শাল-মহুলের গন্ধমাখা সাঁওতালী ভাষা ২০০৩ সালে ৯২ তম সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তপশীলে ১৮ নং স্থানে অন্তর্ভুক্ত হয়। সংবিধান-স্বীকৃত হলেও অন্যান্য ভাষার তুলনায় এই ভাষার সাহিত্যমুল্য সমাজের চোখে মনে হয় যেন বেশ পিছিয়ে রয়েছে। আদিম অধিবাসীদের মুখের ভাষা শিক্ষিত সমাজে সমাদৃত হতে পারে না ̶ এখনো শিক্ষিত পাড়ার আনাচে কানাচে মাঝে-সাঝেই ঘুরে বেড়ায়। যদিও লোকসাহিত্যের গবেষকরা সাঁওতালী সাহিত্য নিয়ে চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের গবেষণা আটকে পড়ে থাকছে স্বনামধন্য কিছু কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্টিকে ঘিরে। পরবাস-৭২-এ বিখ্যাত সাঁওতাল কবি সারিধরমের সহযোগিতায় আমার লেখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিদগ্ধ পাঠকবৃন্দ পরিচিত হয়েছেন। কিন্তু প্রান্তিক প্রতিশ্রুতিমান কিশোর কবিদের লেখা খুব কমই আলোয় উঠে আসে। আমার এবারের রচনা এমনই এক প্রান্তিক কিশোর কবির কয়েকটি কবিতা নিয়ে। এবারও ভাষার আলোচনায় শব্দের ব্যুৎপত্তি ও ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। সাঁওতালী ভাষার বিকাশ আদিম অধিবাসীদের হাত ধরে, যারাও আসলে প্রান্তিক মানুষ। তাই এই ভাষাতাত্ত্বিক ভাবনার যথেষ্ট উপাদান পাওয়া যাচ্ছে প্রান্তিক কবির কবিতাতেও।
কবি পরিচিতিঃ কিশোর সাঁওতাল কবি মনোজীত মুর্মুর জন্ম ৩১. ০৮. ১৯৯৬, বাঁকুড়া জেলার বারিকুল থানার মাজগেড়িয়া-ধীরাডাঙ্গায়। পিতা বীরেন্দ্রনাথ মুর্মুও একজন কবি। গ্রামের স্কুলে মনোজীতের প্রাথমিক শিক্ষা। তিনি শুশুনিয়া উচ্চ বিদ্যালয় (উচ্চমাধ্যমিক) থেকে কলাবিভাগে উত্তীর্ণ হন (২০১৫)। তাঁর ১৭ বছর বয়সের লেখা ৪৫ মিনিটের একটি নাটক 'অকয় বাড়ায়?' (কে জানে?) মঞ্চস্থ হয় নিজের গ্রামেই শারদীয়া দশমীতে দুর্গামণ্ডপে।
মূল কবিতাঃ [১] || মায়া মনে ||
সেতাঃ বেড়া বেরেৎ কাতে,
বেড়া রাকাব সে সামাং কাতে ... ,
তেঁঙ্গো কঅৗঞ খালি,
মেনাঃ তিঞাঃ মায়া ঝালি
আবিনাঃ কাথাং উইহৗ্রা
মনে মনে তিঞ খালিঞ বিচৗরা।
মেনাঃ তিঞা মায়া মনে,
বানু তিঞাঃ নিরমায়া মনে।
চিদা বিন রাগি আঁদিঞা
চিদা বিন বাগি আঁদিঞা
হায়রে চাঁন্দো নওয়া দঃ অকালিখন ...?
জানাম তরাগে খদা আকানা সারাজীবন।
সের্মা রেগে ক তাঁহেন ইপিল
আবিনাঃ জাং বাহাঞ দিপিল।
ভাবানুবাদঃ || মায়াময় ||
সকালবেলা সূর্য ওঠে,
সামনে দাঁড়িয়ে পুবের গোঠে
খুলে পুব দুয়ারের চাবি।
আমার মনে মায়া আছে
নির্দয়তা নেইকো কাছে
শুধু তোমার কথাই ভাবি।
বল আমার কথায় হয়ে রাগী
করছ কেন মোয় বিবাগী?
হায় ভগবান, এই কি বিধিলিপি ছিল?
জন্ম-ক্ষণে খোদাই হল –
জীবন যখন সাঙ্গ হবে
গগন-তারার সঙ্গী হবে
তোমার মাথার অস্থি বয়ে
সাগর-জলে আসব দিয়ে।
মূল-কবিতাঃ [২] || আলিঞ দঃ বার বয়হা ||
আলিঞ দঃ মেনাঃ লিঞ বার বয়হা,
চেত্ হঁ বাং লিঞ খয়া।
মারাং হড়াঃ কাথা লিঞ আঁজমা।
হানা নাওয়া বাং লিঞ জমা।
আলিঞ দঃ মেনাঃ লিঞ বার বয়হা
চেৎ হঁ বাং লিঞ খয়া।
ধুড়ি ধৗরতি রিলিঞ খেলা
বাং লিঞ তাঁহেনা একলা।
ধরম গাড় রিলিঞ তাবের আঃ,
বুদ্ধি দিসৗ লিঞ খজ আঃ।
ভাবানুবাদ: || আমরা দুটি ভাই ||
আমরা দুটি ভাই
কোনো দিন কিছুই নাহি চাই।
গুরুজনের মানব উপদেশ।
আমাদের থাকবে না তো ক্লেশ।
একলা কভু থাকব না।
ওটা-এটা খাব না।
আমরা দুটি ভাই
ধরার ধূলায় খেলব গো;
ঠাকুর-থানে গড়টি করে
বুদ্ধি-দিশা খুঁজব গো।
মূল কবিতা: [৩] || আলিঞ গে সিধু কানু ||
আসেন মে 'সার্জম সাকাম' পটম গিরৗ
আঠারশ পঞ্চান্ন সালেরে ৩০শা জুনরে হাতাওয়াবন কীরৗ।
সির্জও আবন হুল ...
সানাম মানমি কঃ তাঁহেন কানা চুমুল।
এন হঁবন তেঁঙ্গো না থারে থার,
বার জাঙা লাহাকাতে আড়াগাবন সেঁঙেল সার।
আলিঞ দ সিধু- কানু,
অড়ারে দ মিৎ চুপুৎ জমাঃ বানু,
এন হঁ বন সাব আ আঁ-সার, সাব আবন তাড়ওয়ারী ̶
তুঞ কওয়াবন ইংরেজ, মাঃ কওয়াবন বায়রী।
মায়াম লিঁজি কানা যাওদিন,
এম হঁ ক হিজুঃ কানা সারাদিন।
মায়াম লিঁজি রেহঁ, জিইউ চালা রেহঁ,
সুখবন সাঁওয়ারা এনতে রেহঁ।
ভাবানুবাদঃ || আমরা দুজন সিধু কানু ||
আঠারোশ পঞ্চান্ন তিরিশে জুন
নিয়ে যাও শালপাতায় মোড়া নিমন্ত্রণ।
বিদ্রোহ হল শুরু হুল -
বনবাসী জনগণ ভয়েতে আকুল।
বনমাঝে দাঁড়াইনু সবে সারে সার,
ঘরে ঘরে বাড়ন্ত খাবার দাবার।
সাহসে করিয়া ভর বাড়াইয়া জানু।
সদলে এগিয়ে যাই মোরা সিধু-কানু।
ধর ধনু-তির, ধর তরবারি,
আগুনের ফলা ধর তাড়াতাড়ি -
দাও বিঁধে, ফেল কেটে বৈরীসেনা কর শেষ।
সারা দিনমান করব রক্ত-স্নান,
জীবনের পণ-- সুখেরই সন্ধান,
লক্ষ্য মোদের-- দুঃখের অবসান,
চিরতরে হবে স্বাধীন মোদের দেশ।
১. সাহিত্য-ভাবনা
প্রেক্ষাপট ও আলোচনাঃ
[ক. ১] কবির গ্রামেই তাঁর এক আত্মীয় দাদুর বাস। দাদুর তিন ছেলে। বড়টির লেখা-পড়া অল্প। দ্বিতীয়টি বি.এ.। ছোট জন উচ্চমাধ্যমিক পড়তে পড়তে ছেড়ে দিয়েছে। দাদু তাঁর বড় ছেলেকে ভালবাসেন না। কিন্তু ছেলেটির মা-বাবার প্রতি ভক্তি আছে। বাবার দুর্ব্যবহারে ছেলেটি একবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনাকে ভিত্তি করেই কবি তাঁর ১২-১৩ বছর বয়সে এই কবিতাটি লেখেন। জন্মদাতা ছেলেটির প্রতি বিরাগভাজন হয়ে তাকে ত্যাগ করতে চাইছেন তাতেই কিশোরের আক্ষেপ। জীবন সাঙ্গ হলে বড় ছেলেরই কর্তব্য পিতার অন্ত্যেষ্টিতে প্রধান ভূমিকা নেওয়া; যার একটি অঙ্গ হোল কপালের অস্থি বয়ে নিয়ে সাগর জলে সমর্পণ। কবিতার কথক কিশোরই একদিন তা করবে। এই কথা ভেবে পিতা যেন তার প্রতি দুর্ব্যবহার ত্যাগ করে আস্থা রেখে চলেন এবং ছেলেকে 'বিবাগী' না করেন-- কিশোরের অন্তর-মনের এই অনুরোধের সঙ্গে কবির কল্পনা একাত্ম হয়ে গিয়েছে--'চিদা বিন রাগি আঁদিঞা/চিদা বিন বাগি আঁদিঞা'।
[ক. ২] কবি মনোজীতের ভাই সুরোজিৎ১ পাচ বছরের ছোট। ২০১৮-তে মাধ্যমিক দিয়েছে। দুই ভাইয়ে এই আড়ি ̶ তো এই ভাব। এখনও বাড়িতে গেলে দুই ভাই এক থালাতেই ভাত খায়। সুরোজিৎ অন্যের কাছে গম্ভীর থাকে কিন্তু একা একাই হাসে। নিজেদের দুই ভাইয়ের গভীর ভালবাসা এবং আদর্শ জীবনচর্যার বাসনাই ব্যক্ত করেছেন কবি 'আলিঞ দঃ বারবয়হা' কবিতায়। কীভাবে এই 'মধুময় পৃথিবীর ধূলি'-তে হেসে খেলে জীবন কাটাবে; গুরুজনের উপদেশ মতো এবং ঠাকুরের কাছে জীবনে আদর্শপথে চলার প্রেরণা খুঁজবে ̶ এটিই তাদের প্রার্থনা।
'আমরা দুটি ভাই, শিবের গাজন গাই' এই বাংলা ছড়ার আদলে এটি একটি ছড়া-ধর্মী কবিতা ̶ অন্ত্যমিল-যুক্ত। প্রতি চরণে 'আলিঞ' বা 'লিঞ' এর অনুপ্রাস, 'বার বয়হা'-তে ব-এর অনুপ্রাস, 'হানা নাওয়া'-তে ন-এর, 'ধুড়ি ধারতী'-তে ধ-এর অনুপ্রাস ধরা পড়েছে। 'আঁজমা' ও 'জমা' শব্দ দুটিতে অন্ত্যানুপ্রাস ছাড়াও 'যমক' অলঙ্কারের (দুটি প্রায় সমোচ্চারিত শব্দের অর্থপার্থক্য) লক্ষণ পূরণ করেছে।
[ক. ৩] মনোজীত ও সুরোজিৎ দুই ভাই সাঁতাল বিদ্রোহের সময় 'সিধু-কানু' হয়ে জন্মে থাকলে কী করতেন? ২০১৭-র হুল দিবসের দিন কয়েক আগে মনে এই ভাব জাগার ফলেই কবিতাটি রচিত হয়।
ছন্দ-ছাঁদ ও অলঙ্কারঃ [ক. ১] সাঁওতালি সাহিত্যে এখনও ছন্দের তত্ত্ব বা সূত্র তৈরি হয় নি। তবে ১৪ লাইনের এই কবিতায় বাংলা পয়ার ও চতুর্দশ-পদী কবিতার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। অবশ্য কোথাও কোথাও মাত্রা-লাঘব (-হীনতা) ও মাত্রাধিক্য রয়েছে। সাঁওতালী অলঙ্কারশাস্ত্রও রচিত হওয়ার অপেক্ষায়। বাংলামাধ্যমে পড়াশুনার সুবাদে মনোজীতের কবিতায় বাংলা কবিতার অন্ত্যমিলের প্রভাব পড়েছে। এই অন্ত্যানুপ্রাস ছাড়াও কবিতার স্থানে স্থানে আরও অনুপ্রাস রয়েছে -- 'মেনাঃ তিঞা মায়া মনে,/ বানু তিঞাঃ নিরমায়া মনে', 'চিদা বিন রাগি আঁদিঞা/চিদা বিন বাগি আঁদিঞা', ইত্যাদি। [ক. ২] এটি একটি ছড়াধর্মী কবিতা। এর দশটি চরণের প্রতি দুই চরণে অন্ত্যমিল রয়েছে। [ক. ৩] 'আলিঞ গে সিধু কানু' কবিতাটিও চোদ্দ চরণের। তবে প্রতি চরণে অক্ষরসংখ্যার হেরফের রয়েছে (পাঁচ থেকে একুশ)।
১. ভাষাভাবনা:
শব্দার্থঃ
[ক. ১] সেতা = সকাল। বেড়া = সূর্য (তু সং বেলা।)। বেরে কাতে = উঠামাত্র। রাকাপ = সূ্র্য উঠার দিকে অর্থাৎ পূর্বদিকে। সেত্ = দিকে। সামাং কতে = মুখ করে। তেঙো কপৌং = দাঁড়িয়ে আছি। খালি = শুধু। মেনাঃ = আছে। তিঞাঃ = আমার। মায়া (তু সং) = দয়া। মনে (তু বাং) = হৃদয়ে।ঝালি = দয়ালু মন। আমাঃ = তোমার। কাথা = কথা। উইহৗরা = ভাবি। তিঞ = আমি। খালিঞ = খালি + ইঞ। বিচারা = বিচার করা। চিদা = কেন? এম্ (আম)= তুমি। রাগি = রাগী। আদিঞা = ছেড়ে দিলে। হায় রে (তু. বাং.)। চাঁন্দো = ভগবান। নওয়া দ = এটা। অকা = কী। লিখন = লিখন। জানাম = জন্ম। তরাগে = সময়ে। মলং = কপাল। সের্মা রেগে = আকাশেই। ইপিল = তারা। আবিনাঃ = তোমাদের। জাং = অস্থি। বাহা = (ফুল) এখানে কপাল অর্থে। দিপিল = বয়ে নিয়ে যাব।
[ক. ২] বার = দুই। বয়হা = ভাই। চেৎ হঁ = কোনদিনও। বাং = না। মারাং = বড়। হড়া: = মানুষের। কাথা = কথা, গল্প। আঁজমা = শুনব। হানা-নওয়া = ওটা-এটা। ধুড়ি = তু. সং. ধূলি। রিলিং = আমরা দুজন। ধরম = ধর্ম। গাড় = থান = তু. সং.স্থান। তাবের আঃ = প্রণাম করব। বুদ্ধি দিসৗ = বুদ্ধি-দিশা। খজ আঃ = খুঁজব।
শব্দতত্ত্বঃ
সাঁওতালী শব্দ-ভাণ্ডারঃ সাঁওতালী শব্দভাণ্ডারকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায় ̶
(ক) মৌলিক অস্ট্রো-এশীয়- যে শব্দগুলি আমরা সাঁওতালী বলে জানি, সেগুলির সাথে সমগোত্রীয় মুণ্ডা কোল ভিল প্রভৃতি ভাষার কিছু কিছু শব্দও মিশে থাকতে পারে সে গুলি চিহ্নিত করতে হলে আরও গভীর গবেষণার প্রয়োজন। তাই আপাতত 'মৌলিক সাঁওতালী শব্দ'-এর পরিবর্তে সাধারণভাবে 'মৌলিক অস্ট্রো-এশীয়'-নামকরণ করা হোল। এখানে তিনটি কবিতায় যে মৌলিক শব্দ গুলি ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলি হোল:
[ক. ১] সেতাঃ, বেরেত্ কাতে, রাকাব, সেত্, সামাং, কাতে, তেঙো, কঅৗঞ, মেনাঃ, তিঞাঃ, ঝালি, আমাঃ উইহৗরা, তিঞ, চিদা, এম্ (আম) আঁদিঞা, চাঁন্দো, নওয়া দ, অকা, তরাগে, মলং, সের্মা, রেগে, ইপিল, আবিনাঃ, জাং, বাহা, দিপিল।
[ক. ২] বার, বয়হা, চেত্,বাং, মারাং, হড়া:, আঁজমা, হানা-নওয়া, রিলিঞ, তাবের আঃ।
[ক. ৩] আসেনমে, সাকাম, পটম, গিরৗ, আবন, হুল, সানাম, চুমুল, তেঙোনা, লাহা, কাতে, আড়াগাবন্, সেঙেল, আম দ, ইঞ, অড়ারে, জমা, বানু, এন হঁ, সাব মে, তুঞ, মাঃ কম, মায়াম, লিঁজি, রেঁহ, এনতে, সাঁওয়ারা, রেহঁ।
(খ) তৎসমঃ সাঁওতালী ভাষায় বহু আরবী, ফারসী, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষার শব্দ প্রতিবেশী ভাষা বাংলা, হিন্দী, প্রভৃতির প্রভাবে পুনরায় বিকৃত না করে হুবহু ব্যবহৃত হয়। এমন শব্দগুলিকে এই শ্রেণীতে রাখা যায়, মনোজীতের কবিতায় এরকম শব্দগুলি হোল ̶
[ক. ১] খালি < বাং./হি./আ. = শুধু। মনে (<বাং. < সং.মনসি) = হৃদয়ে। মায়া (<সং.) = দয়া। নিরমায়া (উপসর্গ - নির্ - মায়া) = মায়াহীন, নির্দয়। = শুধু। হায় রে (বাং.)। লিখন (সং.) = লেখা। সারাজীবন (<বাং)।
[ক. ২] বুদ্ধি (< স.)। দিশা (< বাং.) < দিক্ (সং.)। ধরম (স্বরভক্তি)< ধর্ম (সং.)। একলা (<বাং.) = একা।
[ক.৩] কীরৗ (<বাং. কিরা/কিরে = শপথ। ইংরেজ (<বাং.)। সুখ (<সং. অকারান্ত (মুক্ত) শব্দগুলি, কিন্তু হি. ও বাং. উচ্চারণে হসন্ত (বদ্ধ) ̶ তৎসম শ্রেণীবিভাগে এই পার্থক্য ধরা হয় না।।
(গ) অর্ধতৎসমঃ আকর ভাষার শব্দ সামান্য ধ্বনিপরিবর্তন করে সাঁওতালীতে ব্যবহার করা হয়েছে এমন শব্দগুলিকে এই শ্রেণীতে রাখা হয়েছে। তিনটি কবিতায় এরূপ নির্বাচিত শব্দগুলি ̶
[ক. ১] বেড়া = সূর্য (তু. সং. বেলা। আ. বাং. - 'বেলা উঠিছে' অর্থাৎ সূর্য উঠেছে)। জানাম < জনম (বাং.) < সং. জন্ম। খদা < বাং. খোদাই < হি./গু./ম. খুদাঈ ।
[ক. ২] ধুড়ি < সং. ধূলি। কাথা < সং. কথা = উপদেশ, গল্প। বিচৗরা < সং. বিচার = বিচার করা। গাড় < সং. গড় = দুর্গ, স্থান। খজ < খোঁজ (বাং.)/খোজ (হি. < আ. )।
[ক. ৩] বায়রী <সং. বৈরী) = শত্রু। যাওদিন < বাং.যতদিন। সার্জম (তু. সং. সর্জ) = শাল। হাতাও < হাত (বাং.) = ধর, নাও। চালা < চলা (বাং.) = থাকা।
(ঘ) তদ্ভবঃ আকর ভাষার একাধিক ধ্বনি পরিবর্তনের মাধ্যমে সাঁওতালীতে গৃহীত হলে সেগুলিকে এই শ্রেণীতে ফেলতে পারি। এই কবিতা গুলিতে তদ্ভব শব্দগুলি হোল --
[ক. ৩] সিরজও < সৃজ্ ধাতু (সং.) = সৃষ্টি বা শুরু করা। মানমি < মানুষ (সং.)। থারে থার < স্তরে স্তরে (বাং.= সং.) = সারিতে। সার (তু. সং. শর)। তাড়ওয়ারি < তরবারি (< সং.)। জিইউ < জীবন (সং.)।
(ঙ) সঙ্কর-শব্দঃ [ক. ১] খালিঞ = আমি শুধু। মনে মনেতিঞ = আমি মনে মনে। [ক. ২] খেল্ <বাং./হি. - আ-বিভক্তি = খেলব। [ক.-৩] সুখবন = আমরা সুখ ... (নিচে সন্ধি দেখুন)
ধ্বনিতত্ত্বঃ
ক) সাঁওতালী সন্ধিঃ
বিশেষ্য ও উত্তম পুরুষের সন্ধিঃ [ক. ১] ক + ইঞ = কঅৗঞ। কাথা + ইঞ = কাথাঞ। বাহা + ইঞ = বাহাঞ।
[ক. ২] মেনাঃ + (আ)লিঞ = মেনালিঞ। কাথা আলিঞ = কাথালিঞ। বাহা + ইঞ = বাহাঞ। কাথা + (আ)লিঞ = কাথালিঞ। মেলা + (আ)লিঞ = মেলালিঞ। দিসৗ = (আ)লিঞ = দিসৗলিঞ। খেল + আ = খেলা।
[ক. ৩] সুখ + আবন = সুখবন (আকার লোপ)।
বিভক্তি ও উত্তম পুরুষের সন্ধিঃ [ক. ২] রে + (আ)লিঞ = রিলিঞ।
অব্যয় ও উত্তম পুরুষের সন্ধি ̶ [ক. ১] খালি + ইঞ = খালিঞ।
বিশেষ্য ও সর্বনামের সন্ধি ̶ [ক. ১]কাথা + ইঞ = কাথাঞ। ক্রিয়া ও বিভক্তির সন্ধি ̶ [ক. ২] মেনাঃ + (আ)লিঞ। আঁজম + আ = আঁজমা। জম + আ = জমা। [৩] তেঙোন + আ = তেঙোনা।
ক্রিয়া ও সর্বনামের সন্ধি ̶ [ক. ১] ক + ইঞ = কঅৗঞ। [ক.-৩] কওয়া + আবন = কওয়াবন।
(খ) স্বর-সংহতি (Vowel Combinations): অন্যান্য ভাষার মতোই সাঁওতালীতেও পরপর একাধিক স্বরধ্বনি সমন্বিত শব্দ বর্তমান। এখানে অর্ধস্বর (semi vowel) অন্তঃস্থ-য়্ (y) ধ্বনিটিও একটি স্বররূপে গ্রাহ্য। হসন্তযুক্ত অন্তস্থ-য়্-তে পূর্ণ-স্বর জোড়া থাকলে একটি অক্ষরকেও দুটি স্বর ধরা হয়েছে।
দ্বিস্বর (Diphthong): অয় – বয়হা [ক. ২]। অয়া ̶- খয়া [ক. ২]। অঅৗ ̶ কঅৗঞ [ক. ১] অও – সির্জও [ক.৩]। আয় – হায় [ক. ১]। আও – হাতাও, যাও [ক. ৩]। উই ̶ উইহৗ্রা [ক. ১]।
ত্রিস্বরঃ (Triphthong): আয়া – মায়া [ক. ১], মায়াম [ক. ৩]। ইউই ̶- জিউই [ক. ৩]।
চতুঃস্বর (Tetraphthong): অও্য়া ̶ নওয়া [ক. ১], কওয়াবন, তাড়ওয়ারী [ক. ৩]। আও্য়া – নাওয়া
[ক. ২], সাঁওয়ারা [ক. ৩]।
উপসংহারঃ
দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত সাঁওতালী ভাষার উদীয়মান কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্টি অন্যান্য ভাষায় অনূদিত ও আলোচিত হলে তুলনামূলক সাহিত্য-চর্চায় এই ভাষার স্থানটিও ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। পিছিয়ে থাকা এক বিপুল সংখ্যক জনজাতির সাহিত্যচর্চার মাধ্যমেই মানুষের 'সাহিত্যসঙ্গ' সার্থকতা লাভ করুক ̶ এই আশাতেই বিভিন্ন ভাষার বিবুধ গবেষককদের প্রতি আহ্বান জানাই, 'শালপাতার নিমন্ত্রণে' ̶ আমাদের এই কিশোর কবির ভাষাতেই ̶ 'আসেন মে সার্জম সাকাম পটম গিরৗ'।
[সঙ্কেতঃ আ. বাং.= আঞ্চলি্ক বাংলা। ইং. = ইংরেজী। ক. = কবিতা। গু. = গুজরাটী। তু. তুলনীয়। ম = মরাঠী। সং. = সংস্কৃত। হি. = হিন্দী। ৗ - চিহ্নটি অ, এ, ও-এর মাঝামাঝি একটি সম্মিলিত স্বর-এর সূচক।]
বিশ্লেষণীঃ
১। মনোজীৎ ও সুরোজিৎ ̶ এই বানানই লেখেন দুই ভাই।
তথ্যসূত্রঃ
১। কবির সঙ্গে সাক্ষাৎকার।
২। বঙ্গীয় শব্দকোষ, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রথম খণ্ড - ১৯৬৬, দ্বিতীয় খণ্ড - ১৯৬৭, সাহিত্য অকাদেমি, নিউদিল্লী
৩। https://www.google.co.in/search?source=hp&q=santali+language&oq=santali+language&gs_l=psy-ab.1.0.0l4.4316.13184.0.22856.16.16.0.0.0.0.496.4146.2-13
৪। https://en.wikipedia.org/wiki/Santali_language
(পরবাস-৭৩, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮)