Parabaas Moviestore




Parabaas Moviestore




Subscribe to Magazines




পরবাসে
সারোয়ার রাফি-র

লেখা


ISSN 1563-8685




মকবুলের বৃত্তান্ত


।। ১ ।।

'ঘরে ছালন না থাকলে হুয়াগের কথায় মন ঢলে না! যাও গিয়া ছালনের ব্যবস্থা করো তারপরে আইয়ো হুয়াগের কারবার লইয়া-- যত্ত আপদ আমার'--রেশমার কথাগুলো শুনেই যাচ্ছিলো মকবুল। তার নিজের পক্ষ থেকে কোনো কথা নেই। সত্যিই তো পেট শান্তি রইলেই না পেরেমে মন ঢলে, নইলে এরমই তুই তোকারির ভাষা শোনা লাগে! কিন্তু সে এখন ছালন আনবে কোথা থেকে? তার তো স্থায়ী কোনো রোজগার নেই; তাছাড়া টাকা যা ছিলো সব ফুরিয়ে গেছে। সুতরাং একপ্রকার মন খারাপের অবস্থা নিয়েই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। কোথায়? তা সে জানে না--হাঁটতে হাঁটতে হয়তো বা একটা ছালনের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পথেই সনাতনের সাথে দেখা--'কই, যাও মিয়া? বিলে তো মাছ ধরে সরকারেরা! যাও গিয়া, কিছুক্ষণ পাও ধইরা থাকো--একটা দুইডা মাছ দিলেও দিবার পারে--এই দ্যাখো মোরে দুইখান দিছে'--এই বলে সনাতন বড় বড় দুইটি টাকি মাছ মকবুলকে দেখায় আর মুহূর্তেই তার ভেতরটা হু হু করে ওঠে! ভাবে--এইতো বউয়ের ছালন! কিন্তু নাহ--অই দুইটা সনাতনের বউয়ের! মকবুলের অবাক লাগে যতবারই সে ঘর থেকে বের হয় ততবারই সনাতনের সাথে দেখা হয় আর সনাতনও যেন মনের অবস্থাটা বুঝতে পারে মকবুলের—দুই জনতো এক গোয়ালেরই!


।। ২ ।।


মাথা চুলকাতে চুলকাতে বিদ্যুৎ চমকায় আর মকবুল বলে ওঠে, 'ভিক্ষা মাগবার যাইরে সনাতন! ঘরতো আর চলে না! বউ খেদায়! তাই মাইনষের দুয়ারের ঠ্যাং ধরবার যাই।' 'তা কদিন আগেই না কামলা খাটলি তুই! ট্যাকা কি ফুরায়ে গেছে? বিড়ি কি আবার শুরু করছত নি...!' -- সনাতনের কথায় মকবুলের রাগ হয় কিন্তু তা সাময়িক কেননা এই সত্য তো অস্বীকার করা যায় না তবে যখন সে সনাতনের সাথে চুরির কাজ করতো তখন খেতো; এখন আর খায় না! 'না রে, মুইতো খাইনা আর এখন তো গেরামের সাবেরা খায় – আগের খাওন আর খাওন নাইরে খাওন এহন সেলিবেটিরি হয়া গেছে' -- সনাতন শুনে তবে কিছু বলেনা অথবা মনে মনে বলে কিছু শুনে না! 'যাইরে, মনে লয় মেঘ আইবো!'-- মকবুলও পথ ধরে প্রচণ্ড খিদায়, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত পথের অজানার দিকে--বড়লোকি দুয়ার, পা ধরবার তাগিদে! যদি কিছু পয়সা পাওয়া যায়, পাগুলো, দুয়ারগুলোও যেন এখন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে! --সে বলে ওঠে মনে মনে, 'শালার, সব পা, দুয়ার গরীব হয়া গেছে, এইগুলা য্যান ঈদের চান থুইছে--সব দেহি আমার লাকান হগীরা!'--তখনই বৃষ্টি নামে আকাশ ফেটে, ছোটোছুটি বেড়ে যায়। কেউবা আশ্রয় নেয় ছাতার তলে, কলাপাতার ফাঁকে—মকবুলের কোনো আশ্রয় নেই শুধু! সে এখন হাঁটে আর ভাবে আক্তার মোল্লার কাছেই ভালো ছিলো সে--হাঁটতে হাঁটতেই সে কল্পনায় ডুবে থাকে! কল্পনায় ডুবেই সে লক্ষ করে মাটির কাছটা রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে!


।। ৩ ।।


আক্তার মোল্লার বেশ রমরমা ব্যবসা ছিলো কাঠের। তার নিজেরই বন ছিলো আর সেখান থেকে ইয়া বড় বড় গাছ কাটতো আর তার বদলে নতুন আরো অনেকগুলো গাছের চারা লাগিয়ে দিতো মকবুল। বেশ লাভজনক ব্যবসা, একেবারে বিদেশ পর্যন্ত যাতায়াত আর এসব কিছুরই দায়িত্ব ছিলো মকবুলের। কিন্তু তার কোনো নির্দিষ্ট পেশা ছিলো না। সে সব করতো-- চুরি, ছিনতাই, ঘুষ খাওয়া, কাঠ পাচার করা -- আরো কত কি! এসবই অভ্যেস ছিলো মকবুলের আর সে তো ছোটোবেলায় এনায়েত মিয়ার কাছ থেকে এসব বিদ্যে শিখেছিলো, 'বুঝলি বাজান – সব কাম না করিলে পেট চলে না তাই সব কাম করা নাগে -- মুইও করি, তুইও করবি'-- এনায়েত মিয়া কবেই মরে ভূত হয়ে গেছে আর সেই ভূত এখন মকবুলকে শাসন করছে। তবে আক্তার মোল্লা বেশ স্নেহ করতো তাকে, তাছাড়া তিনি জীবনবাবুর কবিতার খুব ভক্ত ছিলেন। যখন পড়তেন তা আবৃত্তি করে শোনাতেন মকবুলকে, গান গাইতেন। সুখেই ছিলো মকবুল। কিন্তু নিয়তি এমন যে এক রাতের বন্যায় সব ডুবে গেলো, সব ভেসে গেলো কারখানার, ঘরবাড়ি, লোকজন, পশু, মানুষ, ইয়া বড় বড় গাছগুলো বিলীন হয়ে গেলো জলে। এ এক ভ্রম, সে এ ভ্রমে ভেসে বেড়াচ্ছে জীবনভর। সমস্ত আকাশ হাস্যকর চেহারায় চেয়ে থাকে, দিন হয়, রাত নামে -- ব্যাঙের শব্দ ভেসে আসে, চর জেগে ওঠে, কেউবা বিলাপে বিলাপে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে -- এ এক খেলা আর সে খেলা প্রকৃতিই খেলে। আক্তার মোল্লার টিনের ঘরটিও উড়ে যায় আর হাওয়ায় কোথা থেকে আরেকটা টিনের বেশ বড় টুকরা এসে তার গলা কাটে! ঘ্যাচাৎ! গর, গর, গর! আক্তার মোল্লার শেষ শব্দ মুখ থেকে! বেশ শৌখিন লোক ছিলেন তিনি — সাদামাটা ভাবেই থাকতেন প্রকৃতির মাঝে আর সেই এক রাতের বন্যাতেই তার রক্ত জলের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। একটু গোঙানির পর পুরো নিস্তেজ। দেশের একপাশে যখন কাঠ ব্যবসায়ী আক্তার মোল্লা এমন নিস্তেজ পড়ে থাকে ঠিক অন্য পাশে তখন বিপ্লবের জোয়ার ওঠে। বন্যা আর বিপ্লব একাকার হয়ে যায়। সেই রক্তও জল বেয়ে গড়িয়ে যায় দূরে, বহু দূরে -- আজ মকবুল সেই দূর, সেই বহু দূরে দাঁড়িয়ে -- পা কেটে তারও ফিনকি বেয়ে রক্ত পড়ে, সে তারপরও ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে বড়লোকি পা খোঁজে -- মানুষ ও বিস্ময়ের ঘোর থেকে বের হয়ে আসে – এক নিদারুণ ফকিরকে সাহায্য করে সেও ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে পেয়ে যায় 'এক থেকে দশ, দশ থেকে এক টাকা' -- রক্ত ঝরেই ঝরে! তাকে এখন বাড়ির পথ ধরতে হবে এই স্মৃতিকাতরতা ভুলে কিন্তু বৃষ্টি আর বজ্রপাতের বেগ এমনভাবে বাড়ছে যে সে দিক ঠাহর করতে পারছে না। তাছাড়া রক্ততো ঝরছেই ক্রমশ; সে কোনোমতে তা গায়ের ছেঁড়াজামা দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছে কিন্তু না -- রক্ত সে বাধা মানবে কেন? আর আছে অসহ্য খিদা! নিস্তার নেই তা থেকে পালানোর। তবুও মকবুল চেষ্টা করে দিক নির্ণয়ের, 'ঐটা পুব, ঐটা দক্ষিণ, ঐটা উত্তর তাইলে ঐটা পশ্চিম! কিন্তু মোর ঘর কোনদিকে? কোনদিকে আইসা পড়লাম খোদা!' -- সে মনে মনে কাতরায়। প্রশ্ন করে কিন্তু নিজ থেকে রেহাই পায় না।

মকবুল বুঝতে পারে তার জীবন ঘনিয়ে এসেছে। এই পা তাকে বাঁচতে দেবে না। তার মনে হচ্ছে শরীরের সব রক্ত যেন ঐ পা বেয়েই গড়িয়ে পড়ে। সমস্ত ক্লান্তি, ক্লেদ। সে হাঁটার চেষ্টা করে একটু একটু করে, বৃষ্টির প্রবল বাধা সত্ত্বেও সে চেষ্টা করে, আরো বেশি ক্ষত-বিক্ষত হয় পা তবুও ঘরে ফেরার আকুতি। সামনে অগণিত পথ! অসীম। এ পথ যেন আর শেষ হবে না। সে রেশমার কাছে যেতে চায়, তার কোলে মাথা রাখতে চায়, তার হাতে পয়সাগুলো তুলে দিতে চায় কিন্তু বুঝতে পারে সেটা আর সম্ভব নয়! সে দাঁড়ায় পথের মাঝে, মুখ হাঁ করে শূন্যের দিকে চেয়ে থাকে উপরে, আকাশের তারারাও জ্বলজ্বল করে তার দিকে, সমস্ত জল আছড়ে পড়ে তার মুখে, গড়িয়ে যায় পেটে, পরিণত হয় রক্তে! মকবুলের সব ব্যথা, কষ্ট মিশে যায় বন্যায়, বিপ্লবে।

বজ্রপাতের বিকট শব্দ -- আমাদের মকবুল তখনও হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে! !



(পরবাস-৭৩, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮)