Parabaas Moviestore




Parabaas Musicstore




Subscribe to Magazines





পরবাসে
স্বপ্না রায়ের

আরো লেখা


ISSN 1563-8685




আই লাভ ইউ

জুন মাসের মাঝামাঝি, হাড় কাঁপানো শীতের পরে কাঁচা-মিঠে রোদ্দুরটা বেশ উপভোগ্য। কিন্তু উপভোগ করার সময় কোথায়? সারা সপ্তাহের পাঁচটা দিন একটা চাকরি করি, আর উইকএন্ডে দুটো ছুটির দিন যা করি তা চারটে চাকরির সমান। কখনও ঝাড়ুদারনি, কখনও ধোপানী আবার কখনো গানের দিদিমনি। কাজের কি শেষ আছে? এমনই এক রবিবারে বাড়ির তিনটে চাকরি শেষ করে, বাজার সরকারের টুপিটি পরে হাতে বাজারের লিস্টটি নিয়ে আমরা দুজনে বেরিয়েছি। আমার বরের আবার ছুতোর মিস্ত্রির কাজে খুব উত্সাহ। বাইরে বেরোলেই ছোটবেলার চোরচোর খেলার বুড়িছোঁয়ার মত হার্ড-ওয়ারের দোকানে একবার যেতেই হবে। যথারীতি আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে কেটে পড়ল—

—আমি এই যাব আর আসবো, একটা জিনিস ফেরত দেওয়া, আর একটা জিনিস অনলাইন-এ দেখে এসেছি, শুধু তুলে নিয়ে আসা, জাস্ট পাঁচ মিনিটে ফিরে আসবো।

ব্যাস, পাঁচ মিনিটকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট করে তিনি যখন ফিরে এলেন তখন দুপুর আড়াইটে বেজে গেছে। খিদেটা বেশ জানান দিচ্ছে। বাজার করার আগে কোথাও লাঞ্চ সেরে নিতে হবে। গেঁড়ি-গুগলি খুঁজে, মানে ফোনে গুগুল সার্চ করে কাছাকাছি একটা সেচুয়ান চাইনিস দোকান পাওয়া গেল। বেলা গড়িয়েছে লাঞ্চ শেষ হয়ে যাবে, হুড়োহুড়ি করে রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকলাম, ভেতরটা বেশ ফাঁকা। বাইরেও ছাতার তলায় কিছু বসার ব্যবস্থা আছে। আমরা বাইরেই বসলাম, খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিঠে রোদ্দুরের ওমটাও উপভোগ করা যাবে।

প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে আর বাজারের তাড়াও আছে তাই পরের স্টেপ চটপট মেনু কার্ড নিয়ে অর্ডার দেওয়া। এটা বেশ শক্ত কাজ, বাইরে থেকে আমাদের দেখে যেমন মনে হয় “একই বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু মুসলমান”, আসলে কিন্তু তা নয়। কোনো ব্যাপারেই নয়, খাবার ব্যাপারে তো নয়ই। ও চিংড়ি ভালবাসে আমি খাইনা, আমি স্পেয়ার রিব খেতে ভালবাসি, ও পর্ক খায় না, গৃহযুদ্ধ আপাতত স্তগিত রেখে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে চিকেনই বেছে নেওয়া হলো। হট এন্ড সাওয়ার স্যুপ, চিকেন লোমিন আর সেচুয়ান চিকেন উইথ ব্রকলি।

স্যুপ খেতে খেতে লক্ষ করলাম আমাদের সামনের টেবিলে এক ভদ্রলোক এসে বসলেন, যেহেতু চারপাশে আর কেউ নেই তাই সৌজন্যতার খাতিরে ‘হ্যালো’ বললাম। কোনো প্রতি উত্তর পেলাম না। উনি একটা নিউসপেপার পড়তে ব্যস্ত।

একটু অবাক লাগলো, বিরক্তও হলাম যখন দেখলাম ওয়েট্রেস এসে সামনের লোকটিকে বিনা অর্ডারে এক বোল ব্রাউন রাইস আর এক বাটি স্যুপ দিয়ে গেল।

এ কি রে বাবা আমরা আগে এসে অর্ডার দিয়ে স্যুপ খেয়ে বসে আছি আর ইনি কোথাকার কোন জমিদার এলেন যে আসার সঙ্গে সঙ্গে মেঘ না চাইতে জলের মতো খাবার এসে গেল! তাও যদি প্রিন্স অফ ওয়েলস হত। দেখে তো তেমন কিছু মনে হয়না, না-আঁচড়ানো মাথাভর্তি সাদা কালো চুল, কেমন যেন “রাম গরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানার” মতো মুখ। তার ওপর মুখে বেশ কয়েক দিনের অবিন্যস্ত কাঁচা-পাকা দাড়ি, প্যান্ট-সার্টেরও কোনো চাকচিক্য নেই।

আরো রাগ হোল যে আমরা খাবারের জন্যে হা-পিত্যেশ করে বসে আছি, আর তিনি কিনা মন দিয়ে কাগজই পড়ে যাচ্ছেন, খাবারের দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই, যেমনকার তেমনই পড়ে আছে। যাইহোক আমাদের খাবার এসে যাওয়ায় আর কোনো দিকে নজর না দিয়ে খাবারে মনোনিবেশ করলাম। এখানে এই প্রথম এলাম, খিদের জন্যে হোক বা তাড়ার জন্যেই হোক খাবারটা বেশ ভালো এনজয় করছিলাম।

দৃশ্য বদল হলো। একটি ঝকঝকে কুড়ি-একুশ বছরের মেয়ে এসে বসলো আমাদের সামনের টেবিলে ওই ভদ্রলোকের সামনে। দেখতে সুন্দর আর পোষাক-আসাকেরও বেশ পারিপাট্য। আর ভদ্রলোকের ভোলও একেবারে বদলে গেল। হঠাৎ যেন ওনার সামনে কুইন এলিজাবেথ এসে বসেছেন, একেবারে আহ্লাদে গদগদ। মেয়েটি কিন্তু তাতে খুব গলছে বলে মনে হচ্ছে না। ইতিমধ্যে ওয়েট্রেস এসে গেল, মেয়েটি মেনু কার্ডের এপাতা-ওপাতা খুঁজে কি-কি সব অর্ডার দিলো। ভদ্রলোকের খাবার যেমনকার তেমনি পড়ে আছে। উনি খুব অনুনয় বিনয় করে মেয়েটিকে কিছু বলছেন, কিন্তু মেয়েটি কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না।

আমার খাওয়া মাথায় উঠলো, মুখে খাওয়া ছাড়া চোখ কান পুরোপুরি ওই টেবিলে সমর্পণ করলাম। কে জানে অসমবয়সী প্রেম কি না। বাজার করতে যাওয়া মাথায় উঠলো। বেশ ইন্টারেস্টিং স্টোরি হবে, শেষ না দেখে নড়ছি না।

মেয়েটি ইয়াং, দেখতে স্মার্ট, কিন্তু হাবভাব বেশ রাফ, ভদ্রলোক কিছু বলছেন, মেয়েটি কোনো উত্তরই দিচ্ছে না। একবার সেলফোন, একবার কি রিং নিয়ে খুনসুটি করছে। আবার কখনো বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, অথচ ভদ্রলোক বলেই যাচ্ছেন। প্রেমালাপ হচ্ছে নাকি! এত অনুনয়-বিনয় কিসের?

হঠাৎ মেয়েটি বেশ জোরে আর কেটে-কেটে বলে উঠলো— আই টোল্ড ইউ টাইম এন্ড এগেন, আই ডোন্ট ওয়ান্ট এনিথিং ফ্রম ইউ। পিরিয়ড, ডোন্ট বদার মি এনি মোর।

ভদ্রলোক কি তার ধার ধারে, এখন তার গলার স্বরও একটু উচ্চপর্দায়। আরো কাকুতি মিনতি, আরো অনুনয়। আমারই মায়া লাগছিল ওনাকে দেখে—

—ইউ ডোন্ট নিড, বাট আই লাইক টু গিভ ইউ সামথিং, হোয়াট এবাউট এন আইপ্যাড?

—আই ডোন্ট নিড এনি আইপ্যাড।

—ইউ নিড ফর ইয়োর কলেজ -–

—ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু থিঙ্ক এব্যাউট মাই কলেজ, মাই লাইফ, এনিথিং।

—হোয়াট এবাউট আপগ্রেডিং ইওর সেল ফোন টু আই ফোন সেভেন এস?

—নো। প্লিস ডোন্ট বদার মি। আই ডোন্ট ওয়ান্ট নাথিং ফ্রম ইউ।

নাটক বেশ জমে উঠেছে, আমি আস্তে আস্তে খাচ্ছি যাতে নাটকের শেষ দৃশ্যের আগে আমার খাওয়া না শেষ হয়ে যায়।

এদিকে আমার টেবিলেও গজগজানি আরম্ভ হয়ে গেছে — এভাবে অন্যের ব্যাপারে ইভস ড্রপ করার কি দরকার। এখন আর বাজারের তাড়া নেই, না? ...যত্ত সব মেয়েলি ব্যাপার।”

আমি তখন পিঠে দিয়েছি কুলো, কানে দিয়েছি তুলো, এক্কেবারে নট নড়ন চড়ন, নট কিচ্ছু, দেখি কি হয়।

ইতিমধ্যে মেয়েটির খাবার এসে গেল, বেশ বড় সড় একটা টেক আউট। ওমা এখানে বসে খাবেনা। আমার মনটা দমে গেল।

— ও কে আই হ্যাভ টু গো — বলে মেয়েটি প্যাকেটটি নিয়ে বেরিয়ে গেল।

ভদ্রলোকের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে আমারই খারাপ লাগছিল। মেয়েটির যাওয়ার পথে হতাশ চোখে তাকিয়েছিলো। হঠাৎ দেখি মেয়েটি আবার ফিরে এসে চেয়ারে বসে জিগ্গেস করল—

নেক্সট উইক ইস ফাদার্স ডে। মামী ডাস নট ওয়ান্ট মি টু সি ইউ। নেভার্থলেস, টেল মি, হোয়াট ক্যান আই ব্রিঙ ফর ইউ? সামথিং ইউ নিড?

বিশ্বের প্রশান্তি মুখে নিয়ে ভদ্রলোক মেয়েটির হাত ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

আই ডোন্ট নিড এনিথিং মাই ডিয়ার, ইউ, ইউ আর দা বেস্ট গিফট অফ মাই লাইফ, আই লাভ ইউ!




(পরবাস-৭৩, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮)