টা তিনিও খেয়াল করেছেন। কিন্তু সেটা নিয়ে আশার বুকের ভেতর কষ্ট জমা হচ্ছে সেটা বোঝেননি। মুখ ফুটে সেভাবে নিজের অভিযোগ কবেই জানান দিয়েছে সে! তাঁর সবটা জুড়ে আছে স্বামী-সন্তান। তাদের ভালোমন্দ নিয়েই তাঁর যত ভাবনা। বিয়ের এতদিন পরও ফরিদ সাহেবের পক্ষে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর সামনে বসে থাকা এই অনিন্দ্যসুন্দর মুখটাতে তিনি কখনও জটিলতা-কুটিলতার জটাজাল দেখেছেন কিনা। স্ত্রীকে তিনি ভালোবাসেন সন্দেহ নেই। কিন্তু আশার মতো অতটা তিনি বাসতে পারেননি। এই মুহূর্তে স্ত্রীর বুকে ছেলের ফোন করা বিষয়ে যে কষ্ট গেঁথে আছে, সেটা তুলে নেবার ইচ্ছেতেই যেন তিনি স্ত্রীর হাতখানা বুকের কাছে চেপে ধরেন। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকেন পরম মমতায়। সে দৃষ্টিতে থির হয়ে থাকে গির্জার মোমবাতির পবিত্রতা।
৪.
রুটিন মতো হেঁটে এসে, চেয়ার টেনে বসবার মুখে পকেটের মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। সৌরভ এ সময়ে সাধারণত ফোন করে। মা বাবা দু’জনকেই এক সাথে পাওয়া যায়। গত দু’সপ্তাহ ধরে ছেলের ফোন না পেয়ে ফরিদ সাহেব আয়েশা বেগম উদ্বিগ্ন ছিলেন খানিক। ছেলের ফোন আসায় দারুণ তৃপ্তি নিয়ে ফরিদ সাহেব ফোনটা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দেন। হাসিমুখে স্বামীকেই কথা শুরুর ইঙ্গিত করেন আয়েশা বেগম। … ফরিদ সাহেব হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে ভীষণ তাড়াহুড়ো গলায় সৌরভ জানায়, ওঁরা এতদিন যেটা চাচ্ছিলেন, সে ব্যাপারটা গতকালই ঘটে গেছে তার জীবনে। অনেক ভেবেচিন্তেই সে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। বাবা-মা নিশ্চয়ই খুশি হবেন তার এ সিদ্ধান্তে। মায়ের সাথে পরে কথা বলে নেবে। এখনই তারা হাওয়াই রওনা দিচ্ছে হানিমুনের উদ্দেশ্যে...
দু’জন মানুষের অবাক মুখের সামনে কট্ করে ফোনটা কেটে গেলো। ফরিদ সাহেব তাঁর রুটিন মতো লেবু পানির গ্লাসে চুমুক দিতে ভুলে গেলেন। আয়েশা বেগম কর্তব্য করণীয় কী হতে পারে তার খেই হারিয়ে বোকার মতো জানতে চাইলেন, আজ নাস্তায় পরোটা দিতে বলি?
…. সপ্তাহ-খানেক পর, ছেলের কাছ থেকে আসা ইমেইল খুলতেই ফরিদ সাহেবের ছোটোখাটো এ্যাটাকের মতো অনুভূতি হলো। ‘টু মা এন্ড বাবা’ লেখা একবাক্যের ছোট্ট ইমেইলটার সাথে বেশ কিছু ছবি এ্যাটাচ করা। নিষ্পলক অথচ সন্ধানী চোখে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকেও ছেলের পাশে একটা মেয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলেন ফরিদ সাহেব। ভীষণ হাসিখুশি একজন, সব ছবিতে সৌরভের গলা বা কাঁধ ছুঁয়ে আছে। কোথাও বা সে সৌরভের গালে চুমুও খাচ্ছে… কিন্তু সে তো সৌরভের মতোই আরেকজন পুরুষ! বুঝে নিতে কষ্ট হয় না, তাঁদের সন্তান সৌরভ, সমপ্রেমী। প্রচণ্ডভাবে ব্যক্তি-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, সারাজীবন নিজেকে উদারমনা ভেবে আসা ফরিদ সাহেব, এমন সত্যির মুখোমুখি হয়ে ভীষণভাবে অসহায় বোধ করলেন। এরকম দমবন্ধ পরিস্থিতিতে জীবনেও পড়েননি তিনি। তাঁদের একমাত্র সন্তানের এই নিদারুণ চমকানোর মতো সত্যিটা স্ত্রীকেই বা কিভাবে দেয়া সম্ভব, সে কথা ভেবে বাতাসে অক্সিজেনের ভীষণ অভাববোধ করেন ফরিদ সাহেব।
(পরবাস-৭৩, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮)